জগৎশেঠ
পলাশি চক্রান্তে দেশীয় ষড়যন্ত্রীদের মধ্যে জগৎশেঠরাই মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন।1 বস্তুতপক্ষে সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে নবাব হওয়ার দুই প্রতিযোগী, ইয়ার লতিফ খান ও মীরজাফর, শেঠদেরই লোক ছিলেন। কিন্তু যেহেতু ইয়ার লতিফের তুলনায় মীরজাফর অনেক বেশি ক্ষমতাবান এবং শেঠদের অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলেন, সেজন্য ইংরেজরা লতিফকে বাদ দিয়ে মীরজাফরের দিকে ঝুঁকেছিল কারণ তারা জানত, জগৎশেঠদের সক্রিয় সমর্থন ছাড়া পলাশি বিপ্লব সম্ভব হবে না। সেজন্য চন্দননগর পতনের আগেই, চক্রান্ত যখন কোনও রূপই নেয়নি, কলকাতা থেকে সিলেক্ট কমিটি ওয়াটসকে লিখেছিল ‘জগৎশেঠ পরিবার যাতে আমাদের পক্ষে থাকে’ তার জন্য সচেষ্ট থাকতে।2 আবার এপ্রিলের শেষদিকে যখন ষড়যন্ত্র বেশ কিছুটা রূপ নিয়েছে তখন ক্লাইভ মাদ্রাজের গভর্নর পিগটকে লিখলেন: ‘নবাবের বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র হচ্ছে, এর মধ্যে অনেক গণ্যমান্য লোক আছেন এবং এদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন জগৎশেঠ।3 বাংলায় রাজনৈতিক পালাবদল করতে গেলে শেঠদের সাহায্য ও সহযোগিতা যে কতটা প্রয়োজনীয় তা বোঝাতে গিয়ে তিনি লিখেছেন: ‘তিনটি সুবার মধ্যে জগৎশেঠই হচ্ছেন সবচেয়ে ধনী ও প্রতিপত্তিশালী। দিল্লির মুঘল দরবারেও তাঁর যথেষ্ট প্রভাব। সুতরাং এখানকার ব্যাপারে কিছু করতে হলে যোগ্যতম ব্যক্তি হিসেবে তাঁর সাহায্যই সবচেয়ে জরুরি।’4 পলাশির ষড়যন্ত্রে জগৎশেঠদের ভূমিকা এতই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে বিপ্লবের কুড়ি বছর পরেও ফরাসি অধিকৃত পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের গভর্নর ল’ দ্যা লরিস্টন (Law de Lauriston) ১৭৭৭ সালে লিখেছেন যে ষড়যন্ত্রে জগৎশেঠরা সক্রিয় অংশ না নিলে বাংলায় বিপ্লব সম্ভব হত না।5
শেঠ পরিবার রাজস্থানের মাড়ওয়ার অঞ্চলের নাগর থেকে সপ্তদশ শতকের শেষদিকে বাংলায় আসেন। এই পরিবারের মানিকচাঁদ ও তাঁর পুত্র ফতেচাঁদের সময় এঁদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিপত্তি এতই প্রসার লাভ করে যে মুঘল সম্রাট ১৭২২ সালে ফতেচাঁদকে জগৎশেঠ বা ‘দুনিয়ার ব্যাঙ্কার’ উপাধিতে ভূষিত করেন এবং এই উপাধি হয় বংশানুক্রমিক। জগৎশেঠ ফতেচাঁদের আমলেই শেঠদের ক্ষমতা ও প্রভাব তুঙ্গে ওঠে। প্রায় তিন দশক ধরে বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করে ১৭৪৪ সালে ফতেচাঁদ দেহরক্ষা করেন। এরপর তাঁর দুই নাতি, জগৎশেঠ মহতাব রায় ও মহারাজ স্বরূপচাঁদ, শেঠ পরিবারের অধিকর্তা হন এবং পলাশির ষড়যন্ত্রে দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে মুখ্য ভূমিকা নেন।6 এঁদের প্রচণ্ডরকমের অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও তার ফলে অপরিসীম রাজনৈতিক প্রভাবের উৎস ছিল নানা উপায়ে ধনোপার্জন। বাদশাহি টাঁকশালে মুদ্রা তৈরি করার কার্যত একচেটিয়া অধিকার ছিল তাঁদের; প্রদেশের দুই-তৃতীয়াংশ রাজস্ব আদায়ের ভারও ছিল তাঁদের ওপর; তা ছাড়া বাংলায় বিভিন্ন রকমের মুদ্রার বিনিময় এবং বাট্টা ও সুদের হার নির্ধারণও করতেন তাঁরাই। এ-সব ছাড়া চড়া সুদে টাকা ধার দেওয়ার মহাজনি ব্যবসাও ছিল তাঁদের। এ সমস্ত বিভিন্নসূত্রে জগৎশেঠদের প্রচুর উপার্জন হত।
রবার্ট ওরম ১৭৫০-এর দশকের প্রথমদিকে বাংলায় ছিলেন। তিনি লিখেছেন যে ‘আমার জানা পৃথিবীতে জগৎশেঠরাই সর্বশ্রেষ্ঠ সরাফ (sarraf) ও ব্যাঙ্কার।’7 তখন কলকাতায় বসবাসকারী অন্য একজন ইংরেজ, ক্যাপ্টেন ফেনউইক (Fenwick), বলছেন, ‘লন্ডনের লম্বার্ড [Lombard] ষ্টিটের [যেখানে সব ব্যাঙ্কারদের অফিসকাছারি ছিল] সমস্ত ব্যাঙ্কারকে যোগ করলেও জগৎশেঠ মহতাব রায়ের সমকক্ষ হবে না।’8 ১৭৫৭ সালে স্ক্র্যাফ্টন ক্লাইভকে লিখেছিলেন: ‘একদিক থেকে জগৎশেঠরাই [নবাবি] সরকারের ব্যাঙ্কার, রাজস্বের দুই-তৃতীয়াংশ তাঁদের ঘরেই জমা পড়ে। কোনও ব্যবসায়ী যেমন ব্যাঙ্কের ওপর ড্রাফট দিয়ে থাকেন ঠিক তেমনিভাবেই নবাব সরকার এঁদের [জগৎশেঠদের] ওপরই ড্রাফট দেন।’9 জাঁ ল’-ও জগৎশেঠদের মুঘল সাম্রাজ্যের ব্যাঙ্কার হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং তাঁদের মতো এত ধনী এবং ক্ষমতাবান ব্যক্তি আর দেখা যায়নি বলে মত ব্যক্ত করেছেন।10 অন্যদিকে উইলিয়াম ওয়াটস লিখেছেন, জগৎশেঠরা সমগ্র হিন্দুস্থানের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাঙ্কার এবং বাংলায় নবাবের পরেই তাঁদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা।11
বস্তুতপক্ষে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধের পুরো সময়টাই জগৎশেঠরা মুর্শিদাবাদ দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তাঁরা বাংলার প্রশাসনে ও অর্থনীতিতে এমন প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করেছিলেন যা এর আগে কেউ কখনও করতে পারেনি। এ-কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, জগৎশেঠ ফতেচাঁদের সময় থেকে বাংলায় যে কোনও রাজনৈতিক পালাবদলে জগৎশেঠরাই মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। দিল্লির মুঘল দরবারের সঙ্গেও তাঁদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।12 জগৎশেঠরাই ছিলেন বাংলার রাজনীতির আসল ভাগ্যনিয়ন্ত্রক। জাঁ ল’ লিখছেন, ‘জগৎশেঠ পরিবারই আলিবর্দির আমলে শাসন চালাতেন এবং অনেকদিন ধরে এঁরাই বাংলার রাজনৈতিক বিপ্লবের প্রধান হোতা ছিলেন।’13
পলাশি প্রসঙ্গে জাঁ ল’-র যা বক্তব্য—দেশীয় ষড়যন্ত্রীদের মধ্যে শেঠরাই পলাশি চক্রান্ত ও বিপ্লবের মূল উদ্যোক্তা, এবং এঁদের সম্মতি ও সহযোগিতা ছাড়া ইংরেজরা যা করেছে তা কখনও করতে পারত না—বেশ সমীচীন বলেই মনে হয়।14 তবে তাঁরা পর্দার অন্তরাল থেকেই কলকাঠি নাড়ছিলেন। বিপ্লব সফল হওয়ার পরই শুধু নিজেদের মুখোশ খুলে ফেলেছিলেন। জাঁ ল’ হয়তো ঠিকই বলেছেন, হিন্দু বলে শেঠরা আগেভাগে প্রকাশ্যে ষড়যন্ত্রে যোগ দিয়ে নিজেদের বিপদ ডেকে আনতে চাননি। তিনি আরও জানাচ্ছেন যে তাঁরা সম্ভবত ইউরোপীয়দের সাহায্য ছাড়াই সিরাজদ্দৌল্লাকে মসনদ থেকে হঠিয়ে অন্য কাউকে নবাব করতে পারতেন। তবে তার জন্য তাদের অনেক সময়ের প্রয়োজন হত। ইংরেজদের পক্ষে কিন্তু দেরি করা পোষাত না। তিনি এটাও বলছেন যে শেঠদের স্বার্থ ও ইংরেজদের স্বার্থ এক হয়ে গেছল এবং তাঁদের মতো প্রভাবশালী লোকদের পক্ষে, বিশেষ করে যখন ইংরেজরা তাদের সঙ্গে সামিল হয়েছিল, বিপ্লব ঘটাতে বিশেষ কোনও অসুবিধে হত না।15 এখানে বলা প্রয়োজন যে ল’-র উপরোক্ত বক্তব্য সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ আছে, এটা তাঁর অত্যুক্তি। মনে হয় এটা বলে তিনি তাঁর নিজের ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা করেছেন কারণ তিনি বলছেন যে অন্য কারও চাইতে শেঠরাই ইংরেজদের বেশি সাহায্য করতে পারতেন যেহেতু ইংরেজদের সঙ্গে তাঁদেরই সবচেয়ে বেশি ব্যবসায়িক যোগ ছিল। কিন্তু আমরা পরে দেখতে পাব যে, জগৎশেঠদের সম্পদ পুঞ্জীভবনের প্রধান উৎস মোটেই ইউরোপীয়দের বা ইংরেজদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য নয় এবং তাদের মধ্যে সম্পর্কও সবসময় হৃদ্যতাপূর্ণ ছিল না। শেঠরা অনেক ব্যাপারে একচেটিয়া অধিকার অর্জন করে ইংরেজদের ব্যবসা-বাণিজ্যে নানা বাধার সৃষ্টি করেছিলেন।
তবে এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই যে নিজেদের ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থে ইংরেজরা ও শেঠরা পলাশি চক্রান্তে হাত মিলিয়েছিলেন—উভয়েরই লক্ষ্য ছিল এক, সিরাজদ্দৌল্লাকে মসনদ থেকে হঠানো। তরুণ নবাব ইংরেজদের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিলেন কারণ তিনি তাদের বেআইনি ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য ও দস্তকের যথেচ্ছ অপব্যবহার বন্ধ করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। শেঠরা ভয় পেয়েছিলেন যে সিরাজদ্দৌল্লা তাঁদের সম্পদ পুঞ্জীভবনের উৎসগুলি বন্ধ করে দেবেন। এ-প্রসঙ্গে জাঁ ল’-র বক্তব্য যে, শেঠদের ধনসম্পদই সিরাজের লক্ষ্য ছিল—এখন হোক বা পরে তিনি তাঁদের সম্পদ কেড়ে নিতেন—তা যুক্তিগ্রাহ্য বলে মনে হয় না।16 ওয়াটস বা স্ক্র্যাফ্টন, যাঁরা মুর্শিদাবাদ দরবারের সব খোঁজখবর রাখতেন, তাঁদের কেউই এরকম কোনও ইঙ্গিত পর্যন্ত দেননি। এমনকী কোনও ইংরেজি বা ইউরোপীয় নথিপত্রেও এমন কোনও তথ্য নেই যা থেকে প্রমাণ করা যায় যে, শেঠরা তাঁদের ধনসম্পদ বাঁচাবার জন্যই সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে গিয়েছিলেন। শেঠরা সিরাজকে কেন হঠাতে চেয়েছিলেন তার অন্য একটি কারণও দেখানো হয়ে থাকে। বলা হয় যে নবাব তাঁর পুর্ণিয়া অভিযানের জন্য জগৎশেঠকে সওদাগর ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তিন কোটি টাকা জোগাড় করতে বলেন। জগৎশেঠ এ-ব্যাপারে তাঁর অক্ষমতা জানালে সিরাজ নাকি তাঁকে প্রকাশ্য সভায় চড় মারেন। এটা নেহাতই গুজবের ওপর ভিত্তি করা বাজারে গল্প, এর সত্যতার কোনও প্রমাণ নেই।17
এই আজগুবি গল্পের উৎস হল কোম্পানির সার্জন উইলিয়াম ফোর্থ (Forth)। কোম্পানির বাণিজ্য সংগঠনে বা প্রশাসনে সার্জনের গুরুত্ব একেবারেই নগণ্য। ফোর্থ ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখেন যে ডাচ কোম্পানির প্রধান বিসডম (Bisdom) তাঁকে খবর দেন ব্যাপারটা কাউন্সিলকে জানাবার জন্য।18 এখানে প্রশ্ন, বিসডম এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা খবর সোজাসুজি কলকাতায় কোম্পানির প্রেসিডেন্ট বা ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে না জানিয়ে ফোর্থের মতো নগণ্য এক সার্জনকে জানাতে গেলেন কেন? দ্বিতীয়ত, বিসডমের ডায়েরি বা ডাচ রেকর্ডে কোথাও এ-ঘটনার বিন্দুমাত্র উল্লেখ নেই। তৃতীয়ত, গল্পটা সত্য হলে, তখনকার ফারসি ইতিহাসগুলিতে এমন রসালো গল্প অবশ্যই স্থান পেত। বিশেষ করে ওই ঐতিহাসিকেরাই যেখানে সিরাজদ্দৌল্লার খুঁত বার করতে ব্যস্ত। তা ছাড়া যে দু’জন ইংরেজ—ওয়াটস ও স্ক্র্যাফ্টন এবং একজন ফরাসি জাঁ ল’, দরবারের হাঁড়ির খবর রাখতেন, তাঁদের মধ্যে কেউই এ-ঘটনার কথা উল্লেখ পর্যন্ত করেননি। সর্বোপরি, যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, সে সময় সিরাজদ্দৌল্লা ‘প্রভূত অর্থশালী’ এবং তাঁর ‘রাজকোষ পরিপূর্ণ’। এ-কথা জানিয়েছেন গোলাম হোসেন, জাঁ ল’, ওয়াটস ও স্ক্র্যাফ্টনের মতো ব্যক্তিরা।19 এ-সব বিবেচনা করে তাই বলা যায় যে জগৎশেঠকে চড় মারার গল্প আজগুবি ছাড়া আর কিছু নয়।
আসলে সিরাজদ্দৌল্লা প্রথম থেকেই শেঠদের প্রতি বিরূপ ছিলেন না এবং সিংহাসনে আরোহণ করার পরেই তাঁদের নিজের আস্থাভাজন করে নেন। এটা যে তার সঠিক প্রমাণ, সিরাজ আলিবর্দির বিধবা পত্নীর সঙ্গে জগৎশেঠ মহতাব রায়কে ঘসেটি বেগমের কাছে পাঠিয়েছিলেন যাতে বেগম নবাবের বশ্যতা স্বীকার করে নেন।20 আবার শেঠদের গোমস্তা রঞ্জিত রায়ই আলিনগরের চুক্তি সম্পাদনে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন।21 আসলে তখনও পর্যন্ত ইংরেজদের প্রতি জগৎশেঠদের মনোভাব খুব অনুকূল ছিল না। তাঁরা বরং তখন নবাবের প্রতিই সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন। জগৎশেঠ নিজেই এ সময় জানিয়েছিলেন যে তরুণ নবাবের ওপর তাঁর যথেষ্ট প্রভাব আছে। এ-প্রসঙ্গে তিনি ১৪ জানুয়ারি ১৭৫৭-তে ক্লাইভকে যা লিখেছিলেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ:22
আপনি লিখেছেন যে আমি যা বলি নবাব তা শোনেন এবং আমি যেন কোম্পানির এবং বাংলার হিতার্থে নিজেকে নিয়োগ করি। আমি একজন ব্যবসায়ী এবং সম্ভবত আমি যা বলব নবাব তা শুনবেন। তবে আপনারা যা করেছেন তা মোটেই উচিত হয়নি। যুদ্ধ করে কলকাতা পুনর্দখল করেছেন এবং তারপর হুগলি শহর ধ্বংস করেছেন। মনে হয় আপনারা যুদ্ধ ছাড়া অন্য কিছুতে [আপস আলোচনায়] আগ্রহী নন। যদি তা হয় তা হলে আমি কীভাবে নবাব এবং আপনাদের মধ্যে একটা সমঝোতার ব্যবস্থা করব? আপনাদের উপরোক্ত শত্রুতামূলক কাজকর্ম দেখে আপনাদের আসল উদ্দেশ্য বোঝা মুশকিল। এ-সব বন্ধ করুন এবং আপনাদের কী কী দাবি আমাকে জানান। তা হলে আপনারা আমার ওপর আস্থা রাখতে পারেন যে আমি নবাবের সঙ্গে আমার হৃদ্যতা কাজে লাগিয়ে এ-সব সমস্যার সমাধান করতে পারব। আপনারা কী করে আশা করেন যে দেশের রাজা বা সর্বময় কর্ণধারের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে আপনারা যে আচরণ করেছেন তা নবাব অগ্রাহ্য করবেন বা চোখ বুজে সহ্য করবেন?23
খুব সম্ভবত জগৎশেঠরা ইংরেজদের কলকাতা পুনরুদ্ধার ও চন্দননগর আক্রমণের মধ্যবর্তী কোনও সময় থেকে নবাবের প্রতি তাঁদের মনোভাব বদলাতে শুরু করেন। তাঁরা যখন দেখলেন যে নবাব একদিকে মোহনলাল, মীর মর্দান, খাজা আবদুল হাদি খানকে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করছেন এবং অন্যদিকে মীরজাফর, হাকিম বেগ প্রভৃতি পূর্বতন নবাবের বিশ্বাসভাজন অমাত্যকে দায়িত্বপূর্ণ পদ থেকে সরিয়ে দিচ্ছেন, এমনকী রায়দুর্লভ রামের ক্ষমতাও খর্ব করছেন, তখন তাঁরা ভয় পেলেন যে তরুণ ও বেপরোয়া এই নবাব এবার তাঁদের সম্পদ আহরণের পথগুলি রুদ্ধ করে দেবেন। পূর্বতন নবাবদের কাছ থেকে প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে তাঁরা এ-সব সুযোগসুবিধেগুলি পেয়ে এসেছেন। তাই সিরাজদ্দৌল্লা এগুলি কেড়ে নিতে পারেন ভেবে তাঁরা ভয় পেয়ে যান এবং তাঁকে মসনদ থেকে হঠাবার জন্যে তাঁরা ধীরে ধীরে ষড়যন্ত্রে যোগ দেন। এটাই যে আসল ঘটনা সিয়র-এর লেখকও তার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন যে সিরাজদ্দৌল্লা মুর্শিদাবাদের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের (জগৎশেঠরা অবশ্যই তাদের অন্যতম) ‘ভালভাবে কাজে’ লাগাননি। জাঁ ল’ অভিযোগ করেছেন, সিরাজদ্দৌল্লা জগৎশেঠদের প্রতি কোনওরকম সৌজন্য দেখাননি কিংবা তিনি প্রায়ই তাদের অসম্মান ও অবজ্ঞা করতেন, এমনকী তিনি তাঁদের ছুন্নত (circumcision) করার ভয় দেখাতেন।24 এ-সব অভিযোগগুলিই কিন্তু অসার। রবার্ট ওরম পরিষ্কার জানাচ্ছেন সিরাজ জগৎশেঠদের সঙ্গে সৌজন্যমূলক ব্যবহারই করতেন।25 সমসাময়িক নথিপত্রের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করে বলা যায় যে সিরাজদ্দৌল্লা জগৎশেঠদের সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ ব্যবহার করতেন এবং সব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তাঁদের পরামর্শ নিতেন। এমনকী ল’ পর্যন্ত স্বীকার করেছেন যে ‘আলিনগরের সন্ধির পর থেকে নবাব জগৎশেঠদের প্রতি ভদ্র এবং বিনম্র ব্যবহার করেছেন এবং প্রতিটি ব্যাপারে তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন।’ অবশ্য তিনি সঙ্গে সঙ্গে এটাও জানিয়েছেন, ‘আসলে এ-সব নবাবের ছলচাতুরি এবং ভেতরে ভেতরে তিনি শেঠদের ধ্বংস করার মতলব করছিলেন। ওদিকে শেঠরাও বিরাট পরিকল্পনা (Grand Project) নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন এবং তা হচ্ছে মসনদ থেকে সিরাজদ্দৌল্লার অপসারণ।’26 সম্ভবত নবাব এবং শেঠরা পরস্পরের প্রতি তখন অবিশ্বাস পোষণ করছিলেন কিন্তু কেউই তা বাইরে প্রকাশ করতে চাননি। নবাব হয়তো শঙ্কিত হচ্ছিলেন যে তাঁর চারদিকে বিশ্বাসঘাতকতার জাল ছড়িয়ে পড়ছে। তাই কাউকে তিনি পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। অন্যদিকে শেঠরা বাইরে চুপচাপ থাকতে চাইছিলেন যাতে নবাব তাঁদের প্রতি বেশি বিরূপ না হন আর ওদিকে তলায় তলায় চক্রান্তের ব্যাপারে সাহায্য করে যাচ্ছিলেন।27
জাঁ ল’-র লেখা থেকেই প্রমাণিত হয় যে মুর্শিদাবাদ থেকে তাঁর বিতাড়নের আগে (১৬ এপ্রিল ১৭৫৭) পর্যন্ত সিরাজদ্দৌল্লা ও শেঠরা পরস্পরের প্রতি প্রকাশ্যে কোনও বিরূপতা দেখাননি। ল’ যখন এ সময় জগৎশেঠদের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের জিজ্ঞেস করেন, তাঁরা কেন ফরাসিদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের সাহায্য করছেন তখন তাঁরা তা অস্বীকার করেন এবং তাঁকে আশ্বস্ত করেন যে তিনি যদি কোনও সাহায্য চান তা হলে তাঁরা তা নবাবকে জানাবেন। ল’ তখন তাঁদের অনুরোধ করেন তাঁরা যেন নবাবকে বোঝান যে ইংরেজদের চন্দননগর আক্রমণ আটকাতে সেখানে নবাবি সৈন্য পাঠানো জরুরি হয়ে পড়েছে।28 এ থেকে বোঝা যায় তখনও পর্যন্ত ল’র বিশ্বাস ছিল যে নবাবের সঙ্গে শেঠদের সম্পর্ক ভালই ছিল। সিরাজের দিক থেকে বলা যায় যে তিনি তখনও পর্যন্ত শেঠদের ওপর আস্থা সম্পূর্ণ বিসর্জন দেননি শেঠদের সঙ্গে সাক্ষাতের পরদিন সকালে ল’ নবাবের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কথা জানান। তিনি এটাও বললেন যে অন্যান্যদের সঙ্গে জগৎশেঠরাও এই চক্রান্তে সামিল হয়েছেন, কিন্তু বেচারি নবাব তাতে হো হো করে হেসে উঠলেন যেন ল’ আষাঢ়ে গল্প বলছেন।29 সম্ভবত জগৎশেঠ তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন এমন একটা আন্দাজ সিরাজ করতে পেরেছিলেন কিন্তু তাঁর পক্ষে ওরকম সংকটময় মুহূর্তে শেঠদের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে গিয়ে ব্যাপারটাকে আরও জটিল করে তুলতে চাননি। এমনও হতে পারে যে, তিনি তখনও পর্যন্ত ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে পারেননি কারণ ষড়যন্ত্র তখনও পূর্ণ রূপ নেয়নি এবং শেঠরা তখনও পর্যন্ত মাঠের বাইরেই অপেক্ষা করছিলেন আর পর্দার অন্তরাল থেকেই কলকাঠি নাড়ছিলেন।
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
- অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে জগৎশেঠদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য আমার বই From Prosperity to Decline, পৃ. ১০৯-১১৬ দ্রষ্টব্য।
- উইলিয়াম ওয়াটসকে সিলেক্ট কমিটি, ১৪ মার্চ ১৭৫৭, Ome Mss., India V,f. 1275; O.V .170, p. 397.
- পিগটকে লেখা ক্লাইভের চিঠি, ৩০ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 368.
- সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভ, ৩০ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 437.
- C. A. Bayly, Paris Lectures, p. 18.
- S, Chaudhury, From Prosperity to Decline, p. 110.
- Orme Mss., India VI, f. 1455.
- ঐ, পৃ. ১৫২৫.
- Orme Mss., India, XVIII, f. 504.
- Law’s Memoir, Hill, III, P. 185.
- Watts’ Memoirs, p. 28.
- Hunter, Statistical Account, vol. IX, p. 254.
- Law’s Memoir, Hill, III, p. 175.
- কুমকুম চ্যাটার্জী লিখেছেন যে (পৃ. ১০৩) ১৭৫৭-র ঘটনাবলীর সঙ্গে ১৭২৭ এবং ১৭৪০-এ বাংলায় জগৎশেঠদের নেতৃত্বে যে দুটি বিপ্লব সংগঠিত হয়, তার কোনও তফাত নেই। ১৭৫৭ সালে একমাত্র নতুন জিনিস হচ্ছে ইংরেজদের উপস্থিতি। এটা সমস্ত ব্যাপারটাকে অতি সরলীকরণের প্রচেষ্টা। মধ্য অষ্টাদশ শতকে বাংলায় ইংরেজ ও ফরাসিদের সবল উপস্থিতি এবং বাংলার রাজনীতিতে উভয়ের সক্রিয় অংশ নেওয়ার ফলে আগের তুলনায় পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়ে পড়েছিল। পলাশির ষড়যন্ত্রে ইংরেজরা মুখ্য ভূমিকা না নিলে জগৎশেঠরা বিপ্লব করতে রাজি হত কি না সে-বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে, বিশেষ করে একদিকে যখন সিরাজদৌল্লার সঙ্গে ফরাসিদের আঁতাতের সম্ভাবনা ছিল এবং অন্যদিকে মোহনলাল, মীর মর্দান, আব্দুল হাদি খানের মতো নবাবের অনুগত গোষ্ঠীর একটি দল তৈরি হচ্ছিল।
- Law’s Memoir, Hill, III, pp. 175, 186.
- ঐ, পৃ. ১৭৫।
- J. H. Little, Jagat Seth, p. 165; Marshall, Bengal, p. 76; Ray, পলাশী, পৃ. ১৫৬, ‘Colonial Penetation’, p. 14.
- Fort William Consultations, Fulta, 5 Sept., 1756; Bengal Secret and Military Consultations (Select Committee Consultations), Range A, vol.1.
- সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২১৮; Watts’ Memoirs, P. 117. Scrafton, Reflections, p. 61; Law’s Memoir, Hill, III, p.172.
- রিয়াজ, পৃ. ৩৬৩।
- ক্লাইভকে রঞ্জিত রায়, ৬ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, pp. 213-14; রঞ্জিত রায়কে ক্লাইভ ৯ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, p. 219; নবাবকে ক্লাইভ, ৯ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, p. 221; শেঠদের ক্লাইভ, ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, p. 224.
- ক্লাইভকে জগৎশেঠদের চিঠি, ১৪ জানুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, p. 104.
- সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৯৩।
- Law’s Memoir, Hill, III, p. 175; সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃঃ ২২৫।
- Orme, Military Transactions, vol. II, Sec. I, p. 148
- Law’s Memoir, Hill, III, pp. 185, 208.
- সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৯৩।
- Law’s Memoir, Hill, III, p. 193.
- ঐ, পৃ. ১৯৪।