» » দ্বিতীয় কিস্তি

বর্ণাকার

প্রচেত গুপ্ত

একটু পরে রোদ উঠবে

আঠার

ইউনিভার্সিটির আর পাঁচজন ছেলেমেয়ের মতো বারিধারাও মধুজা ম্যাডামকে পছন্দ করে না। মধুজা রায়কে আড়ালে সবাই ডাকে ‘শ্রীমতী ডিয়ার’। যারা জানে না তারা ‘ডিয়ার’ শুনলে ভাববে, প্রিয়। ঘটনা তা নয়। এই ‘ডিয়ার’ হল ‘ডি’ এবং ‘আর’। শ্রীমতী ধান্দা রায়।

‘শ্রীমতী ধান্দা রায়’-কে নিয়ে ইউনিভার্সিটিতে অনেক গসিপ। শুধু এই ইউনিভার্সিটিতে নয়, তাকে নিয়ে চর্চা অন্য ইউনিভার্সিটি, কলেজেও। কোথাও তিনি গেস্ট লেকচারার, কোথাও গভর্নিং বডির মেম্বার, কোথাও সিলেবাস দেখতে যান, কোথাও ইন্টারভিউ বোর্ডে নাম ঢোকানো আছে। এছাড়া আরও হাজারটা কমিটি তো আছেই । বারাসাতের ওদিকে কোনও কলেজে ‘সাফসুতরো কমিটি’-তেও ঢুকে আছে। মাসে একদিন গাড়ি, আড়াইশো টাকা রেমুনারেশন। গাড়ি নেন, তবে বারাসাত পর্যন্ত যেতে হয় না। ছ’মাস, ন’মাসে একবার গিয়ে একসঙ্গে রেমুনারেশনের টাকা তুলে আনেন। মুখে বড় বড় কথা বলেন।

‘পরিচ্ছন্ন কলেজই দিতে পারে পরিচ্ছন্ন শিক্ষা। সবাই যদি এই দায়িত্ব এড়িয়ে যাই তা হলে কীভাবে চলবে? বইয়ের সঙ্গে ঝাঁটা বালতিও হাতে তুলতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে। আমি এগিয়ে এসেছি।’

তিপ্পান্ন-চুয়ান্ন বছর বয়েসেও মধুজা রায় নিজেকে আকর্ষণীয় করে রেখেছেন। নিজেকে ‘ফিটফাট, পরিচ্ছন্ন’ রাখাটা কোনও দোষের নয়; কিন্তু মধুজা রায়ের সাজপোশাক, ভঙ্গি, আচরণ সব কিছুর মধ্যেই চড়া ভাবে ‘আমাকে দেখো’ ব্যাপার আছে। এই ব্যাপার আর পাঁচজন কলেজ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক-অধ্যাপিকার থেকে আলাদা। তাদের মধ্যেও দেখানো ব্যাপার থাকে। কিন্তু সেটা নিজের শিক্ষা, বিবেচনা, বোধ। তারা নিজের গবেষণাপত্র, প্রবন্ধ, পত্রপত্রিকায় লেখা বইয়ের সমালোচনা ব্যাগে নিয়ে ঘোরেন। সুযোগ পেলেই বের করে দেখান। সেই দেখানোর মধ্যে এক ধরনের চাপা অহঙ্কার থাকে। লেখাপড়া জগতের মানুষ লেখাপড়া নিয়ে চর্চা, অহঙ্কার করবে না তো কী নিয়ে করবে? মধুজা রায়ের ব্যাপার অন্যরকম। নিজের গবেষণাপত্র নয়, তিনি আজকাল সকলকে দেখাতে চান, তাঁর বয়স কমছে। পেটে ভুঁড়ির ভাব হলে জিমে ছোটেন। তাতে যদি ক্লাস মিস হয় তো হবে। ক্লাস বড় না ভুঁড়ি বড়? ভুঁড়ি বড় হলে ক্লাসে গিয়ে সিলেবাসে মন দেবেন কেমন করে? সারাক্ষণই তো মন থাকবে অশান্ত। ছেলেমেয়েরা কি ভুঁড়ির বিষয়টা ধরতে পাচ্ছে? ধরতে পারলে কেলেঙ্কারি। লজ্জার একশেষ। ভুঁড়ির সঙ্গে মধুজা চুলও সামলান। চুলে নিয়মিত রং লাগান। কমবয়সি ছাত্রছাত্রীদের জন্য লাগান না, বেশি বয়সি ‘ক্ষমতাবান’-দের জন্য লাগান। ‘ক্ষমতাবান’-দের কাছে ‘ম্যাডাম’-এর নিয়মিত যাতায়াত। তিন কারণে যাতায়াত। প্রাোমোশন, অপারেশন, সাপ্রেশন। প্রাোমোশন নিজের জন্য। অপারেশন বিবিধ কমিটি, সেমিনার, ট্যুরে নিজের নাম ঢোকানোর জন্য। আর সাপ্রেশন দরকার হয় যোগ্য লোককে অন্যায়ভাবে ঠেকানোর জন্য। এর জন্যে ‘ক্ষমতাবান’-দের হাতে রাখতে হয়। তাদের সঙ্গে ‘প্রেম প্রেম’ ভাব করতে হয়। চুলে কালার টোন ঠিক থাকলে এই কাজ সহজ হয়। শুধু চুলে রং নয়, মধুজা রায় হাতে, মুখে, গলায় স্কিন ট্রিটমেন্ট করান। চামড়া যেন কুঁচকে না যায়। মাসে একবার বিউটি পার্লার মাস্ট। গায়ে তোয়ালে, মাথায় ক্যাপ, চোখে শসা চাপা দিয়ে বসে থাকেন ঘণ্টা চারেক। সেই সময় কেউ যদি তাকে দেখে কে বলবে, তিনি ইউনিভার্সিটির প্রফেসর। মনে হবে ‘এমনটা তুমি করতে পারলে গো’ মেগাসিরিয়ালের দজ্জাল শাশুড়ি। সাজগোজ শেষ হলে ফেসবুকে ফটো পোস্ট করেন মধুজা রায়। ফটোতে দেখা যায় কসবার দোতলা বাড়ির বারান্দায় হাসি হাসি মুখে বসে আছেন। পিছনে গদগদ মুখের স্বামী। তার মুখ দেখে মনে হয়, তিনি বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রবর্তিত স্ত্রী-শিক্ষার হাল, চুলের রং এবং বারান্দার চেয়ার নিয়ে গর্বিত। সেই ফটোতে ছেলেমেয়েদের ঝটাপট ‘লাইক’ মারতে হয়। কে রিস্ক নেবে? পরীক্ষায় সাজেশন পাওয়ার আছে। নোটস পাওয়ার আছে। পরের জীবনে গবেষণা আছে। তার জন্য পরীক্ষায় বসতে হবে। এ তো আর অঙ্ক বা কেমিস্ট্রি নয়। ঠিক হলে ঠিক, ভুল হলে ভুল। এমন কিছু বিষয় আছে যেখানে ঠিক, ভুলের পরে আছে মর্জি। পরীক্ষকের মর্জি। মধুজা রায়ের মতো মানুষ যদি পরীক্ষক হন, সেই মর্জি ঠিক রাখতে হবে? ফেসবুক ইগনোর করলে ভবিষ্যতে বড় ঝামেলা হতে পারে। চাকরি লগ্নে আসতে পারে নানা বিপত্তি। কমিটিতে কে থাকবে এখন বলা যায়? লাইক মেরে কমেন্টস লেখা বুদ্ধির কাজ। শোনা যায়, একটি ছেলে লিখেছে—

‘ম্যাম একটা  কথা না বলে পারছি না। আমাকে মার্জনা করবেন। আপনাকে দ্য স্প্রিং ছবির নায়িকা অড্রে হেপবার্নের মতো লাগছে। ওই সিনেমায় অড্রে হেপবার্ন এই ভাবে বসেছিলেন।’

এর উত্তরে মধুজা ম্যাডাম তার ছাত্রকে ফেসবুকেই লিখেছেন—’অরিত্র, তুমি একটা নটি বয়। তুমি কি মনে করো আমি দ্য স্প্রিং সিনেমাটা দেখিনি? অবশ্যই দেখেছি। সেখানে অড্রে হেপবার্নকে অত্যধিক সুন্দরী লেগেছে। আমার সঙ্গে কোনও তুলনা চলে না। তোমার লেখাপড়া কেমন হচ্ছে? স্পেশাল পেপারের জন্য নোটস লাগলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে।’

অরিত্র এই ফেসবুকের কথা চালাচালি বন্ধুদের বলেছে। হাসতে হাসতে বিষম তুলেছে। দ্য স্প্রিং নামে অড্রে হেপবার্নের কোনও সিনেমাই নেই। তারপরেও ম্যাডাম খুশি হয়েছে।

মধুজা রায় একজন লেখাপড়া জানা মানুষ। স্কুল-কলেজে তেমন ফল করতে না পারলেও, এমএ পরীক্ষার নম্বর খুবই ভালো। ইউনিভার্সিটির দু-একজন শিক্ষক-শিক্ষিকা তাঁকে হাত উপুড় করে নম্বর দিয়েছিলেন। আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থায় কোনও কোনও সময় এমন হয়। ছোটবেলার অচেনা পরীক্ষকরা ছেলেমেয়েদের প্রতিভা বুঝতে পারেন না। তাঁরা ভুল করেন। পরীক্ষার খাতায় কম নম্বর দিয়ে ফেলেন। মধুজা রায় নিজে ইউনিভার্সিটিতে ঢুকে আর ঝুঁকি নেননি। সম্ভাব্য প্রশ্নকর্তা এবং অবশ্যম্ভাবী পরীক্ষকদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয়, ঘনিষ্ঠতা করে নিয়েছিলেন। গাড়ি নিয়ে সটান বাড়ি চলে যেতেন। দোলের দিন পায়ে আবির দিয়ে প্রণাম, পুরী থেকে ফিরে ঝিনুকের পেনদানি উপহার, বিজয়ার মিষ্টির প্যাকেট। এমএ পরীক্ষার পর তিনি খুব খাটাখাটনি করে ডক্টরেট উপাধি পেয়েছেন। গবেষণার বিষয়টা বেশ জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ। তবে গবেষণাটি নিয়ে পরে কিছু বিতর্ক হয়েছে। তার মধ্যে একটির কথা বলতেই হয়। শোনা যায়, নিজের গবেষণাপত্রের শেষে সাহায্য নেওয়া বইয়ের যে দীর্ঘ তালিকা মধুজা রায় দিয়েছিলেন তাতে ভয়াবহ ধরনের গোলমাল ছিল। সেখানে এমন সব বইয়ের নাম ছিল যার সঙ্গে গবেষণার কোনও সম্পর্ক নেই। আবহাওয়া, সেলাই বোনা, আচার ও চাটনি প্রস্তুতি, মানুষ হইবার দশটি উপায়। বইয়ের নাম ও বিষয় দেখে গবেষক-পরীক্ষকরা বিস্মিত হয়েছিলেন। ভাইবা নেওয়ার সময় ক্যান্ডিডেটকে তাঁরা প্রশ্নও করেছিলেন।

‘এসব কী! তোমার গবেষণার সঙ্গে সেলাই বোনা, আচারের রেফারেন্স বইয়ের নাম কেন?’

মধুজা রায় কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘সাবোটাজ! সাবোটাজ স্যার! আমি কিছু জানি না। আমি কিছু করিনি।’ শোনা যায়, টেবিলের উলটো দিকে বসা দুই পরীক্ষক ক্ষোভে, দুঃখে মাথা নাড়তে থাকেন। দুজনের একজন মধুজা রায়ের পুরোনো শিক্ষক। অন্যজন নাকি সেদিন সকালে ‘ফোন’ পেয়েছিলেন। ‘বর’ পাওয়ার মতো। তবে পরীক্ষক ভদ্রলোক কার ‘ফোন’ পেয়েছিলেন, সেই ফোনে তিনি কী বার্তা পেয়েছিলেন জানা যায়নি। কখনও জানা যাবেও না। গসিপের সবটা জানা যায় না। তাই নিয়ে মাথা ঘামাতে নেই। সত্যি ঘটনা হলে একটা কথা ছিল। যাই হোক, ফোন পাওয়া পরীক্ষক বললেন, ‘ছি ছি। একজন মেধাবী ছাত্রীকে এরকমভাবে হেনস্থা! ছি ছি। দেশে শিক্ষা-ব্যবস্থার এ কী বিশ্রি অবস্থা হল! এই ঘটনার ইনভেস্টিগেশন হওয়া উচিত।’

তদন্তের কথা শুনে মধুজা রায় নাকি আরও জোরে কেঁদে উঠেছিলেন।

‘ফোন’ পাওয়া পরীক্ষক মধুজা রায়ের পিঠে হাত রেখে বললেন, ‘কেঁদো না…কেঁদো না…কেঁদো না…আমরা তো আছি…তুমি এসো। তোমার ইন্টারভিউ শেষ।’

যারা এই গসিপ নিয়ে চর্চা করে তারা বলে, মধুজা রায় নাকি শেষ মুহূর্তে রেফারেন্স বইয়ের তালিকা অতিরিক্ত দীর্ঘ করবার জন্য কয়েকজনকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, বানিয়ে বানিয়ে ক’টা নাম লিখে দিলেই চলবে। তারা লেখাপড়া লাইনের লোক নয়। হড়বড় করে মাসি, পিসির, দাদুর কাছ থেকে বইয়ের নাম জোগাড় করে লিখে দিয়েছে। তাতেই কেলেঙ্কারি। কেলেঙ্কারি নিয়ে নাড়াঘাঁটা হয়নি। তিনি ছিলেন পুরোনো গভর্নমেন্টের কাছের মানুষ। গভর্নমেন্ট বদলের সঙ্গে তিনি দল বদলেছেন। সবাই জানে আবার যদি গভর্নমেন্ট বদলায় আবার তিনি আগের পার্টি অফিসে ছুটবেন। গাড়ি রাখবেন দূরে। হাঁপাতে হাঁপাতে উঠবেন দোতলায়। হাতে লাল গোলাপের স্তবক।

‘এতদিন বুকের ভিতরে জ্বালা নিয়ে বসেছিলাম দাদা। আজ সেই জ্বালা জুড়োল। এই ফুলটুকু আমার বুকের রক্ত। আপনার পায়ে নিবেদন করতে নিয়ে এসেছি।’

আর্টস ডিপার্টমেন্টের চারতলায় মধুজা রায় একটা আলাদা ঘরে বসেন। সতেরোটা কমিটির কাজ তাঁকে করতে হয়। সবার সঙ্গে বসে অত কাজ হয়? তা ছাড়া বেশিরভাগ কাজই তো গোপন। এই কারণে ইউনিভার্সিটি তাঁকে ঘর দিয়েছে। সেই ঘরের দরজায় বারিধারা এসে দাঁড়াল।

‘ম্যাডাম আসব?’

মধুজা রায় কাগজপত্র থেকে মুখ তুলে বারিধারাকে দেখলেন। চোখ থেকে চমশা খুললেন।

‘এসো, বারিধারা।’

যতই টিচার হোন না কেন, এই মহিলাকে বাকি ছেলেমেয়েদের মতো বারিধারাও পছন্দ করে না। ‘শ্রীমতী ধান্দা রায়’ তাকে আলাদা কারে ডাকলেন কেন! তার ওপর লবদার মুখও গম্ভীর। কী ঘটল? মধুজা রায় চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, ‘পরীক্ষার প্রিপারেশন কেমন হচ্ছে বারিধারা?’

বারিধারার ভুরু কুঁচকে গেল। হঠাৎ দরদ! এভাবে তো কখনও ডেকে জিগ্যেস করেন না। বরং পেয়ারের ছেলেমেয়ে ছাড়া অন্য কেউ কাছে গেলে হাত-টাত নেড়ে, ‘ব্যস্ত আছি’ বলে ভাগিয়ে দেয়।

‘অল্প অল্প করে হচ্ছে ম্যাম।’

মধুজা রায় মাথা দুদিকে নাড়িয়ে বললেন, ‘অল্প অল্প করলে তো হবে না বারিধারা। তুমি ভালো ছাত্রী। ভালো রেজাল্ট করতে হবে।’

বারিধারা আরও অবাক হল। পিওন পাঠিয়ে ক্যান্টিন থেকে ডেকে এনে উপদেশ! আসল কথাটা কী?

‘পড়লেও সবসময় তো রেজাল্ট ভালো হয় না ম্যাম। হয়তো ঠিকমতো লিখতে পারি না।’

মধুজা রায় এবার স্মিত হাসলেন। বললেন, ‘রেজাল্ট যাতে ভালো হয় তার জন্য তো আমি আছি। তোমাদের একটা পেপার আমার হাতেই আছে। আর একটার প্রশ্নও তো আমাকে সেট করতে হয়। এসব  কথা বাইরে বলার মতো নয়। কনফিডেন্সিয়াল। তোমাকে বললাম, কারণ তুমি ভালো মেয়ে। গুড স্টুডেন্ট। ভালোদের যাতে আরও ভালো হয় সেটা দেখাই তো একজন টিচরের কাজ। তাই না?’

কথা শেষ করে আবার হাসলেন মধুজা রায়। বারিধারা চুপ করে রইল। ওনার এইসব কনফিডেন্সিয়াল কথা সবাই জানে। উনিই বলে বেড়ান। নইলে ছেলেমেয়েরা তাঁকে সমঝে চলবে কেন? বারিধারা চুপ করে রইল।

মধুজা রায় এবার মুখ থেকে হাসি মুছে বললেন, ‘তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারলে বারিধারা?’

বারিধারা হালকাভাবে ঘাড় নাড়ল। মধুজা রায় বললেন, ‘তোমার যদি কোথাও আটকে যায়…এই ধরো সাজেশনস, নোটস, বই… শুধু আমার পেপারের জন্য নয়…অন্য কারওটা আটকালেও আমাকে স্বচ্ছন্দে বলতে পারো…।’

এত লোভ দেখাচ্ছে! ব্যাপারটা কী? বারিধারা অস্ফুটে বলল, ‘বলব ম্যাম।’

মধুজা রায় টেবিলের ওপর খুলে রাখা চশমাটা তুলে চোখে দিলেন। বারিধারার চোখে চোখ রেখে ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ‘সুদর্শনের সঙ্গে তোমার কী হয়েছে বারিধারা? এনি প্রবলেম?’

বারিধারা ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কে সুদর্শন ম্যাম?’

‘যাকে তুমি খানিক আগে চড় মেরেছ।’

বারিধারা একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘আমার সঙ্গে কোনও প্রবলেম হয়নি ম্যাম।’

মধুজা রায় বললেন, ‘তা হলে তুমি তাকে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে সবার সামনে চড় মারলে কেন?’

বারিধারা চুপ করে রইল। মধুজা রায়ের গলায় এবার রাগ জোরালো হল। হিসহিসিয়ে বললেন, ‘যার সঙ্গে তোমার কোনও সমস্যা হয়নি তাকে তুমি কোন সাহসে এত বড় অপমান করলে বারিধারা?’

এতক্ষণে মধুজা রায়ের ডেকে পাঠানোর কারণ বুঝতে পারল বারিধারা। বারিধারা মনকে শক্ত করল।

‘আমার এক বন্ধুকে ওই ছেলেটি বিশ্রী অপমান করেছে। অনেকের সামনেই করেছে।’

মধুজা দাঁতে দাঁত চেপে ধমকের ঢঙে বললেন, ‘তোমার বন্ধুকে কী করেছে আমি জানতে চাই না বারিধারা, আমি জানতে চেয়েছি তোমাকে কিছু করেছে কি না। সুদর্শনের একজন রিলেটিভ কলেজে আমার ব্যাচমেট ছিল। আমার খুবই বন্ধু। সুদর্শনের দাদার সঙ্গে আমার সেই বন্ধুর বিয়ে হয়েছে। এ সবের থেকেও বড় কথা, এখন সে একজন খুবই ইনফ্লুয়েন্সিয়াল লেডি। পলিটিক্যাল এবং সোশ্যাল কানেকশন হাইলি স্ট্রং। এডুকেশন ডিপার্টমেন্টের বহু অফিসার তার হাতের মুঠোয়। সে অনেক গোলমাল করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। আমাকে ফোন করেছিল। তুমি চড় মারবার পরই ওই ছেলে তার রিলেটিভকে ফোন করে।’

মধুজা রায় দম নেওয়ার জন্য চুপ করলেন। বারিধারার কাছে এখন সবটা জলের মতো স্পষ্ট হল। মধুজা রায় প্রথমেই তাকে মনে করিয়ে দিয়েছে, পরীক্ষার রেজাল্টের ব্যাপারে তিনি কত ক্ষমতাশালী। এখন ধমক দিচ্ছে।

‘চুপ করে আছ কেন বারিধারা? স্পিক আউট। বলো, মানিনীর দেওর তোমাকে কী করেছে? গালাগালি দিয়েছে? ইনসাল্ট করেছে? মলেস্ট করেছে? রেপ করেছে? দেন?’ একটু থমকালেন মধুজা রায়। হাঁপিয়ে নিলেন। বললেন, ‘মানিনী এটা নিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত যেতে চাইছে। ভিসির কাছে কমপ্লেইন তো বটেই, থানায় ডায়েরিও করতে চায়। যেহেতু সুদর্শন তোমাকে কিছু করেনি, খুব সহজেই তুমি ফাঁসবে। ইউনিভার্সিটি থেকে সাসপেন্ড তো হবেই, থানা-পুলিশও করতে হবে। পরীক্ষার আগে তোমার কেরিয়ারের পক্ষে একটা বিরাট ধাক্কা হবে। যদি তুমি ভাবো, অন্য ছেলেমেয়েদের তাতিয়ে হট্টগোল পাকাবে, লিডার হবে, সেটাও লাভ হবে না। কতদিন হট্টগোল চালাবে? সবাই কেরিয়ার নিয়ে ব্যস্ত। একটা সময় দেখবে, পলিটিক্যাল পার্টিগুলো তোমাকে ধরে নিজেদের ফায়দা করে নিয়েছে। তুমি ছিবড়ে হয়ে পড়ে আছ। চারপাশে দেখছ না? যদিও আমি চাই না এ সব হোক। ঘটনা এখানেই মিটে যাক। আমি যা বলব তাই করো বারিধারা। তোমার ভালোর জন্যই করো।’

বারিধারা মাথা নামিয়ে বলল, ‘কী করতে হবে?’

মধুজা রায় খানিকটা শান্তভাবে বললেন, ‘তুমি ওই ছেলের কাছে ক্ষমা চাইবে। কালই আমি তাকে ডাকব। মানিনীকেও আসতে বলব। তুমি প্রকাশ্যে অসভ্যতা করেছ। কিন্তু আমি এই ঘরের মধ্যেই বিষয়টা মিটিয়ে দিতে চাই। তোমার  কথা ভেবেই চাই। এই ঘরে তুমি ওই ছেলের পায়ে ধরে ক্ষমা চাইবে।’

বারিধারার শরীর কেঁপে উঠল। বলল, ‘ম্যাডাম, ওই ছেলে তিথিকে খুব নোংরা কথা বলেছে। খুব নোংরা।’

মধুজা রায় শান্ত গলায় বললেন, ‘কী কথা?’

‘মুখে আনা যায় না।’

মধুজা রায় হিসহিসে গলায় বললেন, ‘তা হলে বলছ কেন?’

বারিধারা বলল, ‘আমি তো বলিনি। চড় মেরেছি।’

মধুজা রায় টেবিল চাপড়ে হুঙ্কার দিলেন, ‘শাট আপ।’ তারপরে নিজেকে সামলে বললেন, ‘বুধবার তিনটের সময় এই ঘরে এসে তুমি ক্ষমা চাইবে। এটাই আমার শেষ কথা। এখন যেতে পারো।’

মধুজা রায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে বারিধারার মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। সে বুঝতে পারছে একটা বিরাট ঝামেলার মধ্যে পড়ে গেল।