নিঝুম রাত। নাজি তার খাস কামরায় অধীন দুই কমাণ্ডার নিয়ে সুরাপানে বিভোর। গায়ে হালকা কাপড়, পায়ে নুপুর, চোখে-মুখে প্রসাধনী মেখে অস্পরা সেজে কামোদ্দীপক ভঙ্গিতে নাচছে দুই সুন্দরী নর্তকী।
নাজির খাস কামরায় যে কারোর প্রবেশাধিকার নেই। যারা নাজির ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি আর একান্ত সেবিকা, নর্তকী, সাকি একমাত্র তাদেরই সিডিউল মত নাজির ঘরে প্রবেশের অধিকার আছে। দারোয়ান জানত, কখন কাদের প্রবেশের অনুমতি রয়েছে।
হঠাৎ নাজির ঘরে প্রবেশ করে কানে কানে কি যেন বলল দারোয়ান। নাজি দারোয়ানের পিছনে পিছনে উঠে এল সঙ্গে সঙ্গে। দারোয়ান নাজিকে পার্শ্বের কক্ষে নিয়ে গেল।
কক্ষে উপবিষ্ট এক প্রৌঢ়। সাথে এক তরুণী। যৌবন যেন ঠিকরে পড়ছে মেয়েটির দেহ থেকে। নাজিকে দেখেই তরুণী উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাল। চোখের চাহনিতে গলে পড়ল মায়াবী আকুতি। তরুণীর রূপের জৌলুসে তন্ময় হয়ে দীর্ঘক্ষণ অপলক তাকিয়ে রইল নাজি।
তরুণীর গায়ে ফিনফিনে হালকা পোশাক। খুব দামী না হলেও বেশ আকর্ষণীয়।
নাজি অভিজ্ঞ নারী শিকারী। নিজের ভোগের জন্যই শুধু নয়, নারীকে তিনি ব্যবহার করেন অন্য বহু কাজে। বড় বড় অফিসার, আমীর-উমরাকে নারীর ফাঁদে ফাঁসিয়ে ব্ল্যাকমেইল করা নাজির অন্যতম কৌশল। সুন্দরী তরুণীদের গোয়েন্দা কাজে ব্যবহার করেও নাজি সৃষ্টি করে রেখেছে নিরাপদ এক জগৎ। এ জগতে আধিপত্য শুধুই নাজির।
কসাই জন্তু দেখেই যেমন বলতে পারে এতে কত কেজি গোশত হবে, নাজিও নারী দেখলেই বলতে পারে, ও কী কাজের হবে, কোন্ কাজে একে ব্যবহার করলে বেশী ফায়দা পাওয়া যাবে।
নারী ব্যবসায়ী, চোরাচালানী, অপহরণকারীদের সাথে নাজির গভীর হৃদ্যতা। ওরা সবসময়ই নাজির জন্যে নিয়ে আসে সেরা চালান। নাজি অকাতরে অর্থ দিয়ে কিনে নেয় তার পছন্দনীয় মেয়েদের। এই প্রৌঢ় লোকটিও নারী ব্যবসায়ীর মত। গায়ে আজানুলম্বিত সুদানী পোশাক। নাজিকে বলল, ‘এই মেয়েটি নাচ-গানে বেশ পারদর্শী। মুখের ভাষা যাদুমাখা। কথার যাদুমন্ত্রে পাথর গলাতে পারে। যে কাউকে মুহূর্তের মধ্যে বশ করতে পারঙ্গম। আর রূপ-লাবণ্য তো আপনার সামনেই। আমি এমন সুন্দরী মেয়ে জীবনে কমই দেখেছি। আপনিই এর যোগ্য বলে সরাসরি আপনার কাছে নিয়ে এলাম।’
তরুণীর সৌন্দর্যে নাজি মুগ্ধ । মেয়েটির বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতা যাচাই করার জন্যে দু-চার কথায় তরুণীর ইন্টারভিউ নিয়ে নিলেন নাজি। তরুণীর সাথে কথা বলে নাজির মনে হল, এ অনেক এক্সপার্ট। এ ধরনের মেয়েই তিনি তালাশ করছেন। সামান্য প্রশিক্ষণ দিলেই একে বিশেষ কাজে ব্যবহার করা যাবে।
দাম-দস্তর ঠিক হল। মূল্য বুঝে নিয়ে চলে গেল বেপারী। নাজি খাস কামরায় নিয়ে গেলেন মেয়েটিকে। কক্ষে তখন তুমুল নৃত্য-গান চলছে।
নাজি ঘরে প্রবেশ করতেই ওদের নাচ বন্ধ হয়ে গেল। নাজি নতুন মেয়েটিকে নাচতে বললেন।
পরিধেয় কাপড়ের পাট খুলে দু পাক ঘুরে হাত-পা-কোমর দুলিয়ে নাচ শুরু করতেই ওর নাচের মুদ্রা ও মনকাড়া ভঙ্গি দেখে ‘হা’ হয়ে গেলেন নাজি ও তার সহকর্মীরা। অনির্বচনীয় এই তরুণীর নাচ। এ যেন নাচ নয়, মরুর বুকে তীব্র ঝড়। সে ঝড়ে মানুষের কামভাব, দুশ্চিন্তা ও যন্ত্রণাকে শুধু একই তন্ত্রে পুঞ্জিভূত করে। মেয়েটির উর্বশী শরীর, কণ্ঠের সুরলহরী আর অঙ্গের পাগলকরা কম্পন মুহূর্ত মধ্যে মাতিয়ে তুলল নাজির কক্ষটিকে।
নাজি এবং তার সাথীরাই অবাক হল না শুধু। দুই পুরাতন নর্তকীর চেহারাও পাণ্ডুর হয়ে গেল ওর যাদুময়ী কণ্ঠ আর নাচের তালে। নাজির মনে হল, খুব বেশী সস্তায় অনেক দামী জিনিস পেয়ে গেছেন তিনি। যোগ্যতা ও সৌন্দর্যের হিসেবে দাম অনেক বেশী হওয়া উচিত ছিল মেয়েটির।
নাজির প্রতি ঝুঁকে নাচের ভঙ্গিতে কুর্নিশ করল তরুণী। নাচের ঘুর্ণনে বার বার নাজির গায়ে বুলিয়ে দিচ্ছিল কোমল অঙ্গের মোলায়েম পরশ। তরুণীর সৌন্দর্যে আনমনা হয়ে পড়ল নাজি।
আচমকা সবাইকে বিদায় করে দিল নাজি। দরজা বন্ধ। কক্ষে শুধু নাজি আর তরুণী। কাছে ডাকল তরুণীকে। বসাল নিজের একান্ত সান্নিধ্যে।
‘নাম কী তোমার?’
‘জোকি।’
‘বেপারী বলল, তুমি নাকি পাথর গলাতে পার। আমি তোমার এই যোগ্যতার পরীক্ষা নিতে চাই।’
‘কোন্ সে পাথর, যাকে পানি করে দিতে হবে বলুন?’
‘নয়া আমীর ও সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক সালাহুদ্দীনকে। তাকে পানির মত গলিয়ে দিতে হবে তোমাকে।’ বললেন নাজি।
‘সালাহুদ্দীন আইউবী?’ জিজ্ঞাসা করল জোকি।
‘হ্যাঁ, সালাহুদ্দীন আইউবী। তুমি যদি তাকে বশে আনতে পার, তবে আমি তোমাকে তোমার ওজনের সমান স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার দেব।’
‘তিনি কি মদপান করেন?’
‘না। মদ, নারী, নাচ-গান, আমোদ-ফুর্তিকে সে এমনই ঘৃণা করে, যেমন একজন মুসলমান শূকরকে ঘৃণা করে।’
‘আমি শুনেছি, আপনার কাছে নাকি এমন যুবতীও রয়েছে, যাদের দেহের সৌন্দর্য আর কলা-কৌশল নীল নদের স্রোতকেও রুদ্ধ করে দিতে পারে। ওদের যাদু কি ব্যর্থ?’
‘এ ক্ষেত্রে আমি ওদের পরীক্ষা করিনি। আমার বিশ্বাস, তুমিই এ কাজের জন্য উপযুক্ত। আমি তোমাকে সালাহুদ্দীনের আচরণ-অভ্যাস সম্পর্কে আরও বলব।’
‘আপনি কি তাকে বিষপ্রয়োগ করে হত্যা করাতে চান?’
‘না। এখনই এমন কিছু করতে চাই না। তার প্রতি আমার ব্যক্তিগত কোন আক্রোশ নেই। আমি শুধু তোমার রূপের জালে তাকে ফাঁসাতে চাই। তাকে আমার পাশে বসিয়ে শরাব পান করাতে চাই। তাকে হত্যা করার ইচ্ছা থাকলে সে কাজ হাশীশ গোষ্ঠী দিয়ে আরও সহজেই করান যেত।’
‘তার মানে আপনি তাঁর সাথে মিত্রতা গড়ে তুলতে চান, তাই না?’
জোকির দূরদর্শিতায় অভিভূত হলেন নাজি।
কথার ফাঁকে জোকি নিজের দেহের উষ্ণতায় নাজিকে কাছে নিয়ে এল। গায়ের সুগন্ধি, সোনালী চুল, মায়াবী চোখের চটুল চাহনী আর মুখের যাদুময়তায় নাজি ক্রমশ এলিয়ে দিচ্ছিল নিজেকে জোকির দিকে।
জোকির বুদ্ধিদীপ্ত কথায় নাজি তার সোনালী চুলের গোছা হাতে নিয়ে নাড়তে নাড়তে বললেন— ‘হ্যাঁ জোকি! আমি তার সাথে দোস্তি করতে চাই। তবে সে দোস্তি হবে আমার আনুগত্য ও মর্যাদার ভিত্তিতে। আমি চাই সেও আমার পানের আসরের একজন অতিথি হোক।’
‘এর জন্য আমাকে কী করতে হবে বলুন।’
নাজি একটু ভাবলেন। বললেন, ‘বলছি তোমাকে কী করতে হবে। তবে তার আগেই তোমাকে সতর্ক করে দিচ্ছি যে, সালাহুদ্দীন আইউবীর কথায় রয়েছে আমার চেয়েও বেশী যাদু। তোমার ভাষা, সৌন্দর্য, চালাকীর যাদু যদি কার্যকর না হয়, তবে তোমাকে জীবন্ত রাখা হবে না। সালাহুদ্দীন আইউবীও তোমাকে রক্ষা করতে পারবে না। আর আমাকে ফাঁকি দিয়েও তুমি রক্ষা পাবে না। এ জন্যই আমি তোমাকে সব খোলাখুলি বলছি। অন্যথায় তোমার মত একটি বাজারী মেয়ের সাথে আমার ন্যায় একজন সেনা অধিনায়ক প্রথম সাক্ষাতেই এত কথা কখনও বলে না।’
‘ভবিষ্যতই বলবে কার কথা ঠিক থাকে। আপনি আমাকে শুধু এতটুক বলে দিন, সালাহুদ্দীন আইউবী পর্যন্ত আমি কিভাবে পৌঁছবো?’ বলল জোকি।
‘আমি তাঁর সম্মানে একটি সংবর্ধনা সভার আয়োজন করছি। সেটি হবে রাতের বেলায়। খুবই আড়ম্বরপূর্ণ। ওই রাতে তাঁকে অনুষ্ঠান স্থলে একটি তাঁবুতে রাখব। তোমাকে সেই তাঁবুতে ঢুকিয়ে দেব। শুধু এতটুকু কাজের জন্যই আমি তোমাকে আনিয়েছি।’
‘ঠিক আছে। বাকি পরিকল্পনা আমিই ঠিক করে নেব।’
* * *
চক্রান্তের জাল বুনতেই শেষ হল রাত। রাতের চাদর ভেদ করে বেরিয়ে এল দিন। আবার রাত। সমতালে চলল দেশপ্রেম আর দেশদ্রোহীতার বিপরীতমুখী স্রোতের ধারা। এক দিকে আলী ও সালাহুদ্দীন। অপরদিকে নাজি ও তার সহযোগীরা। এভাবে পেরিয়ে গেল আরও কয়েক রাত। সালাহুদ্দীন আইউবী প্রশাসনিক কাজে বেজায় ব্যস্ত। নতুন সৈন্য রিক্রুটমেন্টের ঝামেলায় নাজির সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগদানের অবসর পাচ্ছেন না তিনি।
ইত্যবসরে নাজি সম্পর্কে আলী যে রিপোর্ট দিলেন, তা শুনে সালাহুদ্দীনের মনে দেখা দিল গম্ভীর হতাশা। বললেন— ‘তার মানে কি তুমি বলতে চাচ্ছ, এ লোকটি খৃষ্টানদের চেয়েও খতরনাক?’
‘নাজি খেলাফতের আস্তিনে একটি কেউটে সাপ।’ নাজির দীর্ঘ দুষ্কর্মের ফিরিস্তি শুনিয়ে আলী বললেন। নাজি কিভাবে খেলাফতের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা ও ব্যক্তিদের চক্রান্তের জালে আটকিয়ে নিঃশেষ করছে এবং অন্যদের তার নির্দেশ মান্য ও আনুগত্য করতে বাধ্য করছে তাও জানালেন। বললেন, ‘তার নিয়ন্ত্রিত সুদানী বাহিনীর সিপাইরা আপনার কমাণ্ড অমান্য করে তার কথা শুনবে তাতে সন্দেহ নেই। আপনি এ ব্যাপারে কী চিন্তা-ভাবনা করেছেন মাননীয় আমীর?’
‘শুধু চিন্তায় করিনি, কাজও শুরু করে দিয়েছি।’ বললেন সালাহুদ্দীন।
‘নতুন রিক্রুটমেন্টদের সুদানী সৈন্যদের সাথে মিশিয়ে দেব। যার ফলে এরা না হবে সুদানী, না হবে মিসরী। নাজির একক আধিপত্য ও ক্ষমতা আমি খর্ব করে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। এটি সমাপ্ত হলেই তাকে তার উপযুক্ত জায়গায় সরিয়ে আনব।
‘আমি বিভিন্ন সূত্রে নিশ্চিত হয়েছি যে, নাজি খৃষ্টানদের সাথেও গাঁটছড়া বেঁধেছে। আপনি যে সময়টায় জীবনের তোয়াক্কা না করে ইসলামী খেলাফতের শক্তিবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধির চেষ্টা করছেন, ঠিক তখন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আপনার এ প্রচেষ্টাকে বানচাল করার চক্রান্ত করছে নাজি।’ বললেন আলী বিন সুফিয়ান।
‘এ ব্যাপারে তুমি কী করছ?’
‘প্রতিরোধ কৌশলের ব্যাপারটি আমার উপরে ছেড়ে দিন। আমার কাজের অগ্রগতি, সমস্যা ও সম্ভাবনা আমি যথাসময়েই আপনাকে অবহিত করব। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। আমি নাজির চার পার্শ্বে গোয়েন্দাজাল বিছিয়ে দিয়েছি। ওর চলাচলের পথ ও অবস্থানে এমন দেওয়াল তৈরী করে রেখেছি, যে শুনতেও পায়, অনুধাবন করতে পারে। প্রয়োজনে প্রতিরোধ ব্যবস্থাও গ্রহণ করবে। আমার গোয়েন্দাদের ব্যারিকেডের বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা নাজির নেই।’
আলী বিন সুফিয়ান সালাহুদ্দীন আইউবীর বিশ্বস্ত ব্যক্তি। শুধু বিশ্বস্তই নন, আলীর কর্ম দক্ষতার উপরও সালাহুদ্দীনের আস্থা অপরিসীম। তাই তাঁর পরিকল্পনার বিস্তারিত কিছু জানার প্রয়োজন বোধ করেননি সালাহুদ্দীন।
আলী বললেন— ‘আমি জানতে পেরেছি, নাজি আপনাকে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্যে উৎসাহিত করছে। এ তথ্য সঠিক হলে, আমি না বলা পর্যন্ত আপনি তার সংবর্ধনা সভায় যাবেন না। এটা আমার অনুরোধ।’
উঠে দাঁড়ালেন সালাহুদ্দীন। দু হাত পিছনে বেঁধে মেঝেতে পায়চারী করতে লাগলেন। পায়চারী করতে করতে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তার কণ্ঠচিরে। হঠাৎ দৃঢ়পদে দাঁড়িয়ে আলীর উদ্দেশে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন—
‘আলী! জীবন-মৃত্যু আল্লাহর হাতে। উদ্দেশ্যহীন বেঁচে থাকার চেয়ে জন্মকালেই মরে যাওয়া অনেক ভাল। আমার মাঝে মধ্যে মনে হয়, জাতির ঐসব লোকই ভাগ্যবান, সুখী, যাদের মধ্যে কোন জাতীয় চিন্তা নেই। তাদের কওমের ইজ্জত-সম্মান, ইসলাম ও মুসলিমের অবনতি-উন্নতি নিয়ে কোন উদ্বেগ নেই, মাথা ব্যথা নেই। বড় আরামে তাদের জীবন কাটে। আয়েশের ঘাটতি হয় না তাদের জীবনে।’
‘ওরা হতভাগ্য সম্মানিত আমীর!’
‘হ্যাঁ, আলী! ওদের নির্বিকার জীবন দেখে যখন আমার মধ্যে এসব চিন্তা ভর করে, তখন কে যেন আমার কানে কানে তোমার কথাটিই বলে দেয়। আমার ভয় হয় আলী! আমরা যদি মুসলিম মিল্লাতের অধঃপতনের ধারা ঠেকাতে না পারি, তবে অদূর ভবিষ্যতে মুসলিম জাতি মরু-বিয়াবান আর পাহাড়-জঙ্গলে মাথা কুটে মরবে।
মিল্লাত আজ শতধাবিচ্ছিন্ন। খেলাফত তিন ভাগে বিভক্ত।
আমীররা নিজেদের খেয়াল-খুশী মত দেশ শাসন করছে। খৃষ্টানদের কাছে বন্ধক দিয়ে দিয়েছে মিল্লাতের মর্যাদা। ওদের ক্রীড়নকে পরিণত হয়ে রয়েছে তারা। আমার ভয় হয়, এ ধারা অব্যাহত থাকলে খৃষ্টানদের গোলামে পরিণত হবে সমগ্র জাতি। ওদের হুকুমবরদার হয়ে বেঁচে থাকতে হবে আমাদের ভবিষ্যত বংশধরকে। এই অবস্থায় আমাদের কওম জীবিত থাকলেও পরিণত হবে অনুভূতিহীন এক মানবগোষ্ঠীতে।
আলী! বিগত পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসের দিকে চেয়ে দেখ। আমাদের শাসকদের অবস্থা কী করুণ হয়েছে!’
সালাহুদ্দীন নীরব হয়ে গেলেন। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় কণ্ঠ তাঁর ভারী হয়ে এল। ঘরময় পায়চারী করতে লাগলেন তিনি।
নীচের দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে পায়চারী করলেন কিছুক্ষণ। দাঁড়ালেন মাথা সোজা করে আলীর দিকে তাকিয়ে বললেন—
‘কোন জাতির ধ্বংস উপকরণ যখন জাতির ভেতর থেকেই উত্থিত হয়, তখন আর তাদের ধ্বংস রোখা যায় না আলী! আমাদের খেলাফতের আমীর-উমরার নৈতিক অধঃপতন যদি রোধ করা না যায়, তবে খৃষ্টানদের আর আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে না। পারস্পরিক সংঘাত, বিদ্বেষ, লোভ আর হিংসার যে আগুন আমরা নিজেদের মধ্যে প্রজ্বলিত করেছি, ঈমান ও জাতির মর্যাদা ও কর্তব্যকে ভুলে আত্মঘাতী যে সংঘাতে আমরা লিপ্ত হয়েছি, খৃষ্টানরা তাতে ঘি ঢালবে শুধু। আমরা ওদের চক্রান্তে নিজেদের আগুনেই ধ্বংস হয়ে যাব। জাতির শেষ রক্তবিন্দুটুকু পর্যন্ত আমাদের আত্মঘাতী সংঘাতেই ব্যয়িত হবে।
জানি না, আমি আমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারবো কি-না। হয়ত খৃষ্টানদের কাছে আমার পরাজয়বরণ করতে হবে। আমি কওমকে এ কথাটাই জানিয়ে ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক করে দিতে চাই শুধু কাফেরের সাথে মুসলমানদের সখ্য হতে পারে না। বেঈমানদের সাথে ঈমানদারদের বন্ধুত্ব হতে পারে না। খৃষ্টানদের সাথে মুসলমানদের সমঝোতা হতে পারে না। ওদের শুধু বিরোধিতা নয়—কঠোরভাবে দমন করাই মুসলমানদের কর্তব্য। এতে যদি যুদ্ধ করে জীবনও দিতে হয়, তাতে আমার কোন দুঃখ নেই।’
‘আপনার মধ্যে হতাশা ভর করেছে মাননীয় আমীর! কথা থেকেই বোঝা যায়, আপনি নিজের সংকল্পে সন্দিহান।’ বললেন আলী বিন সুফিয়ান।
‘হতাশা আমাকে ভর করেনি আলী! নিরাশা আমাকে কখনও কাবু করতে পারে না। আমি আমৃত্যু কর্তব্য পালনে সামান্যতম ত্রুটি করব না।’ বললেন সালাহুদ্দীন।
ফের আলীর দিকে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে সালাহুদ্দীন বললেন— ‘সৈন্যভর্তির কাজটি বেগবান করে এমন সব লোকদের সেনাবাহিনীতে ভর্তি করবে, যাদের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা রয়েছে।
আর জরুরী ভিত্তিতে তুমি একটি শক্তিশালী গোয়েন্দা ইউনিট গড়ে তোল। তারা গোয়েন্দাগীরির পাশাপাশি শত্রু এলাকায় রাতে গুপ্ত হামলা চালাবে। তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবে, যাতে মরুভূমির উটের মত দীর্ঘসময় ক্ষুধা-পিপাসা সহ্য করার ক্ষমতা অর্জন করতে পারে। এই ইউনিটের সদস্যরা হবে বাঘের চেয়ে ক্ষিপ্র, বাজের মত তীক্ষ্ণদৃষ্টিসম্পন্ন, হরিণের মত সতর্ক আর সিংহের মত সাহসী। মদের প্রতি তাদের কোন আকর্ষণ থাকবে না। নারীর প্রতি হবে নিরাসক্ত। সর্বোপরি ঈমানদার, নিষ্ঠাবান মুসলমানদেরকে এই স্কোয়াডে প্রাধান্য দিবে।
আলী! এ কাজটি তুমি খুব তাড়াতাড়ি সমাধা করে ফেল। খেয়াল রাখবে, আমি সংখ্যাধিক্যে বিশ্বাসী নই। আমি চাই জানবাজ যোদ্ধা। অথর্বদের সংখ্যাধিক্য আমার দরকার নেই। আমি চাই এমন যোদ্ধা, যাদের মধ্যে আছে দেশপ্রেম, জাতিসত্ত্বার প্রতি যাদের আছে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার, যারা হবে সত্যনিষ্ঠ, কর্তব্যপরায়ণ—যারা আমার উদ্দেশ্য ও সংকল্পকে অনুধাবন ও ধারণ করতে সক্ষম। যারা কখনও এমন সংশয়াপন্ন হয় না যে, কেন আমাদের প্রাণঘাতি যুদ্ধে লিপ্ত করা হচ্ছে।
* * *
দশদিন চলে গেল। এই দশদিনে আমীরে মেসেরের সৈন্য বাহিনীতে দশ হাজারের বেশী অভিজ্ঞ যোদ্ধা ভর্তি হল।
অপরদিকে এ দশদিনে নাজি জোকিকে ট্রেনিং দিয়েছে, সালাহুদ্দীন আইউবীকে কিভাবে তার রূপের জালে ফাঁসাতে হবে।
জোকি ভেনাসের মত সুন্দরী। নাজির যে সহকর্মীই জোকিকে দেখেছে, সে, মন্তব্য করেছে, মিসরের ফেরাউন জোকিকে দেখলে তাকে পাওয়ার জন্যে সে খোদা দাবির কথা ভুলে যেত।
নাজির নিজস্ব গোয়েন্দা বাহিনী চক্রান্ত বাস্তবায়নে তৎপর। শক্তি, সামর্থ ও যোগ্যতার বিচারে এরা অসাধারণ।
নাজি প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলেন, আলী বিন সুফিয়ান সালাহুদ্দীনের প্রধান উপদেষ্টা। একজন চৌকস আরব গোয়েন্দার মতই মনে হয় আলীকে। আলীর সহযোগিতা থাকলে সালাহুদ্দীনকে ঘায়েল করা কঠিন হবে বুঝে নাজি আগে তার গোয়েন্দা বাহিনীকে আলীর পিছনে নিয়োগ করলেন। তিনি গোয়েন্দাদের নির্দেশ দেন, আলীর গতিবিধির প্রতি লক্ষ্য রাখবে এবং সুযোগ পেলেই তাকে হত্যা করবে।
সালাহুদ্দীন আইউবীকে ফাঁসানোর জন্যে জোকিকে প্রস্তুত করছিলেন নাজি। অথচ মরক্কোর এই স্বর্ণকেশীর সোনালী চুলে বাঁধা পড়লেন তিনি নিজে। নাজি বিন্দুমাত্র টের পেলেন না, জোকির মুক্তাঝরা হাসি, অনুপম বাচনভঙ্গি আর নাচ-গানের ফাঁদে বাঁধা পড়ে গেছেন তিনি নিজেই।
জোকি নাজিকে এততাই আসক্ত করে ফেলল যে, চক্রান্তের প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময় সে মেয়েটিকে নিজের কোলে বসিয়ে রাখত। নাজিরই দেওয়া পোশাক, সুগন্ধি আর প্রসাধনী ব্যবহার করে জোকি তাকে বেঁধে ফেলল। ফেঁসে গেলেন নাজী তার রূপ-যৌবনের মাদকতায়, যাদুকরী চাহনী আর দেহের উষ্ণতায়।
এ কয়দিনে নাজি ভুলে গেলেন তার একান্ত প্রমোদ সঙ্গিনীদের, যাদের নাচ-গান আর শরীরের উষ্ণতা ছিল তার একান্ত চাওয়া-পাওয়া। চার-পাঁচ দিন চলে গেল। একবারের জন্যও তিনি সেবিকাদের একান্তে খাস কামরায় ডাকলেন না। এ কয়দিন সারাক্ষণ জোকিকে নিয়েই ব্যস্ত থাকেন নাজি।
এই নর্তকী—সেবিকা—রক্ষিতাদের কাছে নাজি পরম আরাধ্য। এদের কাছে নাজির সান্নিধ্য ছিল নারীত্বের বিনিময়ে দীর্ঘ ত্যাগের পরম পাওয়া। মুহূর্তের জন্যে তার সান্নিধ্য হাতছাড়া করা ছিল এদের জন্যে মৃত্যুসম যন্ত্রণা।
জোকির আগমনে নাজির এ পরিবর্তন সহ্য করতে পারল না দুই নর্তকী-রক্ষিতা। মেয়েটাকে হত্যা করে পথের কাটা সরিয়ে দেওয়ার ফন্দি করল ওরা। কিন্তু কাজটি সহজ নয় মোটেই।
জোকির ঘরের বাইরে সার্বক্ষণিক দুই কাফ্রীকে পাহারাদার নিযুক্ত করলেন নাজি। জোকি ঘর থেকে বের হত না তেমন। অনুমতি নেই নতর্কীদেরও ঘরের বাইরে যাওয়ার। বহু চিন্তা-ভাবনা করে ওরা হেরেমের এক দাসীকে প্ররোচিত করার সিদ্ধান্ত নিল।
দুজন ঠিক করল, দাসীর মাধ্যমে খাবারে বিষ মিশিয়ে হত্যা করবে জোকিকে।
* * *
আলী বিন সুফিয়ান মিসরের পুরাতন আমীরের দেহরক্ষী বাহিনী বদল করে সালাহুদ্দীনের দেহরক্ষী বাহিনীতে নতুন লোক নিয়োগ করলেন। এরা সবাই আলীর নতুন রিক্রুটকরা সৈন্য। যোগ্যতার বিচারে এরা অদ্বিতীয়। আদর্শের প্রতি নিষ্ঠাবান—বিশ্বস্ত আর সাহস ও বীরত্বে সকলের সেরা।
নিজের গড়া গার্ড বাহিনীর পরিবর্তন মেনে নিতে পারলেন না নাজি। কিন্তু প্রকাশ্যে বিন্দুমাত্র ক্ষোভ দেখালেন না তিনি। উল্টো গার্ড বাহিনীর পরিবর্তনের সিদ্ধান্তকে মোসাহেবী কথায় ভূয়সী প্রশংসা করলেন। এরই ফাঁকে বিনয়ের সাথে আবার সালাহুদ্দীনকে সংবর্ধনায় যোগদানের কথাটি স্মরণ করিয়ে দিলেন।
সালাহুদ্দীন নাজির দাওয়াত গ্রহণ করলেন। বললেন, ‘দু-একদিনের মধ্যে জানাব আমার পক্ষে কোন্দিন অনুষ্ঠানে যাওয়া সম্ভব হবে।’ মনে মনে কূটচালের সফলতায় উল্লসিত হয়ে তাড়াতাড়ি চলে গেলেন নাজি।
নাজি চলে যাওয়ার পর সালাহুদ্দীন আলী বিন সুফিয়ানের সাথে পরামর্শ করলেন। জানতে চাইলেন কোন্ দিন নাজির অনুষ্ঠানে যাওয়া যায়।
‘এখন যে কোন দিন আপনি অনুষ্ঠানে যেতে পারেন। আমার আয়োজন সম্পন্ন।’ বললেন আলী বিন সুফিয়ান।
পরদিন নাজি দফতরে এলেই সালাহুদ্দীন জানালেন, ‘যে কোন রাতেই আপনার অনুষ্ঠানে যাওয়া যেতে পারে।’
নাজি অনুষ্ঠানের সময় নির্ধারণ করলেন। সালাহুদ্দীনকে ধারণা দিলেন, অনুষ্ঠানটি হবে জমকালো, অতিশয় আড়ম্বরপূর্ণ। শহর থেকে দূরে। মরুভূমিতে। উপস্থিত হবে বিশিষ্ট নাগরিক ও সামরিক বাহিনীর সদস্যরা। সৈন্য বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট কুচকাওয়াজ ও নৈপুণ্য প্রদর্শন করবে। অন্ধকার রাতে মশালের আলোয় অনুষ্ঠিত হবে পুরো অনুষ্ঠান। বিভিন্ন তাঁবু থাকবে। সম্মানিত আমীরসহ সবারই রাত যাপনের ব্যবস্থা করা হবে অনুষ্ঠানস্থলে। রাতে সৈন্যরা একটু আমোদ-ফুর্তি, নাচ-গান করবে।
সালাহুদ্দীন অনুষ্ঠানসূচী শুনছিলেন নাজির মুখ থেকে। নাচ-গানের কথা শুনেও তিনি বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন না।
নাজি একটু সাহস সঞ্চয় করে বার কয়েক ঢোক গিলে বিনয়ী ভঙ্গিতে বললেন, ‘সেনাবাহিনীতে বহু অমুসলিম সদস্য আছে। তাছাড়া দুর্বল ঈমানের অধিকারী নওমুসলিমও আছে অনেক। তারা মহামান্য আমীরের সৌজন্যে সংবর্ধনা সভায় একটু প্রাণ খুলে ফুর্তি করতে আগ্রহী। এজন্য তারা ওই দিন মদপানের অনুমতি চায়। তারা এ বিশেষ দিনটিকে স্মরণীয় ও আনন্দময় করে রাখতে চায়।’
‘আপনি তাদের অধিনায়ক। আপনি প্রয়োজন বোধ করলে আমার অনুমতির প্রয়োজন কি?’ বললেন সালাহুদ্দীন।
‘আল্লাহ মহামান্য আমীরের মর্যাদা আরও বাড়িয়ে দিন।’ তোষামোদের সুরে বললেন নাজি। সামনে ঝুঁকে অনুগত গোলামের মত কুর্নিশের ভঙ্গিতে বললেন, ‘অধম কোন্ ছার! আপনি যা পছন্দ করেন না, তার অনুমতি চেয়ে………!’
‘আপনি ওদের জানিয়ে দিন, সংবর্ধনার রাতে হাঙ্গামা-বিশৃংখলা ছাড়া সামরিক নিয়ম মেনে তারা সবই করতে পারবে। মদপান করে কেউ যদি হাঙ্গামা বাঁধায়, তবে কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে।’ বললেন সালাহুদ্দীন।
নাজি কৌশলে মুহূর্ত মধ্যে ব্যারাকে এ খবর ছড়িয়ে দিলেন। সালাহুদ্দীন আইউবী নাজির সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের অনুমতি দিয়েছেন। শরাব-মদ, নাচ-গান সবকিছু চলবে সেখানে। সালাহুদ্দীন নিজেও সেখানে উপস্থিত থাকবেন। একথা শুনে সৈন্য বাহিনীতে হুলস্থুল পড়ে গেল। একজন আরেকজনের দিকে জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে তাকাতে লাগল। তাদের চোখে রাজ্যের বিস্ময়, এসব কী শুনছি আমরা! কেউ কেউ দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘এসব নাজির মিথ্যা প্রচার। নিজের ইমেজ বাড়ানোর জন্য তিনি ভূয়া প্রচারণা চালাচ্ছেন।’
কেউ আবার সাবধানে মন্তব্য করল, ‘নাজির যাদু সালাহুদ্দীনকে ঘায়েল করে ফেলেছে।’ সৈন্য বাহিনীতে যারা সালাহুদ্দীন আইউবীর ন্যায়-নিষ্ঠার প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তাদের মধ্যে কিছুটা হতাশা সৃষ্টি করলে এ সংবাদ।
অপরদিকে এ সংবাদ নাজির ভক্ত সেনা অফিসারদের হৃদয়-সমুদ্রে বয়ে আনল খুশির বন্যা। সালাহুদ্দীনের আগমনের পর থেকেই সেনাবাহিনীতে মদ-সুরা, নাচ-গান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এ ক’দিনে সেনাবাহিনীর মদ্যপ, লম্পট, প্রমোদবিলাসী অফিসারদের দিনগুলো কেটেছে খুব কষ্টে। যা এবার শুকনো হৃদয়-মন একটু ভিজিয়ে নেওয়ার ফুরসত পাওয়া যাবে। তারা এই ভেবে উৎফুল্ল যে, কিছুদিন পরে হয়ত আমীর নিজেও মদ-সুরায় অভ্যস্ত হয়ে যাবেন।
আলী বিন সুফিয়ান ছাড়া আর কেউ জানতেন না, সালাহুদ্দীন আইউবীর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মদপান ও নাচ-গানের এ অনুমতি দানের রহস্য কী।
* * *