» » প্রথম কিস্তি

বর্ণাকার

প্রচেত গুপ্ত

একটু পরে রোদ উঠবে

পাঁচ

অর্চিনের মুখ তেতো।

মাসখানেক যাবৎ এই সমস্যা হয়েছে। সকালে অর্চিনের ঘুম ভাঙছে মুখে তেতো স্বাদ নিয়ে। স্বাদটা চট করে চলে যায় না। একসময়ে মনে হত চা এবং সিগারেট খেলে চলে যাবে। যায়নি। দ্বিতীয় দফায় চা এবং সিগারেট খেওে যায়নি। বরং তেতো ভাবের সঙ্গে সিগারেটের কষা ভাব যুক্ত হয়েছে। মুখটাকে আরও বিচ্ছিরি করে দিয়েছে।

এ বাড়িতে সিগারেট খাওয়ার নিয়ম নেই। কেউ খায় না বলেই হয়তো নিয়ম নেই। কে-ই বা খাবে? পুরুষমানুষ বলতে বিমলকান্তি সেন, কমলকান্তি সেন। আর দারোয়ান ভবানী। এরা কেউই ধূমপায়ী নয়। মেঘবতীর স্বামী জ্যোতিষ্ক সিগারেট খায় ঠিকই, কিন্তু এ বাড়িতে এলে খায় না। তার বউ কড়া নজর রাখে। সেন অ্যাসোসিয়েটসের অফিসার, কর্মচারীরা আসে। মালিকের বাড়িতে তাদের সিগারেট খাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। ফলে গোটা বাড়িটাই নো স্মোকিং জোন। অর্চিনের ঘর একতলার পিছন দিকে। একসময় বাড়ির গেস্টরুম ছিল। পিছন দিয়ে যাতায়াতের পথ আছে। অর্চিন গত তিন বছর এখানেই রয়েছে। গেস্টরুমের ব্যবস্থা খুবই ভালো। দরজা বন্ধ করে সিগারেট খেলে কেউ বুঝতে পারবে না। বুঝলেও কোনও ব্যাপার নয়। বিমলকান্তিবাবু তাঁর স্ত্রীর কাছে খানিকটা রাগারাগি করতে পারেন এই পর্যন্ত। অর্চিনকে সরাসরি উনি কিছু বলবেন না। তিন বছরে এটা বোঝা হয়ে গেছে। বিমলকান্তিবাবু এই ছেলের সঙ্গে বিশেষ কথা বলেন না। দুজনেই একধরনের দূরত্ব বজায় রাখে। তবে কর্তব্যের ব্যাপারে বিমলকান্তিবাবু আর-পাঁচটা বিষয়ের মতো এক্ষেত্রেও সিরিয়াস। আড়ালে অর্চিনের খোঁজখবর নেন, মুখোমুখি হলে নিজেই জানতে চান।

‘কেমন আছ অর্চিন?’

অর্চিন মাথা নামিয়ে বলে, ‘ভালো আছি।’

‘পড়াশোনা কেমন চলছে?’

অর্চিন ঘাড় কাত করে বলে, ‘ঠিক আছে।’

‘ভেরি গুড। অন্য কোনও অসুবিধে নেই তো? খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো হচ্ছে? রাতে ঘুম?’

অর্চিন খানিকটা লজ্জা পেয়েই বলে, ‘সব ঠিক আছে।’

‘অসুবিধে হলে তোমার মাসিকে বলবে।’

অর্চিন কোনও কথা না বলে ঘাড় কাত করে। মণিকুন্তলা সেন তার মাসি ঠিকই, তবে অনেকটা দূরসম্পর্কের। অর্চিনের মা মণিকুন্তলার খুড়তুতো বোন। কাজিন। তাও প্রথম পক্ষের নয়, দ্বিতীয় পক্ষের। প্রথম স্ত্রী নিঃস্তান অবস্থায় মারা গেলে, মণিকুন্তলাদেবীর কাকা আবার বিয়ে করেন। এবার তার মেয়ে হয়। একটা নয়, তিন বছরের ব্যবধানে দুটি মেয়ে হয়। বড় মেয়ে বাড়ির প্রবল আপত্তিতে এক যুবককে বিয়ে করে বিদেশ চলে গেছে। সে আর কোনও সম্পর্ক রাখেনি। ছোট মেয়ের একমাত্র সন্তান এই অর্চিন। প্যাঁচালো সম্পর্ক। আজকাল এই ধরনের সম্পর্ককে আত্মীয়তার মধ্যে ধরা হয় না। বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান হলে, নেমন্তন্নর তালিকা থেকে অনায়াসে নাম বাদ দেওয়া যায়। তাই এই বাড়ির লোকজনদের সঙ্গে অর্চিনের আচরণ যে খানিকটা ফর্মাল হবে তাতে আর আশ্চর্য কী? উল্টোটাও সত্যি। বাড়ির লোকদেরও একটা বাধো বাধো ভাব আছে। অর্চিন যখন এ বাড়িতে থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে সিদ্ধান্ত হয়, তখন অনেকেই অবাক হয়েছিল। বাড়ির ভিতের যেমন হয়েছিল, বাইরেও হয়েছিল। বারিধারা, মেঘবতী থেকে শুরু করে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ভুরু কোঁচকায়। এই ছেলে কে যে তাকে একেবারে বাড়িতে এনে তুলতে হবে? ছেলের বাড়ি কলকাতা থেকে খানিকটা দূরে। ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করে কলকাতায় পড়া যাবে না ঠিকই, কিন্তু তাতে কী হয়েছে? হস্টেল, মেস, পেয়িং গেস্ট নেই? বাইরের হাজার হাজার ছেলেমেয়ে কলকাতায় থেকে কীভাবে পড়াশোনা করে? এই ছেলেকে বাড়িতে এনে তোলার কারণ কী?

বাইরের লোকের কথায় পাত্তা দেননি বিমলকান্তিবাবু। বাড়িরও নয়। শুধু বৃদ্ধ বাবাকে জানিয়েছিলেন। তাও দরজা বন্ধ করে।

‘বাবা, একটা পারমিশন চাই।’

কমলকান্তি সেন বই পড়ছিলেন। মুখের সামনে থেকে বই না সরিয়ে বললেন, ‘অফিস সংক্রান্ত কিছু হলে পাবে না। তুমি জানো, আমি অফিসের ব্যাপারে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি।’অনলাইনে বেস্টসেলিং বই কিনুন

বিমলকান্তিবাবু বললেন, ‘না, অফিস নয়। বাড়ির বিষয়।’

কমলকান্তি বই সরিয়ে বললেন, ‘আমি তোমাদের অনুমতি দিলাম।’

বিমলকান্তি বিরক্ত হলেন। এটা কোনও সিরিয়াস কথা হল? ঘটনা না শুনেই রায়! অন্য কেউ হলে ধমক দিয়ে বসতেন। বাবাকে ধমক দেওয়া যায় না। নিজেকে সামলালেন বিমলকান্তি।

‘বাবা, তুমি কি আগে বিষয়টা শুনবে।’

কমলকান্তি সেনের হাতে রান্নার বই। এটা একটা বিস্ময়ের ব্যাপার। বয়েস বেশি হলে মানুষ সাধারণত হাতে ধর্মগ্রন্থ রাখে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চোখের কারণে পড়তে পারে না। তারপরেও রাখে। স্পর্শে যদি পুণ্যি হয়। কমলকান্তি সেনের ঘটনা অন্যরকম। কয়েকবছর হল বুড়োমানুষটা রান্নার বইতে মজেছে। রেসিপি পড়ে একইসঙ্গে প্রভূত আনন্দ পাচ্ছেন, আবার মুগ্ধও হচ্ছেন। একই জিনিস এতরকমভাবে রান্না করা যায়! সেসবের আলাদা আলাদা স্বাদ, বর্ণ, গন্ধ, চেহারা! কই এসব তো তাঁর জানা ছিল না। এ যেন ম্যাজিকের মতো। অথচ ম্যাজিক নয়। মানুষই মাথা খাটিয়ে বের করেছে! নিরন্তর করে চলেছে। রান্নাঘর যেন একটা বড় রসায়নাগার! পরীক্ষার পর পরীক্ষা, আবিষ্কারের পর আবিষ্কার! মজার কথা হল, এই গবেষণার কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। কখনও ফর্মুলা তৈরি হচ্ছে, কখনও ভাঙছে। কখনও অনেক আয়োজন দিয়ে ছোটখাটো খাবার বানিয়ে ফেলা যাচ্ছে, কখনও সামান্য আয়োজন থেকে অসাধারণ কোনও ‘ডিশ’ হচ্ছে। এতদিন কমলকান্তি সেনের ধারণা ছিল খাবার শুধু পেটের ক্ষুধা নিবৃত্ত করে। রান্নার বই পড়ে সেই ধারণা থেকে তিনি বেরিয়ে এসেছেন। এখন তাঁর বিশ্বাস, খাবার শুধু পেট নয়, মনের ক্ষুধাও মেটায়। তিনি নানা ধরনের দেশি-বিদেশি রান্নার বই কিনে আনাচ্ছেন। ফোন করে বইয়ের দোকান, পাবলিশার্সকে অর্ডার দিচ্ছেন। ছোট নাতনিকে দিয়ে অনলাইনে বই কেনাচ্ছেন। নিজে জীবনে কখনও রান্না করেননি। রান্নার ব্যাপারে তাঁর কোনও ইন্টারেস্টও ছিল না। বাড়িতে কখনও জানতে চাননি কী রান্না হচ্ছে। যেমন দেওয়া হত তেমনটাই খেয়ে নিতেন। রান্নার মধ্যে যে এত বিস্ময়, এত রহস্য লুকিয়ে আছে তাঁর জানা ছিল না।

সেদিনও কমলকান্তির হাতে রান্নার বই ছিল। বইয়ের নাম, ‘দ্য নাইফ’। জেফরি কর্ড নামে এক ব্রিটিশ সেফের লেখা। প্রায় একশো বছর আগে লেখা। এটা ঠিক রেসিপির বই নয়। প্রাক রান্না প্রস্তুতি। জেফরি কর্ড দেখিয়েছেন, কীভাবে বিভিন্ন ধরনের আনাজপাতি বিভিন্ন মাপে, চেহারার কাটা যায়। এতে রান্নার স্বাদও বদলে দেওয়া যায়। আলু গোল করে কাটলে একরকম, চিরে কাটলে আরেকরকম। আবার মোটা করে চিরলে একরকম, সরু করে চিরলে আরেকরকম। ছুরি দিয়ে কাটাকুটির ব্যাপার বলে বইয়ের নাম ‘দ্য নাইফ’। নাম শুনলে মনে হবে খুনের গল্প। কমলকান্তি সেন মন দিয়ে পড়ছিলেন। আচ্ছা, এই বই যদি বাংলায় লেখা হয় তাহলে নাম কী হবে? বঁটি? বঁটি নামে কোনও বই কি মানুষ আগ্রহ নিয়ে পড়বে?

খানিকটা অন্যমনস্কভাবেই ছেলেকে বললেন, ‘বলো শুনছি। কীসের ব্যাপারে অনুমতি চাই?’

বিমলকান্তিবাবু নীচু গলায় বললেন, ‘একজন আমাদের বাড়িতে থাকবে।’

কমলকান্তি সেন বললেন, ‘ভালো কথা, থাকবে। বাড়িতে লোক থাকা ভালো। বাড়ি হল ফুলদানির মতো। ফাঁকা মানায় না।’

বিমলকান্তিবাবু বললেন, ‘মণিকুন্তলার দূরসম্পর্কের এক বোনের ছেলে। বাইরে থাকে। আমাদের এখানে থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে।’

‘আরও ভালো কথা। বাড়িতে পড়াশোনা হবে। এর জন্য অনুমতি কীসের? তাছাড়া বাড়ি আমার একার নয়। বাড়ি সবার। মণিকুন্তলারও। আমার অনুমতির কী প্রয়োজন?’

বিমলকান্তিবাবু এবার দ্বিধার সঙ্গে বললেন, ‘ছেলেটি অন্য কোথাও না থেকে আমাদের এখানে কেন থাকবে এই বিষয়ে কি তুমি কিছু জানতে চাও বাবা?’

‘অবশ্যই চাই না। আমি চাই, এবার তুমি যাও। আমি একটা জরুরি বই পড়ছি।’

বিমলকান্তি গম্ভীরভাবে চাপা গলায় বললেন, ‘তুমি না চাইলেও আমি বলব বাবা। বাড়ির আর কারও না হোক, তোমার জেনে রাখা দরকার।’

কথা শেষ করে বিমলকান্তি উঠে গিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে এলেন।

এই ছেলের সঙ্গে এ বাড়ির সম্পর্ক যে গভীর হবে না সেটা বোঝাই যায়। খানিকটা ব্যতিক্রম বারিধারা। বয়েসে কাছাকাছি। বারিধারা ‘অর্চিদা’র সঙ্গে মাঝেসাঝে গল্প টল্প করে, ঠাট্টা ইয়ার্কি করে। মেঘবতীও হইচই করতে চেষ্টা করেছে। খুব একটা সুবিধে করতে পারেনি। শুধু সম্পর্কের দূরত্ব নয়, অর্চিন গোটানো ধরনের ছেলে। চুপচাপ থাকতে পছন্দ করে। বাড়ির সকলেই এ কথা বুঝে গেছে। কেউ তাকে আগ বাড়িয়ে বিরক্ত করে না। সবথেকে বড় কথা হল, ছেলেটা ভালো। শুধু পড়াশোনায় নয়, স্বভাবেও ভালো। কোনও চাহিদা নেই। খাওয়া, পরা নিয়ে মাথা ঘামায় না। পেলেই হল। বাড়িতে কেউ অসুস্থ হলে আগ বাড়িয়ে ব্যস্ততা দেখায় না, কিন্তু ঘরের বাইরে চুপ করে বসে থাকে। শান্তভাবে খোঁজ নেয়। রাত করে বাড়ি ফেরে না। বাড়িতে বন্ধুবান্ধব এনে আড্ডা দেয় না।

অর্চির সিগারেট খাবার মতো যথেষ্ট বয়স হয়েছে। সে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ফাইনাল ইয়ারে পড়ছে। মেকানিক্যাল। তাদের ক্লাসের ছেলেমেয়েরা নানা ধরনের নেশা করে। অর্চিন করে না। সে শুধু সিগারেট খায়। তবে বাড়িতে খায় না। রাতেও চেষ্টা করে না খেতে। তারপরেও কোনও কোনও রাতে খুব ইচ্ছে হলে পা টিপে টিপে ছাদে চলে যায়। সকালে কমলাদি চা এনে দরজা ধাক্কায়। তাকে বলা আছে, তিনবারের বেশি ধাক্কা দেওয়ার দরকার নেই। তিনবারেও যদি দরজা খোলা না হয় তাহলে ধরে নিতে হবে, সে ঘুমোচ্ছে। কমলাদি এরপরেও দরজা ধাক্কা দিয়ে যায়। যতক্ষণ না দরজা খোলা হয় ততক্ষণ ধাক্কা চলে। অর্চিন বাধ্য হয়ে দরজা খুলে চা নেয়। চা খেয়ে অর্চিন বাড়িরে বাইরে বেরোয়। গলির মোড়ে আসে। বড় রাস্তা পার হলে ফুটপাথে পরপর চায়ের ঝুপড়ি। সেখানে বসলে খানিকটা আড়াল হয়। বাড়ির কেউ বেরোলে তাকে চট করে দেখতে পাবে না। সেখানে বসে অর্চিন খবরের কাগজ পড়ে, সিগারেট খায়।

মুখের তেতো স্বাদ নিয়ে গোড়ার দিকে ঋষা ঠাট্টা করত।

‘ও তাই বল, এই কারণে তোর কথাগুলো দিন দিন এমন তেতো হয়ে যাচ্ছে।’

অর্চিন সহজভাবে বলেছে, ‘হতে পারে। এবার পকেটে মধুর শিশি নিয়ে ঘুরব। কথা বলবার আগে পকেট থেকে বের করে কয়েক ফোঁটা খেয়ে নেব। তারপর তোর সঙ্গে কথা বলব। তখন কথাগুলো মিষ্টি লাগবে।’

ঋষা বলেছে, ‘লাভ হবে না। তোর মুখের অন্য টেস্ট বাডগুলো নষ্ট হয়ে গেছে অর্চি। শুধু একটাই কাজ করছে। বিটার সেনসিটিভ পার্ট। তুই যা বলবি, সবই তেতো লাগবে। যাকে বইয়ের ভাষায় বলে তিক্ত।’

অর্চিন হাই তুলে বলল, ‘তাহলে তো ভালোই হল। অনেককে বাধ্য হয়ে তিক্ত কথা বলতে হয়। এখন আর তার প্রয়োজন হবে না। যদি বলি, তুমি কী ভালো! তাহলেও তেতো শোনাবে। এটা একটা বিরাট সুবিধে।’

আজ আর বিষয়টাকে হাসি-ঠাট্টার মধ্যে রাখল না ঋষা।

সকালেই ফোন করেছে। অর্চিন ঝুপড়িতে বসে আছে। তার পকেটের মোবাইল বাজল।

‘কী করছিস?’

অর্চিন বলল, ‘বসে আছি। ফোন করেছিস কেন?’

ঋষা বলল, ‘সাতসকালের ব্যাপার বলে সাতসকালে ফোন করেছি। একটু আগে মনে হল, তোর রোজ সকালে উঠে খালি পেটে এক গ্লাস করে জল খাওয়া দরকার।’

অর্চিন হেসে বলল, ‘ডাক্তারি করছিস?’

ঋষা বলল, ‘হ্যাঁ করছি। নিশ্চয় তোর অ্যাসিডের সমস্যা হচ্ছে। জল খেলে কমবে।’

অর্চিন বলল, ‘হতে পারে। হলেও সকালে উঠে জল খেতে পারব না। এরপর তো বলবি, যোগাসন করতে। তারপর বলবি ছোলা সিদ্ধ খেয়ে মর্নিংওয়াকে যেতে।’

ঋষা বলল, ‘দরকার হলে তাই যাবি।’

‘সরি, পারলাম না। ছোট বিষয় নিয়ে এত চিন্তা করিস না। সময় নষ্ট হবে।’

ঋষা বলল, ‘আমার সময় আমাকে বুঝতে দে। তুই ডাক্তার দেখা। মুখে সারাক্ষণ তেতো ভাব ঠিক নয়। অনেক সময় লিভার বা গলব্লাডার থেকেও প্রবলেম হতে পারে।’

অর্চিন বলল, ‘বাদ দে। শরীর একসময় বিষয়টা মানিয়ে নেবে। সে জানবে তেতো স্বাদটা তার জন্য স্বাভাবিক। মানুষের শরীরের এটাই মজা ঋষা। সে ভালো এবং মন্দ দুটোর সঙ্গেই নিজেকে অ্যাডপ্ট করে নিতে পারে। যেমন ধর…যেমন ধর…যে মানুষ ঠিকমতো খেতে পায় না, তার শরীরও একটা পর্যায়ের পর থেকে মানিয়ে নিতে শেখে। আমরা যেমন খাবার থেকে ভিটামিন, কার্বোহাইড্রেট, প্রাোটিন, জল এসব বের করে নিই, না খেতে পাওয়া মানুষের শরীর অনাহার, অপুষ্টি থেকে তার নিজের মতো করে ভিটামিন, কার্বোহাইড্রেট, প্রাোটিন সংগ্রহ করে। করতেই হয়। নইলে বাঁচবে কী করে?’

ঋষা বিরক্ত গলায় বলল, ‘বাঁচে না। বাঁচলে ধুঁকতে ধুঁকতে বাঁচে।’

অর্চিন গম্ভীরভাবে বলল, ‘বাঁচা অনেকরকম হয় ঋষা। মরাই বরং একরকম। সবাই একরকমভাবে মরে। হার্ট বন্ধ। ধনী মানুষের যা, গরিবেরও তাই। কিন্তু বাঁচা একেকজনের কাছে একেকরকম। আমাদের বাড়িতে কমলকান্তি সেন একানব্বই বছর বয়েসে দুধে-ভাতে বেঁচে আছে। পৃথিবীর কোথাও আবার আট বছরের আদিবাসী ছেলে গাছের পাতা শিকড় খেয়ে বেঁচে আছে। সবটাই বাঁচা। একটা মানুষের বাঁচা, একটা পশুর।’

ঋষা একটু চুপ করে বলল, ‘লেকচার স্টপ কর। আজ রেজাল্ট।’

এই কথার উত্তর দিল না অর্চিন। সে জানে এই সেমিস্টারেও সে ফার্স্ট হবে। তার কিছু এসে যায় না। সে ঠিক করে ফেলেছে, সে আর লেখাপড়া করবে না। লেখাপড়া করা মানে সময় নষ্ট। সে একজন পাতি ইঞ্জিনিয়ার হয়ে পেটি বুর্জোয়া কেরিয়ার করবার জন্য জন্মগ্রহণ করেনি। তার জন্য অনেক বড় কাজ অপেক্ষা করছে।

সবার আগে মাসির বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হবে।