☼ প্রচেত গুপ্ত ☼
একটু পরে রোদ উঠবে
বাইশ
বিমলকান্তি সেন একতলার ঘরে বসে আছেন। সামনে, টেবিলের ওপর অফিসের কাগজপত্র ছড়ানো। তিনি সেদিকে তাকাচ্ছেন না।
বিমলকান্তির মতো সিরিয়াস মানুষকে এ ধরনের আচরণে দেখা যায় না। তিনি কাজ সামনে নিয়ে বসে থাকায় বিশ্বাস করেন না। হয় কাজ করেন, নয় কাজ সরিয়ে রাখেন। যদি কখনও মনে করেন, এখন খাতায়-কলমে কাজ নয়, কাজ হবে মাথার ভিতরে, তাহলে তাই হবে। তিনি আর পাঁচটা বিষয়ের মতো ভাবনাকেও সিরিয়াসভাবে দেখেন। তিনি মনে করেন, যদি ভাবার দরকার হয়, তাহলে মন দিয়ে ভাবা উচিত। অনেকেই একটা কাজ করতে করতে অন্য কিছু নিয়ে ভাবে। অনেকটা প্যারালাল থিঙ্কিং-এর মতো। একটার সঙ্গে একটা কাজ করার অর্থ, কোনওটাতেই উপযুক্ত গুরত্ব না দেওয়া। বিমলকান্তি মনে করেন, এটা ঠিক নয়।
আজ তার নিজের কী হল?
খানিক আগে গেট থেকে ভীম ইন্টারকমে ফোন করেছিল। একজন দেখা করতে চায়। বিমলকান্তি বিরক্ত হয়েছিলেন। চিন্তায় ছেদ পড়েছিল বলে বিরক্ত।
‘আজ তো বুধবার নয় ভীম! তুমি জানো না, আমি শুধু বুধবার ভিজিটর মিট করি? নাকি দিনটা ভুলে গেছ?’
ভীম নীচু গলায় বলল, ‘স্যার, একজন মেয়েমানুষ এসেছে।’
বিমলকান্তি আরও বিরক্ত হলেন। তার পরেও শান্ত গলায় বললেন, ‘মেয়েমানুষ আর পুরুষমানুষের জন্য কি দেখা করবার দিন আলাদা হয়েছে? কই, আমি তো জানতাম না!’
ভীম আমতা আমতা করে বলে, ‘না, মানে… বলেছে অনেক দূর থেকে এসেছে। ফুলিয়া না কৃষ্ণনগর।’
বিমলকান্তি আর গলা শান্ত রাখতে পারলেন না। কঠিন গলায় বলেন, ‘ফুলিয়া, কৃষ্ণনগর কেন? দিল্লি, মুম্বই থেকে এলেও আজ আমি কারও সঙ্গে দেখা করব না।’
‘স্যার, আমি বলেছি। তার পরেও বলছে জরুরি দরকার।’
বিমলকান্তি ঝাঁঝ নিয়ে বললেন, ‘মুখের ওপর কথা বলছ কেন? ওর দরকার থাকতে পারে, আমার দরকার নেই। চলে যেতে বলো।’
ভীম ইন্টারকাম কেটে দেয়। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সাধারণ এবং বিধ্বস্ত চেহারার মহিলাটিকে ধমক দেয়। মহিলা কিছু বলার চেষ্টা করে। এবার ভীম তাকে হাত নেড়ে তাড়ায়। সে এই মহিলার ওপর রেগে গেছে। এর জন্যই স্যারের কাছ থেকে বকুনি খেতে হল। হতাশভাবে মহিলাটি ফুটপাথ বদল করে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আবার ভীমের ইন্টারকম বেজে ওঠে। ‘স্যার’-এর নম্বর। ভীম দ্রুত রিসিভার তোলে।
‘স্যার।’
বিমলকান্তি চাপা গলায় বললেন, ‘ভীম, সেদিনও তুমি একই অন্যায় করেছ। প্রহ্লাদ নামে আমার অফিসের একজন স্টাফকে আমার কাছে নিয়ে এসেছিলে। সেদিন দেখা করবার দিন ছিল না, তার পরেও এনেছিলে। আজ আবার সেই অন্যায় করতে যাচ্ছিলে।’
ভীম থতমত গলায় বলল, ‘আর হবে না স্যার। আমি বুঝতে পারিনি।’
বিমলকান্তি বললেন, ‘বাড়ির গার্ড যদি নিয়ম বুঝতে না পারে, তাহলে সেটা চিন্তার। গোটা বাড়ির সিকিউরিটি সিস্টেম নড়বড়ে হয়ে যায়। আমার মনে হয়, বাড়ির সিস্টেম নড়বড়ে হওয়ার আগেই কথাবার্তা বলে আমাদের একটা ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। মনে হচ্ছে, কাজটা তুমি আর সিরিয়াসভাবে নিতে পারছ না। সে ক্ষেত্রে আমরা অন্যভাবে ভাবতে পারি।’
ভীম এবার কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘আর হবে না স্যার।’
বিমলকান্তি একটু চুপ করে থাকলেন। বললেন, ‘আর একটা কথা ভীম। মহিলাদের মেয়েমানুষ বলাটা ঠিক নয়। এই কাজ তুমি আর কখনও করবে না।’
‘আচ্ছা, স্যার, আর হবে না।’
বিমলকান্তি ইন্টারকম নামিয়ে আবার চিন্তায় ডুবে গেলেন। তাঁর চিন্তিত হওয়ার কারণ অনেকগুলো। এই যে তিনি মাঝে মাঝেই আরেকজন মানুষ হয়ে যাচ্ছেন, সেই মানুষটার মতো করে দুনিয়াটাকে দেখছেন, সামনের মানুষটাকে চিনছেন এটা যে এক ধরনের মানসিক অসুস্থতা, এতে আর কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু অসুস্থতা কতটা জটিল? অসুখটা কি শেষ পর্যন্ত ভায়োলেন্সের দিকে যাবে? অনেক মানসিক অসুস্থতাই মারধর, ভাঙচুরের দিকে ঘুরে যায়। তার এক খুড়তুতো ভাইয়ের এইরকম হয়েছিল। এমনিতে শান্ত স্বভাব। কিন্তু একটা সময়ের পর যাকে কাছে পেত কামড়ে দিতে চাইত। তাকেও তেড়ে এসেছে। সত্যি কথা বলতে কী, এই কারণে ডাক্তারের কাছে যেতে ভয়ও করেছে। ডাক্তার যদি ভয়ের কিছু খুঁজে পায়। জীবনে নানা ধরনের জটিলতা, সমস্যা সাহসের সঙ্গে দেখেছেন। নিজের মানসিক সমস্যার ব্যাপারে সাহস দেখানো কঠিন। দ্বিতীয় চিন্তার কারণ হল, বাবা। বাবা কি সত্যি নিখিলেশ উপাধ্যায়কে অফিসে পাহারাদার হিসেবে রেখেছেন? তিনি সুযোগ বুঝে ‘কোপ’ মারবার কথা ভাবছেন। সেই ‘কোপ’ কী? সেন অ্যাসোসিয়েটসের কোনও ক্ষতি করতে চাইছেন? এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? উপাধ্যায়বাবু সর্বক্ষণ কোম্পানির ভালো করবার চেষ্টা করেন। এমনকী এবারও করেছেন। অত বড় একটা অর্ডার যাতে হাত ফসকে না যায়, তার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। তাহলে? কথাটা বাবাকে জিগ্যেস করাটা উচিত। কিন্তু গোটা বিষয়টাই যদি ভুল হয়, তাহলে বিষয়টা নিয়ে কথা বলা ছেলেমানুষি হবে। বাবা এই বাষট্টি বছরের ছেলের ছেলেমানুষি খুব সহজভাবে নিতে পারবেন বলে মনে হয় না। চিন্তিত হওয়ার সব থেকে বড় কারণ হল, গোটা বিষয়টা নিয়ে কারও সঙ্গে আলোচনা করা যাচ্ছে না। মণিকুন্তলাকে সমস্যাটা জানানো উচিত। কিন্তু মন চাইছে না। সে ঘাবড়ে গেলে মুশকিল। বাড়িসুদ্ধ সবাই জানতে পারবে। একটা হট্টগোল শুরু হবে। আবার স্ত্রী হিসেবে স্বামীর এই ধরনের সমস্যা সবার আগে তার জানা উচিত। এটা নিয়েই মনের মধ্যে দোনামোনা চলছে। তবে প্রথমে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলাটাই যুক্তিযুক্ত।
আবার ইন্টারকম বেজে উঠল।
‘কী হয়েছে ভীম?’
‘ভীম ভয় পাওয়া চাপা গলায় বলল, ‘আপনার সঙ্গে একজন দেখা করতে চাইছে।’
বিমলকান্তি সেন অবাক হলেন। ভীমেরও কি মাথায় সমস্যা হল? এতটা বঝাঝকা, এমনকী চাকরি থেকে বরখাস্ত করে দেওয়ার ভয় দেখানোর পরও লোক পাঠাতে চাইছে?
বিমলকান্তি কিছু বলবার আগে ভীম গলা আরও নামিয়ে বলল, ‘স্যার, বলছে পুলিশের লোক।’
বিমলকান্তি নড়েচড়ে বসলেন।
‘কী বললে? কীসের লোক?’
ভীম গলা নামিয়ে বলল, ‘পুলিশের লোক। প্রথমে অর্চিনদাদাকে খুঁজছিল।’
অর্চিনকে পুলিশ খুঁজছে! বিমলকান্তি সেনের কপালে ভাঁজ পড়ল।
‘অর্চিন কোথায়?’
‘সকালবেলা যেমন প্রতিদিন বের হয়, আজও বেরিয়েছে, এখনও ফেরেনি। সে-কথা শুনে ওই লোক বলছে, আপনার সঙ্গে দেখা করবে।’
বিমলকান্তি একটু চুপ করে থাকলেন। বললেন, ‘ঠিক আছে। ভিতরে নিয়ে এসো।’
বিমলকান্তি টেবিলে ছড়ানো কাগজপত্র গোছাতে শুরু করলেন। অর্চিনকে পুলিশ খুঁজছে! কেন? পথেঘাটে সে কোনও গোলমাল পাকিয়েছে? অর্চিন তো গোলমাল পাকানোর ছেলে নয়। তাহলে? নিশ্চয় ভুল কিছু হচ্ছে।
ভীম যাকে নিয়ে এল, তাকে দেখে পুলিশ বলে মনে হয় না। মনে হচ্ছে, স্কুল-কলেজের মাস্টার। কমবয়সি মাস্টার। চোখমুখে এক ধরনের উজ্জ্বল ভাব। ‘বই পড়া, বই পড়া’ ব্যাপার আছে। পুলিশের ইউনিফর্ম নেই। কাঁধে একটা ব্যাগ। চামড়ার ব্যাগ। ব্যাগটা মোটা। ব্যাগে রিভলভার আছে?
ভীমকে চোখের ইশারায় চলে যেতে বলে বিমলকান্তি সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে বললেন, ‘নমস্কার, বসুন।’
যুবকটি বসল না। পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করল। সেই ব্যাগের ভাঁজ খুলে এগিয়ে ধরল। খাপের ভিতরে আইডেনটিটি কার্ড। সরকারি সিলমোহর দিয়ে তাতে লেখা—’ইনস্পেক্টর’।
যুবক সৌজন্য হেসে বলল, ‘আমি স্পেশাল ব্রাঞ্চ থেকে আসছি। আমার নাম সুপর্ণ ভট্টাচার্য।’
বিমলকান্তি বললেন, ‘কার্ড দেখাতে হবে না। আমি বিশ্বাস করেছি। আপনি প্লিজ বসুন।’
সুপর্ণ ভট্টাচার্য সহজভাবে চেয়ারে বসল। যেন এই ঘরের চেয়ারে সে আগে বহুবার বসেছে। পুলিশ বোধহয় এরকমই হয়। অভিনয় করতে পারে।
‘মিস্টার সেন, আপনাকে বিরক্ত করতে হচ্ছে বলে দুঃখিত। তবে বেশিক্ষণ সময় নেব না।’
বিমলকান্তি চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, ‘ইটস ওকে। কী ব্যাপার বলুন তো? শুনলাম, আপনি অর্চিনকে খুঁজতে এসেছেন?’
সুপর্ণ ভট্টাচার্য সহজভাবে বলল, ‘হ্যাঁ মিস্টার সেন, আমি অর্চিন রায়ের সঙ্গেই কথা বলতে এসেছি। তবে সেই সূত্রে আপনার সঙ্গেও কথা বলতাম। হয়তো খানিকটা পরে বলতাম। অর্চিনের সঙ্গে কথা বলবার পর। কিন্তু সেটা তো সম্ভব হল না। অর্চিন তো এখন বাড়িতে নেই। আমাকে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তাই ভাবলাম, সেই সময়টা যদি আপনার সঙ্গে একটু কথা বলে নিই। আপনার কি অসুবিধে হবে?’
অবশ্যই অসুবিধে হবে। আজ তার বাইরের কারও সঙ্গে কথা বলবার মতো মানসিক অবস্থা নেই। তার ওপর অফিসে বেরোনোর সময় হয়ে গেল। কিন্তু পুলিশকে তো আর সে কথা বলা যায় না। বিমলকান্তি অস্ফুটে বললেন, ‘না, অসুবিধে হবে না। তবে আমার অফিসের সময়…।’
যুবক অফিসার বিনয়ের সঙ্গে বলল, ‘তাহলে বরং আজ থাক। আপনার সঙ্গে আমি অন্য কোনও সময় দেখা করে নেব। আমি কি অর্চিনের জন্য এখানে বসে একটু অপেক্ষা করতে পারি?’
বিমলকান্তি সেন বললেন, ‘না না, তেমন তাড়া নেই যে কথা বলতে পারব না। আপনি বলুন না কী জানতে চান।’
সুপর্ণ ভট্টাচার্য বিনয়ের সঙ্গে বলল, ‘ধন্যবাদ। আপনি চিন্তা করবেন না। অফিসের লেট করিয়ে দেব না। অল্প ক’টা কথা বলেই আপনাকে ছেড়ে দেব। অর্চিন রায় আপনার কে হয়?’
বিমলকান্তি সেন একটু ভেবে বললেন, ‘রিলেটিভ। আত্মীয়।’
সুপর্ণ ভট্টাচার্য বলল, ‘আচ্ছা, ঠিক কী ধরনের আত্মীয়?’
বিমলকান্তি সেন আবার একটু চুপ করে রইলেন। পুলিশকে কতটা বলা ঠিক হবে? আবার না বলেই বা উপায় কী? নিশ্চয় ইতিমধ্যে অনেকটা জেনে এসেছে।
‘সরাসরি আমার রিলেটিভ নয়। আমার স্ত্রীর বোনের ছেলে। দূর সম্পর্কের বোন।’
যুবক অফিসার চোখদুটো বড় করে বিস্ময়ের ভান করল।
‘অর্চিন আপনার এখানে আছে কেন?’
বিমলকান্তি হালকা বিরক্ত হলেন। এই ছোকরা অফিসার অতিরিক্ত চালাক মনে হচ্ছে। নানারকম অভিনয় করছে। কখনও বিনয়ের, কখনও বিস্ময়ের। এবার বিমলকান্তির গলায় বিরক্তির ভাব এসে পড়ল। বললেন, ‘ছেলেটির বাড়ি সিউড়িতে। ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। কলকাতায় খুব নামকরা জায়গায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। আপনি নিশ্চয় বুঝবেন, সিউড়ি থেকে কলকাতায় আসা-যাওয়া করে লেখাপড়া সম্ভব নয়। তাই আমার বাড়িতে থাকে।’
‘অর্চিনের বাবা-মা কি সিউড়িতে থাকে?’
বিমলকান্তি ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ‘এত ডিটেইলসে আমি বলতে পারব না। যদি বলেন, স্ত্রীর কাছে জেনে রাখতে পারি।’
সুপর্ণ ভট্টাচার্য হাত তুলে বলল, ‘না না, অত কিছু করতে হবে না মিস্টার সেন। আপনি যতটা জানেন, ততটাই যথেষ্ট। আমার কনসার্ন অর্চিন রায়কে নিয়ে, তার বাবা-মাকে জড়ানোর কোনও বিষয় নেই।’
বিমলকান্তি ভারী গলায় বললেন, ‘আপনি কি চা খাবেন?’
সুপর্ণ ভট্টাচার্য হেসে বলল, ‘আমি চা খাই না।’
বিমলকান্তি সেন বললেন, ‘তাহলে কি আমার সঙ্গে কথা শেষ?’
সুপর্ণ ভট্টাচার্য ঘাড় কাত করে বিনয়মাখা গলায় বলল, ‘অবশ্যই শেষ। আপনি যে এই ছেলে সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানেন না, বোঝা যাচ্ছে। আপনাকে বিরক্ত করবার জন্য দুঃখিত।’
বিমলকান্তি বললেন, ‘আমি কি এবার আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?’
যুবক অফিসার হেসে বলল, ‘প্রশ্ন করতে হবে না। আমি জানি আপনি কী জানতে চান। আপনি জানতে চান, আমি কেন অর্চিনের সঙ্গে কথা বলতে এসেছি। তাই তো? মিস্টার সেন, আমরা একটা অস্ত্র মামলায় আপনার এই দূর সম্পর্কের, সরি, আপনার স্ত্রীর এই দূর সম্পর্কের ব্রিলিয়ান্ট বোনপোটির কানেকশন পেয়েছি। ঠিক কানেকশন বলব না, বলব নাম পেয়েছি।’
বিমলকান্তি চমকে উঠলেন। অর্চিন অস্ত্র মামলায়! তিনি কি ঠিক শুনছেন? নিশ্চয় নয়।
‘অফিসার আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন, একটু স্পষ্ট করে বলবেন?’
সুপর্ণ ভট্টাচার্য বলল, ‘কেন বলব না? অবশ্যই বলব। গত সপ্তাহে পুলিশ একটা বড় অস্ত্র চালান র্যাকেট ক্র্যাক করেছে। এরা বিভিন্ন জেলা এবং কলকাতা জুড়ে কাজ করে। এখন পর্যন্ত পুলিশ তিনজনকে অ্যারেস্ট করেছে। ইনভেস্টিগেশন চলছে। আরও অনেকেই ধরা পড়বে। আসামিদের ইন্টারোগেশনের সময় তারা কতগুলো নাম বলেছে। তার মধ্যে অর্চিন রায়ের নামও রয়েছে।’
উত্তেজনায় বিমলকান্তি সেন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। আবার বসে পড়লেন। বললেন, ‘কী বলছেন আপনি! হতেই পারে না। অর্চিন ভালো ছেলে। সে এইসবের মধ্যে মোটেও যুক্ত থাকতে পারে না।’
সুপর্ণ ভট্টাচার্য মৃদু হেসে বলল, ‘মিস্টার সেন, আমি তো একবারও বলিনি সে যুক্ত আছে। একজন অস্ত্র চালানের আসামি জেরার সময় কত নাম বলে। তার কথা বিশ্বাস করতে হবে? বিশ্বাস করলে তো আপনার রিলেটিভকে আমরা আগে অ্যারেস্ট করতাম। সেসব তো আমরা কিছু করিনি।’
অ্যারেস্ট! বিমলকান্তির মনে হচ্ছে তাঁর শরীর কাঁপছে। বুকের ভিতর ধড়ফড়ও করছে। কপালে ঘাম জমছে। হাত দিয়ে সেই ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, ‘তাহলে এসেছেন কেন?’
সুপর্ণ ভট্টাচার্য বলল, ‘ছেলেটি যে এইসব কাজের সঙ্গে যুক্ত নয়, সেই বিষয়টা কনফার্ম করতে এসেছি। পুলিশের রুটিন খোঁজ। আপনি চিন্তা করবেন না। আমি ওর সঙ্গে কথা বলেই চলে যাব। আপনি বরং অর্চিনের মোবাইল ফোনের নম্বরটা আমাকে দিন। একটা ফোন করে দেখি, সে কখন আসবে। যদি সেরকম দেরি হয়, তাহলে না হয় সে আমার অফিসে আসবে। সেখানে কথা হবে। আপনি যখন বলছেন ছেলেটি এত ভালো, তখন তাড়াহুড়ো তো কিছু নেই।’
বিমলকান্তি অসহায়ভাবে মুখ তুললেন। মোবাইল ফোন নম্বর! অর্চিনের মোবাইল ফোন নম্বর তো তিনি জানেন না। মাথাটা হালকা ঘুরে উঠল যেন। আর তখনই নিমেষের জন্য বদলে গেলেন বিমলকান্তি। মনে হল, তিনি উলটো চেয়ারে বসা ছোকরা পুলিশ অফিসার সুপর্ণ ভট্টাচার্য হয়ে গেছেন। চোখ সরু করে অফিসার বিমলকান্তির দিকে তাকিয়ে আছেন। লোকটার একটা কথাও বিশ্বাস হচ্ছে না। বুড়ো অনেক কিছু জানে, কিন্তু বলছে না।
বিমলকান্তি নিজের মধ্যে ফিরে আসতে আসতে কেঁপে উঠলেন। নিজেকেই নিজের বিশ্বাস হচ্ছে না! কী ভয়ংকর! এ কী অসুখ হল তার! চেয়ারের হাতল ধরে নিজেকে সামলালেন বিমলকান্তি।
সুপর্ণ ভট্টাচার্য তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে মিস্টার সেন?’
বিমলকান্তি সেন মাথা নামিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, ‘না, ঠিক আছে।’
মুখে ঠিক আছে বললেও বিমলকান্তি সেন বুঝতে পারলেন, ঠিক নেই। অনেক কিছু গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।