» » তৃতীয় কিস্তি

বর্ণাকার

প্রচেত গুপ্ত

একটু পরে রোদ উঠবে

চব্বিশ

মরি লো মরি আমায় বাঁশিতে ডেকেছে কে

ভেবেছিলাম ঘরে রব কোথাও যাব না—

ওই যে বাহিরে বাজিল বাঁশি, বলো কী করি॥

শুনেছি কোন কুঞ্জবনে যমুনাতীরে

সাঁঝের বেলা বাজে বাঁশি ধীর সমীরে

ওগো তোরা জানিস যদি আমায় পথ বলে দে॥

দেখি গে তার মুখের হাসি,

তারে ফুলের মালা পরিয়ে আসি,

তারে বলে আমি তোমার বাঁশি

আমার প্রাণে বেজেছে॥

বাঁশিতে রবিঠাকুরের এই গান পুরোটা বাজানোর পর বংশীবাদক এখন খাটের ওপর বাবু হয়ে বসে লুচি-আলুরদম খাচ্ছে। পাশে রসগোল্লার রসভর্তি ছোট একটা বাটি। মেঘবতী প্রথমে বাটিতে দুটো রসগোল্লা দিয়েছিল। বংশীবাদক বলেছে, ‘মা, রসগোল্লা নিয়ে যাও, শুধু রসটা থাক। শেষ পাতে চুমুক দিতে খাব।’

‘সে কী! আপনি শুধু রস খাবেন! একটা মিষ্টি অন্তত নিন।’

বংশীবাদক হেসে বলল, ‘রসের থেকে বেশি মিষ্টি আর কী আছে মা? রসই তো মিষ্টির প্রাণ। তুমি আমাকে শুধু রসই দাও। আমি ভিখিরি মানুষ, রসেই আমি খুশি।’

মেঘবতী কথা বাড়ায়নি, বাটি থেকে রসগোল্লা সরিয়ে নিয়েছে। আসলে মেঘবতী চিন্তিত। এই লোক বাঁশি ভালো বাজালেও ঝামেলা করবে বলে মনে হচ্ছে। কাকভোরে বাঁশি বাজিয়েছে। ঘুম ভেঙে গেছে। একদিন-আধদিন বাঁশির সুরে ঘুম ভাঙলে ভালো লাগে। রোজ হলে মুশকিল। সুন্দর ভাব নষ্ট হয়ে যায়। এটাই স্বাভাবিক। মেঘবতীর এক বন্ধু গড়িয়ার কাছে থাকে। একটু ভিতর দিকে। ওদিকটায় এখনও কিছু কিছু পুকুর-দীঘি, গাছপালা রয়েছে। পাখিও আছে। পাখিরা সারাদিনই ডাকাডাকি করে। শুনতে ভালোই লাগে। হঠাৎই একটা কোকিল খুব ঝামেলা শুরু করল। রাত একটা-দুটোতে ‘কুহু কুহু’ শুরু করল। এক-আধবার ডাক নয়। একটানা ডাক। নিঃশব্দ গভীর রাতে সেই ডাক তীক্ষ্ণ হয়ে ঘুম ভাঙিয়ে দিল। প্রথম দিন কোনওরকমে মেনে নেওয়া গেল, কিন্তু পরদিনও যখন এক কাণ্ড, তখন অসহ্য মনে হল। ইচ্ছে করল, গিয়ে কোকিলের গালে ঠাঁটিয়ে দুটো চড় লাগাই। মাঝরাত কুহু শোনানোর সময়? ইয়ার্কি হচ্ছে। কোকিলের কুহু কুহু ডাক যতই মিষ্টি হোক, রাত একটা-দুটোয় সেই ডাক ভয়াবহ। কাকের কা কা-এর থেকেও কর্কশ। মেঘবতীর বন্ধু জানলা আটকে সেই ডাক ঠেকাতে গেল। পারল না। কানে বালিশ চাপা দিল। তাতেও লাভ হল না। বাধ্য হয়ে জেগে বসে থাকতে হল গোটা রাত। এরকম প্রায় টানা সপ্তাহখানেক চলেছে। শেষের দিকে সারাদিন ধরে টেনশন হত। আজ রাতে কোকিলের ডাকে ঘুম ভাঙবে না তো? কোকিল-ফোবিয়া। বন্ধুদের একথা বলতে গিয়ে ঠাট্টা শুনতে হয়েছে। কোকিলের ডাক আবার খারাপ লাগে নাকি! নিশ্চয় মেয়েটা বানিয়ে বলছে। তাছাড়া, কোকিল মাঝরাতে ডাকবে কেন? সে ডাকবে সকালে আর বিকেলে। সঙ্গীকে ডাকবে। মন ভালো করে দেবে। এই কোকিলের নিশ্চয় মাথায় গোলমাল হয়েছে। মেঘবতীর সেই বন্ধুকে কেউ ঠাট্টা করে বলল, ‘তুই বরং ওকে সাইকায়াট্রিস্ট দেখা।’ কেউ বলল, ‘তুইও জানলা খুলে কোকিলকে পালটা গান শোনা। এক হাতে কান চেপে গলা খুলে গান ধরবি। কোয়েলিয়া গান থামা এবার, তোর এই কুহুতান ভালো লাগে না আমার…। দেখবি পাখি ঘাবড়ে গিয়ে উড়ে গেছে।’

ঠাট্টা হোক, আর যাই হোক, কোকিলের মিষ্টি ডাকও অসময়ে অত্যাচারের মতো লাগে। বাঁশিও তাই হবে। আশপাশের বাড়ি থেকে অবজেকশন দেবে। এই জন্য মেঘবতী চিন্তিত। তবে তার থেকে অনেক বেশি চিন্তা হচ্ছে জ্যোতিষ্ককে নিয়ে। সে বংশীবাদককে পেয়ে কেমন যেন গলে মতো পড়ছে। তার মুগ্ধভাবে বাড়াবাড়ির লক্ষণ। বলছে, সেরকম বুঝলে নাকি বাঁশিওয়ালার সঙ্গে ঘর ছাড়বে। প্রথমে মনে হয়েছিল, রসিকতা করে বলছে। তার স্বামীর রসবোধ আছে। কিন্তু পরে মনে হয়েছে, রসিকতা নয়, কথাটার মধ্যে কোথাও এক ধরনের সত্যি সত্যি ভাব আছে। তবে ভয় আরও বাড়িয়ে দিয়েছে গুপির মা।

‘এইসব মানুষকে ঘরবাড়িতে রাখা ভালো নয় বউদি।’

মেঘবতী ভুরু কুঁচকে বলেছিল, ‘ভালো নয়? কেন? কী হয়েছে?’

গুপির মা ঘর ঝাঁট দিচ্ছিল। সেই কাজ বন্ধ না করে সহজ ভঙ্গিতে বলল, ‘সবের কি কারণ থাকে বউদি? দুনিয়া দুই রকম জিনিসে ঠাসা। তার কিছু জিনিস ভালা, কিছু জিনিস ভালা নয়। বুঝেসুঝে চলতে হয়। এইটা যেমন ভালা নয়।’

মেঘবতী বলল, ‘কী সুন্দর বাঁশি বাজায়, তার পরেও তুমি এসব বলছ গুপির মা?’

‘এমনি এমনি বলছি না বউদি। এই মানুষ ঘরবাড়ির মানুষ নয়, এই মানুষ হল পথের মানুষ। ঘরের মানুষকে যদি পথে রাখেন, সে যাবে নষ্ট হয়ে। তেমন পথের মানুষকে ঘরে রাখলেও এক ঘটনা। সে নষ্ট হবে।’

মেঘবতীর মনে মনে খুঁতখুঁতানি হচ্ছিলই। গুপির মায়ের কাছ থেকে আরও কথা শুনতে চাইল।

‘আমরা কি জোর করে ধরে রেখেছি। তার ইচ্ছে হয়েছে তাই আছে। ইচ্ছে না হলে থাকবে না। অমন একটা ধেড়ে লোককে আমরা নষ্ট করবার কে?’

গুপির মা এই বাড়িতে সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত থাকে। তবে কাজে ফাঁকি দিতে ওস্তাদ। গোটা ঘরে হয়তো ঝাঁটা বুলিয়ে চলে গেল, ধুলো পড়ে থাকল আগের মতো। টেবিল মুছল ঠিকই, কিন্তু হলুদের দাগ রয়ে গেল এক কোণায়। ভেজানো কাপড়-জামার আদ্দেকটা কাচল, আদ্দেকটা ফেলে রাখল পরের দিনের জন্য। মেঘবতীকে কঠিন নজর রাখতে হয়। এই আলোচনার সময় কঠিন নজর রাখতে পারল না। গুপির মা দার্শনিক প্রসঙ্গ তুলে তাকে অন্যমনস্ক করে ফেলেছে। টেবিল-চেয়ারের তলা পর্যন্ত তার ঝাঁটা পৌঁছল না।

‘অতসব জানি না বউদি। তবে এটুকু জানি, এসব মানুষ ঘরে থাকলে নিজে নষ্ট হয়, সংসারের ক্ষতি করে।’

মেঘবতী চোখ বড় করে বলল, ‘কী ধরনের ক্ষতি করে?’

এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে গুপির মা গলা নামিয়ে বলল, ‘দাদাকে বুড়োটার কাছে অত ঘুরঘুর করতে দেবে না বউদি। এরা ভালোমানুষ বশ করতে পারে। ভিখিরি ফকির মানুষ, মন্ত্র-টন্ত্র, ঝাঁড়ফুক জানে।’

মেঘবতী নড়েচড়ে বসল। সে এসব কুসংস্কারে মোটে বিশ্বাস করে না। বিজ্ঞানের ছাত্রী ছিল। বাপেরবাড়ি, শ্বশুরবাড়ি কোথাও তাবিজ-মাদুলির ব্যাপার নেই। কিন্তু এখন নিজেকে কেমন দুর্বল লাগছে। ঘটনা সত্যি নয়তো? জগতে কত কিছুই তো থাকে। সব কি যুক্তি বিজ্ঞান দিয়ে বিচার করা যায়?

গুপির মা চিন্তিত মুখে বলল, ‘কে জানে, ওই লোক এতক্ষণে দাদাবাবুকে বশটশ কিছু করে বসেছে কিনা। যেভাবে এ বাড়িতে জাঁকিয়ে বসেছে, তাতে তো মনে হচ্ছে, একটা কিছু ঘটেছে! নইলে পথের ভিখিরি নোংরা জামাকাপড় পরে খাটে বসে লুচি খায়?’

মেঘবতী মন শক্ত করল। বলল, ‘বাজে কথা বোলো না। লোকটার গুণ দেখনি? কেমন সুন্দর বাঁশি বাজায়। এরা হল শিল্পী মানুষ। এদের তোয়াজ করতে হয়। তাছাড়া তোমার দাদাবাবু ছেলেমানুষ নয়। তুমি থামো দেখি। ওই লোক তো পাকাপাকি এখানে থাকতে আসেনি, কাল-পরশুই চলে যাবে। তার নিজের দেশের বাড়ি নেই নাকি?’

গুপির মা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘কিছু না হলেই ভালো। তবে যতক্ষণ না ওই বুড়ো বাড়ি থেকে যায়, সাবধানে থাকবে বউদি।’

মেঘবতী এতে আরও ঘাবড়ে গেল। গুপির মা এসব বলছে কেন? ভয় দেখাচ্ছে? কীসের ভয়? সে তো জানে না, জ্যোতিষ্ক এই লোকের সঙ্গে ঘর ছাড়বে বলে প্ল্যান করছে। তাহলে? বোনকে ফোন করে দুশ্চিন্তার কথা জানাতে গেল মেঘবতী। বারিধারা ঠাট্টা করে উড়িয়ে দিয়েছে। বংশীবাদককে খাবার দিয়ে ওপরে চলে এসেছে। তার কান্না পাচ্ছে। খানিকটা কেঁদে নিলে কি টেনশন কমবে? একটাই নিশ্চিন্তি, তার কান্না পাচ্ছে মানে ঘটনা সিরিয়াস নয়। কেস হিস্ট্রি বলছে, সিরিয়াস ঘটনায় তার কখনও কান্না পায় না। যতসব ছোটখাটো গুরত্বহীন বিষয়েই তার চোখে  জল আসে।

নীচের গেস্টরুমে তখন অন্য দৃশ্য।

জ্যোতিষ্ক চেয়ার টেনে খাটের পাশে বসে আছে। এতক্ষণ সে আপ্লুত হয়ে বাঁশি শুনছিল, এখন মুগ্ধ হয়ে বংশীবাদকের খাওয়া দেখছে।

একটু আগে বাঁশিতে যে গান বংশীবাদক বাজিয়ে শোনাল, সেটা যে প্রায়ই শোনা যায় এমন নয়। ‘মরি লো মরি আমায় বাঁশিতে ডেকেছে’ এ গানটা জ্যোতিষ্ক আগে শুনেছে কিনা, মনে করতে পারল না। গানের কথাও তার জানা নেই। বংশীবাদক বোধহয় বুঝতে পেরেছিল। বাঁশিতে ফুঁ দেওয়ার আগে তার ঝোলা থেকে একটা জীর্ণ খাতা বের করে। গেরুয়া কাগজ দিয়ে মলাট দেওয়া। জ্যোতিষ্কের দিকে এগিয়ে বলল, ‘নিন, ষোল নম্বর পাতাটা খুলুন।’ খাতা হাতে নিয়ে জ্যোতিষ্ক বলল, ‘কী আছে?’

‘আমি যে গানটা এখন বাজাব, সেটা আছে। আপনার চোখের সামনে কথাগুলো থাকলে শুনতে ভালো লাগবে।’

জ্যোতিষ্ক হেসে বলল, ‘থাক, আমার কথা লাগবে না, আপনার বাঁশিই সুন্দর।’

বংশীবাদক বলল, ‘যে সুরে কথা আছে সেখানে কথাও সুন্দর। তাছাড়া এই গানটা রবি ঠাকুরের। তার গানের কথা না শুনলে সুর অসম্পূর্ণ থাকে। এই কারণেই তো আমি ওঁর গান বিশেষ বাজাতে চাই না। শুধু সুর দিয়ে কথার আনন্দ, যন্ত্রণা, গভীরতা আর কতটা ফুটিয়ে তোলা যায় বলুন। কেউ হয়তো পারেন, আমি তাদের মতো গুণী নই। নিন, গানটা বের করুন।’

বংশীবাদক লুচি খাওয়া শেষ করে রসের বাটিতে ছোট একটা চুমুক দিল।

জ্যোতিষ্ক বলল, ‘আপনি বাঁশি কোথা থেকে শিখেছেন?’

‘মাঠেখাটে। ওই যে বললাম, পেটের তাগিদে বাঁশি বানাতাম। তখনই শিখতে হয়েছে। নিজে না জানলে যে ভালো জিনিস বানানোই যাবে না। খানিকটা নিজে শিখেছি, খানিকটা একে ওকে ধরে শিখেছি।’

জ্যোতিষ্ক উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘বাঁশি কীভাবে বানাতে হয়?’

বংশীবাদক সামান্য হেসে বলল, কতরকম বাঁশি আছে, একেকটা একেকরকম ভাবে বানাতে হয়।’

জ্যোতিষ্কর এই বিষয়টাও জানা ছিল না। অনেকরকম বাঁশি আছে! সে জানত, বাঁশি একরকমই। মোটাসোটা, গোলগাল। ফুঁ দিয়ে বাজাতে হয়। বড়রা পাশ থেকে ফুঁ দেয়। কমবয়সিরা সামনে থেকে ফুঁ দেয়। হারমোনিয়ামের রিডের মতো ফুটো খুলে বন্ধ করে সুর বের করতে হয়। সে বিস্ময়ের সঙ্গে বলে, ‘বাঁশি অনেকরকম হয় বুঝি!’

বংশীবাদক বলল, ‘অবশ্যই অনেকরকম। আড় বাঁশি, কদ বাঁশি, সরল বাঁশি, হরিণা বাঁশি, টিপরা বাঁশি, লয়া বাঁশি, মুখ বাঁশি, ভুয়াং বাঁশি, মোহন বাঁশি। হরিণ বাঁশি নামটা সুন্দর নয়? অতি সুন্দর। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তৈরি করতে হয়। প্রায় নয় থেকে দশ ইঞ্চির মতো লম্বা হয়। নীচ পর্যন্ত দুভাগে ভাগ করা থাকে। ফুটোর কোনও বলাই নেই। এতে ফুঁ দিলে হরিণ শাবকের ডাকের মতো এক ধরনের আওয়াজ হয়। হরিণ শিকারের কৌশল হিসেবে একসময় এই বাঁশি ব্যবহার হত। এখন তো সে পাট চুকে গেছে। তবে এখনও বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলায় এই বাঁশি পাওয়া যায়।’

জ্যোতিষ্ক অস্ফুটে বলল, ‘ইন্টারেস্টিং। আপনি কি এই বাঁশি বানাতে পারেন?’

বংশীবাদক রসের বাটিতে আর একটা চুমুক দিয়ে বলল, ‘না, পারি না। তবে এরকম সুন্দর বাঁশি আরও আছে। যেমন ধরুন পাতা বাঁশি। তালপাতা দিয়ে এই বাঁশি বানাতে হয়। গ্রামের দিকের ছেলেপিলেরা বাজায়। একটা পাতা দু’ভাঁজ করে করে কলম কাঁটার মতো করে আগাটা একটু কেটে নিতে হয়। পরের পাতাকে কেন্দ্র করে পাতা জড়াতে জড়াতে আস্তে আস্তে বন্ধ করতে হয়। ওই ছোট মুখে ফুঁ দিলেই বাঁশি বেজে ওঠে। তবে পাতা বাঁশি দিয়ে নিখুঁত বা মধুর সুর তৈরি করা সম্ভব নয়।’

কথা শেষ করে খাট থেকে নেমে পড়ল বংশীবাদক।

‘যাই, হাতটা ধুয়ে আসি। স্যর, আপনি বরং একটা কাজ করুন। আমার ঝোলাটার মধ্যে একটা বই আছে। বাঁশি বিষয়ক বই। বইটা নিন। পড়ে দেখুন।’

জ্যোতিষ্কও উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘অবশ্যই পড়ব। কিন্তু আপনি এখনও আমাকে স্যর বলছেন কেন? আমি তো আপনাকে বলেছি…’

বংশীবাদক হাত তুলে থামিয়ে বলল, ‘আমি জানি, ওইসব প্রথাগত সম্বোধনে আপনি আগ্রহী নন। প্রথম দিনই বুঝেছিলাম। যেদিন আপনার সঙ্গে ভবানীপুরের চায়ের দোকানে আলাপ হয়েছিল, সেদিনই আপনাকে চিনেছি। তবু আপনি কত বড় সরকারি অফিসার! পদের মর্যাদা বলে তো একটা ব্যাপার আছে।’

জ্যোতিষ্ক বলল, ‘বাড়িতে আবার পদ কী? না না, দয়া করে আপনি আমাকে আর স্যর ডেকে বিড়ম্বনায় ফেলবেন না। এটাই আমার অনুরোধ।’

বংশীবাদক হাসতে হাসতে বলল, ‘আচ্ছা, সে দেখা যাবে’খন। আপনি আগে বইটা উলটে পালটে দেখুন। আপনার বাঁশি সম্পর্কে আগ্রহ আমাকে মুগ্ধ করেছে।’

জ্যোতিষ্ক এবার ঝট করে বলে ফেলল, ‘আচ্ছা, আমি বাঁশি শিখতে পারি না?’

বংশীবাদক দরজার কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়াল।

‘কেন পারবেন না? অবশ্যই পারবেন।’

জ্যোতিষ্ক লজ্জা পাওয়া মুখে বলল, ‘আসলে বয়স হয়ে গেছে তো। এই বয়সে নতুন করে কিছু শেখা…।’

‘বাঁশি বাজানো তো ফুটবল খেলা নয় স্যর। বয়স হলে দৌড়তে পারবেন না সেই সমস্যা নেই।’

জ্যোতিষ্ক নিজের ঘরে গিয়ে খবরের কাগজের মলাট দেওয়া বই খুলল। বইটি তাঁতঘর নামে এক পতিতার বাঁশি বিষয়ক সংকলন। খুবই আশ্চর্য লাগছে, ভিখিরি মানুষটা শুধু বাঁশি বাজাতে পারে না, পড়াশোনাও করে। বইয়ের একটা পাতায় চোখ পড়ল। লেখা আছে—বাঁশির সবথেকে বড় পরিচয় হল তার অন্তরটি অন্তঃসারশূন্য। যার অর্থ, সে অহমিকাহীন। কামনা-বাসনায় শূন্যতার বৈভবে সে রসময়। যে একটি বিশুদ্ধ পাত্র বা আধার। বাঁশি শূন্য, তাই সে পূর্ণ হয়ে যায় রসিকজনের প্রসন্ন শব্দময় ধ্বনিতে।

জ্যোতিষ্ক অস্ফুটে বলল, ‘আহা!’

জ্যোতিষ্কর এই ‘আহা!’ উচ্চারণের কিছুক্ষণের মধ্যে এ বাড়িতে একটা ঘটনা ঘটল।

তখন জ্যোতিষ্ক অফিসে। মেঘবতীও বাইরে। বংশীবাদকের জন্য জামাকাপড় কিনতে বেরিয়েছে। নোংরা পোশাকে তাকে বেশিক্ষণ বাড়িতে অ্যালাও করা যাচ্ছে না। সেই কারণেই খুব বিরক্তির সঙ্গে গড়িয়াহাটে গেছে। পায়জামা, পাঞ্জাবি কিনবে। ঘণ্টাখানেক পরে বাড়ি ফিরে মেঘবতী দেখে, গোটা বাড়ি লণ্ডভণ্ড। বেডরুমের আলমারি ভাঙা। কাপড়জামা, টাকা পয়সা, গয়নাগাঁটি কিচ্ছু নেই। এরও মিনিট পনেরো বাদে গোঁ গোঁ আওয়াজ শুনে একতলার রান্নাঘরে গুপির মাকে পাওয়া গেল। তার হাত পা এবং মুখ বাঁধা। বাঁধার কাজ করা হয়েছে তারই শাড়ি খুলে নিয়ে। তার পরনে শুধু ব্লাউজ আর সায়া।

গেস্টরুমে বংশীবাদক নেই। তার ঝোলা নেই। বিছানার ওপর একটা বাঁশি পড়ে আছে শুধু।