সারারাত এক লহমার জন্যে ঘুমোল না ওরা।

মেডিকেল হোস্টেল, মুসলিম হল, চামেলী হাউস, ইডেন হোস্টেল, ফজলুল হক হল, সতর্ক প্রহরীর মত সারারাত জেগে রইল ওরা।

কেউবা জটলা বেঁধে কোরাসে গান গাইলো, ভুলবো না, ভুলবো না, একুশে ফেব্রুয়ারি।

কেউ গাইলো, দেশ হামারা।

ফজলুল হক হলটাকে বাইরে থেকে দেখতে মোঘল আমলের দুর্গতদের মত মনে হয়। আস্তরবিহীন ইটের দেয়ালগুলো রক্তের মত লাল।

তিনতলা দালানটা চৌকোণণা, মাঝখানে দুর্বাঘাস পাতা প্রশস্ত মাঠ।

দুপাশে বাগান।

মাঠের ওপর ছেলেরা কাগজের স্মৃতিস্তম্ভ গড়তে বসলো। বাঁশের কঞ্চি এলো। কাগজ এালো। রঙ তুলি সব কিছু নিয়ে কাজে লেগে গেলো ওরা। অদূরে কালো পতাকা আর কালো ব্যাজ বানাতে বসলো আরেক দল ছেলে। ঘন অন্ধকারে ছায়ার মত মনে হলো ওদের।

তিনতলা থেকে কে একজন ডেকে বললো, একটু অপেক্ষা করো, আমরা আসছি।

অপেক্ষা করার সময় নেই, নিচে থেকে কবি রসুল জবাব দিলো।

রাতারাতি শেষ করতে হবে সব। তোমরা তাড়াতাড়ি এসো।

আরেকজন বললো, আসতে আঠার টিনটা নিয়ে এসো মাহের।

এমনি, আরো একটা রাত এসেছিলো বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে।

পরিকল্পনাটা প্রথমে আলীম ভাই-এর মাথায় এসেছিলো।

রাতারাতি একটা স্মৃতিস্তম্ভ গড়বে আমরা।

চমৎকার। শুনে সায় দিয়েছিলো সবাই।

মেডিকেল হোস্টেলের চারপাশে তখন জমাট নিস্তব্ধতা। রাস্তায় গাড়ি ঘোড়ার চলাচল নেই। আকাশমুখী গাছগুলো কুয়াশার ভারে আনত।

একে একে ছেলেরা সবাই বেরিয়ে এলে ব্যারাক ছেড়ে।

প্রথমে একটা জায়গা ঠিক করে নিলো ওরা।

শহীদ রফিকের গুলিবিদ্ধ খুলিটা চরকীর মত ঘুরতে ঘুরতে যেখানে এসে ছিটকে পড়েছিলো, যেখানে দাঁড়িয়ে বরকত তার জীবনের শেষ কথাটা উচ্চারণ করেছিলো, ঠিক হলো সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ গড়বে ওরা।

সেখান থেকে প্রায় তিনশ’ গজ দূরে, মেডিকেল কলেজের একটা বাড়তি ঘর তোলার জন্যে ইট রাখা হয়েছিলো স্তুপ করে। এই তিনশ’ গজ পথ সার বেঁধে দাঁড়াল ছেলেরা। তারপর হাতে হাতে, এক ঘণ্টার মধ্যে চার হাজার ইট সেখান থেকে বয়ে নিয়ে এলো ওরা। স্টোর রুমের তালা খুলে তিন বস্তা সিমেন্ট বের করা হলো। দু’জন গিয়েছিলো রাজমিস্ত্ৰী আনতে। চকবাজারে। সেই শীতের রাতে অনেক তালাশ করে মিস্ত্রী নিয়ে ফিরে এলো ওরা।

সারারাত কাজ চললো।

পরদিন সমস্ত দেশ অবাক হয়ে শুনলো সে খবর।

তারপর।

তারও দিন চারেক পরে আরো একটা খুব শুনে বিস্ময়ে বিমূঢ় হলো সবাই। সরকারের মিলিটারি এসে স্মৃতিস্তম্ভটাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে গেছে।

কিন্তু, ছেলেরা দমেনি। ধুলোয় মেশানো ইটের পাঁজরগুলোকে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ঘিরে দিয়েছিলো ওরা। কয়েকটা গন্ধরাজ আর গাঁদা ফুলের চারা লাগিয়ে দিয়েছিলো ভেতরে।

এসব তিন বছর আগের কথা।

সে রাতে মেডিকেলের ছেলেরা কাপড় দিয়ে কঞ্চির ঘেরটা ঢেকে নিলো সযত্নে। বাগান থেকে ফুল তুলে এনে অজস্ৰ ফুলে ভরিয়ে দিলো বেদী।

তারপর কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে গান গাইলো ওরা, শহীদের খুন ভুলবো না।

বরকতের খুন ভুলবো না।

কাগজ দিয়ে গড়া স্মৃতিস্তম্ভের কাজ শেষ হলে পরে ছেলেরা অনেকে কবি রসুলের রুমে বিশ্রাম নিতে এলো। রাহাত আর মাহের হাত-পা ধুয়ে ধপ করে শুয়ে পড়লো বিছানার ওপর। উঃ এই শীতের ভেতরেও গায়ে ঘাম বেরিয়ে গেছে। রাহাত ই তুললো।

মাহের বললো, একটা সিগারেট খাওয়ানা রসুল ভাই। আছে?

না, নেই। কম্বলের ভেতর থেকে মুখ বের করে জবাব দিলো রসুল।

বিকেল থেকে শরীরটা জ্বর জ্বর করছিলো ওর। এখন আরো বেড়েছে। কিন্তু সেটা ও জানতে দেয় নি কাউকে। ওর ভয়, যদি জ্বরের খবরটা সবাই জেনে যায় তাহলে ঘর ছেড়ে এক পাও বাইরে বেরুতে দেবে না ওকে। উহ! এমন দিনেও কেউ ঘরে বন্দি হয়ে থাকতে পারে।

নড়েচড়ে শুতে গিয়ে ওর গায়ে হাত লাগতে রাহাত চমকে উঠলো।

একি রসুল ভাই, তোমার জ্বর এসেছে।

এই সামান্য জ্বর।

ইস! গা দেখছি পুড়ে যাচ্ছে, আর তুমি বলছে সামান্য। রাহাত উঠে বসে কম্বলটা ভাল করে গায়ে জড়িয়ে দিল ওর।

মাহের বললো, আমি ঘুম দিলাম রাহাত। ভোর রাতে ব্লাক ফ্ল্যাগ তোলার সময় আমায় জাগিয়ে দিয়ে।

এখন আবার ঘুমোবো কি? রাহাত কোন উত্তর দেবার আগে আরেকজন বললো। একটু পরেই পতাকা তোলার সময় হয়ে যাবে। তারচে’ এসে গল্প করি।

সেই ভালো। মাহের উঠে বসলো, কিন্তু একটু ধুয়ো না পেলে জমছে না। আছে নাকি কারো কাছে, থাকলে এক-আধটা দাও।

আহ, তুমি জ্বালিয়ে মারলে। কে একজন বলে উঠলো, নাও টানো।

সিগারেটটা ধরিয়ে একটা তৃপ্তির টান দিলো মাহের। তারপর একটা গল্প বলতে শুরু করলো সে।

 

ঘড়িতে এলাৰ্ম দিয়ে রেখেছিলো সালমা। এলাৰ্মের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল ওর। গায়ের ওপর থেকে লেপটা সরিয়ে ধীরে ধীরে উঠে বসলো।

বাতিটা জ্বালিয়ে কলগগাড়া থেকে হাত-মুখ ধুয়ে এলো। তারপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঘন চুলগুলোর মধ্যে মৃদু চিরুনি বুলিয়ে নিলো সালমা। খাটের তলা থেকে স্টোভটা টেনে নিয়ে আগুন ধরালো। ঠাণ্ডায় হাত-পা কাঁপছিলো। আগুনের পাশে বসে গা-টা একটু গরম করে নিলে সে। তারপর চায়ের কেতলিটা আগুনে তুলে দিয়ে আসাদকে ডাকতে গেলো।

দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকতে বড় সঙ্কোচ হচ্ছিলো সালমার। দরজা খুলে দেখলো, কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে আসাদ। বালিশের ওপর থেকে মাথাটা গড়িয়ে পড়েছে বিছানার ওপর। চোখে তার গাঢ় ঘুম কি নাম ধরে ডাকবে, সালমা ভাবলো । আসাদ সাহেব, না আসাদ ভাই।

অবশেষে ডাকলো, এই শুনছেন। চারটা বেজে গেছে, শুনছেন?

শোনার কোন লক্ষণ দেখা গেল না।

সালমা ভাবলো শাহেদকে দিয়ে জাগাবে ওকে। কিন্তু এতো রাতে শাহেদকে জাগানো বিপদ। যেমন রগচটা ছেলে, রেগে গিয়ে আবার একটা কাণ্ড ঘটিয়ে বসবে।

সালমা আবার ডাকলো, এই যে, শুনছেন। চারটে বেজে গেছে।

শুনছেন?

আহ্ কি হচ্ছে এই রাতের বেলা। সহসা রেগে গেলো আসাদ। তার চোখেমুখে বিরক্তি।

ঘুমের ঘোরে পাশ ফিরে শুলো সে।

সালমা মুখ টিপে হাসলো ।

আচ্ছা বিপদ তো লোকটাকে নিয়ে। এই যে শুনছেন? কাঁধের পাশে জোরে একটা ধাক্কা দিলো সালমা।

ধড়ফড় করে এবার বসলো আসাদ। কি ব্যাপার ক’টা বাজে।

চারটা। সালমা ঈষৎ ঘাড় নেড়ে বললো, আপনি তো বেশ ঘুমোতে পারেন? উঠুন, চটপট হাত-মুখ ধুয়ে নিন। আমি যাই চায়ের পানিটা নামই গিয়ে।

কেমন? মিষ্টি করে হাসলো সালমা ।

যান, আমি আসছি। আসাদের চোখেমুখে তখনও ঘুমের অবসাদ। জড়ানো গলায়। বললো, উত্ কি শীত। হাত-পা সব ঠকঠক করে কাঁপছে।

চাদরটা গায়ে জড়িয়ে নিন। নইলে ঠাণ্ডা লাগবে। যাবার সময় বলে গেলো সালমা।

ঘুমে তখনো চোখজোড়া বার বার জড়িয়ে আসতে চাইলো তার। তবু চাদরটা গায়ে টেনে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো আসাদ। চটিজোড়া খাটের তলা থেকে বের করে নিয়ে পরলো।

বারান্দায় বালতি ভরা পানি ছিলো।

পানিতে হাত দিতে গিয়ে ঠাণ্ডায় শিউরে উঠলো সে।

উত্তর থেকে আসা ঈষৎ ভেজা বাতাস দেয়ালের গায়ে প্রতিহত হয়ে অদ্ভুত একটা শব্দের সৃষ্টি করছে। সে শব্দ অনেকটা যেন হাহাকারের মতো শোনাচ্ছে কানে।

ও ঘর থেকে সালমা শুধালো, আপনার হাত-মুখ ধোঁয়া হলো আসাদ সাহেব? এইতো হলো।

ঘরের মধ্যে আর কোন আলো নাই। অন্ধকারে শুধু স্টোভটা জ্বলছে, মাঝখানে। তার পাশে বসে স্থির চোখে কেতলিটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে সালমা। দেয়ালে বড় হয়ে একটা ছায়া পড়েছে তার। দোরগোড়ায় মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়ালো আসাদ। হঠাৎ দেয়ালের ছায়াটাকে অদ্ভুত সুন্দর বলে মনে হলো ওর।

নিঃশব্দে স্টোটার কাছে এসে বসলো আসাদ।

আপনার কি খুব শীত লাগছে? এক সময় আস্তে করে সালমা শুধালো।

স্টোভের আরো একটু কাছে সরে এসে আসাদ বললো, সত্যি ভীষণ শীত পড়েছে। হাতজোড়া বরফের মত ঠাণ্ডা হয়ে গেছে দেখুনা বলে হাত দুটো ওর দিকে এগিয়ে দিলো আসাদ।

অন্ধকারে মৃদু হাসলো সালমা হাত বাড়িয়ে ওর হাতের তাপ অনুভব করতে গেলে হাতজোড়া মুঠোর মধ্যে আলতো ধরে রাখলো আসাদ।

সালমা শিউরে উঠলো।

প্রথমে রীতিমত ঘাবড়ে গেলো সে। ঈষৎ বিস্মিত হলো।

তারপর চুপচাপ মাথা নিচু করে তাকিয়ে রইলো জ্বলন্ত স্টোভের দিকে। বুকটা দুরু দুরু কাঁপছে তার। এই শীতের ভেতরেও মনে হলো সে যেন ঘামতে শুরু করেছে। কয়েকটি মুহূর্ত, বেশ ভালো লাগলো সালমার।

সে ওর মুখের দিকে তাকাবার সাহস পেলো না। হাতজোড়া টেনে নেবার কোন চেষ্টা করলো না। শুধু আধফোটা স্বরে বললো, পানি গরম হয়ে গেছে। বলতে গিয়ে গলাটা অদ্ভুতভাবে কেঁপে উঠলো।

তারপর এক সময় আস্তে হাতজোড়া টেনে নিলো সালমা।

নিঃশব্দে চা তৈরি করতে লাগলো সে।

চায়ের কাপে চামচের টুংটাং শব্দ।

আসাদ বললো, আমার কাপের চিনি একটু কম করে দেবেন।

সালমার মনে হলো আসাদের গলাটাও যেন কাঁপছে। যেন একটু আড়ষ্ট আর জড়িয়ে যাওয়া কণ্ঠস্বর।

অন্ধকারে বার কয়েক ওর শক্ত সবল হাতজোড়ার দিকে তাকালো সালমা। না। রওশন তার হারানো হাত দুটো কোনদিনও ফিরে পাবে না। একটা অশান্ত দীর্ঘশ্বাস বাতাসে শিহরণ জাগিয়ে গেলো।

অনেকক্ষণ নীরবে চায়ের পেয়ালায় চুকুম দিলো ওরা। মিছিল, শোভাযাত্রা, ধর্মঘট, মুহূর্তের জন্য সবকিছু অনেক দূরে সরে গেলো।

তারপর।

তারও অনেক পরে।

আগে থেকে রিক্সা ঠিক করা ছিলো, দোরগোড়ায় তার ডাক শোনা গেলো। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আসাদ বললো, কাপড় পরে নিন, সময় হয়ে গেছে।

সালমা অস্ফুট স্বরে কি যে বললো, বোঝা গেলো না।

বাইরে কনকনে শীত।

রিক্সায় এসে চুপচাপ বসলো ওরা।

সালমাকে মেয়েদের হোস্টেলে পৌছে দিয়ে আসাদ তখন ছেলেদের ব্যারাকে এসে। ঢুকলো। ঠিক সেই সময়ে হঠাৎ টাইফুনের শব্দে স্লোগানের তরঙ্গ জেগে উঠলো চারদিকে। অন্ধকারের বুক চিরে ধ্বনির বজ্ৰ ইথারে কাপন সৃষ্টি করলো।

মুসলিম হল, নূরপুর ভিলা, চামেলী হাউস, ফজলুল হক হল, বান্ধব কুটির, মেডিকেল হোস্টেল, ঢাকা হল যেন হুঙ্কার দিয়ে উঠলো এক সাথে। সে শব্দ তরঙ্গে অভিভূত হয়ে কে একজন ব্যারাকের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললো, বিদ্ৰোহ আজ বিদ্রোহ চারিদিকে।

ছেলেরা তখন কালো পতাকা উত্তোলন করছিলো।

সরু সিঁড়িটা বেয়ে ছাদের উপর উঠে এলো একদল ছেলে। মুনিম জিজ্ঞেস করলো, মই এনেছ তো?

দেখো মইটা খুব মজবুত নয়। সাবধানে উঠো; কালো পতাকাটা উড়িয়ে দাও।

পতাকাটা উড়িয়ে দেয়া হলে পর বেশ কিছুক্ষণ ধরে স্লোগান দিলো ওরা। তারপর কেউ কেউ নিচে নেবে গেলো। আর কয়েকজন ছাদের ওপর পায়চারী করতে লাগলো নিঃশব্দে।

একপাশে, যেখানে কার্নিশটা বেশ চওড়া, সেখানে এসে বসলো মুনিম। কুয়াশা ছাওয়া আকাশে তখন তারারা নিভতে শুরু করেছে একটা একটা করে। রমনার আকাশে ধলপহর দিচ্ছে। মৃদু উত্তরা বাতাসে শীতের শেষ সুর। দু’একটা পাখি শাল, দেবদারু গাছের ফাঁকে কিচিরমিচির করে ডাকছে।

কার্নিশের উপর থেকে দেখলো মুনিম। তিন লরী পুলিশ এসে নাবলো মুসলিম হলের গেটে। সাথে একটা জীপ। জীপ থেকে নাবলেন পুলিশ অফিসাররা। গাব্ৰাগোট্টা চেহারা। চোখগুলো লাল শাল।

গেটটা বন্ধ ছিলো বলে বাইরে দাঁড়াতে হলে ওদের । দারওয়ানকে ডাকলো, কিন্তু কোন সাড়াশব্দ পেলো না। ফ্লাগ ষ্ট্যাণ্ড কালো পতাকাটা পত পত করে উড়ছিলো। সে দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত ঘষলো ওরা। ছেলেরা তখন শ্লোগান দিতে শুরু করেছে। দমন নীতি চলবে না। ছাদের উপর থেকে দ্রুত নিচে নেবে এলো মুনিম।

একটা ছেলে ওকে দেখতে পেয়ে বললো, আপনি ওদিকে যাবেন না মুনিম ভাই । আপনি পেছনে থাকুন।

আরেকটি ছেলে হাত ধরে পেছনের দিক টেনে নিয়ে গেলো তাকে।

খবরটা পেয়ে ইতিমধ্যে প্রভোষ্ট সাহেব এসে হাজির। মোটাসোটা দেহটা নিয়ে রীতিমতো হাফিয়ে উঠেছিলেন তিনি, বুকটা দুরু দুরু করছিলো। শুকনো ঠোঁটজোড়া নেড়ে বারবার বিড়বিড় করছিলেন তিনি, কি আপদ, কি আপদ।

তাঁকে দেখে দারওয়ান সালাম ঠুকে গেট খুলে দিলো। গেট খুলতে পুলিশ অফিসাররা হুড়মুড় করে ঢুকতে যাচ্ছিলো, ছেলেরা চিৎকার করে উঠলো, আপনারা ভেতরে ঢুকবেন না বলছি।

আহাহা কি হয়েছে, কি হয়েছে। হাত-পা নেড়ে একবার পুলিশ অফিসারদের দিকে আরেকবার ছাত্রদের দিকে তাকালেন তিনি।

গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, তাঁর দেহটা কাঁপছে।

ছেলেরা বললো, ওদের বাইরে দাঁড়াতে বলুন স্যার, ভেতরে এলে ভালো হবে না।

আহাহা, আপনারা ভিতরে আসছেন কেন, বাইরে দাঁড়ান একটু।

প্রভোষ্ট সাহেবের কথায় অপ্রস্তুত হয়ে গেটের বাইরে গিয়ে দাঁড়ালো পুলিশ অফিসাররা।

ছেলেদের সঙ্গে এরপর কিছুক্ষণ বচসা হলো প্রভোষ্ট সাহেবের। প্রভোষ্ট সাহেব বললেন, কি আপদ, কালো পতাকাটা এবার নাবিয়ে ফেললেই তো পারো তোমরা। নাবিয়ে ফেলো না।

বাজে অনুরোধ আমাদের করবেন না স্যার। নাবাবার জন্যে ওটা তুলি নি। ছেলেরা একস্বরে বলে উঠলো। নিরাশ হয়ে বার কয়েক মাথা চুলকালেন প্রভোষ্ট সাহেব। তারপর বিড়বিড় করে বললেন, কি আপদ, কি আপদ।

পুলিশ অফিসারগুলোর ধৈর্যচ্যুতি ঘটছিলো। তাই হুড়মুড় করে আরেক প্রস্থ ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করলে তারা। ছেলেরা এগিয়ে এসে বাধা দিলো। আমরা ঢুকতে দিবো না বলছি, দেবো না।

তবু খাকি পোষাক পরা অফিসারদের সামনে এগুতে দেখে পরক্ষণে অপরিসর বারান্দাটার ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লা ওরা। তারপর চিৎকার করে বললো, যেতে হলে বুকের উপর দিয়ে হেঁটে যাও, এমনিতে যেতে দেবো না আমরা।

পুলিশ অফিসারগুলো পরস্পরের মুখের দিকে তাকালো। একজন অফিসার আরেকজনের কানে ফিসফিসিয়ে বললো, আমাদের অত কোমল হলে চলবে কেন স্যার, শুনলে কিউ. খান সাহেব বরখাস্ত করে দেবেন আমাদের। কিন্তু কেউ সাহস করলো না এগুতে।

 

মেডিকেলে মেয়েদের হোস্টেলের বাঁ দিককার রুমটায় তিন-চারজন মেয়েকে নিয়ে বসে আলাপ করছিলো সালমা। বাইরে বারান্দায় বসে তখন কয়েকটি মেয়ে গান গাইছিলো, ওদের ভুলিতে পারি না, ভুলি নাই রে- একটু আগে কালো পতাকা তুলেছে ওরা। এখনো সেই পতাকা তোলার বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলো। এমন সময়, হঠাৎ একটা বিরাট শব্দে চমকে উঠলো সালমা। বারান্দা থেকে একটি মেয়ে চিৎকার করে বললো, পুলিশ।

কোথায়? সালমা ছিটকে বেরিয়ে এলো বারান্দায়।

মেয়েটি হাত বাড়িয়ে দেখালো ওই দেখো।

সালমা চেয়ে দেখলো পুলিশ বটে। ছাত্রদের ব্যারাক ঘেরাও করেছে ওরা। সামনে দাড়িয়ে কিউ, খান নিজে। রাতে বড় কর্তার পাল্লায় পড়ে মাত্রাতিরিক্ত টেনেছে। তার আমেজ এখনো যায় নি। মাথাটা এখনো ভার ভার লাগছে। চোখজোড়া জবা ফুলের মত লাল টকটকে।

মেডিকেল ব্যারাকের গেটটা পেরুতে কালো কাপড় দিয়ে ঘেরা শহীদ বেদীটা চোখে পড়লে কিউ, খানের। লাল চোখে আগুন ঠিকরে বেরুলো তার। আধধ আলো-অন্ধকারে শহীদ বেদীটার দিকে তাকালে গাটা ছমছম করে ওঠে। আলকাতরার মত কালো কাপড়টা অন্ধকারকে যেন বিভীষিকাময় করে তুলেছে। আর তার ওপর যত্নে সাজিয়ে রাখা অসংখ্য ফুলের মালা হিংস্র পশুর চোখের মত জ্বলছে ধিকিধিকি করে।

কিউ. খানের ঈশারা পেয়ে একদল পুলিশ অকস্মাৎ ঝাঁপিয়ে পড়লে শহীদ বেদীটার ওপর। কঞ্চির ঘেরাটা দুহাতে উপরে অদূরে নর্দমার দিকে ছুঁড়ে মারতে লাগলো তারা। কালো কাপড়টা টুকরো টুকরো করে ফেলে দিলো একপাশে। ফুলগুলো পিষে ফেললো বুটের তলায়। হঠাৎ একটা রক্ত গোলাপ মারাতে গিয়ে কিউ, খানের মনে পড়লো, যৌবনে একটি মেয়েকে এমনি একটি ফুল দিয়ে প্রেম নিবেদন করেছিলো সে।

এক মুহূর্ত নীরব থেকে পিশাচের মত হেসে উঠলো কিউ, খান। হৃদয়ের কোমলতা তার মরে গেছে বহুদিন আগে।

ছেলেরা ইতিমধ্যে ব্যারাক ছেড়ে বেড়িয়ে জমায়েত হয়েছে বাইরে।

আর মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে স্লোগান দিচ্ছে উত্তেজিত গলায়। কারো গায়ে গেঞ্জি, কারো লুঙ্গি ছাড়া আর কিছুই নেই পরনে। কেউ কেউ গায়ে কম্বল চাপিয়ে বেরিয়ে পড়েছে বাইরে। সকলে উত্তেজিত। ক্রোধে আর ঘৃণায় হাত-পাগুলো ছিলো। যেন পুলিশগুলোকে হাতের মুঠোয় পেলে এক্ষুণি পিষে ফেলবে ওরা।

হঠাৎ কিউ. খানের বন্য গলায় আওয়াজ শোনা গেলো চার্জ।

মুহূর্তে পুলিশগুলো ঝাঁপিয়ে পড়লো ছাত্রদের উপর।

ওসমান খান সীমান্তের ছেলে। ভয় কাকে বলে জানে না সে। ছাত্রদের বেপরোয়া মারতে দেখে সে আর স্থির থাকতে পারলো না। বারান্দা থেকে লাফ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লে পুলিশের মাঝখানে। ইয়ে সব কায় হোতা হ্যায়, হামলোগ ইনসান নাহি হ্যায়? দুজন পুলিশকে জড়িয়ে ধরে মাটিতে গড়িয়ে পড়লো ওসমান খান। ছেলেরা সব পালাচ্ছিলো, ওসমান খান চিৎকার করে ডাকলো ওদের, আরে ভাগতা হায় কিউ। ক্যায়া হামলোগ ইনসান নাহি হ্যায়? কিন্তু পরক্ষণে একজন লালমুখে ইন্সপেক্টর ছুটে এসে গলাটা টিপে ধরলো তার। তারপর শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে কয়েকটা ঘুষি বসিয়ে দিলো ওসমান খানের মুখের ওপরে। প্রথম কয়েকটা ঘুষি কোন রকমে সয়ে নিয়েছিলো সে।

তারপর হুঁশ হারিয়ে টলে পড়লো মাটিতে।

রশীদ চৌধুরী এতক্ষণ লেপের তলায় ঘুমোচ্ছিলো। এসব হট্টগোল আর স্লোগান দেয়া ওর ভাল লাগে না। যারা এসব করে তাদের দুচোখে দেখতে পারে না সে ও জানে শুধু দুটো কাজ। এক হলো সিনেমা দেখা আর দুই হলো সারারাত জেগে ফ্লাশ খেলা। এ দুটো নিয়ে মশগুল থাকে সে।

বাইরে হট্টগোল শুনে ব্যাপার কি দেখার জন্যে দরজা দিয়ে উঁকি মারছিলো সে। অমনি একটা পুলিশ হাতের ব্যাট দিয়ে তো মারলো ওর মুখের ওপর। অস্ফুট আর্তনাদ করে দরজাটা বন্ধ করে দিতে চাইছিলো রশীদ চৌধুরী। ধাক্কা মেরে দরজাটা খুলেই পুলিশটা ওর গেঞ্জি চেপে ধরলো। ভাগতে হে কাঁহা, চালিয়ে।

রশীদ চৌধুরী বলির পাঠার মত কাঁপতে লাগলো, আমি কিছু করি নি।

আরে-আরে এ কি হচ্ছে? খামোস–ভয়ঙ্কর স্বরে হুঙ্কার দিয়ে উঠলো পুলিশটা।

রশীদ চৌধুরী আবার তাকে বোঝাতে চাইলে যে, সে নির্দোষ। আমি কিছু করি নি, কসম খোদার বলছি। কিন্তু এতে কোন ফল লাভ হলো না দেখে এবার রীতিমত গরম হয়ে উঠলো রশীদ চৌধুরী। চিৎকার করে সে তার বন্ধুদের ডাকলো। ভাইসব- তারপর স্লোগান দিতে লাগলো উত্তেজিত গলায়।