» » তৃতীয় কিস্তি

বর্ণাকার

প্রচেত গুপ্ত

একটু পরে রোদ উঠবে

ত্রিশ

মহিলাটি কে?

খানিক আগে সেনবাড়ির উলটো দিকের ফুটপাথে মাঝবয়সি এই মহিলা দাঁড়িয়েছিলেন। চেহারায় বিধ্বস্ত ভাব। দূরের পথ থেকে এলে যেমন হয়। চুল উসকো-খুসকো। চোখ মুখে রোদে পোড়া কালো ছাপ। মহিলা মাঝে মাঝেই শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখে গলায় ঘাম মুছছিলেন।

আজ প্রথম নয়, গত এক বছরে বেশ কয়েকবার এই মহিলা সেনবাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। কারও খেয়াল হয়নি। খেয়াল হওয়ার কথা নয়। একজন সাধারণ চেহারার বাঙালি মহিলাকে রাস্তার ভিড়ে কে খেয়াল করবে? যদিও কিছু মহিলা পথের লোকের নজর কাড়বার নানা আয়োজন জানে। পোশাকে, ভঙ্গিতে, কথাবার্তায় তারা এমন কিছু করতে পারে যে লোক মুখ না ফিরিয়ে পারবে না। শুধু পুরুষ নয়, অন্য মহিলারাও দেখতে বাধ্য। বেশি কিছু করতে হবে না, পোশাকের একটু এদিক-ওদিক ঘটিয়েই পথের মানুষের নজরে আসা সহজ। সেই নজরে কখনও মুগ্ধতা, কখনও কামনা, কখনও হিংসে থাকে।

এই পর্যন্ত সমস্যা নেই। সমস্যা হল, নজর কাড়বার পর কিছু মহিলা তেড়েফুঁড়ে ওঠে। তারা নিঃসংকোচে বলে বসে, পুরুষগুলো অতি খারাপ। অশ্লীল। মেয়ে দেখলেই শরীরের দিকে নোংরা চোখে তাকায়।

‘ইস! সেদিন গড়িয়াহাটে কতগুলো ধেড়ে লোক এমনভাবে বুকের দিকে তাকাচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল, চড় দিই।’

এই কথা বলবার আগে মহিলার মনে থাকে না সে নিজেই সেদিন ‘নজর কারবার’ জন্য জামা-কাপড়ে আয়োজন করে পথে বেরিয়েছিল। নজর পাওয়ার পর আয়োজনটা যেন কোনও ব্যাপারই নয়। এই প্রসঙ্গ তুললে অনেক নারীবাদী হইহই করে ওঠে। মেয়েদের পোশাক কি তবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ঠিক করে দেবে? এটা কি মধ্যযুগ? বর্বর যুগ? তা হলে কি মেয়েদের আজও পথে ঘোমটা দিয়ে বেরোতে হবে? পালকিতে পর্দা টেনে পথ চলতে হবে? বদ পুরুষমানুষ শরীরের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাবে বলে ফ্যাশন বন্ধ হবে নাকি?

এই হইচইয়ের সময় নারীবাদীরা এতটাই উত্তেজিত হয়ে থাকে যে কোনও যুক্তি শুনতে চায় না। এমনিতে স্লোগান হল—’নারী পুরুষ সমান’ আর উত্তেজনার সময় স্লোগান হল, ‘আমরা নারী, আমাদের বক্তব্যই ঠিক।’ এই সময় যদি কোনও মহিলাও যুক্তি দিয়ে কিছু বলতে চায় তা হলে তাকেও ‘নারী বিদ্বেষী’ বলে চিহ্নিত করা হবে। নারীকুলে কলঙ্ক। কে উত্তেজিত নারীবাদীদের বোঝাবে, এটা মধ্যযুগ নয়? এখন ছেলেমেয়ে সবাই নিজের রুচি অনুযায়ী পোশাক পরবে। যা খুশি পরবে। বেশ করবে। মেয়েরা স্বাধীন, শিক্ষিত, বুদ্ধিমতী। সম্প্রতি আমেরিকার এক গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে, কোম্পানি পরিচালনার ব্যাপারে মেয়েরা পুরুষদের থেকে বেশি দক্ষ। বেশি ইনোভেটিভ। শুধু সাজুগুজু নয়, সুযোগ পেলে তারা বড় বড় ব্যবসায় তাক লাগিয়ে দিচ্ছে। লাভ বাড়িয়ে দিচ্ছে। মেয়েরা শান্তির জন্য আন্দোলনও করে, আবার যুদ্ধবিমান চালায়। ঘোমটা, পালকির যুগ শেষ। পোশাক-আশাকের মতো ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে চিন্তা করবার মতো সময় আর মেয়েদের নেই।

নারীবাদীদের কে বোঝাবে এসব কথা? এই যুক্তি তারা মানতে চায় না। নজর কাড়বার মতো পোশাক পরে পথে নামলে নজর পড়বেই। এক ছিপছিপে তরুণী হটপ্যান্ট পরে ক্যামাক স্ট্রিট দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় তার পায়ের দিকে যদি কেউ না তাকায় তা হলে তো ওই সুন্দরী বাড়ি গিয়ে সুইসাইডের চেষ্টা করবে। সে তার পায়ের চর্চা করছে। ওয়াক্সিং, স্পা, জিমের পিছনে বড় খরচ করেছে। তবেই পা এত চমৎকার। এই চমৎকার পা কি কেবল পোশাকের পিছনে লুকিয়ে রাখবার জন্য বানানো হল? বাথরুমের বাথটবে শুয়ে পুরোনো দিনের হলিউড সিনেমার নায়িকাদের মতো তুলে নিজে দেখবার জন্য? অসম্ভব। তার ওপর হটপ্যান্টের পিছনেও খরচ আছে না? গোড়ালি পর্যন্ত ঝোলাপ্যান্টের থেকে থাই পর্যন্ত প্যান্ট এখন অনেক দামি। নামে হট, দামেও হট। সব মিলিয়ে খরচ, পরিশ্রম কম হল? আগে পা দেখানোর মানে ছিল ‘লাথি দেখানো’। ছেলেমেয়ে নির্বিশেষেই তাই করত। তাতে কোনও খরচখরচা ছিল না। এখনে পা দেখানোতে বিরাট খরচ। তারপরেও কেউ না দেখলে লোকসান। হতাশা গ্রাস করে। তবে ‘পা-সুন্দরী’-দের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। নজর লোকে করে। সেই নজর কামনার না প্রেমের, নাকি ঘৃণার? নাকি লজ্জার? অন্য মেয়েদের হিংসেও হতে পারে। তবে সেসব বিচার এক-একজনের কাছে এক-একরকম। যাকে বলে ‘সাবজেক্টিভ’ আলোচনা। নজর পড়ে এটাই সত্য। তা হলে রাগ কেন? আমার কাঁধ, বুক, পিঠ, পা, হাঁটু উন্মুক্ত। তুমি সেদিকে তাকালে আমি তোমাকে অশ্লীল, অসভ্য বলব কেন? বরং না দেখলে তো মনোকষ্ট হওয়ার কথা। এটা কি দ্বিচারিতা নয়?

আধুনিক মনোবিজ্ঞান বলছে, যারা এই বিষয়ে দ্বিচারিতা করে, একরকম চায়, অথচ একরকম বলে, তারা ভালো নয়। পুরুষ নারী নির্বিশেষেই ভালো নয়। নজর কাড়বার স্থূল চেষ্টা আসলে এক ধরনের অসুখ। কেউ এই চেষ্টা করে শরীর দেখিয়ে, কেউ করে পথের মাঝে ডিগবাজি খেয়ে। নিজেদের বহুবিধ হীনমন্যতা, অক্ষমতা থেকেই এই অসুখের জন্ম। নারীবাদীদের হুঙ্কার এই অসুখকে আরও বাড়িয়ে দেয়। তারা সমাজের আসল সমস্যাকে গুলিয়ে দিতে চেষ্টা করে। মনোবিজ্ঞানীরা যাই বলুন, আশার কথা, সমাজে এই ধরনের পুরুষ ও মহিলার সংখ্যা কম। সেই কারণে সমাজটা এখনও বাসযোগ্য।

সেনবাড়ির সামনে দাঁড়ানো মহিলার পথের মানুষের ‘নজর কাড়বার’ জন্য কোনও আয়োজন নেই। বরং উলটো। মহিলা ভিড়ে যেন নিজেকে মিশিয়ে রাখতে চাইছেন। গায়ে একটা সাধারণ সুতির শাড়ি। সেটাও পিঠ ঢেকে জড়িয়ে আছেন। শাড়ির রংও ঝলমলে নয়। চট করে চোখ টানে না। মহিলাকে দেখলে মনে হচ্ছে, একেবারে দরিদ্র না হলেও টাকাপয়সা বিশেষ নেই। দাঁড়িয়ে থাকবার মধ্যে এক ধরনের জড়সড় ভাব রয়েছে।

এর আগে কখনও কখনও একে অর্চিনের ইউনিভার্সিটির সামনেও দেখা গেছে। ইউনিভার্সিটির উলটো দিকে যে বাস স্টপটা আছে সেখানে দাঁড়িয়ে থেকেছেন। যতবার তিনি এসেছেন, খানিকটা সময় দাঁড়িয়ে থেকে তিনি চলে যান। আজ ব্যতিক্রম ঘটল। রাস্তা টপকে বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। বিশাল গেট। উঁচু পাঁচিল। কলকাতার বনেদি ধনী পরিবারের বাড়ি যেমন হয়। গেটের বাইরে দারোয়ান। মহিলা এগিয়ে যান।

ভীম বলল, ‘কাকে চাই?’

মহিলা ইতস্তত করে বলেন, ‘এটা কি কমলকান্তি সেনের বাড়ি?’

ভীম ভুরু কোঁচকাল। বলল, ‘উনি তো কারও সঙ্গে দেখা করবে না। নিজের ঘর থেকেই বেরোন না।’

মহিলা একটু থমকালেন। কিছু ভাবলেন। বললেন, ‘ওহ আমার জানা ছিল না। তার ছেলে আছেন? বিমলকান্তি সেন?’

অপরিচিত মহিলার এই থতমত ভাবে ভীমের ভুরু কোঁচকানো আরও গভীর হল। বলল, ‘আছেন’।

‘তার সঙ্গে দেখা করা যাবে?’

দারোয়ান মাথা নেড়ে বলল, ‘না, আজ স্যার বাড়িতে কারও সঙ্গে দেখা করেন না।’

মহিলা আবার একটু চুপ করে রইলেন। একেই মহিলার মধ্যে বিধ্বস্ত ভাব, তার ওপর দেখা হবে না শুনে তিনি যেন খানিকটা হতাশ হয়ে পড়লেন। ভীমের মায়া হল। দারোয়ানের মায়াদয়া থাকার কথা নয়। ভীমের এটাই সমস্যা। মাঝে মাঝে মায়ার মধ্যে পড়ে যায়। সে গলা খাকড়ি দিল। ‘স্যার দেখা করেন বুধবার করে। আপনি বুধবার আসবেন। সকাল আটটা থেকে ন’টার মধ্যে আসবেন।’

মহিলা খানিকটা ইতস্তত করে বললেন, ‘একবার দেখা হবে না? একটু সময় নেব।’

ভীম মনকে শক্ত করল। বলল, ‘না, হবে না। আপনি একটা কাজ করতে পারেন। স্যারের অফিসে গিয়ে দেখা করতে পারেন।’

মহিলা তাড়াতাড়ি বলল, ‘না, না, অত লোকজনের মধ্যে…না, না, আমি ওনার সঙ্গে একটু একা কথা বলতে চাই…।’

মহিলার গলায় ভয় ভয় ভাব। কিছু একটা গোপন করতে চাইছেন যেন। বিপদে পড়লে মানুষের কখনও কখনও এরকম হয়। হাবেভাবে ব্যস্তসমস্ত। কথা বলবার সময় চারপাশে তাকাচ্ছেন। কেউ দেখে ফেলছে না তো?

ভীম চিন্তিত হল। কেউ দেখে ফেললে কী সমস্যা?

‘আপনি বুধবার আসুন।’

মহিলা এবার অনুরোধের ঢঙে বলল, ‘আপনি বিমলকান্তিবাবুকে একবার বলে দেখুন। একটু খানিক সময় নেব। অনেক দূর থেকে আসছি। সেই কৃষ্ণনগর থেকে।’

বাইরে চোখ-মুখ কঠিন রাখতে পারলেও ভীম ভিতরে ‘মায়া’ ভাব অনুভব করল। না, এভাবে চললে চাকরি থাকবে না। তবে এই মহিলার ভাবভঙ্গি অন্যরকম। সত্যি যদি কোনও সমস্যা থাকে?

‘একটু দাঁড়ান। স্যারকে একবার বলে দেখছি।’

ভীম বিলমকান্তি সেনকে ইন্টারকমে ফোন করে এবং জোর ধমক খায়। ধমকের চোটে কৃষ্ণনগর নামটা ফুলিয়ার সঙ্গে গুলিয়েও যায়। বিমলকান্তি তখন আরও ধমক দেন। জানান, মুম্বই, দিল্লি থেকে এলেও কিছু করবার নেই। কারও সঙ্গে দেখা করবেন না। নিজের ওপর রাগ হয় ভীমের। কেন যে ‘স্যার’-কে বলতে গেল? সেই রাগ সামনে আগ্রহ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলার ওপর পড়ে। সে একরকম হাত নাড়িয়ে ভাগিয়ে দেয়।

কিন্তু মহিলাটি কে? কেনই বা তিনি মাঝে মাঝেই এই বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ান? অর্চিনের ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত বা ধাওয়া করেন কেন? আজ এই বাড়ির লোকদের সঙ্গে দেখা করতে চাইছিলেন কেন?

মহিলার নাম বৈশাখী। বৈশাখী সান্যাল। বয়স বছর চল্লিশ-বিয়াল্লিশ। মহিলা মোটেও কৃষ্ণনগর বা ফুলিয়া থাকে না। থাকেন দুর্গাপুর। জায়গার নাম বানিয়ে বলেছেন। তিনি ভীমকে নাম বলবার সুযোগ পাননি। সুযোগ পেলে নামও বানিয়ে বলতেন। বানানো নাম ঠিক করাও ছিল। মহুয়া। মহুয়া রায়। নিজের নাম, ঠিকানা মিথ্যে বলবার অভ্যেস বৈশাখী অনেকদিন ধরেই করছেন। না করে উপায় নেই। সত্যি পরিচয় দিলে অনেক ধরনের ঝামেলা। সেই ঝামেলা পুলিশ, জেল পর্যন্ত গড়াতে পারে। গড়াতে পারে কেন, গড়াবেই। যাই হোক, সেই দুর্গাপুর থেকে কলকাতায় এসে সেনবাড়ির সামনে বৈশাখী সান্যালের ঘুরঘুরের কারণ কমলকান্তি বা বিমলকান্তি নন। কারণ অর্চিন। সেই কারণে তিনি অর্চিনের ইউনিভার্সিটির সামনেও যান।

ভীম ভাগিয়ে দেওয়ার পর বৈশাখী উলটো দিকের ফুটপাথ ধরে খানিকটা হাঁটলেন। খুব জল তেষ্টা পাচ্ছে। মোড়ের কাছে এসে একটা পান-সিগারেটের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন।

‘ঠাণ্ডা আছে?’

উঁচু প্ল্যাটফর্ম থেকে দোকানদার বলল, ‘আছে বউদি। কোনটা নেবেন?’

বৈশাখী নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলেন, ‘যে-কোনও একটা হলেই হবে। ঠাণ্ডা হলেই চলবে।’

দোকানদার ঠাণ্ডা পানীয়ের বোতল খুঁজতে লাগল। বৈশাখী দোকানের পাশে ঝোলানো আয়নার চুল ঠিক করলেন। পেটে গোঁজা রুমাল বের করে মুখ মুছলেন। খানিকটা জলের ঝাপটা দিতে পারলে হত। গরমের মধ্যে এতটা জার্নিতে চোখ-মুখ বসে গেছে। তার ওপর অর্চিনের বাড়ির সামনে অতটা সময় দাঁড়াতে হয়েছে। একবার তো বৃষ্টি নেমে গেল। সঙ্গে আবার ছাতাও ছিল না। ভাগ্যিস পিছন দিকের একটা দোকানে খানিকটা শেড ছিল, তার তলায় গিয়ে দাঁড়াতে ভেজার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া গিয়েছিল। নইলে ভেজা শাড়িতেই থাকতে হত।

দোকানদার বোতলের মুখ খুলে, স্ট্র ভরে নীচু হয়ে হাত বাড়াল।

‘নিন বউদি, ভালো ঠাণ্ডা।’

বৈশাখী হাত বাড়িয়ে বোতল না ধরেই বলল, ‘জিনিস ভালো তো?’

‘অবশ্যই ভালো। এত বড় কোম্পানির মাল খারাপ হবে কেন? দোকানদার মহিলার বোকামিতে হাসল। এ কী বোকার মতো কথা? বড় কোম্পানির জিনিস কখনও খারাপ হয়!

হাতে বোতল নিয়েও বৈশাখী সেই বোতল মুখে না তুলে দাঁড়িয়ে রইলেন। বললেন, ‘বাজে কথা বোলো না ভাই। এই তো সেদিন পেপারে পড়লাম। কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতলে পোকা। ছিপি বন্ধ ছিল তারপরেও পোকা। ইস!’

দোকানদার বলল, ‘হাজারটায় একটা-দুটো ওরকম হতেই পারে।’

বৈশাখী বললেন, ‘আমার এই বোতলে পোকা-টোকা নেই তো?’

দোকানদার এবার বিরক্ত হল। একটা কোল্ড ড্রিঙ্কস নিয়ে এত জাবাবদিহি তার পছন্দ হচ্ছে না। সে চুপ করে পান সাজতে শুরু করল। বৈশাখী বললেন, ‘কী হল, বললে না? তুমি ভালো করে বোতল দেখে দিয়েছ তো?’

দোকানদার এবার কড়া গলায় বলল, ‘আমার দোকানে এসব হয় না। কিছু থাকলে পয়সা নেব না।’

বৈশাখী এই কথায় খানিকটা যেন আস্বস্ত হলেন। বোতলে ডোবানো স্ট্রতে মুখ দিলেন। লম্বা করে টান দিলেন। আহ। শরীর জুড়োল।

‘সে তুমি না হয় পয়সা নেবে না, কিন্তু পোকা পেটে গেলে আমায় তো হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।’

দোকানদার পানের সরঞ্জাম থেকে মুখ না তুলে বলল, ‘বলছি তো কিছু নেই।’

স্ট্রতে এবার নিশ্চিন্তে একটার পর একটা টান দিতে লাগলেন বৈশাখী।

আজ অর্চিনকে দেখতে পেলেন না কেন? এই সময়টা তো বাড়ি থাকে। হয় ঢোকে, নয় বের হয়। শরীরটরীর খারাপ হল না তো? আবার ইউনিভার্সিটিও যেতে পারে। হয়তো সকাল সকাল বেরিয়ে গেছে। পরীক্ষা-টরীক্ষা আছে। ছেলে লেখাপড়ায় খুবই ভালো। আহা! মন ভরে যায়। এই ছেলের বাবাও ঠিকমতো লেখাপড়া করলে ভালো করত। অঙ্কে মাথা ছিল। পড়াশোনাই তো করেনি। এখন একবার ইউনিভার্সিটি গেলে হত। অর্চিনকে পাওয়া যেত। শুধু একবার দূর থেকে দেখা। অতদূর থেকে আসা তো শুধু একবার ছেলেটাকে চোখের দেখা দেখতে। ইদানীং অবশ্য কাজ নিচ্ছেন বৈশাখী। কলকাতায় পার্টি ধরছেন।

চিৎকার করে উঠল উঠলেন বৈশাখী।

‘এ কী! এ মা! কী এটা?’

বোতল হাতে ধরে নাক-মুখ কুঁচকে আছেন বৈশাখী। বোতল প্রায় শেষ। পানীয়র তলানিতে গোল মতো কিছু একটা ভাসছে। কালো পোকার মতো চেহারা। রোঁয়াও আছে। দোকানদার হাতের কাজ ফেলে ঝুঁকে পড়ল।

‘কী হল বউদি?’

বৈশাখী ঝাঁঝিয়ে উঠলেন।

‘কী হল? কী হল বলছ! দেখো, দেখো বোতলে কী পড়ে আছে। ওয়াক।’

বৈশাখী গলা-বুকে হাত রেখে বমির ভঙ্গি করলেন। হাত বাড়িয়ে বোতল নিল দোকানদার। চোখের সামনে তুলে দেখতে লাগল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে।

ধমকে উঠলেন বৈশাখী।

‘কী দেখছ? পোকা চিনছ? ফাজলামি হচ্ছে? এই জন্য বলেছিলাম, বোতলটা দেখে দাও। ওয়াক। ওয়াক। এবার আমার কী হবে? বমি পাচ্ছে।’

পথের দু-একজন মুখ ঘুরিয়ে দেখছে। ক’জন দাঁড়িয়েও পড়ল। দোকানদার তাড়াতাড়ি হাত জোড় করে কাঁচুমাচু গলায় বলল, ‘ঠিক আছে বউদি, ভুল হয়ে গেছে। আপনাকে দাম দিতে হবে না।’

বৈশাখী আরও জোর ধমক দিতে গেলেন! দাম! এরপরেও দামের কথা বলছে লোকটা! নিজেকে সামলালেন।

‘ঠিক আছে। আর যেন কখনও এমন না হয়।’

বৈশাখী চোখ-মুখ কুঁচকে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে একটা অটোতে উঠলেন। তিনি এখন যাবেন শিয়ালদা। বৈশাখী মুখ ঘুরিয়ে বাইরে তাকালেন। ব্যস্ত কলকাতা ছুটছে। বেচারি পান-সিগারেটের দোকানদার। যখন বোতলের তলানিটুকু ফেলে, পরীক্ষা করে দেখবে, ওই কালো গোল জিনিসটা পোকা-টোকা কিছু নয়, দলা পাকানো সুতো, তখন তিনি অনেক দূরে। এ কাজ তিনি আগেও কয়েকবার করেছেন। কোলড্রিঙ্কস খেতে খেতে শাড়ির আঁচল থেকে সুতো ছিঁড়ে দলা পাকিয়ে বোতলে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এতে তেষ্টাও মেটে আবার খরচও হয় না। শ্রীমতী বৈশাখী সান্যাল মনে-মনে হাসলেন। লেখাপড়ায় ফার্স্ট হওয়া গুড বয় অর্চিন যদি জানত, তার মা এভাবে লোক ঠকিয়ে বেড়ায় তা হলে কী করত? কাঁদত? নাকি ঘেন্না করত? খুব জানতে ইচ্ছে করে।