» » দ্বিতীয় কিস্তি

বর্ণাকার

প্রচেত গুপ্ত

একটু পরে রোদ উঠবে

পনের

এতদিন আমরা আপনাদের শিখিয়েছি। এবার আপনাদের পালা। আপনারা আমাদের শেখাবেন। —যোশেফ স্টালিন।

অর্চিন দাঁড়িয়ে পড়ল। এই নিয়ে কতবার যে কথাটা সে পড়েছে তার কোনও ইয়ত্তা নেই। গত তিন বছর ধরে যখনই সে শেখর গুপ্তর বাড়িতে আসে তখনই একবার করে পড়ে। তার ভালো লাগে।

শুনলে মনে হচ্ছে, এটা কোনও পোস্টার বা দেওয়ালের লেখা। শেখর গুপ্ত নামে কারও বাড়ি যাতায়াতের সময় অর্চিনের চোখে পড়ে। ঘটনা সেরকম নয়। এটা পোস্টার নয়। দেওয়ালেও লেখা হয়নি। লেখা হয়েছে শেখর গুপ্তর বাড়ির দরজায়। একটা কাগজের টুকরোয় লিখে দরজার গায়ে লাগানো। কম্পিউটারে টাইপ করা কাগজ। চারপাশে যত্ন করে বাদামি রঙের সেলোটেপ। রোদে, জলে লেখা নষ্ট হলে আবার নতুন কাগজ লাগানো হয়। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, জীর্ণ রংচটা, পলকা দরজার গায়ে নেমপ্লেট। নাম, ঠিকানা লেখা আছে। কাছে গেলে ভুল ভাঙবে। প্রথম প্রথম সবাই অবাক হত। বাড়ির দরজায় এসব কী লেখা! হাসাহাসিও করত। শেখর গুপ্তকে জিগ্যেস করত।

‘এর মানে কী!’

শেখর অবাক হয়ে বলত, ‘কেন! সহজ বাংলায় লেখা আছে। মানে না বোঝার তো কোনও কারণ নেই। এতদিন আমরা শিখিয়েছি, এবার তোমরা শেখাবে।’

‘এসব কাকে বলছ শেখর।’

শেখর বলছে, ‘জনগণকে। নিজের বাড়ির দরজা দিয়ে শুরু করেছি।’

‘চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম?’

রসিকতা। খানিকটা অপমান মেশানো রসিকতা। শেখর গুপ্ত চুপ করে থেকেছে। সে অপ্রয়োজনীয় কারণে রাগে না। ঠাট্টা, ব্যঙ্গ, অপমান অবজ্ঞা করতে পারে। মুখে বলে, অপমান করবার জন্য যোগ্যতা লাগে। যে যোগ্য নয়, তার অপমান গায়ে মাখবার কারণ নেই।

‘তোমরা ক্ষমতা থেকে সরে গেছ বলে এসব লিখেছ নাকি শেখর?’

শেখর বলে, ‘পুরোটা তাই না হলেও, খানিকটা তো তাই বটে।’

এরপরই প্রশ্নকর্তা ব্যঙ্গের সুরে হেসে বলত, ‘এতে পাপস্খালন হবে? তোমাদের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ফিরবে?’

শেখরও মৃদু হেসেছে। বলেছে, ‘পাপস্খালনের প্রশ্ন কোথা থেকে আসছে? আমাদের পার্টিতে পাপ-পুণ্যের কোনও জায়গা নেই। একেকটা পরিস্থিতিতে একেকরকম শিক্ষার মধ্যে দিয়ে আমাদের চলতে হয়। বামপন্থায় সেটাই নিয়ম। তবেই এগিয়ে চলা যায়। নইলে তো থমকে থাকতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতি যা, তাতে এভাবেই আমাদের চলা উচিত। মানুষের  কথা শুনতে হবে। তাদের কাজ থেকে শিখতে হবে। আমাদের ঠিক, ভুল তারা বলবে।’

‘তা বলে নিজের বাড়ির দরজায় নোটিস লাগিয়ে শিখতে হবে?’

শেখর আবার হাসে। বলে, ‘অসুবিধে কী? আমি তোমার কাজ থেকে শিখব এটা প্রকাশ্যে বলায় কোনও লজ্জা আছে নাকি?’

তিন বছর ধরে দরজায় এই কাগজ সাঁটা। পার্টি ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার কয়েক মাস পরেই শেখর গুপ্ত এই কাণ্ড করেছে। বাড়িতে যাদের আসা-যাওয়া তারা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তবে নতুন কেউ এখনও অবাক হয়। দরজায় স্ট্যালিনের বাণী সাঁটার ব্যাপারে তমসার আপত্তি ছিল। স্বামীর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে সে কখনওই নাক গলায় না। বহু বছরের অভ্যেস। একটা সময়ে সেও পার্টির খুব কাছে ছিল। মহিলা ফ্রন্টে। সমিতির ওপর দিকেই ছিল। পরে দু-একজনের সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় সরে আসে। পার্টি অবশ্য তমসাকে ছাড়তে চায়নি। বোঝাতে চেষ্টা করেছিল।

‘আদর্শ, বিশ্বাস, লক্ষ্য অনেক বড়। দু-পাঁচজনের সঙ্গে মতের অমিল অনেক ছোট জিনিস। তার জন্য দল থেকে সরে আসার কোনও কারণ নেই। আপত্তি, প্রশ্ন, প্রতিবাদ নিয়ে দলের ভিতর লড়তে হয়।’

তমসা সেই সময়কার পার্টি লিডারশিপকে বলেছিল, ‘মতের অমিল যদি কোনও ইস্যু নিয়ে হত, তাহলে অন্য কথা ছিল। আমার বিশ্বাসে ধাক্কা লেগেছে। দলের মধ্যে যারা ক্ষমতাবানদের গা ঘেঁষে চলে তারা একরকমভাবে কাজ করবে, আর যারা দূরে দূরে থাকে তারা অরেকরকম কাজ করবে, এই নীতি আমি মানতে পারছি না।’

‘বসে মিটিয়ে নাও তমসা। কথা বলো।’

তমসা বলেছিল, ‘অনেকবার বসেছি। আশ্বাস পেয়েছি, কাজ পাইনি।’

‘এত ছোট কারণে এত বড় একটা স্বপ্ন বাতিল করে দেবে। তুমি তো আর নেতানেত্রীর মুখ দেখে পার্টি করতে আসোনি, মানুষদের মুক্তির স্বপ্ন দেখে এসেছ।’

তমসা এরপরেও রাজি হয়নি। বলেছিল, ‘আমি স্বপ্নকে বাদ দিচ্ছি না। পার্টিকেও না। আমার আজও বিশ্বাস এই পার্টি পারবে সমাজ বিকাশের মধ্যে দিয়ে মানুষের মুক্তির পথ দেখাতে। আমি পার্টির সঙ্গে ঝগড়া করছি না। শান্তিপূর্ণভাবে বিচ্ছেদ নিচ্ছি। এখনও মেম্বারশিপ পাইনি। ফলে জটিলতা কিছু নেই। তাছাড়া আমার ছেলেটা খুব ছোট। তাকে বাড়িতে ফেলে প্রাোগ্রামে আসতেও পারি না। এখন তো সমিতিতে লোকের অভাব হবে না। আমার মতো দু-পাঁচজন কে থাকল কি না থাকল তাতে কিছু এসে যায় না। আবার যখন প্রয়োজন মনে করব নিশ্চয় ফিরে আসব।’

এরপর আর তমসাকে নেতৃত্ব কিছু বলেনি।

মহিলা ফ্রন্টে কাজ করতে করতেই শেখরের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল তমসার। শেখর তখন ব্রাঞ্চের সেক্রেটারি। রাতদিন পার্টি অফিসে পড়ে থাকে। একনিষ্ঠ, সিরিয়াস, সৎ নেতা। পরিশ্রম করে খুব। তার হাবভাব আচার আচরণ দেখলে বোঝা যেত না পার্টি সরকারে আছে। কেউ কখনও তার দিকে আঙুল তুলতে পারেনি। সংগঠনে খুব জোর দিত। মাঝে মাঝেই মহিলা, ছাত্র, যুব শাখার সদস্যদের ডেকে বকাবকি করত।

‘কমরেড আপনারা কী চান? পার্টিটা উঠে যাক? আমরা সবাই মিলে সরকারে চলে যাই? মন্ত্রী হয়ে রাইটার্স বিল্ডিয়ে গিয়ে বসি? সরকারটা কীসের জোরে দাঁড়িয়ে আছে আপনারা জানেন না? দাঁড়িয়ে আছে আমাদের সংগঠনের জোরে। ফ্রন্টাল অর্গানাইজেশন যদি অ্যাক্টিভ না থাকে, পার্টিও চলতে পারে না। সরকারও টিকতে পারে না। আপনাদের দেখে অবাক লাগে। আপনারা যেন বুঝে গেছেন, গণসংগঠন করবার জন্য পরিশ্রম করতে হবে না। পার্টি গভর্নমেন্টে রয়েছে, সেই লোভে সবাই ছুটে আসবে। ছাত্র, যুব, মহিলাদের মিটিং-মিছিলে ভিড় হবে। তাই হচ্ছেও। ভিড় দেখেই আপনারা খুশি। অথচ আপনারা জানেন, এর মধ্যে অনেকটাই ভুষি। বেনোজল। কিছু পাওয়ার জন্য ভিড় করে। সরকারি সুবিধে, চাকরি, কন্ট্রাক্টরি, বদলি, প্রাোমোশন। যদিও আমি তাদের এই ছুটে আসাটাকে অন্যায় বলে মনে করি না। এই দেশে একজন দরিদ্র, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষের যা প্রাপ্য, তা সে পায় না। সে তার প্রয়োজন মেটাতে অসহায়ের মতো সর্বত্র ছুটে বেড়ায়। আমাদের কাছে রিলিফের জন্য আসে। যেহেতু আমাদের সরকার পার্টির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, তাই পার্টির কাছেই মানুষ আসবে। অনেকে সমালোচনা করেন, পার্টির ব্রাঞ্চ অফিস, লোকাল অফিস সরকার চালাচ্ছে। আমরা কেউ কেউ এই সমালোচনা শুনে মুষড়ে পড়ি। লজ্জা পাই। কারণ নিজেদের সম্পর্কে আমাদের ধারণা স্পষ্ট নয়। আমরা কী, কেন সেটাই আমরা ভালো করে জানি না। আমার তো গর্ব হয়। দরিদ্র পার্টির সরকার তো এরকমই হবে। আমরা নীতি আদর্শ দিয়ে সরকার গড়েছি। মানুষ তো পার্টি অফিসে আসবেই। সাধারণ, গরিব মানুষের কাছে পার্টিই সরকার। আর আপনারা সকলে সরকারের একেকটা পার্ট, অংশ। এইসব সমালোচনায় মুষড়ে পড়বার কিছু নেই। নিজেদের মনকে পরিষ্কার রাখুন। নিজেরা কোনও লোভে জড়িয়ে পড়বেন না। আপনার কাছে যে আসছে তাকে নিয়ম মেনে সাহায্য করতে পারলে করবেন। বুক ফুলিয়ে করবেন। কিন্তু একই সঙ্গে তাকে পার্টির আদর্শে, নীতিতে শিক্ষিত করবার চেষ্টা করতে হবে। গণসংগঠন এই কাজ করতে পারে। যারা ভুষি, বেনোজল তারা সরে যাবে। যাক। আপনারা দশ জনে একজনকে নিজেদের সংগঠনে আনুন। ভিড় বাড়াবার জন্য নয়, নীতি, আদর্শের জন্য। আপনারা এই কাজ সিরিয়াসলি করছেন না।’

তমসা মানুষটার প্রেমে পড়ে যায়। শেখর পার্টির হোলটাইমার। পার্টির দেওয়া লেভিটুকুই আয়। তমসা চাকরির জন্য উঠেপড়ে লাগল। সে লেখাপড়ায় ভালো। পরীক্ষা দিয়ে স্কুলে চাকরি পেয়ে গেল। অনেকে বেঁকাভাবে বলল, পার্টির কাছের লোক তাই চাকরি জুটে গেল। তমসা এসব কথায় পাত্তা দিল না। সে জানে, পার্টিতে এ ধরনের বেঁকা  কথা বলার মতো মানুষ যেমন আছে, তেমন লেখাপড়ায় ভালো, কাউকে ধরাধরি না করে, পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পাওয়ার মতো লোকও প্রচুর আছে। এসব কথা গায়ে মাখবার কিছু নেই।

তমসাই বিয়ের জন্য শেখরকে প্রস্তাব দিয়েছিল।

‘আমার সঙ্গে সংসার করতে পারবে?’

তমসা বলেছিল, ‘জানি না সংসার কাকে বলে, তবে তোমার পাশে থাকাটা যদি সংসার করা হয়, তাহলে পারব।’

‘আমি কিন্তু রাজনীতি নিয়েই থাকব।’

তমসা বলেছিল, ‘সেই কারণেই তো তোমাকে বিয়ে করতে চাই।’

‘অনেক ঝামেলা। অনেক কষ্ট।’

তমসা বলেছিল, ‘এটা আর নতুন কথা কী? ঝামেলার মানুষকে ভালোবাসলে কষ্ট তো পেতেই হবে।’

‘পার্টি এখন পাওয়ারে। কিন্তু আমি কখনও কোনও সুযোগ-সুবিধের মধ্যে দিয়ে যাইনি, যাব না। আমি একা নই, আমার মতো এরকম বহু কমরেড আছে, তারা আমার থেকেও অনেক কষ্টে জীবনযাপন করে। তাদের কথা আমরা জানতে পারি না। গুটিকয়েক শহুরে সুবিধাভোগীকে দেখে পার্টির বিচার করি। আমি কিন্তু এই জীবন থেকে সরতে পারব না তমসা।’

তমসা বলে, ‘জানি। জানি বলেই তোমার পাশে থাকতে চাই। একজন ভালো মানুষের সঙ্গে থাকবার আনন্দ টাকাপয়সার কষ্টের থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী। অনেক বেশি আকর্ষণীয়। আমি সেই আকর্ষণ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চাই না।’

বিয়ে হল। তারপর একসময় পার্টি থেকে দূরেও সরে গেল তমসা। এই নিয়ে শেখর তাকে জোর করেনি। তবে কেউ কেউ ফের বিদ্রুপ করেছে। বলেছিল, ‘মেয়েটা চালু। চাকরি, বর জুটিয়ে নিয়ে কেটে পড়ল।’ তবে সেই কথা বেশি দূর এগোতে পারেনি। শেখরের মতো সৎ, স্বচ্ছ মানুষকে জড়িয়ে বেশিদিন খারাপ কথা চালানো মুশকিল। যারা প্রসঙ্গটা তুলেছিল, তারাই দ্রুত চুপ করে গেল। তমসাই দরজায় সাঁটা কাগজ নিয়ে স্বামীর কাছে আপত্তি তুলেছিল।

‘এইসব বাড়ির দরজায় না লাগালেই নয়?’

শেখর বলেছিল, ‘কেন নয়? না লাগালেও চলে।’

তমসা অবাক হয়ে বলল, ‘না লাগালে যদি হত, তাহলে লাগিয়েছ কেন?’

শেখর বলল, ‘দুটো কারণে। না, দুটো নয়, তিনটে কারণে তমসা। এক নম্বর হল, সরকার থেকে সরে গিয়েছি মানেই আমাদের কাজ শেষ হয়ে গেছে, আমরা সব গালে হাত দিয়ে বসে থাকব এটা একেবারেই ঠিক নয়। আমাদের নতুন করে কাজ শুরু হল, শেখবার কাজ। এতদিন যে কাজটা আমরা করতে পারিনি। পারা সম্ভবও ছিল না। এত বছরের একটা সরকার গন্ধমাদন পর্বতের মতো আমাদের ঘাড়ের ওপর বসেছিল। তাকে সামলাতেই গোটা পার্টিটার অনেক সময় চলে গেছে। দু-নম্বর কারণ, আমি।’

তমসা অস্ফুটে বলল, ‘আমি।’

শেখর বলল, ‘হ্যাঁ আমি। আমি নিজে যেন ঘরে ঢুকতে-বেরোতে কথাটা মনে রাখি। শুধু কমরেডদের বললাম, আর আমি নিজের মতো চললাম, তা যেন না হয়।’

তমসা বলল, ‘তা হলে দরজার বাইরে? ঘরেও রাখা যেত। এটা কি বাড়াবাড়ি নয়?’

শেখর সামান্য হেসে বলেছিল ‘অবশ্যই বাড়াবাড়ি তমসা। আমাদের এখন বাড়াবাড়িই করা দরকার। যা বলবার জোর গলায় বলতে হবে। আমি ভয় পাইনি, একথাটা পার্টি, সমর্থকদের জানাবার জন্যই নিজের বাড়ির দরজায় লিখে দিয়েছি। আমি জানি, এই মুহূর্তে যা পরিস্থিতি তাতে এর জন্য বাড়িতে হামলা হতে পারে। আমি সামান্য একটা কাগজ বাড়ির দরজায় সাঁটতে ভয় পাব? এটাই স্বাভাবিক তমসা। এতদিন একটা সিস্টেম চলছিল। সেটা নড়েছে। তার জন্য কিছু ক্ষয়ক্ষতি তো হবেই।’

তমসা একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘আর তিন নম্বর কারণ?’

শেখর একটু চুপ করে থেকে হাসল। বলল, ‘লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট। আমি কমরেড স্তালিনের প্রসঙ্গ এনে নতুনের একটু নাড়া দিতে চাইছি। এটা পার্টিতে সম্ভব নয়। পার্টি অ্যাপ্রুভ করবে না। তাই নিজেকে দিয়ে খুব ছোটভাবে শুরু করলাম। আমি বিশ্বাস করি, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কমিউনিস্ট নেতারা, বিভিন্নভাবে উন্মোচিত হন। যুগে যুগে হয়েছেন। কমরেড স্তালিনের কিছু  কথা এখন খুব সময়োপযোগী। যেমন এই শিক্ষার প্রসঙ্গ।

তমসা অবাক হয়ে বলেছিল, ‘তা বলে স্তালিন!’

শেখর বলেছিল, ‘অবশ্যই। কমরেড স্তালিনের সাফল্যকে ছোট করে দেখবার ক্ষমতা কারও নেই। তাঁর নেতৃত্বেই বুর্জোয়া গণতন্ত্রকে ভেঙে গুঁড়িয়ে শ্রমিকের সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এটা খুব বড় কথা। গণতন্ত্র কার হাতে থাকবে। এখানেই দেখো না। মধ্যবিত্ত, বুর্জোয়া স্ট্রাকচার থেকে উঠে আসা অনেকেই পার্টিতে উচ্চস্থান পেয়েছেন। এটার ভালো দিক যেমন আছে, তেমন মন্দ দিকও আছে। আদর্শকে সরিয়ে ব্যক্তিপুজো বড় হয়ে ওঠে।’

তমসা নীচু গলায় বলে, ‘এখানেও কি তা হয়নি? ব্যক্তি নিয়ে আমরা লাফালাফি করিনি?’

শেখর বলল, ‘অস্বীকার করছি না। কিছু হয়তো হয়েছে। তবে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে এটা নতুন কিছু নয়। বারবার ঘটেছে। এই চ্যুতি শুদ্ধ মার্কসবাদের ছদ্মবেশে বহুবার আধিপত্য কায়েম করতে চেয়েছে। পেরেওছে। আসলে কী জানো তমসা, মার্কসবাদ চিরকালই আগুনের মধ্যে দিয়ে চলে। যাকে বলে অগ্নিপরীক্ষা। এক সময় যেটা ঠিক, সত্য, অন্য সময়ে সেটাই মিথ্যে ভুল হয়ে যায়। মার্কসবাদের এই দ্বন্দ্ব, দ্বিধা চিরন্তন। তার মধ্যে থেকেই অমৃতকে খুঁজে নিতে হবে। সেই অমৃতই হল মানুষের হাতে ক্ষমতা। আমাদের এখানে এটা সত্য। ব্যক্তির মূর্তি ভাঙা যায়। মানুষটাকে ভাঙা যায় না।

তমসা আর দরজায় সাঁটা কাগজ নিয়ে আপত্তি করেনি। বরং গত দুবছর হল সে আবার পার্টির কাজে খানিকটা করে সময় দিচ্ছে। বারো বছরের ছেলে শান্ত। তাকে সবসময় নজরে রাখতে হয় না। তমসা মনে করে, এখন শুধু ঘর-সংসার নয়, বাইরে বেরিয়ে কাজের সময় এসেছে।

অর্চিন তার ‘শেখরদা’র দরজায় কড়া নাড়ল। সেও মনে করে, এখন শুধু নিজের কেরিয়ার গুছিয়ে ‘গুডবয়’ হওয়ার সময় নয়, মাঠে নেমে কাজ করবার সময় এসেছে। সে সব ছেড়ে দিয়ে সর্বক্ষণের রাজনৈতিক কর্মী হতে চায়।