খোজা ওয়াজিদ
বাংলার দুই বণিক রাজা জগৎশেঠ ও উমিচাঁদের মতো অন্য বণিকরাজা আর্মানি খোজা ওয়াজিদ কিন্তু পলাশির চক্রান্তে যোগ দিয়েছিলেন একেবারে শেষ পর্যায়ে— যখন চক্রান্ত একেবারে পাকা। তাই তিনি কেন যে শেষ মুহুর্তে ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে যোগ দিলেন তা বিশ্লেষণ করা একান্ত প্রয়োজন। প্রথম থেকেই ওয়াজিদ ছিলেন নবাব সিরাজদৌল্লার একান্ত আপনজন ও অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন, নবাবের অন্তরঙ্গ পরামর্শদাতাদের একজন, ফরাসিদের বন্ধু এবং সে হিসেবে ইংরেজবিরোধী। কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনিও সিরাজদৌল্লাকে পরিত্যাগ করে তাঁর শত্রুদের সঙ্গে যোগ দেন এবং ইংরেজদের বিপ্লবের পরিকল্পনায় নিজেকে যুক্ত করেন।
ওয়াজিদ যে ১৭৪০ ও ৫০’-এর দশকে বাংলার বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।1 বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্যের রাজধানী হুগলি থেকেই তিনি তাঁর ব্যবসার সাম্রাজ্য চালাতেন, সূক্ষ্ম কূটনীতি অবলম্বন করে এবং প্রয়োজনমতো নবাব আলিবর্দিকে আর্থিক সাহায্যের মাধ্যমে ওয়াজিদ নবাবের দরবারে একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। প্রকৃতপক্ষে হুগলি ফৌজদারের দরবারে সামান্য ব্যক্তি থেকে ১৭৪০-এর দশকের মাঝামাঝি তিনি মুর্শিদাবাদ দরবারে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে নিয়েছিলেন।2 আর ১৭৪০-এর দশকের শেষদিকে দরবারের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে তিনি বিহারের অর্থনীতির ওপর নিজের প্রায় একচেটিয়া দখল প্রতিষ্ঠিত করে নেন।
ওয়াজিদ একদিকে নিজের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যদিকে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলিকে পণ্যসরবরাহের সূত্রে বাংলার অন্তর্বাণিজ্যে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। ফরাসি ও ডাচ কোম্পানির সঙ্গে এবং উমিচাঁদের মাধ্যমে ইংরেজ কোম্পানির সঙ্গেও তাঁর ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। দরবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে তিনি কিছু কিছু পণ্যের একচেটিয়া ব্যবসা করার চেষ্টা করেছিলেন। এভাবে তিনি বাংলায় সোরা ও লবণের ব্যবসা কুক্ষিগত করেন।3 তিনি বিহারের আফিং-এর ব্যবসাও নিজের একচেটিয়া আয়ত্তে আনার চেষ্টা করেছিলেন। ওখানেও দরবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের মাধ্যমে তিনি এ-সব করতে সক্ষম হন।4 এভাবে বাংলার অন্তর্বাণিজ্যে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে তিনি সমুদ্রবাণিজ্যে অংশ নিতে শুরু করেন। ডাচ কোম্পানির রেকর্ডস থেকে জানা যায়, ১৭৪০-এর দশকের মাঝামাঝি ওয়াজিদের বাণিজ্যতরী বাংলা থেকে পণ্যসম্ভার নিয়ে সুরাট যাচ্ছে আর পঞ্চাশের দশকের প্রথমদিকে তাঁর বেশ কয়েকটি বাণিজ্যতরী বিভিন্ন দিকে পাড়ি দিচ্ছে। ওই সব রেকর্ডস থেকে ওয়াজিদের এরকম অন্তত ছয়টি বাণিজ্যতরীর হদিস আমরা পাই যেগুলি হুগলি থেকে জেড্ডা (Jedda), মোখা (Mocha), বসরা (Basra), সুরাট ও মসুলিপট্টনমে পণ্যসম্ভার নিয়ে যাতায়াত করত। বাংলায় ডাচ কোম্পানির প্রধান ইয়ান কারসেবুম (Jan Kerseboom) ও কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল সুরাটে ওয়াজিদের বাণিজ্য কুঠির উল্লেখ করেছেন।5
সুতরাং ১৭৫০-এর দশকের সংকটপূর্ণ সময়ে এ হেন ওয়াজিদ যে বাংলার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবেন তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। প্রায় সমসাময়িক ঐতিহাসিক ইউসুফ আলি খান লিখেছেন যে, ওয়াজিদ নবাব আলিবর্দির বিশেষ প্রিয়পাত্র এবং ব্যক্তিগত বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। হুগলির সবচেয়ে বড় সওদাগর ওয়াজিদের ব্যবসা-বাণিজ্য এতই সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে যে তিনি তা থেকে বিশাল সম্পদের অধিকারী হন। তিনি সাধারণত ফখর-উল-তুজ্জার (সওদাগরের গর্ব) হিসেবেই পরিচিত ছিলেন।6 তাঁর প্রতিপত্তি ও ক্ষমতার আরও ইঙ্গিত পাওয়া যায় ডাচ ও ইংরেজ কোম্পানির নথিপত্র থেকে। ডাচ কোম্পানির প্রধান হাউখেনস (Huijghens) ১৭৫০-এর প্রথমদিকে তাঁর Memorie-তে লেখেন যে, ওয়াজিদের সঙ্গে ডাচ কোম্পানির ভাল সম্পর্ক রেখে চলা উচিত কারণ মুর্শিদাবাদ দরবারে তাঁর সম্মান ও প্রতিপত্তি অত্যন্ত প্রবল।7 বস্তুত বাংলায় ডাচ কোম্পানির প্রায় সব ডাইরেক্টর মুর্শিদাবাদ দরবারের সঙ্গে ওয়াজিদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে কথা ও সেখানে তাঁর বিশিষ্ট স্থান সম্বন্ধে মন্তব্য করে গেছেন। ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীরাও দরবারে ওয়াজিদের প্রভাব দেখে একাধিকবার বলেছেন যে, তিনি একজন উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী কিংবা তিনি ‘নবাব সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।’8 বাংলার রাজনীতিতে ওয়াজিদ যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন তা ডাচ কোম্পানির ডাইরেক্টর ইয়ান কারসেবুমের লেখা থেকেও স্পষ্ট। কারসেবুম তাঁর ‘মেমোরি’-তে ১৭৫৫ সালে লেখেন:9
বাংলায় যে-সব গণ্যমান্য ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের কোম্পানির বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন, তাদের মধ্যে খোজা ওয়াজিদ অন্যতম। সম্প্রতি তাঁকে ফখর-উল-তুজ্জার উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। এর অর্থ তিনি ‘সম্পদের পূজারি’। প্রকৃতই তিনি শাসককুলের ধনসম্পত্তির রক্ষকের ভূমিকা নিয়েছেন। তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এঁদের প্রয়োজনমতো অর্থ সাহায্য করেন, কোনও রকম জোরজুলুমে বাধ্য হয়ে নয়।
সেই বছরই কারসেবুমের পরবর্তী ডাইরেক্টর টেইলেফার্ট (Taillefert) মন্তব্য করেন যে, কোম্পানির উপনিবেশ চুঁচুড়াতে ওয়াজিদের মতো এমন সব সম্মানিত ও প্রতিপত্তিশালী সওদাগরকে বসবাস করার অনুমতি দেওয়া ঠিক হয়নি। কারণ এঁরা একদিকে সমুদ্রবাণিজ্য করেন অন্যদিকে অন্তর্বাণিজ্যেও লিপ্ত। ফলে এঁদের ডাচ কোম্পানির প্রতিদ্বন্দ্বী বলেই গণ্য করা যায়। এঁরা নিজেদের ডাচ কোম্পানির ডাইরেক্টরদের থেকে বড় না ভাবলেও তাদের সমকক্ষ বলে মনে করেন।10
উপরোক্ত বর্ণনা থেকেই প্রাক্-পলাশি বাংলার রাজনীতিতে ওয়াজিদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে পড়ে। মুর্শিদাবাদ দরবারে ওয়াজিদের প্রভাব যে কতটা প্রবল তার প্রমাণ, সিরাজদৌল্লা মসনদে বসার পর তাঁকে ইংরেজদের সঙ্গে আপস-মীমাংসার দৌত্যে নিযুক্ত করেন। জাঁ ল’ মন্তব্য করেছেন যে ওয়াজিদ ইউরোপীয়দের সঙ্গে নবাবের কটনৈতিক আলাপ-আলোচনার দায়িত্বে ছিলেন।11 ইংরেজরা কলকাতা থেকে বিতাড়িত হবার পরে মাদ্রাজ থেকে সৈন্যসম্ভার নিয়ে রবার্ট ক্লাইভ ও মেজর কিলপেট্রিক (Killpatrick) বাংলায় এসে ওয়াজিদকে (অবশ্য অন্য দু’জন বণিকরাজাকেও) অনুরোধ করেন, কোম্পানি ও নবাবের সঙ্গে একটা মিটমাটের ব্যবস্থা করতে।12 আবার ইংরেজরা হুগলি বন্দর আক্রমণ ও লুঠ করার পর নবাবের সঙ্গে শান্তিচুক্তির শর্তাবলী নিয়ে আলোচনা করার জন্য ক্লাইভ ওয়াজিদকেই পাঠান ২২ জানুয়ারি ১৭৫৭। ওয়াজিদ ক্লাইভকে জানিয়েছিলেন যে এই শর্তগুলির মধ্যে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের সংস্কার ও দুর্ভেদ্যীকরণ নবাব মেনে নিলেও, অন্য শর্ত যে তাদের মুদ্রা তৈরির স্বাধীনতা দিতে হবে, সেটা নবাব কিছুতেই মেনে নেবেন না।13 এই থেকেই বোঝা যায় যে ওয়াজিদ তদানীন্তন বাংলার আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রের বাস্তব পরিস্থিতি সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন। তিনি জানতেন জগৎশেঠরা টাঁকশালে মুদ্রা তৈরির একচেটিয়া অধিকার ভোগ করছিলেন এবং তাঁরা কোনওমতেই এটা হাতছাড়া হতে দেবেন না।14 সমসাময়িক নথিপত্র থেকে এটা স্পষ্ট, ইংরেজদের হুগলি আক্রমণের ফলে ওয়াজিদ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তিনি কিন্তু নবাব ও ইংরেজদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ মীমাংসার জন্য যথেষ্ট আগ্রহী ছিলেন।15
মুজাফ্ফরনামা-র লেখক করম আলি বলেছেন যে, ওয়াজিদ নবাব আলিবর্দি ও সিরাজদৌল্লা উভয়কেই ইংরেজদের বিরুদ্ধে উসকানি দিয়েছিলেন।16 এটা অবশ্য ওয়াজিদের প্রতি ক্লাইভসহ ইংরেজদের যে মনোভাব তারই প্রতিধ্বনি। এর ওপর নির্ভর করা যায় না। ক্লাইভ ওয়াজিদকে ফরাসিদের ‘এজেন্ট’ বলে মনে করতেন।17 নিজের স্বার্থ ওয়াজিদ ভাল করেই বুঝতেন এবং তিনি এটাও ভাল করে জানতেন, ইংরেজদের বিতাড়িত করে তাঁর কোনও স্বার্থসিদ্ধিই হবে না। তাঁর সোরা ও লবণের একচেটিয়া ব্যবসা বা আফিং-এর বাণিজ্য কিংবা তাঁর সমুদ্রবাণিজ্য, কোনওটাই ইংরেজদের তাড়িয়ে দিলে খুব কিছু লাভবান হবে না। তবে এ-কথা সত্য যে তিনি ইংরেজদের চেয়ে ফরাসি ও ডাচদের প্রতি বেশি অনুকূল ভাবাপন্ন ছিলেন। কিন্তু প্রথমোক্ত দু’জনের সঙ্গে তাঁর যে সম্পর্ক তা ইংরেজদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের পরিপন্থী ছিল না। জাঁ ল-’র মন্তব্যই সঠিক যে ওয়াজিদ সবার সঙ্গেই ভাল সম্পর্ক বজায় রাখতে চাইতেন।18 তবে তাঁর নিজের ব্যবসা-বাণিজ্যের যে সাম্রাজ্য তা বজায় রাখাই ছিল তাঁর একমাত্র লক্ষ্য—যে-কোনও মূল্যেই তিনি তা করতে প্রস্তুত ছিলেন। সম্ভবত এ জন্যই তিনি ১৭৫২ সালে মসনদের ভাবী উত্তরাধিকারী সিরাজদৌল্লার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধি এবং দরবারে প্রতিপত্তি নবাবের আনুকূল্যের ওপরই সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। অচিরেই তিনি সিরাজের ঘনিষ্ঠ ও অন্তরঙ্গ পরামর্শদাতাদের মধ্যে অন্যতম বলে পরিগণিত হন।
জাঁ ল’-র সঙ্গে ওয়াজিদই সিরাজদৌল্লার পরিচয় করিয়ে দেন। ল’ তাঁর সম্বন্ধে যে বিবরণ দিয়েছেন তা শুধু আকর্ষণীয় নয়, অনেকাংশে সঠিকও বটে। তিনি লিখেছেন:
সবাই জানে ওয়াজিদ আমাদের হিতাকাঙ্ক্ষী এবং তিনি হুগলির সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী। তবে তিনি খুবই দুর্বল প্রকৃতির লোক। খুব সম্ভবত তিনি শেঠদের পছন্দ করতেন না। তাঁদের ভয় করতেন। সেজন্য আমাদের দিক থেকে তাঁর প্রয়োজনীয়তা বিশেষ ছিল না।19
অবশ্য বাইরে থেকে ওয়াজিদের সঙ্গে শেঠদের শত্রুতা বোঝা যেত না, যদিও তাঁরা যে পরস্পরের বন্ধু ছিলেন না সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সম্ভবত এই কারণেই দরবারের ষড়যন্ত্রীদের মধ্যে জগৎশেঠরা মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন বলেই ওয়াজিদ যতদিন সম্ভব পলাশি চক্রান্তের বাইরে ছিলেন এবং নবাবের সঙ্গেই নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন।
ওয়াজিদ যে জগৎশেঠদের সঙ্গে নিজেকে প্রথম দিকে যুক্ত করেননি তার প্রমাণ দরবারে উমিচাঁদের ‘এজেন্ট’ হাজারিমলের ১৭৫৬-এর ২৩ নভেম্বরের চিঠিতে পাওয়া যায়। হাজারিমল লিখছেন, দরবারে জগৎশেঠরা ও ওয়াজিদ দুটো ভিন্ন দলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং শেঠদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে তিনি ইংরেজদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করছিলেন।20
এখানে যে-প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই আসছে সেটা হচ্ছে, তা হলে ওয়াজিদ কেন শেষপর্যন্ত পলাশি চক্রান্তে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন? মনে হয় ইংরেজদের হুগলি আক্রমণের পর তিনি তাঁর বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা সম্বন্ধে চিন্তিত হয়ে পড়েন। তাই তিনি সিরাজদৌল্লাকে পরামর্শ দেন, ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফরাসিদের সঙ্গে আঁতাত করার জন্য। ১৭৫৭ সালের ২৩ মার্চ ইংরেজদের হাতে চন্দননগরের পতনের পর ওয়াটস লেখেন যে, ফরাসিদের পরাজয়ের পর সিরাজদৌল্লা ওয়াজিদের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন কারণ ওয়াজিদ নবাবকে বুঝিয়েছিলেন যে ফরাসিরা ইংরেজদের চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী এবং ইংরেজরা তাদের বিরুদ্ধে কখনওই সফল হবে না।21 এ থেকে স্পষ্ট যে নবাবের সঙ্গে ফরাসিদের সম্ভাব্য আঁতাতের ওপরই ওয়াজিদ তাঁর নিজের বাঁচার একমাত্র উপায় বলে ভেবেছিলেন। সেটা তো হল না, কিন্তু তা সত্ত্বেও ওয়াজিদ সবার শেষেই পলাশির ষড়যন্ত্রে যোগ দিয়েছিলেন। ১৭৫৭ সালের মে মাস পর্যন্ত তিনিই ছিলেন ষড়যন্ত্র সফল করার পথে অন্যতম অন্তরায়। তাই ওয়াটস ৩ মে ক্লাইভকে লেখেন:22
আমি শুনলাম যে খোজা ওয়াজিদের গোমস্তা শিববাবু আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।….তাঁর মনিব ফরাসিদের মঙ্গলার্থে আত্মোৎসর্গ করেছেন এবং প্রথম থেকেই তিনি দরবারে তাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক এবং তিনি সেখানে তাদের ‘এজেন্ট’ হিসেবে কাজ করছেন। শুধু তাই নয়, তিনি ফরাসিদের ক্ষমতা ও সামরিক শক্তি সম্বন্ধে নানারকমের অতিরঞ্জিত গল্প বাজারে চালু করেছিলেন….সংক্ষেপে বলতে গেলে তিনি আমাদের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি শত্রুতা করেছেন এবং এখনও করে যাচ্ছেন। নবাবের সঙ্গে আমাদের যে ঝামেলা চলছে তার জন্য তিনিই অনেকাংশে দায়ী। তিনি নবাবকে আমাদের বিরুদ্ধে সবসময় উসকে দেন এবং আমাদের সম্বন্ধে প্রায়ই নবাবের মনে ভীতি ও আশঙ্কা ধরিয়ে দেন….শিববাবু এবং তাঁর মনিব আমার আর স্ক্র্যাফ্টনের প্রতি অত্যন্ত বিরূপ এবং পারলে আমাদের শেষ করে দেন।
যদিও ওয়াজিদ অনেকদিন পর্যন্ত পলাশি চক্রান্তের বাইরে ছিলেন, তা সত্ত্বেও তিনি ভাল করেই জানতেন যে দরবারের কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি এতে জড়িত ছিলেন। রবার্ট ওরম জানিয়েছেন যে, দেশীয়দের মধ্যে ষড়যন্ত্রের অন্যতম নায়ক উমিচাঁদ ছিলেন ওয়াজিদের বন্ধু এবং অনেক ব্যবসাতেই তাঁর অংশীদার।23 খুব সম্ভবত উমিচাঁদ তাঁর ঘনিষ্ঠ ওয়াজিদের কাছে যড়যন্ত্রের কথা গোপন করেননি। তা ছাড়া দরবারের অমাত্যদের সঙ্গে ওয়াজিদের যে ঘনিষ্ঠতা ছিল এবং সারা দেশে তাঁর নিজের বিস্তৃত ব্যবসায়িক সংগঠনের যে-সব লোকজন ছিল তাদের মারফত তিনি নিশ্চয়ই ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে খবর পেতেন এবং একেবারে অন্ধকারে ছিলেন না। কিন্তু সুচতুর ও পাকা হিসেবি ওয়াজিদ একেবারে শেষ মুহূর্তে ষড়যন্ত্রে সামিল হন, যখন তিনি বুঝলেন যে, নবাবের পরিত্রাণের আর কোনও সম্ভাবনাই নেই। তিনি শেষ মুহুর্তে ষড়যন্ত্রে যোগ দেন কারণ তাঁর বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য রক্ষা করার জন্য প্রয়োজন ছিল রাজনৈতিক আনুকূল্য। ততদিনে মুর্শিদাবাদ থেকে জাঁ ল-’র বিতাড়নের ফলে নবাবের পক্ষে ফরাসিদের হস্তক্ষেপের সব সম্ভাবনাই নষ্ট হয়ে যায়। আবার, তাঁর দেওয়া পরামর্শ—নবাব ফরাসিদের সঙ্গে আঁতাত করুন—ব্যর্থ হওয়ায় সিরাজদৌল্লাও তাঁর প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন এবং তাঁকে পরিত্যাগ করেন। মে মাসের প্রথমদিকে দরবারে তাঁর অবস্থা এমন শোচনীয় হয়ে পড়ে এবং তিনি নিরাপত্তার এমনই অভাব বোধ করতে থাকেন যে সম্ভবত তিনি ইংরেজদের কাশিমবাজার কুঠিতে আশ্রয় নেন। ওয়াটস ক্লাইভকে ৯ থেকে ১৩ মে-র মধ্যে কোনও এক সময় লেখেন, ‘খোজা ওয়াজিদ এখন নবাবের অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত। উমিচাঁদকে দিয়ে আমার কাছে খবর পাঠিয়েছেন আমি যেন তাঁকে আমাদের কুঠিতে লুকিয়ে আশ্রয় দিই।’24
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে ওয়াজিদ নিজের ব্যবসা-বাণিজ্যের সাম্রাজ্য বাঁচাতে অনন্যোপায় হয়েই একেবারে শেষ মুহুর্তে পলাশি চক্রান্তে যোগ দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাঁর এবং তাঁর মতো অন্য দু’জন বণিকরাজারও কপাল খারাপ— পলাশি, কিছুটা আগে-পরে, বাংলার এই তিন বণিকরাজারই পতন ডেকে আনে। ১৭৫৮ সালেই ওয়াজিদের পতন সম্পূর্ণ হয়ে যায়—তিনি ঘোষণা করেন যে ইংরেজরা তাঁর ব্যবসাবাণিজ্য ধ্বংস করেছে এবং তাঁকে সর্বনাশের পথে ঠেলে দিয়েছে। এটা পরিষ্কার যে ওয়াজিদের পতন পলাশিতে ইংরেজবিজয়ের প্রত্যক্ষ ফল। অবশ্য জাঁ ল’ বলছেন যে, ওয়াজিদ তাঁর কূটনীতি ও হঠকারিতার শিকার হয়েছেন।25 এটা ঠিক মানা যায় না। যদি কোনও একটা বিশেষ কারণকে ওয়াজিদের পতনের মুখ্য কারণ হিসেবে ধরতে হয়, তবে তা হল তাঁর প্রতি ক্লাইভের প্রচণ্ড রোষ। ক্লাইভ তাঁকে ‘ভিলেন’ বলে মনে করতেন কারণ তিনি সন্দেহ করতেন ওয়াজিদ ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফরাসিদের সাহায্য করছিলেন। তা ছাড়াও ক্লাইভের ঘোরতর সন্দেহ ছিল যে পলাশির পর ১৭৫৭ সালে ফরাসিদের বাংলায় হস্তক্ষেপ করার পরিকল্পনার সঙ্গে ওয়াজিদও যুক্ত ছিলেন। ক্লাইভ ওয়াটসকে লেখেন: ‘কাগজপত্রের মধ্যে ওয়াজিদের একটা চিঠি পাওয়া গেছে যাতে ও-সব [ফরাসিদের পরিকল্পনা] ব্যাপারের উল্লেখ আছে। আমি চাই যে আপনি ওই ভিলেনের সর্বনাশের ব্যবস্থা করুন—ও কিন্তু মনেপ্রাণে ফরাসি৷’26 ইংরেজদের পক্ষে ওয়াজিদের সর্বনাশ সম্পূর্ণ করার সুযোগ এল ১৭৫৯-তে।
ওয়াজিদ বুঝতে পেরেছিলেন, ইংরেজরা যতদিন বাংলায় ক্ষমতার শীর্ষে থাকবে, ততদিন তাঁর ধ্বংসোন্মুখ বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য রক্ষা করার কোনও উপায় নেই। তাই মরিয়া হয়ে তিনি আবার জুয়া খেলে নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করতে চাইলেন। জুয়ায় আবার হারলেও তাঁর আর বেশি কী ক্ষতি হবে কিন্তু জিতলে অনেক লাভ—হয়তো এটাই তিনি ভেবেছিলেন। তিনি ডাচদের সঙ্গে পরিকল্পনা করলেন যে, ডাচরা বাংলা আক্রমণ করে ইংরেজদের তাড়াবার চেষ্টা করবে। কিন্তু পলাশির মতো, তাঁর এই দ্বিতীয় জুয়া খেলাও ব্যর্থ হল৷ ডাচদের পরাজয়ের পর ওয়াজিদের সর্বনাশ ঠেকানো আর কোনও রকমেই সম্ভব ছিল না। ক্লাইভ খুব উৎফুল্ল হয়ে ওয়াজিদের পতন বর্ণনা করেছেন: ‘আমি জানতাম যে নবাবের সঙ্গে আমাদের কলকাতায় যে সাম্প্রতিক ঝামেলাটা হয়েছিল তার প্রধান হোতা হচ্ছে ওই ‘রাসকেল’ ওয়াজিদটা। আবার আমাদের সঙ্গে ডাচদের বিরোধ বাঁধাতে সে এখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। তাই আমি ভাবলাম তাকে হাতকড়া পরানো দরকার যাতে সে ভবিষ্যতে মহামান্য নবাব [মীরজাফর], আপনি [মীরণ] এবং আমার [ক্লাইভ] মধ্যে যে দৃঢ় বন্ধুত্ব হয়েছে তা যেন ভাঙতে না পারে।’27 ওয়াজিদকে ধরে জেলে পোরা হল। সেখানে তিনি বিষ পান করে আত্মহত্যা করেন।28
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
- ওয়াজিদ সম্বন্ধে তথ্যগুলি আমার প্রবন্ধ ‘Khwaja Wazid in Bengal Trade and Politics’, Indian Historical Review, vol. xvi, nos.l-2, pp. 137-44 থেকে সংগৃহীত।
- Mayor’s Court Records, Calcutta, 7 May 1751, Range 155, vol 24, f. 30vo.
- Bengal Letters Recd, vol. 22, para 18, f. 410; BPC, Range 1, vol. 26, f. 110, 2 April753; Ome Mss. 0. V. 134, f. 13; Mss. Eur. D. 283,f. 22.
- Dutch Director Huijghen’s ‘Memorie’, VOC 2763, f. 458, 20 March 1750; VOC 2732, ff. 9-10, HB 27, 24 Jan. 1750.
- Jan Kerseboom’s ‘Memorie’, VOC2849,f. 122, 14 Feb, 1755; Hill, II, p. 87.
- ইউসুফ আলি, জামিয়া-ই-তাদকিরা-ই-ইউসুফি, পৃ. ১৭।
- Huijghen’s ‘Memorie’, voc 2763,f. 467, 20 March 1750.
- BPC, Range 1, vol. 26, ff. 131vo-132vo, 3 May 1753.
- Jan Kerseboom’s ‘Memorie’, V0c2849, f. 128yo, 14 Feb. 1755.
- Tailleferr’s ‘Memoire’, VOC 2849,f. 264, 27 Oct, 1755.
- Law’s Memoir, Hill, III, p. 187.
- Select Committee Consults., Fulta, 22 Aug. 1756, quoted in Brijen Kr. Gupta, Sirajuddaullah, pp. 89-90.
- Hill, II, pp. 126-27.
- জগৎশেঠদের টাকশালে মুদ্রা তৈরির একচেটিয়া অধিকারের প্রচেষ্টা বিস্তারিতভাবে আমার বই From Prosperity to Deiline-এ আছে, পৃ. ৭৭-৭৯।
- ক্লাইভকে ওয়াজিদ, ১০ জানুয়ারি ১৭৫৭, Home Misc, vol. 193, ff. 14-15; ওয়াজিদকে ক্লাইভ, ২১ জানুয়ারি ১৭৫৭, Home Misc., vol. 193, ff. 125-26.
- করম আলি, মুজাফ্ফরনামা, পৃ. ৫৬, ৬৩।
- ওয়াটসকে ক্লাইভ, ৪ আগস্ট ১৭৫৮, Orme Mss., India, X, f. li2vo.
- Law’s Memoir, Hill, III, p. 190.
- ঐ।
- Select Committee Consults., Fulta, Bengal Secret and Military Consults., 23 Nov. 1756.
- সিলেক্ট কমিটিকে ওয়াটাস, Select Committee Consults., Orme Mss., India V, f. A210; O.V. 170, f. 215.
- ক্লাইভকে ওয়াটস, ৩ মে ১৭৫৭, Hili, II, pp. 374-75.
- জন পেইনকে ওরম, ৩ নভেম্বর ১৭৫৬, Orme Mss., O.V.28,f. 52.
- ক্লাইভকে ওয়াটস, ৯-১৩ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 379.
- Law’s Memoir, Hill, III, p. 190, fn.1
- ওয়াটসকে ক্লাইভ, ৪ আগস্ট ১৭৫৮, Ore Mss., India x, f. 112vo.
- মীরণকে ক্লাইভের চিঠি, ২৭ নভেম্বর ১৭৫৯, Clive Mss. 269, no. 982.
- Mss. Eur.G. 37, Box 22.