» » চক্রান্তের মূল নায়করা

বর্ণাকার

লিউক স্ক্র্যাফ্‌টন

পলাশি ষড়যন্ত্রে ওয়াটসের পরে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন লিউক স্ক্র্যাফ্‌টন। ইংরেজরা এ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার আগে স্ক্র্যাফ্‌টন ঢাকায় ইংরেজ কুঠির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ক্লাইভই তাঁকে ঢাকা থেকে আনিয়ে মুর্শিদাবাদে পাঠান। আসলে ওয়াটসের মতো সতর্ক ও কিছুটা ভীরু লোকের চাইতে স্ক্র্যাফ্‌টনের মতো তারুণ্য ও উৎসাহে ভরতি যুবককে ক্লাইভের বেশি পছন্দ ছিল। স্বভাবতই ওয়াটস ও স্ক্র্যাফ্‌টনের মধ্যে সব বিষয়ে ঐকমত্য হত না। তাই ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল মুর্শিদাবাদ থেকে স্ক্র্যাফ্‌টনকে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল। কিন্তু ক্লাইভ তাতে কিছুতে রাজি হননি। কাউন্সিল অবশ্য জানিয়ে দিল যে ওখানকার সব ব্যাপারের তত্ত্বাবধানে থাকবেন ওয়াটসই।1 স্ক্র্যাফ্‌টন মুর্শিদাবাদে উমিচাঁদের সঙ্গে বরাবর যোগাযোগ রেখেই চলতে লাগলেন এবং তার মতে, উমিচাঁদ ইংরেজদের জন্য যা করছেন, তাতে তাঁর যথেষ্ট প্রশংসা প্রাপ্য। তিনি প্রায়ই উমিচাঁদের সঙ্গে দেখা করতেন এবং তাঁর কাছ থেকেই জানতে পেরেছিলেন যে ইয়ার লতিফ খানকে মসনদে বসাবার পরিকল্পনা হচ্ছিল, যদিও উমিচাঁদের সঙ্গে মিলে সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠাবার পরিকল্পনা করার জন্য ওয়াটসকেই ভার দেওয়া হয়েছিল। স্ত্র্যাফ্‌টন কিন্তু ওয়াটসকে নেহাত ‘গোবেচারি’ [simpleton] বলেই মনে করতেন।2

ওয়াটস ক্লাইভকে ২৩ এপ্রিল জানাচ্ছেন যে তিনিই উমিচাঁদকে ইয়ার লতিফের কাছে পাঠিয়েছিলেন কারণ লতিফ নবাব হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তার আগেই ২০ এপ্রিল স্ক্র্যাফ্‌টনই ক্লাইভের বিশ্বস্ত অনুচর ওয়ালসকে জানিয়েছিলেন যে, তাঁর মনে হয়, উমিচাঁদ ইয়ার লতিফকে নবাব করার পরিকল্পনা জানাতে জগৎশেঠদের কাছে গেছেন। এ-ব্যাপারে তিনি বেশ উত্তেজিতই বোধ করেন, যেটা ওয়াটস করতেন না। তিনি ওয়ালসকে লিখছেন:3

আমার মনে হয় আমি স্বদেশ ও স্বজাতির জন্য কিছু একটা করতে উদ্বুদ্ধ বোধ করছি। আমাকে ক্ষমতা দেওয়া হলে আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, দশদিনের মধ্যে আমি এমন ব্যবস্থা করতে পারি যাতে আপনারা উত্তর দিক থেকে যাত্রা করে দু’দিন এগুলেই এক বিরাট বাহিনী আপনাদের সঙ্গে যোগ দেবে। আপনাদের কী শর্ত [সন্ধির] তা আমাকে জানান, আমি কথা দিচ্ছি আমার যথাসাধ্য আমি করব।

স্ক্র্যাফ্‌টন এতেই ক্ষান্ত হননি। শর্তগুলি কী হওয়া উচিত তিনি নিজেই তা জানিয়ে দিয়েছেন। আসলে তিনি ওয়াটসের চেয়ে অনেক বেশি আক্রমণাত্মক নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। ওয়ালসকে তিনি ২০ এপ্রিল লেখেন:4

আমাদের অবস্থা মানুষের শরীরে একটা দুষ্ট ক্ষতের মতো, যেটা বাইরে থেকে শুকিয়ে যাবে মনে হবে কিন্তু ভেতরে ভেতরে পচে পুঁজ হতে শুরু করেছে। দক্ষ চিকিৎসকের মতো আমাদের এর সুরাহা করতে হবে। ক্ষতস্থান কেটে তার মধ্যে থেকে সব পচা জিনিস বার করে একেবারে পরিষ্কার করে ফেলতে হবে।

কিন্তু সরকারিভাবে ওয়াটসের অধঃস্তন হিসেবে কাজ করতে হত বলে তিনি মোটেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাই তিনি ওয়ালসকে সতর্ক করে দেন, তিনি যে-সব খবরাখবর পাঠান সেগুলি যেন ওয়াটস ঘুনাক্ষরেও জানতে না পারেন। তা ছাড়াও তিনি ওয়ালসকে অনুরোধ করেন, তিনি যেন উমিচাঁদকে তাঁর সঙ্গে মিলে কাজ করার জন্য একটা চিঠি তাঁর কাছে পাঠিয়ে দেন। সঙ্গে সঙ্গে ওয়ালসকে এটাও জানিয়ে দেন যেন এ-সব কিছু গোপন থাকে এবং সিলেক্ট কমিটিকে যেন কিছুই না জানানো হয়। এই পর্যায়েও, যখন ষড়যন্ত্র দানাই বাঁধেনি, তিনি কিন্তু বিপ্লব সফল হওয়া সম্বন্ধে বেশ আশাবাদীই ছিলেন এবং ওয়ালসের মাধ্যমে ক্লাইভকে পরামর্শ দিলেন, ‘আমরা সম্পূর্ণ তৈরি হওয়া পর্যন্ত একটু ধৈর্য ধরে থাকুন—এটা অল্প কিছুদিনের ব্যাপার। মাত্র।’5

স্ক্র্যাফ্‌টনের নিজের অবশ্য ধৈর্য বিশেষ ছিল না। ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে তিনি খুবই উত্তেজিত বোধ করতে থাকেন। তাই ওয়াটস ও উমিচাঁদ যখন সবেমাত্র সিরাজদ্দৌল্লার বিকল্প নবাব হিসেবে ইয়ার লতিফকে জোগাড় করতে পেরেছেন কিন্তু ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা কিছুই বিশেষ তৈরি হয়নি, তিনি কিন্তু ওয়ালসকে লিখে বসলেন (২১ এপ্রিল ১৭৫৭):6

আমার মাথার মধ্যে এখন রাজনীতির চিন্তা কিলবিল করছে, আমার ঘুম হচ্ছে না। নানা পরিকল্পনা ও চিন্তাভাবনা মাথায় ঘুরছে। ওয়াটসের কিন্তু এরকম অবস্থা হয়নি। তিনি চিন্তাভাবনা দূরে সরিয়ে বেশ নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। আমার কিন্তু তা হবার জো নেই। খারাপ কিছু হলেও আমি কিন্তু মোটেই ভয় পাব না—ভয় পাওয়ার লোক আমি নই।

ওয়ালসের মাধ্যমেই তিনি সব কিছু ক্লাইভকে জানাতেন। কিন্তু ২৪ এপ্রিল তিনি সোজা ক্লাইভকে চিঠি লিখলেন কারণ ‘ব্যাপারটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ ওই চিঠিতে তিনি ক্লাইভকে জানালেন যে নবাব কিছুতেই ইংরেজদের রেহাই দেবেন না, সুযোগ পেলেই তাদের বিরুদ্ধে ফরাসিদের সঙ্গে যোগ দিয়ে ইংরেজদের দেশ থেকে বিতাড়িত করবেন। একই সঙ্গে তিনি ক্লাইভকে ওয়াটসের ভীরুতার সম্পর্কে সতর্ক করে দেন এবং বিপ্লবের ব্যাপার কতটা এগিয়েছে তা জানান। তিনি লেখেন:7

ওয়াটস কখনও এ-সব ব্যাপারে লেখার সাহস জোগাড় করে উঠতে পারেননি। উপরন্তু আমি যখন তাঁকে সব জানালাম তখন তিনি আমাকে দোষারোপ করলেন যে আমি নাকি ঘোঁট পাকাচ্ছি। কিন্তু এখন তো আর করার কিছু নেই। উমিচাঁদ বরং আমার মতো একজন লড়াকুকে পেয়ে খুব খুশি। তাঁর মাথায় মস্ত বড় একটা প্ল্যান কাজ করছে। তিনি আমাকে গতকাল বলেছেন, তাঁকে খুব গোপনীয়তার সঙ্গে এগুতে হবে কিন্তু আমরা যেন প্রস্তুত থাকি—সময় হলেই তিনি আপনাকে সব জানাবেন। ব্যাপারটা কী আমি বেশ আন্দাজ করতে পারছি—তা হচ্ছে জগৎশেঠের সঙ্গে মিলে লতি[ফ]কে নবাব করা….মহাশয়, আপনাকে এও জানাচ্ছি ওয়াটসের মতো ভীরু লোকের ওপর নির্ভর করলে আপনার [অর্থাৎ ইংরেজদের] সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা।

কিন্তু তিনি যেহেতু ষড়যন্ত্রে মুখ্য ভূমিকা নিতে চেয়েছিলেন, তাই ক্লাইভকে সতর্ক করে দিলেন তিনি যেন উমিচাঁদকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস না করেন, এবং তাঁকে অনুরোধ জানালেন তিনি যেন উমিচাঁদকে লেখেন যাতে উমিচাঁদ পুরো পরিকল্পনার কথা তাকে [স্ক্র্যাফ্‌টনকে] খুলে বলেন।

এ সময় কোম্পানির অন্যান্য কর্মচারীর মতো স্ক্র্যাফ্‌টনও ব্যক্তিগত বাণিজ্যে লিপ্ত ছিলেন। ক্লাইভকে একটা চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন যে ক্লাইভের নির্দেশে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য [পলাশির ষড়যন্ত্র করার?] তাঁকে ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদ চলে আসতে হওয়ায় তাঁর ব্যক্তিগত কাজে [ব্যবসায়?] যথেষ্ট ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছে। ক্লাইভকে তিনি অনুরোধ করেন সিলেক্ট কমিটিকে জানাতে যে তিনি মুর্শিদাবাদে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সমাধা করার জন্যই ওখানে চলে এসেছিলেন এবং সেজন্যই লখিপুর [Luckipore] কুঠির প্রধানের কাজটি গ্রহণ করতে পারেননি, যদিও এই পদটি বাংলায় কোম্পানির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ। বলা বাহুল্য, লখিপুরে ব্যক্তিগত ব্যবসার সুযোগও অনেক বেশি ছিল যার জন্য পদটি খুব লোভনীয় বলে গণ্য হত। তাই স্ক্র্যাফ্‌টন ক্লাইভকে জানিয়ে রাখেন তিনি যেন সিলেক্ট কমিটিকে অনুরোধ করেন, মুর্শিদাবাদের কাজটি সম্পন্ন হলে তাঁকে যেন অন্তত ঢাকায় ফিরে যাবার [লখিপুরের পদটি ততদিনে শূন্য থাকবে না বলে হয়তো] অনুমতি দেওয়া হয়। ঢাকায় ফিরে যাবার জন্য তাঁর ব্যগ্রতা থেকে অনুমান করা সহজ যে তিনি ওখানে ব্যক্তিগত ব্যবসায় লিপ্ত ছিলেন।8

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. Hill, 1, p. clxxxiv; Hill, II, p. 367.
  2. ওয়ালসকে স্ক্র্যাফ্‌টন, ১৮ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, pp. 342-43.
  3. ঐ, ২০ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 349.
  4. ঐ, পৃ. ৩৫০৷
  5. ঐ।
  6. ওয়ালসকে স্ক্র্যাফ্‌টনের চিঠি, ২১ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, I, p. 351.
  7. ক্লাইভকে স্ক্র্যাফ্‌টনের চিঠি, ২৪ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, pp. 357-58.
  8. ঐ, পৃ. ৩৫৮।