অবশেষে একদিন এসে পড়ল কাঙ্ক্ষিত সন্ধ্যা। সূর্য ডুবে গেছে। মরু বিয়াবানে নেমেছে চতুর্দশী জোৎস্নার ঢল। চারদিকের মরুর বালু জোৎস্নার স্নিগ্ধ আলোয় চিক্ চিক্ করছে। অসংখ্য মশালের আলোয় মরুভূমি উদ্ভাসিত।

ময়দানের একধারে বিশাল জায়গা জুড়ে সারি সারি তাঁবু। মাঝামাঝি স্থানে সুশোভিত মঞ্চ। অপরূপ কারুকার্যে সাজানো। রঙ-বেরঙের ঝাড়বাতি আর প্রদীপ্ত মশাল মঞ্চটিকে করে তুলেছে স্বপ্নীল। পাশেই বিশিষ্ট নাগরিক ও অফিসারদের বসার প্যান্ডেল। চতুর্দিকে হাজার হাজার সশস্ত্র প্রহরী। প্রাচীরের মত নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা।

মঞ্চ থেকে একটু দূরে অনুপম শিল্প সুষমায় তৈরী করা হয়েছে একটি সুদৃশ্য তাঁবু। সেখানে রাতযাপন করবেন স্বয়ং আমীরে মেসের।

আলী বিন সুফিয়ান রাত নামার আগেই সালাহুদ্দীনের জন্য নির্ধারিত তাঁবুর আশেপাশে গোয়েন্দা বাহিনীর কমাণ্ডোদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন। এ সময় নাজি তাঁর বিশেষ তাঁবুতে জোকিকে শেষ নির্দেশনা দানে মহাব্যস্ত।

জোকি আজ সেজেছে অপরূপ সাজে। আকাশ থেকে যেন মর্তে নেমে এসেছে কোন রূপের পরী। কড়া সুগন্ধী দিয়ে স্নাত হয়েছে মেয়েটি। সূক্ষ্ম কারুকার্যের ধবধবে সাদা কাশফুলের মত কোমল এক প্রস্থ কাপড়ে সেজেছে জোকি। সোনালী চুলগুলো ছেড়ে দিয়েছে উন্মুক্ত কাঁধে। শ্বেতশুভ্র কাঁধের চুলগুলো এলোমেলো হয়ে জোকিকে করে তুলেছে স্বপ্নকন্যা। পটলচেরা হরিণী চোখে কাজল মেখে যেন হয়ে উঠেছে রহস্যময়ী। কণ্ঠে তো রয়েছেই যাদুর বাঁশি। নৃত্যে রয়েছে হৃদয় ছিনিয়ে নেওয়ার তাল। মাতাল করা তার সুরলহরী। এমন কোন দরবেশ নেই, আজ জোকিকে দেখে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে পারে। হালকা কাপড় ভেদ করে ঠিকরে বেরুচ্ছে জোকির বিস্ফোরমুখ রূপ-লাবণ্য। রঙিন ঠোঁটের স্মিত হাসিতে যেন ঝরে পড়ছে গোলাপের পাপড়ী।

জোকির আপাদমস্তক একবার গভীর নিরীক্ষার দৃষ্টিতে দেখলেন নাজি। সাফল্যের নেশায় মনটা ভরে উঠছে তার। কিন্তু তারপরও সতর্ক নাজি। জোকিকে আবার সাবধান করে দিল—যদি তোমার এই অপরূপ অনিন্দসুন্দর দেহখানা দিয়ে সালাহুদ্দীনকে বশ করতে না পার, তাহলে প্রয়োগ করবে মুখের যাদু। আমার শেখানো কথাগুলো ভুলো না যেন। সাবধান! তাঁর কাছে গিয়ে, আবার তার দাসী হয়ে যেয়ো না। তুমি তার কাছে হবে ডুমুরের ফুল, যা দূর থেকে দেখা যায়; কখনও ছোঁয়া যায় না।

এই রূপ-লাবণ্য দিয়ে তুমি তাকে ভৃত্য বানিয়ে নেবে। আমার বিশ্বাস, তুমি পাথর গলাতে পারবে। মিসরের এই মাটিই জন্ম দিয়েছিল ক্লিওপেট্টার মত রূপসীকে। নিজের সৌন্দর্য, প্ররোচনা, যাদুকরী কূটচাল আর রূপের আগুনে গলিয়ে সীজারের মত লৌহমানবকেও মরুর বালিতে পানির মত বইয়ে দিয়েছিল সে। ক্লিওপেট্টা তোমার চেয়ে বেশী সুন্দরী ছিল না। আমি এতদিন তোমাকে ক্লিওপেট্রার কৌশলই শিখিয়েছি। রমণীর এ চাল ব্যর্থ হয় না কোনদিন।

নাজির কথায় মুচকি হাসল জোকি। গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনলো নাজির উপদেশগুলো। মিসরের এই রাতের মরুতে নাগিনীর রূপ ধরে ইতিহাসের পুরনো অধ্যায়ের পুনরাবৃত্তির আয়োজন করল নতুন এ ক্লিওপেট্টা।

সূর্য ডুবেছে একটু আগে। আঁধারে মিলিয়ে গেল পশ্চিম আকাশের লালিমা। জ্বলে উঠল হাজারও মশাল।

ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে অনুষ্ঠানের দিকে পা বাড়ালেন সালাহুদ্দীন। মিসরের নতুন আমীরের সম্মানে নাজির এই সংবর্ধনা, সামরিক মহড়া। মিসরের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা।

সালাহুদ্দীনের ডানে-বাঁয়ে, আগে-পিছে আলী বিন সুফিয়ানের অশ্বারোহী রক্ষী বাহিনী। ওরা আলীর কমাণ্ডো বাহিনীর বিশেষ সদস্য। দশজনকে সালাহুদ্দীনের তাঁবুর চার দিকে নিযুক্ত করা হয়েছিল আগেই।

সংবর্ধনা। রাজকীয় অভ্যর্থনা। সুলতান সালাহুদ্দীন ঘোড়া থেকে নেমে এলেন। ধীরপায়ে এগিয়ে গেলেন মঞ্চের দিকে। বেজে উঠল দফ। পর পর তোপধ্বনি। আমীরে মেসের সালাহুদ্দীন আইউবী জিন্দাবাদ ধ্বনিতে নিস্তরঙ্গ নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে মুখরিত হয়ে উঠল মরু উপত্যকা।

পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে মাথা নুইয়ে স্বাগত জানালেন নাজি। বললেন, ‘ইসলামের রক্ষক, জীবন উৎসর্গকারী সেনাবাহিনী আপনাকে খোশ আমদেদ জানাচ্ছে। তারা আপনার ইঙ্গিতে জীবন বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত। আপনি তাদের প্রাণচাঞ্চল্য দেখুন। আপনাকে পেয়ে তারা ভীষণ গর্বিত।’

সালাহুদ্দীন আইউবী মঞ্চে নিজ আসনের সামনে দাঁড়ালেন। চৌকস সৈন্যদলের একটি দল তাকে গার্ড অব অনার দিল। তিনি তাদের সালাম গ্রহণ করলেন। রাজকীয় মার্চ ফাষ্ট করে ওরা আড়ালে চলে গেল।

রাজকীয় আসনে বসলেন সালাহুদ্দীন। দূর থেকে কানে ভেসে এল এক অশ্ব ক্ষুরধ্বনি। প্যান্ডেলের আলোর সীমানায় এলে দেখা গেলে, দুই প্রান্ত থেকে চারটি ঘোড়া ক্ষীপ্রগতিতে মঞ্চের সামনে ময়দানের মাঝ বরাবর এগিয়ে আসছে। প্রত্যেক ঘোড়ায় একজন করে সওয়ার। সবাই নিরস্ত্র।

দেখে মনে হচ্ছে, তাদের সঙ্গে সংঘর্ষ অনিবার্য। কিন্তু না, চোখের পলকে মঞ্চের সোজাসুজি এসে থেমে গেল তারা। আরোহীরা এক হাতে লাগাম টেনে ধরে অন্য হাত প্রসারিত করে প্রতিপক্ষকে ডিঙিয়ে যেতে চাইল। এক পক্ষ অপর পক্ষের আরোহীকে ঘোড়া থেকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এক আরোহী প্রতিপক্ষের আরোহীকে বগলদাবা করে তার বাহন থেকে নিজের বাহনে নিয়ে দ্রুত দিগন্তে হারিয়ে গেল। ঘোড়া থেকে ময়দানে পড়ে ডিগবাজী খাচ্ছিল দুই আরোহী। অশ্ববাহিনীর এই ক্রীড়া-নৈপুণ্যে উপস্থিত দর্শকদের হর্ষধ্বনিতে মরুভূমি কেঁপে উঠল। হর্ষধ্বনিতে কানে তালা লাগার উপক্রম হল।

এদের পর দু প্রান্ত থেকে আরও চারজন করে অশ্বারোহী অনুরূপ ক্রীড়া-নৈপুণ্য দেখাল। একে একে এল উষ্ট্রারোহী, পদাতিক বাহিনী। এল নেজা, বল্লম ও তরবারীধারী সৈনিকরা। নানা রকম নৈপুণ্য দেখাল। দর্শকদের উচ্ছ্বসিত হর্ষধ্বনিতে অনুষ্ঠানস্থল মুখরিত হয়ে উঠল।

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী সৈনিকদের ক্রীড়া-নৈপুণ্য দেখে খুশী হলেন। এমন সৈনিকের প্রত্যাশাই মনে লালন করেন তিনি। আলী বিন সুফিয়ানের কানে কানে বললেন, ‘এ সৈনিকদের যদি ইসলামী চেতনায় উজ্জীবিত করা যায়, তাহলে এদের দিয়েই খৃষ্টানদের পরাজিত করা যাবে।’

‘নাজিকে সরিয়ে দিন। দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে। নাজি না থাকলে এদেরকে ইসলামী চেতনায় উজ্জীবিত করা কঠিন হবে না।’ বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

কিন্তু সালাহুদ্দীন আইউবী নাজির মত অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ সিপাহসালারকে অপসারণ না করে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার কথা ভাবছিলেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সুরাপানের সম্মতি দিয়ে তিনি নিজ চোখে দেখে নিতে চাচ্ছিলেন নাজির নিয়ন্ত্রিত সৈনিকরা আরাম-আয়েশে, ভোগ-বিলাসিতায় কতটুকু নিমজ্জিত; রণকৌশল ও কর্মদক্ষতায় কতটুকু পটু।

নাজির সৈন্যবাহিনীর বিভিন্ন ক্রীড়া-নৈপুণ্য, অস্ত্র-মহড়া, কমাণ্ডো অভিযানের প্রদর্শনীতে প্রমাণিত হল যুদ্ধবিদ্যা ও বীরত্ব-সাহসিকতায় তারা অসাধারণ। কিন্তু মহড়া শেষে যখন আহারের পর্ব এল, তখনই ধরা পড়ল তাদের আসল চরিত্র।

বিশাল প্যান্ডেলের একদিকে সৈনিকদের খাওয়ার আয়োজন; অপরদিকে আমীর, পদস্থ অফিসার ও বিশিষ্ট নাগরিকদের আহারের ব্যবস্থা। অনুষ্ঠান তো নয়, যেন সুলাইমানী আয়োজন। হাজার হাজার আস্ত খাসি, দুম্বা, মুরগী আর উটের রকমারী রান্না। আরও যত রকম প্রাসঙ্গিক খাদ্য সামগ্রী হতে পারে, কোনটি বাকি রাখেননি নাজি। খাবারের মৌ মৌ গন্ধ গোটা প্যাণ্ডেল জুড়ে।

সৈনিকদের প্রত্যেকের সামনে একটি করে শরাবের মশক। খাবারের চেয়ে যেন মদের প্রতিই তাদের আগ্রহ বেশী। আহার শুরু হতে না হতেই সৈনিকদের মধ্যে মদের মশক দখলের হড়োহুড়ি শুরু হল। ক্ষুধার্ত কুকুরের মত খাবারে হামলে পড়ল সবাই। কিছুক্ষণের মধ্যে নিঃশেষিত আহারের অবশিষ্টাংশ আর মদের সোরাহি নিয়ে শুরু হল ওদের চেঁচামেচি, হৈহুঁল্লোড়। উচ্ছৃঙ্খলতা ও হৈহুঁল্লোড় ছড়িয়ে পড়ল ছাউনীর বাইরেও।

নীরবে সালাহুদ্দীন পর্যবেক্ষণ করলেন সৈনিকদের আহারপর্ব। ভাবলেশহীন তার চেহারা। তিনি গভীরভাবে কিছু ভাবছেন চেহারা দেখে তা বোঝার উপায় নেই। সৈনিকদের উচ্ছৃঙ্খল আচরণে তিনি নির্বাক।

নাজিকে জিজ্ঞেস করলেন— ‘হাজার হাজার সৈনিকের মধ্যে অনুষ্ঠানের জন্যে আপনি এদের কী করে বাছাই করলেন? এরা কি আপনার বাহিনীর সবচেয়ে নিকৃষ্টতম সৈনিক?’

‘না, মহামান্য আমীর’ —ভূতের মত অনুগত ভঙ্গিতে বললেন নাজি— ‘এই দু হাজার সৈন্য আমার বাহিনীর শ্রেষ্ঠ সৈনিক। আপনি তো এদের মহড়া দেখলেন। যুদ্ধের ময়দানে এদের দুঃসাহসিক লড়াই দেখলে আপনি বিস্মিত হবেন। দয়া করে এদের সাময়িক বিশৃংখলা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখুন। এরা আপনার ইঙ্গিতে জীবন বাজী রাখতে প্রস্তুত। আমি মাঝে-মধ্যে এদের একটু অবকাশ দেই, যাতে মরার আগে রূপ-রসে ভরা পৃথিবীর স্বাদ কিছুটা উপভোগ করে নিতে পারে।’

সালাহুদ্দীন নাজির অযৌক্তিক ব্যাখ্যায় কোন মন্তব্য করলেন না। সালাহুদ্দীনকে তোষামোদের ঝরনায় স্নাত করে নাজি যখন বিশিষ্ট মেহমানদের কাছে নিজের বাহাদুরী প্রকাশে ব্যস্ত, এ সুযোগে সালাহুদ্দীন আইউবী আলীকে বললেন—

‘আমি যা দেখতে চেয়েছিলাম, দেখেছি। সুদানী ফৌজ মদ আর বিশৃংখলায় অভ্যস্ত। তুমি বলেছিলে এদের মধ্যে ইসলামী চেতনা ও দেশপ্রেম নেই। আমি দেখছি এদের সামরিক যোগ্যতাও নেই। এই বাহিনীকে যুদ্ধে পাঠালে যুদ্ধের চেয়ে এরা নিজের জীবন বাঁচানোর ধান্ধায় থাকবে বেশী। গনীমতের সম্পদ লুণ্ঠনের নেশায় থাকবে বিভোর। বিজিত এলাকায় নারীদের বাগে নিয়ে তাদের সাথে পাশবিক আচরণ করবে নিশ্চিত।’

‘এর প্রতিকার হল, আমাদের নতুন রিক্রুটকৃত মিসরীয় সৈনিকদেরকে এদের সাথে একীভূত করে দেওয়া। তাহলে ভালরা ভ্রষ্টগুলোর নৈতিকতাবোধ উন্নত করতে পারবে।’ বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

সালাহুদ্দীন আইউবী মুচকি হাসলেন। বললেন— ‘আলী! তুমি দেখছি আমার মনের কথাই বলছে! আমিও কিন্তু তাই ভাবছিলাম। কিন্তু বিষয়টা আমি এখনই প্রকাশ করতে চাই না। সাবধান! এ পরিকল্পনার কথা যেন কেউ জানতে না পারে।’

আলী বিন সুফিয়ানের অসাধারণ মেধা। তিনি চেহারা দেখেই মানুষের মনের লেখা পড়ে ফেলতে পারেন। মানুষ চেনার ব্যাপারে আলী কখনও ভুল করেন না। তিনি সালাহুদ্দীনকে কী যেন বলতে চাচ্ছিলেন। এ সময়ে মঞ্চের সামনে, হঠাৎ করে জ্বলে উঠল বাহারী ঝাড়বাতি। মঞ্চের সামনে দামী গালিচা বিছানো। বাদকদলের যন্ত্রে বেজে উঠল মনমাতানো সুর। ব্যাণ্ড দলের সুরের লহরি আর মরুর মৃদু বাতাসে দুলতে শুরু করল মঞ্চের শামিয়ানা।

মঞ্চের পিছন থেকে বাজনার সুরে সুরে নৃত্যের তালে তালে এগিয়ে এল একদল তরুণী। সংখ্যায় বিশজন। পরনে নাচের ঝলমলে পোশাক। আধখোলা দেহ। উক্ত কাঁধে ছড়ানো রেশমী চুল।

মরু রাতের মৃদুমন্দ বাতাসে উড়ছে তরুণীদের গায়ের কাপড়। চোখ-মুখ; ঢেকে দিচ্ছে চুল। প্রত্যেকের পোশাকের রঙ ভিন্ন; কিন্তু শরীরে গড়ন এক। সবাই উর্বশী তরুণী। আবক্ষ খোলা বাহু দিগন্তে প্রসারিত। বকের মত ডানা মেলে যেন এক গুচ্ছ ফুটন্ত গোলাপ উড়ে আসছে। দেখা যাচ্ছে না তাদের পায়ের নড়াচড়া। এগিয়ে আসছে নৃত্যের ছন্দে দুলে দুলে, যেন বাতাসে ভর করে।

মঞ্চের সামনের গালিচায় এসে অর্ধবৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে গেল তারা। সালাহুদ্দীনের দিকে দু হাত প্রসারিত করে একই সাথে মাথা ঝুঁকালো সবাই। ওদের খোলা চুল এলিয়ে পড়ল কাঁধে। যেন কতগুলো তারা খসে পড়ছে আসমান থেকে। মাথার উপর কারুকার্যমণ্ডিত শামিয়ানা। পায়ের নীচের মহামূল্যবান কার্পেট। নর্তকীদের লতানো শরীর আর অপূর্ব সুরের মূর্ছনায় সৃষ্টি হল এক স্বপ্নীল নীরবতা।

মঞ্চের এক প্রান্ত থেকে দৈত্যের মত এক হাবশী ক্ষীপ্রগতিতে এগিয়ে এল। পরনে চিতা বাঘের চামড়ার মত পোশাক। হাতে বিশাল এক ডালা। ডালায় আধফোঁটা পদ্মের ন্যায় একটি বস্তু।

তরুণীদের অর্ধবৃত্তের সামনে এসে ডালাটা রেখে দ্রুত আড়াল হয়ে গেল হাবশী।

সঙ্গীত দলের বাজনা তুঙ্গে উঠল। বেজে উঠল আরও জোরে। ডালা থেকে ধীরে ধীরে উত্থিত হল এক কলি। দেখতে দেখতে সব পাপড়ী মেলে ফুটন্ত গোলাপের মধ্য থেকে বেরিয়ে এল এক অপ্সরী।

মনে হচ্ছিল লাল মেঘের আবরণ ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে দ্বাদশীর চাঁদ। এক অনিন্দ্য সুন্দরী তরুণী। ঠোঁটে মুক্তা ঝরানো হাসির ঝিলিক। এ যেন মাটির মানুষ নয়, এক হীরে-পান্নার তৈরী ভিন গ্রহের মায়াবিনী।

দু হাত প্রসারিত করে নৃত্যের তালে এক পাক ঘুরে অভিবাদন জানাল তরুণী। সালাহুদ্দীনের দিকে চোখের পটলচেরা কটাক্ষ হেনে পলক নেড়ে স্থির হয়ে দাঁড়াল। অভ্যাগত দর্শকরা নৃত্য সঙ্গীতের বাজনা আর তরুণীদের আখি মুদিরায় তন্ময়। নিঃশ্বাসটি বেরুচ্ছে না কারও।

সালাহুদ্দীনের দিকে তাকালেন আলী বিন সুফিয়ান। ঠোঁটে রহস্যপূর্ণ হাসি। বললেন— ‘মেয়েটি এতটা সুশ্রী হবে ধারণা করিনি।’

‘আমীরে মেসেরের জয় হোক’ বলতে বলতে এগিয়ে এলেন নাজি। সালাহুদ্দীনের সামনে এসে গদগদ চিত্তে বললেন— ‘এর নাম জোকি। আপনার খেদমতের জন্যে একে আমি আলেকজান্দ্রিয়া থেকে আনিয়েছি। এ তরুণী পেশাদার নর্তকী বা বারবণিতা নয়। মেয়েটি ভাল নাচতে ও গাইতে জানে। এটা এর শখ। কখনও কোন অনুষ্ঠানে নাচে না।

মেয়েটির পিতা আমার পরিচিত। মাছ ব্যবসায়ী। বাপ-বেটি দুজনই আপনার খুব ভক্ত। এই মেয়েটি আপনাকে পয়গম্বরের মত শ্রদ্ধা করে। এক কাজে আমি এর বাবার সাথে সাক্ষাৎ করতে এদের বাড়ি গেলে মেয়েটি আমাকে বলল— ‘শুনেছি, সালাহুদ্দীন আইউবী মিসরের আমীর হয়ে এসেছেন। মেহেরবানী করে আপনি তাঁর সাথে আমার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিন। তাঁর পায়ে উৎসর্গ করার মত আমার জীবন আর নাচ ছাড়া কিছুই তো নেই। আল্লাহর কসম! আমি তার খেদমতে নিজেকে উৎসর্গ করে ধন্য হতে চাই।’

‘মহামান্য আমীর! আপনার কাছে নাচ-গানের অনুমতি চেয়েছিলাম শুধু এ মেয়েটিকে আপনার খেদমতে পেশ করার জন্যে।’

‘আমি নগ্ন নারী আর নাচ-গান পছন্দ করি না, একথা কি আপনি ওকে বলেছিলেন? আর যে মেয়েদের আপনি পোশাক-পরিহিতা বলছেন, ওরা তো উলঙ্গ।’ বললেন সালাহুদ্দীন।

‘মাননীয় আমীর! আমি ওকে বলেছিলাম, মিসরের আমীর নাচ-গান পছন্দ করেন না। ও বলল, মাননীয় আমীর আমার নাচে অসন্তুষ্ট হবেন না। আমার নাচে কোন নোংরামী থাকবে না, থাকবে শৈল্পিক উপস্থাপনা। মাননীয় আমীরের সামনে আমি নৃত্যের শিল্প সুষমাই উপস্থাপন করব। মেয়েটি আরও বলল, হায়! আমি যদি ছেলে হতাম, তাহলে মহামান্য আমীরের দেহরক্ষী বাহিনীতে যোগ দিয়ে নিজের জান তার জন্যে কুরবান করে দিতাম।’ স্বলাজ কম্পিত কণ্ঠে বললেন নাজি।

‘আপনি চাচ্ছেন, আমি মেয়েটিকে কাছে ডেকে ধন্যবাদ দিয়ে বলি, ‘তুমি হাজার হাজার পুরুষের সামনে উদ্দাম নৃত্যে চমৎকার নৈপুণ্য দেখিয়েছ, পুরুষের পাশবিক শক্তি উস্কে দিতে তুমি খুবই পারঙ্গম, এজন্যে তোমাকে ধন্যবাদ’, তাই না?’

‘না, না আমীরে মেসের! এমন অন্যায় চিন্তা আমি কস্মিনকালেও করিনি।’ কাচুমাচু হয়ে বললেন নাজি। ‘আমি তাকে এই নিশ্চয়তা দিয়ে এনেছি যে, এখানে এলে আপনার সাথে তার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেব। আপনার সাক্ষাতে ধন্য হতে প্রচণ্ড বাসনা নিয়ে সে অনেক দূর থেকে এসেছে।

আপনি ওর দিকে একটু তাকিয়ে দেখুন। ওর নাচে পেশাদারিত্বের নোংরামী নেই। নেই কোন পাপের আহ্বান। আছে শৈল্পিক কৌশলে আত্মোৎসর্গের বিনয়ভরা মিনতি। একটু চেয়ে দেখুন, মেয়েটি আপনাকে কী অপূর্ব শ্রদ্ধামাখা দৃষ্টিতে দেখছে। নিঃসন্দেহে ইবাদত আল্লাহর উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে। কিন্তু এই মেয়ে ওর অনুপম নাচ, মোহিনী দৃষ্টি সবকিছু উজাড় করে দিয়ে আপনার ইবাদত করছে।

কয়েক মুহূর্তের জন্য আপনি ওকে আপনার তাঁবুতে যাওয়ার অনুমতি দিন। ওকে মনে করুন সেই মহিয়সী মা, যার উদর থেকে জন্ম নেবে ইসলামের সুরক্ষক জানবাজ মুজাহিদ। ও হবে সেই বীরপ্রসূ মায়েদের একজন। ও সন্তানদের কাছে গর্ব করে বলতে পারবে, আমি সালাহুদ্দীন আইউবীর একান্ত সান্নিধ্যধন্য ভাগ্যবতী।’

নাজি আবেগময় ভাষায় সালাহুদ্দীনকে বিশ্বাস করাতে চাইল যে, এই মেয়েটি এক সম্ভ্রান্ত পিতার নিষ্পাপ কন্যা।

‘ঠিক আছে, ওকে আমার তাঁবুতে পৌঁছিয়ে দেবেন’ —বলে নাজিকে আশ্বস্ত করলেন সালাহুদ্দীন।

* * *

নিজের অপূর্ব নৃত্যকলা দেখাচ্ছিল জোকি। ধীরে ধীরে শরীর সংকোচিত করে একবার গালিচার উপর বসে যাচ্ছিল আবার সোজা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। শারীরিক সংকোচন ও সংবর্ধনের প্রতি মুহূর্তে জোকির দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল সালাহুদ্দীনের প্রতি। ওর ভূবনমোহিনী মুচকি হাসির মধ্যেই ফুটে উঠেছিল মনের হাজারও কথামালা, বিনয়-নম্র আত্মোৎসর্গের আকুতি। জোকির চারপাশে অন্য মেয়েরাও ডানাকাটা পরীর বেশে উড়ছে মনোহারী প্রজাপতির মত পাখা মেলে। মরুভূমির চাঁদনী রাতের আকাশে কোটি তারার মেলায় অসংখ্য ঝাড়বাতির আলোয়, শিল্পমণ্ডিত চাঁদোয়ার নীচে মনে হচ্ছে যেন স্ফটিকস্বচ্ছ পানির পুকুরে রাণীকে কেন্দ্র করে সাঁতার কাটছে একদল জলপরী।

সালাহুদ্দীন আইউবী নীরব। কী ভাবছেন বলা মুশকিল। মদ খেয়ে বুঁদ হয়ে আছে নাজির সৈন্যরা। সবাই যেন মৃত্যু-যন্ত্রণায় বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে ধুকছে। ড্যাব-ড্যাবে চোখে তাকাচ্ছে নতর্কীদের প্রতি। দর্শকরা হারিয়ে গেছে স্বপ্নীল জগতে। একটানা বেজে চলছে সঙ্গীতের মৃদু তরঙ্গ। মরুভূমির নিশুতি রাতে অল্পক্ষণ মঞ্চস্থ হচ্ছে ইতিহাসের গোপন অধ্যায়, যা জানবে না সাধারণ মানুষ। যা স্থান পাবে না ইতিহাসের পাতায়।

নিজের সাফল্যে নাজি খুব খুশি। জোকি দেখিয়ে যাচ্ছে যাদুকরী নাচ। সমতালে চলছে বাজনা। গম্ভীর হচ্ছে রাত।

* * *

রাত অর্ধেক পেরিয়ে গেছে। বিরতি টানা হল নৃত্যসঙ্গীতে। সবাই চলে গেল যার যার তাঁবুতে। জোকি শৈল্পিক ভঙ্গিতে হেলে-দুলে প্রবেশ করল নাজির কামরায়।

নিজের তাঁবুতে প্রবেশ করলেন সালাহুদ্দীন। দক্ষ কারিগরের হাতে সাজানো তাঁবু। মেঝেতে ইরানী কার্পেট। দরজায় ঝুলান্ত রেশমী পর্দা। রাজকীয় পালঙ্কে চিতা বাঘের চামড়ায় মোড়ানো বিছানা। ঝুলানো ঝাড়বাতির আলোয় তাঁবুর ভিতরে চাঁদের আলোর স্নিগ্ধতা। বাতাসে দুর্লভ আতরের সুবাস।

সালাহুদ্দীনের পিছনে পিছনে তাঁবুতে ঢুকল নাজি। বললেন— ‘ওকে একটু সময়ের জন্যে পাঠিয়ে দেব কি? আমি ওয়াদা ভঙ্গকে খুব ভয় করি।’

‘হ্যাঁ, দিন।’ বললেন সালাহুদ্দীন।

শিয়ালের মত নাচতে নাচতে নিজ তাঁবুর দিকে লাফিয়ে চললেন নাজি।

কয়েক মুহূর্ত পরে প্রহরীরা দেখল সালাহুদ্দীনের তাঁবুর দিকে অতি সন্তর্পণে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে এক তরুণী। গায়ে তার নর্তকীর পোশাক।

সালাহুদ্দীনের তাঁবুর চারপাশে প্রখর আলোর মশাল। নাজি তাঁবুর চতুর্দিকে। কোন আলোর ব্যবস্থা রাখেননি। ব্যবস্থাটা করেছেন আলী বিন সুফিয়ান। অতিরিক্ত নিরাপত্তার জন্যেই এ আয়োজন, যাতে কোন দুষ্কৃতিকারীর আগমন হলে পরিষ্কার তাকে চেনা যায়। বিশেষ প্রহরার জন্যে সালাহুদ্দীনের তাঁবুর প্রহরীদেরও নিযুক্তি দেন আলী।

তাঁবুর কাছে আসতেই মশালের আলোয় প্রহরীরা দেখতে পেলো নর্তকীকে। এই সেই নর্তকী। এখনও গায়ে তার নাচের ফিনফিনে পোশাক। ঠোঁটে মায়াবী হাসির আভা।

পথ রোধ করে দাঁড়াল প্রহরী দলের কমাণ্ডার। বলল, ‘এদিকে যেতে পারবে না তুমি।’

‘মহামান্য আমীর আমাকে তার তাঁবুতে ডেকে পাঠিয়েছেন।’ বলল জোকি।

‘হু! সালাহুদ্দীন আইউবী তোমার ন্যায় বাজে মেয়েদের সাথে রাত কাটানোর মত আমীর নন।’

‘না ডাকলে কোন সাহসে আমি এখানে আসব?’

‘কার মাধ্যমে তোমাকে ডেকে পাঠালেন?’

‘সেনাপতি নাজি আমাকে বলেছেন, মহামান্য আমীর তোমাকে তার তাঁবুতে ডেকেছেন।’

‘বিশ্বাস না হলে তাকেই জিজ্ঞেস করুন। যেতে না দিলে আমি ফিরে যাচ্ছি। কিন্তু আমীরের নির্দেশ অমান্য করার দায়দায়িত্ব আপনার।’

দেহরক্ষী কমাণ্ডার বিশ্বাস করতে পারছিল না, সালাহুদ্দীন আইউবী এক নর্তকীকে রাতে তার শয়নঘরে ডেকে পাঠাবেন। সালাহুদ্দীনের চারিত্রিক পবিত্রতা সম্পর্কে কমাণ্ডার অবগত। সে এ আদেশও জানত যে, কেউ নর্তকী-গায়িকাদের সাথে রাত কাটালে তাঁকে একশ দোররা মারা হবে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল কমাণ্ডার। কূল-কিনারা খুঁজে পাচ্ছে না সে। সাত-পাঁচ ভেবে শেষ পর্যন্ত কমাণ্ডার সালাহুদ্দীনের তাঁবুতে ঢুকে পড়ল।

কম্পিত কণ্ঠে বলল— ‘বাইরে এক নর্তকী দাঁড়িয়ে আছে। ও বলছে হুজুর জাঁহাপনা নাকি তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন?’

‘হ্যাঁ, পাঠিয়ে দাও।’ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন সালাহুদ্দীন।

বেরিয়ে এল কমাণ্ডার।

সালাহুদ্দীনের তাঁবুতে প্রবেশ করল জোকি। প্রহরীদের ধারণা, এক্ষুণি সালাহুদ্দীন আইউবী নর্তকীকে তাঁবু থেকে বের করে দেবেন। তারা আমীরের সে নির্দেশের জন্যে তাঁবুর কাছেই অপেক্ষা করছিল। কিন্তু না। এমন কোন আওয়াজ ভিতর থেকে এল না।

রাত বাড়ছে। ভিতর থেকে ভেসে আসছে ফিসফিস কণ্ঠস্বর। অস্থির পায়চারী করছে দেহরক্ষী কমাণ্ডার। তাঁর মাথায় তোলপাড় করছে আকাশ-পাতাল ভাবনা। এক প্রহরী কমাণ্ডারকে বলেই বসল— ‘ও…… যত আইন শুধু আমাদের বেলায়?’

‘হ্যাঁ, আইন আর শাসন অধীনদেরই জন্য। শাস্তির যত খড়্গ প্রজাদের জন্যে।’ বলল এক সিপাই।

‘মিসরের আমীরের জন্যে কি দোররার শাস্তি প্রযোজ্য নয়?’ বলল অন্য এক সিপাই।

‘না, রাজা-বাদশার কোন শাস্তি হয় না’ —ঝাঁঝের কণ্ঠে বলল কমাণ্ডার— ‘হয়ত সালাহুদ্দীন আইউবী মদও পান করেন। আমাদের উপর কঠোর শাসনের দণ্ড ঠিক রাখতে প্রকাশ্যে একটা পবিত্রতার ভান করেন মাত্র।’

একটি মাত্র ঘটনায় সালাহুদ্দীন আইউবীর প্রতি সৈনিকদের এত দিনের বিশ্বাস কর্পুরের মত উড়ে গেল। এতদিন যাদের কাছে সালাহুদ্দীন ছিলেন একজন ইসলামী আদর্শের মূর্তপ্রতীক, সে স্থলে তাদের কাছে এখন তিনি ভাল মানুষীর ছদ্মাবরণে পাপাচারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত বিলাসী চরিত্রহীন এক আরব শাহজাদা।

নাজি আজ পরম উফুল্ল। সালাহুদ্দীন আইউবীকে ঘায়েল করার সাফল্যে আজ মদ স্পর্শ করেনি সে। আনন্দে দুলছে লোকটা। সহকারী ঈদরৌসও নাজির তাঁবুতে বসা।

‘গেল তো অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। মনে হয় আমাদের তীর সালাহুদ্দীন আইউবীর অন্তর ভেদ করেছে।’ মন্তব্য করল ঈদরৌস।

‘আমার নিক্ষিপ্ত তীর কবে আবার ব্যর্থ হল?’

বলতে বলতে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল নাজি। ব্যর্থ হলে দেখতে, আমাদের ছোঁড়া তীর সাথে সাথে আমাদের দিকেই ফিরে আসত।

‘আপনি ঠিকই বলেছেন। মানবরূপী একটা যাদুর কাঠি জোকি।’ বলল ঈদরৌস। ‘মনে হয় ও হাশীশীদের সাথে কখনও থেকে থাকবে। না হয় মেয়েটা সালাহুদ্দীনের এমন পাথরের মূর্তি ভাঙ্গল কী করে।’

‘আমি ওকে যে প্রশিক্ষণ দিয়েছি, হাশীশীরা তা কল্পনাও করতে পারবে না।’ সাফল্যের ভঙ্গিতে বললেন নাজি। ‘এখন সালাহুদ্দীনের গলা দিয়ে মদ ঢুকানোর কাজটি শুধু বাকি।’

কারও পায়ের শব্দে লাফিয়ে উঠে তাঁবুর বাইরের এলেন নাজি। না, জোকি নয়। এক প্রহরী স্থান বদল করতে হেঁটে যাচ্ছে। নাজি সালাহুদ্দীনের তাঁবুর দিকে তাকালেন। দরজায় পর্দা ঝুলানো। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে প্রহরী।

বিজয়ের হাসিমাখা কণ্ঠে তাঁবুর ভিতরে বসতে বসতে নাজি বললেন— ‘এখন আমি নিশ্চিত বলতে পারি, আমার জোকি এতক্ষণে পাথর গলিয়ে পানি করে ফেলেছে।’

* * *

রাতের শেষ প্রহর। সালাহুদ্দীনের তাঁবু থেকে বেরিয়ে এল জোকি। নাজির তাঁবুতে না গিয়ে উল্টা দিকে রওনা দিল ও। পথেই আপাদমস্তক কাপড়ে আবৃত এক ব্যক্তি দাঁড়ানো। ক্ষীণ আওয়াজে ডাকলেন জোকি! দ্রুত পায়ে জোকি চলে গেল লোকটির কাছে। লোকটি জোকিকে নিয়ে একটি তাঁবুতে প্রবেশ করল।

জোকি অনেকক্ষণ কাটাল ওই তাঁবুতে। তারপর বেরিয়ে সোজা হাঁটা দিল নাজির তাঁবুর দিকে।

নাজি তখনও জাগ্রত। বারকয়েক তাকিয়ে দেখেছে সালাহুদ্দীনের তাঁবুর দিকে। সে জোকির আগমনের প্রতীক্ষায়। কিন্তু জোকিকে আসতে দেখেনি। তার ধারণা, জোকি সালাহুদ্দীন আইউবীকে রূপের মায়াজালে আবদ্ধ করেছে। আসমানের সুউচ্চ অবস্থান থেকে বিচ্যুত করে জোকি তার মর্যাদাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছে।

‘ঈদরৌস! রাত তো প্রায় শেষ। ও তো এখনও এল না!

‘ও আর আসবেও না’ —বলল ঈদরৌস— ‘আমীর তাকে সাথে নিয়ে যাবে। এমন হীরের টুকরোকে শাহজাদারা কখনও ফিরিয়ে দেয় না— এ কথাটি কখনও আপনি ভেবেছেন কি মাননীয় সেনাপতি?’

‘না তো! এ দিকটি আমি মোটেও ভাবিনি।’

‘এমনও হতে পারে যে, আমীর জোকিকে বিয়ে করে ফেলবেন’ —বলল ঈদরৌস— ‘তখন আর মেয়েটি আমাদের কাজের থাকবে না।’

‘ও খুব সতর্ক মেয়ে। অবশ্য নর্তকীদের উপর ভরসা করা যায় না। তাছাড়া জোকি পেশাদার নর্তকী মেয়ে। এ ধরনের কাজে সে অভিজ্ঞ। ধোঁকা দেওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।’ বললেন নাজি।

গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে নাজি। তার এতক্ষণের সাফল্যের ঝিলিককে ঘন মেঘমালার আড়ালে হারিয়ে দিয়েছে বিপরীত চিত্তা। এমন সময় পর্দা ফাঁক করে তাঁবুতে প্রবেশ করল জোকি। হাসতে হাসতে বলল, ‘এবার আমায় ওজন করুন আর পাওনা চুকিয়ে দিন।’

‘আগে বল কী করে এলে?’ পরম আগ্রহে জিজ্ঞেস করলেন নাজি।

‘আপনি যা চাচ্ছিলেন, তা-ই করেছি। কে বলল, আপনাদের সালাহুদ্দীন আইউবী পাথর? আবার উনি নাকি ইস্পাতের মত ধারাল, মুসলমানদের জন্যে আল্লাহর রহমতের ছায়া?’

পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলীর নখ দিয়ে মাটি খুঁড়তে খুড়তে জোকি বলল, ‘সে এখন এই বালু কণার চেয়েও হালকা। এখন সামান্য বাতাসই উড়িয়ে নিয়ে যাবে তাঁকে।’

‘তোমার রূপের যাদু আর কথার মন্ত্র তাকে বালুতে পরিণত করেছে’ —বলল ঈদরৌস— ‘নয়ত হতভাগা পাথুরে পর্বতই ছিল।’

‘ছিল বটে, তবে এখন বালিয়াড়িও নয়।’

‘আমার সম্পর্কে কোন কথা হয়েছে কি?’ জিজ্ঞেস করেন নাজি।

‘হ্যাঁ, হয়েছে। সালাহুদ্দীন আইউবী জিজ্ঞেস করেছেন, নাজি কেমন মানুষ? আমি বলেছি, মিসরে যদি আপনার কারও উপরনির্ভর করতে হয়, সেই লোকটি একমাত্র নাজি। তিনি জানতে চেয়েছেন, আমি আপনাকে কিভাবে চিনি? বলেছি, নাজি আমার পিতার অন্তরঙ্গ বন্ধু। তিনি আমাদের বাড়িতে যেতেন এবং আমার পিতাকে বলতেন, আমি সালাহুদ্দীন আইউবীর গোলাম। তিনি যদি আমাকে উত্তাল সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলেন, নির্দ্ধিধায় আমি তা করতে প্রস্তুত। তারপর তিনি বললেন, তুমি তো সতী-সাধ্বী মেয়ে। বললাম, আমি আপনার দাসী; আপনার যে কোন আদেশ আমার শিরোধার্য। তিনি বললেন, কিছু সময় তুমি আমার কাছে বসে থাক। আমি তার পার্শ্বে গা ঘেষে বসে পড়লাম। মুহূর্ত মধ্যে তিনি মোম হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণের জন্য আমরা দুজন প্রেমের অতল সমুদ্রে হারিয়ে গেলাম। পরে তিনি আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে বললেন, জীবনে আমি এই প্রথমবার পাপ করলাম; তুমি আমায় ক্ষমা করে দিও। আমি বললাম, না, আপনি কোন পাপ করেননি। আমার সঙ্গে আপনি প্রতারণাও করেননি, জোর-জবরদস্তিও নয়। রাজা-বাদশাহদের ন্যায় আদেশ দিয়ে আপনি আমায় ডেকে আনেননি। আমি নিজেই এসে স্বেচ্ছায় আপনার হাতে ধরা দিয়েছি। আসব আবারও।’ বলল জোকি।

আনন্দের আতিশয্যে নাজি বাহুবন্ধনে জড়িয়ে ধরল মেয়েটিকে। নাজি ও জোকিকে মোবারকবাদ জানিয়ে ঈদরৌস বেরিয়ে যায় তাঁবু থেকে।

* * *

মরুর রহস্যময় রাতের উদর থেকে জন্ম নিল যে প্রভাত, তা অন্য কোন প্রভাতের চেয়ে ব্যতিক্রম ছিল না। তবে প্রভাতকিরণ তার আঁধার বক্ষে লুকিয়ে রেখেছিল এমন একটি গোপন রহস্য, যার দাম সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর স্বপ্নের সালতানাতে ইসলামিয়ার মূল্যের সমান, যে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে যৌবন লাভ করেছেন সুলতান সালাহুদ্দীন।

গতরাতে এ মরুদ্যানে যে ঘটনাটি ঘটল, তার দিক ছিল দুটি। একটি দিক সম্পর্কে অবগত ছিলেন শুধু নাজি আর ঈদরৌস। অপর দিক সম্পর্কে অবহিত ছিল সুলতান সালাহুদ্দীনের রক্ষী বাহিনী। আর সুলতান সালাহুদ্দীন, গোয়েন্দা প্রধান আলী বিন সুফিয়ান ও জোকীর জানা ছিল ঘটনার উভয় দিক।

সুলতান সালাহুদ্দীন ও তাঁর সহকর্মীদের মর্যাদার সাথে বিদায় জানান নাজি। পথের দু ধারে সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে ‘সুলতান সালাহুদ্দীন জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিচ্ছে সুদানী ফৌজ। কিন্তু এই শ্লোগানের কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন না সুলতান। সামান্য একটু হাসির রেখাও দেখা গেল না তার দু ঠোঁটের ফাঁকে। ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসেন সুলতান। অত্যন্ত গম্ভীর মুখে নাজির সঙ্গে করমর্দন করে ছুটে চলেন তিনি।

হেড কোয়ার্টারে পৌঁছে সুলতান সালাহুদ্দীন আলী বিন সুফিয়ান ও এক নায়েবকে সঙ্গে করে কক্ষে প্রবেশ করেন। বন্ধ হয়ে যায় কক্ষের দরজা। বেলা শেষে রাত নামে। আঁধারে ছেয়ে যায় প্রকৃতি। বাইরের সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই কক্ষের এই তিনটি প্রাণীর। খাবার তো দূরের কথা, এত সময়ে এক ফোঁটা পানিও ঢুকল না কক্ষে। কক্ষের দরজা খুলে যখন তিনজন বাইরে বের হন, রাত তখন দ্বি-প্রহর।

কক্ষ থেকে বেরিয়ে চলে যান সালাহুদ্দীন। রক্ষী বাহিনীর এক কমাণ্ডার আলী বিন সুফিয়ানের কাছে এগিয়ে এসে বিনীত সুরে বলল— ‘মোহতারাম! বিনা বাক্যব্যয়ে আপনাদের আদেশ মান্য করে চলা আমাদের কর্তব্য। তথাপি একটি কথা না বলে পারছি না। আমার ইউনিটে এক রকম হতাশা ও অনাস্থা সৃষ্টি হয়ে গেছে। আমি নিজেও তার শিকার হতে চলেছি।’

‘কেমন হতাশা?’ জানতে চান আলী বিন সুফিয়ান।

‘আমার অভিযোগকে যদি আপনি গোস্তাখী মনে না করেন, তবেই বলব। আমাদের মহামান্য গভর্নরকে আমরা আল্লাহর প্রিয় বান্দা মনে করতাম এবং সর্বান্তকরণে তার প্রতি ছিলাম উৎসর্গিত। কিন্তু রাতে ………।’ বলল কমাণ্ডার।

‘রাতে সুলতান সালাহুদ্দীনের তাঁবুতে একটি নর্তকী গিয়েছিল, তাই তো? তুমি কোন গোস্তাখী করনি। অপরাধ গভর্নর করুন কিংবা ভৃত্য করুক, শাস্তি দুজনেরই সমান। পাপ সর্বাবস্থায়ই পাপ। তবে আমি তোমাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি, আমীরে মেসের ও নর্তকীর নির্জন মিলনের সঙ্গে পাপের কোন সংশ্রব ছিল না। বিষয়টা কী ছিল, তা এখনই বলব না; সময়ে তোমরা সবই জানতে পারবে।’ বললেন আলী বিন সুফিয়ান।

আলী বিন সুফিয়ান কমাণ্ডারের কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘মন দিয়ে আমার কথাগুলো শোন আমের বিন সালেহ! তুমি একজন প্রবীণ সৈনিক। তোমার ভাল করেই জানা আছে, সেনাবাহিনী ও সেনা কর্মকর্তাদের এমন কিছু গোপনরহস্য থাকে, যার সংরক্ষণ আমাদের সকলের কর্তব্য। নর্তকীর আমীরে মেসেরের তাঁবুতে রাত কাটানও তেমনি এক রহস্য। তুমি তোমাদের জানবাজদের কোন সংশয়ে পড়তে দিও না। রাতে সুলতানের তাঁবুতে কী ঘটেছিল, তা নিয়ে কাউকে ভুল বুঝবার সুযোগ দিও না।’

আলী বিন সুফিয়ানের বক্তব্যে কমাণ্ডার নিশ্চিত হয়ে যায়। দূর হয়ে যায় তার মনের সব সন্দেহ। বাহিনীর অন্য সকলের মনের খটকাও দূর করে ফেলে সে।

পরদিন দুপুর বেলা। আহার করছেন সুলতান সালাহুদ্দীন। ইত্যবসরে সংবাদ আসে, নাজি আপনার সাক্ষাৎ প্রার্থনা করছে। সুলতানের খাওয়া শেষ হলে কক্ষে প্রবেশ করেন নাজি। তার চেহারা বলছে, লোকটা সন্ত্রস্ত ও ক্ষুব্ধ। খানিকটা চড়া গলায় বলল, ‘মহামান্য আমীর! এ-কি আদেশ জারি করলেন আপনি! পঞ্চাশ হাজার অভিজ্ঞ সুদানী ফৌজকে মিসরের এই আনাড়ী বাহিনীর মধ্যে একাকার করে দিলেন!’

‘হ্যাঁ, নাজি! আমি গতকাল সারাটা দিন এবং আধা রাত ব্যয় করে এবং গভীরভাবে ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তুমি যে বাহিনীটির সালার, তাকে মিসরী বাহিনীর সঙ্গে এমনভাবে একাকার করে ফেলব যে, প্রতিটি ইউনিটে সুদানী সৈন্যের সংখ্যা থাকবে মাত্র দশ শতাংশ। আর এতক্ষণে তুমিও নির্দেশ পেয়ে গেছ, তুমি আর এখন সে বাহিনীর সালার নও, তুমি সেনা হেডকোয়ার্টারে চলে আসবে।’

‘মহারাজ! আপনি আমাকে এ কোন্ পাপের শাস্তি দিচ্ছেন?’ বললেন নাজি।

‘আমার এ সিদ্ধান্ত যদি তোমার মনঃপূত না হয়ে থাকে, তাহলে তুমি আমার সেনাবাহিনী থেকে সরে দাঁড়াও।’ বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন।

‘আমি বোধ হয় ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছি। আমি, আপনার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন মনে করি। হেডকোয়ার্টারে আমার অনেক শত্রু আছে।’

‘শোন! প্রশাসন ও সেনাবাহিনী থেকে ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা যেন চিরতরে দূর হয়ে যায়, তার জন্যই আমার এ সিদ্ধান্ত। আরেকটি কারণ, আমি চাই সেনাবাহিনীতে যার পদমর্যাদা যত উঁচু হোক কিংবা যত নিচু, যেন কেউ মদপান ও ব্যভিচার না করে এবং কোন সামরিক মহড়ায় নাচ-গান না হয়।’ বললেন, সুলতান সালাহুদ্দীন।

‘কিন্তু আলীজাহ! আমি তো আয়োজনটা হুজুরের অনুমতি নিয়েই করেছিলাম।’ বললেন নাজি।

‘তা ঠিক। তুমি যে বাহিনীটিকে মিল্লাতে ইসলামিয়ার সৈনিক বলে দাবি করতে, মদ ও নাচ-গানের অনুমতি আমি তার আসল রূপটা দেখার জন্যই দিয়েছিলাম। পঞ্চাশ হাজার সৈন্যকে আমি বরখাস্ত করতে পারি না। তাই মিসরী ফৌজের সঙ্গে একাকার করে আমি তাদের চরিত্র শোধরাব। আর তুমি এ কথাটিও শুনে নাও যে, আমাদের মধ্যে কোন মিসরী, সুদানী, শামী ও আজমী নেই। আমরা মুসলমান। আমাদের পতাকা এক, ধর্মও অভিন্ন।’ বললেন সুলতান সালাহুদ্দীন।

‘আমীরে মোহতারাম কি ভেবে দেখেছেন, এতে আমার মর্যাদা কোথায় নেমে যাবে?’ ক্ষুণ্ণ কণ্ঠে বললেন নাজি।

‘দেখেছি; তুমি যার যোগ্য, তোমায় সেখানেই রাখা হবে। নিজের অতীতের পানে একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নাও। নিজের কারগুজারী আমার কাছে শুনতে চেও না। যাও, তোমার সৈন্য, সামান-পত্র ও পশু ইত্যাদির তালিকা প্রস্তুত করে এক্ষুণি আমার নায়েবের কাছে হস্তান্তর কর। সাতদিনের মধ্যে আমার হুকুমের তামিল সম্পন্ন হয়ে যায় যেন।’

কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে চাইলেন নাজি। কিন্তু সুযোগ না দিয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান সুলতান সালাহুদ্দীন।

* * *