» » প্রথম কিস্তি

বর্ণাকার

প্রচেত গুপ্ত

একটু পরে রোদ উঠবে

চার

হাসি সহজ বিষয়, কিন্তু কান্না সহজ বিষয় নয়। কান্না জটিল বিষয়। মানুষ কেন হাসে? এই প্রশ্নের উত্তর সহজ। মানুষ হাসে মূলত তিনটি কারণে। খুশিতে, উন্মাদ হলে এবং বানিয়ে। কিন্তু মানুষ কেন কাঁদে সে প্রশ্নের উত্তর চট করে বলা যায় না। একটা কান্নার পিছনে অনেক রকম কারণ থাকতে পারে। জটিল বিষয় হল, কান্নার কারণ অধিকাংশই পরস্পরবিরোধী। মানুষ যেমন দুঃখে কাঁদতে পারে, আবার আনন্দেও কাঁদতে পারে। প্রেমে কাঁদে, বিরহে কাঁদে। মারধর খেলে কাঁদে, আদর পেলে কাঁদে। অনেক সময় দেখা যায় দুম করে অনেকটা টাকাপয়সা পেয়ে মানুষ কাঁদছে। হঠাৎ করে নিঃসন্তান, অকৃতদার ছোটমামার সম্পত্তি বা লটারি পেলে এমনটা হয়। একে বলে ‘গদগদ কান্না’। আবার ধনদৌলত চলে গেলে কাঁদে। টাকার শোক। মানুষ ঈশ্বরের কাছে কাঁদে। বলে, ‘ঠাকুর, আমাকে দাও, দাও, আরও দাও। যশ, অর্থ, যৌবন, আয়ু তোমার স্টকে যা আছে সব দিয়ে দাও ঠাকুর। আর ক’টা দিনই বা বাঁচব? ভোগ করব আর ক’টা দিন? সুতরাং দেরি না করে দিয়ে দাও।’ একই মানুষ শয়তানের কাছে কাঁদে। কেঁদে বলে, ‘আমার ওপর নজর দিও না প্লিজ। তোমার ঘোড়ার খুরের মতো দুটি পায়ে পড়ি। আর কিছুদিন এই পোড়া পৃথিবীটাকে ভোগ করে যেতে দাও।’ মানুষ ধনীর কাছে ভিক্ষুক সেজে কাঁদে। ভিক্ষুকের কাছে ধনী সেজে কাঁদে। বছরের একদিন গরিবকে লোটাকম্বল বিলির সময় ধনী মানুষকে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে চোখ খামচে কাঁদতে হয়। সম্ভবত শাস্ত্রে এরকমই নিয়ম। গরিব মানুষকে দানধ্যানের সময় চোখের  জল ফেলতে হয়। নইলে পুণ্যি ফুলপ্রুফ হয় না। ফাঁক থেকে যায়। ফাঁক দিয়ে পাপ ঢুকে পড়ে।

এই জন্যই কান্নার কারণ সহজে ধরা মুশকিল।

বারিধারা কিন্তু তার দিদির কান্নার কারণ ধরতে পারে। এই যে মেঘবতী টেলিফোনে ভেউ ভেউ করে কাঁদছে, বারিধারা তার কারণ বলে দিতে পারে। নো কারণ। কাঁদবার মতো উপযুক্ত কোনও কারণ ছাড়াই তার দিদি সুন্দর কাঁদতে পারে। মেঘবতী যদিও একটা দুর্বল যুক্তি দেখায়। সেটা এত তুচ্ছ, অকিঞ্চিৎকর, হাস্যকর যে কেউ মানে না। আগে রেগেও যেত। বকাবকি করত। কখনও বলা হত নেকা, কখনও ছিঁচকাদুনে। এখন সবার অভ্যেস হয়ে গেছে। মেঘবতীর কান্না এখন ইগনোর করা হয়। ছোটবেলা থেকেই বারিধারা এই জিনিসই দেখে আসছে। তবে একটা নিশ্চিন্তির ব্যাপার হল, দিদির কান্না দ্রুত থেমে যায়। এক পশলা বৃষ্টির মতো। মাটি ভেজার আগেই শেষ। মণিকুন্তলাদেবী বড় মেয়েকে ছোটবেলা থেকেই বোঝাতে চেষ্টা করেছেন।

‘এরকম করে না সোনা।’

মেঘবতী ছোট মাথা কাত করে বলত, ‘কেন? করলে কী হবে?’

‘রাখল বালকের গল্পের মতো হয়ে যাবে।’

ছোটবেলা থেকে মেঘবতীর চোখ বড়। সেই চোখ আরও বড় করে সে বলত, ‘সেটা কী গল্প মা?’

মণিকুন্তলাদেবী গুছিয়ে গল্প শুরু করতেন। তাঁর আশা হত, গল্প শুনে মেয়ে নিজেকে শুধরোবে।

‘এক গ্রামে একটা রাখাল বালক ছিল। মাঠে ভেড়া চড়াতে যেত আর মিথ্যে মিথ্যে চিৎকার করত…বাঘ এসেছে, বাঘ এসেছে…আমাদের বাঁচাও…বাঘ আমার সব ভেড়া নিয়ে গেল। চিৎকার শুনে গাঁয়ের লোকেরা লাঠিসোটা নিয়ে রে-রে বলে ছুটে আসত। এসে দেখত, কোনও বাঘ নেই! তারা রাখাল বালককে গালি দিতে দিতে ফিরে যেত। পরদিন রাখাল বালক আবার মিথ্যে করে চেঁচাতে লাগল…বাঘ এসেছে…বাঘ এসেছে। একদিন কিন্তু সত্যি সত্যি বাঘ এল…রাখাল বালকও চিৎকার করতে লাগল…বাঘ এসেছে বাঘ এসেছে…কিন্তু সবাই ভাবল মিথ্যে…কেউ আর এল না…বাঘও ভেড়ার ঘাড় মটকে দিয়ে গেল।’

মেঘবতী বলল, ‘ইস! খুব খারাপ হল।’

মণিকুন্তলাদেবী মেয়ের মাথায় আদর করে হাত বুলিয়ে বলতেন, ‘হ্যাঁ সোনা, খুব খারাপ হল। তোমারও কিন্তু রাখাল বালকের মতো অবস্থা হবে মেঘ। যেদিন তুমি সত্যি সত্যি কাঁদবে, কেউ তোমার কাছে আসবে না। বলবে, মেঘবতীর কাছে গিয়ে কী হবে? ও তো কারণ ছাড়াই কাঁদে। তুমি কি আমার কথাটা বুঝতে পেরেছ?’

মেঘবতী ঘাড় কাত করে বলে, ‘হ্যাঁ মা, বুঝতে পেরেছি।’

‘তাহলে তুমি আর কখনও এমনি-এমনি কাঁদবে না তো?’

মেঘবতী চুলের ঝুঁটি নাড়িয়ে বলে, ‘না মা। এমনি এমনি কাঁদব না।’

মণিকুন্তলাদেবী মেয়ের গালে চুমু খান। বলেন, ‘আমার লক্ষ্মী মেয়ে। আমার হিরের টুকরো মেয়ে।’ তারপর নিশ্চিন্ত মনে কাজে চলে যান। ছোট্ট মেঘবতী খেলনা ছড়িয়ে বারান্দায় রান্নাবাটি খেলতে বসে এবং একটু পরেই ডুকরে কেঁদে ওঠে। মণিকুন্তলাদেবী ছুটে আসেন।

‘কী হল? কী হল মেঘ। কাঁদছ কেন?’

মেঘবতী মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘মা, আমার ওই ভেড়াটার জন্য মন কেমন করছে?’

মণিকুন্তলা একটু আগের গল্প ভুলে গেছেন। তিনি অবাক হয়ে বললেন, ‘ভেড়া! কোন ভেড়া?’

মেঘবতী ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ‘যাকে বাঘ ঘাড় মটকে নিয়ে গেল, সেই ভেড়াটার জন্য।’

মণিকুন্তলাদেবী মেয়ের গালে চড় বসালেন। মেঘবতীর একটা গুণ ছিল। সে ছোটবেলায় মারধর বা বকাঝকায় কখনও কান্নাকাটি করেনি। থম মেরে গেছে, ঠোঁট ফুলিয়েছে, কিন্তু চোখের জল ফেলেনি। মান-অভিমানেও আর পাঁচজন মেয়ের মতো ‘ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ’ করা তার ধাতে নেই। এই স্বভাব এখনও আছে। বড় কোনও বিপদ বা দুঃসংবাদে হাত-পা ছড়িয়ে ‘আগে তো খানিকটা কেঁদে নিই’ গোছের অভ্যেস তার নেই। ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে। এসব ব্যাপারে সে অবশ্যই শক্ত মনের। আসলে জেনুইন কারণে কান্নাকাটি মেঘবতীর পোষায় না।

দিদির কান্না শুনতে শুনতে বারিধারা পাশে রাখা প্যাকেট থেকে পোটাটো চিপস খেতে লাগল। সে রোজ প্রতিজ্ঞা করে, আজই শেষ। কাল থেকে চিপস ছোঁবে না। কিন্তু প্রতিজ্ঞা রাখতে পারে না। বাড়িতে ঢোকবার সময় দোকান থেকে প্যাকেট নিয়ে ঢোকে। মনকে বোঝায়, কাল থেকে আর নয়। পরদিন মন বিশ্বাসঘাতকতা করে। আগের দিনের প্রতিজ্ঞা ভুলিয়ে দেয়। শুধু চিপস নয়, সবরকম জ্যাঙ্ক ফুডের প্রতি বারিধারার দুর্নিবার আকর্ষণ। বন্ধুরা বারণ করে।

‘এভাবে যা খুশি খাস না বারি। মোটা হয়ে যাবি। এই ছিপছিপে ফিগার নষ্ট হয়ে যাবে।’

বারিধারা গম্ভীরভাবে বলে, ‘আমার একটু মোটা হওয়ার দরকার ত্রিধি।’

ত্রিধি অবাক হয়ে বলে, ‘মোটা হওয়ার দরকার। মানে? কী আবোলতাবোল বকছিস? তোর মতো চেহারার জন্য আমরা হেদিয়ে মরছি। ডায়েট, জিম কী না করছি? আর তুই বলছিস মোটা হবি!’

বারিধারা আরও গম্ভীর মুখে বলে, ‘তোর চেনাজানা কোনও জিম আছে ত্রিধি? মাসখানেকের মধ্যে মোটা করে দেবে? আছে চেনা?’

‘তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেল বারি? তুই মোটা হওয়ার জিম খুঁজছিস? তোর সব কিছুই উলটোপালটা।’

বারিধারা ত্রিধির কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘কিছুই উলটোপালটা নয়। তুই আগে ঘটনাটা শোন, তাহলেই সব বুঝতে পারবি। পরশু মুম্বাই থেকে একটা মেল পেয়েছি। আমিরকাকুর মেল। আমিরকাকু কে বল তো? আমির খান। আমির খানকে চিনিস তো? ওর নেক্সট সিনেমায় আমাকে হিরোইন করতে চাইছেন। ফেসবুকে আমার ফটো দেখে পাগল। বলেছেন, তোমার চোখ মুখ নাক চিবুক এভরিথিং অলরাইট। শুধু খানিকটা ওয়েট গেইন করতে হবে। আমার হিরোইন মোটা।’

ত্রিধি হেসে বলল, ‘গুল থামা। আর নিতে পারছি না।’

বারিধারা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘জানিস তো আমির খানের সিনেমা মানেই সুপার ডুপার হিট। সেখান থেকে নতুন ট্রেন্ড সেট হবে। তখন একটার পর একটা সিনেমা তৈরি হবে মোটা হিরোইন নিয়ে। তারা ট্যুইট করে মোটা হওয়ার টিপস দেবে। যাকে বলে সৌন্দর্যের গোপন রহস্য। কেউ বলবে, আমি দুপুরে পেটপুরে ভাত ঘি খেয়ে ঘুম লাগাই। কেউ বলবে, টিফিনে দুটো আস্ত আলু সিদ্ধ না খেলে আমার মন খারাপ হয়ে যায়। কেউ বলবে চিপস চকোলেট আইসক্রিম না থাকলে আমি পার্টিতে যাই না। সব মেয়েরা তখন মোটা হওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগবে। দেখবি কী কাণ্ড হয়! একটু থেমে কাতর গলায় বারিধারা বলল, ‘প্লিজ ত্রিধি, আমাকে একটা মোটা হওয়ার জিম খুঁজে দে। এক মাসের মধ্যে মোটা না হতে পারলে আমিরকাকু খুব বকাবকি করবে। চল, আগে ফুচকা খেয়ে আসি।’

এ সব ঠাট্টা-ইয়ার্কি করলেও বারিধারা জানে, হাবিজাবি খাবার অভ্যেস তাকে ছাড়তে হবে। আজ তার চেহারা ছিপছপে ঠিকই, কিন্তু সে চেহারা নষ্ট হতে কতদিন? শুধু সুন্দর হওয়ার ব্যাপার নয়, অসুখবিসুখও আছে। তবে চারপাশে এত রোগা হওয়ার ধুম দেখে বিশ্রী লাগে। শুধুমাত্র রোগা হওয়ার জন্য কত আয়োজন! কত হইচই! পেট ভরে খাব না, বেলা করে ঘুমোব না। সুযোগ পেলেই লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে দাপিয়ে ঘাম ঝরাব। বাপরে! এত স্যাকরিফাইজ আর পরিশ্রম দেখে অবাক হতে হয়। বারিধারার কখনও কখনও মনে হয়, এই পরিশ্রম, স্যাকরিফাইজের দশ ভাগের এক ভাগও যদি দেশের অসুখে আর অপুষ্টিতে থাকা মেয়েদের জন্য দেওয়া হত…। পরক্ষণেই মনে হয়, এ সব ছেলেমানুষি ভাবনা।

বারিধারা এখন যে চিপস খাচ্ছে, তার সঙ্গে মোটা-রোগার কোনও সম্পর্ক নেই। সে দিদির টেলিফোনিক কান্না থামার জন্য অপেক্ষা করছে। অল্পক্ষণের মধ্যেই কান্না থামিয়ে মেঘবতী কথা বলল।

‘বৃষ্টি, শুনতে পাচ্ছিস?’

বারিধারা চিৎ হয়ে শুয়ে পড়েছে। ডান হাঁটুর ওপর বাঁ পা দিয়ে নাড়াচ্ছে। নাড়াতে নাড়াতেই বলল, ‘হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছি।’

মেঘবতী খানিকটা ধমকের গলাতে বলল, ‘তাহলে চুপ করে আছিস কেন?’

বারিধারা মুখে চিপসের কচমচে আওয়াজ করে বলল, ‘চুপ করে থাকব না তো কী করব? তোর কান্নার সঙ্গে পোঁ ধরব? কান্না কোনও নহবতখানার সঙ্গীত নয় যে, সঙ্গে সানাই বাজাতে হবে।’

মেঘবতী একটু চুপ করে রইল। বলল, ‘তুই কী করছিস?’

বারিধারা নির্লিপ্তভাবে বলল, ‘পোটাটো চিপস খাচ্ছি।’

‘অ্যাঁ, চিপস খাচ্ছিস! আমি কাঁদছি আর তুই চিপস খাচ্ছিস।’

বারিধারা ফের কচরমচর আওয়াজ তুলে বলল, ‘তাতে তোর কী সমস্যা দিদি? তোর কান্নাকাটিতে বিঘ্ন ঘটছে?’

মেঘবতী উত্তেজিত গলায় বলল, ‘তা বলে আমার কান্নার সময় তুই খাওয়াদাওয়া করবি! একটা কোনও সিমপ্যাথি থাকবে না? একবার বলবি না, আহারে দিদি, তুই কাঁদছিস কেন? আমি তোদের কেউ নই? আমার জন্য তোদের কোনও ভাবনাচিন্তা নেই। আমি হাসি, কাঁদি, খাবি খাই, তাতে তোদের কিছু এসে যায় না?’

উত্তেজনা কমলে বারিধারা আহ্লাদি ধরনের গলায় বলল, ‘আহারে দিদি, তুই কাঁদছিস কেন?’

টেলিফোনের ওপাশে মেঘবতী খানিকটা চুপ করে রইল। গজগজ করে বলল, ‘কী হবে শুনে?’

বারিধারা নির্বিকার গলায় বলল, ‘কিছু হবে না। তার পরেও যদি বলতে চাস বলতে পারিস। আমার ধারণা, তুই আজ কোনও গুরত্বপূর্ণ কারণে কান্নাকাটি করছিস। মনে হচ্ছে, তুই মাছের ঝোলে আজ বেশি নুন দিয়ে ফেলেছিস। জ্যোতিষ্কদা খেতে বসে রেখে আগুন হয়ে গেছে। খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়েছে। অফিস যাবার আগে ঘোষণা করেছে, অনেক হয়েছে, আর নয়, এবার তোকে ডিভোর্স করবে। ঠিক বলেছি?’

মেঘবতী গম্ভীর গলায় বলল, ‘ফাজলামি করছিস? ছ’বছরের বড় দিদির সঙ্গে ফাজলামি করছিস?’

বারিধারা হেসে বলল, ‘সরি দিদি। কান ধরছি। এখন থেকে বাবার মতো সিরিয়াস হয়ে গেলাম। ড্যাম সিরিয়াস। এবার বল কী হয়েছে।’

মেঘবতী একটু চুপ করে থেকে গলা নামিয়ে বলল, ‘তোর জামাইবাবু একটা ভয়ঙ্কর কাণ্ড করেছে। আজ সকালে রাস্তা থেকে একটা ভিখিরিকে ধরে বাড়িতে নিয়ে এসেছে।’

বারিধারা ধড়ফড় করে উঠে বসল। বড় হয়ে সে বুঝতে পেরেছিল, মায়ের রাখাল বালকের গল্পটা ঠিক ছিল না। দিদির সঙ্গে যায় না। গল্পের বালক ‘বাঘ এসেছে’, বলে মিথ্যে কথা বলেছিল। দিদি সহজে মিথ্যে বলে না। সেই কারণেই বোকার তালিকায় তাকে দু’নম্বরে রাখা হয়েছে। যে মানুষ মিথ্যে বলে না, সে একজন উচ্চমানের বোকা ছাড়া আর কী? ছোটবেলা থেকেই মিথ্যে না-বলার বোকামি করে আসছে দিদি। এর জন্য তাকে কম হেনস্থা হতে হয়নি। স্কুলে এবং বাড়িতে অহরহ ঝামেলায় পড়তে হয়েছে। নিজের দুষ্টুমিজনিত অপরাধ কখনোই সে অন্যের ঘাড়ে চাপাতে পারত না। চুপ করে থাকত, কিন্তু মিথ্যে বলত না। স্বীকারও করে ফেলত। গুরুজনেরা তখন বকাঝকা, কান মলা, ঝুঁটি নাড়ার জন্য ‘রে-রে’ করে ঝাঁপিয়ে পড়ত। সেই দুর্যোগে বড় নাতনিকে বাঁচাতেন কমলকান্তি সেন।

‘যে মিথ্যে বলছে না তাকে তোমরা বকাবকি করো কোন মুখে?’

মণিকুন্তলাদেবী রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, ‘মিথ্যে বলে না বলে সব অপরাধ মাপ করে দিতে হবে। এটা আপনি কী বলছেন বাবা! অত সুন্দর ফুলদানিটা কীভাবে ভেঙে গেছে, সেটা একবার দেখবেন না? এত হুটোপাটি করলে চলে? এরা তো বাড়ির সব ভালো জিনিস নষ্ট করে ফেলবে।’

কমলকান্তি ঠান্ডা গলায় বলেন, ‘সত্যি বলবার মতো ভালো জিনিস যে বাড়িতে আছে, সে বাড়ির আর দু-চারটে ভালো জিনিস ভেঙে গেলে সমস্যা নেই। বউমা, তুমি মাথা ঘামিও না। মেঘকে আমি শাসন করে দেব।’

কমলকান্তি সেন খুশি হলেও, দিদির সত্যি কথা নিয়ে বারিধারা একেবারেই খুশি ছিল না। বিরক্ত ছিল। রাগও করত। বহু জায়গায় দিদি মিথ্যে বলতে পারেনি বলে তাকেও বিপদে পড়তে হয়েছে। সেই কারণে যেসব গর্হিত কাজে ধরা পড়বার চান্স ছিল, সেগুলো সে দিদিকে বলতে পারত না।

‘এই ভরদুপুরে কোথায় যাচ্ছিস?’

‘পড়তে। মানির বাড়িতে গিয়ে জিওমেট্রি করব।’

‘সে কী রে বৃষ্টি! এই যে কাল বললি মানিরা সাউথে বেড়াতে গেছে। বললি না?’

‘বলেছিলাম বুঝি? ঠিকই বলেছি। বেড়াতে গেছে তো কী হয়েছে? ফিরে এসেছে। বেড়াতে গেলে কেউ ফেরে না?’

‘এই গেল, এই ফিরে এল!’

‘জিওমেট্রি করবে বলে ট্যুর ক্যানসেল করে ফিরে এসেছে। হয়েছে? এবার তোর জেরা বন্ধ করবি দিদি?’

‘অ্যাই বৃষ্টি, বল না কোথায় যাচ্ছিস? প্লিজ বল, সিনেমা? কী সিনেমা?’

‘খেপেছিস, তোকে বলে মরি আর কী? তুই হলি সত্যবাদিনী। মায়ের একটু চাপেই হড়হড় করে সত্য কথার ফুলঝুরি ফোটাবি। দিদি সত্যবাদিনী হলে বোনের যে কী বিপদ হয়, তা আমি হাড়ে হাড়ে জানি। কথা না বাড়িয়ে টাকা দে দেখি। পপকর্ন খাব।’

এই মেয়ের কথা ভুল হতে পারে, কিন্তু মিথ্যে হবে না। ‘ভিখিরি’ না আনলেও জ্যোতিষ্কদা যে বাড়িতে কাউকে ধরে এনেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। বারিধারা বলল, ‘সে কী রে, ভিখিরি এনেছে মানে! লোকটা কোথায়?’

মেঘবতী ফিসফিস করে বলল, ‘একতলার গেস্টরুমে।’

বারিধারা চমকে উঠল, ‘অ্যাঁ, গেস্টরুমে। বলিস কী রে দিদি! ভিখিরি গেস্টরুমে!’

মেঘবতী বলল, ‘হ্যাঁ, তোর জামাইবাবু সেরকম ব্যবস্থা করে অফিস চলে গেছে। ভেবে দেখ একবার। এর পরও কাঁদব না? বল, কাঁদব না?’

বারিধারা একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘কী করছে লোকটা?’

মেঘবতী ধরা গলায় বলল, ‘একটু আগে গুপির মাকে নীচে দেখতে পাঠিয়েছিলাম, সে ঘর পর্যন্ত যেতে পারেনি। ভিখিরিটার জামাকাপড় থেকে বোঁটকা গন্ধ বের হচ্ছে। তবে সিঁড়ির মুখ থেকে শুনে এসেছে বাঁশি বাজাচ্ছে।’

বারিধারা উত্তেজনায় খাট থেকে নেমে উঠে দাঁড়াল।

‘অ্যাঁ, বাঁশি বাজাচ্ছে। বলিস কী রে দিদি! সত্যি বাঁশি বাজাচ্ছে?’

মেঘতীকে জবাব দিতে হল না। টেলিফোনের ওপাশ থেকে বাঁশির আওয়াজ ভেসে এল। বারিধারা থমকে গেল। এই ঘন হয়ে আসা সকালবেলা বালিগঞ্জের বাড়িতে কে বাঁশি বাজাচ্ছে!