» » পলাশি অভিমুখে : ইংরেজ পরিকল্পনা

বর্ণাকার

কমিটির এই চাতুর্যপূর্ণ চিঠি ক্লাইভের কাছে পৌঁছয় ২৭ জুন। ততদিনে যুদ্ধ শেষ, ক্লাইভ বিজয়ী বীর। তিনি ওই চিঠির উত্তর দিলেন রীতিমতো ব্যঙ্গ করে— ‘আপনাদের চিঠির বক্তব্য এমন অসঙ্গতিপূর্ণ ও পরস্পরবিরোধী যে আমার মনে হয় এটা লেখার আসল উদ্দেশ্য, যদি আমার অভিযান ব্যর্থ হয়, তা হলে তার জন্য আপনারা আমার ওপর সম্পূর্ণ দোষ চাপিয়ে নিজেরা বেঁচে যাবেন।’1 এর মধ্যে ক্লাইভ খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে ২১ জুন যুদ্ধবিষয়ক কাউন্সিলের একটি মিটিং ডাকলেন। সিলেক্ট কমিটিকে লেখা একটি চিঠিতে ক্লাইভ এই মিটিং ডাকার কারণ হিসেবে লিখেছেন যে, কোনও দেশীয় শক্তির সাহায্য ছাড়াই নবাবকে আক্রমণ করা ঠিক হবে কি না বা মীরজাফরের কাছ থেকে সাহায্যের সঠিক প্রতিশ্রুতি না পাওয়া পর্যন্ত এগুনো উচিত হবে কি না এ-সব বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্ত নেবার জন্য।2 আয়ার কুট (Eyre Coote) কাউন্সিলের আলোচ্য বিষয় জানাচ্ছেন:3

কর্নেল [ক্লাইভ] কাউন্সিলকে জানান যে নবাবের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ হলে তাতে মীরজাফর নিরপেক্ষ থাকবেন, তার বেশি কিছু করবেন বলে তাঁর মনে হয় না। এদিকে মঁসিয়ে ল’ কিছু ফরাসি সৈন্য নিয়ে নবাবের সঙ্গে যোগ দিতে আসছেন, তাঁর পৌঁছুতে দিন তিনেক লাগবে। ক্লাইভ এই সভা ডেকেছেন, এ-অবস্থায় নবাবের ওপর তক্ষুনি ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত, না আমরা যেখানে আছি সেখানে আরও সুসংহত হয়ে বর্ষা শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করে তারপর মারাঠাদের নবাবের বিরুদ্ধে আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো উচিত, তা জানতে।

এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে পলাশির যুদ্ধের মাত্র দু’দিন আগেও ক্লাইভ সিরাজদ্দৌল্লাকে গদিচ্যুত করার জন্য মারাঠাদের সঙ্গে হাত মেলাবার কথা চিন্তা করছিলেন। এতে এটাই পরিষ্কার বোঝা যায় যে সিরাজকে হঠিয়ে অন্য কাউকে নবাব করার যে-চক্রান্ত সেটা পুরোপুরি ইংরেজদেরই ‘প্রকল্প’ (‘project’)। এ-প্রকল্পের রূপায়ণের জন্য তারা যে-কোনও শক্তি বা গোষ্ঠীর সাহায্য নিতে প্রস্তুত—মুর্শিদাবাদ দরবারের বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর ওপরই শুধুমাত্র তারা নির্ভর করে ছিল না।

যুদ্ধবিষয়ক কাউন্সিলে ক্লাইভ নবাবকে এক্ষুনি আক্রমণ করার বিরুদ্ধে ভোট দিলেন। কাউন্সিলের অন্য বারোজন সদস্যও এর বিরুদ্ধে ভোট দিল। পক্ষে ভোট মাত্র সাত। কিন্তু এই মিটিং-এর এক ঘণ্টা পরেই ক্লাইভ আয়ার কুটকে জানালেন যে পরের দিনই নবাবের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করা হবে4, যদিও তখনও পর্যন্ত মীরজাফরের কাছ থেকে ইতিবাচক কোনও সংকেত বা নির্দেশ এসে পৌঁছয়নি। এতেই স্পষ্ট যে, বিপ্লব সংগঠিত করতে ইংরেজরা শুধু অস্থিরই নয়, খুব উদগ্রীবও হয়ে পড়েছিল। ২২ জুন ভোরবেলা ক্লাইভের নেতৃত্বে ইংরেজ বাহিনী পলাশি অভিমুখে অভিযান শুরু করল। কিন্তু সেদিনই সম্ভবত যাত্রা শুরু করার আগে ক্লাইভ আবার মীরজাফরকে তাঁর সঙ্গে এসে যোগ দিতে ব্যাকুল হয়ে চিঠি লিখলেন:5

যদিও আপনি নিজে কিছুই করছেন না, আপনার জন্য সর্বস্ব বিপন্ন করতে আমি স্থিরপ্রতিজ্ঞ। আজ সন্ধের মধ্যেই আমি নদীর ওপারে পৌঁছে যাব। আপনি যদি পলাশিতে আমার সঙ্গে যোগ দেন তা হলে আমি মাঝপথ পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে আপনার সঙ্গে মিলিত হতে পারি….আমি আপনাকে শুধু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই এর ওপর আপনার সম্মান ও নিরাপত্তা কতখানি নির্ভর করছে। আপনাকে আমি সম্পূর্ণভাবে আশ্বস্ত করছি যে এটা করলে আপনি তিন প্রদেশেরই (বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা] সুবাদার (নবাব) হবেন। কিন্তু আপনি যদি আমাদের সাহায্যার্থে এটুকুও না করেন তা হলে ভগবান আপনার সহায় হন। আমাদের কিন্তু পরে বিন্দুমাত্র দোষ দিতে পারবেন না।

মীরজাফর যাতে ইংরেজদের সঙ্গে যোগ দেন তার জন্য একদিকে কী ধরনের প্রলোভন ও অন্যদিকে যে প্রচ্ছন্ন ভীতিপ্রদর্শন করা হয়েছিল, তার উৎকৃষ্ট নিদর্শন ওপরের চিঠিটি। শেষ পর্যন্ত ২২ জুন দুপুরের দিকে ক্লাইভের কাছে মীরজাফরের চিঠি এসে পৌঁছুল এবং বিকেলেই ক্লাইভ পলাশি অভিমুখে অভিযান শুরু করার সিদ্ধান্ত মীরজাফরকে জানিয়ে দিলেন।6

এদিকে নবাবের শিবিরে তখন সম্পূর্ণ বিভ্রান্তি চলছিল। আমরা আগেই দেখেছি ইংরেজ ও ফরাসিরা উভয়েই তাদের সাধ্যমতো দরবারের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উৎকোচ দিয়ে নিজেদের দলভুক্ত করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু জাঁ ল’-র অর্থবল তেমন ছিল না, ফলে তিনি শুধু এমন সব ব্যক্তিদের হাত করতে পেরেছিলেন যাদের সম্বন্ধে ইংরেজদের বিশেষ আগ্রহ ছিল না। এরা ফরাসিদের উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি করেছিল। অন্যদিকে ইংরেজরা প্রচুর টাকাপয়সার জোরে ও উমিচাঁদের সহায়তায় মুর্শিদাবাদ দরবারে ফরাসিদের চেয়ে অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল। চন্দননগরের পতনের পর সিরাজদ্দৌল্লা একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েন। বস্তুতপক্ষে এর ফলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফরাসি-নবাব জোটবন্ধনের সম্ভাবনা একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং তাতে ইংরেজদের পক্ষে নবাবের বিরুদ্ধে জোরালো ব্যবস্থা নেওয়া অনেক সহজ হয়ে পড়ে। চন্দননগর বিজয়ের জন্য বিহ্বল সিরাজ ইংরেজদের ‘উচ্ছ্বসিত অভিনন্দন’ জানালেন7 ঠিকই কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কাশিমবাজারে জাঁ ল’-কে উৎসাহিত করতে বা ব্যুসিকে (তখন দাক্ষিণাত্য থেকে কটকের দিকে আসছেন বলে গুজব) চিঠি লিখতে বিরত থাকলেন না। তা ছাড়াও তিনি সৈন্যবাহিনীর একজন সর্দারকে (জমাদার) একশো জন গোলন্দাজ সমেত কাশিমবাজারের ফরাসি কুঠি পাহারা দেবার জন্য পাঠিয়ে ছিলেন। ফরাসি কুঠির ওপরে নবাবের একটি পতাকাও টাঙিয়ে দেওয়া হল। সিরাজ ল’-কে খবর পাঠালেন, ভয়ের কিছু নেই, তিনি তাঁর সব সৈন্যবাহিনী নিয়ে ফরাসিদের রক্ষা করার জন্য প্রস্তুত।8 ব্যুসিকেও নাকি নবাব লেখেন:9

ইংরেজদের বিশ্বাসঘাতকতার কথা আপনাকে কী আর বলব! তারা কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই মঁসিয়ে রেনন্টের সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়েছে এবং যুদ্ধে ফরাসিদের পরাস্ত করে তাদের (চন্দননগর) কুঠি দখল করে নিয়েছে। এখন তারা আপনাদের কাশিমবাজার কুঠির প্রধান মঁসিয়ে ল’-র সঙ্গে ঝগড়া বাধাবার চেষ্টা করছে কিন্তু আমি তাতে বাধা দেব এবং তাদের বদ মতলব ভেস্তে দেব। আপনি যখন বালেশ্বরে পৌঁছুবেন তখন আমার আন্তরিকতার নিদর্শনস্বরূপ আমি মঁসিয়ে ল’-কে আপনার সাহায্যার্থে পাঠাব। এখন আমার কর্মচারীদের নির্দেশ পাঠাচ্ছি আপনাকে সবরকম সাহায্য দেবার জন্য।

এ-সব চিঠিপত্রের যাথার্থ্য সম্বন্ধে এখন প্রশ্ন উঠেছে সন্দেহ নেই, কিন্তু ল’ নিজে তাঁর ও সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে ব্যুসির চিঠিপত্রের আদানপ্রদানের কথা উল্লেখ করেছেন।10 আসলে সত্যিকারের ব্যাপার বোধহয়, সিরাজদ্দৌল্লা ইংরেজদের দাপট দেখে কিছুটা ভয় পেয়েছিলেন। আবার দরবারে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের আভাস পেয়ে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। তাই তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফরাসিদের সঙ্গে আঁতাত করতে চেয়েছিলেন কিন্তু দুর্বলচিত্ত স্বভাব ও মানসিক স্থৈর্যের অভাবের জন্য দোনামনা করে শেষপর্যন্ত তা করে উঠতে পারেননি।

ইতিমধ্যে চন্দননগরের পতন ও সিরাজদ্দৌল্লার নিঃসঙ্গতার সুযোগে ইংরেজরা আরও সাহসী হয়ে উঠল এবং স্বমূর্তি ধারণ করল। ক্লাইভ এখন ওয়াটসকে এরপর কীভাবে চলতে হবে তার নির্দেশ দিলেন।11

এতদিন আমাদের নীতি ছিল নরমে গরমে যখন যে রকম দরকার সেভাবে নবাবকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাংলা থেকে ফরাসিদের তাড়ানোর ব্যবস্থা করা। এখন আমাদের তাঁকে বোঝাতে হবে আমরা যা করেছি তা আমাদের দু’ পক্ষের জন্যই সবচেয়ে উত্তম ব্যবস্থা। এ ক্ষেত্রে যে যুক্তি সবচেয়ে কার্যকর হবে তা হল—করমণ্ডল উপকূলে আমাদের ও ফরাসিদের কার্যকলাপের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে নবাবকে বোঝাতে হবে ফরাসিরা কীভাবে নিজাম বাহাদুর সালাবৎ জঙ্গের হাত থেকে তাঁর রাজ্য কেড়ে নিয়ে তাঁকে পুরোপুরি ক্রীড়নক বানিয়েছে…. তা ছাড়া নবাবকে আশ্বস্ত করতে হবে যে আমরা সর্বদা তাঁর শত্রুদের বিরুদ্ধে তাঁকে সাহায্য করব। বিনিময়ে আমরা শুধু চাইব যে, আমাদের সঙ্গে নবাবের যে চুক্তি তা তিনি মেনে চলবেন এবং আমাদের স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতে দেবেন। এটাও তাঁকে বোঝাতে হবে যে, ফরমানে আমাদের যে সুযোগসুবিধে দেওয়া হয়েছে তার বেশি কিছু আমরা চাই না। এখন থেকে আমরা শুধু বণিক হিসেবেই কাজকর্ম করব। কিন্তু তাঁর শত্রুদের হাত থেকে তাঁকে রক্ষা করার জন্য আমরা উপযুক্ত সংখ্যক সৈন্য এখানে রাখব। তাঁকে নিশ্চিত করতে হবে যে আমার সৈন্যবাহিনীর বহর দেখে ফরাসিরা আর কোনও ঝামেলা পাকাবার সাহস পাবে না। তবে তারা নবাবের কোনও একটি প্রদেশ দখল না করা পর্যন্ত অস্ত্রসংবরণ নাও করতে পারে। আমাদের দিক থেকে একমাত্র চাহিদা নবাবের সঙ্গে চুক্তি যাতে পুরোপুরি মেনে চলা হয়। এখন যে শুভ সূচনা হয়েছে তা সম্পূর্ণ হওয়া একান্ত প্রয়োজন আর সেজন্য নবাব যেন যেখানে ফরাসিরা আছে তাদের সে-সব জায়গা এবং সব সম্পত্তি আমাদের হাতে সমর্পণ করেন।

ক্লাইভের ওপরের নির্দেশ থেকে এটা স্পষ্ট যে ইংরেজদের পক্ষে শুধু চন্দননগরের পতন যথেষ্ট নয়। সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে চুক্তির বাইরে গিয়ে তারা চাইছিল যে, নবাবকে তাঁর শত্রুদের বিরুদ্ধে সাহায্য করার অজুহাতে বাংলায় পর্যাপ্ত পরিমাণ ফৌজ রাখতে এবং ফরাসিদের যাবতীয় কুঠি ও সম্পত্তি হস্তগত করতে। খুব সম্ভবত, চন্দননগরের পতনের পরও ফরাসি-বাঙালি আঁতাতের সম্ভাবনায় তারা আশঙ্কিত ছিল এবং ভাবছিল মঁসিয়ে ল’ যতদিন কাশিমবাজারে থাকবেন ততদিন মুর্শিদাবাদ দরবারে ফরাসি প্রভাব বজায় থাকবে। তাই মাদ্রাজ থেকে তাঁকে ফিরে যাবার জন্য জরুরি বার্তা পাঠানো সত্ত্বেও ক্লাইভ বাংলা থেকে ফরাসিদের সমূলে উৎপাটন করার জন্য বাংলায় থেকে যাওয়াই স্থির করলেন। মাদ্রাজের গভর্নর পিগটকে তিনি ২৯ মার্চ লিখলেন: ‘এখানে আগস্ট মাস পর্যন্ত থেকে যাওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই। আমার মনে হয় তাতে করে আমরা এখানে কোম্পানির পক্ষে অত্যন্ত সুবিধেজনক শর্তে সবকিছুর মীমাংসা করতে পারব এবং ফরাসিদের সব কুঠিগুলি আমাদের হাতে সমর্পণ করার জন্য নবাবকে রাজি করাতে পারব। ফলে এখান থেকে ফরাসিদের সম্পূর্ণভাবে বহিষ্কার করা সম্ভব হবে।’12 ওই একই দিনে ক্লাইভ সিরাজদ্দৌল্লাকে জানান যে, ইউরোপে ইংরেজ ও ফরাসিরা পরস্পরের সঙ্গে যতদিন যুদ্ধে রত থাকবে বাংলায়ও ততদিন তারা যুদ্ধরত বলে গণ্য হবে। সুতরাং যতদিন না পর্যন্ত নবাব ফরাসিদের সব সম্পত্তি ও কুঠি ইংরেজদের হাতে তুলে দিচ্ছেন ততদিন তাঁর পক্ষে শান্তির কোনও আশা নেই। ক্লাইভ তাঁকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, এ-সব ইংরেজদের দিয়ে দিলে এদেশে তাদের আর কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী থাকবে না এবং কেউ যদি দেশের শান্তি বিঘ্ন করার চেষ্টা করে তাদের শায়েস্তা করতে ইংরেজরা নবাবকে সাহায্য করবে।13

সিরাজদ্দৌল্লা সম্ভবত বুঝতে পেরেছিলেন যে, ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে রেষারেষি ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা জিইয়ে রাখতে পারলেই তাঁর পক্ষে সবচেয়ে সুবিধেজনক হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ঘটনাক্রম তাঁর হাতের বাইরে চলে গিয়েছে। তা সত্ত্বেও তিনি ক্লাইভের প্রস্তাব মেনে নিতে কতগুলি অসুবিধের কথা জানিয়ে আপত্তি করেছিলেন—যেমন ফরাসিরা মুঘল বাদশাহের অনুমতি নিয়েই এদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করছিল, তাদের তাড়িয়ে দিলে বাদশাহের রাজস্বের ক্ষতি হবে। তাই তিনি ক্লাইভকে বললেন, ফরাসিরা তাদের সব কুঠিই ইংরেজদের হাতে তুলে দেবে এই মর্মে রেনল্টের কাছ থেকে একটি চিঠি জোগাড় করতে এবং ফরাসিরা চলে গেলে রাজস্বের যে ক্ষতি হবে ইংরেজরা তা পূরণ করে দেবে এই প্রতিশ্রুতি দিতে।14 ক্লাইভ কিন্তু সিরাজের ওপর চাপ সৃষ্টি করলেন এই বলে যে তিনি ফ্রেব্রুয়ারি চুক্তির শর্তাবলী মানেননি, যেটা আমরা আগেই দেখেছি, একেবারেই ভিত্তিহীন। এ-প্রসঙ্গে জাঁ ল’ মন্তব্য করেছেন যে ইংরেজরা হাজার রকমের নতুন নতুন দাবিদাওয়া নিয়ে সিরাজকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল।15 ক্লাইভ আসলে এ-সব দাবিদাওয়ার অজুহাত তুলে নবাবের ওপরে চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করছিলেন। ইংরেজদের সঙ্গে প্রকাশ্য সংঘাত এড়াতে সিরাজদ্দৌল্লা শেষপর্যন্ত তাদের অন্যতম দাবি মেনে নিলেন। তিনি ৭ এপ্রিল জাঁ ল’-কে মর্শিদাবাদ ছেড়ে চলে যাবার নির্দেশ দিলেন। তারপরের ঘটনাবলীর বিবরণ ল’ নিজেই দিয়েছেন—যা থেকে পরিষ্কার, এ সময় নানারকমের বিপাকের সম্মুখীন হয়ে তরুণ নবাব একেবারে দিশেহারা ও অসহায় বোধ করতে থাকেন এবং নিজের কর্তব্য স্থির করতে দোদুল্যমান হয়ে পড়েন।16

জাঁ ল’ জানাচ্ছেন যে ফরাসিদের বিতাড়ন করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নবাবের ছিল না। বরং তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ইংরেজদের দাবিয়ে রাখার জন্য ফরাসিদের উপস্থিতি তার একান্ত প্রয়োজন ছিল। যা হোক, ১০ এপ্রিল নবাব ল’-কে দরবারে ডেকে পাঠান। ল’-র ধারণা, সম্ভবত নবাব তাঁকে বন্দি করে ইংরেজদের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ওই সময় ফরাসি সৈন্যের একটি দল সময়মতো ওখানে উপস্থিত হওয়ায় নবাব তাঁর মত বদলে ফেলেন। নবাবের সঙ্গে ল’-র যখন দেখা হল তখন নবাব তাঁকে পরামর্শ দিলেন, হয় ওয়াটসের প্রস্তাব অনুযায়ী কাশিমবাজারের কুঠি ইংরেজদের হাতে সমর্পণ করে কলকাতা চলে যেতে নয়তো তাড়াতাড়ি নবাবের রাজ্য ছেড়ে দিতে। ল’ জানাচ্ছেন সিরাজদৌল্লা তাঁকে বললেন:17

আপনাদের [ফরাসিদের] জন্যই ইংরেজদের কাছে আমাকে অপদস্থ হতে হচ্ছে। আপনাদের জন্য সমগ্র দেশে আমি অশান্তি ডেকে আনতে পারি না। আপনার মনে রাখা উচিত যখনই আপনাদের সাহায্য আমার প্রয়োজন হয়েছে তখন তা করতে আপনারা অস্বীকার করেছেন। এখন আমার কাছ থেকে আপনারা কিছুই প্রত্যাশা করতে পারেন না।

ল’ অবশ্য স্বীকার করেছেন যে নবাবের সঙ্গে তাঁরা যে আচরণ করেছেন তারপর নবাবের কাছে জবাব দেওয়ার মুখ তাঁর ছিল না। তিনি এটাও জানিয়েছেন যে, নবাব যখন তাঁকে মুর্শিদাবাদ ছেড়ে যেতে বলেন তখন নবাব মখ নিচ করে ছিলেন—যেন নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই নবাব এই নির্দেশ দিলেন। তিনি যখন নবাবকে বললেন যে পাটনার দিকে যাওয়াই তাঁর ইচ্ছে তখন নবাব এবং খোজা ওয়াজিদ ছাড়া দরবারের বাকি সবাই প্রায় সমস্বরে চিৎকার করে উঠল—ওদিকে নয়, ল’-কে মেদিনীপুর বা কটকের দিকেই যেতে হবে। নবাব মুখ নিচু করেই রইলেন—কিছু উচ্চবাচ্য করলেন না। ল’ যখন জিজ্ঞেস করলেন, নবাব কি চান যে তাঁকে ইংরেজদের হাতে তুলে দেওয়া হোক, তখন নবাব উত্তর দিলেন, ‘না না, আপনার যেদিকে ইচ্ছে যান, আল্লা আপনার সহায় হন।’18 সিয়র-এর লেখক গোলাম হোসেন জানাচ্ছেন যে সিরাজদ্দৌল্লা ল’-কে বলেছিলেন, প্রয়োজন হলেই তাঁকে তিনি ডেকে পাঠাবেন। উত্তরে ল’ বলেছিলেন—‘আমাকে আবার ডেকে পাঠাবেন? জাঁহাপনা, আপনি আশ্বস্ত থাকুন, এই আমাদের শেষ দেখা। মনে রাখবেন আমাদের আর কোনওদিন দেখা হবে না। আমাদের দেখা হওয়া প্রায় অসম্ভব।’19 তবে ল’ বা ওয়াটস কেউ এ ধরনের কোনও কথোপকথনের কথা বলেননি, যদিও ওয়াটস সর্বদাই প্রায় দরবারে উপস্থিত থাকতেন। ল’ শেষপর্যন্ত ১৬ এপ্রিল মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করে পাটনা অভিমুখে রওনা হলেন। মাঝখানে ভাগলপুর অতিক্রম করার সময় তিনি নবাবের একটি পরোয়ানা পেলেন যে তাঁর যাত্রা স্থগিত করে নবাবের নির্দেশের জন্য ওখানে অপেক্ষা করতে। ল’পরের দিনই সে-নির্দেশ পেলেন—তক্ষুনি মুর্শিদাবাদ ফিরে আসতে এবং ইংরেজদের আক্রমণ করতে। কিন্তু তাঁর মনে সন্দেহ জাগল—হয়তো এ-নির্দেশ নবাবের নয়, এর মধ্যে ‘বিশ্বাসঘাতকে’র দল জড়িয়ে আছে। তাই সত্য যাচাই করার জন্য এবং মুর্শিদাবাদের হালচাল জানতে তিনি সাঁ ফ্রে-কে (M. de St. Fray) সেখানে পাঠালেন আর সিরাজদ্দৌল্লাকে লিখলেন যে তাঁর সঙ্গে যোগ দিতে তিনি প্রস্তুত, তবে সৈন্যদের বেতন দিতে তাঁর অর্থের প্রয়োজন।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভ, ২৭ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 431.
  2. ক্লাইভ সিলেক্ট কমিটিকে, ২১ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 419.
  3. আয়ার কুটের জার্নাল, Ome Mss., India VII, f. 1665; Hill, III, p.54.
  4. ঐ।
  5. মীরজাফরকে ক্লাইভ, ২২ জুন ১৭৫৭ (১ নং), Hill, II, pp. 420-21; ক্লাইভকে মীরজাফর, ক্লাইভ পেলেন ২২ জুন বিকেল তিনটে, Hill, II, p. 420; মীরজাফরকে ক্লাইভ, ২২ জুন ১৭৫৭ (২ নং), সন্ধেয় ছ’টায় পাঠাননা, Hill II, p. 421. জোরটা আমার দেওয়া।
  6. মীরজাফরকে ক্লাইভ, ২২ জুন ১৭৫৭, Hill, I, p. 421.
  7. ক্লাইভকে সিরাজদৌল্লা, ২৯ মার্চ ১৭৫৭, Hill, II, p. 295; Scrafton, Reflections, p. 79.
  8. Law’s Memoir, Hill, III, p.199.
  9. ব্যুসিকে সিরাজদৌল্লা, মার্চ ১৭৫৭, Hill, II, p. 314.
  10. অক্ষয়কুমার মৈত্র, সিরাজদৌল্লা, পৃ. ২৮৭; Law’s Memoir, Hill, II, p. 196.
  11. ওয়াটসকে ক্লাইভ, ২৪ মার্চ ১৭৫৭, One Mss., India XI, ff. 2752-54. জোর আমার দেওয়া।
  12. গভর্নর পিগটকে ক্লাইভ, ২৯ মার্চ ১৭৫৭, Hill, II, p. 303.
  13. সিরাজদৌল্লাকে ক্লাইভ, ২৯ মার্চ ১৭৫৭, Hill, II, p. 304.
  14. ক্লাইভকে সিরাজদৌল্লা, ৮ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 316.
  15. Law’s Memoir, Hill, III, p. 208.
  16. ঐ, পৃ. ২০২-১০।
  17. ঐ, পৃ. ২০৫।
  18. ঐ, পৃ. ২০৬।
  19. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২২৭।