» » দ্বিতীয় কিস্তি

বর্ণাকার

প্রচেত গুপ্ত

একটু পরে রোদ উঠবে

তের

কর্ণিকা বুঝতে পারছে, আজ তার চাকরি চলে যাবে। গত তিন দিন ধরে তার প্রায়ই এরকম মনে হয়। কিন্তু আজ একেবারে নিশ্চিত। কেউ ঠেকাতে পারবে না। আজ তার অপরাধ সীমাহীন।

চাকরি চলে গেলে কর্ণিকা খুবই সমস্যার মধ্যে পড়বে। বাড়িতে রোজগেরে মানুষ একমাত্র সে। বাবা অসুস্থ হয়ে গত তিন বছর ঘরে। একটা নড়বড়ে চাকরি ছিল, সেটাও গেছে। এখন যে বেরিয়ে নতুন করে আবার কাজ খুঁজবে, সে মনের জোর নেই। অনেক গোঁতাগুঁতির পর ক’দিন বেরিয়েছিল। ফিরে এসেছে। ভাই স্কুলে পড়ছে। মা কোনওদিন বাইরে কাজকর্ম করেনি। এই অবস্থায় তার চাকরি চলে যাওয়া একটা বড় ধাক্কা। কিন্তু কিছু করবার নেই। ঘটনা অবশ্যম্ভাবী। কর্ণিকা জানে, লাঞ্চের পর সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের কর্মচারী বিষয়ক ম্যানেজার তাকে ঘরে ডেকে পাঠাবেন। তার পর কী কী ঘটবে, তা সিনেমার মতো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে।

‘স্যার আমাকে ডেকেছেন?’

এই ম্যানেজার বয়স্ক এবং ভালোমানুষ। মনের ভাব গোপন রাখতে পারেন না। হাবভাবে দেখিয়ে ফেলেন। রাগ হলে রাগ, খুশি হলে খুশি। ভদ্রলোক থমথমে মুখে বললেন, ‘হ্যাঁ ডেকেছি।’

কর্ণিকা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে। ম্যানেজার মুখ না তুলে বলবেন, ‘দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন।’

এই ভদ্রলোক অফিসের সবাইকেই ‘আপনি’ সম্বোধন করেন। শুধু বয়সে ছোট নয়, পদে ছোট হলেও তিনি সম্বোধনে ফারাক করেন না। অফিসারকে যা বলেন, পিওনকেও সেইভাবে কথা বলেন। কর্ণিকার বয়স পঁয়ত্রিশ বছর দু’মাস। সে চাকরির প্রথম দিকে ‘আপনি’ সম্বোধন না করবার জন্য এঁর কাছে আবেদন জানিয়েছিল। আবেদন গ্রাহ্য হয়নি।

আজ ম্যানেজারের ঘরে ঢুকে কর্ণিকা ভয় পাবে। অফিসের বসেরা যখন ঘরে ডেকে থমথমে মুখে বসতে বলেন, তখন বুঝতে হয় সমস্যা আছে। বিপদ আসছে। সে জড়সড় হয়ে চেয়ারে বসবে। কর্মচারী বিষয়ক ম্যানেজার ভদ্রলোক হাতের ফাইলগুলো নাড়াচাড়া করবেন, কম্পিউটারের কি-বোর্ড টিপবেন, তার পর কর্ণিকার চোখের দিকে তাকাবেন।

‘একটা খারাপ খবর আছে কর্ণিকা।’

কর্ণিকা জানে কী খবর। তার পরেও চমকে উঠবে। কাঁপা গলায় বলবে, ‘কী স্যার? কী খবর?’

ম্যানেজার খবর বলবেন না। তবে এই প্রথম সম্বোধন বদলাবেন। ‘আপনি’র বদলে ‘তুমি’। স্নেহের কারণেই করবেন। নরম গলায় বলবেন, ‘চিন্তা কোরো না কর্ণিকা। তোমার বয়স কম। কেরিয়ার সবে শুরু করেছ। ভবিষ্যতে অনেক বড় বড় কাজের অফার তোমার কাছে আসবে। রিলিজ অর্ডারে তোমার সম্পর্কে আমরা ভালো কথা লিখে দেব। শি ইজ এক্সেলেন্ট। কাজ পেতে অসুবিধে হবে না।’

কর্ণিকা অস্ফুটে বলবে, ‘স্যার…স্যার…।’

ম্যানেজার ভদ্রলোক গলা খাকারি দিয়ে বলবেন, ‘সরি কর্ণিকা। তোমাকে সেন অ্যাসোসিয়েটস আর কনটিনিউ করতে পারছে না। এটাই তোমার লাস্ট মান্থ। কাল থেকেই তুমি ছুটিতে চলে যাও। এ মাসের ফুল স্যালারি তুমি পাবে।’

কর্ণিকা কাতর গলায় বলবে, ‘স্যার, চাকরি চলে গেলে আমি খুব বিপদে পড়ে যাব। বাড়িতে আমিই একমাত্র উপার্জন করি স্যার।’

ম্যানেজার একটু চুপ করে থেকে বলবেন, ‘সরি কর্ণিকা, আমার কিছু করার নেই। দিজ ইজ হায়েস্ট লেভেল অর্ডার। তুমি বুঝতে পারছ?’

কর্ণিকা মাথা নামিয়ে বলবে, ‘পারছি স্যার।’

চাকরি চলে যাওয়ার এই ভয়ঙ্কর কল্পনা কর্ণিকাকে মাঝে-মাঝেই করতে হয়। এক-একদিন এক-একটা কারণ থাকে। আজ কারণ হল ঘাম। কর্ণিকার মনে হচ্ছে, সে কুলকুল করে ঘামছে। এখনই কপাল থেকে সেই ঘাম টপ করে টেবিলের ওপর রাখা নোটখাতার ওপর পড়বে। এতক্ষণ ধরে ডিকটেশন শুনে যা লিখেছে, সব ঝাপসা হয়ে যাবে। বাইরে গিয়ে কিছুই পড়তে পারবে না। চিঠি ভুল টাইপ করবে এবং সেই অপরাধে তার চাকরি চলে যাবে।

কোম্পানির মালিকের ডিকটেকশন যদি তাঁর সেক্রেটারির ঘাম ঘুছে দেয়, তাহলে তার চাকরি থাকতে পারে?

যদিও ঘটনা একেবারেই ঠিক নয়। ঘরে এয়ারকন্ডিশন মেশিন চলছে। ফুসফুস করে আওয়াজ হচ্ছে। কড়া ঠাণ্ডা। ঘাম হাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। কর্ণিকা আসলে নার্ভাস। এত নার্ভাস যে, এত ঠাণ্ডার মধ্যে তার গরমের বিভ্রম হচ্ছে। হ্যালুসিনেশন। আজ যদি ঘর গরম থাকত, তাহলে হয়তো মনে হত, শীতে কাঁপছে। হ্যালুসিনেশনের মাত্রা এতটাই বেশি যে, সে মনে মনে কর্মচারী বিষয়ক ম্যানেজারের ঘরে চলে গিয়েছে। চাকরি নট-এর গল্প শুনে এসেছে। নার্ভাস ভাব থেকে বিভ্রম এতটা হয় কি না তা মনোবিদরা বলতে পারবেন। কর্ণিকার সবটাই কল্পনা। ভয়ঙ্কর কল্পনা।

তিন মাস তেরো দিন হল, অন্য ডিপার্টমেন্ট থেকে বদলি হয়ে সে ম্যানেজিং ডিরেক্টরের পার্সোনাল সেক্রেটারি হয়েছে। এখনও শিক্ষানবিশ। সিনিয়ররা কাজ শিখিয়ে দিচ্ছেন। তাঁরা সারাক্ষণ ভয়ও দেখাচ্ছেন।

‘এই যে মেয়ে, খুব সাবধানে থাকবে। বসের কঠিন সমস্যা আছে। সিরিয়াস সমস্যা। কাজে ভুল করলে রেগে যান না, কিন্তু কাজ যদি এলেবেলেভাবে ঠিক করো, রেগে আগুন হয়ে যাবেন। পান থেকে চুন কেন, সুপুরি, খয়ের, এলাচ খসলে ক্ষতি নেই। কিন্তু সিরিয়াস ভাব খসলে বিরাট ক্ষতি। তখন চাকরি গন হতে এক মিনিট।’

জটিল বিষয়। কাজ ভুল করলে ক্ষতি নেই, কাজ ঠিক করলে ক্ষতি! কর্ণিকা খুব ভয়ে ভয়ে আছে। কেন যে মরতে এই পোস্টে তাকে আনা হল। মনে হয় চাকরি থেকে নট করে দেওয়ার জন্যই হয়েছে। যদিও এখনও সে বড় দায়িত্ব পায়নি, চিঠি লেখালেখির কাজ করছে মাত্র। বস ডিকটেকশন দেন। সে শর্টহ্যান্ডে লিখে নেয়। পরে কম্পিউটারে টাইপ করে, প্রিন্ট বের করে দেখায়। সরাসরি ল্যাপটপেও ডিকটেশন নেওয়া যেত। বস পছন্দ করেন না। তিনি পুরোনো পদ্ধতিতে অভ্যস্ত। যখনই কর্ণিকা বসের ঘরে ডাক পায়, তার হাঁটু কাঁপতে থাকে। মনে হয়, আজ সে নিশ্চিতভাবে ‘সিরিয়াস ভাব’-এ কোনও গোলমাল করে বসবে এবং চাকরি খোয়াবে।

ঘামে ডিকটেশন মুছে যাওয়াটা কি ‘সিরিয়াস ভাব’-এর বড় গোলমাল নয়?

বিমলকান্তি সেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা চিঠি ডিকটেশন দিচ্ছেন। কোটি টাকার চিঠি। কোটি টাকার অর্ডার যেখান থেকে পাওয়া গেছে, চিঠি তাদের উদ্দেশে। কোম্পানির সাবান, ডিটারজেন্ট, রুম ফ্রেশনার, টুথপেস্ট, পাউডার, পারফিউম পাঠানোর খুব বড় অর্ডার। প্রাোডাক্ট বাইরে যাবে। সব মিলিয়ে বিজনেস প্রায় কোটি টাকার কাছাকাছি। সবই ঠিক আছে, কিন্তু এলসি খোলা নিয়ে একটা জটিলতা দেখা দিয়েছে। ফলে প্রাোডাক্ট সাপ্লাইয়ের তারিখ পিছোনো ছাড়া উপায় নেই। সমস্যা হল, এসব ক্ষেত্রে অর্ডার বাতিল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এলসির সমস্যা সম্পূর্ণ গোপন রেখে তাদের জানানো হচ্ছে, প্রাোডাক্ট কোয়ালিটি নিয়ে একটা সংশয় দেখা দিয়েছে। সংশয়টি খুবই সামান্য। মনে হচ্ছে, একটা নির্দিষ্ট ব্যাচের সাবানে সেন্টের পরিমাণ যথোপযুক্ত হয়নি। ওয়ার্কশপের চিফ কেমিস্টও সংশয়মুক্ত নন। তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানিয়েছেন, কোনও কোনও সাবানে গোলমাল থাকলেও থাকতে পারে। অন্য যে-কোনও প্রস্তুতকারক এই ত্রুটি অবজ্ঞা করত। কারণ, এই ত্রুটি ধরা পড়বার নয়। যে ক্রেতা এই সাবান ব্যবহার করবেন, তাঁর পক্ষে গন্ধের সূক্ষ্ম তারতম্য বোঝা অসম্ভব। যাকে অর্ডার সাপ্লাই করা হচ্ছে, সেই সংস্থার পক্ষেও এই খামতি যাচাই করা সম্ভব নয়। গন্ধের মানদণ্ড বিচার করবার মতো কোনও যন্ত্র নেই। সুতরাং, এই ত্রুটিকে গুরুত্ব না দিলেও অনায়াসে চলত। কিন্তু সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস সে কাজ করবে না। তারা নিজেদের প্রাোডাক্ট সম্পর্কে অতিরিক্ত সংবেদনশীল এবং যত্নশীল। তারা মনে করে, প্রাোডাক্টের কোয়ালিটির ওপর নজর দেওয়াটা কোনও প্রস্তুতকারক সংস্থার জন্য সব থেকে জরুরি। লাভ-লোকসান পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব। কিন্তু একবার ‘গুড উইল’ নষ্ট হলে সে ক্ষতি মেরামত করা যায় না। তাই কোম্পানির মিটিংয়ে আজ সিদ্ধান্ত হয়েছে, যতই লোকসান হোক, সাবানের এই লট বাতিল করা হবে। নতুন প্রাোডাকশন হবে। তার পর অর্ডার সাপ্লাই হবে। তাই ক’টা দিন সময় চাই। আশাকরি, সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটেসের সদিচ্ছা এবং সততার প্রতি আস্থা রেখে অর্ডার সাপ্লাইয়ের জন্য আরও ক’টা দিন সময় পাওয়া যাবে। ধন্যবাদ…

চিঠি এখনই মেইল করা হবে। যদিও ইতিমধ্যে মুখে কথা হয়ে গেছে। পার্টিকে টেলিফোন করা হয়েছিল। ওরা অভিভূত। সামান্য একটা ত্রুটির জন্য সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস এতদূর যেতে পারে, তারা কল্পনাও করতে পারেনি। এত টাকা লোকসান। যে ত্রুটি ধরাই পড়ত না, তাই নিয়ে এত চিন্তা। ওরা টেলিফোনে বলেছে, আপনারা সময় নিন। ফর্মালি চিঠি মেইল করে দিন। আমরা আজই জবাব পাঠাব।

এই চিঠিটাই বিমলকান্তি সেন কর্ণিকাকে ডিকটেশন দিচ্ছেন। কর্ণিকা মেয়েটির কাজ বিমলকান্তি সেনের বিশেষ পছন্দ। মেয়েটি তাঁর কাছে এসেছে বেশিদিন হয়নি। কত দিন হবে? বড় জোর মাস তিনেক। মেয়েটির বয়স কম, অথচ কাজের ক্ষেত্রে খুবই সিরিয়াস। ডিকটেশনের একটা শব্দ বুঝতে না পারলে দশবার জিগ্যেস করে। চিঠির বাক্যে কোথাও জটিলতা থাকলে ঘরে এসে বলে। মাসখানেক আগে একটা চিঠিতে ভুল হয়েছিল। গ্রামারের ভুল। একটা ভুল নয়, দুটো ভুল। একটা ভার্বে, একটা প্রিপোজিশনে। মালিকের ভার্ব আর প্রিপোজিশন ভুল ধরার জন্য সাহস লাগে। সেই সাহস আসে কাজের প্রতি সিরিয়াস ভঙ্গি থেকে। কাজটা কোনও ব্যক্তি নয়, কাজটা শুধুই কাজ। কে রেগে গেল, কে খুশি হল তাই দিয়ে কাজের বিচার হয় না। দুভার্গ্যের বিষয়, বাঙালি কর্মজগৎ এটাই মেনে চলে। ব্যক্তির রাগ, ব্যক্তির খুশি এই জগতের কাছে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। বাঙালির কর্মকাণ্ডের সব থেকে বড় সাফল্য হল, উচ্চ আসনে বসা মানুষকে তোষামোদ করা। কাজের প্রতি সিরিয়াস হওয়ার থেকে, হাত কচলানোর প্রতি সিরিয়াস হওয়া তার কাছে অনেক বেশি স্বস্তিজনক। কর্ণিকা যে সাহস দেখিয়েছে, একশো কর্মীর মধ্যে একজনও এর ধারে-কাছে যেতে পারবে না। কাঁচুমাচু মুখ করে এসে ভুল ধরিয়েছে। ভাবটা এমন ছিল, যেন ভুল তার, এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে। কর্ণিকার ব্যাপারে বিমলকান্তিবাবু একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেই সিদ্ধান্ত যে-কোনও সময় কার্যকর হতে পারে।

ডিকটেশন শেষ হলে বিমলকান্তি বললেন, ‘যাও, ভালো করে টাইপ করে আমাকে দেখাও।’

কর্ণিকা হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। এখনও তার নোটখাতায় কপালের ঘাম ঝরে পড়েনি। সে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে ঘাড় কাত করে বলল, ‘অবশ্যই স্যার।’ তার পর নোটবই হাতে তাড়াহুড়ো করে দরজার দিকে যেতে গিয়ে চেয়ারে ধাক্কা খেল।

চিঠির পরিকল্পনা নিখিলেশ উপাধ্যায়ের। সেন অ্যাসোসিয়েটস কোম্পানির বয়োজ্যেষ্ঠতম কর্মী। অবসর নেওয়ার বয়স দশ বছর পেরিয়ে গেছে। তার পরেও চাকরি রয়েছে। কেন রয়েছে? কারণ খানিকটা জানা যায়, খানিকটা জানা যায় না। অফিসে, ওয়ার্কশপে নানা রকম ঘটনা। শোনা যায়, কোম্পানির গোড়ার দিকে কমলকান্তি সেন তাঁর এই কর্মচারীটির কাছ থেকে এমন কোনও উপকার পেয়েছিলেন, যা তিনি কখনও ভোলেননি। সেই কৃতজ্ঞতার কারণেই অবসরের বয়স হয়ে যাওয়ার পরও তাঁকে ছাড়া হয় না। আবার শোনা যায়, কমলকান্তি সেন সরে যাওয়ার পর নিখিলেশ উপাধ্যায়ও চলে যেতে চেয়েছিলেন। বিমলকান্তিবাবু কিছুতেই রাজি হননি। তিনি মনে করেন, সন্তান যদি পিতার পরিচয়, সম্মান, সম্পত্তি বহন করতে পারে, তাকে পিতার কৃতজ্ঞতাও বহন করতে হবে।

‘উপাধ্যায়বাবু, আপনাকে অফিসে আসতে হবে না। কিন্তু আপনি আমাদের ছেড়ে যেতেও পারবেন না।’

‘কী মুশকিল। এটা কখনও হয়? সবাই কী বলবে?’

বিমলকান্তিবাবু বললেন, ‘যা খুশি বলুক। আমরা আপনাকে ছাড়ব না। সেন অ্যাসোসিয়েটসের সঙ্গে আপনাকে আজীবন যুক্ত থাকতে হবে।’

‘আপনি তো একজন সিরিয়াস ধরনের মানুষ। আপনার বাবা যা করেছেন, আপনি কেন এসব পাগলামি করবেন? আপনার পিতা তো সরে গেলেন, এবার আমাকে ছুটি দিন।’

বিমলকান্তিবাবু হেসে বলেন, ‘বাবা চলে গেলেন বলেই তো আরও আপনাকে ছাড়া যাবে না। উনি তো কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে যাননি। এখন জিগ্যেস করলে অফিসের বিষয়ে কোনও কথা বলেন না। আপনি যদি ওর ডিসিশন নিয়ে আসতে পারেন, আমি আটকাব না। আপনার ছুটি হয়ে যাবে।’

উপাধ্যায়বাবু বলেন, ‘আমার শরীর ভালো নয়। মাঝে-মাঝে হাসপাতালেও ভর্তি হতে হয়।’

বিমলকান্তিবাবু বলেন, ‘আপনাকে তো অফিসে আসতে হবে না।’

উপাধ্যায়বাবু সাদা হয়ে যাওয়া ভুরু তুলে বলেন, ‘সে কী! তা হলে বেতন নেব কেন?’

বিমলকান্তিবাবু ফের হেসে বলেন, ‘বেতন তো নয়, আপনাকে এখানে আটকে রাখবার জন্য কোম্পানি ক্ষতিপূরণ দেবে।’

নিখিলেশ উপাধ্যায় এবার কমলকান্তি সেনের সঙ্গে দেখা করতে চান। কমলকান্তি রাজি হননি। অনেক জোরাজুরির পর টেলিফোনে কথা বলতে রাজি হন। কী কথা হয় কেউ জানে না।

নিখিলেশ উপাধ্যায় অফিসে রয়ে গেছেন। আগে অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টে কাজ করতেন, এখন ফ্রি। আবাধ গতি। কখনও আসেন, বেশিরভাগ সময়েই আসেন না। তবে দীর্ঘদিন থাকার কারণে এবং স্বভাব মধুর হওয়ায় সব ডিপার্টমেন্টেই চেনাজানা। ম্যানেজার থেকে পিওন—সকলেই পছন্দ করেন। কোম্পানির খবরাখবরও বলে। বেশিরভাগ সময়েই তিনি আগ্রহ দেখান না। হাসিঠাট্টা করে, খানিকটা সময় কাটিয়ে চলে যান। আবার কোনও কোনও খবরে তিনি নিজে থেকেই গভীর আগ্রহ দেখান। সেই খবর ঘুরে ঘুরে যাচাই করেন। খবরের শিকড় পর্যন্ত যান। তার পর কখনও দেখা করেন ম্যানেজারদের সঙ্গে, কখনও বিমলকান্তি সেনের সঙ্গে। এই কোটি টাকার অর্ডারের ব্যাপারেও করেছেন। বিমলকান্তিবাবুকে সময় বাড়াবার পরিকল্পনা বলে দিয়েছেন। পার্টিকে কীভাবে কোয়ালিটির প্রসঙ্গ তুলে চিঠি দিতে হবে, সে কথা বুঝিয়েছেন। বলেছেন, এটা মিথ্যে নয়, এটা ব্যবসার কৌশল। এই সময়ে জট খুলতে হবে। ফুটবল খেলায় যেমন প্রতিপক্ষকে আটকে রাখতে হয়, ব্যবসাতেও তাই।

লাঞ্চের পর সেন অ্যাসোসিয়েটসের অফিসে দুটো অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। একটি ঘটল অফিসের অতি সামান্য এক কর্মচারী কর্ণিকার জন্য। বিকেল তিনটে নাগাদ কর্মচারী বিষয়ক ম্যানেজার ইন্টারকমে থমথমে গলায় তাকে ডেকে পাঠালেন। কর্ণিকার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। নিশ্চিয় আজ তার চাকরি চলে যাচ্ছে। সে কি কোটি টাকার চিঠি ভুল টাইপ করল? দ্বিতীয় ঘটনা ঘটল অফিসের সব থেকে বড় পদের লোকটিকে ঘিরে। তিনি বিমলকান্তি সেন।