☼ প্রচেত গুপ্ত ☼
একটু পরে রোদ উঠবে
সাতাশ
‘ও মাটি জননী মাগো, আমি তোর উদরের ধুলো
অপার আঁচলে আজ মুছে নেব ভুল ত্রুটিগুলো।’
এটি একটি কবিতার শেষ দুই লাইন। কবিতার নাম ‘মাটিবতী’। বাংলাদেশের অতি বিখ্যাত কবি আবু হাসান শাহরিয়ার কবিতাটা লিখেছেন। এই লাইন দুটি শেখর গুপ্ত তার একটি লেখার শুরুতে ব্যবহার করেছেন। কবিতার লাইন দিয়ে শুরু করলেও লেখার বিষয় সহজ নয়। লেখার বিষয় জটিল। লেখার বিষয় হল, ‘বাঙালি মধ্যবিত্ত এবং বামপন্থার সংকট।’
আজ সকাল থেকে শেখর লিখতে বসেছে। দমদমের একটা পত্রিকা বেশ কয়েকদিন ধরে লেখা চাইছে। দেব দেব করেও হয়ে উঠছিল না। নানা কারণ ছিল। খানিকটা হাতে সময় নেই, খানিকটা আলিস্যি, খানিকটা লেখার জন্য যে বইগুলো দরকার সেগুলো হাতের কাছে নেই। তবে মূল কারণ অন্য। শেখর হালকা খবর নিয়ে জেনেছে, পত্রিকাটি কোনওরকম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয়। ব্যস এতেই শেখর উৎসাহ হারিয়েছে। রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয়, এমন কোনও পত্রিকায় লেখালিখিতে তার চিরকালের অনীহা। সে যে খুব লেখালিখি করে এমন নয়। কালেভদ্রে একটা-দুটো। আগে তো অন্য কাজের চাপে একেবারেই পারত না। পার্টি ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পর তাও কিছুটা সম্ভব হয়েছে। গত কয়েক বছরে খানকতক প্রবন্ধ লিখেছে। সবই পার্টির সঙ্গে যুক্ত পত্রপত্রিকায়। বিভিন্ন গণসংগঠনের কাগজে। তবে সবসময়েই মনে হত, রাজনীতির ধারকাছ দিয়ে যায় না, এমন পত্রিকায় লেখা অর্থহীন। সে তো গল্প উপন্যাস লিখতে বসেনি যে, যে-কোনও পত্রিকায় লিখবে আর মানুষ পড়বে। সে লিখছে রাজনীতির কথা। তাও আবার নির্দিষ্ট মতাদর্শের কথা। এটা এমন একটা মতাদর্শ যা রসাল ভাষায়, তরল ভঙ্গিতে লেখা সম্ভব নয়। শেখর লিখছেও না। তার পছন্দ নিরস, কঠিন ভঙ্গি। এই ধরনের লেখার জন্য আলাদা পত্রিকা থাকে, আলাদা পাঠক থাকে। সাধারণ পত্রিকায় এসব কথা কে পড়বে? পড়লেই বা কে বুঝবে? বেশিভাগই তো পাতা উলটে যাবে। তার পরেও এক-দুজন পড়তে পারে। সে পড়ার অর্থ কী? পরিশ্রম করে লেখা হল, অথচ কোনও কাজে লাগল না—এতে লাভ কী? এইসব ভেবে সাধারণ পত্রিকায় লেখালেখি থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখে শেখর। এবারও রেখেছিল। দমদম থেকে আসা অনুরোধ পড়েই ছিল। তমসাই জোর করল। দিন তিনেক আগে চেপে ধরল। শুধু চেপে ধরল না, জোরে চেপে ধরল। কথা এক ধরনের বিতর্কের দিকে চলে গেল। পার্টির চলবার পথ কেমন হবে? কাকে সে বেছে নেবে? কোয়ান্টিটি না কোয়ালিটি? আলোচনা যদিও শুরু হয়েছিল সহজ ভঙ্গিতে।
তমসা সেদিন বেশ রাগ রাগ করেই বলেছিল, ‘ওরা এতবার বলছে, তারপরেও লিখছ না কেন? আজও তো ফোন করেছিল। করেছিল না?
শেখর এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বলল, ‘হ্যাঁ করেছিল, কিন্তু লেখা নিয়ে বসবার সময় পাচ্ছি না।’
তমসা বলল, ‘কী এমন কাজ করছ যে তিন মাস ধরে তিনপাতা লেখবার সময় পাচ্ছ না?’
শেখর আত্মরক্ষার কায়দায় খানিকটা আমতা আমতা করেই বলল, ‘আহা, লিখব বললেই তো চট করে লিখতে বসে যাওয়া যায় না তমসা। কী লিখব ভাবতে হয়, তার জন্য প্রস্তুতি নিতে হয়। বই ঘাঁটতে হয়। সময় লাগে। হাতে এখন সেই সময় কোথায়? সবে কনফারেন্সগুলো শেষ হল। এবার তো রিপোর্ট গোছগাছ করতে হচ্ছে। দেখছ না সর্বক্ষণ গাদাখানেক কাগজ নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছি।’
স্বামীর এই উত্তর পছন্দ হল না তমসার। থম মারা গলায় বলল, ‘না লিখলে বলে দাও ওদের। ঝুলিয়ে রেখেছ কেন? হয়তো তোমার লেখার জন্য অপেক্ষা করছে বেচারিরা। তুমি তো আর বিরাট কোনও লেখক নও যে, তোমার লেখা ছাড়া পত্রিকা চলবে না।’
শেখর হেসে ফেলল। বলল, ‘এটাই তো সমস্যা তমসা। ”না” বলতে পারছি না। এটা আমাদের কঙ্কণদার শ্যালকের ম্যাগাজিন। কী যেন নাম ম্যাগাজিনের? আগুনের ঝরণা, না আগুনের নদী, না, না মনে পড়েছে আগুনের স্রোত। দমদম থেকে বের করে। নিজেদের গল্প কবিতা ছাপে। এবার কী শখ হয়েছে, ঠিক করেছে, এখন থেকে পলিটিক্সও ছাপবে। কঙ্কণদাকে বলেছিল, লেখা চাই। যে কারও লেখা নয়, এমন লোকের লেখা চাই যে নিজে অ্যাকটিভলি পলিটিক্স করে। কঙ্কণদা আমাকে ফাঁসিয়েছে। বলেছে, ওরে বাবা, আমি ওসব রাজনীতি টাজনীতিতে নেই। একজনকে চিনি, সে বেটা এসবে আছে। দেখো বাপু তাকে ধরে যদি রাজি করাতে পারো। আমাকে ওরা কঙ্কণদার রেফারেন্সে ফোন করল। আমি বললাম, আমাকে ছেড়ে দাও। ওরা বলল, তা হবে না দাদা। আপনি সময় নিন, কিন্তু লিখতে হবে। আমি বললাম, নিজের ইচ্ছেমতো লিখতে পারব তো? ওরা বলল অবশ্যই। আপনি যা ভালো বুঝবেন। আমি জিগ্যেস করলাম, এই সময় আমার কথা ছাপতে পারবে? আমার রাজনীতি কিন্তু অন্যরকম? ওরা বলল, সব জানি দাদা। কঙ্কণদা সব বলেছে। আমাদের কোনও সমস্যা নেই। আপনি আপনার মতো লিখবেন। আমি বললাম, কতদিন সময় দেবে? ওরা বলল, মাসখানেক নিন।’
শেখর থামলে তমসা বলল, ‘এই তো, তাহলে তো তুমি রাজি হয়েছিলে। এত কথা বলা মানে তো রাজি হওয়া। এবার তাহলে ঝুলিয়ে রাখছ কেন?’
শেখর মুখ নামিয়ে একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলল। বলল, ‘আসলে কী জানো তমসা, তখনও আমি জানতাম না, পরে খবর নিলাম। ম্যাগাজিনটার সঙ্গে রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই। যারা এটা বের করে তারাও যে পলিটিক্যালি মোটিভেটেড এমনটা নয়।’
তমসা দাঁড়িয়ে শাড়ি ভাঁজ করছিল। থমকে বলল, ‘তাতে কী?’
‘না মানে, ওখানে আমি লিখে কী করব?’
তমসা বলল, ‘ওখানেই তো এখন লিখতে হবে।’
শেখর মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে আধশোয়া অবস্থায় কাজ করছিল। এটা তমসার নিয়ম। সে বিছানায় বই, ফাইল, কাগজপত্র ছড়িয়ে কাজ করলে রাগ করে। বাড়িটা পার্টি অফিস নয়। এখানে বিছানা বিছানা। কাজ করতে হলে হয় টেবিল-চেয়ারে, নয় মেঝেতে। শেখর আধশোয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘তমসা, এসব জায়গায় আমাদের মতো লোকদের লিখে কী হবে বলো তো? ক’জন পড়বে? আমি প্রচারের কথা বলছি না, বলছি, যে ক’জন পড়বে তারাও কি বুঝবে? এই পাঠকরা রাজনীতির সঙ্গে যুক্তই নয়। আমার পরিশ্রমটাই মাঠে মারা যাবে। আর তুমি তো জানো তমসা, লিখব ভাবলে, আমি খেটেখুটেই লিখব। ফাঁকি দিতে পারব না।’
তমসা বলল, ‘এটা কী বলছ? এখন তো এসব জায়গাতেই নিজেদের কথা বলবার সময়। যারা সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নয়, তাদের কাছে পৌঁছতে হবে। এই আগুনের স্রোত ম্যাগাজিনের একজন পাঠকও যদি তোমার লেখা ভালোবেসে ফেলে, সেটাই আমাদের লাভ।’
শেখর একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘অত খেটেখুটে তৈরি করা লেখা একজন পড়লেই হবে! এটা তুমি কী বলছ।’
তমসা শক্ত গলায় বলল, ‘ঠিকই বলছি। অনেক কোয়ান্টিটি আমরা দেখেছি, এবার কোয়ালিটি খোঁজবার পালা। মিটিং, মিছিলের লোক কম দেখেছি? লাভ কী হয়েছে?’
শেখর হেসে ফেলল। বলল, ‘তোমার কোয়ালিটির কথাটা ফেলতে পারলাম না তমসা, কিন্তু আমাদের মিটিং মিছিল নিয়ে অ্যাসেসমেন্ট মানতে পারছি না। ভোটে হেরে যাওয়ার পর অনেককেই এসব বলতে শুনেছি। ব্রিগেডে অত বড় মিটিং করে লাভ কী হল? ভোটের আগে বর্ধমান, হাওড়া, যাদবপুরে অত বড় বড় মিছিল করে লাভ কী হল? সেই তো হারতে হল। তুমিও একই কথা বললে তমসা। মিটিং-মিছিলের স্ট্রেংথ দিয়ে সরকার সমর্থনের বিচার হয় না। যদি কেউ বিচার করে থাকে সে ভুল করেছে। সেটা পদ্ধতির ভুল। মিটিং, মিছিলের ভুল নয়। ধরো, সেই সময় মিটিং, মিছিলগুলো যদি ছোট হত, তাহলে কী হত? যা হওয়ার তাই হত। না আমরা ভোটে জিততাম, না আমাদের অ্যাসেসমেন্ট ঠিক হত? অবশ্যই যারা ভুল অ্যাসেসমেন্ট করবার জন্য মুখিয়ে ছিল, তাদের কথা বলছি। তারা সবসময়ই ভুল ভাবত। কারণ তারা ভুল ভাবতে চাইছিল।’
তমসা খানিকটা উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘তুমি কী বলছ, এরকম বিচার হয়নি? শুধু ভোট কেন, একটা সময় ছিল যখন বছরের পর বছর আমরা মিটিংয়ের লোক দেখে খুশি হয়েছি। যত বেশি লোক, তত বেশি খুশি। কত বড় মিটিং, কত বড় মিছিল বলে পিঠ চাপড়ে দিয়েছি নিজেদের। মিটিং, মিছিল যাতে বড় হয় তার জন্য জেলা কমিটিগুলো লোকাল কমিটি, ব্রাঞ্চ কমিটিকে কোটা বেঁধে দিয়েছে। এই ঘটনা তো বছরের পর বছর ঘটেছে। কোয়ান্টিটি আমাদের গ্রাস করেছে। বাইরে যতই আমরা অন্য কথা বলি, ঘরের ভিতর এই কথা তুমি অস্বীকার করতে পারো?’
শেখর এবার পুরো উঠে বসল। শান্ত গলায় বলল, ‘আমি তোমার কথা অস্বীকার করছি না, আবার পুরোটা স্বীকারও করছি না তমসা। পার্টি যখন ক্ষমতায় থাকে তখন নানা ধরনের ভাইসেস তাকে ঘিরে ফেলে। যে-কোনও পার্টির জন্যই একথা সত্য। কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর ক্ষেত্রে এই সত্য অনেক বেশি। দীর্ঘদিন মার খাবার পর ক্ষমতা এক ধরনের মুক্তি। কমিউনিস্টরা যুগযুগান্ত ধরে শুধু মারই খেয়েছে। কখনও মালিকের হাতে মার খেয়েছে, কখনও রাষ্ট্র তাকে মেরেছে। তারপর কোনও কোনও দেশে কেউ কেউ ক্ষমতা পেয়েছে। কেউ ভোটে, কেউ বিপ্লবে, কেউ জোর করে। এই ক্ষমতা পেয়ে মার খাওয়া কমিউনিস্টরা যেন মুক্তির স্বাদ পেয়ে গেল। এই ঘটনায় বিশৃঙ্খল হওয়ার প্রবণতা বেশি হওয়ারই কথা। সেই প্রবণতা আমরা জিনে ক্যারি করছি। আমাদের পার্টির জিনে। আমাদের পার্টির বেলাতেও তাই হয়েছে। অনেকের বিচারবুদ্ধি লোপ পেয়েছিল। নিজেকে যেমন অ্যাসেস করতে পারেনি, পার্টিকেও পারেনি। ভাবতেও পারেনি, কখনও ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হবে। তাই মিটিং, মিছিলের ভিড় দেখে সমর্থনের হিসেব কষত। কিন্তু তার মানে এই নয়, সবার বুদ্ধি লোপ পেয়েছিল তমসা। সবাই ভুল হিসেব কষেছে। আমাদের লিডারশিপের অনেকেই বুঝেছিল, দিন ফুরিয়ে আসছে। নতুন দিনের জন্য তৈরি হতে হবে।’
তমসা বলল, ‘তাহলে মিটিং, মিছিলের ভিড় নিয়ে আমরা এত হইচই করতাম কেন?’
শেখর বলল, ‘ঠিকই করতাম। হইহই করবার মতো জিনিস বলেই করতাম। মিটিং, মিছিল বড় হওয়া মানে আমাদের দাবি, আবেদন মানুষের কাছে বেশি জোরে পৌঁছে দেওয়া। আমরা তা করেছি। পাঁচ-দশজনের মিছিল যতটা জোরে কোনও কথা বলতে পারে, পাঁচ হাজারের মিছিল তার থেকে অনেক বেশি জোরে সে কথা বলতে পারে। মানুষ সে কথা মানতে নাও পারে, কিন্তু ইগনোর করতে পারে না। বছরের পর বছর আমরা এভাবে মানুষের কাছে পৌঁছেছি। বহু ভোটে জয়ী হয়েছি। বহু দাবি জোগাড় করেছি। মানুষকে যতটা সম্ভব রিলিভ দিয়েছি। এতে ভুল কী হয়েছে আমি বুঝতে পারছি না।’
তমসা বলল, ‘আবার সেই কোয়ান্টিটি আর কোয়ালিটির প্রশ্ন। মিছিল, মিটিং-এ কত বাজে লোক ঢুকেছে। সুযোগ নিয়েছে।’
শেখর এবার বিরক্ত হল। বলল, ‘উফ তমসা, আজ তোমার হঠাৎ কী হল বলো তো? বাজে লোক কি শুধু মিটিং, মিছিলে ঢুকেছিল? যেখানে হাজার, দশ হাজার, এক লক্ষ মানুষ ছিল সেখানে? যেখানে তিনজন, পাঁচজন, দশজন সেখানে বাজে লোক ঢোকেনি? বাজে লোক, ভুল লোকের প্রবেশ সংখ্যার ওপর নির্ভর করে না। করেওনি। যাক। সেই জন্যই পার্টিতে তো রেক্টিফিকেশনের চেষ্টা হচ্ছে। তার মানে এই নয়, সুযোগ পেলে আমরা আবার বড় মিটিং, মিছিল করব না। একশোবার করব। তাতে দু-পাঁচটা পুরোনো মন্দ মানুষ এলে আসবে। তবে একজন নতুন ভালো মানুষকে পেলে সেটা হবে বড় অ্যাচিভমেন্ট। কোয়ান্টিটি দিয়ে কোয়ালিটি ধরে আনতে তবে তমসা। কোয়ান্টিটি অস্বীকার করা বোকামি। তা ছাড়া…তা ছাড়া… মিটিং-এ লোক আনো, মিছিলে লোক আনো বলে পার্টিরা কর্মী, সাপোর্টারদের অ্যাকটিভ রাখা হত। এটা তো মিথ্যে নয়।’
তমসা থুতনির নীচে শাড়ি চেপে ধরে ভাঁজ শেষ করল। বলল, ‘আমি কোনওটাই মিথ্যে বলছি না, তবে এটাও বলছি, মিটিং, মিছিলে মানুষের সংখ্যা যখন কম, তখনও সেটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। দাবিটা কী, সেটাই আসল কথা। লোকটা নয়।’
শেখর উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘অবশ্যই। দশটা লোকও যদি ঠিক দাবিতে, ঠিক প্রতিবাদে একসঙ্গে হয়, তার মূল্য আছে। ভুল দাবিতে দশ হাজার মানুষের সমাবেশের থেকে সেই মূল্য অনেক বেশি। তবে দশ হাজার মানুষ একসঙ্গে হয়েছেন বলেই তাকে বাজে লোকের ভিড় বলে ছোট করব, এটাও ঠিক নয়।’
তমসা বলল, ‘তাহলে তুমি লিখতে শুরু করো। সেই লেখা যদি ঠিক তিনজন পাঠকও পড়ে সেটার মূল্য অনেক। অন্তত ভুল তিনশো পাঠকের থেকে তো বটেই।’
শেখর হেসে ফেলল। বলল, ‘তোমার যুক্তির কাছে হার মানছি তমসা। তোমার কথা আমার কাছে একরকম শিক্ষার মতোই হল। আমি অবশ্যিই লিখব।’
তারপরেই শেখর লিখতে বসছে। কবিতার লাইন দিয়ে শুরু করে বেশ ভালো লাগল শেখরের। তরতর করে লেখা এগিয়ে চলল।
‘আমাদের দেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপটটি যদি চালচিত্রের মতো খুলে ধরা যায়, তাহলে দেখা যাবে, তার বড় অংশটাই মধ্যবিত্তের দখলে। কমিউনিস্ট দলগুলি, যারা সব সময় শ্রমিক-কৃষক সর্বহারার নেতৃত্বের কথা বলে, তারাও এখন স্বীকার করে, তাদের পার্টি চালায় মধ্যবিত্ত। এর অর্থ, কমিউনিস্ট পার্টিগুলির শ্রেণিচরিত্রে এখন বড় রদবদল ঘটেছে। মধ্যবিত্তের আধিপত্য দেখা দিয়েছে। শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি এখন মধ্যবিত্তের পার্টি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা কি কমিউনিস্ট আন্দোলনের জন্য দুঃসময়? নাকি এই ছিল ভবিতব্য? মধ্যবিত্তর এই সর্বগ্রাসী দখলদারি বামপন্থার জন্য কতটা সর্বনাশের, সে বিচার করবার আগে দেখা যাক, অতীতে বাঙালি মধ্যবিত্ত বাম আন্দোলনে কতটা অবদান রাখতে পেরেছে…।’
মোবাইল বেজে উঠল। শেষের লেখা থামিয়ে বিরক্তি মুখে ফোন তোলে। কঙ্কণদা।
‘কী হয়েছে কঙ্কণদা?’
‘শেখর, ভালো আছিস?’
শেখর হেসে বলল, ‘ভালো আর থাকতে দিলে কই কঙ্কণদা? ঘাড়ে যা চাপিয়েছ। তোমার শালার জন্য লিখতে হবে না? তারই মকসো করছিলাম।’
ওপাশে কঙ্কণদা একটু চুপ করে থেকে বলে, ‘একটা কথা বলতে হচ্ছে, কিছু মনে করিস না।’
‘আরে বলো, কী হয়েছে? আমতা আমতা করছ কেন?’
‘না, বলতে বাধো বাধো ঠেকছে।’
শেখর হালকাভাবে বলল, ‘আবার লেখার অনুরোধ না হলে অনায়াসে বলতে পারো। আমি কিছু মনে করব না।’
‘আমার শ্যালক তোকে যে লেখাটার জন্য বলেছিল, ওটা ছেড়ে দে।’
শেখর অবাক হয়ে বলল, ‘ছেড়ে দেব মানে!’
কঙ্কণদা বলল, ‘লিখতে হবে না তোকে। ওরা নিজেরা তোকে কথাটা বলতে লজ্জা পাচ্ছে। আমাকে ফোনে ধরল। বলল, তোর লেখা ছাপায় ওদের সমস্যা হবে। যে লোক পত্রিকা ছাপার টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করে, সে নাকি আপত্তি করেছে। বলেছে, তোদের পলিটিক্সের কথা ছাপা হলে সে আর থাকবে না। বুঝতেই তো পারছিস, ছোট পত্রিকা…আমার খুব খারাপ লাগছে। আই অ্যাম সরি শেখর।’
শেখর আবার হেসে বলল, ‘দুর, সরির কী আছে? কথাটা তো সত্যি। বেচারিরা এখন আমাদের লেখা ছেপে বিপদে পড়বে নাকি? থাক ও সব। তুমি আছ কেমন বলো?’
দু-একটা কথার পর ‘কঙ্কণদা’ ফোন ছাড়লে শেখর গুপ্ত আবার উপুড় হয়ে শুয়ে লিখতে শুরু করল। এই লেখা কে পড়বে সেটা বড় কথা নয়, লিখতে হবে এটাই আসল কথা।