সিরাজদ্দৌল্লার কাছ থেকে ল’ দ্বিতীয় পরোয়ানা পেলেন ৬ মে। এতে নবাব তাঁকে মুর্শিদাবাদ আসতে বারণ করে দিলেন। নির্দেশ দিলেন রাজমহলে গিয়ে অপেক্ষা করতে। এদিকে ফরাসি সূত্র থেকে কোনও খবর না পাওয়ায় ল’-র মন থেকে সন্দেহ দূর হল না। তাই তিনি পাটনার পথে মুঙ্গের যাওয়া সাব্যস্ত করলেন। তিনি মুঙ্গের পৌছুলেন ৭ মে। এখানেই তিনি মুর্শিদাবাদে কী ঘটছে তার বিস্তারিত খবর পেলেন। তিনি অবশ্য পরে বুঝতে পেরেছিলেন যে ইংরেজদের ব্যবহারে উত্ত্যক্ত হয়ে সিরাজ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন এবং স্থির করেছিলেন যে তাদের আর বরদাস্ত করা হবে না এবং ফরাসিদের ডেকে পাঠাতে হবে। এদিকে বিপ্লবের পাকাপোক্ত ব্যবস্থা যেহেতু তখনও কিছু হয়নি, তাই ইংরেজ ও শেঠরা স্থির করল যে আপাতত নবাবকে শান্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে।1 ওদিকে জঁ ল’ ৩ জুন পাটনা পৌঁছুলেন, সেখানে বিহারের নায়েব সুবা রাজা রামনারায়ণ তাঁকে আন্তরিকতার সঙ্গে অভ্যথনা করলেন। তিনি বেশ কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে ভাবলেন, তেমন নতুন বা আশঙ্কাজনক কিছু ঘটলে সিরাজদ্দৌল্লা নিশ্চয়ই তাঁকে বিশদ জানাবেন। তিনি পরে লিখেছেন, এদিকে ইংরেজরা নবাবকে সম্পূর্ণভাবে প্রতারিত করে তাঁর মধ্যে একটা মিথ্যা নিরাপত্তার ভাব সৃষ্টি করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেল। ইংরেজদের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্বন্ধে তখনও পর্যন্ত সিরাজের স্পষ্ট কোনও ধারণা ছিল না। কিন্তু ল’ জানাচ্ছেন—‘এই পুরো সময়টাতেই ইংরেজদের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান ছিল কীভাবে নবাবের সর্বনাশ করা যাবে এবং তাদের [বিপ্লবের] ‘বিরাট প্রকল্প’ সফলভাবে রূপায়িত হবে।’2 সিরাজদ্দৌল্লা ১০ জুন একটি চিঠিতে, যেটা ল’ পেলেন ১৯ জুন, ল’-কে নির্দেশ দিলেন তিনি যেন পাটনাতেই অবস্থান করেন এবং তাঁর সম্বন্ধে কোনওরকম চিন্তা না করেন।3 ২০ জুন ল’ পাটনাতে গুজব শুনলেন যে ইংরেজরা মুর্শিদাবাদ অভিমুখে অভিযান করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। তিনি ২২ জুনের চিঠিতে সিরাজদ্দৌল্লাকে অনুনয় করে লিখলেন, তাঁর আসা অবধি অপেক্ষা করতে, কারণ তাঁর ভয় হচ্ছিল যে নবাব তাঁর নিজের পক্ষে অসুবিধেজনক একটা সময়ে তাঁর ইংরেজ শত্রুদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে উদ্যোগ নেবেন।4 কার্যত তাই হল—২৩ জুনের মধ্যে সব শেষ। সিরাজদ্দৌল্লাকে সাহায্য করার জন্য ল’ আর মুর্শিদাবাদ পৌঁছে উঠতে পারলেন না।
সিরাজদ্দৌল্লার দৃঢ় সংকল্পের অভাব ও দোদুল্যমান মনোভাবের একটা অন্যতম কারণ ছিল, খুব সম্ভবত, আহমদ শা আবদালির নেতৃত্বে আফগান আক্রমণের আশু সম্ভাবনা। ১৭৫৭ সালের প্রথম দিক থেকেই এ আক্রমণের আশঙ্কা তাঁর কাছে এক বিরাট দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর মনে হয় তিনি ঠিক করে হোক বা ভুল করে তোক ভেবেছিলেন, ইংরেজদের চাইতে তখন আফগানরাই বড় বিপদ হিসেবে দেখা দিয়েছে। তাই তিনি ইংরেজদের আপাতত খুশি রাখতে একের পর এক সুযোগ সুবিধে দিয়ে যাচ্ছিলেন। এ পর্যন্ত ইংরেজদের প্রতি তাঁর আচরণ থেকে স্পষ্ট যে তাদের সঙ্গে প্রকাশ্য সংঘাত এড়িয়ে চলাই তাঁর লক্ষ্য ছিল। আবদালি দিল্লি ও তাঁর পার্শ্ববর্তী অঞ্চল লুঠতরাজ করে ৩ এপ্রিল দিল্লি থেকে বিদায় নিলেও আফগানদের বাংলা আক্রমণের আশঙ্কা আগের মতোই প্রবলই ছিল, কিছুমাত্র কমেনি। নবাবের সবচেয়ে দক্ষ সৈন্যবাহিনী রাজা রামনারায়ণের নেতৃত্বে আফগান আক্রমণ প্রতিহত করতে বিহার সীমান্তে পাঠানো হয়েছিল। এতে বাংলায় সিরাজের সৈন্যবাহিনী অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ে। নবাবি ফৌজের যে-অংশ মুর্শিদাবাদে ছিল তাঁর সেনাপতিদের মধ্যে অনেকেই নির্ভরযোগ্য ছিল না।5 সৌভাগ্যক্রমে এপ্রিলের শেষদিকে আফগান বাহিনী ভারতবর্ষ থেকে নিজেদের দেশে ফিরে যেতে শুরু করল। তখন সিরাজদ্দৌল্লা ক্লাইভকে লিখলেন যে, আফগান আক্রমণের আশঙ্কা যেহেতু বিলীন হয়ে গেছে সেজন্য ইংরেজদের সাহায্য তাঁর আর প্রয়োজন হবে না। তা ছাড়া আবদালির আক্রমণ থেকে রেহাই পাওয়ায় তিনি এখন অনেকটা নিশ্চিন্ত হলেন এবং বেশ কিছুটা সাহস পেয়ে তিনি ক্লাইভকে জানালেন তিনি যেন মুর্শিদাবাদ অভিমুখে তাঁর যাত্রা বন্ধ রাখেন কারণ এটা আলিনগরের সন্ধির পরিপন্থী এবং এতে ওই চুক্তিভঙ্গই করা হবে।6 একই সঙ্গে তিনি মীরজাফরকে পনেরো হাজার সৈন্য নিয়ে পলাশিতে রায় দুর্লভরামের সঙ্গে যোগ দিতে নির্দেশ দিলেন—দুর্লভরাম একমাস ধরে ওখানেই অবস্থান করছিলেন। মনে হয়, আফগান আক্রমণের বিপদ কেটে যাওয়ায় তরুণ নবাব তখন অনেকটা আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছেন এবং ইংরেজদের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য মনস্থির করে ফেলেছিলেন। ওয়াটস ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ক্লাইভকে ২৮ এপ্রিল লিখলেন: ‘নবাব [এখন] তুঙ্গে আছেন….আমি আপনাকে অনুরোধ করছি আপনার ফৌজকে এখন কলকাতা ফেরত পাঠান, শুধুমাত্র চন্দননগরে অল্পসংখ্যক সৈন্য রাখুন। এমন ভাব দেখান যে মাথা থেকে যুদ্ধের চিন্তা তাড়িয়ে দিয়েছেন, আপনার লোকজনদের এদিক ওদিক পাঠাবেন না—একেবারে চুপচাপ থাকুক।’7
আসলে ইংরেজরা বাংলায় রাজনৈতিক পালাবদল ঘটানোর জন্য অত্যুৎসাহে তাদের ষড়যন্ত্র চালিয়ে যেতে লাগল। সিলেক্ট কমিটির আলোচনায় বলা হল, ‘যেহেতু [দেশের] সবাই একটা রাজনৈতিক পরিবর্তন চাইছে, সেজন্য আমরা সাহায্য করি বা না করি, বিপ্লবের একটা প্রচেষ্টা হবেই এবং খুব সম্ভবত তা সফলও হবে। ’পলাশির ষড়যন্ত্রে ইংরেজদের ভূমিকার সমর্থনে কমিটি বলছে—‘এমন একটি ঘটনার অলস ও নির্বিকার দর্শক হয়ে থাকাটা রাজনীতিতে গুরুতর ভ্রান্তি হিসেবেই গণ্য হবে। অন্যদিকে যাকে মসনদে বসাবার পরিকল্পনা হচ্ছে তার মিত্র হিসেবে তার সাহায্যে এগিয়ে গেলে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের এবং আমাদের দেশবাসীর প্রভূত লাভেরই সম্ভাবনা।’8 তাই ইংরেজরা এখন সিরাজের প্রতি নরম মনোভাব দেখাতে শুরু করল এবং তাঁকে বেশ মিষ্ট ভাষায় চিঠি দিতে লাগল। পলাশির ষড়যন্ত্র তখনও পূর্ণরূপ না নেওয়ায় ক্লাইভও কিছুটা নরমভাব দেখাতে লাগলেন এবং কিছুটা পিছু হঠতে চাইলেন। তিনি সিরাজকে লিখলেন যে তাঁর অধিকাংশ ফৌজকে কলকাতায় ফেরত যেতে আদেশ দেওয়া হয়েছে এবং সব কামানগুলিও ওখানে পাঠানো হবে। তিনি কায়দা করে এটাও নবাবকে জানিয়ে দিলেন যে বিনিময়ে নবাবও পলাশি থেকে তাঁর সৈন্যবাহিনী সরিয়ে নেবেন, এটা তিনি চান।9 কিন্তু ততদিনে মিষ্টি কথায় ভোলার পর্যায় সিরাজ পেরিয়ে গেছেন—তাঁর সৈন্যবাহিনীকে পলাশি থেকে সরিয়ে নেবার কোনও চেষ্টাই তিনি করলেন না। এ সময়ই তিনি জাঁ ল’-কে মুর্শিদাবাদে ডেকে পাঠালেন। ল’ যদি ঠিক সময় পৌঁছুতে পারতেন তা হলে পলাশির যুদ্ধে ইংরেজরা আদৌ জয়ী হতে পারত কি না তাতে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে।
ইংরেজদের ভাগ্যক্রমে সিরাজদ্দৌল্লাকে প্রতারিত করার আরেকটি সুযোগ তাদের হাতে এসে যায়। এটা দিয়ে তারা নবাবকে তাদের আন্তরিকতার প্রমাণস্বরূপ নিদর্শন হিসেবে দেখিয়ে তাঁকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াস পেল। তারা ৯ বা ১০ মে নাগাদ মারাঠা পেশোয়া বালাজি রাও-এর কাছ থেকে মারাঠাদের সঙ্গে তাদের আঁতাতের প্রস্তাব নিয়ে একটি চিঠি পেল। বালাজি রাও প্রতিশ্রুতি দিলেন যে, এক লক্ষ কুড়ি, হাজার মারাঠি অশ্বারোহী সৈন্য নবাবের বিরুদ্ধে ইংরেজদের সঙ্গে যোগ দেবে এবং কলকাতায় ইংরেজদের যা ক্ষতি হয়েছে তার দ্বিগুণ ক্ষতিপূরণ তাদের দেওয়া হবে। ক্লাইভ প্রথমে ভাবলেন চিঠিটা জাল এবং এটা লিখে নবাব ইংরেজদের আসল উদ্দেশ্য যাচাই করতে চাইছেন। স্ক্র্যাফ্টন অবশ্য বলেছেন যে ক্লাইভ পত্রবাহকের সঙ্গে গোপনে একটা বৈঠক করেছিলেন।10 শেষপর্যন্ত ক্লাইভ এই চিঠিকে দুটো কাজে লাগাতে চাইলেন—প্রথম, ওয়াটসকে বললেন, মীরজাফরকে ব্যাপারটা সম্বন্ধে জানাতে। তা হলে হয়তো মারাঠা আক্রমণের ভয়ে মীরজাফরও বিপ্লব ত্বরান্বিত করতে বাধ্য হবেন। অন্যদিকে স্ক্র্যাফ্টনের মারফত চিঠিটা সিরাজদৌল্লাকে পাঠিয়ে দেওয়া যাতে নবাব ইংরেজদের আন্তরিকতা সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হন।11 মারাঠাদের চিঠিটি নিয়ে সিলেক্ট কমিটি যে সিদ্ধান্ত করল তা থেকে ইংরেজদের দ্বিচারিতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং এটাও পরিষ্কার হয়ে যায় যে, যে-কোনও উপায়ে সিরাজকে হঠাতে তারা বদ্ধপরিকর ছিল। কমিটির সিদ্ধান্ত:12
কমিটির সদস্যরা সবাই একমত যে মারাঠা শাসন পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে জঘন্য এবং সম্ভব হলে আমরা তা কখনও হতে দেব না। সেজন্যই আমরা মীরজাফরকে মসনদে বসাবার পরিকল্পনা সমর্থন করি, যদি তা কার্যে পরিণত করা যায়। কিন্তু এমনও হতে পারে যে আমাদের পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে এবং নবাবের সঙ্গে আবার আমরা যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে যেতে পারি। সেক্ষেত্রে মারাঠাদের সাহায্য দেশের [বাংলার] বিভিন্ন অঞ্চলে যে অরাজকতার সৃষ্টি করতে পারবে তা আমাদের পক্ষে অত্যন্ত সুবিধেজনক হবে। তাই ঠিক করা হল যে বাজিরাও’র সঙ্গে বন্ধুতাপূর্ণ যোগাযোগ রেখে চলাই শ্রেয়। সুতরাং তাঁর প্রস্তাব পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান বা তা সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ কোনওটাই করা হবে না।
লিউক স্ক্র্যাফ্টন বাজিরাও-এর চিঠি নিয়ে সিরাজদৌল্লার কাছে গেলেন। চিঠিটি সম্বন্ধে নবাবের প্রথমে সন্দেহ হয় কিন্তু স্ক্র্যাফ্টন বেশ চাতুর্যের সঙ্গে তাঁর সন্দেহ ভঞ্জন করতে সক্ষম হন। ফলে ইংরেজদের চালাকি বেশ সফল হল৷ সিরাজদৌল্লা ক্লাইভের ‘প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ফেটে পড়লেন,’ এবং এমনকী ঘোষণা করলেন যে তিনি পলাশি থেকে তাঁর সেনাপতিদের—রায়দুর্লভ, মীরজাফর ও মীর মর্দান— ফিরে আসার নির্দেশ দেবেন। নবাব অবশ্য প্রথমে বলেছিলেন যে শুধু মীরজাফরকে ফিরে আসার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। তাতে কিন্তু চক্রান্তকারীরা খুব বিপদে পড়ে যেত। তাই ওয়াটস ভাবছিলেন মীরজাফর যাতে পলাশি থেকে এক পা না নড়েন সে-সম্বন্ধে তাঁকে সাবধান করে দেওয়ার কথা। ইংরেজদের ভাগ্যক্রমে সিরাজদৌল্লা অচিরেই তাঁর মত পরিবর্তন করেন এবং তিন সেনাপতিকেই মুর্শিদাবাদে ফিরে আসতে নির্দেশ দেন।13 মীরজাফর ৩০ মে মুর্শিদাবাদে ফিরে এলেন।
ততদিনে ষড়যন্ত্রের কথা লোকে বলাবলি করতে শুরু করে দিয়েছে। সিরাজদৌল্লাও হয়তো কিছুটা আভাস পেয়েছিলেন। তাই তিনি মীরজাফরকে সরিয়ে খাজা আব্দুল হাদি খানকে বক্সির পদে নিযুক্ত করেন। মুজাফ্ফরনামা-র লেখক করম আলি মন্তব্য করেছেন যে ষড়যন্ত্রের কথা সিরাজকে জানানো সত্ত্বেও তিনি তা অগ্রাহ্য করে ‘ইন্দ্রিয় সুখের ভোগে’ লিপ্ত থাকলেন। তাঁর বিশ্বাসভাজন ও বিশেষ অনুগত ব্যক্তিরা, বিশেষ করে মীর মর্দান ও আব্দুল হাদি খান, তাঁর এহেন নিষ্ক্রিয়তায় অত্যন্ত ব্যথিত হলেন।14 এটা কিন্তু সঠিক বলে মনে হয় না। খুব সম্ভবত ষড়যন্ত্রের আভাস পেয়ে এবং ইংরেজদের সম্ভাব্য আক্রমণের আশঙ্কায় সিরাজদৌল্লা বিচলিত ও দিশেহারা হয়ে পড়েন। তাই হয়তো নবাব, যারা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে বলে সন্দেহ করছিলেন, তাদেরও সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করতে ভয় পাচ্ছিলেন। হয়তো তাঁর তখনও আশা ছিল যে ইংরেজরা আক্রমণ করলে সঙঘবদ্ধভাবে তার মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। সে-কারণে তিনি তাড়াতাড়ি মীরজাফর ও খাদিম হোসেন খানকে তাঁদের পুরনো পদে পুনর্বহাল করে তাঁদের সঙ্গে নতুন করে বোঝাপড়ার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁরা শপথ নিলেন যে নবাবের প্রতি তাঁরা বিশ্বস্ত থাকবেন।15
মীরজাফর ও তাঁর সঙ্গী অন্য চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে কোনও চরম ব্যবস্থা না নিয়ে সিরাজদৌল্লা যে সবচেয়ে বড় ভুল করেছিলেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। বস্তুতপক্ষে সিরাজের প্রতি অনুগত সেনাপতিরা মীরজাফরদের বিরুদ্ধে চরম ব্যবস্থা নেবার জন্য তাঁকে বারংবার অনুরোধ করেছিল। খাজা আব্দুল হাদি খান ও মীর মর্দান নাকি তাঁকে এই বলে সাবধান করেছিলেন যে, ‘ইংরেজদের কার্যকলাপ সহ্যের সব সীমা অতিক্রম করে গেছে। তারা এদেশ জয় করতে বদ্ধপরিকর….মীর মহম্মদ জাফর খান বিশ্বাসঘাতকতার আশ্রয় নিয়ে এই নবাবের বংশকে ধ্বংস করতে প্রস্তুত। সুতরাং প্রথমেই তাঁকে খতম করা উচিত। তা হলে পরে ইংরেজদের সঙ্গে মোকাবিলা করা সহজসাধ্য হবে।’16
খুবই সৎপরামর্শ সন্দেহ নেই। কিন্তু করম আলির ভাষ্য অনুযায়ী কয়েকজন ‘বিশ্বাসঘাতক’ মিলে সিরাজকে পরামর্শ দিল যে একটি বিশাল সৈন্যবাহিনী সমাবেশ করে ইংরেজদের সঙ্গে লড়াইয়ে জেতা প্রায় অসম্ভব—তাই তিনি মীরজাফর ও তাঁর সঙ্গীদের শাস্তি দেবার চিন্তা মাথা থেকে তাড়িয়ে দিয়ে তাদের সঙ্গে মিটমাট করে ফেলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু মীর মর্দান আবার তাঁকে সাবধান করে দিলেন এই বলে যে:17
বিপজ্জনক শত্রু সম্বন্ধে খুবই সতর্ক থাকা প্রয়োজন। এসময় ওই সব সরদারদের [সেনাপতিদের অর্থাৎ মীরজাফর ইত্যাদি] কাছ থেকে কোনও রকম সাহায্য প্রত্যাশা করা আমাদের পক্ষে অনুচিত। আমাদের প্রধান কর্তব্য হবে এদের শায়েস্তা করা। তা হলে সেই শুনেই ইংরেজরা পিছু হঠে যাবে। আমাদের তাঁবুতে ওই দু’জনের [মীরজাফর ও খাদিম হুসেন খান] উপস্থিতি আমাদের অনুগত সেনাপতিদের অস্বস্তি ও আশঙ্কার কারণ হবে। ওঁরা দু’জন বিশ্বাসঘাতকতা করবেনই।
সিরাজদৌল্লা কিন্তু এ-সবে কর্ণপাতই করলেন না। এমনকী স্ক্র্যাফ্টনও জোর দিয়ে বলছেন যে মীরজাফরের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিয়ে সিরাজদৌল্লা চরম ভুল করেছিলেন। শুধু তাই নয়। তিনি মন্তব্য করেছেন যে সিরাজ তাঁর নিজের দুর্বলতা সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন কিন্তু তার ঊর্ধ্বে উঠে এবং সবরকম ভয় কাটিয়ে মীরজাফরকে শায়েস্তা করতে সাহস করেননি। তার পরিবর্তে বদান্যতা ও ক্ষমা প্রদর্শনের সূক্ষ্ম আড়ালে তাঁকে ভোলাবার চেষ্টা করলেন এবং শপথ বাক্যের মাধ্যমে তা সুদৃঢ় করার প্রয়াস পেলেন।18 জাঁ ল’-ও বলছেন যে চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে চরম ব্যবস্থা না নিয়ে নবাব বিরাট ভুল করেছিলেন। তাঁর মতে মীরজাফর প্রতারণা করেছেন সিরাজদৌল্লা তাও বুঝতে পারেননি। তাঁর সঙ্গে একটা মিটমাট করে ফেললেন। মীরজাফর কোরাণ নিয়ে শপথ করলেন, তিনি নবাবের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবেন, আর সিরাজ তাতেই সন্তুষ্ট থাকলেন।19 ল’-র সঙ্গত প্রশ্ন, সিরাজদৌল্লা যখন মীরজাফর, জগৎশেঠ এবং অন্যান্যদের তাঁর প্রতি বিরুদ্ধতার কথা জানতেন তখন এঁদের পরিকল্পনার কথা কেন আগে থেকে আঁচ করতে পারেননি? উত্তরটা অবশ্য তিনি নিজেই দিয়েছেন:20
নবাবের এই অদ্ভুত আচরণের একমাত্র ব্যাখ্যা বোধহয় মোহনলালের অসুস্থতার ফলে তিনি একেবারে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন। কাকে বিশ্বাস করবেন তা বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তিনি তাঁর শত্রুদের বিশ্বাস করছেন এমন ভাব দেখাতে চাইলেন যদি এভাবে তাদের ছলনা করা যায়। এভাবে আপাতত তাদের ভুলিয়ে ভালিয়ে পরে সুযোগমতো তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া যাবে, সম্ভবত এটাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য।
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
- Law’s Memoir, Hill, III, p. 208.
- ঐ, পৃ. ২০৯-১০; জোর আমার দেওয়া।
- জাঁ ল’-র সন্দেহ যে ইংরেজরা নবাবের ওয়াকিয়ানবিশকে ঘুষ দিয়ে এই জাল চিঠি লিখিয়েছিল। Law’s Memoir, Hill, III, p. 210, fn.l.
- Law’s Memoir, Hill, III, pp. 210, 212.
- Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, pp. 116-17.
- ক্লাইভকে সিরাজদৌল্লা, ২৬ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 361.
- ক্লাইভকে ওয়াটস, ২৮ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 367.
- Select Committee Proceedings, 1 May 1757, Hill, II, p. 371.
- সিরাজদৌল্লাকে ক্লাইভ, ২ মে ১৭৫৭, Hill, II, P. 372; 4 May 1757, Hill, II, pp. 376-77.
- Scrafton, Reflections, pp. 84-85.
- ওয়াটসকে ক্লাইভ, ১১ মে ১৭৫৭, Hill, II, pp. 378-79; ১২ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 379; সিরাজকে ক্লাইভ, ১৪ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 380; ২০ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 390; ওয়াটসকে ক্লাইভ, ১৯ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 389; ওয়াটস ভেবেছিলেন যে চিঠিটা নবাবের একটা চালাকি, ক্লাইভকে ওয়াটস, ১৭ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 386.
- Select Committee Proceedings, Orme Mss., India V, f. 1223; O. V. 170, f. 238. জোর আমার দেওয়া।
- Scrafton, Reflections, pp. 85-86; সিরাজদৌল্লাকে ক্লাইভ, ২৫ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 394; ক্লাইভকে সিরাজদৌল্লা, ২৭ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 394.
- করম আলি, মুজাফ্ফরনামা, পৃ. ৯৮.
- রিয়াজ, পৃ. ৩৭৪; তারিখ-ই-বাংগালা-ই-মহবৎজঞ্জী, পৃ.১৩২; মুজাফ্ফরনামা, পৃ. ৭৪-৭৫; ওয়াটসকে ক্লাইভ, ৬ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 400; ক্লাইভকে ওয়াটস, ৮ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 401; ৯ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 403; ১১ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 403; Scrafton, Reflections, p p. 89,91-92.
- মুজাফ্ফরনামা, পৃ. ৭৪.
- ঐ, পৃ. ৭৪-৭৫.
- Scrafton, Reflections, pp. 91-92.
- Law’s Memoir, Hill, III, pp. 211-12.
- ঐ, পৃ. ১৯৪।