» » চক্রান্তের মূল নায়করা

বর্ণাকার

উমিচাঁদ

পলাশি চক্রান্তে উমিচাঁদের ভূমিকাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ কারণ তাঁর সাহায্যেই ইংরেজরা দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ষড়যন্ত্রের টোপ গেলায় এবং এভাবে ষড়যন্ত্র পাকা করে তোলে।1 চক্রান্তের সূত্রপাত হবার অনেক আগে থেকেই যখন ইংরেজরা কলকাতা থেকে বিতাড়িত হয়ে ফলতায় আশ্রয় নিয়েছিল, তখনই উমিচাঁদ তাদের পরামর্শ দিয়েছিলেন তারা যেন জগৎশেঠদের হাত করার চেষ্টা করে।2 অবশ্য ইংরেজরা প্রথমে সিরাজের কলকাতা আক্রমণের ব্যাপারে উমিচাঁদের হাত ছিল মনে করে তাঁকে ইংরেজদ্রোহী ভেবেছিল। উমিচাঁদও কলকাতা ছেড়ে মুর্শিদাবাদ চলে গেছিলেন। পরে ক্লাইভ এসে যখন কলকাতা পুনরুদ্ধার করলেন তখন উমিচাঁদ তাঁকে লিখলেন যে ‘তিনি তাঁর সামনে উপস্থিত হয়ে তাঁর নির্দোষিতা প্রমাণ করতে চান এবং তাঁর কাছ থেকে সুবিচার আশা করেন’।3 উমিচাঁদ সম্বন্ধে সব খোঁজখবর নেবার পর ক্লাইভ তাঁকে যা লিখলেন (৯ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭) তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ: ‘আমি খুব চাই যে আপনি আমার সঙ্গে দেখা করুন। আপনাকে আমার অনেক কিছু বলার আছে। আপনি স্বল্প সময়ের জন্য হলেও নির্ভয়ে আমার কাছে আসতে পারেন, আপনার কোনও ক্ষতি করা হবে না। আপনি যখনই যেখানে যেতে চাইবেন সেখানে ফিরে যেতে পারবেন।’4 এ থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে ক্লাইভ উমিচাঁদকে ইংরেজদের পরিকল্পিত চক্রান্তে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। তাই আলিনগরের সন্ধির পর যখন ওয়াটসকে মুর্শিদাবাদে পাঠানো হল তখন ঠিক হল যে উমিচাঁদও তাঁর সঙ্গে যাবেন। এটাও বলা হল যে সন্ধির সময় উমিচাঁদ যেভাবে সাহায্য করেছেন তাতে তাঁর সম্বন্ধে আগের অভিযোগ বাতিল হয়ে গেছে। ওয়াটসকে নির্দেশ দেওয়া হল তিনি যেন কোনও দ্বিধা না করে সব বিষয়ে খোলাখুলিভাবে উমিচাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং তাঁকে দিয়ে নির্দ্বিধায় কাজ করান।5

বাংলার অন্য দুই বণিকরাজা জগৎশেঠ ও খোজা ওয়াজিদের মতো উমিচাঁদ অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধের শেষ তিন দশকে বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির জগতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।6 তিনি ছিলেন আগ্রার অধিবাসী। আগ্রা থেকে এসে তিনি কলকাতায় বাস করতে শুরু করেন অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে। কলকাতার প্রভাবশালী দাদনি বণিক ও একসময় ইংরেজ কোম্পানির প্রধান সওদাগর (Broker) বিষ্ণুদাস শেঠের [কলকাতার বিখ্যাত শেঠ পরিবার— জগৎশেঠদের সঙ্গে এদের কোনও সম্পর্ক নেই] তত্ত্বাবধানে কলকাতায় উমিচাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্যের সূত্রপাত। ১৭৩০-এর দশকেই তিনি নিজেকে কলকাতার একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিরিশ দশকের শেষ দিক থেকে তিনি পাটনাতে আলিবর্দি খানের প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হন। তাঁর ভাই দীপচাঁদ বিহারে সোরা উৎপাদনের অন্যতম কেন্দ্র ‘সরকার’ শরণের ফৌজদারি চালাতেন। উমিচাঁদ প্রধানত বিহারের সোরা ও আফিং-এর ব্যবসাতে যুক্ত ছিলেন। ইংরেজ কোম্পানিকে সোরা সরবরাহকারীদের অন্যতম প্রধান ছিলেন তিনি। তিনি ও তাঁর ভাই মিলে বিহার প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে সোরার প্রায় একচেটিয়া ব্যবসা কুক্ষিগত করেছিলেন। কলকাতায় তিনি ইংরেজ কোম্পানির পণ্য সরবরাহকারী দাদনি বণিকদের অন্যতম প্রধান ছিলেন। তা ছাড়া তাঁর ছিল ব্যাঙ্কিং ও টাকাপয়সা লেনদেনের ব্যবসা।7

তিনি বহুদিন ধরে মুর্শিদাবাদ দরবারের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। একবার যখন দাদনি বণিক হিসেবে কোম্পানির তালিকা থেকে তাঁর নাম কেটে দেওয়া হল তখন আলিবর্দির বড় ভাই ও মুর্শিদাবাদ দরবারের অন্যতম প্রভাবশালী অমাত্য, হাজি আহমেদ উমিচাঁদকে পুনর্বহাল করার জন্য কোম্পানিকে লিখেছিলেন এবং জানিয়েছিলেন যে উমিচাঁদের জন্য যে-কোনও পরিমাণ টাকার জামিন হতে তিনি রাজি। এ থেকেই বোঝা যায় যে মুর্শিদাবাদ দরবারের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের একজন সদস্য একবার বিতর্কের সময় দেশের অন্তর্বাণিজ্য সম্বন্ধে উমিচাঁদের গভীর জ্ঞানের কথা বলেন এবং তাঁর অর্থের বিরাট জোগান আছে বলেও উল্লেখ করেন। উমিচাঁদ যে সোরার উৎপাদন ও বাণিজ্যের একচেটিয়া অধিকার লাভ করতে চেয়েছিলেন, বিহারের অর্থনীতি ও সোরা-আফিং-এর ব্যবসায় তাঁর যে প্রতিপত্তি—এগুলি সবই মুর্শিদাবাদ ও পাটনার দরবারের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের ফলেই সম্ভব হয়েছিল। তাই এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই যে নবাব আলিবর্দির সময় তিনি দরবারে যথেষ্ট প্রভাবশালী ছিলেন। পরে তিনি সিরাজদ্দৌল্লারও বিশেষ প্রিয়পাত্র হন। তাঁর সম্বন্ধে ওরম লিখেছেন:8

কলকাতার হিন্দু বণিকদের মধ্যে একজন হলেন উমিচাঁদ। ব্যবসায়িক বুদ্ধি খাটিয়ে ও প্রচণ্ড অধ্যবসায়ের জোরে তিনি তাঁর ধনসম্পদ বাড়িয়েছেন…. এই শহরে তিনিই সবচেয়ে বড় ধনী। অসংখ্য ঘর নিয়ে তাঁর প্রকাণ্ড বাড়ি, বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত তাঁর অসংখ্য চাকরবাকর ও নানারকমের কর্মচারী এবং বেশ কিছু সশস্ত্র পাহারাদার দেখে মনে হবে তাঁর বাড়িটা কোনও রাজার প্রাসাদ, শুধুমাত্র একজন সওদাগরের বাড়ি নয়।

এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই যে ইংরেজরা বাংলায় বিপ্লব করার ষড়যন্ত্রে উমিচাঁদকে কাজে লাগিয়েছিল। ক্লাইভ বাংলায় আসার আগেই চার্লস এফ. নোবেল (Charles F. Nobel) নামক এক ইংরেজ ফোর্ট সেন্ট জর্জ কাউন্সিলকে জানিয়েছিলেন যে, ‘আমাদের কাজে লাগাবার পক্ষে উমিচাঁদই সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি, যদি তিনি তা করতে ইচ্ছুক হন।’9 উমিচাঁদ অনেকদিন ধরেই মুর্শিদাবাদ দরবার ও ইংরেজ কোম্পানির মধ্যে প্রধান যোগসূত্র ছিলেন।10 তাঁর সঙ্গে দরবারের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল বলে এবং তিনি দরবারের প্রায় সব অমাত্যকেই ঘনিষ্ঠভাবে জানতেন বলেই ইংরেজরা তাঁকে ওয়াটসের সঙ্গে মুর্শিদাবাদ পাঠান। স্ক্রাফ্টন লিখেছেন যে উমিচাঁদ ওয়াটসের অধীনে ইংরেজদের ‘এজেন্ট’ হিসেবে কাজ করতেন।11 ওয়াটস প্রথম থেকেই উমিচাঁদের বুদ্ধিমত্তা ও মুর্শিদাবাদের রাজনীতি সম্বন্ধে তাঁর গভীর জ্ঞানের অনুরক্ত ছিলেন এবং সেজন্য তিনি সবসময় তাঁর সঙ্গে আলোচনা করেই চলতেন। তিনি এটাও বিশ্বাস করতেন যে উমিচাঁদ ইংরেজদের হিত চিন্তায় খুবই নিষ্ঠাবান এবং আগ্রহী ছিলেন। এমনকী তিনি ক্লাইভকে এটা পর্যন্ত লিখেছিলেন যে, ‘কোম্পানির কাজে উমিচাঁদ অক্লান্ত পরিশ্রম করতে দ্বিধা করেন না এবং কোনও ব্যক্তি যদি কোম্পানির অনুগ্রহ লাভের সবচেয়ে যোগ্য হয় তা হলে উমিচাঁদই সেই ব্যক্তি।’12 বস্তুতপক্ষে তিনি মুর্শিদাবাদ দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের হালচাল, তাদের মধ্যে ধূমায়িত অসন্তোষ ইত্যাদি নিয়ে উমিচাঁদের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা করতেন। উমিচাঁদ রোজ দরবারে গিয়ে বিশিষ্ট অমাত্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে তাঁদের সামিল করা যায় কি না তা চেষ্টা করে দেখা।13

উমিচাঁদ চেয়েছিলেন সিরাজদ্দৌল্লার পরিবর্তে ইয়ার লতিফকে নবাব করতে, মীরজাফরকে নয়। সম্ভবত তিনি ভেবেছিলেন, ইয়ার লতিফ দরবারের তেমন জবরদস্ত অমাত্য নন বলে তিনি তাঁকে সহজেই নিজের তাঁবে রাখতে পারবেন। কিন্তু মীরজাফর যেহেতু অমাত্যদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিপত্তিশালী ছিলেন এবং যেহেতু তাঁর সঙ্গে জগৎশেঠদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল, তাই তাঁকে সামলানো উমিচাঁদের পক্ষে সম্ভব হবে না। তা ছাড়া মীরজাফরের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কও খুব একটা ভাল ছিল না। ওয়াটস লিখেছেন: ‘উমিচাঁদ সম্বন্ধে মীরজাফরের খুব একটা ভাল ধারণা নেই কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর ওপরে বিশ্বাস রেখে তাঁকে কাজে লাগানো প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। এতে অবশ্য মীরজাফর বিশেষ আপত্তি করেননি, যদিও উমিচাঁদের প্রতি তাঁর বিরাগ বিন্দুমাত্র কমেনি।’14

কিন্তু ইংরেজরা ইয়ার লতিফের বদলে মীরজাফরকে মসনদে বসাবার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় উমিচাঁদের পরিকল্পনা মাঠে মারা গেল। তিনি দেখলেন নতুন যে ব্যবস্থা হতে যাচ্ছে তাতে তাঁর ভূমিকা হবে নগণ্য এবং তাতে তাঁর লাভও বিশেষ কিছু হবে না। আসলে তাঁর নিজের স্বার্থই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় চিন্তা। তাই তিনি নিশ্চিন্ত হতে চাইছিলেন যে বিপ্লবের পরে নবাবের ধনদৌলতের একাংশ যাতে তিনি আত্মসাৎ করতে পারেন। তিনি ওয়াটসকে জানালেন যে বিপ্লবের পর নবাবের ধনসম্পদের পাঁচ শতাংশ তাঁকে দিতে হবে। ওয়াটসের ধারণা এর পরিমাণ দাঁড়াবে। দুই কোটি টাকা। মুর্শিদাবাদের রাজকোষে তখন চল্লিশ কোটি টাকা ছিল বলে অনুমান করা হয়, যদিও এটা নেহাতই অতিরঞ্জন৷ আবার রায়দুর্লভকে নিজের দলে টানার জন্য উমিচাঁদ দাবি করলেন যে, রায়দুর্লভকেও মীরজাফরের ভাগ থেকে কিছুটা দিতে হবে। এ-সব দেখে ওয়াটস, যিনি এতদিন উমিচাঁদের কাজকর্ম ও সাহায্যের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন, এখন ক্লাইভকে লিখে পাঠালেন: ‘উমিচাঁদের এ-সব দাবির মধ্যে তাঁর উচ্চাভিলাষ, ধূর্ততা ও অর্থলোলুপতার নগ্নরূপ বেরিয়ে পড়ছে। তিনি সব দাবিগুলিই বজায় রাখতে চান, একটি দাবিও ছাড়তে রাজি নন।’15

মীরজাফরও ইংরেজদের সঙ্গে তাঁর চুক্তির মধ্যে উমিচাঁদের প্রাপ্য সম্বন্ধে কোনও উল্লেখ থাকুক তা একেবারেই চাননি এবং তাতে প্রবল আপত্তি জানিয়েছিলেন। জগৎশেঠরাও ওয়াটসকে জানিয়েছিলেন মীরজাফরের সঙ্গে ইংরেজদের চুক্তিতে যেন উমিচাঁদের কথা কিছু না থাকে। ১৭ মে সিলেক্ট কমিটির বৈঠক বসল উমিচাঁদের দাবি সম্পর্কে আলোচনার জন্য এবং তাতে ঠিক হল যে, তাঁর ব্যবহারের জন্য শাস্তি ও অপমানই তাঁর প্রাপ্য, কোনও পুরস্কার নয়। তারপর কমিটি বিবেচনায় বসল:16

উমিচাঁদকে কীভাবে আমরা এমন করে ফাঁকি দেব যে তিনি তা জানতেই পারবেন না, সেটা ভাবতে হবে। একদিকে তাঁর অন্যায় আবদার ও অসঙ্গত দাবিগুলি প্রত্যাখ্যান করলে বা তা মানতে দ্বিধা দেখালে আমাদের বিপদ হওয়ার সম্ভাবনা। অন্যদিকে যে ব্যক্তি আমাদের পরিকল্পিত বিপ্লবে কোনও কাজে লাগবে না, তাঁর অত্যধিক সব দাবি মেনে নেওয়াও অত্যন্ত অনুচিত। কিন্তু তাঁর স্বার্থ আমরা একেবারেই দেখছি না এবং তাঁকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছি, উমিচাঁদের মতো চরিত্রের লোককে এমন ভাব দেখালে তাতে প্ররোচিত করাই হবে এবং সেক্ষেত্রে তিনি আমাদের সর্বনাশ করতে উঠে-পড়ে লাগবেন। তা হলে আমাদের সব পরিকল্পনাই বানচাল হয়ে যাবে।

এ-সব ভেবে কমিটি দুটি চুক্তি করার সিদ্ধান্ত নিল। দুটিতেই মীরজাফর এবং ইংরেজরা সই করবে তবে একটিতে (লাল কাগজ) উমিচাঁদের প্রাপ্যের উল্লেখ থাকবে কিন্তু অন্যটিতে (সাদা কাগজ) তা সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া হবে।17

সেই একই দিনে অর্থাৎ ১৭ মে ওয়াটস ক্লাইভকে লিখলেন যে মীরজাফর তাঁকে জানিয়েছেন, তিনি উমিচাঁদকে বিশ্বাস করবেন না এবং নেহাত প্রয়োজনের খাতিরেই তাঁর সঙ্গে বাহ্যত ভাব দেখিয়ে যাবেন।18 আসলে ততদিনে উমিচাঁদের প্রতি ইংরেজদের মনোভাব পুরোপুরি পাল্টে গেছে। তারা এখন তাঁকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ‘ভিলেন’ হিসেবে গণ্য করতে শুরু করেছে এবং সন্দেহ করতে আরম্ভ করেছে যে তিনি একজন ‘আদি ও অকৃত্রিম দুর্জন’। তাই তারা ঠিক করল যে বিপ্লব একবার সফল হয়ে গেলে তাঁর সঙ্গে ‘যথোপযুক্ত’ ব্যবহার করা হবে। ক্লাইভ ওয়াটসকে পরামর্শ দিলেন, উমিচাঁদকে মিষ্টি কথায় তোষামোদ করে আপাতত কার্যোদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত ভলিয়ে ভালিয়ে রাখতে।19 ওয়াটসও তাঁর দিক থেকে ক্লাইভকে জানালেন যে তিনি যেভাবে উমিচাঁদকে প্রতারিত করার মতলব করেছেন, হয় সেটাই করা হোক কিংবা এমন ভাব দেখানো হোক যে, ‘আমরা আমাদের পরিকল্পনা সম্পূর্ণ বাতিল করে দিয়েছি যাতে উমিচাঁদকে আমাদের গোপন কাজকর্ম থেকে দূরে রাখা যায়।’20 কিন্তু ইংরেজদের গায়ে জ্বালা ধরিয়ে উমিচাঁদ পলাশিতে গিয়ে দুর্লভরামের সঙ্গে দেখা করেন এবং ইংরেজদের অভিসন্ধি সম্বন্ধে তাঁকে সতর্ক করে দেন। এতে ওয়াটস ভীষণ মুষড়ে পড়েন কারণ তিনি ভেবেছিলেন যে এই সাক্ষাতের ফলে ‘আমাদের সঙ্গে মীরজাফরের যে পরিকল্পনা’ তা ভেস্তে গেল। এর ক’দিন পর রায়দুর্লভ মুর্শিদাবাদ ফিরলে তাঁকে যখন মীরজাফরের সঙ্গে ইংরেজদের চুক্তিপত্রটি দেখানো হল তখন তিনি তাতে যে টাকাকড়ি, লেনদেনের ব্যাপার ছিল তা নিয়ে প্রবল আপত্তি জানালেন। ওয়াটসের ধারণা, পলাশিতে রায়দুর্লভের সঙ্গে উমিচাঁদের শলাপরামর্শের ফলেই রায়দুর্লভ এরকম করলেন।21 মীরজাফর চুক্তি স্বাক্ষর করার পরদিন ওয়াটস লেখেন যে, রায়দুর্লভ স্বীকার করেছেন উমিচাঁদ তাঁর কানে বিষমন্ত্র দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন এবং তাঁকে বলেছিলেন যে, একবার ইংরেজরা মুর্শিদাবাদ পৌঁছুলে তিন বছরের আগে তারা সেখান থেকে নড়বে না। তিনি সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলেন যে ‘আমাদের ব্যাপারটা কাচিয়ে দিতে ওই ধূর্ত সাপ [উমিচাঁদ] কোনও কিছুই করতে বাকি রাখেনি।’22

ওয়াটসের ধারণা, উমিচাঁদ যখন বুঝতে পারলেন যে তাঁর বিপদের সম্ভাবনা নেই তখন তিনি বিপ্লবের পরিকল্পনার কথা ফাঁস করে দেন এবং তা ওয়াটস, মীরজাফর এবং অন্যদের একবারে চরম পরিণতির মুখে প্রায় ঠেলে দিয়েছিল।23 উমিচাঁদ সিরাজদ্দৌল্লার কাছে ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস করে দিয়েছিলেন কি না তা সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে সম্ভবত তিনি ইংরেজদের ভয় দেখিয়েছিলেন, তারা যদি তাঁকে পরিত্যাগ করে তা হলে তিনি নবাবের কাছে ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস করে দেবেন। তিনি সত্যিই তা আদৌ করতেন কি না সেটা অন্য প্রশ্ন—ফাঁস করে দেওয়ার ভয় দেখানোটাই ইংরেজদের পক্ষে বিপজ্জনক ছিল। সিরাজদ্দৌল্লা যদি কোনও বিশ্বস্তসূত্রে চক্রান্তের কথা জানতে পারতেন, তা হলে তিনি অবশ্যই মীরজাফরকে খতম করে দিতেন এবং খুব সম্ভবত ফরাসিদের সঙ্গে মিলে ইংরেজদের সঙ্গে মোকাবিলা করতেন। উমিচাঁদের দিক থেকে এ সময় ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস করে দেওয়ার কোনও যৌক্তিকতা দেখা যায় না কারণ তাতে তাঁর পক্ষে নবাবের কাছ থেকে নগদ টাকাকড়ি বা পারিতোষিক পাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই ছিল না। অন্যদিকে নবাবকে ষড়যন্ত্রের কথা জানাতে গেলে তিনি যে নিজেই এতে জড়িত ছিলেন সেটা বেরিয়ে পড়ত এবং তা হলে তিনি নবাবের রোষানলে পড়তেন। তাঁর পক্ষে সবচেয়ে নিরাপদ পন্থা ছিল, ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা এবং বিপ্লব সফল হলে তিনি লাভবান হচ্ছেন কি না সেটা দেখা।

ষড়যন্ত্র যখন পাকা হতে চলেছে তখন (৫ জুন) কলকাতায় এটা নিয়ে কানাকানি শুরু হয়ে গেল এবং মুর্শিদাবাদে ৭ জুন নাগাদ এ-খবর ছড়িয়ে পড়ে।24 ওয়াটস মুর্শিদাবাদ ছাড়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়লেন কিন্তু পাছে উমিচাঁদ ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস করে দেন, সেই ভয়ে তাঁকে ওখানে রেখে তিনি পালাতে পারছিলেন না। তাই ঠিক হল, বিপ্লবের পরে উমিচাঁদকে মুর্শিদাবাদে ইংরেজদের প্রধান এজেন্ট করা হবে— এ-আশ্বাস দিয়ে স্ক্র্যাফ্টন তাঁকে কলকাতা নিয়ে যাবেন। এভাবে স্ক্র্যাফ্টন উমিচাদঁকে নিয়ে কলকাতা পৌঁছুলেন ৮ জুন।

মীরজাফরকে মসনদে বসাবার পর জগৎশেঠের বাড়িতে যখন মিটিং শেষ হল তখন স্ক্র্যাফ্‌টন উমিচাদঁকে জানালেন, লাল কাগজের চুক্তি আসলে একটি ভাঁওতা এবং উমিচাঁদ একেবারে কিছুই পাবেন না। রবার্ট ওরম লিখেছেন, এ-কথা শুনে উমিচাঁদের মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল এবং তিনি মূৰ্ছা গেলেন। তাঁর রক্ষীরা তাকে ধরে না ফেললে তিনি মাটিতে পড়ে যেতেন। তিনি আরও বলছেন যে, এর পর উমিচাঁদ একদম পাগল হয়ে গেলেন।25 কিন্তু এটা সত্য বলে মনে হয় না। কারণ এর পরেও উমিচাঁদ সুস্থ শরীরে এবং বহাল তবিয়তে থেকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে নানা চক্রান্ত করার চেষ্টা করেছেন। ক্লাইভ তাঁকে কোম্পানিকে সোরা সরবরাহ করার একচেটিয়া অধিকার দিতে চেয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও তিনি ষড়যন্ত্র করার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।

ক্লাইভ লন্ডনের সিক্রেট কমিটিকে লিখেছিলেন (৬ আগস্ট ১৭৫৭):26

উমিচাঁদ ওয়াটসের সঙ্গে মিলে বেশ ভাল কাজই করছিলেন কিন্তু আমার মনে হয় নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ধূর্ততার সঙ্গে অনেক কুকর্মও করার চেষ্টা করেছেন। তাই আমি তীর্থ করতে তাঁকে মালদহে যেতে পরামর্শ দিলাম। ঠিকমতো চালাতে পারলে এঁকে দিয়ে অনেক কাজ করানো যাবে। সে কারণে এঁকে পুরোপুরি পরিত্যাগ করাটা ঠিক হবে না।

তবে এর পরে উমিচাঁদ বেশিদিন বাঁচেননি। সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে ইংরেজদের ষড়যন্ত্রে তিনি অনেক সাহায্য করেছিলেন। তা সত্ত্বেও ইংরেজরা তাঁকে শেষপর্যন্ত প্রতারিত করায় নিদারুণ আশাহত হয়েই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. কুমকুম চ্যাটার্জী বলছেন (পৃ. ১০৩) যে উমিচাঁদ ইংরেজদের সঙ্গে মিলে পলাশি চক্রান্তের সূত্রপাত করেননি। কিন্তু আমরা এখানে যেসব তথ্যপ্রমাণ দিয়ে বিশ্লেষণ করেছি তাতে তাঁর বক্তব্য অসার প্রমাণিত হয়।
  2. Fort William Consultations, Fulta, 7 Oct. 1756; Bengal Secret and Military Consults. (Select Committee Consults.) Range A, vol. I.
  3. ক্লাইভকে লেখা উমিচাঁদের চিঠি, ২৮ জানুয়ারি ১৭৫৭, Hil, II, p. 174.
  4. উমিচাদকে লেখা ক্লাইভের চিঠি, ৯ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, p. 174.
  5. ওয়াটসকে লেখা সিলেক্ট কমিটির চিঠি, ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, p. 225.
  6. বিস্তারিত বিবরণের জন্য আমার বই From Prosperity to Decline, পৃ.১১৬-২০।
  7. ঐ।
  8. Orme, Military Transactions, vol. II, pp. 50-51.
  9. ফোর্ট সেন্ট জর্জ কাউন্সিলকে লেখা চার্লস এফ নোবেলের চিঠি, ২২ সেপ্টেম্বর ১৭৫৬, Hill, III, p. 328।
  10. Eur. Mss. D. 283, f. 29; কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা হলওয়েলের চিঠি, ৩০ নভেম্বর ১৭৫৬, Hill, II, p. 21.
  11. Scrafton, Reflections, p. 81.
  12. ক্লাইভকে লেখা ওয়াটসের চিঠি, ২৬ মার্চ ১৭৫৭, Hill, II, p. 294.
  13. Orme, Military Transactions, vol. II, Sec. I, p. 148.
  14. Watts’ Memoirs, p. 94.
  15. ক্লাইভকে ওয়াটস, ১৪ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 381. ওয়াটস লিখেছেন যে ‘সব শুনে মনে হয় নবাবের ধনসম্পদের পরিমাণ ৪০ কোটি টাকার মতো। ক্লাইভকে ওয়াটসের চিঠি, ৩ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 397.
  16. Hill, II, p. 382.
  17. Proceedings of the Select Committee, 17 May 1757, Hill, II, p. 383.
  18. ক্লাইভকে ওয়াটস, ১৭ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 386.
  19. ওয়াটসকে ক্লাইভ, ১৯ মে ১৭৫৭, Hill, II, pp. 388-89.
  20. ক্লাইভকে ওয়াটস, ২৩ মে ১৭৫৭, Hill, If, p. 393.
  21. ক্লাইভকে ওয়াটস, ৩ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 397.
  22. Watts’ Memoirs, p.97; ক্লাইভকে ওয়াটস, ৬ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 400.
  23. Watts’ Memoirs, p. 98.
  24. ওয়াটসকে ক্লাইভ, ৫ জুন ১৭৫৭, Hil, II, p. 398; ওয়াটস ক্লাইভকে, ৭ জুন ১৭৫৭, Hill, II, P. 400.
  25. Orme, Military Transactions, vol. II, Sec. I, p. 154.
  26. লন্ডনের সিক্রেট কমিটিকে ক্লাইভের চিঠি, ৬ আগস্ট ১৭৫৭, Hill, II, p. 465.