» » প্রথম কিস্তি

বর্ণাকার

প্রচেত গুপ্ত

একটু পরে রোদ উঠবে

নয়

হাম্বা…হাম্বা…

বারিধারার মোবাইলে মেসেজ ঢুকল।

মেসেজ পাঠিয়েছে শ্রবণ। বারিধারা শ্রবণের মেসেজ অ্যালার্ট টোনে গরুর ডাক লাগিয়ে রেখেছে। রোগাভোগা গরুর ডাক নয়, যাকে বলে ‘হৃষ্টপুষ্ট গাভি’র ডাক। গম্ভীর, বিজ্ঞ, খানিকটা দার্শনিক। বারিধারা এই কাজ লুকিয়ে করেনি, শ্রবণকে জানিয়েই করেছে। শ্রবণ কিন্তু কিন্তু করেছিল।

‘আমার মেসেজ টোনে গরুর ডাক! এটা কি ঠিক হবে বারি?’

বারিধারা দেখতে সুন্দর এবং আকর্ষণীয়। তার না-রোগা না-মোটা চেহারায় এক ধরনের স্মার্ট, ডোন্ট কেয়ার ব্যাপার আছে। মেয়েরা হিংসে করে, ছেলেরা তাকিয়ে দেখে। মুখের গড়নে তীক্ষ্ণ ভাব। চোখ দুটো বড় এবং উজ্জ্বল। গায়ের রং কালোর দিকে। গায়ের রং কালোর দিকে হওয়ায় বারিধারা গর্বিত। সে মনে করে, যেসব মেয়ের গায়ের রং কালো বা কালোর দিকে, তাদের বুদ্ধি বেশি হয়। এই বিশ্বাসের পক্ষে তার কাছে কঠিন কোনও যুক্তি নেই। সে নাকি বিভিন্ন উদাহরণ থেকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। তার দিদি মেঘবতী অতি ফর্সা একজন মেয়ে। স্বাভাবিকভাবেই বোনের এই উদ্ভট বিশ্বাসে তার বিরাট আপত্তি। স্কুলে পড়ার বয়সে ঝগড়া, মারপিটও হয়েছে। মেঘবতী বলত, ‘তুই একটা উদাহরণ দেখা তো বৃষ্টি, কোন ফর্সা মেয়ের বুদ্ধি কম?’

বারিধারা গম্ভীর মুখে বলেছে, ‘কেন! তোর।’

মেঘবতী প্রথমটায় হকচকিয়ে যায়। সামলে নিয়ে বলে, ‘আমি বোকা?’

বারিধারা বলে, ‘অবশ্যই বোকা।’

মেঘবতী চোখ পাকিয়ে বলে, ‘এবার পরীক্ষায় কত নম্বর পেয়েছি জানিস? অঙ্কে নাইনটি সিক্স। বোকারা অঙ্কে এত নম্বর পায়?’

বারিধারা বলল, ‘এই তো তোর বোকামির বড় উদাহরণ। অঙ্কের নম্বর দিয়ে বুদ্ধির বিচার করছিস। শেলি, কিটসের অঙ্কের নম্বর জানিস? খোদ আইনস্টাইন একবার অঙ্কে ফেল মেরেছিলেন জানা আছে তোর? সালভাদোর ঢালি ক্লাস এইটে অঙ্কে কত পেয়েছিলেন বলতে পারবি?’

মেঘবতী ভুরু কুঁচকে বলল, ‘সালভাদোর ঢালি? সে কে?’

বারিধারা ফিক করে হেসে বলল, ‘আমাদের ক্লাসের মোনালিসা ঢালির ছোটমামা। কুস্তিগির।’

মেঘবতী ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, ‘রাখ তোর কুস্তিগির, আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল শিমলি ফর্সা টুকটুকে মেয়ে। গায়ে হাত দিলে মনে হয় খানিকটা সাদা রং আঙুলে উঠে আসবে। যেমন দেখতে, তেমন বুদ্ধি। জেনারেল নলেজে চ্যাম্পিয়ন। স্কুলের হয়ে যেখানে কুইজে যাবে প্রাইজ নিয়ে ফিরবে। ফর্সা শিমলি বোকা আর তুই কালো হয়ে বিরাট চালাক, না? তোর খালি উদ্ভট কথা।’

বারিধারা চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল, ‘তোর বন্ধু বোকা কিনা বলতে পারব না, তবে জেনারেল নলেজ পারাকে যারা বুদ্ধি বলে তারা যে বোকা, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তাহলে তো গুগলস সব থেকে বেশি বুদ্ধি। কী বোর্ড টিপে খটাখট প্রশ্ন করবি, স্ক্রিনে ফটাফট উত্তর পেয়ে যাবি। তা বলে কম্পিউটার কি মানুষের থেকেও বেশি বুদ্ধি ধরে? জিকে পারাটাই বুদ্ধির পরিচয়?’

মেঘবতী বলল, ‘অবশ্যই।’

বারিধারা বলল, ‘এই জন্য তোকে বোকা বলি দিদি। অঙ্কে নাইনটি সিক্স কাজে লাগছে না। কম্পিউটারের যা থাকে, তা হল ডেটা, ইনফর্মেশন, মেমারি। একে বুদ্ধি বলে না। যাদের বুদ্ধি নেই তারা ডেটা, মেমারি এসব নিয়ে বড়াই করে। মানুষের বুদ্ধি আর মেশিনের ডেটার মধ্যে অনেক পার্থক্য। বুদ্ধি মানে দশটা দেশের নাম জানা নয়, অঙ্কের কটা ফর্মুলা মুখস্থ থাকা নয়, বুদ্ধি সামথিং ডিফারেন্ট। ওসব তো কম্পিউটারেই পাওয়া যাবে। আগেকার দিনে স্মৃতিধরকে বিরাট পণ্ডিত বলা হত। যার স্মৃতি বেশি, সেই নাকি বুদ্ধিমান! বোঝো ঠেলা! এখন স্মৃতির কোনও প্রয়োজন নেই, দামও নেই। একশো উনিশের নামতা খামোকা মুখস্থ রাখব কেন? হাতের মোবাইল ফোনেই তো ক্যালকুলেটর পাওয়া যায়। ফালতু ডেটা মাথায় রেখে অহেতুক ব্রেনকে ভারাক্রান্ত করে বোকারা। একশো বছর আগে এসব ধারণা ছিল।’

মেঘবতী বলে, ‘তুই বেশি ফরফর করিস বৃষ্টি, বড্ড পাকা হয়েছিস। তাহলে বুদ্ধি কাকে বলে?’

বারিধারা হেসে বলল, ‘ইতিহাস, ভূগোল, অঙ্ক জেনে মানুষ যখন সেটাকে কাজে লাগায়, সেটাকেই বুদ্ধি বলে। কম্পিউটার তোকে ডেটা দেবে দিদি, কিন্তু কাজে লাগাতে পারবে না। কাজ তোকেই করতে হবে। তার জন্য যে জিনিসটা লাগে, সেটাই বুদ্ধি।’

মেঘবতী ঠোঁট উলটে বলে, ‘কী কাজ? অঙ্কে ছিয়ানব্বই পাওয়াটা কাজ নয়? কুইজ কম্পিটিশনে ফার্স্ট হওয়াটা ফালতু?’

‘ফালতু বলিনি, তবে বিরাট কোনও কাজ নয়। হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ হচ্ছে। রোজই কেউ না কেউ নম্বর পাচ্ছে, কুইজে প্রাইজ পাচ্ছে। তাতে কী হবে? আসলে নিজের জানাটাকে আর পাঁচজনের জন্য ব্যবহার করা গেলে তবেই সেটা কাজ। সেটা বিজ্ঞানের কোনও ইনভেনশান হতে পারে, ছবি আঁকা হতে পারে, স্টুডেন্টদের ভালো করে পড়ানোও হতে পারে। দেশের জন্য, সোসাইটির জন্য কিছু করাটা সবথেকে বড় কাজ। যাঁরা করেন, তাঁরা কতটা স্মৃতিধর আর অঙ্কে কত নম্বর পেয়েছিলেন কেউ ভাবে না। গান গেয়ে, বাজনা বাজিয়ে, অভিনয় করে, কবিতা লিখে মানুষকে আনন্দ দেওয়াটা বা জীবনের কথা, সমাজের কথা বলাটা খুব কঠিন কাজ। এরা নিজের অনুভূতি সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। এই কাজ যাঁরা ঠিকমতো পারেন, সবাই তাঁদের মাথায় তুলে রাখে। যুগে যুগে এটা হচ্ছে। এর জন্য ইচ্ছে লাগে, মনের জোর লাগে, কল্পনা লাগে, সাহস লাগে। আমাদের মায়ের মতো যেসব মহিলা চাকরিবাকরি বা অন্য কিছু করে না, কিন্তু সংসার সামলানোর মতো সব থেকে জটিল আর কঠিন কাজটা সামলায়, তাদের জানবি সব থেকে বেশি বুদ্ধি। সবার প্রয়োজন দেখতে হয়। মান অভিমান বুঝতে হয়। ভাব তো যে বাড়িতে টাকা-পয়সার টানাটানি, সে বাড়ির গৃহিণীকে কত অঙ্ক জানতে হয়! এই খরচ কমিয়ে, ওই খরচ সামলে, এটা এবার বাদ রেখে, ওটা সেবার দিয়ে…পারমুটেশন কম্বিনেশন করতেই থাকে। নইলে তো সংসারই চলত না। এদের তুই অঙ্কে কত দিবি? একশোয় তো দুশো দেওয়া উচিত। কেউ দেয় না। তাদের বুদ্ধির কোনও হিসেবও হয় না। এই যে বাবার মতো মানুষের সঙ্গে মা এতদিন টিকে আছে, তার জন্যও তো বিরাট বুদ্ধি লাগে। আমি হলে কবে ডিভোর্স নিতাম। আসলে সব মিলিয়ে বুদ্ধির বিচার হয়। স্কুল কলেজের পরীক্ষার নম্বর দিয়ে বড় চাকরি হতে পারে, আর কিছু হয় না। চাকরি চলে যাওয়ার পর তাদের কেউ পাত্তাও দেয় না।’

মেঘবতী বলল, ‘ইচ্ছে করে তুই বিষয়টা গুলিয়ে দিচ্ছিস বৃষ্টি। বড় চাকরি মানে বড় কাজ নয়? এই যে একজন ইঞ্জিনিয়ার নদীতে ব্রিজ বানান, এটা বড় কাজ নয়?’

বারিধারা বলল, ‘অবশ্যই বড় কাজ। খুব ইমপর্টান্ট। তবে জানবি সব পেশাই গুরুত্বপূর্ণ। যিনি অঙ্কে একশোতে একশো পেয়ে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ব্রিজ বানাচ্ছেন, তিনি খুব জরুরি কাজ করছেন। ব্রিজ না থাকলে মানুষ নদীটাই পেরোতে পারত না। নদীর ধারে গালে হাত দিয়ে বসে থাকতে হত কখন নৌকা আসবে আর গান গাইতে হত, নদী আপন বেগে পাগলপারা…। আবার যিনি জীবনে এক ফোঁটা পড়াশোনা না করে রোজ সকালে এসে আমাদের বাড়ির ময়লা নিয়ে যান, তিনিও জরুরি কাজ করেন। তিন দিন ময়লা না নিয়ে গেলে অবস্থা হাঁড়ির হাল হয়ে যাবে। বাড়ি থেকে পালিয়ে নদীর ব্রিজে উঠে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে হবে আর অঙ্ক চিবিয়ে খেতে হবে।’

মেঘবতী বলল, ‘উইক লজিক। তবু তর্কের খাতিরে মেনে নিলাম। কিন্তু এসবের সঙ্গে গায়ের রঙের কী সম্পর্ক?’

বারিধারা বলে, ‘অবশ্যই আছে। যেমন ধর, আমি বুদ্ধি বিষয়টা কেমন সুন্দর বুঝি, আর তুই তোর ক্লাসের শিমলিকে বিরাট বুদ্ধিমতী ধরে বসে আছিস। তার কারণ তুই বোকা… আমার ধারণা, ফর্সা না হলে এতটা বোকা হতে পারতিস না।’

হেসে ওঠে বারিধারা। মেঘবতী বারিধারার প্রায় গায়ের ওপর উঠে পড়ে। চড়, কিল মারতে থাকে। আদরের মার।

বারিধারা হো হো করে হাসতে হাসতে বলে, ‘এই দেখ তুই কত বড় বোকা! বোকা না হলে কেউ গায়ের রং নিয়ে রাগারাগি করে? আহা, ফর্সা বলে তোর তো কোনও দোষ নেই। তুই কেন রাগ করবি? গায়ের রং কি কারও হাতে থাকে রে দিদি? এ হল জিনঘটিত ব্যাপার। জিন যদি না বুঝিস, তাহলে জানবি, ভগবানের হাত। ফর্সা হয়ে জন্মেছিস যখন মেনে নিতে হবে, তাই নিয়ে মাথা কুটে লাভ কী?’

কথা শেষ করে বারিধারা আরও জোরে হেসে উঠত। মেয়েদের ফর্সা হওয়াটা যে দুঃখের ঘটনা, এই অভিনব তত্ব পেশ করতে পেরে সে খুবই আহ্লাদিত। মেঘবতী বলত, ‘তোকে আজ মেরেই ফেলব।’

মেঘবতী বোনের ওপর আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে। বারিধারা চিৎকার করে ওঠে, ‘ওরে বাবা মরে গেলাম রে…।’

এই ঝগড়া দুই বোন অনেকদিন পর্যন্ত চালিয়েছে। কোনও মীমাংসা হয়নি। তবে এটা সত্যি যে বারিধারার সৌন্দর্যে এক ধরনের বুদ্ধির ছাপ আছে। সেটা তার গায়ের রং কালোর দিকে বলে না উজ্জ্বল চোখের জন্য, নাকি লেখাপড়া, আচরণ সবটা মিলিয়ে কে জানে! এসব সঠিকভাবে বলবার মতো কোনও অঙ্কের ফর্মুলা নেই, জেনারেল নলেজও নেই। প্রেমিকার বুদ্ধির এই ছাপকে শ্রবণ অবশ্য ‘রাগ’ ভাব বলে মনে করে। তার ধারণা, বারিধারা তার ওপর বেশিরভাগ সময়েই রেগে থাকে। যে-কোনও সময় বকাবকি শুরু করে দেবে। প্রেমিকার বকাবকিতে তার কোনও সমস্যা নেই। সমস্যা হল, কেন রাগ, সেটাই বেশিরভাগ সময় বোঝা যায় না। সে কি বোকা প্রেমিক? নার্ভাস? নাকি গদগদ টাইপ? মনে হয় শেষেরটাই হবে। এই যুগে একজন স্মার্ট, বুদ্ধিমান ছেলের গদগদ টাইপ প্রেমিক হওয়া খুবই দুঃখের ঘটনা। একথা শ্রবণ জানে না এমন নয়, জানে, তবু নিজেকে বদলাতে পারে না। বারিধারাকে দেখলে বা কথা বললে তার যেমন নার্ভাস লাগে, তেমন প্রেমও উথলে ওঠে। মোবাইল মেসেজে হাম্বা রবের ঘটনাটাই ধরা যাক না কেন। এই ব্যাপারে তার আপত্তি হওয়া উচিত ছিল জোরালো। কিন্তু পারেনি। মৃদু আপত্তিতেই বারিধারা ধমক দিয়েছিল।

‘কেন? ঠিক হবে না কেন?’

শ্রবণ আমতা আমতা করে বলল, ‘না, কোনও কারণ নেই, তবে একেবারে গরু?’

বারিধারা চোখ পাকিয়ে বলল, ‘গরুর ডাক খারাপ নাকি? তুমি জানো এই ডাক আমি কত কষ্ট করে খুঁজে বের করেছি? ইউ টিউব ঘেঁটে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। বাঘ, সিংহ সব পাই, গরু পাই না। শেষে অনেক কষ্টে পেয়েছি। তাছাড়া এটা তো এদেশের গরুর ডাক নয়, অস্ট্রেলিয়ার গরুর ডাক।’

শ্রবণ মাথা চুলকে বলে, ‘অস্ট্রেলিয়ান হোক আর জাপানি হোক, ধারা, গরু তো গরুই…।’

বারিধারা খেপে যায়। বলে, ‘তাহলে কি তোমার মেসেজে পাখির ডাক লাগাব? কোকিলের মতো কু কু করে ডাকবে? আর সত্যি কথা বলতে কী, তোমার মেসেজগুলোর সঙ্গে গরুর ডাক মানানসই বলে আমার মনে হয়।’

শ্রবণ হতাশ গলায় বলে, ‘কেন?’

বারিধারা মুচকি হেসে বলল, ‘সে বলা যাবে না।’

গাড়ির মধ্যে বারিধারা মোবাইল তুলে মেসেজ পড়ল। শ্রবণ লিখেছে—

‘তোমার কথা শুনে বাড়ি থেকে পালালাম।’

বারিধারা হেসে ফেলল। এই কারণে ছেলেটাকে ভালো না বেসে পারা যায় না। তার কথা শোনে বলে নয়, ছেলেমানুষির জন্য। পাগল একটা। শ্রবণের নম্বর টিপতে গেল বারিধারা। মেসেজের টোনে গরুর হাম্বা ডাক রাখলেও, ফোনের লিস্টে শ্রবণকে সে রেখেছে ‘চিরসখা’ নামে। এটা কেউ জানে না। শ্রবণও না। এই নাম তার গোপন। রবি ঠাকুরের চিরসখা… গানটা তার মা বড় চমৎকার গায়। মায়ের গানের কোনও চর্চা নেই। কোনও দিন গুছিয়ে গান গাইতে বসেছে বলে মনে পড়ে না। যখন ইচ্ছে হয়, ছেঁড়া ছেঁড়াভাবে গান করে। কখনও রান্না করতে করতে, কখনও ঘর গোছাতে গোছাতে। দুই বোন চাপাচাপি করলেও লাভ হয় না। শুধু কমলকান্তি সেন ব্যতিক্রম। বুড়োমানুষটা বললে ‘না’ করতে পারে না। তবে তিনি বলেনও ন’মাসে, ছ’মাসে একবার। মায়ের গলায় বারিধারা এই গান প্রথম শোনে। শুনেছিল ঠাকুরদার ঘরে। মা মোড়ায় বসে খালি গলায় গাইছিল। কমলকান্তি তাঁর ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে শুনছিলেন। বারিধারার মনে হয়েছিল, কত স্বচ্ছন্দে মা গাইছে! যেন বাইরে কোথাও নয়, এই গান তৈরি হয়েছে মায়ের ভিতরে। শান্ত নির্জন দিঘিতে যেমন আপনমনে ঢেউ তৈরি হয়, কেন হল, কীভাবে হল তাতে কিছু যায় আসে না, যেমন অল্প বাতাস কাউকে না বলে গাছের পাতা আলতো ছুঁয়ে দেয়, কেন ছুঁল কাউকে বলে না, অনেকটা সেরকম! বুকের ভিতরটা হু হু করে উঠল। মা গাইল—

“চিরসখা, ছেড়ো না মোরে ছেড়ো না।

সংসারগহনে নির্ভয়নির্ভর, নির্জনসজনে সঙ্গে রহো।।

অধনের হও ধন, অনাথের নাথ হও হে, অবলের বল।

জরাভারাতুরে নবীন করো ওহে সুধসাগর।।”

কমলকান্তি সেনকে সেদিন কাঁদতে দেখেছিল বারিধারা। গান শেষ হলে তিনি চোখ খুলে এবং জল না মুছে এক গাল হেসে মাকে বললেন, ‘তোমার গান শুনে খুব আনন্দ পেলাম মণিকুন্তলা। দুঃখে চোখের জল ফেলা বড় কথা নয়, আনন্দে চোখে জল আনা খুব কঠিন কাজ। তুমি সেই কঠিন কাজ পেরেছ।’

মা মুখ নামিয়ে বলেছিল, আমি পারিনি বাবা, রবি ঠাকুর পেরেছেন। সেদিনই বারিধারা তার মোবাইল ফোনে শ্রবণের নাম মুছে লেখে ‘চিরসখা’।

বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া ‘চিরসখা’কে ফোন করতে গিয়ে বারিধারা থমকে গেল। গাড়ির চালক নন্দকাকা যথারীতি দিদির বাড়ির রাস্তা গুলিয়ে ফেলেছে। গাড়ি ঢুকেছে বালিগঞ্জের ভুল গলিতে। চক্কর খাচ্ছে।