8
কয়েক দিন কাটিয়া গেল। উল্কা সখীপরিজনবেষ্টিতা হইয়া অন্তঃপুরেই বাস করিতে লাগিল। পুরী পরিত্যাগ করিয়া যাইবার কোনও আগ্রহ সে প্রকাশ করিল না— মহারাজও অন্য বাসভবনের উল্লেখ করিলেন না। বৃদ্ধ কঞ্চুকী বহুদিন পরে নিজ কার্য ফিরিয়া পাইয়া মহা উৎসাহে উল্কার তত্ত্বাবধানে লাগিয়া গেলেন। কোথাও বিন্দুমাত্র ত্রুটির ছিদ্র রহিল না।
রাজসভাতেও উল্কা কয়েক দিন নিজ আসনে গিয়া বসিল। সূক্ষ্ম বস্ত্রাবরণের ভিতর উল্কার আলোকসামান্য রূপ যেন শারদ মেঘাচ্ছন্ন শশিকলার প্রভা বিকিরণ করিতে লাগিল। রাজসভা এই নবচন্দ্রোদয়ে কুমুদ্বতীর মতো উৎফুল্ল হইয়া উঠিল। ভিতরে ভিতরে সভাসদ্গণের মধ্যে নানা উৎসুক জল্পনা চলিতে লাগিল।
মহারাজ সেনজিৎ কিন্তু তাঁহার নিরুৎসুক নিস্পৃহতার মধ্যে অটল হইয়া রহিলেন। উল্কাকে তিনি পদোচিত মর্যাদা ও সমাদর প্রদর্শন করিতেন; কিন্তু তাহার বেশি কিছু নয়। উল্কা বিস্মিত হইয়া লক্ষ্য করিল, মহারাজের আচরণে নারীজাতি সম্বন্ধে একটা নীরস ঔদাসীন্যের ভাব রহিয়াছে— রাজন্যবর্গের পক্ষে ইহা যেমন অসাধারণ, তেমনই বিস্ময়কর। উল্কা হতাশ হইল না, বরঞ্চ মহারাজকে কুহকমন্ত্রে পদানত করিবার সঙ্কল্প তাহার কুলিশ-কঠিন হৃদয়ে আরও দৃঢ় হইল।
কিন্তু একদিন রাজসভায় একটি ঘটনা দেখিয়া উল্কা অধিকতর বিস্ময়াপন্ন হইল। মহারাজের ব্যবহারে অনাড়ম্বর মৃদুতা দর্শনে উল্কার বিশ্বাস জন্মিয়াছিল যে, সেনজিৎ স্বভাবত দুর্বলপ্রকৃতি— চিত্তের দৃঢ়তা বা পুরুষোচিত সাহস তাঁহার নাই। এই ভ্রান্তি তাহার সহসা ভাঙ্গিয়া গেল।
মহারাজ সেনজিৎ সেদিন যথারীতি সিংহাসনে আসীন ছিলেন। সভামধ্যে চণ্ডের রহস্যময় মৃত্যু সম্বন্ধে নানা জল্পনা ও কৌতুকের অনুমান চলিতেছিল, উল্কা আকুঞ্চিত অধরে অর্ধ-নিমীলিত নেত্রে শুনিতেছিল, এরূপ সময় রাজ-মহামাত্র দৌড়িতে দৌড়িতে সভায় প্রবেশ করিয়া বলিল— ‘আয়ুষ্মন্, সর্বনাশ উপস্থিত, পুষ্কর ক্ষিপ্ত হইয়াছে। সে শৃঙ্খল ছিঁড়িয়া এই দিকেই ছুটিয়া আসিতেছে।’
‘পুষ্কর’ রাজার পট্ট হস্তীর নাম। এই সংবাদ শুনিয়া সভামধ্যে বিষম চাঞ্চল্য ও গণ্ডগোল উপস্থিত হইল। কিন্তু সেনজিৎ কিছুমাত্র বিচলিত না হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন— ‘তোমরা শান্ত হও, ভয় নাই— আমি দেখিতেছি।’ বলিয়া তিনি বাহিরের দিকে চলিলেন।
মহামাত্র সভয়ে বলিল— ‘আয়ুষ্মন্, পুষ্কর তাহার রক্ষককে শুণ্ডাঘাতে বধ করিয়াছে, আমিও তাহাকে শাসন করিতে পারি নাই। এ অবস্থায় আপনি তাহার সম্মুখীন হইলে—’
মহারাজ তাহার কথায় কর্ণপাত করিলেন না, বহু স্তম্ভযুক্ত উন্মুক্ত সভামণ্ডপের প্রান্তে আসিয়া দাঁড়াইলেন। সঙ্গে সঙ্গে উদ্যতশুণ্ড প্রকাণ্ড উন্মত্ত হস্তী বৃংহিতধ্বনি করিতে করিতে তাঁহার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। হস্তীর গণ্ড হইতে মদবারি ক্ষরিত হইতেছে, চরণে ছিন্ন শৃঙ্খল, ক্ষুদ্র চক্ষুর্দ্বয় কষায়বর্ণ ধারণ করিয়া ঘূর্ণিত হইতেছে। এই দৃশ্য দেখিয়া সভাসদ্গণ কাষ্ঠপুত্তলীর ন্যায় হতগতি হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। উল্কাও নিজ আসনে উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিল, সে বিস্ফারিত-নয়নে স্পন্দিতবক্ষে চাহিয়া রহিল। কাহারও মুখে বাক্য সরিল না।
সেনজিৎ সভাচত্বর হইতে অবতরণ করিয়া হস্তীর আরও নিকটবর্তী হইলেন। মদস্রাবী মাতঙ্গ প্রহার-উদ্যমে শুণ্ড ঊর্ধ্বে তুলিল। তখন সেই রুদ্ধশ্বাস নীরবতার মধ্যে সেনজিৎ মৃদু র্ভৎসনার সুরে বলিলেন— ‘পুষ্কর! পুষ্কর!’
পুষ্করের শুণ্ড ঘোরাবেগে অবতরণ করিতে করিতে অর্ধ-পথে থামিয়া গেল। মত্ত হস্তী রক্তনেত্রে মহারাজের দিকে চাহিয়া যেন বিদ্রোহ করিতে চাহিল, একবার দ্বিধাভরে তাহার করদণ্ড ঈষৎ আন্দোলিত হইল— তারপর ধীরে ধীরে শুণ্ড অবনমিত করিয়া সে নম্রভাবে দাঁড়াইল। কয়েক মুহূর্তমধ্যে ধ্বংসের মূর্তিমান বিগ্রহ যেন শান্তিময় তপোবনামৃগে পরিণত হইল।
মহারাজ সস্নেহে তাহার শুণ্ডে হাত বুলাইয়া তাহার কানে কানে কি বলিলেন; পুষ্করের প্রকাণ্ড দেহ লজ্জায় সঙ্কুচিত হইয়া গেল, সে অধোবদনে ধীরে ধীরে পশুশালা অভিমুখে ফিরিয়া চলিল। মহারাজ তাহার সঙ্গে চলিলেন। এতক্ষণে হস্তিপক সাহস পাইয়া মহারাজের অনুবর্তী হইল।
এই ঘটনা উল্কার মনে গভীর রেখাপাত করিল। শত্রুর শক্তি সম্বন্ধে অন্ধ থাকিতে নাই; উল্কাও মহারাজ সম্বন্ধে সতর্ক ও অবহিত হইয়া তাঁহাকে জালবদ্ধ করিবার উপায় চিন্তা করিতে লাগিল।
ওদিকে মহারাজ সেনজিৎ বর্মাচ্ছাদিত যোদ্ধার ন্যায় অক্ষতদেহে বিরাজ করিতে লাগিলেন। তাঁহার অন্তরে কন্দর্পজনিত কোনও বিক্ষোভ উপস্থিত হইয়াছে কি না কেহ অনুমান করিতে পারিল না।
একদা প্রাতঃকালে মহারাজ যথাবিহিত স্নানাদি সম্পন্ন করিয়া পক্ষিভবনে গমন করিলেন। পক্ষিপালন মহারাজের অতি প্রিয় ব্যসন; বহুজাতীয় বিহঙ্গ তাঁহার পক্ষিশালায় নিরন্তর কলরব করিত, তিনি প্রত্যহ প্রাতে স্বহস্তে তাহাদিগকে আহার করাইতেন।
একটি শুক স্বর্ণদণ্ডের উপর বসিয়া ছিল, সেনজিৎ তাহার নিকটে যাইতেই সে ডানা ঝটপট করিয়া উড়িয়া গেল। তাহার চরণের সুবর্ণশৃঙ্খল কোনও উপায়ে কাটিয়া গিয়াছিল; মহারাজ দেখিলেন, শুক উড়িয়া অন্তঃপুরসংলগ্ন উপবনের এক আমলকীবৃক্ষের শাখায় গিয়া বসিল।
এই শুক মহারাজের অতি আদরের পক্ষী, বহুকাল শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকিয়া ভাল উড়িতেও পারে না। তাহাকে ধরিবার জন্য কি করা যায়, মহারাজ চিন্তা করিতেছেন, এমন সময় তিলক-পুণ্ড্রক-চিত্রিত ললাটে বটুকভট্ট আসিয়া স্বস্তিবাচন করিল। তাহাকে দেখিয়া মহারাজ বলিলেন— ‘ভালই হইল। বটুক, আমার শুকপাখিটা উড়িয়া গিয়া অন্তঃপুরের ঐ আমলকীবৃক্ষে বসিয়াছে। তুমি যাও, উহাকে ধরিয়া আন। উদ্যানপালিকাকে বলিলেই সে ধরিয়া দিবে।’
বটুকভট্টের চক্ষু গোলাকৃতি হইল, সে বলিল— ‘রাজার আদেশ অলঙ্ঘনীয়, কিন্তু অনাহূতভাবে রাজ-অবরোধে প্রবেশ করা কি উচিত হইবে? লোকে যদি নিন্দা করে?’
‘নিন্দা করিবে না— তুমি যাও।’
বটুক অতিশয় গম্ভীরমুখে বলিল— ‘অকলঙ্ক-চরিত্র ব্রাহ্মণ-সন্তানকে সর্বদাই সাবধানে থাকিতে হয়—’
মহারাজ শ্লেষ করিয়া বলিলেন— ‘এত ভয় কিসের?’
তখন সত্য কথা বাহির হইয়া পড়িল, বটুক কম্পিতস্বরে কহিল— ‘যদি আবার তীর ছোঁড়ে?’
মহারাজ হাসিয়া উঠিলেন— ‘ভয় নাই। রসিকতার চেষ্টা করিও না, তাহা হইলে আর কোনও বিপদ ঘটিবে না।’
ক্ষুব্ধস্বরে বটুক বলিল— ‘যাইতেই হইবে?’
তাহার কাতরভাব দেখিয়া মহারাজ স্মিতমুখে ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন— ‘হাঁ।’
সশব্দ দীর্ঘনিশ্বাস মোচনপূর্বক বটুক অনিচ্ছা-মন্থরপদে অন্তঃপুরের দিকে চলিল, মহারাজকে শুনাইতে শুনাইতে গেল— ‘এই জন্যই প্রজারা মাৎস্যন্যায় করে। সামান্য একটা পক্ষীর জন্য—’
কয়েক পদ গিয়া বটুক আবার ফিরিয়া আসিল, বলিল— ‘মহারাজ, আমি বলি, আপনিও আমার সঙ্গে চলুন না, দু’জন থাকিলে বিপদে আপদে পরস্পরকে রক্ষা করিতে পারিব।’
মহারাজ হাসিতে লাগিলেন, বলিলেন— ‘মূর্খ, আমিই যদি যাইব, তবে তোমাকে পাঠাইতেছি কেন?’
বটুকভট্ট তখন জোড়করে করুণবাচনে বলিল— ‘মহারাজ, রক্ষা করুন, আমাকে একাকী পাঠাইবেন না। ঐ বিদেশিনী যুবতীটাকে আমি বড় ভয় করি।’
মহারাজের স্মিতমুখে ক্ষণকালের জন্য ঈষৎ ভাবান্তর দৃষ্ট হইল; তিনি যেন বিমনা হইয়া কি ভাবিলেন। তারপর বাহিরে দৃঢ়তা অবলম্বন করিয়া বলিলেন— ‘না, তুমি একাকী যাও, আমি যাইব না।’
এবার বটুকভট্ট প্রতিশোধ লইল, রাজার বাক্য ফিরাইয়া দিয়া বলিল— ‘কেন, আপনার এত ভয় কিসের?’
রুষ্ট বিস্ময়ে মহারাজ বলিলেন— ‘ভয়? আমি কি তোমার মতো শিখা-সর্বস্ব ব্রাহ্মণ।’ বটুক উত্তর দিল না, শুধু মিটিমিটি চাহিতে লাগিল। তখন মহারাজ অধীরভাবে বলিলেন— ‘ভাল, একাকী যাইতে ভয় পাও, চল, আমি রক্ষক হিসাবে যাইতেছি। নারীভয়ে ভীত ব্রাহ্মণকে রক্ষা করাও সম্ভবত রাজধর্ম।’
রাজা অগ্রবর্তী হইয়া অন্তঃপুর অভিমুখে চলিলেন। যাইতে যাইতে বটুকভট্টের কণ্ঠ হইতে একবার একটা অবরুদ্ধ হাসির শব্দ বাহির হইল। রাজা সন্দিগ্ধভাবে তাহার দিকে ফিরিলেন; কিন্তু বটুকভট্টের মুখে দুর্জয় গাম্ভীর্য ভিন্ন আর কিছুই দেখিতে পাইলেন না।
সঙ্কীর্ণ পরিখার ভিতর হইতে অনুচ্চ প্রাকার-বেষ্টনী— তন্মধ্যে রাজ-অবরোধের চক্রাকৃতি বিস্তীর্ণ ভূমি। ভূমির কেন্দ্রস্থলে সৌধ— চতুর্দিকে নানা বৃক্ষ-লতা-শোভিত উপবন।
উদ্যানে প্রবেশপূর্বক কয়েক পদ গমন করিবার পর মহারাজ সেনজিতের গতি ক্রমশ শ্লথ হইয় শেষে থামিয়া গেল। যে আমলকীবৃক্ষটা তাঁহার লক্ষ্য ছিল, তাহার অনতিদূরে এক পুষ্পিত রক্ত-কুরুবকের ছায়ায় তাঁহার দৃষ্টি আকৃষ্ট হইল। তিনি দেখিলেন, সদ্যস্নাতা উল্কা একাকিনী বৃক্ষতলে দাঁড়াইয়া কর্ণে কুরুবক— কোরকের অবতংস পরিতেছে! তাহার কটিতটে চম্পকবর্ণ সূক্ষ্ম কার্পাসবন্ত্র, বক্ষে কাশ্মীর-রঞ্জিত নিচোল— উত্তরীয় নাই। দর্পণের ন্যায় ললাটে কুঙ্কুম-তিলক, চরণপ্রান্তে লাক্ষারাগ, সিক্ত অবেণীবদ্ধ কুন্তলভার পৃষ্ঠে বিলম্বিত হইয়া যেন এই সম্মোহিনী প্রতিমার পটভূমিকা রচনা করিয়াছে।
মহারাজের উত্তরীয় আকর্ষণ করিয়া উত্তেজিত নিম্নস্বরে বটুকভট্ট বলিল— ‘মহারাজ, দেখুন, দেখুন, সাক্ষাৎ কন্দর্পের জয়শ্রী বৃক্ষতলে আবির্ভূতা হইয়াছে। হে কন্দর্পারি, এই দুরন্ত বসন্তকালে তুমি আমাদের রক্ষা কর।’
পরিপূর্ণ নারীবেশে মহারাজ ইতিপূর্বে উল্কাকে দেখেন নাই— আজ প্রথম দেখিলেন। উল্কা যখনই প্রকাশ্যে বাহির হইয়াছে, নারীসুলভ প্রসাধন বর্জন করিয়া দৃপ্ত যোদ্ধৃবেশে দেখা দিয়াছে। তাই আজ তাহার সুকুমার নারীমূর্তি যেন দর্শকের চিত্তে বিপ্লবের সৃষ্টি করিয়া দিল।
উল্কাও দূর হইতে মহারাজকে দেখিতে পাইয়াছিল; সে রিমঝিম মঞ্জীর বাজাইয়া, অঙ্গসঞ্চালনে লাবণ্যের তরঙ্গ তুলিয়া সেই দিকে অগ্রসর হইল। জঘনভারমন্থর মদালস গতি, যেন প্রতি পদক্ষেপে ভাঙ্গিয়া ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে। উত্তরীয়ের অভাবে ব্যক্ত দেহভাগ সুমধুর নির্লজ্জতায় নিজ গৌরব-গর্ব ঘোষণা করিতেছে। মন্ত্ররুদ্ধবীর্য সর্পের ন্যায় মহারাজ স্থির হইয়া রহিলেন।
উল্কা মহারাজের সম্মুখে উপস্থিত হইল। মুখে একটু ভঙ্গুর হাসি, আয়ত চক্ষুপল্লবে শ্যামস্নিগ্ধ ছায়া। উল্কা মহারাজের পদপ্রান্তে জানু নত করিয়া বসিল, কূজন-মধুর স্বরে বলিল— ‘প্রভাতে উঠিয়া রাজদর্শন করিলাম, আজ আমার সুপ্রভাত। দেবপ্রিয়, দাসীর অর্ঘ্য গ্রহণ করুন।’ বলিয়া কপোতহস্তে কয়েকটি কুরুবক-কলি তুলিয়া ধরিল।
মহারাজ মূক হইয়া রহিলেন।
বটুকভট্ট উল্কার আগমনে মহারাজের পশ্চাতে গিয়া দাঁড়াইয়াছিল, সেখান হইতে হস্ত উত্তোলন করিয়া বহু অলঙ্কারযুক্ত ভাষায় সাড়ম্বরে আশীর্বচন করিতে লাগিল। তাহার তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরে মহারাজের চমক ভাঙ্গিল।
আত্মবিস্মৃতির তন্দ্র হইতে জাগিয়া উঠিয়াই মহারাজ মুখভাব কঠিন করিলেন, ললাটে ভ্রূকুঞ্চন দেখা দিল। তিনি ধীর-হস্তে উল্কার অঞ্জলি হইতে একটি পুষ্প তুলিয়া লইয়া সংক্ষিপ্ত স্বরে বলিলেন— ‘স্বস্তি!’
উল্কা চপলনেত্রে আনন্দ বিকীর্ণ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, কর্ণভূষণ দুলাইয়া পরিহাস-তরল-কণ্ঠে বলিল— ‘মহারাজ, এতদিনে বিদেশিনীকে স্মরণ হইল? রাজকার্য কি এতই গুরু?’
উল্কাকে এত হাস্যরহস্যময়ী মহারাজ পূর্বে দেখেন নাই; কিন্তু তিনি আকাশের দিকে চোখ তুলিয়া বলিলেন— ‘আমার একটা শুকপক্ষী উড়িয়া ঐ আমলকীবৃক্ষে বসিয়াছে, তাহাকে ধরিতে আসিয়াছি।’
কলকণ্ঠে হাসিয়া উল্কা বলিল— ‘সত্য? কই, আসুন তো দেখি।’
ক্রীড়াচঞ্চলা বালিকা যেন নূতন খেলার উপাদান পাইয়াছে, এমনই ভাবে চটুলপদে উল্কা আগে আগে চলিল, মহারাজ তাহার অনুবর্তী হইলেন। যাইতে যাইতে গ্রীবা বাঁকাইয়া উল্কা জিজ্ঞাসা করিল— ‘মহারাজ, আপনার শুকের নাম কি?’
মহারাজ গম্ভীরমুখে বলিলেন— ‘বিম্বোষ্ঠ।’
‘বিম্বোষ্ঠ! কি সুন্দর নাম!— কঞ্চুকী মহাশয় আমাকেও একটা শুকপক্ষী দিয়াছেন— সে ইহারই মধ্যে কথা বলিতে আরম্ভ করিয়াছে। কিন্তু এখনও তাহার নামকরণ হয় নাই। কি নাম রাখি বলুন তো?’
মহারাজ ললাটের উপর দিয়া একবার হস্তচালনা করিলেন, উল্কার পক্ষীর নামকরণ সহসা করিতে পারিলেন না।
ক্রমে উভয়ে আমলকীবৃক্ষতলে উপনীত হইলেন। রাজা পশ্চাৎ ফিরিয়া দেখিলেন, সাবধানী বটুক তাঁহার সঙ্গে আসে নাই, বৃক্ষতলে উপবেশন করিয়া আছে। তিনি মনে মনে ভীরু ব্রাহ্মণকে কটূক্তি করিলেন।
আমলকীবৃক্ষ বসন্ত ঋতুর সমাগমে নবপত্রে শোভিত হইয়াছে, তাহার ভিতরে হরিদ্বর্ণ পক্ষী সহজে দৃষ্টিগোচর হয় না। উল্কা ও মহারাজ ঊর্ধ্বমুখ হইয়া অন্বেষণ করিতে লাগিলেন।
সহসা উল্কা সেনজিতের হাত ধরিয়া টানিয়া বলিয়া উঠিল— ‘ঐ দেখুন মহারাজ, ঐ দেখুন, আপনার ধূর্ত বিম্বোষ্ঠ পত্রান্তরালে বসিয়া ফল ভক্ষণ করিতেছে।’
মহারাজ ধীরে ধীরে হাত ছাড়াইয়া লইলেন, তারপর রুক্ষস্বরে কহিলেন— ‘বিম্বোষ্ঠ, নামিয়া আয়!’
মহারাজের কণ্ঠস্বর শুনিবামাত্র বিম্বোষ্ঠ নখঘৃত ফল ফেলিয়া দিয়া সতর্কভাবে ঘাড় বাঁকাইয়া নীচের দিকে তাকাইল, কিন্তু নামিয়া আসিবার জন্য কোনও ব্যস্ততা প্রদর্শন করিল না।
মহারাজ আবার তর্জন করিলেন— ‘বিম্বোষ্ঠ, শীঘ্র নামিয়া আয়।’
কোনও ফল হইল না; বিম্বোষ্ঠ পাশের দিকে সরিয়া গিয়া এক শাখার আড়ালে লুকাইবার চেষ্টা করিল।
উল্কা বিভক্ত ওষ্ঠাধরে দেখিতেছিল, এবার সে পলাতক মুক্তিবিলাসী পক্ষীকে আহ্বান করিল; ভ্রূবিলাস করিয়া কপট ক্রোধমিশ্রিত কৌতুকের স্বরে বলিল— ‘ধৃষ্ট পাখি, মহারাজের আজ্ঞা লঙ্ঘন করিতে তোর সাহস হয়? এখনও নামিয়া আয়, নচেৎ তোর দুই পায়ে শিকল দিয়া পিঞ্জরে বাঁধিয়া রাখিব।’
এত বড় শাসনবাক্যেও বিদ্রোহী পাখি অটল রহিল। তখন উভয়ে বহুপ্রকারে তাহাকে প্রলুব্ধ করিবার চেষ্টা করিলেন, উল্কা আরক্ত বিম্বাধর স্ফুরিত করিয়া, করকঙ্কণ ক্বণিত করিয়া তাহাকে তর্জন অনুনয় করিল; কিন্তু বিম্বোষ্ঠ গ্রাহ্য করিল না।
তখন সেনজিৎ হতাশ হইয়া বলিলেন— ‘এখন উপায়?’
উল্কা গণ্ডে তর্জনী রাখিয়া চিন্তা করিল। তারপর সহসা মুখ তুলিয়া বলিল— ‘উপায় আছে, মহারাজ! ক্ষণেক অপেক্ষা করুন, আমি আসিতেছি।’ বলিয়া রহস্যময় হাসিয়া দ্রুতশিঞ্জিত-চরণে ভবন অভিমুখে প্রস্থান করিল। সেনজিৎ তাঁহার চঞ্চল নিতম্বলুণ্ঠিত কেশজালের প্রতি একবার দৃষ্টিপাত করিয়াই চক্ষু ফিরাইয়া লইলেন।
কিয়ৎকাল পরে উল্কা ফিরিয়া আসিল। মহারাজ দেখিলেন, তাহার মণিবন্ধে একটি দীর্ঘপুচ্ছ শুক পক্ষী।
মহারাজ আশ্চর্যান্বিত হইয়া বলিলেন— ‘পাখি দিয়া পাখি ধরিবে?’
উল্কা পূর্ণ-দৃষ্টিতে মহারাজের দিকে তাকাইল, বলিল— ‘হাঁ। কেন, তাহা কি অসম্ভব?’
মহারাজের গণ্ড ঈষৎ উত্তপ্ত হইল, তিনি পুনর্বার কণ্ঠস্বর নীরস করিয়া বলিলেন— ‘বলিতে পারি না। চেষ্টা করিয়া দেখিতে পার।’
উল্কা তখন মৃদুহাস্যে বাহু ঊর্ধ্বে তুলিয়া কুহক-মধুর স্বরে ডাকিল— ‘আয়, আয় বিম্বোষ্ঠ! এই দ্যাখ, তোর সাথী তোর জন্য প্রতীক্ষা করিতেছে। আয়!’
বিম্বোষ্ঠ কৌতূহলীভাবে নীচের দিকে তাকাইল, ঘাড় বাঁকাইয়া বাঁকাইয়া নিরীক্ষণ করিল। তারপর উড়িয়া আসিয়া উল্কার অংসের উপর বসিল।
বিজয়োজ্জ্বল দৃষ্টিতে উল্কা বলিল— ‘দেখিলেন, মহারাজ?’
‘দেখিলাম।’
দুই পক্ষী কিছুক্ষণ নীরবে পরস্পরের পরিচয় গ্রহণ করিল। তারপর বিম্বোষ্ঠ অবজ্ঞাসূচক একটা শব্দ করিয়া উল্কার কর্ণবিলম্বী রক্তবর্ণ কুরুবক-মুকুলে চঞ্চু বসাইয়া টান দিল।
উল্কা বিপন্নভাবের বিভ্রম করিয়া বলিয়া উঠিল— ‘মহারাজ, রক্ষা করুন, আপনার দস্যু পক্ষী আমার কর্ণভূষা হরণ করিতে চায়।’
সেনজিৎ পক্ষীকে ধরিতে গেলেন। পাখি ঝটপট করিয়া পলায়নের চেষ্টা করিল, কিন্তু মহারাজ তাহার চরণবিলম্বিত স্বর্ণশৃঙ্খলের অংশ ধরিয়া ফেলিয়াছিলেন। পাখি পলাইতে পারিল না— মহারাজের উন্মুক্ত বক্ষের উপর গিয়া পড়িল। ভীত পক্ষীর তীক্ষ্ণ নখ তাঁহার বক্ষে অবলম্বন অন্বেষণ করিতে গিয়া কয়েকটা আঁচড় কাটিয়া দিল।
দেখিতে দেখিতে নখচিহ্ন রক্তিম হইয়া উঠিল; তারপর দুই বিন্দু রক্ত ধীরে ধীরে সঞ্চিত হইয়া গড়াইয়া পড়িল।
উল্কা সত্রাসে বলিয়া উঠিল— ‘সর্বনাশ! মহারাজ, এ কি হইল!— ওরে কে আছিস্, শীঘ্র আয়! বান্ধুলি। বিপাশা!— শীঘ্র অনুলেপন লইয়া আয়! মহারাজ আহত হইয়াছেন।’
মহারাজের মুখ লজ্জায় রক্তবর্ণ হইল, তিনি প্রায় রূঢ়স্বরে বলিয়া উঠিলেন— ‘এ কিছু নয়, সামান্য নখ ক্ষত মাত্র।’
‘সামান্য নখক্ষত! মহারাজ কি জানেন না, পশু-পক্ষীর নখে বিষ থাকে?’ ব্যাকুলভাবে গৃহের দিকে তাকাইয়া বলিল— ‘কই, কেহ আসে না কেন? বিলম্বে বিষ যে দেহে প্রবেশ করিবে। বান্ধুলি! সুজাতা!’
মহারাজ আবার আরক্তমুখে আপত্তি করিলেন। তখন উল্কা হঠাৎ যেন পথ খুঁজিয়া পাইয়া বলিয়া উঠিল— ‘মহারাজ, আপনি স্থির হইয়া দাঁড়ান, আমি বিষ নিষ্কাশন করিয়া লইতেছি!’
উল্কার উদ্দেশ্য মহারাজ সম্পূর্ণ হৃদয়ঙ্গম করিবার পূর্বেই সে মহারাজের একেবারে নিকটে গিয়া দাঁড়াইল, তারপর দুই হাত তাঁহার স্কন্ধের উপর রাখিয়া ক্ষরণশীল ক্ষতের উপর তাহার কোমল অধরপল্লব স্থাপন করিল। মহারাজ ক্ষণকাল স্তম্ভিত অভিভূত হইয়া রহিলেন, তারপর সবলে নিজেকে উল্কার আশ্লেষমুক্ত করিয়া লইয়া পিছু সরিয়া দাঁড়াইলেন।
উল্কার অধরে মহারাজের বক্ষ-শোণিত। সে অর্ধস্ফুট বিস্ময়ে বলিল— ‘কি হইল!’
তিক্ত ঘৃণাজর্জরিতস্বরে সেনজিৎ বলিলেন— ‘নারীর পুরুষভাব আমি ক্ষমা করিতে পারি, কিন্তু নির্লজ্জতা অসহ্য!’ বলিয়া উল্কার দিকে আর দৃক্পাত না করিয়া দ্রুতপদে প্রস্থান করিলেন।
যতক্ষণ মহারাজকে দেখা গেল, উল্কা স্থিরনেত্রে তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিল। তাহার চোখে ধিকি-ধিকি আগুন জ্বলিতে লাগিল। তারপর সে সজোরে দন্ত দিয়া অধর দংশন করিল। মহারাজের বক্ষোরুধিরে উল্কার রুধির মিশিল।
প্রত্যাখ্যাতা খণ্ডিতা নারীর চিত্ত-গহনে কে প্রবেশ করিবে? শিকার-বঞ্চিতা ব্যাঘ্রীর ক্ষুধিত জিঘাংসাই বা কে পরিমাপ করিতে পারে? উল্কার নয়নে যে বহ্নি জ্বলিতে লাগিল তাহার অন্তর্গূঢ় রহস্য নির্ণয় করা মানুষের সাধ্য নয়। বোধ করি দেবতারও অসাধ্য।