বস্তুতপক্ষে মোহনলালের অসুস্থতাই সিরাজের পক্ষে মারাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যার ফলে ভাগ্যচক্রের কাঁটা নবাবের বিরুদ্ধে এবং ইংরেজ সমেত ষড়যন্ত্রকারীদের সপক্ষে ঘুরে যায়।মোহনলালের শত্রুরা তাঁকে বিষপ্রয়োগ করেছিল বলে সন্দেহ করা হয়।ইউসুফ আলি বলেছেন মোহনলাল ছিলেন সিরাজদৌল্লার সবচেয়ে বড় ভরসা এবং ডানহাত।1 জাঁ ল’ অবশ্য তাঁকে ‘সবচেয়ে বড় বজ্জাত’ বলে অভিহিত করেছেন, যদিও তার কারণ হয়তো তাঁর হতাশা যে মোহনলাল নবাবকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফরাসিদের সাহায্য করতে এবং মুর্শিদাবাদ থেকে তাঁর বিতাড়ন বন্ধ করতে রাজি করাননি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁকে স্বীকার করতে হয়েছে যে সিরাজদৌল্লা ওই সময় যে বিপদে পড়েছিলেন তার মোকাবিলা করার জন্য তাঁর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল মোহনলালকে। ল’ লিখছেন:2
মোহনলাল ছিলেন শেঠদের জাতশত্রু এবং তাঁদের সঙ্গে লড়াই করার পক্ষে সবচেয়ে সক্ষম ব্যক্তি। আমার ধারণা মোহনলাল সুস্থ থাকলে এই সওকাররা [জগৎশেঠরা] তাঁদের [বিপ্লবের] প্রকল্পে অত সহজে সফল হতে পারতেন না। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, কিছুদিন ধরে এবং এই সংকটের মুহূর্তে মোহনলাল সাংঘাতিক অসুস্থ…. খুব সম্ভবত তাঁকে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছে। এই দুর্ঘটনায় সিরাজদৌল্লা তাঁর একমাত্র ভরসা থেকে বঞ্চিত হলেন।
ততদিনে ষড়যন্ত্র পাকা হতে চলেছে এবং ওয়াটস মুর্শিদাবাদ থেকে পালাবার ফন্দি করছিলেন। ১২ জুন যখন ওয়াটস মুর্শিদাবাদ থেকে পালান, তখনই নবাব প্রমাদ গুনলেন এবং ইংরেজদের আসল মতলব সম্বন্ধে নিশ্চিত হন। ১৩ জুন ক্লাইভ নবাবকে তাঁর শেষ সতর্কবাণী জানিয়ে দিলেন। তার জবাবে সিরাজদৌল্লা লিখলেন:3
ওয়াটসের পলায়ন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও প্রতারণামূলক আচরণ। [আলিনগরের] সন্ধি বানচাল করার জন্যই এটা করা হয়েছে। আপনার অনুমতি ও নির্দেশ ছাড়া ওয়াটস নিশ্চয় এরকম করতেন না। এরকম কিছু যে ঘটতে পারে তা আন্দাজ করেই আমি পলাশি থেকে আমার সৈন্যবাহিনী সরিয়ে আনিনি। কারণ আমি সন্দেহ করেছিলাম আপনারা এরকম কোনও ফন্দি করছেন। আল্লাকে ধন্যবাদ যে আমার দিক থেকে চুক্তিভঙ্গ করা হয়নি।
সিরাজদৌল্লা এখন পাগলের মতো জাঁ ল’-কে চিঠি লিখলেন, তাঁকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সাহায্য করার জন্য মুর্শিদাবাদ ফিরে আসতে। এ সময় প্রচণ্ড গুজব যে ব্যুসি (Bussy) বাংলার দিকে আসছেন। ইংরেজদের তখনও ভয় ছিল যে ফরাসিরা নবাবকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসতে পারে।আর নবাবের কাছে তা ছিল একমাত্র আশাভরসা। নবাবের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন অমাত্য আবার তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করল মীরজাফরকে বন্দি করে রাখতে, কিন্তু সম্ভবত এই সংকটময় মুহূর্তে তাঁর সৈন্যবাহিনীর মধ্যে বিভাজন এড়াবার জন্য সিরাজ আবারও মীরজাফরকে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করলেন। মীরজাফর তাঁর আস্থাভাজন ওমর বেগকে ১৯ জুন লেখা একটি চিঠিতে নবাব তাঁকে কীভাবে তোয়াজ করছেন তা সবিস্তারে জানালেন:4
ওয়াটসের [পালানোর] খবর সোমবার সকালে জানাজানি হয়ে যায়। এতে নবাব বেশ বিচলিত হয়ে পড়েন। আমাকে খুশি করা একান্ত প্রয়োজন মনে করে তিনি নিজেই আমার কাছে আসেন।বৃহস্পতিবার বিকেলে হুগলি থেকে চিঠি এসেছে যে তারা [ইংরেজরা] তাদের অভিযান [পলাশি অভিমুখে] শুরু করেছে। নবাব চাইলেন আমি যেন তাঁর সঙ্গে থাকি। তিনটে শর্তে আমি রাজি হলাম।প্রথম, আমি তাঁর সৈন্যবাহিনীতে কাজ করব না; দ্বিতীয়, আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাব না আর শেষ শর্ত, আমি তাঁর সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেব না। আমি তাঁকে খবর পাঠালাম তিনি যদি এ-সব শর্তে রাজি থাকেন তা হলে তাঁর সঙ্গে যেতে আমি প্রস্তুত। যেহেতু আমাকে তাঁর প্রয়োজন ছিল, তিনি রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু আমি সব সেনাপতি ও গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধানের কাছ থেকে লিখিয়ে নিলাম যে ইংরেজদের পরাজিত করার পর আমি এবং আমার পরিবারের সকলে যেখানে যেতে চাই তারা আমাদের সেখানে যেতে দেবে।
সিরাজদৌল্লার পক্ষে অপমানজনক শর্ত সন্দেহ নেই কিন্তু ইংরেজদের বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ শক্তি প্রদর্শনের আশায় তিনি সব মেনে নিলেন। কিন্তু সব বিফলে গেল কারণ ক’দিনের মধ্যেই মীরজাফর নবাবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলেন। পলাশির রঙ্গমঞ্চ অবশেষে তৈরি হয়ে গেল। ষড়যন্ত্র এখন পাকা। ওয়াটস ও স্ক্র্যাফ্টন ষড়যন্ত্র সফল করতে আপ্রাণ করেছেন। মীরজাফরের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়ে গেছে, শীলমোহর দিয়ে তা ইংরেজদের হাতে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ষড়যন্ত্রের পুরো খসড়া তৈরি এবং সব আয়োজন সমাপ্ত।পলাশির যুদ্ধ অবধারিত হয়ে গেল—পলাশি অভিমুখে যাত্রার আর কোনও পিছুটান রইল না।
নবাবও তাঁর সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হবার জন্য যাত্রা শুরু করলেন। তাঁর সৈন্যবাহিনীর সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন অনুমান আছে—স্ক্র্যাফ্টনের মতে তার সংখ্যা ৭০,০০০, ক্লাইভ ও আয়ার কুটের অনুমান ৬০,০০০ আর ওয়াটসের মতে ৩৫-৪০,০০০৷ তবে কাশিমবাজারের ডাচ কর্মচারী ভেরনেটের (Vernet) অনুমান যে, নবাবের বাহিনীতে প্রকৃত যোদ্ধার (vanguard) সংখ্যা ছিল ১৫,০০০ এবং এটাই অনেকটা সঠিক অনুমান বলে মনে হয়।5 নবাবের গোলন্দাজ বাহিনীতে সাঁ ফ্রে-র নেতৃত্বে ৪০-৫০ জনের মতো ফরাসিও ছিল। কামানের সংখ্যা ৪০টির মতো। ইংরেজদের ফৌজে ছিল এক হাজার ইউরোপীয়, দু’হাজার সেপাই, ৫০জন নৌসেনা আর ৮টি কামান।6 যুদ্ধক্ষেত্রে মীরজাফর, রায় দুর্লভরাম ও ইয়ার লতিফ খানের নেতৃত্বে নবাবের সৈন্যবাহিনীর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ একেবারে পুতুলের মতো নিষ্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।নবাবের সৈন্যবাহিনীর অগ্রবর্তী অংশের নেতৃত্বে ছিলেন তাঁর অনুগত সেনাপতিরা—মোহনলাল, মীর মর্দান, খাজা আব্দুল হাদি এবং নবসিং হাজারী প্রভৃতি। সিয়র-এর লেখক গোলাম হোসেন লিখেছেন, মীরজাফর তাঁর অধীনস্থ সৈন্যবাহিনী নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন, একেবারে যেন দর্শক হয়ে, নিতান্ত মজা দেখতেই যেন যুদ্ধে আসা।7 আর রিয়াজ-এর লেখক বলছেন মীরজাফর তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে নবাবের মূল বাহিনীর বাঁদিকে দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন—নবাব তাঁকে বার বার তাঁর দিকে আসার জন্য অনুরোধ জানানো সত্ত্বেও একবিন্দু নড়লেন না।8
তা সত্ত্বেও পলাশির তথাকথিত যুদ্ধে হার-জিৎ আগে থেকেই নির্ধারিত হয়ে যায়নি, প্রথমে যথেষ্ট অনিশচয়তাই ছিল.২৩ জুন সকালে যখন নবাবের সৈন্যবাহিনী তাঁবু থেকে বেরিয়ে সারিবদ্ধভাবে মাঠে দাঁড়াল তা দেখে স্ক্র্যাফ্টন লিখেছেন:9
…when the Soubah’s army appeared marching from their fortified camp…and what with the number of elephants all covered with scarlet cloth and embroidery; then horses with their drawn swords glistering in the sun; their heavy cannon drawn by vast trains of oxen; and their standard flying, they made a most pompous and formidable appearance. And their disposition as well as the regular manner in which they formed, seemed to speak greater skill in war than we expected from them.
পলাশিতে নবাবের শিকারগৃহের ছাদ থেকে ক্লাইভ দৃশ্যটা দেখলেন।সকাল আটটায় (ক্লাইভের ভাষ্যে ছ’টায়) যুদ্ধ শুরু হল। কিছুক্ষণ পর ইংরেজদের দিকে নবাবের বাহিনীর এগিয়ে আসা দেখতে দেখতে ক্লাইভের ব্যাপারটা খুব আশাপ্রদ মনে হল না। তিনি ভাবলেন দিনের বেলা কোনও রকমে যুদ্ধ করে রাত্রে কলকাতা ফিরে যাবেন। এমন ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও সিরাজদৌল্লার দিক থেকে এখনও সব শেষ হয়ে যায়নি, তাঁর সঙ্গে এখনও বেশ কয়েকজন দক্ষ এবং অনুগত সেনাপতি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। মীর মর্দান, মোহনলাল, খাজা আব্দুল হাদি খান, নবসিং হাজারী প্রভৃতির নেতৃত্বে নবাবি সৈন্য ইংরেজদের সঙ্গে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে চলেছিল। সাঁ ফ্রে-র অধীনে গোলন্দাজ বাহিনীও ইংরেজদের ওপর ক্রমাগত গোলাবর্ষণ করে চলেছিল। ক্লাইভ নিজে স্বীকার করেছেন: ‘[আম্রকুঞ্জে] আমাদের সুবিধেজনক অবস্থান আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে,’ ‘তাদের [নবাবের গোলন্দাজদের] কামান স্তব্ধ করে দেওয়া আমাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।’ তাই ইংরেজরা চুপ করে তাদের জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে রাত্রে শত্রুদের তাঁবু আক্রমণ করার অপেক্ষায় ছিল।10
নবাবের গোলন্দাজ বাহিনীর আক্রমণে আধ ঘণ্টার মধ্যে ইংরেজ ফৌজের ১০ জন ইউরোপীয় ও ২০ জন সেপাই মারা গেল বা আহত হল। ইংরেজদের অপেক্ষাকৃত ছোট ফৌজের পক্ষে এ-ক্ষতি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তাই ক্লাইভ তাঁর সৈন্যদের আম্রকুঞ্জে আশ্রয় নিতে আদেশ দেন। নবাবের সৈন্যদের দিক থেকে এরকম প্রতিরোধ ক্লাইভ চিন্তাই করতে পারেননি। তিনি নাকি ষড়যন্ত্রকারীদের একজন প্রতিনিধিকে বলেছিলেন যে তাঁকে ধারণা দেওয়া হয়েছিল ‘নবাবের সৈন্যরা এবং তাদের সেনাপতিরা নবাবের ওপর সম্পূর্ণ বীতশ্রদ্ধ,’ তাই তারা বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ করবে না। কিন্তু এখন তিনি তো দেখছেন ‘সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র’।11 জন ডড (John Wood) নামে পলাশিতে যুদ্ধ করেছেন এমন এক ইংরেজ সৈনিক লিখেছেন যে সেদিন সারা সকাল ইংরেজদের অবস্থা ছিল হতাশাজনক এবং রাত না হওয়া পর্যন্ত কিছু করার কথা তারা চিন্তাই করছিল না।12 ইংরেজদের অবস্থা যে অত্যন্ত বিপজ্জনক ও খারাপ হয়ে পড়ে তা ওয়াটসের লেখা থেকেও স্পষ্ট: ‘নবাব বা তাঁর সেনাপতিদের মধ্যে কেউ যদি ইংরেজদের অবস্থাটা ভাল করে অনুধাবন করতে পারত তা হলে তারা নিশ্চিতভাবে ইংরেজদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত এবং ইংরেজ ফৌজকে সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত করতে পারত। তা হলে ক্লাইভকে [কলকাতা পালাবার জন্য] রাত্রের অন্ধকারের জন্য অপেক্ষা করতে হত। ক্লাইভ আসলে তাই ভেবে রেখেছিলেন।’13
চার ঘণ্টা ধরে যুদ্ধ চলার ও গোলা বিনিময়ের পরেও কিন্তু কোনও ফলাফল দেখা গেল না।তবে ইংরেজদের অবস্থা তখন মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। ফারসি ঐতিহাসিকদের ভাষ্য অনুযায়ী (এঁরা কিন্তু সিরাজের প্রতি মোটেই সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন না), তখন বেলা প্রায় তিনটে, নবাবের জয় প্রায় সুনিশ্চিত হয়ে এসেছে।14 তাঁর সৈন্যবাহিনীর দুই-তৃতীয়াংশ স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে যুদ্ধ দেখতে থাকলেও15 বাকি সৈন্যরা তাঁর অনুগত সেনাপতি মীর মর্দান, মোহনলাল ও অন্যান্যদের নেতৃত্বে বীরত্ব ও অসম সাহসের সঙ্গে পলাশির আম্রকুঞ্জে অবস্থানকারী ইংরেজফৌজের দিক এগোতে লাগল। ঠিক এই সময় হঠাৎ দুর্ভাগ্যবশত মীর মর্দান একটি গোলার আঘাতে গুরুতর আহত হয়ে পড়েন এবং তাঁকে নবাবের তাঁবুতে নিয়ে আসার পর তাঁর মৃত্যু হয়। এতেই যুদ্ধের মোড় একেবারে ঘুরে যায়। স্ক্র্যাফ্টন লিখেছেন: ‘আমাদের জয়ের একটি বিরাট কারণ যে আমাদের সৌভাগ্যক্রমে মীর মর্দান নিহত হন।’16 মীর মর্দানের এই আকস্মিক মৃত্যুতে সিরাজদৌল্লা দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে মীরজাফরকে ডেকে পাঠান এবং তাঁর রাজকীয় মুকুট মীরজাফরের পায়ে রেখে তাঁর কাছে নিজের প্রাণ ও সম্মান বাঁচাবার জন্য ব্যাকুল আকুতি জানান। মীরজাফর নবাবকে পরামর্শ দিলেন ওইদিনের মতো যুদ্ধ বন্ধ করে দিতে এবং পরের দিন সকালে তা শুরু করতে। খবরটা তিনি সঙ্গে সঙ্গে ক্লাইভকে জানিয়ে দিলেন। সিরাজদৌল্লা দিশেহারা হয়ে রায়দুর্লভকে ডেকে পাঠালেন—তিনিও একই পরামর্শ দিলেন।সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত ও দিশেহারা হয়ে তরুণ নবাব মোহনলাল এবং অন্যান্য অনুগত সেনাপতিদের—যেমন, খাজা আব্দুল হাদি খান, নবসিং হাজারী, মীর মহম্মদ কাজিম, রাজা মাণিকচাঁদ প্রভৃতি—যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসার নির্দেশ দিলেন। মীর মর্দানের মৃত্যুর পর মোহনলালই মূল বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। ওই সেনাপতিদের সকলেই কিন্তু প্রথমে সিরাজের নির্দেশ মানতে অস্বীকার করলেন, কারণ ওই সময় পিছু হঠে আসা অত্যন্ত বিপজ্জনক হবে এই যুক্তিতে। কিন্তু নবাবের বারংবার ব্যাকুল অনুরোধ উপেক্ষা করতে না পেরে তাঁরা শেষপর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হলেন।17 প্রায় সম-সাময়িক ঐতিহাসিক ইউসুফ আলি খান পলাশিতে কী ঘটেছিল তার সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন:18
সিরাজদৌল্লা মোহনলাল, খাজা আব্দুল হাদি খান, মীর মহম্মদ কাজিম এবং রাজা মাণিকচাঁদ—যাঁরা নিজের নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন—তাঁদের সবাইকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসতে নির্দেশ পাঠালেন। কিন্তু তাঁরা সবাই এরকম সময় পিছু হঠাটা যে অত্যন্ত বিপজ্জনক তা যতই বোঝাতে চেষ্টা করুন না কেন, সিরাজ তাঁদের কথায় কর্ণপাতও করলেন না। তাই বাধ্য হয়ে তাঁরা নবাবের সামনে হাজির হলেন।ওই সময় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তাঁদের ওভাবে চলে আসার নির্দেশ দেওয়ার জন্য মীর মহম্মদ কাজিম বেশ রূঢ় ভাষায় নবাবকে র্ভৎসনা করতেও দ্বিধা করেননি।
সিরাজদৌল্লার সৈন্যরা পেছন ফিরতেই ইংরেজরা তাদের ওপর নতুন করে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তারপরই নবাবের সৈন্যবাহিনী ছত্রখান হয়ে যায়। বিকেল পাঁচটার মধ্যেই পলাশির যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। পলাশি যুদ্ধের ইংরেজ সৈনিক জন উড যথার্থই মন্তব্য করেছেন: ‘Such was this great and decisive battle by which a kingdom was conquered without there ever having been a general assault.’19 ক্লাইভ সন্ধে ছ’টায় মীরজাফরের অভিনন্দনসূচক বার্তা পেলেন: ‘I congratulate you on executing your design.’20 লক্ষণীয় যে মীরজাফর তখনও কিন্তু বলছেন ‘আপনার [অর্থাৎ ইংরেজদের] পরিকল্পনা।’ ক্লাইভ দাউদপুর থেকে পরের দিনই (২৪ জুন) স্ক্র্যাফ্টন মারফত মীরজাফরকে চিঠি পাঠালেন: ‘I congratulate on the victory which is yours, not mine. I should be glad if you would join me with the utmost expedition. We propose marching tomorrow to complete the conquest…I hope to have the honour of proclaiming you Nabob’.21 মুর্শিদাবাদে ক্লাইভই মীরজাফরকে মসনদে বসিয়ে তাঁর মাথায় মুকুট পরিয়ে দিলেন।
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
- তারিখ-ই বাংগালা-ই-মহবৎজঙ্গী, পৃ. ১৩২।
- Law’s Memoir, Hill, III p. 190. করম আলি এবং ইউসুফ আলি দু’জনই জানিয়েছেন যে, মোহনলাল মারাত্মক এক দুরারোগ্য রোগে সাংঘাতিক অসুস্থ, মুজাফ্ফরনামা, পৃ. ৭০; তারিখ-ই-বাংগালা-ই-মহবৎজঙ্গী, পৃ. ১২৯।
- ক্লাইভকে সিরাজদৌল্লা, ১৫ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 411.
- ওমর বেগকে মীরজাফরের চিঠি, ১৯ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 416; মুজাফ্ফরনামা, পৃ. ৭৫।
- হুগলিতে ডাচ ডাইরেক্টর ও কাউন্সিলকে লেখা ভেরনেটের চিঠি, ২৪ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 426; Scrafton, Reflections, p. 92; সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভ, ২৪ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 427, 436. ক্লাইভ ফোর্ট সেন্ট জর্জের সিলেক্ট কমিটিকে, ২ জুলাই ১৭৫৭, Hill, II, p, 440; সিক্রেট কমিটিকে ক্লাইভ, ২৬ জুলাই ১৭৫৭, Hill, II, p. 457; তাঁর পিতাকে ক্লাইভ, ১৯ আগস্ট ১৭৫৭, Hill, III, p. 360; আয়ার কুটের জার্নাল, Hill, III, p. 56; Watts’ Memoirs, p. 109, ইউসুফ আলি (পৃ. ১৩২) বলছেন পদাতিক ও অশ্বারোহী মিলে নবাবের সৈন্যসংখ্যা ছিল ১০,০০০।
- সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৩০; ফোর্ট সেন্ট জর্জের সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভ, ২ জুলাই ১৭৫৭, Hill, II, p. 440; ক্লাইভ তাঁর পিতাকে, ১৯ আগস্ট ১৭৫৭, Hill, III, p. 360; Scrafton, Reflections, p. 92; Watts’ Memoirs, p. 109.
- সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৩১।
- রিয়াজ, পৃ. ৩৭৫; মুজাফ্ফরনামা, পৃ. ৭৫।
- Scrafton, Reflections, pp. 93-94.
- ফোর্ট সেন্ট জর্জের সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভ, ২ জুলাই ১৭৫৭, Hill, II, p. 440; লন্ডনের সিক্রেট কমিটিকে ক্লাইভ, ২৬ জুলাই ১৭৫৭, Hill, II, p. 457; Watts’ Memoirs, p. 110.
- সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৩১; Mark Bence-Jones, Clive, p. 140; Michael Edwardes, Battle of Plassey, pp. 144-45.
- Holden Furber and Kristof Glarnann, ‘Plassey’, p. 178.
- Watts’, Memoirs, p. 110.
- রিয়াজ, পৃ. ৩৭৫।
- সিয়র, পৃ. ২৩১; রিয়াজ, পৃ. ৩৭৫।
- Scrafton, Reflections, p. 110.
- তারিখ-ই-বাংগালা-ই-মহবৎজঙ্গী, পৃ. ১৩৩; সিয়র, পৃ. ২৩২-৩৪; রিয়াজ, পৃ. ৩৭৫; মুজাফ্ফরনামা, পৃ. ৭৫-৭৬।
- তারিখ-ই-বাংগালা-ই-মহবৎজঙ্গী, পৃ. ১৩৩।
- Holden Furber and Kristof Glamann, ‘Plassey’, p. 181.
- ক্লাইভকে মীরজাফরের চিঠি, ২৩ জুন ১৭৫৭, (ক্লাইভ পেলেন সন্ধে ছ’টায়), Orme Mss., India, XI, f. 2814.
- দাউদপুর থেকে স্ক্র্যাফ্টনের মারফত মীরজাফরকে ক্লাইভের চিঠি, ২৪ জুন ১৭৫৭, Orme Mss., India, XI, f. 2815.