» » প্রথম কিস্তি

বর্ণাকার

প্রচেত গুপ্ত

একটু পরে রোদ উঠবে

পাঁচ

‘বাবা, কেমন আছ?’

কমলকান্তি সেন ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে আছেন। তাঁর চোখ বোজা। ছেলের প্রশ্নের তিনি জবাব দিলেন না। তিনি কি অবেলায় ঘুমিয়ে পড়েছেন? অসম্ভব কিছু নয়। নম্বই পেরোনো একজন মানুষের ঘুম, জেগে থাকা সবসময় নিয়ম মেনে হয় না।

বিমলকান্তিবাবু একটু থমকে আবার ডাকলেন।

‘বাবা, বাবা…।’

কমলকান্তি সেনের ইজিচেয়ারটা অ্যান্টিক। সেগুন কাঠ আর লেদারের। পালিশ করা কালো রং ঠিকরে বেরোয়। আজ থেকে বাহান্ন বছর আগে পার্ক স্ট্রিটের অকশন হাউস থেকে কমলকান্তি নিজে দাম হেঁকে কিনেছিলেন। দরাদরির শেষ লড়াই হয় এক ফিরিঙ্গি সাহেবের সঙ্গে। কম্পিটিটরের গায়ের রং ফর্সা বলে কমলকান্তির রোখ চেপে যায়। যে-কোনও বিষয়ে সাহেবদের হারাতে পারলে বাঙালির আলাদা আনন্দ হয়। তিনি হড়বড়িয়ে দাম তুলে দিয়েছিলেন। চেয়ার সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের অফিসে নিয়ে যাওয়া হল। তখনও অফিসে অ্যান্টি চেম্বারের প্রথা চালু হয়নি। বড় কর্তাদের ঘর ছিল একটাই। রাজকীয় চেয়ার-টেবিলে বসে তিনি কাজকর্ম করতেন। ঘরের একপাশে একটা করে ইজিচেয়ার রাখা থাকত। লাঞ্চ আওয়ারে বা কাজের ফাঁকে এই ইজিচেয়ারেই বিশ্রাম। কমলকান্তি যতদিন অফিস করেছেন এই ইজিচেয়ারেই বিশ্রাম নিয়েছেন। তার পুত্র কিন্তু অফিসে বা ওয়ার্কশপে বাবার ব্যবহার করা কোনও চেয়ারে বসেন না। মণিকুন্তলাদেবীর কারণেই এমনটা হয়েছে। কমলকান্তি সেন যেদিন থেকে ব্যবসার কাজে বেরোনো বন্ধ করলেন, সেদিনই মণিকুন্তলাদেবী তার স্বামীর সঙ্গে তর্ক করেন।

‘অফিসে তুমি বাবার চেয়ারে বসবে না।’

বিমলকান্তি অবাক হয়ে বলেন, ‘কেন? আজ থেকে আমাকে তো বাবার ঘরেই বসতে হবে।’

মণিকুন্তলাদেবী শান্তভাবে বললেন, ‘ঘরে বসবে, কিন্তু চেয়ারে বসবে না।’

বিমলকান্তি বিরক্ত হলেন। কিন্তু বিরক্ত হলেও উপায় নেই। এই মহিলার তর্ক তিনি অ্যালাও করেন। ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘কারণটা কি জানতে পারি?’

‘কারণ কিছুই নয়। তাঁর চেয়ারে না-বসা মানে মানুষটাকে সম্মান দেওয়া।’

বিমলকান্তি দু’পাশে হাত ছড়িয়ে ব্যঙ্গের হেসে বললেন, ‘কী অদ্ভুত কথা! তাঁর অফিসে বসব, তাঁর ঘরে বসব, তার হয়ে কাজ করব—তাতে কিছু হয় না, চেয়ারে বসলে ক্ষতি?’

মণিকুন্তলাদেবী বলেন, ‘ক্ষতি তো বলিনি। বলেছি, যে মানুষটা এত বড় একটা প্রতিষ্ঠান তৈরি করলেন, এতদিন ধরে সফলভাবে পরিচালনা করলেন, তাঁর চেয়ারটা দখল না করাই উচিত। থাকলই বা খালি, সমস্যা কী? চেয়ার খালি থাকলেও মনে হবে, তিনি সেখানে আছেন।’

বিমলকান্তি রেগে যান। বলেন, ‘এ সব বস্তাপচা ভ্যালুজ আমাকে শেখাতে যেও না। আমি কি স্কুলের ছাত্র যে মাস্টারমশাইয়ের চেয়ারে বসব না? সব কিছু নিয়ে আর্গুমেন্ট করবে না। আমার অফিসের ব্যাপারে আমাকে বুঝতে দাও।’

মণিকুন্তলাদেবী হেসে ফেলেন। মহিলার এই একটা ক্ষমতা। স্বামীর রাগারাগির সামনে তিনি হাসতে পারেন।

‘অবশ্যই তুমি ছাত্র। তোমার বাবার কাছ থেকে কাজ শিখেছ। তাই না? তাঁকে সম্মান জানানোটা বস্তাপচা ভ্যালুজও যদি হয়, লজ্জার কী আছে? হলে হবে। বুড়ো বাবা-মাকে না দেখাশোনা করাটা আজকাল খুবই আধুনিক একটা বিষয়। তাঁদের নিয়ে গিয়ে পাশের পাড়ার বৃদ্ধাশ্রমে পুরে দেওয়া আরও আধুনিক। আমারটা যদি বস্তাপচা হয়, এগুলো একেবারে খেতের তাজা তরকারি। পটল, ঝিঙে। তুমি কি তবে বস্তাপচা ভ্যালুজের বদলে পটল, ঝিঙে ভ্যালুজ মেনেই চলবে?’

বিমলকান্তি বলেন, ‘পটল-ঝিঙে ভ্যালুজ! এসব কী কথা? তুমি কি রসিকতা করছ মণি?’

‘রসিকতা করছি না, তবে একটা সহজ বিষয় নিয়ে তোমার মতো সিরিয়াস ভাবও করছি না।’

বিমলকান্তিবাবু বলেন, ‘তর্ক কোরো না… তর্ক কোরো না মণি। এমনিতেই চিন্তায় আছি। এতদিন মাথার ওপর বাবা ছিলেন। এখন বলছেন, অবসর মানে ফুল অবসর। আর কাজের কোনও কথা শুনবেন না। ঝামেলায় পড়লেও নয়। আমাকে একা বিজনেস চালাতে হবে। কী যে করব বুঝতে পারছি না। তার ওপর তোমার তর্ক। উফ!’

মণিকুন্তলাদেবী এগিয়ে এসে স্বামীর গায়ে হাত রাখলেন। বললেন, ‘মাথা ঠাণ্ডা করো। ঠিক পারবে। বাবার চেয়ার পাশে রাখলে সব ঝামেলা সামলাতে পারবে। বড় বড় রাজা-বাদশারাও বাবার সিংহাসন পাশে রেখে নতুন সিংহাসনে বসত। আজকালকার দু-চার আনার ছেঁদো বিশ্বাস, মূল্যবোধ, আধুনিকতা নিয়ে মাথা ঘামিও না। যারা ছেঁদো ছেলেমেয়ে হয় তারা বাপ-ঠাকুরদার সম্পত্তি নেওয়ার ব্যাপারে আধুনিকতা দেখায় না। সম্পর্ক বলে কিছু হয় না, কেরিয়ারের জন্য জন্মেছি, কেরিয়ারের জন্য মরব বলে বুক বাজিয়ে বেড়ায়, অথচ বাবা মরল কি মরল না, জমি-বাড়ির হিসেব নিতে ছুটে আসে। এরাই বুড়ো বাবা-মাকে সম্মান দেখাতে কুণ্ঠা বোধ করে। নীচু হয়ে প্রণাম পর্যন্ত করে না। পারলে বাবার সঙ্গে বিজয়ার হ্যান্ডশেক করে। এই যুগে নাকি মাথা নোয়ানো খারাপ। অথচ বাড়ির দলিল খুঁজতে হামাগুড়ি দিয়ে খাটের তলায় ঢুকে যায়। এরা কী ভ্যালুজ ঠিক করে দেবে?’

বিমলকান্তি বলেন, ‘তুমি থামবে মণি? আর লেকচার সহ্য হচ্ছে না।’

স্ত্রীর কাছে রাগ দেখালেও সেদিন অফিসে পৌঁছেই বিমলকান্তি প্রথমে বাবার চেয়ারটা সরিয়ে রাখলেন। নিজের জন্য অন্য চেয়ার এসেছে। সেদিনই বেলা তিনটের পর কোম্পানির ভ্যানে কমলকান্তি সেনের প্রিয় ইজিচেয়ার চলে এসেছে বাড়িতে। মণিকুন্তলাদেবী মুখ টিপে হেসেছেন। মুখে কিছু বলেননি। তিনি এতদিনে বুঝে গেছেন, তার স্বামী মানুষটা সিরিয়াস এবং ভালো। ভালো এবং ছেলেমানুষ।

বিমলকান্তি অফিসে বেরোনোর আগে রোজই একবার বাবার কাছে আসেন। খোঁজখবর নেন। আবার আসেন সন্ধেবেলা। অফিস থেকে ফেরবার পর। কোনও দিন অল্প কথাবার্তা হয়, কোনও দিন শুধু কেমন আছে জেনেই চলে যান। কথা হবে কিনা কমলকান্তির মুডের ওপর নির্ভর করে। তবে কথা হলেও সেখানে ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয়ের প্রবেশ নিষেধ।

দু’বার ডাকাতেও বাবা চোখ না খোলায় বিমলকান্তিবাবু খানিকটা অস্বস্তি অনুভব করলেন। তার দেরি হয়ে যাচ্ছে। অফিসে জরুরি মিটিং আছে। একটা এলসি খোলা নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। বাইরের বড় অর্ডার এসেছে। সাবান, ডিটারজেন্ট, টুথপেস্ট, ফিনাইল, রুমফ্রেশনার সবকিছুর অর্ডার হয়েছে। এইভাবে কোম্পানির সবক’টা প্রডাক্টের অর্ডার চট করে হয় না। প্রায় কোটি টাকার ব্যবসা। এই সময় কোনও সমস্যা হলে বড় লোকসান হয়ে যাবে। অন্য কেউ অর্ডার তুলে নেবে। এই ব্যবসার সব থেকে ঝামেলা হল নামি ব্র্যান্ডের সঙ্গে লড়াই। তারা যদি জানতে পারে সেন অ্যান্ড অ্যাসেসিয়েটস এলসির জটে পড়েছে, অর্ডার তুলে নেওয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে। বিষয়টা নিয়ে বিমলকান্তিবাবু চিন্তিত। তার ওপর প্রহ্লাদ নামের লোকটার ঘটনায় খানিকটা বিব্রত হয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ করে নিজেকে অন্য একটা মানুষ মনে করা বিব্রত হওয়ার জন্য যথেষ্ট। শুধু লোকটার মনের কথা নয়, লোকটার মতো পেট চুলকোনো, ঢেঁকুর সবই হয়েছে। মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। দুম করে নিজেকে একটা অন্য মানুষ মনে হলে মন খারাপ তো হবেই। যে কারও হবে। তার ওপর প্রহ্লাদের মতো অধস্তন কর্মচারীর মতো। আপসেট হওয়ার পক্ষে এই ঘটনা যথেষ্ট। পরে অবশ্য সামলে নিয়েছেন। নিজেকে বুঝিয়েছেন, বয়স বাড়ছে। মস্তিষ্কের নানা কোষ যে মাঝে মাঝে নিয়ম ভেঙে নিজের ইচ্ছেমতো আচার-আচরণ করবে, তাতে আর আশ্চর্য কী? সেখান থেকে তৈরি হয় হ্যালুসিনেশন। কয়েক মুহূর্তের জন্য প্রহ্লাদ নামের লোকটা হয়ে যাওয়া সেরকমই কিছু ছিল। সত্যি নয়, বিভ্রম। লোকটার ওপর বিরক্তি থেকেই হয়তো হয়েছে। এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। নিজেকে এই যুক্তিতে শান্ত করেছেন।

স্নান খাওয়া করে যখন ওপরে বাবার কাছে আসছেন, তখন ছোট মেয়ের সঙ্গে দেখা। বারিধারা সিঁড়ি দিয়ে নামছিল। এই মেয়েটিকে নিয়ে বিমলকান্তিবাবু সব সময়ই চিন্তার মধ্যে থাকেন। কোনও মানুষ যে জীবনকে এমন হালকা চালে নিতে পারে, বারিধারাকে না দেখলে তিনি জানতেও পারতেন না।

এই মেয়ে যখন যা খুশি করতে পারে, বলতে পারে। ভয়ডর বলে কোনও ব্যাপারই নেই। সব থেকে বড় কথা, লোকে কী ভাববে তাই নিয়ে বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা করে না। তার ওপর বড্ড জেদি। অথচ লেখাপড়ায় অতি ভালো। ছবি আঁকতে পারে। স্কুলে পড়বার সময় গান শিখতে যেত। দুম করে একদিন দিল ছেড়ে। বাড়ি এসে বলল, ‘আমি আর গান শিখতে যাব না। ওখানে পরীক্ষা হবে। আমি পরীক্ষা দেব না। গান কোনও পরীক্ষা নয়, গান হল পরীক্ষার পর ছুটি।’

স্ত্রীর কাছে ঘটনা শুনে বিমলকান্তিবাবু মেয়েকে ডেকে পাঠালেন। যত্ন করে মেয়েকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। ‘এটা ঠিক নয় বৃষ্টি। জীবনের সব কিছুই সিরিয়াস ভাবে দেখতে হয়। গানটাও একটা সিরিয়াস বিষয়। আর পাঁচটা সিরিয়াস বিষয়ে যেমন পরীক্ষা আছে, গানের বেলাতেও আছে। পরীক্ষা না দিলে বুঝবে কী করে, তুমি কতটা শিখেছ? তা ছাড়া তুমি তো গান খুব খারাপ করোও না। তোমার ভয় কীসের? পরীক্ষায় তুমি বেশি নম্বর পাবে।’

মেয়ে মুখ গোঁজ করে বলেছিল, ‘আমি জানি গান, আমি খারাপ করি। গানে আমার নম্বর দরকার নেই বাবা, আনন্দ দরকার। আমি গান শিখব না, আমি গান গাইব।’

সেদিনই বিমলকান্তি বুঝেছিলেন এ মেয়ে পরে গোলমাল করবে। তিনি মণিকুন্তলাদেবীকে সাবধানও করেছিলেন।

‘ছোট মেয়েকে মানুষ করতে পারছ না মণি। মেয়ে বেয়ারা হয়ে যাচ্ছে। পাকা পাকা কথা বলতে শিখেছে। জীবনটা লম্বা। এক লাফে পাকা হওয়ার দরকার নেই। কাঁচা থেকে ধাপে ধাপে পাকার দিকে যেতে হয়। মেয়েকে কন্ট্রোল করো।’

মণিকুন্তলাদেবী বারিধারাকে বকাঝকা করে গানের পরীক্ষায় বসালেন। বারিধারা বেসুরো গান গেয়ে পরীক্ষায় ডাহা ফেল করে এবং হাসতে হাসতে বাড়ি ফেরে। এই ঘটনায় বিমলকান্তি আরও চিন্তিত হয়ে পড়লেন।

সিঁড়িতে মেয়েকে দেখে থমকে দাঁড়ালেন বিমলকান্তি।

‘কোথায় চললে? ইউনিভার্সিটি?’

বারিধারা এমনভাবে মাথা নাড়ল, যার মনে হ্যাঁও হয়, নাও হয়। বিমলকান্তিবাবু বললেন, ‘একটু অপেক্ষা করো। আমি তোমায় ড্রপ করে দেব।’

বারিধারা হেসে বলল, ‘তোমার জন্য অপেক্ষা করা যাবে না বাবা। আর্জেন্ট কেস।’

বিমলকান্তি বললেন, ‘ঠিক আছে, তুমি ছোট গাড়িটা নিয়ে যাও। নন্দ এসে গেছে।’

বাড়িতে দুটো গাড়ি। একটা বিমলকান্তিবাবুকে নিয়ে যাতায়াত করে, দ্বিতীয়টি বাড়ির অন্য সবার। এই গাড়ি চেহারায় প্রথমটির থেকেও বড়। তার পরেও গাড়ির নাম ”ছোট গাড়ি”।’ বারিধারা, মেঘবতী ছোটবেলায় এই বিষয়ে তাদের মাকে প্রশ্ন করত।

‘মা, গাড়ি বড় কিন্তু নাম ”ছোট গাড়ি” কেন?’

মণিকুন্তলাদেবী হেসে বলতেন, ‘তোমরা ছোটরা এই গাড়িতে চড়ো বলে গাড়ির নাম ”ছোট গাড়ি”।’

বারিধারা বলত, ‘আমরা বড় হলে কি গাড়ির নাম বদলে যাবে?’

মণিকুন্তলাদেবী উৎসাহ নিয়ে বলতেন, ‘অবশ্যই যাবে।’

বারিধারা হাততালি দিয়ে বলত, ‘খুব মজা হবে, আমরা তখন বড় গাড়িতে চড়ব।’

বারিধারা, মেঘবতী বড় হয়ে গেছে। এর মধ্যে তিনবার গাড়ি বদলেছে। নতুন গাড়ি এসেছে। কিন্তু গাড়ির নাম বদলায়নি। সেই ‘ছোট গাড়ি’ই রয়ে গেছে। বারিধারা, মেঘবতীরা এই নিয়ে কথা বলে না। সম্ভবত ‘ছোট গাড়ি’তে চাপলে তারা এখনও ছোটবেলার মজা পায়। সামান্য নাম বদলে এই অসামান্য মজা তারা নষ্ট করবে কেন? ছোট গাড়ির চালক নন্দ। গত তিরিশ বছর এ বাড়িতে গাড়ি চালাচ্ছে। আগে অফিসের গাড়ি চালাত। পরে বাড়ির গাড়িতে পদোন্নতি হয়েছে। বারিধারা, মেঘবতী ডাকে ‘নন্দকাকা’। বয়স্ক এই মানুষটি বহুবিধ গুণের অধিকারী। সৎ, প্রখর সময়জ্ঞান, দায়িত্ব সম্পর্কে অতি সচেতন। তেল চুরি, মেরামতি থেকে কমিশন, গ্যারেজ থেকে দু’নম্বরী পার্টস কেনা ধরনের কোনও বদভ্যাস তার নেই। বরং অনেক সময় নিজের পকেটের পয়সা দিয়ে গাড়ির কাজ করিয়ে নেয়। এমন পাংচুয়াল ড্রাইভার খুব কমই দেখা যায়। ভোর সাড়ে তিনটে বললেও এক মিনিট নড়চড় হবে না। তিনটের সময় এসে গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে, তেল মবিল চেক করে, টায়ারের হাওয়া টিপেটুপে, ধুলো ঝেড়ে রেডি হয়ে যাবে। দায়িত্বজ্ঞানও মারাত্মক। ছোটবেলোতেও বারিধারা, মেঘবতীকে কোথাও নিয়ে গেলে বাড়ির লোক নিশ্চিন্ত থাকত। নন্দ যখন গেছে চিন্তা নেই। মানুষটার একটাই দোষ। যে দোষ আর সবার থাকলে মেনে নেওয়া যায়, গাড়ির চালকের থাকলে মানা যায় না। অতি অল্প দিনে চাকরি নট হয়ে যায়। গাড়ি চালাতে গিয়ে নন্দ প্রায় সব সময়েই রাস্তা ভুল করে ফেলে। অতি চেনা রাস্তাও সে অতি সহজে গুলিয়ে ফেলে। হাজারবার যে পথে সে গেছে, হাজারবার সেই পথ হারিয়ে ফেলতে পারে। মজার কথা হল, পথ গুলিয়ে সে বিন্দুমাত্র বিচলিত হয় না। মথা চুলকে, লজ্জা লজ্জাভাবে হাসে। যেন ভুল পথে চক্কর কাটা একটা আনন্দের বিষয়। পিছনে বসা যাত্রীদের উদ্দেশে বলে, ‘পথ ব্যাপারটাই গোলমেলে। বার বার হারিয়ে যায়। অবার বার বার ফিরে আসে। এই কারণে পথ হারালে বেশি চিন্তা করতে নাই। পথ নিজে ফিরে আসে।’

নন্দর এই দার্শনিক বোধে বাড়ির সকলে একই সঙ্গে বিরক্ত এবং মুগ্ধ। ফলে বিভ্রান্ত। সম্ভবত এই বিভ্রান্তির কারণেই এই লোকের চাকরি নট হয় না।

‘থ্যাঙ্কু বাবা। তা হলে নন্দকাকার সঙ্গেই চললাম। বাই।’

বারিধারা ফড়ফড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। বিমলকান্তি ভুরু কোঁচকালেন। তিনি তার ছোট মেয়েকে এত ভালোবাসেন কেন? গোলমেলে বলে? এটা কোনও কাজের কথা নয়। কোঁচকানো ভুরু নিয়েই বাবার ঘরের দিকে পা বাড়ালেন বিমলকান্তি।

দু’বার ডাকার পরও কমলকান্তি সেন চোখ খোলেননি। আর কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে? ঘুমিয়ে থাকলে বিরক্ত না করাই ভালো। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎই বিমলকান্তিবাবুর শরীর ঝিমঝিম করে উঠল। তিনি চমকে উঠলেন।

এ কী! কী হচ্ছে এ সব?