☼ প্রচেত গুপ্ত ☼
একটু পরে রোদ উঠবে
সাত
আলমারি থেকে ঝুপ ঝুপ করে দুটো বই মাটিতে পড়ে গেল।
বিমলকান্তিবাবু চমকে উঠে আলমারিটা ধরেছিলেন। সেই নাড়াতেই বই পড়েছে। এটা ঠিক বইয়ের আলমারি নয়, চারটে খোলা তাক। অর্ডার দিয়ে বানানো। বুক সমান হাইট। একেবারে নীচের তাকটা বেশ খানিকটা উঁচুতে। বই নেওয়ার জন্য যাতে কোমর ভেঙে খুব নীচু হতে না হয়। ঠাকুরদার অবসর উপলক্ষ্যে দুই নাতনি এই বইয়ের তাক উপহার দিয়েছিল। দুটো-একটা করে বই জমতে জমতে এখন তাক উপচে পড়বার মতো অবস্থা।
বিমলকান্তিবাবু শুধু চমকাননি, ভয়ও পেয়েছেন। ভয় পাওয়ার মতোই ঘটনা। সেদিন প্রহ্লাদ নামের লোকটার সঙ্গে যেমন হয়েছিল, আবার সেই একই ঘটনা ঘটেছে। মুহূর্তের জন্য মনে হল, তিনি বিমলকান্তি নন, তিনি অন্য মানুষ। শরীর, মন সব অন্য মানুষের। তবে এবার আর অধস্তন, দরিদ্র কর্মচারী নয়, এবার তিনি হয়ে গেছেন সেন অ্যাসোসিয়েটসের কমলকান্তি সেন!
কী ভয়ংকর!
বাবার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বিমলকান্তিবাবুর মনে হল, এক ঝটকায় বয়স তিরিশ বছর বেড়ে গেল। তিনি দাঁড়িয়ে নেই। চোখ বুজে আধশোয়া হয়ে আছেন ইজি চেয়ারে। হাতদুটো হাতলে রাখা। বাঁ পায়ের পাতাটা ভারী। গায়ে ফতুয়া জামা আর লুঙ্গি। পায়ে ঘরে পরবার স্লিপার। ডান পায়ের স্লিপারের তলায় কিছু একটা আটকে গেছে। মেঝেতে পড়ে থাকা সেলোটেপ? চুইংগাম? নাকি কাগজ জড়িয়েছে? বাঁ-হাতের কনুইয়ের কাছটা একটু জ্বালা করছে। সকালে বাথরুমের দেওয়ালে ঘসা লেগেছিল। বিমলকান্তিবাবু বুঝতে পারলেন, তিনি চোখ বুজে মনে মনে কারও সঙ্গে কথা বলছেন। কোনও মহিলার সঙ্গে। মহিলার গলা ভারী। বয়স্ক? মহিলার কণ্ঠস্বরে অনুযোগ। বললেন, ‘তুমি এখনও কিছু করলে না?’
‘করব। অবশ্যই করব।’
এবার মহিলার কণ্ঠস্বরে বিরক্তি। বললেন, ‘আর কবে করবে? এবার তো ফট করে একদিন মরে যাবে। বয়স কত হল খেয়াল হয়েছে? একানব্বই কোনও সহজ বয়স নয়।’
চিন্তা কোরো না, চট করে মরছি না। শরীরের কলকবজা বিগড়োয়নি। আসলে ঠিক কী করা উচিত, কোনটা করলে ভালো হয়, কোনটার বেশি প্রয়োজন, তাই নিয়ে একটা দোনামোনার মধ্যে ছিলাম।’
মহিলা কণ্ঠস্বর বললেন, ‘দোনামোনা বন্ধ করো। দোনামোনার কারণে বেশিরভাগ সময়ে ভালো কাজ করে ওঠা হয় না। সময় ফুরিয়ে যায়।’
‘ঠিকই বলেছ। সময় কমে আসছে। কাজটার শেষ দেখে যেতে পারব না।’
মহিলা কণ্ঠস্বর চাপা ধমক দিয়ে বলল, ‘শেষ দেখবার জন্য ব্যস্ত হচ্ছ কেন? তুমি কি উদ্বোধন করে কাগজে ছবি ছাপাতে চাও। পাশে মন্ত্রীসান্ত্রীরা দাঁড়িয়ে থাকবে? ছিঃ। তোমার কাজ তুমি করবে। শুরু করবে। বিমল আছে, সে বাকিটা সামলাবে। সে খুবই কাজের ছেলে।’
‘বিমল কাজের ছেলে, কিন্তু বোকা। বেশি সিরিয়াস বলেই বোকা। এই কাজে সিরিয়াস হওয়ার থেকে অনেক বেশি আবেগ দরকার। আমি অন্যরকম ভেবেছি। কাজটার দায়িত্ব অন্য একজনকে দেব। আমার বিশ্বাস, সে-ই সব থেকে ভালোভাবে করবে। সে বড় হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। দেরি হওয়ার পিছনে এটাও একটা কারণ।’
ব্যস এখানেই শেষ। কথাবার্তা যেমন দ্রুত এলও, মিলিয়েও গেল দ্রুত। মহিলা কণ্ঠস্বর চেনা চেনা লাগলেও বিমলকান্তিবাবু ঠিক ধরতে পারলেন না। হয়তো ঘোরের মধ্যে ছিলেন বলেই ধরতে পারেননি। আবার এমনটাও হতে পারে, এইমুহূর্তে তিনি ছিলেন কমলকান্তি। কার সঙ্গে কথা বলছেন জানেন। আলাদা করে কণ্ঠস্বর চেনবার প্রয়োজন হয়নি। সেই কারণেই মাথাও কাজ করেনি। নিজের মধ্যে ফিরে আসবার পর অস্বস্তি হচ্ছে।
অস্বস্তির সঙ্গে ভয়। প্রহ্লাদের ঘটনার থেকে অনেকটা বেশি ভয়। হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসা ভয়। মাত্র কয়েকঘণ্টার ব্যবধানে দু’বার এক ঘটনা কী করে ঘটল! এক ভুল! বাবার কনুইয়ের জ্বালা তিনি অনুভব করবেন কেন? গায়ের ফতুয়াটা না হয় চোখে দেখা যাচ্ছে, কিন্তু লুঙ্গির আড়ালে থাকা পা? সেটা যে ফুলে ভারী লাগছে, এটা তো বোঝা সম্ভব নয়। চটির নীচে আটকে থাকা সেলোটেপ? তার খবর জানবেন কী করে? বাবার পায়ের চটি তো উলটনো নেই। তার ওপর কথা। দুজনের কথা শুনতে পেয়েছেন। যা অসম্ভব। হতেই পারে না। যার সঙ্গেই বাবা কথা বলুন না কেন, মুখে বলেননি, মনে মনে বলেছেন। শুনতে পাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তবু শুনেছেন। সবমিলিয়ে ঘটনা বেশ কয়েক মিনিটের। সকালের মতো পনেরো-বিশ সেকেন্ডে শেষ হয়ে যায়নি। নরমাল অবস্থায় ফিরতে সময় লেগেছে। নরমাল হয়ে কোট প্যান্ট পরে বাবার চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে পড়েছেন ফের। অফিসে বেরোবার সময় রোজ যেমন দেখা করতে আসেন।
কী হচ্ছে এসব! এ কী জটিল সমস্যায় পড়তে হল? একই ভুল বারবার হবে কেন? হতেই পারে না। সমস্যা অন্য কোথাও হচ্ছে।
বই পড়বার শব্দে কমলকান্তি সেন চোখ খুললেন। বিমলকান্তি তাড়াতাড়ি নীচু হয়ে বই দুটো তুলে আলমারির তাকে রাখলেন। নিজেকে সামলে বললেন, ‘সরি বাবা, ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম।’
কমলকান্তি সেন আধশোওয়া অবস্থা থেকে সোজা হলেন। ছেলের ‘সরি’ পাত্তা দিলেন না। বললেন, ‘তাক থেকে কী বই পড়ল?’
আলমারিতে রেখে দেওয়া বই দুটো আবার টানলেন বিমলকান্তি। একটা পড়ল হ্যামলিনের রোমান মিথলজি, আর একটা শিবরাম চক্রবর্তীর গল্প। শিবরাম চক্রবর্তীর নাম শুনে কমলকান্তি সেনের মুখ উজ্জ্বল হল। বললেন, ‘গল্পের বইটা আমার হাতের কাছে এই টেবিলে রাখো। এটা একটা ওয়াণ্ডারফুল বই। এতে রেসিপির ওপর দুর্দান্ত একটা গল্প আছে। পড়বার সময় এত হেসেছিলাম যে, পেটে ব্যথা হয়ে গিয়েছিল। বুঝলে বিমল, বয়সকালে এইসব গল্পের কথা আমি কিছুই জানতাম না। এটা একটা আপশোসের ব্যাপার। আগে শুরু করলে আরও অনেক কিছু পড়তে পারতাম। তবে এখন যে পারছি, এটাও বিরাট সৌভাগ্যের। যাক, গল্পটার কথা বলি। আমি ঠিক জানি না, রান্না নিয়ে এমন ভালো গল্প পৃথিবীর অন্য কোনও ভাষায় লেখা হয়েছে কিনা। আমার বিশ্বাস, হয়নি। গল্পটার নাম ”পাক প্রণালী বিপাক”। তুমি কি গল্পটা জানো?’
বিমলকান্তিবাবু এমনিতেই খুব থতমত অবস্থায় আছেন। এই প্রশ্নে আরও থতমত খেয়ে গেলেন।
বিমলকান্তিবাবু বইটই পড়বার মধ্যে বিশেষ নেই। গল্প উপন্যাস তো একেবারেই নয়। মোটে ভালো লাগে না। গল্প উপন্যাস বানানো ব্যাপার। সিরিয়াস ভাবনাচিন্তার অভাব। লেখকরা যা খুশি লেখেন। লেখালেখির ব্যাপারে কোনও নিয়মকানুন, নিষেধাজ্ঞা নেই বলেই এই হাল। ক’দিন আগে বারিধারার ঘরে একটা গল্পের বই দেখেছিলেন। অন্যমনস্কভাবে সেই বইয়ের কয়েকটা পাতা উলটেও ফেলেন। মাথায় আগুন ধরে যায়। মনে হচ্ছিল, এই বই এখনই জানলা দিয়ে নীচে ফেলে দেওয়া দরকার। ফেলবার আগে পাতাগুলো ছিঁড়ে ফেলতে হবে, যাতে কুড়িয়ে নিয়েও কেউ পড়তে না পারে। এটা একটা বই! এ তো ফাজলামি! শব্দ ন্যালবেলে, বাক্য নড়বড়ে। ঘটনার বাস্তব ভিত্তি নেই। ভাবনায় শিক্ষার ছাপ নেই। গভীর কথা নেই। বারিধারাকে পরদিন বলেও ছিলেন।
‘এসব কী পড়িস বৃষ্টি? এ তো খুবই সাবস্ট্যাণ্ডার্ড লেখা। অতি নিম্নমানের।’
বারিধারা হেসে বলল, ‘খেপেছ বাবা? এই বই কি আমি পড়বার জন্য এনেছি? আমার পড়ার টেবিলের পায়ার নীচে রাখবার জন্য এনেছি। পায়া নড়বড় করছে। শুনলে তুমি খুশি হবে বাবা, বই এত খারাপ যে টেবিলও রিফিউজ করছে। এই বই দিলে আরও নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। আমার ধারণা, গাছের মতো টেবিলেরও প্রাণ থাকে। পড়ার টেবিল বই পড়তে পারে, খাবার টেবিল খেতে পারে, অফিসের টেবিল ফাইলে নোট দিতে পারে, হসপিটালের অপারেশন টেবিল রোগীর পেট কাটতে পারে। এই কারণেই আমার পড়বার টেবিল এই জঘন্য বই পড়তে পেরেছে এবং ঘাড় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছে।’
বিমলকান্তিবাবু সিরিয়াস মুখ করে বললেন, ‘এসব কী কথা! টেবিলের পায়া গোলমাল করছে বলে তুমি এই ধরনের নিম্নমানের বই বাড়িতে নিয়ে আসবে? আজই নতুন টেবিল কিনে নাও।’
এরপরেও বিমলকান্তিবাবু মাঝে মাঝে যেটুকু পড়েন, তার বেশিটাই বিজ্ঞান, ইতিহাস বা জীবনীগ্রন্থ। তা-ও বিশেষ পড়া হয় না। সত্যি কথা বলতে বই পড়ার প্রতি তার টান নেই। বাবার প্রশ্নে আমতা আমতা করে মাথা চুলকোতে থাকেন। চোখ মুখ দেখে কি বোঝা যাচ্ছে, তিনি নার্ভাস? বাবা সম্পূর্ণ অন্য একটা বিষয় নিয়ে মেতে গেছেন। অপ্রয়োজনীয়, ফালতু একটা বিষয়। ছেলের দিকে খেয়াল করবার অবকাশ নেই। এটা ভালো হয়েছে। আজ অফিস বাদ দিলে কেমন হয়? বাড়িতে বসে বিষয়টা নিয়ে ভাবা উচিত। কেন এমন হচ্ছে? একটা মানুষ কখনোই আর একটা মানুষ হয়ে যেতে পারে না। খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও নয়, অনেক বেশি সময়ের জন্য হলেও নয়। অলৌকিক ব্যাপার বলে পৃথিবীতে কিছু নেই। সবকিছুর পিছনে কারণ আছে। বিজ্ঞান, যুক্তি আছে। এই ঘটনার পিছনেও আছে। সেটা হল ভুল। কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। মনের ভুল। একবার পর্যন্ত মনের ভুল বলে এড়িয়ে থাকা যায়। বারবার হলে কীভাবে এড়ানো সম্ভব? নাকি সেটা উচিত। ভাবতে হবে। কাজকর্ম বাদ দিয়ে সিরিয়াস ভাবনা চাই। আজ অফিস বাদ দেওয়া ভালো।
কমলকান্তি সেন ইতিমধ্যে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে ফেলেছেন এবং বেশ জমিয়ে হাসি হাসি মুখে শিবরাম চক্রবর্তী গল্প বলতে শুরু করেছেন। এত উদ্বেগের মধ্যেই বিমলকান্তিবাবু দেখলেন, তার বাবা এই বৃদ্ধ বয়েসেও কত তুচ্ছ অহেতুক বিষয় নিয়ে খুশি।
‘গল্পটা এরকম…শিবরামবাবুর বোন বিনু ক’দিনের জন্য গেছে বাইরে…যাবার আগে দাদাকে একটা রেসিপির বই দিয়ে গেছে। প্রাক প্রণালী। ক’দিন বই দেখে নিজে রান্না করে খেতে হবে। শিবরামবাবু বললেন, এ তো কোনও ব্যাপারই নয়, রান্নার বই যখন আছে রান্না করা অতি সহজ হবে…হা হা…বই দেখে ঠিক করলেন পেঁয়াজের স্যুপ বানাবেন। বইতে লেখা আছে। প্যানে জল গরম করে দিতে হবে আলু, পেঁয়াজ, গোলমরিচ। মজা শুরু হয়েছে খোসা ছাড়ানো আলু থেকে। লেখক বাড়িতে খোসা ছাড়ানো আলু খুঁজে পাচ্ছে না। সব আলুতেই নাকি খোসা…হা হা…তারপর পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে কান্নাকাটি অবস্থা। বইয়ে লেখা রেসিপি হল, পিঁয়াজ দিতে হবে ফুটন্ত জলে। দিতে হবে ছুড়ে। লেখক দূর থেকে পিঁয়াজ ছুড়লেন, কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছেন বার বার…হা হা…একসময় স্যুপ প্যান ছাপিয়ে…স্টোভ ছাপিয়ে এসে লেখককে তাড়া করল। লেখক স্যুপে পা পিছলোলেন। লাফিয়ে উঠলেন খাটে…হা হা…।’
এত পর্যন্ত বলে দম নেওয়ার জন্য থামলেন কমলকান্তি সেন। হাসির চোটে ফর্সা মানুষটার চোখ-মুখ লালচে হয়ে গেছে। বিমলকান্তি কী করবেন বুঝতে পারছেন না। তারও কি হাসা উচিত? মনের এই ভয়ঙ্কর অবস্থায় হাসবেন কী করে? তারপরেও বানিয়ে হাসবার চেষ্টা করলেন বিমলকান্তি। হাসি হল না।
কমলকান্তি সেন বললেন, ‘বুঝলে বিমল এই গল্পটাকে নিছক হাসির হলেও, আসলে একটা দর্শন। ফিলসফি। লিখে রাখা নিয়ম, পদ্ধতি, কারিকুরিতে যে স্বাদু জীবন তুমি তৈরি করতে চাইবে, সে জীবন যে বইয়ের কথামতো নিয়ম মানবে এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। সে জীবন এখন কাণ্ড করতে পারে যা তুমি কল্পনাও করতে পারোনি। সে হাসাবে, কাঁদাবে। উপচে পড়ে ভাসিয়ে দেবে। কখনও পিছনে তাড়া করবে, কখনও ফেলেও দেবে ধাক্কা দিয়ে। শিবরাম চক্রবর্তী খুব বড় লেখক বলে হাসতে হাসতে এই দর্শনের কথা বলেছেন। আবার যদি মনে করো ওসব কিছু নয়, শুধুই হাসাতে চেয়েছেন, প্রাণখোলা হাসি, তাতেও কোনও সমস্যা নেই। তুমি যদি চাও এই গল্পটা পড়তে পারো। আমার মনে হয়, লেখাপড়া জানা বাঙালির এইসব গল্প না-পড়াটা একটা লজ্জার।’
বিমলকান্তিবাবু দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন, না অফিসে যাবেন। এখন যদি ঘরে গিয়ে কোট প্যান্ট ছেড়ে ঘরের পোশাক পরে খাটের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়েন, একটা বিচ্ছিরি হইচই শুরু হয়ে যাবে। বাড়ির সবাই লাফালাফি শুরু করবে। কী হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে? পেট ব্যথা? মাথা ঘুরছে? বুক ধড়ফড়? প্রেসার? হয়তো ডাক্তারও ডেকে আনবে। হয়তো কেন, অবশ্যই আনবে। কী বলবেন? আমার কিছু হয়নি? তোমরা চিন্তা কোরো না। আমি একটা ভুল নিয়ে গোলমালে পড়েছি। ঠাণ্ডা মাথায় ভুলটা ভাবতে চাই। বাড়ির লোক সে কথা মেনে নেবে? অসম্ভব। আরও উত্তেজনা তৈরি করবে। না, তার থেকে অফিসে চলে যাওয়াটা বুদ্ধিমানের। জীবন কি লেখার নিয়ম মেনে তৈরি করা যায়? সে হাসায়, কাঁদায়, উপচে পড়ে, তাড়াও করে। অন্য মানুষ হওয়ার ভুলটা কি সেরকম কিছু? তাড়া করছে?
‘বাবা, গল্পটা আমি পড়ব। আজ অফিসে চললাম।’
কমলকান্তি সেন খুশি হয়ে বললেন, ‘আচ্ছা, বইটা তোমার ঘরে পাঠিয়ে দেব।’
বিমলকান্তিবাবু ঘুরতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। একটু থমকে থেকে বললেন, ‘বাবা, তোমার কি হাতে ছড়ে গেছে? হাতের কনুই?’
কমলকান্তি সেন ছেলের দিকে তাকিয়ে ভুরু কোঁচকালেন।
‘কে বলল?’
বিমলকান্তিবাবু লজ্জা পেয়ে বিড়বিড় করে বললেন, ‘কে যেন বলল…।’
কমলকান্তি সেন ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ‘ভুল বলেছে। অথবা তুমি গুলিয়ে ফেলছ। আমার এরকম কিছু হয়নি।’
বিমলকান্তি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। না, তাহলে সবটাই ভুল। জিগ্যেস করলে হয়তো জানা যেত, বাবার পায়েও কোনও সমস্যা হয়নি।
ছেলে ঘর থেকে বেরোনোর পর কমলকান্তি আবার ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজলেন। ছেলেকে একটা মিথ্যে বললেন। আজ সকালে স্নান করবার সময় তার বাঁ হাতের কনুইয়ের কাছটা ছড়ে গেছে। খুবই সামান্য। তবে এখনও জ্বালা জ্বালা ভাবটা রয়েছে। কিন্তু বিমল জানল কী করে? কোইন্সিডেন্স? তাই হবে।
কমলকান্তি মনে মনে তিরিশ বছর আগে মারা যাওয়া স্ত্রীর সঙ্গে ফের কথা বলা শুরু করলেন। এটা উনি মাঝে মাঝেই করে থাকেন।