» » চক্রান্তের মূল নায়করা

বর্ণাকার

রায়দুর্লভ

মীরজাফর, জগৎশেঠ বা উমিচাঁদের মতো রায়দুর্লভ কিন্তু ষড়যন্ত্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন না। ষড়যন্ত্রের সঙ্গে তাঁর যোগ অনেকটাই পরোক্ষ। নবাবের দেওয়ান এবং সৈন্যবাহিনীর একাংশের অধ্যক্ষ হওয়া সত্ত্বেও দুর্লভরাম নবাবের প্রতি বিরূপ হয়ে উঠেছিলেন। সাধারণত বলা হয় এর মূল কারণ সিরাজদ্দৌল্লা হঠাৎ মোহনলালকে সব অমাত্যদের ওপর বসিয়ে দিলেন এবং এই মোহনলাল আলিবর্দির আমলের সব পুরনো অমাত্যদের হেনস্থা ও অপমান করতে লাগলেন।1 ফারসি ঐতিহাসিকরা মীরজাফর ও রায়দুর্লভের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কথা বলেছেন এবং তাঁদের ধারণা উক্ত দু’জন জগৎশেঠদের সঙ্গে মিলে সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠাবার জন্য পলাশির ষড়যন্ত্র করেছিলেন।2 স্ক্র্যাফ্টনও বলেছেন যে মীরজাফরের সঙ্গে রায়দুর্লভের ঘনিষ্ঠ যোগ থাকায় নবাব তাঁকে সন্দেহ করতেন। আর গোলাম হোসেন লিখেছেন, সিরাজদ্দৌল্লা সন্দেহ করেছিলেন যে দুর্লভরামের সঙ্গে মিলেই মীরজাফর দরবারের অসন্তুষ্ট গোষ্ঠীকে সংগঠিত করেছিলেন। তবে তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার বা তাঁদের কারারুদ্ধ করার মতো সাহস সিরাজের হয়নি।3

যদিও এটা সত্য যে মীরজাফরের সঙ্গে রায়দুর্লভের বেশ ঘনিষ্ঠতাই ছিল, তা সত্ত্বেও এটা বলা যায়, রায়দুর্লভ কিন্তু চক্রান্তের প্রথম দিকে এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। খুব সম্ভবত ইংরেজদের কলকাতা পুনরুদ্ধার করা পর্যন্ত তিনি দরবারের ইংরেজ-বিরোধী ও ফরাসিদের প্রতি অনুকূল গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেজন্যই জাঁ ল’ ভেবেছিলেন যে দরবারে রায়দুর্লভ একমাত্র ব্যক্তি যাঁর ওপর তাঁর সবচেয়ে বেশি ভরসা করা উচিত। তাঁর মতে, ক্লাইভ বাংলায় আসার আগে রায়দুর্লভকে ইংরেজ-বিরোধী বলে গণ্য করা যেতে পারে। রায়দুর্লভও এমন ভাব দেখাতেন যে তিনিই ইংরেজদের পরাজিত করে কলকাতা থেকে তাড়িয়েছেন। কিন্তু ক্লাইভ কলকাতা পুনরুদ্ধার করতে এসে ৫ ফেব্রুয়ারিতে যখন নবাবের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধে লিপ্ত হলেন তা দেখে রায়দুর্লভের চোখ ছানাবড়া। জাঁ ল’-র ভাষ্য অনুযায়ী ওই যুদ্ধে তিনি [রায়দুর্লভ] ইংরেজদের ভয়ে ল্যাজ তুলে পালানো ছাড়া আর কিছুই করেননি। তখন থেকেই তিনি অন্য মানুষ। তিনি নাকি ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ করার মতো ভীতিপ্রদ আর কিছুকে মনে করতেন না। সম্ভবত ক্লাইভের কলকাতা পুনরুদ্ধারের পর রায়দুর্লভ দরবারের রাজনীতিতে তাঁর দলবদল করেন। জাঁ ল’ লিখেছেন, ইংরেজদের প্রতি এই ভয় থেকেই যে-জগৎশেঠদের প্রবল প্রতাপ ও প্রতিপত্তির জন্য তিনি তাঁদের প্রচণ্ড ঈর্ষা করতেন, শেষপর্যন্ত তাঁদের দিকেই তিনি ঝুঁকলেন। ফলে ফরাসিদের হয়ে তিনি একটা কথাও আর নবাবকে বললেন না। এটা ঠিক যে দেশীয় চক্রান্তকারীদের নিজেদের মধ্যেও নানা টানা-পোড়েন ছিল। জগৎশেঠ ও রায়দুর্লভের মধ্যে মোটেই সদ্ভাব ছিল না যদিও দু’জনেই মীরজাফরের ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং শেষপর্যন্ত সবাই তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য—সিরাজদৌল্লাকে হঠানো—পূর্ণ করতে হাত মেলালেন। তবে অন্য দু’জনের মতো রায়দুর্লভ কিন্তু প্রথম থেকে ষড়যন্ত্রে সামিল হননি। তিনি চক্রান্তে যোগ দেন একেবারে শেষ পর্যায়ে। জাঁ ল’ লিখেছেন, ‘নিজেকে অন্যদের, বিশেষ করে জগৎশেঠদের তাঁবে চলে যেতে হবে ভয়ে রায়দুর্লভ ঠিক করেছিলেন যে তিনি আপাতত নিরপেক্ষ থাকবেন। তবে সঙ্গে সঙ্গে এটাও একেবারে স্থির করে রেখেছিলেন যে, যে-দল শেষপর্যন্ত ভারী হবে এবং সবচেয়ে শক্তিশালী বলে তাঁর মনে হবে, সে-দলেই তিনি যোগ দেবেন।’4

রায়দুর্লভ ছিলেন বিহারের ডেপুটি গভর্নর জানকীরামের পুত্র। তবে তিনি পিতার বিশেষ স্নেহভাজন ছিলেন না। মৃত্যুর আগে জানকীরাম নবাব আলিবর্দিকে লেখেন যে, তাঁর পুত্ররা কেউ পাটনার (অর্থাৎ বিহারের) শাসনকার্য চালাতে পারবে বলে তাঁর মনে হয় না। তাই তাঁর অবর্তমানে তাঁর পেশকার রাজা রামনারায়ণকে যেন বিহারের ডেপুটি গভর্নরের পদে নিযুক্ত করা হয়। এ-পরামর্শ মেনে আলিবর্দি জানকীরামের মৃত্যুর পর ১৭৫৩ সালে রাজা রামনারায়ণকে ওই পদে নিযুক্ত করেন।5 রায়দুর্লভ অবশ্য তাঁর পিতার জীবিতাবস্থায় মুর্শিদাবাদে সৈন্যবিভাগের হিসাবপত্র দেখার কাজে ডেপুটি দেওয়ান হিসেবে কাজ করতেন এবং তাঁর পিতার মৃত্যুর পর আলিবর্দি তাঁকে ওই বিভাগেরই দেওয়ান পদে উন্নীত করেন। তাঁর কাজকর্ম এতই ভাল হচ্ছিল এবং তিনি সবার এতই প্রশংসা লাভ করেছিলেন যে মুর্শিদাবাদের দরবারে বিহারের স্বার্থ দেখার জন্য রামনারায়ণ তাঁকে দরবারে বিহারের ডেপুটি গভর্নরের প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন। আলিবর্দির বিশ্বস্ত কর্মচারীদের মধ্যে রায়দুর্লভ ছিলেন অন্যতম।6

মীরজাফরের সঙ্গে রায়দুর্লভের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকলেও, ইংরেজদের সঙ্গে মীরজাফরের চুক্তি হওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি ষড়যন্ত্রে পুরোপুরি যোগ দিয়েছিলেন বলে মনে হয় না। তা না হলে এর ক’দিন আগে উমিচাঁদ পলাশিতে তাঁর সঙ্গে দেখা করায় ইংরেজরা তাদের সব পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে বলে এত ভয় পেত না। রায়দুর্লভ যে চুক্তির ব্যাপারে প্রথমে আপত্তি করেছিলেন সেটা, ইংরেজদের সন্দেহ, উমিচাঁদের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের ফল। ওয়াটস মনে করতেন মীরজাফর রায়দুর্লভের হাতের পুতুল। তাই তিনি লিখেছিলেন যে মীরজাফর রায়দুর্লভের সঙ্গে পরামর্শ না করে চুক্তিতে সই করবেন না।7 ইংরেজরা আসলে রায়দুর্লভ সম্বন্ধে সন্দেহমুক্ত হতে পারছিল না। তাই ক্লাইভ ৬ জুনও ওয়াটসকে লেখেন যে, তাঁর সন্দেহ, মীরজাফর ও ইংরেজদের উভয়ের প্রতিই রায়দুর্লভ বিশ্বাসঘাতকতা করছেন।8 বিপ্লবের পরেও কিন্তু তিনি রায়দুর্লভের প্রতি সদয় ছিলেন না। সিলেক্ট কমিটিকে তিনি ২৭ জুন লিখলেন : ‘আমি কালই মুর্শিদাবাদ যাচ্ছি কারণ রায়দুর্লভের হাতে যে প্রচণ্ড ক্ষমতা এবং সেই সঙ্গে তাঁর ছলনাচাতুরি ও দুষ্টবুদ্ধি মিলে নবাব এবং আমাদের উভয়েরই পক্ষে ক্ষতিকারক হতে পারে। তা আটকাতেই আমার যাওয়া প্রয়োজন।’9 যা হোক নবাব হওয়ার পর মীরজাফর দুর্লভরামকে তাঁর প্রধান অমাত্য ও সব দায়িত্বের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে নিয়োগ করেন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই দু’জনের সম্পর্ক অত্যন্ত খারাপ হয়ে যায়। গোলাম হোসেন লিখছেন, এই দু’জন এক সময় এত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন কিন্তু এখন পরস্পরের মধ্যে বিদ্বেষ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তাঁদের মধ্যে কথাবার্তাই বন্ধ এবং একে অপরের প্রতি ঘৃণা পোষণ করেন।10 এর ফলে দু’জনের মধ্যে যে বিরোধের সৃষ্টি হয় তাতে ক্লাইভ দুর্লভরামকে সমর্থন করেন কারণ পলাশি-উত্তর ক্ষমতার লড়াইয়ে দুর্লভরামের পেছনে দাঁড়ানোই ইংরেজদের স্বার্থের অনুকূল ছিল।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২২৫; Ome, Military Transactions, vol. II, Sec. I, p. 148; তারিখ-ই-বাংগালা-ই-মহবৎজঙ্গী, পৃ. ১২৫, ১২৮।
  2. মুজাফ্‌ফরনামা, পৃ. ৭৪; সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২২৭।
  3. Scrafton, Rejlections, p. 12; সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২২৪।
  4. Law’s Memoir, Hill, II, pp. 190-91.
  5. মুজফ্‌ফরনামা, পৃ. ৫১।
  6. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ১১৮।
  7. ক্লাইভকে ওয়াটস, ৩১ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 396; ৩ জুন ১৭৫৭, Hill, II, pp. 396-97.
  8. ওয়াটসকে ক্লাইভ, ৬ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 400.
  9. সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভের চিঠি, ২৭ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 431.
  10. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৩৭, ২৫২।