☼ প্রচেত গুপ্ত ☼
একটু পরে রোদ উঠবে
বার
বারিধারা উত্তেজিত। সে তার জামাইবাবুর কাছে গল্প শুনছে। এক হতদরিদ্র বংশীবাদককে বাড়ি নিয়ে আসার গল্প। দুর্লভ বস্তু সংগ্রহের গল্প সবসময়েই ইন্টারেস্টিং। পাথরের স্কন্ধকাটা মূর্তি, মাটিতে পুঁতে রাখা ঘড়াভর্তি মোহর, পিকাসোর তুলি, কয়েক হাজার বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া টেরোডাকটিল পাখির ডিম সংগ্রহের গল্প যে গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো হবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু একজন বংশীবাদক সংগ্রহের গল্প যে এতটা ইন্টারেস্টিং হবে, কে ভাবতে পেরেছিল? বারিধারা পারেনি। সে অভিভূত।
মেঘবতী ‘যে-কোনও সময়ে কেঁদে ফেলব’ ধরনের মুখ করে পাশে বসে আছে। থাকুক। বারিধারা সেদিকে তাকাচ্ছে না। দিদি কাঁদুক, কাঁদতে কাঁদতে গড়াগড়ি দিক, তাতেও কিছু এসে যায় না। খ্যাপা জামাইবাবুর গল্প ছেড়ে এখন অন্যদিকে মন দেওয়া যাবে না। গল্প বলতে পেরে জ্যোতিষ্কও খুশি। শালিকে সে পছন্দ করে। তার বিবিধ পাগলামির প্রতি মেয়েটির বিশেষ আগ্রহ আছে। হাবিজাবি আগ্রহ নয়, এক ধরনের অ্যাকাডেমিক আগ্রহ। জ্যোতিষ্কর মনে হয়, মেয়েটা তার কর্মকাণ্ড নিয়ে হয়তো একদিন গবেষণা শুরু করবে। এই মেয়ে অতি বুদ্ধিমতী। তার কাছে গোপনে খবর এসেছে, বারিধারা তার একানব্বই বছরের ঠাকুরদার সঙ্গে পরামর্শ করে একটা লিস্ট বানাচ্ছে। বোকাদের লিস্ট। লিস্টের নাম উলটো। মোস্ট ইনটেলিজেন্ট। লিস্টের মাথায় রেখেছে নিজেকে। সেই লিস্ট অবিরত বদল হয়। নাম ওপর-নীচে ওঠানামা করে। একজন অসাধারণ বুদ্ধিমতী মেয়ে ছাড়া এই কাজ করা অসম্ভব। সেই মেয়ে তার পাগলামিতে প্রশ্রয় দিচ্ছে, এটা কম কথা নয়। জ্যোতিষ্ক স্ত্রীকে একথা বলেছে। মেঘবতী বলে, ‘এটা কোনও ব্যাপার নয়। পাগলার সবসময় অন্য পাগলকে পছন্দ করে। পাগলদের মধ্যে ইউনিটি থাকে।’ জ্যোতিষ্ক স্ত্রীর এই মন্তব্যে গা করে না। বারিধারাও করে না। ‘আউট অব সিলেবাস’ মানুষকে তার সবসময়েই পছন্দ। শ্রবণকেও তার একই কারণে পছন্দ। জামাইবাবুর মতো অতটা না হলেও, শ্রবণও অন্যরকম। এখনকার আর পাঁচটা গাধা ছেলেমেয়েদের মতো জীবনটাকে দাঁড়িপাল্লায় তুলে বেতনের বাটখারা দিয়ে মাপামাপি করে না। সবাই জানে টাকার খুবই প্রয়োজন। কিন্তু তার মানে এই নয়, একজন মানুষের জীবন কতটা জরুরি, সে জীবনের কাছে কতটা যোগ্য—সে বিচার আয়ের পরিমাণ ঠিক করে দেবে। জীবনকে ওজন করবার জন্য বাটখারা শুধু উপার্জনের হয় না। পৃথিবীতে বহু বড় মানুষ খুব কম উপার্জন করেছেন। একবেলা ভালো করে খেতেও পাননি। মজার কথা হল, তাঁদের অনেকেই মানুষের কাছে সবচেয়ে বেশি সম্মান পেয়েছেন। শ্রবণ এখনও সম্মান না পাক, উপার্জন আর উপার্জনের নিরাপত্তার কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। সে নিজের পছন্দমতো কাজকে জীবিকা হিসেবে বেছে নিয়েছে। তাতে রোজগার কম, নিরাপত্তাও নেই। কিন্তু আনন্দ আছে।
এক রাউন্ড চা শেষ হয়েছে। তার পরেও গুপির মাকে চা করতে বলা হয়েছে। মেঘবতী কাঁদো কাঁদো মুখেই বোনের জন্য মাছের ডিমের বড়া করে এনেছে। সেই বড়ায় জ্যোতিষ্কও ভাগ বসাচ্ছে। সে আজ অফিসে দেরি করে যাবে। বাড়িতে অতিথি এসেছে। তাকে সেটল করবার একটা দায়িত্ব আছে না?
বারিধারা বলল, ‘ঘটনা আপনি ডিটেলসে বলুন জ্যোতিষ্কদা। একটা পয়েন্টও বাদ দেবেন না।’
জ্যোতিষ্ক নীচু গলায় বলতেও শুরু করল।
‘বহুদিন পর জগুবাবুর বাজারে গিয়েছিলাম। গিয়েছিলাম তোমার দিদির জন্য। সে কোথা থেকে খবর পেয়েছে, উৎকৃষ্ট মানের মাছের ডিম নাকি ওখানেই পাওয়া যায়। এটা একটা জটিল কথা। মাছ এক বাজারে ভালো, মাছের ডিম আরেক বাজারে ভালো, এটা কী করে সম্ভব? তাও আমি ভাবলাম, একবার ঢুঁ মেরে আসি। যাই হোক, বাজারটাজার করে বেরিয়ে ভাবলাম, ফুটপাথের চায়ের দোকানে বসে এক কাপ চা খাই। চা খাওয়ার থেকে বড় কথা হল, বহুদিন ফুটপাথে বসা হয় না। ফুটপাথে বসার আলাদা মজা। কলেজ, ইউনিভার্সিটি জীবনে তো কম বসিনি। এখন আর পারি না। এখন বিদঘুটে একটা চাকরি করি যে, যেখানে-সেখানে লোকজন চিনে ফেলে আর স্যার স্যার করে। নিজের পাড়ায় তো একেবারেই পারি না। তাও লুকিয়েচুরিয়ে যে দু-একবার বসিনি এমন নয়। তোমার দিদি একবার দেখে ফেলে বিরাট ঝামেলা করল। আমার মতো অফিসারের নাকি…।’
মেঘবতী থমথমে গলায় বলল, ‘আলোচনা কাকে নিয়ে হচ্ছে? বাঁশিওলাকে নিয়ে, না আমাকে নিয়ে? আমি কোন মাছের ডিম পছন্দ করি, ফুটপাথে বসলে কেন রাগারাগি করি—এই সব প্রসঙ্গ এখানে আসছে কেন। আমাকে যদি তোমার এত অপছন্দ, তাহলে বলে দিলেই তো পারো। আমি বৃষ্টির সঙ্গে ও-বাড়ি চলে যাই। ওর সঙ্গে তো গাড়ি আছে। তোমার গাড়িও লাগবে না। তুমি বাঁশিওলাকে নিয়ে থাকো। রোববার রোববার সকালে ওকে নিয়ে ভিক্ষে করতে বেরিয়ো।’
বারিধারা আরও একটা ডিমের বড়া মুখে ফেলল, ‘খুব ভালো আইডিয়া দিয়েছিস দিদি। জামাইবাবু যদি সত্যি ভিক্ষেতে বেরোয়, তাহলে আমিও মাঝে মাঝে সঙ্গে যাব। আসলে আমরা তো সারাজীবন ভিক্ষে করেই বেড়াই। একবার এর কাছে গিয়ে হাত পাতি, একবার তার কাছে গিয়ে হাত পাতি। কখনও চাইছি পরীক্ষার নম্বর, কখনও চাকরি, কখনও প্রাোমোশন, কখনও বিজনেসের অর্ডার, কখনও খ্যাতি, কখনও প্রেম, কখনও সংসারের কাছে চাইছি শান্তি, প্রশংসা, কখনও চাইছি সমঝোতা। সবই চেয়ে বেড়াচ্ছি। আর মুখে বড়াই করছি। এই চান্সে নাহয় ডাইরেক্ট ভিখিরি হয়ে দেখব। বড়াটা ভালো করেছিস দিদি। না, জগুবাবুর বাজারে মাছের ডিম সত্যি ওয়াণ্ডারফুল। তোর ইনফর্মেশন ঠিক।’
মেঘবতী এবার চোখ পাকিয়ে বোনকে বলল, ‘ইঃ উনি ভিক্ষে করবেন… একটা চড় মারব। খালি পাকা পাকা কথা। এইটুকু মেয়ে বেশি ফিলজফি শিখেছে। ডায়লগ দিচ্ছে দেখ…আমরা সবাই ভিক্ষে করি…ইস মজা আর কী!’
বারিধারা মুখ ঘুরিয়ে হেসে বলল, ‘এটা ফিলজফি নয় দিদি, ফিলজফির ভান। আমার মতো যাদের পেটে সত্যিকারের বিদ্যে নেই, তারা এইসব ভান করে। গল্প উপন্যাসেও পাবি। লেখকমশাই ফিলজফির ভানভণিতা ক্যারেক্টরের মুখে বসিয়ে দেন। ক্যারেক্টরগুলো ঘ্যান ঘ্যান করে বলতেই থাকে। অসহ্য। প্রপার শিক্ষিত মানুষ ভানভণিতা ধরে ফেলে। তারপর ভিক্ষের ঝুলি নিয়ে চুপিচুপি বেরিয়ে পড়ে।’
মেঘবতী কটমট করে তাকিয়ে বলল, ‘চুপ করবি? নইলে সত্যি সত্যি কিন্তু এবার মারব বৃষ্টি।’
জ্যোতিষ্ক হাত তুলে বলে, ‘দুই বোনে মারপিট করবে পরে। আগে বংশীবাদকের ঘটনা শোনো।’
বারিধারা বলল, ‘সরি জ্যোতিষ্কদা। আপনি আবার শুরু করুন। অ্যাই দিদি, হয় চুপ করে বসে শোন, নয় আরও খানকতক মাছের ডিম ভেজে আন। বেশি করে লঙ্কা দিবি।’
মেঘবতী উঠল না। আরও গ্যাঁট হয়ে বসল। জ্যোতিষ্ক ফের বলতে শুরু করল। শুনতে শুনতে বারিধারার চোখ আরও বড় হয়ে গেল। যতটা ভাবা গিয়েছিল, ঘটনা তার থেকে অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং।
ফুটপাথ হলে কী হবে, চায়ের দোকানটা বেশ বড়। ভিড়ও ছিল। জ্যোতিষ্ক নড়বড়ে বেঞ্চে বসে এক ভাঁড় চা নিয়েছে। হঠাৎই ঝগড়া কানে এল। দোকানদার কোনও খদ্দেরের সঙ্গে চাপা গলায় ঝগড়া করছে। জ্যোতিষ্ক প্রথমটায় কথা কানে নেয়নি। চায়ের দোকানে ঝগড়া, তর্কবিতর্ক লেগে থাকেই। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মতো। খানিকক্ষণের মধ্যেই এমন সব কথা কানে আসতে লাগল যে, জ্যোতিষ্ক মুখ না ঘুরিয়ে পারল না।
‘তুমি মাঝে মাঝে এসে বিরক্ত করো কেন?’
‘বিরক্ত করবার কী আছে? আপনি চায়ের দোকান দিয়েছেন, আমি চা খেতে আসি। চায়ের দোকান না দিয়ে যদি লোহালক্কড়ের দোকান দিতেন, তাহলে কি আসতাম? বয়ে গেছে।’
‘তুমি বড্ড বাজে বকো।’
‘আপনিও বড্ড বাজে বকেন। তা ছাড়া আপনি আমাকে তুমি তুমি করে বলছেন কেন?’
দোকানওলা এবার তেড়েফুঁড়ে বলল, ‘তাহলে কী বলব? আপনি-আজ্ঞে করব?’
জ্যোতিষ্ক এবার লোকটাকে পুরোপুরি দেখতে পায়। গায়ে ধুতি-ফতুয়া। ফতুয়ার রং গেরুয়া। বড় বড় চুল। একটা বাউল বাউল ভাব। পোশাকের অবস্থা অতি মলিন। কাঁধে যে ঝোলাটা রয়েছে, সেটায় নানা রঙের কাপড় দিয়ে তাপ্পি। ঝোলা থেকে লাঠির মতো একটা কিছু উঁচু হয়ে আছে। সম্বোধন নিয়ে ঝগড়া শুনে জ্যোতিষ্কর উৎসাহ বাড়ল।
মলিন ধুতি-ফতুয়া বলল, ‘আপনি-আজ্ঞে না করুন, সম্মান দিয়ে কথা বলুন।’
দোকানদার বলল, ‘কেন? তোমাকে সম্মান দেব কেন? রোজ সকালে এসে ভিক্ষে চাও।’
মলিন ধুতি-ফতুয়া বলল, ‘আবার আপনি বাজে কথা বলছেন। রোজ আমি আসি না। আপনার এখানে আসার পালা যেদিন পরে, সেদিনই শুধু আসি। তাছাড়া আমি মোটেও ভিক্ষে করি না। আর যদি করতাম, তাতে খারাপটা কী হত? আপনি চায়ের দোকান দিতে পারেন, আমি ভিক্ষে করতে পারি না?’
দোকানদার হাত জোড় করে বলল, ‘আচ্ছা বাবা, আমারই ভুল হয়েছে। এবার চা খেয়ে বিদায় হন।’
মলিন ধুতি-ফতুয়া বলল, ‘চা আমি এমনি খাই না আপনি জানেন।’
দোকানদার হতাশ হয়ে বলল, ‘এ তো মহাঝামেলা করে। ব্যস্ত সময় ভ্যানভ্যানানি। বলছি তো, এখন আমার বাঁশি শোনবার টাইম নেই…দোকান ভর্তি খদ্দের। চা খেতে হলে খান, নইলে বিদায় হন।’
মলিন ধুতি-ফতুয়া এবার বেঞ্চ থেকে উঠতে উঠতে বলল, ‘তাহলে আমারও চা খাওয়া হবে না। আমি চললাম।’
এই পর্যন্ত বলে জ্যোতিষ্ক থামল। মেঘবতী বলল, ‘এসবের মানে কী! চায়ের সঙ্গে বাঁশির কী সম্পর্ক! লোকটা পাগল নাকি?’
জ্যোতিষ্ক সোফাতে হেলান দিয়ে মুচকি হেসে বলল, ‘প্রথমটায় আমিও তাই ভেবেছিলাম। পরে জানলাম ঘটনা অন্য।’
বারিধারা বলল, ‘কী ঘটনা?’
জ্যোতিষ্ক বলল, ‘আমি তখন মানুষটাকে ডাকি। ডেকে পাশে বসাই। দু-একটা এদিক-সেদিক কথার পর আসল ঘটনা জানতে পারি। মানুষটা বাঁশি বাজান। বর্ধমান না বীরভূমের কোনও গ্রামে গরিব চাষির বাড়িতে জন্মেছে। কাজেকর্মে মন ছিল না। ছোটবেলা থেকেই বাঁশির নেশা। নিজে নিজেই শিখেছে। বাঁশিতে গান, সুর, রাগ-রাগিণীও বাজাতে পারে। কাজ করে না বলে, বাবা একদিন বাড়ি থেকে দিল তাড়িয়ে। তখন বালক বয়স। ঠিকই করেছে। গরিবের ঘরে কাজকম্ম না করে বাঁশি বাজালে কতদিন সহ্য করবে? তারপর থেকেই ভদ্রলোকের জীবিকা মাধুকরী। মাধুকরী জানো তো?’
বারিধারা বলে, ‘জানি, ভিক্ষে।’
জ্যোতিষ্ক বলে, ‘ঠিক। মানুষটা ভিক্ষেই করেন। তবে টাকাপয়সা নেন না, পেট ভরে খাওয়াতে হয়। যখন খিদে পায়, তখন কোথাও একটা হাজির হয়ে বাঁশি বাজান। কেউ খুশি হয়ে খাওয়ালে ভালো, না খাওয়ালেও ঠিক আছে। সে সকালবেলার চা-ই হোক আর দুপুরের ভাত ডাল বা বিকেলের মুড়ি বাদামই হোক। উনি এমনি এমনি কারও কাছ থেকে খান না। বাঁশি শোনানোর পারিশ্রমিক হিসেবে খান। তবে শুধু তো পেটপুরে খেলেই একটা মানুষের জীবন চলে না। জামাকাপড়, চটি কিনতে পয়সা লাগে। এদিক-ওদিক যেতে ট্রেন, বাসের ভাড়া লাগে। এই কারণে উনি মাঝে মাঝে বাঁশি বানিয়ে হাটে, মেলায় বিক্রি করেন। সেদিক থেকে বলতে গেলে ভদ্রলোক শুধু বাঁশি বাজান না, বাঁশির মতো মধুরতম একটি বাদ্যযন্ত্রের প্রচারকও বটে।’
বারিধারা বিড়বিড় করে বলল, ‘উনি খিদে না পেলে কাউকে বাঁশি শোনান না?’
জ্যোতিষ্ক বলল, কেন শোনাবেন না? অবশ্যই শোনাবেন। তবে নিজের মুডের ওপর নির্ভর করেন। আর পাঁচজন শিল্পীর মতো। এবার বলো, এই ভিক্ষুক ভদ্রলোককে বাড়ি নিয়ে এসে কি আমি অন্যায় করেছি? আচ্ছা বৃষ্টি তোমায় বলতে হবে না। মেঘ তুমি বলো, আমার ভুল হয়েছে?’
মেঘবতীর চোখে জল টলটল করছে। সম্ভবত গল্প শুনে তার মন বদলেছে। স্বামীকে এখন পাগলের বদলে মহানুভব বলে মনে হচ্ছে। সেন্টিমেন্টাল হয়ে পড়েছে। হাতের পিঠে চোখের জল মুছে নীচু গলায় বলল, ‘এসব তো আমাকে আগে বলোনি!’
জ্যোতিষ্ক হেসে বলল, ‘বলব কখন? তুমি তো রাগারাগি শুরু করে দিলে।’
বারিধারা বলল, ‘ভদ্রলোকের নাম কী?’
জ্যোতিষ্ক বলল, ‘এ-ও এক মজার কথা। আমি নাম জিগ্যেস করায় বললেন, নাম দিয়ে কী হবে? নামে কি একটা মানুষের পরিচয় হয়? না তাকে চেনা যায়? মানুষ হল গানের মতো। সুর দিয়ে চেনা যায়। আপনার যা খুশি নামে ডাকতে পারেন।’
বারিধারা বলল, ‘আমরা বংশীবাদক বলেই ডাকব। আচ্ছা জ্যোতিষ্কদা, বংশীবাদক বাড়িতে আসতে আপত্তি করল না?’
জ্যোতিষ্ক বলল, ‘একেবারেই নয়। আমি প্রস্তাব দিতে বললেন, চলেন। আমার কোনও সমস্যা নেই। আমার কাছে চায়ের দোকানও যা, বাড়িও তাই।’
মেঘবতী বলল, ‘কতদিন থাকবেন?’
জ্যোতিষ্ক বলল, ‘কী জানি। এসব লোক কোথাও বেশিদিন থাকতে পারে না। যাযাবর টাইপের হয়।’
বারিধারা ধড়ফড় করে উঠে কাকুতি-মিনতি করবার ভঙ্গিতে বলল, ‘প্লিজ জ্যোতিষ্কদা, আপনি ওনাকে চলে যেতে দেবেন না। আমার কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে এসে আলাপ করিয়ে দেব। আচ্ছা, একবার দাদুর কাছে নিয়ে গেলে হত না?’
মেঘবতী বলল, ‘দাঁড়া আগেই এত ছটফট করিস না। কটাদিন যাক।’
জ্যোতিষ্ক অন্যমনস্ক হয়ে বলল, ‘না, অনেক কষ্টের মধ্যেও দেশটা বড় সুন্দর! সবথেকে সুন্দর আমার বাংলা। এখানে গানবাজনা করে একজন মানুষ তার খিদে মেটাতে পারে। ভাবা যায়!’
বারিধারা বলল, ‘বিদেশেও আছে জ্যোতিষ্কদা। স্ট্রিট সিঙ্গার পথের ধারে গিটার বাজিয়ে গান করে। লোকে সামনে টাকাপয়সা রেখে যায়।’
জ্যোতিষ্ক জ্বলজ্বলে চোখে বলল, ‘জানি। এ ব্যাপারে পৃথিবীর সেরা হল শান্তিনিকেতন যাওয়ার ট্রেন। রবি ঠাকুরের গান শুনিয়ে দরিদ্র মানুষ উপার্জন করে। আহা! মানুষটা রাজার জন্য যেমন গান লিখেছে, দরিদ্রের জন্যও লিখেছে।’
এই সময় একতলার গেস্টরুম থেকে ভেসে আসা মায়াবী সুরে সবাই থমকে গেল। বাঁশি বাজছে।