» » প্রথম কিস্তি

বর্ণাকার

প্রচেত গুপ্ত

একটু পরে রোদ উঠবে

তিন

মোস্ট ইনটেলিজেন্ট।

এটা একটা গোপন গবেষণার নাম। সহজ বাংলা করলে যার মানে দাঁড়ায় সেরা বুদ্ধিমান এবং সেরা বুদ্ধিমতী। গবেষিকার নাম কুমারী বারিধারা সেন।

সব গবেষণাতেই একজন গাইড থাকে। ‘মোস্ট ইনটেলিজেন্ট’ গবেষণাতেও আছে। গাইডের নাম শ্রীকমলকান্তি সেন। কমলাকান্তি সেন গত চৈত্র মাসের সতেরো বা আঠেরো তারিখ একানব্বই বছরে পা দিয়েছেন। যেহেতু মানুষটার জন্মবিষয়ক কোনও কাগজপত্র নেই এবং সাক্ষী নেই, তারিখ নিয়ে খানিকটা বিভ্রান্তি রয়েছে। সম্প্রতি সেই বিভ্রান্তি আরও বেড়েছে। কিছুদিন আগে এক সকালে কমলকান্তি সেন তাঁর বাঁধানো দাঁতের পাটি যত্ন করে পরে নিয়ে ঘোষণা করলেন।

‘আমার জন্ম চৈত্র মাসে নাও হতে পারে। মাসটা মনে হচ্ছে, ভুল করছি।’

মণিকুন্তলাদেবী কাছাকাছি ছিলেন। শ্বশুরমশাইয়ের ছাতুর সরবতে লেবুর রস মেশাচ্ছিলেন। দুটো গোটা পাতিলেবু। পাতিলেবু হল বার্ধক্য নিরোধক। কমলকান্তি সেন দিন শুরু করেন পাতিলেবু দিয়ে। তার কথায় মণিকুন্তলা আঁতকে উঠলেন।

‘সে কী! এ আপনি কী বলছেন বাবা! এতদিন তো আমরা চৈত্র মাসই জানতাম।’

কমলকান্তি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলেন, ‘এটা কোনও কথা নয় বউমা। মানুষের জানা প্রতি মুহূর্তে বদলায়। এই ধরো, একটা সময় পর্যন্ত আমরা জানতাম, মঙ্গলগ্রহে পৌঁছোনো যায় না। সে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এখন কি আমরা সেই জানাটাই ধরে বসে আছি? না, বসে নেই। অথবা ধরো, আমরা জানতাম, পৃথিবী অনেকটা না হলেও, খানিকটা সভ্য হয়েছে। যতটা সভ্য হয়েছে, তাতে আর যাই ঘটুক, শিশুহত্যার মতো ভয়ংকর ঘটনা ঘটবে না। ক’দিন আগে আমেরিকার স্কুলে যেভাবে ছাত্রদের গুলি করে মারা হল, তার পরেও কি আমাদের সেই জানা বদলায়নি? আজও কি আমরা বলতে পারব, মানুষ বিন্দুমাত্র সভ্য হয়েছে? না, পারব না। এখন জেনেছি, আমরা অতি অসভ্য। পৃথিবীর আদিম মানুষও এত অসভ্য, বর্বর ছিল না। তাই বলছি, কোনও জানা আঁকড়ে পড়ে থেকো না।’

মণিকুন্তলাদেবী শ্বশুরের হাতে শরবতের গ্লাস তুলে দিয়ে আমতা-আমতা করে বললেন, ‘তারিখ এদিকে-ওদিক হতে পারে, তা বলে একেবারে মাসটাই বদলে যাবে বাবা! এটা কি ঠিক হবে?’

কমলকান্তি কৌতুক ভরা গলায় বললেন, ‘ঠিক-বেঠিক কী আছে? ফাল্গুন কি মাস হিসেবে খারাপ?’

মণিকুন্তলাদেবীর সঙ্গে তার শ্বশুরমশাইয়ের সম্পর্ক সহজ। খুবই সহজ। বাঙালি বাড়িতে এমনটা হয় না। বিয়ের আগেই শাশুড়ির মৃত্যু হয়েছিল। ফলে এ বাড়িতে পা দেওয়ার পর সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব কমলকান্তি পুত্রবধূর হাতে তুলে দেন। বলেছিলেন, ‘সংসার মানেই ঝামেলা। এ বাড়িতে মনে হয় বেশি ঝামেলা। সবচেয়ে বড় ঝামেলা আমার ছেলে। আমার ধারণা, খুব অল্পদিনের মধ্যে তুমি সুটকেস গুছিয়ে বাপেরবাড়ি ফিরে যাবে। আমি হলে তাই করতাম। তোমার বরের মতো মানুষের সঙ্গে কারও দুটো দিন থাকাও অসম্ভব। যাই হোক, যখন যাবে আমাকে বলে যাবে।’

মণিকুন্তলাদেবী এই কথায় বিরাট ঘাবড়ে যান। নতুন বউকে এ আবার কী কথা! কান্না চেপে বিড়বিড় করে বলেছিলেন, ‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’

কমলকান্তি সেন এই কথায় জবাব না দিয়ে বললেন, ‘এখনও পর্যন্ত তোমাকে বুদ্ধিমতী মনে হচ্ছে। পরে কী মনে হবে জানি না। আশা করি তুমি ঝামেলা সামলাতে ব্যর্থ হবে।’

বিয়ের এত বছর হয়ে গেল, মণিকুন্তলাদেবী সুইকেস গুছিয়ে যাননি। তিনি এখন মেঘবতী এবং বারিধারা নামে দুই কন্যার মা। একজনের ডাক নাম মেঘ, আরেকজন বৃষ্টি। মেঘবতীর বিয়ে হয়ে গেছে। বারিধারা ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। ফাইনাল ইয়ার। দূর সম্পর্কের এক বোনের ছেলে অর্চিন এ বাড়িতে থাকে। সে-ও কলেজে ভর্তি হয়েছে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। মণিকুন্তলাদেবী আজও সঠিকভাবে জানেন না সংসারের ঝামেলা সামলাতে তিনি ব্যর্থ না সফল।

একানব্বই বছরের কমলকান্তি প্রতিদিন সন্ধে সাতটার মধ্যে ডিনার সারেন আর সকাল ছ’টার মধ্যে স্নান করেন। তিনি মনে করেন, রাতের খাবার এবং ভোরের স্নান যত আগে হবে, মানুষের জরা তত পিছিয়ে যাবে। এর মধ্যে ঠান্ডা-গরমের ব্যাপারও আছে। দিনের শেষ খাওয়া হবে গরম, দিনের প্রথম স্নান হবে ঠান্ডা। বাড়ির লোকের দুটোতেই আপত্তি। এই বয়সে গরম খাবার খাদ্যনালি এবং এবং পাকস্থলীর জন্য ঠিক নয়। সকালের স্নান করা উচিত গরম জলে। নইলে যে-কোনও সময় সর্দি-কাশি এবং শেষ পর্যন্ত নিউমোনিয়া পর্যন্ত গড়াতে পারে। একদিন গড়াবেও। কমলকান্তি সেন আপত্তি আমল দেন না। গত তিরিশ বছর ধরেই দেন না। ভোরবেলা স্নান করবার সময় বাথরুম থেকে তাঁর কণ্ঠস্বর ভেসে আসে।

“মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,

মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।

এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে

জীবন্ত হৃদয়ে স্থান যদি পাই!”

বৃদ্ধ মানুষটি তাঁর পুত্রের ঠিক উলটো চরিত্রের। বিমলকান্তি বাষট্টি বছরেই নিজেকে বয়স্ক, ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত ভেবে বসে আছেন। কমলকান্তি একানব্বইতে পৌঁছে মনে করেন, আরও দশ-পনেরো বছর অনায়াসে হেসে-খেলে বাঁচা যায়। তাঁর ছোট নাতনি এই বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করেছে।

‘একটু বয়স হলেই মানুষ ফোঁস ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর বলে, অনেক তো হল, এবার যেতে পারলেই ভালো। অথচ তুমি আরও বাঁচতে চাও। কেন?’

কমলকান্তি সেন বলেন, ‘অনেক কারণ আছে।’

বারিধারা বলে, ‘নিশ্চয় দার্শনিক ধরনের কোনও উত্তর দেবে। আজকাল তোমার মধ্যে ফিলজফি ভাব প্রকট হয়েছে।’

কমলকান্তি বলেন, ‘পুরুষ মানুষ বালক বয়েসে থাকে খেলোয়াড। খালি খেলব খেলব করে। তরুণ বয়সে রোম্যান্টিক। কবি হব, প্রেম করব, বিপ্লব করব। মাঝবয়সে ব্যবসায়ী। কোথা থেকে কতটুকু রোজগার করব সেই সন্ধান। সর্বক্ষণ লাভ-ক্ষতির হিসেব। শেষ বয়েসে হয়ে যায় দার্শনিক। যা দেখেছি তা নয়, যা ভাবছি তা নয়, ভিতরেও আরও কিছু আছে। অন্য কিছু। এমন কিছু, যা দেখাও যায় না, ভাবাও যায় না। এখন আমার সেই পিরিয়ড চলছে রে বৃষ্টি। দার্শনিক পিরিয়ড।

বারিধারা আঁকতে উঠল। বলল, ‘এই রে আবার শুরু হল। সোজা প্রশ্নের সোজা উত্তর দাও দাদু। এত বয়স হল, তার পরেও তুমি আরও বেঁচে থাকতে চাইছ কেন?’

কমলকান্তি সেনের শরীর-স্বাস্ব্য ভালো। এই বয়সের তুলনায় অতিরিক্ত ভালো। সুগার, প্রেসার, কোলেস্টেরল, আর্থরাইটিসের সমস্যা নেই বললেই চলে। আহার, নিদ্রা, বাহার তিনটিই নরমাল। বেশিরভাগ রাতেই ঝরঝরে ঘুম হয়। দিনে পেট পরিষ্কার। কমলকান্তি নিজে বলেন, ‘অল ক্লিয়ার।’ বেলা বাড়লে খিদে খিদে লাগে। এটাও সুলক্ষণ। আর কী চাই? বাঁধানো দাঁত, গোল চশমা আর একটা পাকানো হাতলের পুরোনো শক্ত লাঠি ছাড়া বাইরের কোনও সাহায্যই প্রায় লাগে না। এই বয়সে শরীর ঠিক থাকলেও মনে নানা অসুখ দেখা দেয়। নানা ধরনের বাতিক। বাতিক থেকে সন্দেহ। সন্দেহ থেকে বিষণ্ণতা। কমলকান্তি সেনের মাথা এ সব থেকে মুক্ত। গৃহ চিকিৎসক ডাক্তার মুখার্জি বলেছেন, ‘ব্রেন সেলের অবস্থা এখনও ঠিক আছে বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। ঘটনা এক্সসেপশনাল তবে ইমপসিবল নয়।’ এই বিষয়ে কমলকান্তি সেনের থিওরি আলাদা।

‘সবাই মনে করে স্মরণশক্তিই মানুষের আসল ক্ষমতা। কথাটা মোটেই ঠিক নয়। স্মরণের সঙ্গে বিস্মরণও চাই। অনেক কিছু মনে যেমন রাখতে হবে, তেমন ভুলেও যেতে হবে বহু কিছু। নইলে ব্রেনে চাপ পড়ে। সুখ, দুঃখ, টেনশনে সেল ক্ষইতে থাকে। আমি মনে রাখবার সঙ্গে সঙ্গে ভুলে যাওয়ার ক্ষমটাও রপ্ত করে ফেলেছি। মস্তিষ্কে তাই ঝামেলা কম।’

ডাক্তার মুখার্জি মাথা নাড়েন। বলেন, ‘হতে পারে…হতে পারে। শরীর, মনের বহু রহস্য তো আজও সলভ করা যায়নি।’

এই বয়েসে সমস্যা হওয়ার কথা কানেও। ফ্লুইড শুকিয়ে আসে। মানুষ হয় কম শোনে, নাহয় ভুল শোনে। যন্ত্র লাগাতে হয়। কমলকান্তি সেনের সেই ঝামেলাও নেই। তার শ্রবণক্ষমতা তীক্ষ্ণ। দূরের হালকা আওয়াজও শুনতে পান। বলেন, ‘বেঁচে থাকাটা বড় কথা নয়। কীভাবে বেঁচে আছি সেটা বড় কথা। আনন্দে বেঁচে থাকলে চোখ, হার্ট, কান, মাথা সব আনন্দে থাকবে। মনমরা হলে সব মনমরা।’

ডাক্তার মুখার্জি এবারও বলেন, ‘হতে পারে…হতে পারে।’ চশমার ফাঁক দিয়ে নাতনির দিক পিটপিট করে খানিকটা তাকিয়ে কমলকান্তি সেন বললেন, ‘শুনবি, কেন আমি আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতে চাই?’

‘শুনব বলেই তো জিগ্যেস করেছি।’

কমলকান্তি একটু চুপ করে রইলেন। তারপর ছেলেমানুষের মতো লজ্জা লজ্জা মুখ করে বললেন, ‘আসলে আরও কয়েকটা রোববার কচি পাঁঠার ঝোল দিয়ে দুপুরে ভাত খেতে চাই রে বৃষ্টি। দু-এক টুকরো মাংসের পিস, একটা বড় আলু, ঝোলে কাঁচালঙ্কার ঝাল। আহা! তারপর টেনে ঘণ্টা দুয়েক ঘুম। জীবনে আর কী চাই? ওপরে গেলে কি এই সিস্টেম পাব? ওখানে রোববার দুপুরে পাঁঠার মাংস দেয়? মনে হয় না। হয়তো বলবে, এখানে এসব চলে না। নীচে যা অনাচার করবার করে এসেছেন। এখন দুধ-খই সোনামুখ করে খেয়ে নিন। রোববার দুপুরে পাঁঠার মাংসের ঝোল আর ভাতঘুম আরও কয়েকটা বছর বেঁচে থাকবার জন্য কি এনাফ রিজন নয়? তুই কি বলিস বৃষ্টি?’

বারিধারা একটুক্ষণ চুপ করে থাকে। ভুরু কুঁচকে বলে, ‘ক’বছর চাইছ?’

কমলকান্তি একটু ভাবেন। বলেন, ‘বেশি নয়, এখন তো নাইটি ওয়ান চলছে। এই ধর আরও বছর দশ-বারো।’

বারিধারা চোখ বড় করে বলল, ‘তার মানে ইউ আর এক্সপেক্টটিং মোর দ্যান ওয়ান হ্যান্ড্রেড?’

কমলকান্তি সেন মাথা দুলিয়ে মুচকি হেসে বললেন, ‘আমি তো আর একটু বেশি বলতে চেয়েছিলাম। ঘাবড়ে যাবি বলে বললাম না।’

বারিধারা তার দাদুর ওপর ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘দাদু তুমি কি চাইনিজ ওরিজিন? মানে তোমার পূর্বপুরুষরা কেউ চীন দেশের মানুষ ছিলেন?’

‘হতে পারে। কেন বল তো?’

বারিধারা উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলল, ‘চীনারা অনেকদিন বাঁচে। ক’দিন আগেই নেটে দেখলাম, একজন একশো আটাশ বছর পর্যন্ত বেঁচে রেকর্ড করেছেন। গোয়াং জি প্রদেশে বাড়ি। নাম লিও মেজহিয়ান।’

কমলকান্তি সেন চোখ জ্বল জ্বল করে বললেন, ‘তাহলে তুই বল বৃষ্টি, আমি কী এমন বেশি বলেছি? সত্যি কথা বলতে কী, মনে মনে আমার তেমনই ইচ্ছে। পনেরো-কুড়ির একটা টার্গেট আছে। পাছে তুই ঘাবড়ে যাস তাই বলিনি। কমিয়ে বললাম।’

বারিধারা হেসে বলল, ‘খুব ভালো। এখন থেকে তোমাকে কমলকান্তি সেনের বদলে কমলকান্তি মেজহিয়ান বলে ডাকব। তুমি চপস্টিক দিয়ে খাওয়াদাওয়া শুরু করো। তবে চীনে কি রোববার দুপুরে মাংসের ঝোল খেয়ে ভাতঘুম দেওয়ার নিয়ম আছে? দাঁড়াও, নেট দেখতে হবে। আমরা হলাম নেটান। নেটে দেখে বিদ্বান।’

এই কমলকান্তি সেনই নাতনিকে ‘মোস্ট ইন্টেলিজেন্ট’ গবেষণার আইডিয়া দিয়েছেন। নাম শুনে মনে হবে, সেরা বুদ্ধিমান এবং সেরা বুদ্ধিমতী বিষয়ক গবেষণা। ঘটনা কিন্তু মোটেই তা নয়।

‘এই গবেষণা করে কী লাভ হবে দাদু?’

‘নিজেকে বুঝতে পারবি।’

‘কী বুঝব?’

‘বুঝবি, লেখাপড়ার পরীক্ষায় যতই ফার্স্ট হোস, আসলে তুই একটা বোকা। গবেষণা যত এগোবে, তত নিজের বোকামির মাত্রা ধরতে পারবি। এটা একটা ভালো ব্যাপার নয়?’

বারিধারা উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘অবশ্যই ভালো ব্যাপার। নিজে কতটা বুদ্ধি রাখি এটা মোটামুটি বোঝা হয়ে গেছে। এবার কতটা বোকা, দেখতে হবে। থার্মোমিটারের মতো আমার এই রির্সাচ হবে বোকামিটার। আচ্ছা, রিসার্চ পেপারের নাম কী রাখব?’

কমলকান্তি আবার চুপ করে রইলেন। নীচু গলায় বললেন, ‘আচ্ছা, বোকার উলটো কিছু রাখি যদি? ধর…ধর বুদ্ধি…না না…আচ্ছা ইনটেলিজেন্ট রাখলে কেমন হয়? মোস্ট ইনটেলিজেন্ট।’

বারিধারা হাততালি দিয়ে বলল, ‘দারুণ হয়। গবেষণায় বোকাদের নামের তালিকা তৈরি করব, অথচ নাম হবে মোস্ট ইনটেলিজেন্ট। ইউ আর গ্রেট ডার্লিং। আমি আজই কম্পিউটরে ফাইল খুলে ফেলছি।’

কমলকান্তি সেন উত্তেজিতভাবে ফিসফিস করে বললেন, ‘খুলে ফেল। লিস্ট তৈরির কাজ শুরু হয়ে যাক আজ থেকেই। বৃষ্টি দেখবি, গবেষণা কেমন বারে বারে লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে। একরকম ভাবে এগোচ্ছিস, হয়ে যাবে আরেকরকম। এটাই মজা। যাকে কাল বোকা ভেবেছিলি, আজ দেখবি সে কেমন বুদ্ধিমান হয়ে গেছে। আজ যাকে বুদ্ধিমান ভেবে লিস্টে নাম তুলবি, কাল দেখবি ব্যাটা বিরাট গাধা। কালকের মার্কসিস্ট আজ হাতে পাথর পরে ঠাকুরের ছবিতে প্রণাম ঠুকছে। বিজ্ঞানী কুসংস্কারে বিশ্বাস করছে। ল্যাবরেটরিতে ঢোকবার আগে বাঁ পা বাড়াচ্ছে। কোনও বিপ্লবীকে দেখবি চরম রাইটিস্টকে বামপন্থী ভেবে জড়িয়ে ধরছে। আবার উলটোটাও পাবি। কুঁকড়ে-মুঁকড়ে থাকা কোনও বোকাকে দেখবি একদিন হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঠান্ডা মাথায় বিপদ থেকে কাউকে রক্ষা করে তোকে চমকে দিয়েছে! পরীক্ষায় গোল্লা পাওয়ায় যাকে এতদিন বোকা ভেবেছিস, সে-ই দেখবি ফুটবল ম্যাচে প্যাঁচ কষে গোল দিয়ে এসেছে। দেখবি ভাবনাচিন্তা সব গোল পাকিয়ে যাবে। যাকে এক নম্বর বোকা ভেবেছিলি, সে দেখবি সাত নম্বরে চলে গেছে। জানতেও পারবি না। প্রতিদিন বুঝতে পারবি, নিজের বিচারবুদ্ধি কত ভুল! কত বোকা! কাকে বুদ্ধি বলে তাই নিয়েই ধন্দে পড়বি।’

বারিধারা মুগ্ধ গলায় বলল, ‘ওয়ান্ডারফুল! ওয়ান্ডারফুল! দাদু কার নাম দিয়ে গবেষণায় কাজ শুরু করব?’

কমলকান্তি সেন হাত বাড়িয়ে নাতনির মাথার চুল এলোমেলো করতে করতে হেসে বললেন, ‘নিজের নাম দিয়ে। দুনিয়ায় নিজের থেকে বড় বোকা আর কে আছে?’

‘মোস্ট ইনটেলিজেন্ট’ গবেষণার লিস্টে প্রথম নাম রয়েছে বারিধারা সেন। দ্বিতীয় নাম মেঘবতী চৌধুরী। এ বাড়ির বড় মেয়ে। বারিধারার থেকে ছয় বছরের বড়। বিয়ে হয়েছে তিন বছর। সে-ই এখন তার বোনকে ফোন করেছে। অনেকক্ষণ ধরে ফোন করছে। বারিধারার মোবাইল বন্ধ। বাধ্য হয়ে সে তার মাকে ফোন করেছে। মেঘবতী মাকে ফোন করতে চায়নি। মায়ের সঙ্গে তার ঝগড়া চলছে। সে প্রতিজ্ঞা করেছে, আর কোনও দিনই সে মায়ের সঙ্গে কথা বলবে না। প্রতিজ্ঞা শুনে বারিধারা বলেছে, ‘এতদিনে একটা বুদ্ধিমানের মতো কাজ করলি। আমি তোকে সাপোর্ট করছি। মোস্ট ইনটেলিজেন্ট লিস্টে তোর নাম দু’নম্বর থেকে সরিয়ে দেওয়া হল।’

মেঘবতী অবাক হয়ে বলল, ‘মোস্ট ইনটেলিজেন্ট লিস্ট! সেটা কী?’

বারিধারা হেসে বলল, ‘এক ধরনের তেল। মাথায় মাখলে বুদ্ধি বাড়ে।’

মণিকুন্তলাদেবী মেয়ের আদর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। এখন আহ্লাদ করছে, এক্ষুনি ঝামেলা শুরু করবে। তার থেকে ভালোয় ভালোয় বিদায় নেওয়াই ভালো। বারিধারা আবার ধপাস করে বিছানায় পড়ল। নিজের মোবাইল চালু করে দিদির নম্বর টিপল।

‘দিদি, বল।’

মেঘবতী চুপ করে রইল।

বারিধারা বলল, ‘কী হল! কথা বলবি তো।’

মেঘবতী ফোনের মধ্যেই ‘ভেউ ভেউ’ করে কেঁদে উঠল।