» » আনোয়ারা

বর্ণাকার

অমর কথাশিল্পী নজিবর রহমান

মুহম্মদ মতিউর রহমান

মোহাম্মদ নজিবর রহমান সাহিত্যরত্ন আধুনিক বাংলা সাহিত্যে প্রথম সার্থক মুসলিম কথাশিল্পী। তাঁর রচিত ‘আনোয়ারা’ উপন্যাস (প্রথম প্রকাশ : ১৯১৪) একসময় অবিভক্ত বাংলার মুসলিম সমাজে সর্বাধিক জনপ্রিয় গ্রন্থ হিসেবে সমাদৃত হয়। তিনি বাংলা গদ্যের এক শক্তিশালী লেখক। প্রবন্ধ, উপন্যাস ও গল্প রচনায় তিনি কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। সমকালে কবি হিসাবেও তাঁর পরিচিতি ছিল। তাঁর রচিত গদ্যের ভাষা ছিল অলঙ্কারবহুল, প্রাঞ্জল, ছন্দময় ও কাব্যাশ্রয়ী।

নজিবর রহমানের জন্ম সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার চর বেলতৈল গ্রামে। নজিবর রহমান পেশাগতভাবে আজীবন শিক্ষক ছিলেন। যুক্তিবাদিতা, দেশপ্রেম, স্বজাতিপ্রেম, ধর্মচেতনা ও জাতীয় উন্নয়ন ছিল তাঁর সব লেখার মূল বিষয়। তিনি প্রধানত গদ্য-রচয়িতা হলেও ক্ষেত্রবিশেষে তাঁর রচিত কিছু কিছু কবিতার চরণ তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে। প্রবন্ধ রচনার মধ্য দিয়ে তাঁর সাহিত্যচর্চার সূত্রপাত ঘটে। তাঁর রচিত প্রথম প্রবন্ধে তৎকালীন

‘সাহিত্যিক’ পত্রিকায় (১২শ বর্ষ, বসন্ত সংখ্যা, ১৩৮৪, পৃ :-১৭৫) মুদ্রিত হয়। এ পত্রিকায় তাঁর মোট দু’টি প্রবন্ধ ছাপা হয়। প্রবন্ধ দু’টির শিরোনাম ‘পবিত্র নিদর্শন, মুসলমানের সপ্তরত্ন,’ তিব্বতে মুসলমান এবং তিব্বতবাসীর আচার ব্যবহার’ এবং ‘পূর্বস্মৃতি-কুতুবুদ্দিন আয়বেক’। শেষের রচনাটি ১৯০১ সালের জুলাই-আগষ্টে (৪র্থ বর্ষ, ১ম-২য় সংখ্যা) ‘ইসলাম প্রচারক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

পরবর্তীতে তাঁর রচিত দু’টি প্রবন্ধগ্রন্থ-’বিলাতী বর্জ্জন রহস্য’ ও ‘সাহিত্য- প্রসঙ্গ’ (১৯০৫) প্রকাশিত হয়। গ্রন্থ দু’টির ভাষা সাধু বাংলা। প্রথম গ্রন্থটিতে ইংরেজ ও কংগ্রেসবিরোধী মনোভাব ফুটে ওঠে এবং দ্বিতীয় গ্রন্থটিতে মুসলিম সমাজের পশ্চাৎপদতা ও উন্নয়নে সাহিত্যচর্চার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এ দু’টি গ্রন্থই প্রকাশের সাথে সাথে সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হয়। এরপর বেশ কিছুকাল তিনি সাহিত্যচর্চা থেকে বিরত থাকেন। ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তাঁর রচিত ‘আনোয়ারা’ উপন্যাস তাঁর সর্বাধিক সার্থক ও জনপ্রিয় গ্রন্থ। এটি নানা কারণে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে যায়।

তাঁর রচিত উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থ হলো : ‘আনোয়ারা’, রচনাকাল ১৯১১-১৪, প্রথম প্রকাশ ১৯১৪ সালে। ‘চাঁদতারা বা হাসন-গঙ্গা বাহমণি’ ঐতিহাসিক উপন্যাস। ‘প্রেমের সমাধী’ সমাাজিক উপন্যাস। ‘পরিণাম’ পারিবারিকত ও সামাজিক উপন্যাস। ‘গরীবের মেয়ে’ একটি আত্মজীবনীমূলক সামাজিক উপন্যাস। ‘মেহের-উন্নিসা’ সামাজিক উপন্যাস। ‘নামাজের ফল’ সামাজিক-ধর্মীয় উপন্যাস। ‘দুনিয়া আর চাই না’ গল্প-সংকলন। ‘বেহেস্তের ফুল’ উপন্যাস। ‘দুনিয়া কেন চাই না’ উপন্যাস। ‘রমণীর বেহেস্ত’ পারিবারিক উপন্যাস।

নজিবর রহমানের প্রথম উপন্যাস ‘আনোয়ারা’ প্রকাশের সাথে সাথে তিনি অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। নজিবর রহমানের পূর্ববর্তী কথাশিল্পীর সবাই হিন্দু। তাঁদের সাহিত্যের ভাব-বিসয়, চরিত্র ও উপাদান প্রায় সবই হিন্দু সমাজ ও পরিবেশকেন্দ্রিক। নজিবর রহমানের উপন্যাসে সর্বপ্রথম মুসলিম সমাজচিত্র ফুটে ওঠে। তাঁর লেখায় বাঙালি মুসলিম চরিত্র, ঘটনা ও নানা সুখ-দুঃখের কাহিনী জীবন্ত রূপ লাভ করে। ইসলাম ধর্মের মাহাত্ম্য, সতী নারীর অপরিসীম ত্যাগ ও ধৈর্য এবং সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়ের চিরন্তন দ্বন্ধ লেখক বাস্তসম্মতভাবে ফুটিয়ে তোলেন। সমাজের সব অন্যায় ও অধঃগতির জন্য তিনি অশিক্ষা-কুশিক্ষা, হিংসাবিদ্বেষ, অকর্মণ্যতা ও অধর্মকে দায়ী করেন। একমাত্র সুশিক্ষা, পরষ্পর সহনশীল মবোভাব, সৎ চরিত্র, ন্যায়পরায়ণতা ও ধর্মপালনেই সমাজের উন্নতি সাধন সম্ভব বলে তিনি বিভিন্ন ঘটনা কাহিনী ও চরিত্র চিত্রনের মাধ্যমে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন।

ইতঃপূর্বে বাংলার মুসলিম সমাজের কাহিনী, ভাব-বিষয়, চরিত্র ও জীবন নিয়ে এভাবে কেউ উপন্যাস বা গল্প রচনা করেননি। এ কারণে উপেক্ষিত মুসলিম সমাজ নজিবর রহমানের সাহিত্যে তাদের নিজস্ব জীবন-চিত্রের রূপায়ণ দেখে মুগ্ধ হয় এবং এটাকে তাদের একান্ত নিজস্ব সাহিত্যরূপে গ্রহণ করে।

নজিবর রহমানের সাফল্য ও জনপ্রিয়তার অন্যতম প্রধান কারণ তাঁর সুললিত, ব্যঞ্জনাময়, প্রাঞ্জল, অলঙ্কারবহুল, কাব্যময় ভাষা। যেকোনো লেখা প্ৰকৃত সাহিত্য পদবাচ্যরূপে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য কি না, তা বিচারের অপরিহার্য মানদন্ড হলো এর হৃদয়গ্রাহী ভাষা। ভাষা সুন্দর, লালিত্যময় ও ছন্দময় না হলে পাঠকের মনকে তা আকৃষ্ট করতে পারে না। নজিবর রহমানের ভাষা অনন্যসাধারণ। এ ভাষা অনেকটা বঙ্কিমচন্দ্রীয় ভাষার আদলে তৈরি হলেও এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো সাধু বাংলার সাথে মুসলমানি শব্দের চমৎকার প্রাঞ্জল ব্যবহার। নজিবর রহমানের এ অনন্যসাধারণ ভাষাভঙ্গি তাঁর সাহিত্যকে সাধারণভাবে সব পাঠক এবং বিশেষভাবে মুসলিম সমাজে জনপ্রিয় করে তোলে। নজিবর রহমানের জনপ্রিয়তার আরেকটি কারণ হলো তিনি তাঁর সাহিত্যে সততা, ন্যায়নিষ্ঠ, প্রেম- ভালোবাসা, মহত্ত্ব-উদারতা, উন্নত জীবন, ধর্মীয় মাহাত্ম্য, শিক্ষা ও সমাজ উন্নয়নের কথা বলেছেন। তাঁর সমকালে পরাধীন দেশে মুসলিম সমাজের অবস্থা ছিল অত্যন্ত করুণ। তারা এক দিকে ইংরেজ অন্য দিকে হিন্দুদের দ্বিমুখী শাসন- শোষণে অধঃপতিত ও নিগৃহীত জীবনযাপন করছিল। রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে মুসলিম সমাজ ছিল পশ্চাৎপদ অশিক্ষিত, অনুন্নত, পশ্চাৎপদ সমাজে উন্নত চরিত্রের বিকাশ ঘটে না। তাই মুসলিম সমাজে তখন সততা, ন্যায়নিষ্ঠা, প্রেম-ভালোবাসা, মহত্ত্ব-উদারতা, উন্নত জীবন ও শিক্ষা-সংস্কৃতির অভাব ছিল প্রকট। নজিবর রহমান তাঁর স্বদেশ ও স্বজাতিকে গভীরভাবে ভালোবসতেন। স্বদেশ ও স্বজাতির উন্নয়নে তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন। মূলত তাঁর সাহিত্য চর্চার সাথে তাঁর দেশপ্রেম, স্বজাতিপ্রেম ও ধর্মবোধ একসূত্রে গাঁথা। তাঁর এসব উদ্দীপনামূলক গ্রন্থাদি পাঠ করে পাঠক বিশেষত মুসলিম সমাজে নবজাগরণ ও নরজীবন গঠনের প্রেরণা সৃষ্টি হয়। বাঙালি মুসলিম সমাজে নবজাগরণের উদ্গাতা হিসেবে নজিবর রহমানের অবদান তাই অবিস্মরনীয় হয়ে থাকবে।

শিল্পবিচারে নজিবর রহমানের সাহিথ্য হয়তো বেশ কিছু ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু নবজাগরণের উন্মেষ-লগ্নে এ ধরণের ছোটখাটো ত্রুটি-বিচ্যুতি কখনো গুরুত্ব লাভ করে না। তা ছাড়া, তাঁর উৎকর্ষমন্ডিত লালিত্যময় ভাষা, উপেক্ষিত মুসলিম সমাজের বাস্তব জীবনচিত্র ও উন্নত মহৎ জীবন-ভাবনার সাবলীল প্রকাশ তাঁর সহিত্যকে চিরন্তন শাশ্বত আবেদনে মহিমময় ও উজ্জ্বল করে তুলেছে। এ কারণে বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি চির অমর হয়ে আছেন।