মদন-মহোৎসবের পূর্বেই এবার গ্রীষ্মের আবির্ভাব হইয়াছে। বিজিগীষু নিদাঘের জয়পতাকা বহিয়া যেন অশোক, কিংশুক, কৃষ্ণচূড়া দিগ্‌দিগন্তে ছড়াইয়া পড়িয়াছে। তবু, কুসুম্ভ ও রঙ্গনের শোণিমা প্রত্যাসন্ন বসন্তোৎসবের বর্ণ-বিলাস বক্ষে ধারণ করিয়া উৎসুক নাগরিকাদিগকে যেন জানাইতেছে— ‘ভয় নাই! মাধবের অরুণ নেত্র দেখিয়া শঙ্কা করিও না, এখনও মধুমাস শেষ হয় নাই।’ তাহাদের সমর্থন করিয়াই যেন চূতমুকুল-লোভী মদারুণিত-চক্ষু কোকিল বারম্বার কুহরিয়া উঠিতেছে — ‘কুহকের কাল সমাগত, কুহকিনীরা প্রস্তুত হও।’

মগধের রাজপ্রাসাদেও এই নব-বসন্তজাত মদালসতা অলক্ষ্যে সঞ্চারিত হইয়াছিল। প্রধান তোরণের প্রতীহার-ভূমিতে লৌহ-শিরস্ত্রাণ পরিহিত শূলহস্ত দ্বারী উন্মনভাবে এক প্রফুল্ল কর্ণিকার-বৃক্ষের পানে তাকাইয়া ছিল; বোধ করি, নির্জন কর্মহীন দ্বিপ্রহরে ঐ বৃক্ষের দিকে চাহিয়া কোনও তপ্তকাঞ্চনবর্ণা যবনী প্রতীহারীর নীলাব্জ-নয়নের কথা ভাবিতেছিল। তোরণের অভ্যন্তরে ভবনে ভবনে নারী-সৈন্যের পাহারা। মহারাজের অবরোধে মহাদেবী নাই বটে, কিন্তু চিরাচরিত প্রথা অনুসারে ধনুষ্পানি যবনী সেনা পূর্ববৎ আছে। প্রাসাদের বিভিন্ন মহলে— মন্ত্রগৃহে, মল্লাগারে, কলাভবনে, কোষাগারে— সর্বত্র দ্বারে দ্বারে যবনী প্রহরিণী দ্বার রক্ষা করিতেছে। তাহাদের বক্ষে অতিপিনদ্ধ বর্ম, হস্তে ধনু, পৃষ্ঠে তূণীর। শ্রেণিভারমন্থর-গতিতে তাহারা দ্বারসম্মুখে পদচারণ করিতেছে, কখনও অলস উৎসুক নেত্রে অলিন্দের বাহিরে সুদূর-দৃষ্টি প্রেরণ করিতেছে। হয়তো তাহাদের মনেও দূরদূরান্তস্থিত জন্মভূমির দ্রাক্ষারস-মদির স্বপ্ন জাগিতেছে।

এই তন্দ্রালস ফাল্গুনের দ্বিপ্রহরে মন্ত্রগৃহের এক শীতলকক্ষে মহারাজ সেনজিৎ কয়েকজন বয়স্যের সহিত বিরাজ করিতেছিলেন। বিদূষক বটুকভট্টও ছিল, নিরুৎসুকভাবে রাজা ও বিদূষকে অক্ষক্রীড়া চলিতেছিল। প্রতি দ্বারে ও বাতায়নে জলসিক্ত উশীরগুচ্ছ ঝুলিতেছে, বাহিরের আতপ্ত বায়ু তাহার স্পর্শে স্নিগ্ধ-সুগন্ধি হইয়া মহারাজের চন্দনপঙ্কচর্চিত দেহ অবলেহন করিতেছিল। একজন বয়স্য অদূরে বসিয়া সপ্তস্বরার তন্ত্রী হইতে অতি মৃদুভাবে বসন্তরাগের ব্যঞ্জনা পরিস্ফুট করিবার চেষ্টা করিতেছিল।

কিয়ৎকাল ক্রীড়া চলিবার পর মহারাজের চঞ্চল চিত্ত আর অক্ষবাটে নিবদ্ধ থাকিতে চাহিল না; তিনি এদিক-ওদিক চাহিতে লাগিলেন। বাদ্যরত বয়স্য বসন্তের সহিত পঞ্চম মিশাইয়া ফেলিতেছিল, রাজা তাহার ভ্রম-সংশোধন করিয়া দিলেন। শেষে অক্ষ ফেলিয়া, পার্শ্বস্থিত কপিত্থ-সুরভিত তক্রের পাত্র নিঃশেষপূর্বক উঠিয়া দাঁড়াইলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন— ‘বসন্তোৎসবের আর বিলম্ব কত?’

বটুকভট্টের আকৃতি ও কণ্ঠস্বর পূর্ববৎ আছে, শুধু মস্তকশীর্ষে গ্রন্থিধৃত কেশগুচ্ছ একটু পাকিতে আরম্ভ করিয়াছে। সে অক্ষক্রীড়ায় জিতিতেছিল; মহারাজের পেশল দেহকান্তির দিকে এক ক্রুদ্ধ কটাক্ষপাত করিয়া বলিল— ‘মদনের সহিত যাহার মৌখিক পরিচয় পর্যন্ত নাই, সে বসন্তোৎসবের সংবাদ জানিয়া কি করিবে? বিল্বফল পাকিল কি না জানিয়া পরভৃতের কি লাভ?’

মহারাজ হাসিলেন। হাসিলে মহারাজকে বড় সুন্দর দেখাইত। তাঁহার তরুণ মুখের সদা-স্ফূর্ত হাসিতে যেন অন্তরের নিরভিমান অনাড়ম্বর সরলতা প্রতিবিম্বিত হইত।

তিনি সকৌতুকে বলিলেন— ‘বটুক, আমাকে কাক বলিলে না কোকিল বলিলে?’

বটুকভট্ট বলিল— ‘মহারাজের যেটা অভিরুচি স্বীকার করিয়া লইতে পারেন।’

মহারাজ বললেন— ‘তবে কোকিলই স্বীকার করিলাম। কোকিল অতি গুণবান পক্ষী; দোষের মধ্যে সে কাকের নীড়ে ডিম্ব প্রসব করে।’

বটুক বলিল— ‘এ বিষয়ে মহারাজ অপেক্ষা কোকিল শ্রেষ্ঠ।’

স্মিতমুখে সেনজিৎ প্রশ্ন করিলেন— ‘কিসে?’

‘কোকিল তো তবু পরগৃহে বংশরক্ষা করে, মহারাজ যে এ বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন।’

মহারাজের মুখ ঈষৎ বিষণ্ণভাব ধারণ করিল, তিনি ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া বলিলেন— ‘দেখ বটুক, তোমাকে একটি গোপনীয় কথা বলি। নারীজাতিকে আমি বড় ভয় করি— এই জন্যই বসন্তোৎসবের সময় আমার প্রাণে আতঙ্ক উপস্থিত হয়। নারীজাতি এই সময় অত্যন্ত দুর্দমনীয় হইয় উঠে।’

বটুকভট্টও বিষণ্ণভাবে শিরা নাড়িয়া বলিল— ‘সে কথা সত্য। এই সময় স্ত্রীজাতি তাহাদের সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র শাণিত করিয়া পুরুষের প্রতি ধাবিত হয়। আমার গৃহিণীর সাতটি সন্তান, বয়সেরও ইয়ত্তা নাই; কিন্তু কয়েক দিন হইতে লক্ষ্য করিতেছি, তিনি আমার প্রতি তীক্ষ্ণ কটাক্ষ নিক্ষেপ করিতেছেন।’

হাস্য গোপন করিয়া মহারাজ বলিলেন— ‘বড় ভয়ানক কথা বটুক, তবে আর তোমার গৃহে গিয়া কাজ নাই। আমার অন্তঃপুর শূন্য আছে, তুমি এইখানেই এ কয় দিন নিরাপদে যাপন কর। এ বয়সে গৃহিণীর কটাক্ষবাণ খাইলে আর প্রাণে বাঁচিবে না।’

বটুকভট্টের মুখ অধিকতর বিষণ্ণ হইল, সে বলিল— ‘তাহা হয় না, মহারাজ। এই বসন্তকালে দেশসুদ্ধ কোকিল পরগৃহে ডিম্ব উৎপাদন করিবার জন্য ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। এখন গৃহত্যাগ করিলে আবার অন্য বিপদ আসিয়া পড়িবে।’

বয়স্যেরা সকৌতুকে উভয়ের রসোক্তি-বিনিময় শুনিতেছিল, বটুকের কথার ভঙ্গিতে সকলে হাসিয়া উঠিল। একজন বয়স্য বলিল— ‘মহারাজ, বটুকভট্ট অকারণে আপনাকে নারীজাতি সম্বন্ধে বিতৃষ্ণ করিয়া তুলিতেছে। আমি অপরোক্ষ অভিজ্ঞতা হইতে বলিতে পারি, নারীজাতি— বিশেষত সুন্দরী ও যৌবনবতী নারী— অবহেলার বস্তু নয়, পুরুষমাত্রেরই সাধনযোগ্য। কণ্টকীফলের মতো বাহিরে দুষ্প্রধর্ষা হইলেও অন্তরে তাহারা অতি কোমল ও সুস্বাদু।’

মহারাজ বলিলেন— ‘নারীজাতি তাহা হইলে কণ্টকীফলের সহিত তুলনীয়া! ইহাই তোমার মত?’

‘হাঁ মহারাজ! একমাত্র ভোক্তাই এই ফলের রসজ্ঞ, দূর হইতে যে ব্যক্তি কেবল নিরীক্ষণ করিয়াছে, তাহার কাছে ইহার রস অব্যক্ত।’

‘বটুক, তোমার কি অভিমত?’

বটুক গভীরভাবে বলিল— ‘আমার অভিমত, নারীজাতি একমাত্র বিল্বফলের সহিত তুলনীয়। যে ক্ষৌরিত-চিকুর হতভাগ্য একবার বিল্বতলে গিয়াছে, সে আর দ্বিতীয়বার যাইবে না।’

এইরূপ রঙ্গপরিহাসে কিছুকাল অতীত হইবার পর একজন বয়স্য রাজাকে জিজ্ঞাসা করিল— ‘মহারাজ, সত্য বলুন স্ত্রীজাতির প্রতি আপনার বিরাগ কি জন্য? বিশেষ কোনও কারণ আছে কি?’

মহারাজ ঈষৎ গম্ভীর হইয়া বলিলেন— ‘রুচির অভাবই প্রধান কারণ। যদি এ কারণ যথেষ্ট মনে না কর, তবে বলিতে পারি, এই নারীজাতিই পুরুষের সুখ-স্বচ্ছন্দ্যের হন্তারক। ভাবিয়া দেখা শ্রী রামচন্দ্রের কথা, স্মরণ কর কুরু-পাণ্ডবের কাহিনী। যে ব্যক্তি সুখের অভিলাষী, সে এই সকল দৃষ্টান্ত দেখিয়া নারিজাতিকে দূরে রাখিবে।’

বয়স্য বলিল— ‘কিন্তু মহারাজ-বংশধর?’

সেনজিৎ সহসা শিহরিয়া উঠিলেন, তাঁহার মুখ হইতে পরিহাসের সমস্ত চিহ্ন লুপ্ত হইল। ক্ষণকাল স্তব্ধ থাকিয়া তিনি বলিলেন— ‘বংশধর! ভানুমিত্র, শিশুনাগবংশে বংশধরের কথা চিন্তা করিতে তোমার ভয় হয় না? শুনিয়াছি, শিশুনাগবংশে আর কেহ জীবিত নাই, আমার ঐকান্তিক কামনা, আমার সঙ্গে যেন এই অভিশপ্ত বংশ লুপ্ত হয়।’

বয়স্য সকলে অধোমুখে নীরব রহিল; একটা প্রতিবাদ বাক্যও কাহারও মুখে যোগাইল না।

কিয়ৎকাল নীরবে কাটিল। তারপর সহসা এই কুণ্ঠিত নীরবতা ভেদ করিয়া মন্ত্রগৃহের প্রতীহার-ভূমিতে দ্রুতছন্দে পটহ বাজিয়া উঠিল।

বিস্মিতভাবে ভ্রূ তুলিয়া রাজা বলিলেন— ‘এ সময় পটহ কেন? বটুক, কে আসিল দেখ। বলিও, এখন আমি বিশ্রাম করিতেছি, কল্য প্রভাতে সভায় সাক্ষাৎ হইবে।’

মহারাজ সাধারণত কোনও দর্শনপ্রার্থীকে ফিরাইতেন না, কিন্তু আজ উল্লিখিত আলোচনার পর তাঁহার মনের প্রসন্নতা নষ্ট হইয়া গিয়াছিল।

বটুকভট্ট প্রস্থান করিল। সেনজিৎ ঈষৎ কুঞ্চিত ললাটে বাতায়নের সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইলেন।

অল্পক্ষণ পরেই বটুকভট্ট সবেগে প্রায় মুক্তকচ্ছ অবস্থায় কক্ষে পুনঃপ্রবেশ করিয়া একেবারে মহারাজের পদমূলে বসিয়া পড়িয়া হাঁপাইতে লাগিল। মহারাজ বলিলেন— ‘বটুক, কি হইল?’

বটুক উন্মুক্ত বক্তৃপথে ঘন ঘন নিশ্বাস ত্যাগ করিতে করিতে বলিল— ‘মহারাজ, জঙ্ঘাবল প্রদর্শন করিয়াছি।’

‘তাহা তো দেখিতেছি। কিন্তু পলাইয়া আসিলে কেন? কে আসিয়াছে?’

‘ঠিক বলিতে পারি না। বোধ হয় দিব্যাঙ্গনা।’

‘সে কি! স্ত্রীলোক?’

‘কদাচ নয়। উর্বশী হইলেও হইতে পারে, নচেৎ নিশ্চয় তিলোত্তমা। কিন্তু বক্ষে কঞ্চুলী নাই, তৎপরিবর্তে লৌহজালিক— মহারাজ, পলায়ন করুন।’

মহারাজ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া বয়স্যদের দিকে চাহিলেন; তাঁহার তিন বৎসরব্যাপী রাজ্যকালে এরূপ কাণ্ড কখনও ঘটে নাই। তিনি বলিলেন— ‘নারী— আমার নিকট কি চায়?’

এই সময় যবনী প্রতিহারী প্রবেশ করিয়া জানাইল যে, বৈশালী হইতে এক নারী রাজকার্য উপলক্ষে মহারাজের সাক্ষাৎপ্রার্থিনী। মহারাজ ক্ষণেক স্তম্ভিত থাকিয়া ক্ষীণকণ্ঠে বলিলেন— ‘লইয়া এস।’

প্রতীহারী নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেল। পরক্ষণেই চারিদিকে রূপলাবণ্যের স্ফুলিঙ্গ বিকীর্ণ করিয়া উল্কা কক্ষে প্রবেশ করিল।

মহারাজ সেনজিৎ দ্বারের দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া ছিলেন, উল্কা প্রবেশ করিতেই উভয়ের চোখাচোখি হইল। পাঁচ  গণিতে যতক্ষণ সময় লাগে, উল্কা ও সেনজিৎ ততক্ষণ পরস্পর চোখের ভিতর চাহিয়া রহিলেন। উল্কার চোখে গোপন উৎকণ্ঠা, মহারাজের নয়নে প্রচ্ছন্ন বিস্ময়! তারপর দু’জনেই চক্ষু ফিরাইয়া লইলেন।

মহারাজ সেনজিৎ ভূমির দিকে চাহিয়া ধীরে ধীরে বলিলেন— ‘ভদ্রে, শুনিলাম তুমি বৈশালী হইতে আসিতেছ; তোমার কি প্রয়োজন?’

উল্কার ওষ্ঠাধর বিভক্ত হইয়া দশনপংক্তি ঈষৎ দেখা গেল। সে গ্রীবা বাঁকাইয়া মহারাজের দিকে একটু অধীরভাবে তাকাইল, বলিল— ‘আমি পরমভট্টারক শ্রীমন্মহারাজ সেনজিতের দর্শনপ্রার্থিনী— তাঁহার নিকটেই আমার প্রয়োজন নিবেদন করিব।’

‘আমিই সেনজিৎ।’

‘মহারাজ! ক্ষমা করুন’ — উল্কার বিস্ময়োৎফুল্ল নেত্র ক্ষণেকের জন্য অর্ধ-নিমীলিত হইয়া আসিল। তারপর সে দুই পদ অগ্রসর হইয়া মহারাজের পদপ্রান্তে নতজানু হইয়া বসিল; যুক্ত করপুট ললাটে স্পর্শ করিয়া সসম্ভ্রমে প্রণাম করিল।

মহারাজ অস্ফুটভাবে কালোচিত সম্ভাষণ করিলেন। তখন উল্কা নিজ অঙ্গাত্রাণের ভিতর হইতে জতুমুদ্রালাঞ্ছিত পত্র বাহির করিয়া মহারাজের হস্তে দিল।

জতুমুদ্রা ভাঙ্গিয়া সেনজিৎ পত্র পড়িতে লাগিলেন। উল্কা নতজানু থাকিয়াই আর একবার মহারাজকে নয়নকোণে ভাল করিয়া দেখিয়া লইল। তাহার মুখের ভাব বিন্দুমাত্র পরিবর্তিত হইল না, কিন্তু সে মনে মনে ভাবিল— ‘ইনিই মগধের মহাপরাক্রান্ত প্রজাপূজিত সেনজিৎ! ইঁহার চন্দন-চর্চিত সুকুমার দেহে বলবীর্যের তো কোনও লক্ষণই দেখিতেছি না। এই সুখলালিত পৌরুষহীন বিলাসীকে জয় করিতে কতক্ষণ সময় লাগিবে?’ উল্কা মনে মনে অবজ্ঞার হাসি হাসিল।

পত্রপাঠ শেষ করিয়া সেনজিৎ চক্ষু তুলিলেন, দেখিলেন, উল্কা তখনও নতজানু হইয়া তাঁহার সম্মুখে বসিয়া আছে। তিনি শুষ্কস্বরে বলিলেন— ‘ভদ্রে, আসন পরিগ্রহ কর। দেখিতেছি, তুমি মিত্ররাজ্য লিচ্ছবির প্রতিনিধি— সুতরাং আমরা তোমাকে সাদরে সম্ভাষণ করিতেছি। বৈশালীর প্রজানায়কগণ যে একটি পুরাঙ্গনাকে প্রতিভূরূপে প্রেরণ করিয়াছেন ইহা তাঁহাদের প্রীতির প্রকৃষ্ট নিদর্শন বটে, অপিচ কিছু বিস্ময়করও বটে।’

উল্কা আস্তরণের উপর আসন গ্রহণ করিয়া ঈষৎ হাস্যে মহারাজের দিকে মুখ তুলিল, কিন্তু সে প্রত্যুত্তর দিবার পূর্বেই বটুকভট্ট তাহার অতি ক্ষীণ অথচ কর্ণবিদারী কণ্ঠে বলিয়া উঠিল— ‘ইহাতে বিস্ময়ের কি আছে? বৈশালীতে নিশ্চয় পুরুষের অভাব ঘটিয়াছে, তাই তাহারা এই সুন্দরীকে পুরুষবেশে সাজাইয়া প্রেরণ করিয়াছে। মহারাজ, বৈশালী যখন আপনার মিত্ররাজ্য তখন মিত্রতার নিদর্শনস্বরূপ আপনিও কিছু পুরুষ বৈশালীতে প্রেরণ করুন। এইভাবে মিত্রতার বন্ধন অতিশয় দৃঢ় হইয়া উঠিবে।’

উল্কা চমকিয়া ফিরিয়া চাহিল। এতক্ষণ সে রাজা ভিন্ন অন্য কোনও দিকে দৃক্‌পাত করে নাই, এখন খর্বকায় বংশীকণ্ঠ বটুকভট্টকে দেখিয়া তাহার অধরে বিদ্রূপের হাসি ফুটিল। সে অবজ্ঞাপূর্ণ স্বরে বলিল— ‘মগধে পুরুষ প্রতিনিধির প্রয়োজন নাই বুঝিয়াই বোধ হয় মহামন্য কুলপতিগণ এই পুরকন্যাকে প্রেরণ করিয়াছেন। নচেৎ লিচ্ছবিদেশে প্রকৃত পুরুষের অভাব নাই।’

ছদ্ম গাম্ভীর্যে শিরঃসঞ্চালন করিয়া বটুকভট্ট বলিল— ‘বৈশালিকে, লিচ্ছবিদেশে যদি প্রকৃত পুরুষ থাকিত, তবে তাহারা কখনই তোমাকে মগধে আসিতে দিত না।’

উল্কার গণ্ড আরক্তিম হইয়া উঠিল, সে চকিতে রাজার দিকে ফিরিয়া তীক্ষ্ণস্বরে বলিল— ‘মহারাজ, এই বিট কি আপনার বাক্‌-প্রতিভূ?’

সেনজিৎ উত্ত্যক্তভাবে বিদূষকের দিকে চাহিলেন, কহিলেন— ‘বটুক, চপলতা সংবরণ কর, এ চপলতার সময় নয়।’

বটুক ভীতভাব প্রদর্শন করিয়া জানু-সাহায্যে হাঁটিয়া একজন বয়স্যের পিছনে লুকাইল।

সেনজিৎ তখন বলিলেন— ‘ভদ্রে—’

উল্কার মুখ আবার প্রসন্ন হইল, সে হাস্য-মুকুলিত অধরে বলিল— ‘দেব, আমার নাম উল্কা।’

বটুকভট্ট অন্তরাল হইতে আতঙ্কের অভিনয় করিয়া মৃদু স্বরে বলিল— ‘উঃ!’

সেনজিৎ একবার সেদিকে দৃষ্টিপাত করিয়া গভীর মুখে বলিলেন— ‘ভাল। উল্কা, পুনর্বার তোমাকে স্বাগত-সম্ভাষণ জানাইতেছি। বৈশালী রাষ্ট্রের মিত্রতার চিহ্ন নারী বা পুরুষ যে মূর্তিতেই আগমন করুক, আমাদের সমাদরের সামগ্রী। কল্য হইতে সভায় অন্যান্য মিত্রগণের মধ্যে তোমার আসন নির্দিষ্ট হইবে।’

উল্কা অকপট-নেত্রে চাহিয়া বলিল— ‘সভায় নিত্য নিয়ত উপস্থিত থাকা কি আমার অবশ্য-কর্তব্য? রাজকীয় সভার শিষ্টতা আমি কিছুই জানি না— এই আমার প্রথম দৌত্য।’ বলিয়া একটু লজ্জিতভাবে হাসিল।

সেনজিৎ বলিলেন— ‘সভায় উপস্থিত থাকা না থাকা পাত্রমিত্রের প্রয়োজন ও অভিরুচির উপর নির্ভর করে। তুমি ইচ্ছা করিলে না আসিতে পার।’

উল্কা শুধু বলিল— ‘ভাল মহারাজ!’

উক্তরূপ কথোপকথন হইতে প্রতীয়মান হইবে যে, মহারাজ সেনজিৎ রাজকার্য অমাত্যদের হস্তে অর্পণ করিলেও নিজে একান্ত অপটু ছিলেন না।

অতঃপর তিনি বলিলেন— ‘বহু দূর পথ অতিক্রম করিয়া তুমি ও তোমার পরিজন নিশ্চয় ক্লান্ত; সুতরাং সর্বাগ্রে তোমাদের বিশ্রামের প্রয়োজন। কিন্তু পূর্বাহ্ণে সময় না থাকায় তোমার সমুচিত আবাসগৃহের ব্যবস্থা হইতে পায় নাই। এরূপ ক্ষেত্রে—’

বটুকভট্ট উঁকি মারিয়া বলিল— ‘কেন, মহারাজের অন্তঃপুর তো শূন্য আছে— সেইখানেই অতিথি সৎকারের ব্যবস্থা হউক না।’

মহারাজ রুষ্টমুখে তাকাইলেন।

কিন্তু উল্কার চোখে গোপনে বিজলি খেলিয়া গেল; সে ভ্রূভঙ্গ করিয়া মহারাজের দিকে মুখ তুলিল— ‘মহারাজের অন্তঃপুর শূন্য! তবে কি মহারাজ অকৃতদার!’

অপ্রসন্ন ললাটে সেনজিৎ নীরব রহিলেন; কেবল বটুকভট্ট সশব্দ দীর্ঘনিশ্বাস মোচন করিল।

উল্কা তখন বলিল— ‘মহারাজ, সত্যই আমরা পথশ্রান্ত। যদি আপনার অপ্রীতিকর না হয়, তবে অবরোধেই আশ্রয় লইতে পারি। আমি নারী, সুতরাং অবরোধে মহারাজের আশ্রয়াধীনে থাকাই আমার পক্ষে সুষ্ঠু হইবে।’

ভ্রূবদ্ধ ললাটে মহারাজ কিছুক্ষণ চিন্তা করিলেন, তারপর বিরস স্বরে বলিলেন— ‘ভাল। আপাতত অন্তঃপুরেই বাস কর, আমি সেখানে পদার্পণ করি না।’ তারপর প্রধানা যবনীকে ডাকিয়া তাহাকে যথোচিত উপদেশ দিয়া বলিলেন— ‘ইহাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ত্রুটি না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখিও। পরে আমি অন্য ব্যবস্থা করিতেছি।’

উল্কা উঠিয়া দাঁড়াইল। ‘জয়োস্তু মহারাজ!’ বলিয়া সে যবনী সমভিব্যাহারে রাজসকাশ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইতেছিল, এমন সময় বটুকের মুণ্ড আর একবার উঁচু হইয়া উঠিল। সে কৃতাঞ্জলিপুটে বলিল— ‘বৈশালিকে, রাজকার্য তো সুচারুরূপে সম্পন্ন হইল, এখন একটি প্রশ্ন করিতে পারি? বৈশালীর সকল সীমন্তিনীই কি সদাসর্বদা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হইয়া থাকে? ভ্রূকুটির ভল্ল ও বক্ষের লৌহজালিক কি তাহারা উন্মোচন করে না?’

প্রস্থানোদ্যতা উল্কা ফিরিয়া দাঁড়াইল। অনুচ্চস্বরে বলিল— ‘তোমার মতো কিম্পুরুষ দেখিলে বৈশালীর নারীরা অস্ত্র ত্যাগ করে।’ বলিয়া ক্ষিপ্রহস্তে যবনীর তূণীর হইতে একটি তীর তুলিয়া লইয়া নিক্ষেপ করিল। বটুকভট্ট আর্তনাদ করিয়া উঠিল; তীর তাহার মস্তকশীর্ষস্থ কুণ্ডলীকৃত কেশকলাপের মধ্যে প্রবেশ করিল।

উল্কা চকিতচপল নেত্রে একবার সেনজিতের মুখের দিকে চাহিয়া হাস্যবিম্বিত রক্তাধরে কৌতুক বিচ্ছুরিত করিতে করিতে প্রস্থান করিল।

তীর জটা হইতে বাহির করিবার জন্য বটুক টানাটানি করিতে লাগিল। মহারাজ তাহার ভঙ্গি দেখিয়া হাসিয়া ফেলিলেন; বলিলেন— ‘তোমার প্রগল্‌ভতার উপযুক্ত শাস্তি হইয়াছে— বৈশালিকার লক্ষ্যবেধ অব্যর্থ। তুমি আর উহার সহিত রসিকতা করিতে যাইও না।’

বটুক তীরফলক অতিকষ্টে কেশ হইতে মুক্ত করিয়া করুণ স্বরে বলিল— ‘না মহারাজ, আর করিব না। একাদশ রুদ্রের কোপ ও দ্বাদশ সূর্যের তাপ সহ্য করিতে পারি; কিন্তু আগুন লইয়া খেলা এই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের আর সহ্য হইবে না।’

মহারাজ বলিলেন— ‘এখন যাও, কঞ্চুকীকে ডাকিয়া আনো, তিনি আসিয়া অন্তঃপুরের সুব্যবস্থা করুন।’

বটুকভট্ট অমনই উঠিয়া দ্বারের দিকে অগ্রসর হইল, বলিল— ‘তাহাই করি। তবু যদি দেবী আমার প্রতি প্রসন্না হন।’

‘দেবী’ শব্দের মধ্যে হয়তো একটা ব্যঙ্গার্থ ছিল, মহারাজের কর্ণে সেটা বিঁধিল; কিন্তু তিনি কোনও প্রকার প্রতিবাদ করিবার পূর্বেই ধূর্ত বটুকভট্ট কক্ষ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেল।