আট
লাইলী প্রতিদিন খবরের কাগজে চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে। মনের মত পেলে সেখানে দরখাস্ত করে। কয়েক জায়গায় ইণ্টারভিউও দিয়েছে। কিন্তু চাকরি হয়নি। তার মনে হয়েছে, বোরখা পরে যাই বলে চাকরি হয়নি। বোরখা না পরে গেলে তার রূপ দেখে নিশ্চয় হত। একদিন কাগজে চিটাগাং-এ একটি নূতন অফিসের জন্য একজন ষ্টেনো দরকার। মহিলারাও দরখাস্ত করতে পারে। এক কপি পাশপোর্ট সাইজ ছবি ও বায়োডাটাসহ স্বহস্তে লেখা দরখাস্ত চেয়েছে। লাইলী অনেক চিন্তা ভাবনা করে বোরখা পরে শুধু মুখটা খোলা রেখে ফটো তুলে বায়োডাটাসহ সেখানে দরখাস্ত পাঠাল। তার হাতের লেখা খুব ঝরঝরে ও অতি সুন্দর। এর মধ্যে সে সর্টহ্যাণ্ড ও টাইপ শিখেছে।
অফিসের ম্যানেজার একটি পদের জন্য দেড়শত ছেলে মেয়ের দরখাস্ত দেখে হাঁপিয়ে উঠলেন। কি করবেন ঠিক করতে না পেরে প্রথমে হাতের লেখা দেখতে লাগলেন। কয়েকটা দেখার পর লাইলীর ফটো ও হাতের লেখা দেখে অবাক হয়ে চিন্তা করলেন, আল্লাহপাক মেয়েটিকে যেমন রূপ দিয়েছেন তেমনি হাতের লেখাও বটে। এরপর তিনি আর কোনো দরখাস্ত দেখলেন না। লাইলীকে ইণ্টারভিউ দেওয়ার জন্য চিঠি পাঠালেন। এই অফিসটা সেলিমদের। সে এটা উদ্বোধন করার পর এ্যাকসিডেণ্ট করে। তারপর অনেক দিন বন্ধ ছিল। সোহানা বেগম যখন সেলিমকে নিয়ে তার চিকিৎসার জন্য সুইজারল্যাণ্ড গেলেন তখন তিনি চিটাগাং এর অফিস চালু করার জন্য ম্যানেজারকে বলে যান। তাঁরই নির্দেশে ম্যানেজার সাহেব কয়েকদিন আগে আবার অফিস খুলেছেন। অনেক লোক আগেই এপয়েণ্টমেণ্ট হয়ে কাজ করেছে। কাজের চাপ বেড়ে যাওয়ায় একজন ষ্টেনোর দরকার হয়ে পড়ে। তাই কাগজে বিজ্ঞাপন দেন। যেদিন সোহানা বেগম লাইলীকে পূত্রবধূ করার কথা ফাংশানে ঘোষণা করেন, সেদিন ম্যানেজার মিটিং এ থাকলেও শরীর খারাপ থাকায় ফাংশান শুরু হওয়ার আগেই চলে যান। সেদিন তিনি লাইলীকে দেখেননি। তাই আজ তার ফটো দেখে তাকে চিনতে পারলেন না। কিন্তু তার মরা মেয়ের সঙ্গে প্রায় হুবহু মিল দেখে অবাক হয়ে গেলেন। ইণ্টারভিউ এর দিন চুরুট ধরিয়ে লাইলীর ফটোর সঙ্গে নিজের মেয়ের মিল দেখছিলেন।
লাইলী চীটাগাং এসে মাকে হোটেলে রেখে নির্দিষ্ট সময়ে ইণ্টারভিউ দিতে গেল। অফিসে পৌঁছে দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে ম্যানেজারের রুমের দিকে এগোল।
দরজার বাইরে টুলে পিয়ন বসেছিল। একজন বোরখা পরা মেয়েকে এগিয়ে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি ইণ্টারভিউ দিতে এসেছেন? ম্যানেজার সাহেব পিয়নকে বলে রেখেছেন, একজন বোরখা পরা মহিলা ইণ্টারভিউ দিতে আসবেন। আসলে তাকে ভিতরে পাঠিয়ে দিও।
পিয়নের কথা শুনে লাইলী বলল, জ্বি।
পিয়ন বলল, আপনি ভিতরে যান।
দরজায় ভারী পর্দা ঝুলছে। লাইলী পর্দা ফাঁক করে দেখল, একজন বয়স্ক ভদ্রলোক চেয়ারে বসে চুরুট টানছে। লাইলী বলল, মে আই কাম ইন স্যার? বলা বাহুল্য সে তখন মুখের নেকাব সরিয়ে দিয়েছে।
ম্যানেজার সাহেব লাইলীর কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠে তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। একটা মেয়ে যে আসবার অনুমতি চাচ্ছে, সেকথা ভুলে গেলেন।
ভদ্রলোককে তার দিকে ঐভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে লাইলীর মনে হল লোকটা যেন অবিশ্বাস্য কিছু দেখছে। সে খুব অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। কোনো রকমে আবার বলল, “মে আই কাম ইন স্যার”?
এবার ম্যানেজার সাহেব স্নেহভরা কণ্ঠে বললেন, অফকোর্স। এস মা এস, আমি তোমারই জন্য অপেক্ষা করছি। লাইলী ভিতরে এলে তাকে সামনের চেয়ার দেখিয়ে বললেন, বস। তারপর প্রশ্ন করলেন, তুমি চাকরি করতে চাও কেন?
লাইলী বলল, দেখন, এটা একান্ত ব্যক্তিগত প্রশ্ন। তার উপর আমি মেয়েছেলে। এরকম প্রশ্ন শুধু পিতৃস্থানীয় ব্যক্তি করতে পারেন। চাকরির ইণ্টারভিউতে এরকম প্রশ্ন হবে জানলে আসতাম না। আপনার অফিসে ষ্টেনো দরকার। সে কাজের উপযুক্ত কিনা পরীক্ষা করতে পারেন। ব্যক্তিগত ব্যাপারে প্রশ্ন করলে ফিরে যাব।
এতক্ষণ ম্যানেজার সাহেব চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে চুরুট টানতে টানতে সব কথা শুনছিলেন। লাইলী থেমে যেতে সোজা হয়ে বসে তার দিকে চেয়ে বললেন, তুমি একদম ছেলেমানুষ। চাকরির ইণ্টারভিউ দিতে এসে এরকম কড়া কড়া কথা বললে কোথাও তোমার চাকরি হবে না। যাক, যা জানার তা জানা হয়ে গেছে। এখন তোমার কথায় ফিরে আসি। তুমি একটু আগে বলেছ, ব্যক্তিগত ব্যাপারে পিতৃস্থানীয় লোক প্রশ্ন করতে পারে। আমি নিজেই সে স্থান দখল করে কয়েকটি কথা জিজ্ঞেস করছি। দরখাস্তে তোমার পিতার নামের আগে লেট লেখা দেখে বুঝেছি তিনি নেই। তোমার কি আর কেউ গার্জেন নেই?
লাইলী কয়েক সেকেণ্ড ম্যানেজারকে বুঝবার চেষ্টা করল। তারপর যখন মনে হল লোকটার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নেই তখন বলল, শুধু মা আছেন। চাচা একজন আছেন। তাদের সঙ্গে ঐ ব্যক্তিগত কারণে অনেক দিন থেকে মনোমালিন্য। বড় এক ভাই ছিল, আল্লাহপাক তাকেও দুনিয়া থেকে তুলে নিয়েছেন। আপনি হয়তো ভাবছেন, লাক্সারী করার জন্য আমি চাকরি করতে চাইছি। আমাকে দেখে কি সে রকম ভাবতে পারছেন? দেখুন, সত্যিই আমার একটা চাকরি খুব দরকার। আর ইন্তেকালের পর মায়ের শরীর খুব ভেঙ্গে পড়েছে। আব্বা চাকরি করতেন। হার্টের অসুখে হঠাৎ করে মারা গেছেন। ঢাকায় শুধু আর পৈত্রিক চার কামরা ঘর আছে। অনেক চিন্তাভাবনা করে চাকরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। হঠাৎ লাইলী লক্ষ্য করল, লোকটার চোখ অশ্রুতে ঢল ঢল করছে। নিজের দুঃখের কথা এতক্ষণ বলছিল, কোনো দিকে তার খেয়াল ছিল না। তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করল, আপনার চোখে পানি কেন? কিছু পড়েছে নাকি?
ম্যানেজার সাহেব রুমাল বার করে চোখ মুছে বললেন, চোখে কিছু পড়েনি মা, মনে কিছু পড়েছে। আমার একটা মেয়ে ছিল, বেঁচে থাকলে আজ ঠিক তোমার মতো এত বড় হত। পনের বছর বয়সে ম্যানেনজাইটীস হয়ে মারা গেছে। দরখাস্তের সঙ্গে তোমার ফটো দেখে আমার মেয়ের কথা মনে পড়ে। তার গড়ন ছিল ঠিক তোমার মতো। এখন তোমার কথাশুনে মনে হচ্ছে, তার গলার স্বরও তোমার মতো। প্রথমে তোমার গলার আওয়াজ শুনে মনে হয়েছিল, ছয় বছর পর মেয়ের গলা শুনছি। তবে সে তোমার মত এতো সুন্দরী ছিল না। তারপর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তুমি আগামীকাল থেকে জয়েন কর। কালকেই তোমাকে এপয়েণ্টমেণ্ট লেটার দিয়ে দেব।
ম্যানেজারের কথা শুনে লাইলীর চোখও পানিতে ভরে গেল। উঠে গিয়ে তার পায়ে হাত দিয়ে কদমবুসি করে বলল, আমাকে চিরদিন মেয়ের মতো মনে করবেন।
এবারও ম্যানেজার সাহেব চোখের পানি রোধ করতে পারলেন না। তার মাথায় হাত রেখে ভিজে গলায় বললেন, বেঁচে থাক মা, সুখী হও। আল্লাহ তোমার মনের বাসনা পূরণ করুন।
অফিস থেকে বেরিয়ে আনন্দে লাইলীর মনটা ভরে গেল। চাকরিটা হয়ে যাবে সে ধারণাই করতে পারেনি। হোটেলে ফিরে মাকে শুভ সংবাদটা দিল। দুপুরে খেয়ে দেয়ে মাকে বিশ্রাম করতে বলে বান্ধবী সুলতানার বাসার ঠিকানাটা নিয়ে তার খোঁজে বেরিয়ে পড়ল।
যেদিন সোহানা বেগম বিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে লাইলীদের চিঠি দেন, সেইদিন সুলতানার সঙ্গে তার খালাত ভাই খালেদের বিয়ে হয়। সুলতানা নিজে তাদের বাড়িতে দাওয়াত দিতে এসে সেলিমের সঙ্গে ওর বিয়ের কথা শুনে যায়। লাইলীর
জীবনে এরকম বিপর্যয় ঘটে গেল বলে সে বিয়েতে যেতে পারেনি।
বিলেত থেকে এফ, আর, সি, এস, ডিগ্রী নিয়ে এসে খালেদ চিটাগাং মেডিকেল কলেজে মেডিসিনের প্রফেসার পদে জয়েন করেছে। বিয়ের দুদিন পর ছুটি না থাকায় সুলতানাকে নিয়ে স্টাফকোয়ার্টারে নিজের বাসায় চলে এসেছে। কয়েকদিন পর সুলতানা লাইলীকে অভিযোগ করে চিঠি দিয়েছে। কিন্তু লাইলী নানান দুর্ভাবনায় সে চিঠির উত্তর দিতে পারেনি।
ঠিকানামতে গিয়ে লাইলী দরজায় নক করল।
সবেমাত্র সুলতানা স্বামীর সঙ্গে খেয়ে উঠে পান চিবুচ্ছে। আর খালেদ বিছানায় আড় হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। এক্ষুণি তাকে আবার চেম্বারে গিয়ে বসতে হবে। দরজায় নক হতে সুলতানাকে বলল, দেখ তোমার কোনো পড়শীনি হয়তো এসেছে। আমি ততক্ষণ পোশাক পরে নেই।
সুলতানা দরজা খুলে লাইলীকে দেখে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল, তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, সই তুই? এতদিন পরে বুঝি আমাদের কথা মনে পড়ল? বিয়েতে তুই যখন এলি না, এমন কি চিঠির উত্তরও দিলি না তখন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, জীবনে তোর সঙ্গে কখনো কথা বলব না। কিন্তু তোর মধ্যে কি যাদ আছে, তোকে দেখে সে প্রতিজ্ঞা ঠিক রাখতে পরলাম না। তারপর তাকে ছেড়ে দিয়ে হাত ধরে বলল, আয় ভিতরে আয়। তোর সয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। ঘরের ভিতরে এসে সুলতানা স্বামীর উদ্দেশ্যে বলল, দেখবে এস কে এসেছে? যদি বলতে পার, তা হলে মিষ্টি খাওয়াব?
খালেদ পাশের রুমে পোশাক বদলাচ্ছিল। এ ঘরে এসে এক অচেনা সুন্দরী মেয়েকে দেখে প্রথমে লজ্জায় থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। চিন্তা করল, আশ-পাশের মেয়ে হলে এভাবে সুলতানা তাকে ডাকত না। হঠাৎ কিছু মনে পড়ায় লাইলীকে ভালভাবে দেখল। তারপর লজ্জা মিশ্রিত মৃদু হাসি দিয়ে “আসসালামু আলাইকুম” বলে বলল, আপনি নিশ্চয় লাইলী।
লাইলীও মিষ্টি হেসে সালামের জওয়াব দিয়ে বলল, আপনি ঠিক বলেছেন। কিন্তু আপনি আমাকে চিনলেন কি করে?
লাইলী আরজুমন বানু এদেশে একজনই আছেন। তাকে কাউকে চিনিয়ে দিতে হয় না, তিনি নিজেই সকলের কাছে পরিচিত। বিলেতে থাকতে এবং বিয়ের পর থেকে আপনার কথা ওর কাছে এত বেশি শুনেছি যে, আপনাকে দেখেই চিনে ফেললাম।
লাইলী সুলতানাকে বলল, তুই তো সয়ার কাছে হেরে গেলি, এখন মিষ্টি খাওয়া।
তাতো খাওয়াবই, কিন্তু তুই একলা কেন? সেলিম আসেনি? তুই অত রোগা হয়ে গেছিস কেন?
খালেদ বলল, তোমরা দুজনে বসে গল্প কর, আমার সময় নেই, চলি। তারপর লাইলীর দিকে চেয়ে বলল, আমি না আসা পর্যন্ত আপনি যাবেন না কিন্তু।
সুলতানা বলল, বারে আমার সই এল, তার খাতির যত্ন না করে তুমি যে বড় চলে যাচ্ছ?
এখন আমার একটা ইমারজেন্সী কল আছে। ময়নার মাকে দিয়ে যা দরকার আনিয়ে নিও। আমি যত তাড়াতাড়ি পারি ফেরার চেষ্টা করব।
খালেদ বেরিয়ে যেতে সুলতানা লাইলীকে জিজ্ঞেস করল, ভাত খাবি?
না এক্ষুণি খেয়ে এসেছি। আমি এখন কিছু খাব না, তুই তাড়াহুড়ো করছিস কেন? আমি কী তোদের কাছে খেতে এসেছি?
সুলতানা তবু শুনল না। ময়নার মাকে ডেকে দু’গ্লাস লক্ষ্মী তৈরী করে আনতে বলল। তারপর লাইলীকে বলল, তোর কি ব্যাপার বলতো? এমন শুকিয়ে গেছিস কেন? তোকে দেখে আমার কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে।
লাইলী বলল, তোর সন্দেহ ঠিক। তারপর সেলিমের এ্যাকসিডেণ্ট, বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়া এবং বাপের মৃত্যু থেকে আজ পর্যন্ত সব ঘটনা খুলে বলল।
শুনতে শুনতে সুলতানার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। চোখ মুছে বলল, কি করবি ভাই? জানিস তো সবকিছু আল্লাহর ইচ্ছা। তাঁর বাণী স্মরণ করে সবুর কর। তিনি নিশ্চয় একদিন সবুরের ফল দেবেন। তুই বেশি চিন্তা করিসনা। খালা আম্মাকে নিয়ে একদম আমার এখানে উঠলেই পারতিস। চল যাই, তোদের মালপত্র আর খালাআম্মাকে এখানে নিয়ে আসি।
লাইলী বলল, সে কি করে হয়? তোদের অসুবিধে হবে। তা ছাড়া সয়া কিছু মনে করতে পারে?
দেখ, তোকে অত চিন্তা করতে হবে না। দেখছিস না, দু-দুটো ঘর খালি পড়ে রয়েছে।
তা হয় না রে, তার চেয়ে সয়াকে বলিস, তোদের কাছাকাছি একটা বাসা দেখে দিতে।
ঠিক আছে তাই হবে। এখন নাস্তা খেয়ে চল, সব কিছু এখানে নিয়ে আসি। যতদিন না বাসা ঠিক হচ্ছে ততদিন এখানে থাকবি। তোর সয়া শুনলে খুব খুশি হবে। সুলতানা লাইলীর কোনো বাধা শুনল না। তাকে সঙ্গে নিয়ে হোটেলে গিয়ে খালা আম্মাকে সালাম করে তাদেরকে নিয়ে চলে এল।
খালেদ ফিরে এসে স্ত্রীর কাছে সব কিছু শুনে খুব দুঃখ প্রকাশ করল। লাইলীরা এখানে এসেছে দেখে খুশি হল।
পরের দিন থেকে লাইলী নিয়মিত অফিস করতে লাগল।
সুলতানা ও খালেদ তাদেরকে এখানেই থাকতে বলল। লাইলী কিছুতেই রাজি হল না। শেষে ওদের বাসার কাছাকাছি একটা বাসা ঠিক করে দিল।
দুমাস হতে চলল লাইলী চাকরি করছে। সে বোরখা পরেই অফিস করে। সব সময় তার মুখ নেকাবে ঢাকা থাকে। যখন সে ম্যানেজারের কাছে একা থাকে তখন শুধু মুখ ভোলা রাখে। তাকে সে চাচার আসনে বসিয়েছে। তার অনুরোধে মাঝে মাঝে লাইলীকে তাদের বাসায় যেতে হয়। ওঁর স্ত্রীও লাইলীকে মেয়ের মত স্নেহ করেন। তাদের বাড়িতে তারা থাকতে বলেছিলেন, কিন্তু সে রাজি হয়নি।
অফিসে মোট পনের জন লোক কাজ করে। তাদের কেউ আজ পর্যন্ত লাইলীর মুখ দেখেনি। অনেকে তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে বিফল হয়েছে। একজন মেয়ে পিয়ন আছে, তার কাছ থেকে অফিস ষ্টাফরা শুনেছে, ষ্টেনো মেয়েটা অপূর্ব সুন্দরী। তারা অনেক চেষ্টা করেছে তাকে দেখতে এবং তার সঙ্গে আলাপ করতে; কিন্তু পারেনি। ছুটির পর লাইলী যখন অফিস থেকে বের হয় তখন অফিস গেটের বাইরে রাস্তায় কলিগরা তাকে দেখে নানা রকম মন্তব্য করে। একদিন একজন তাকে শুনিয়ে সঙ্গীদের বলল, উনি যদি পর্দা মেনে চলেন তবে চাকরি করতে এসেছেন কেন? একজন পীরসাহেবকে বিয়ে করে অসুস্পশ্যা হয়ে থাকতে পারতেন। রূপসী বলে কলিগদের সঙ্গে কি মেলামেশা করতে নেই? মেয়েদের এত অহংকার থাকা ভালো না। এরপরও লাইলীর কাছ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে শেষে আংগুর ফল টক ভেবে তারা ইতি টেনেছে।
লাইলী তাদের কথায় একটু মনে ব্যথা পেলেও কাউকে কিছু বলেনি। সে ভাবে, তাদেরকে দোষ দেওয়া যায় না। আজকাল কয়টা মেয়ে পর্দা করে চাকরি করে? সে তাদের বিরুদ্ধে কোনোদিন ম্যানেজার সাহেবকেও কিছু বলেনি। যদিও সে জানে, ম্যানেজারকে বলে দিলে তারা আর কোনোদিন তার পিছু লাগবে না।
এদিকে সুইজারল্যাণ্ডে দীর্ঘ ছয়মাস চিকিৎসার পর সেলিম স্মৃতিশক্তি ও বাকশক্তি ফিরে পেল। সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার পর মায়ের কাছে এ্যাকসিডেণ্টের কথা শুনে জিজ্ঞেস করল, আমাদের বিয়ে তা হলে হয়নি?
লাইলীর কথা শুনে যদি ছেলের আবার কিছু হয়ে যায়? সেই কথা চিন্তা করে সোহানা বেগম বললেন, সে সব ঠিক আছে, দেশে ফিরে সব কিছু জানতে পারবে।
ও নিয়ে তুমি এখন কোনো চিন্তা করো না। মনে রেখ, তুমি একসিডেণ্ট করে আজ ছয়মাস স্মৃতিশক্তি ও বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলে। কোনো কিছুই এখন তোমার চিন্তা করা নিষেধ।
আরও একমাস পর সোহানা বেগম ছেলেকে নিয়ে দেশে ফিরলেন।
রাত্রে ঘুমোবার সময় আসমা সেলিমের ঘরে তাকে শুয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল, দাদা, তুমি ঘুমিয়ে পড়েছ?
সেলিম জেগেই ছিল। সে তখন লাইলীর কথা চিন্তা করছিল। উঠে বসে বলল, নারে ঘুমোইনি, আয় বস। কিছু বলবি নাকি?
সোহানা বেগম আসমাকে লাইলীর সঙ্গে বিয়ে ভেঙ্গে দেওয়ার ঘটনাটা জানাবার জন্য পাঠিয়েছেন। কিভাবে কথাটা বলবে চিন্তা করতে করতে একটা চেয়ার টেনে বসল।
কিরে কথা বলছিস না কেন? তোর ছেলে কেমন আছে? পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিস তো?
আসমা বলল, আমার খবর ভালো। তোমাকে একটা কথা বলব, সেটা শুনে তুমি মনে আঘাত পাবে, তাই বলতে সাহস হচ্ছে না।
সেলিম একটু চিন্তা করে বলল, যত বড়ই আঘাত পাই না কেন, তুই বল।
আসমা সেই বেনামী চিঠিটা এগিয়ে দিয়ে বলল, পড়ে দেখ।
সেলিম তার হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে পড়ল। তারপর আসমার দিকে রাগের সঙ্গে চেয়ে রইল।
আসমা ভয়ে ভয়ে বলল, তোমার যেদিন এ্যাকসিডেণ্ট হয়, সেদিন একটা লোক এসে খালাম্মাকে এই চিঠিটা দিয়ে যায়। ওঁর ধারনা লাইলী খুব অপয়া মেয়ে। সেই জন্য তোমার এই দুর্ঘটনা হয়। তাই তিনি বিয়ে ভেঙ্গে দেন।
আসমা তুই চুপ কর বলে চিৎকার করে সেলিম মায়ের ঘরে গিয়ে পায়ের কাছে বসে দু’পা জড়িয়ে ভিজে গলায় বলল, একি করলে মা? একজন অচেনা, অজানা লোকের একটা চিঠি পেয়ে তাকে বিশ্বাস করে ফেললে? তোমার নিজের ছেলের চেয়ে সেই অজানা লোকটা তোমার কাছে বেশি বিশ্বাসী হয়ে গেল? তুমি মা হয়ে আমাকে এতখানি অবিশ্বাস করবে তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। তারপর কাঁদতে কাঁদতে বলল, কেন তুমি আমার ভালো হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলে না? আমাকে এত টাকা খরচ করে বিদেশ থেকে ভালো করে আনলে কেন? বল মা বল, চুপ করে থেক না? আমার কথার উত্তর দাও। আমি কী এমন তোমার কাছে অন্যায় করেছি, যার জন্য তুমি আমাকে এত বড় শাস্তি দিলে? তা হলে কী ভাবব, আমাকে এই চরম আঘাত দেওয়ার জন্য বিদেশ থেকে ভালো করে এনেছ।
সোহানা বেগম বললেন, সেলিম, তুই আমাকে এত বড় কথা বলতে পারলি? তারপর ভিজে গলায় বললেন, আমি মা হয়ে তোর ভালর জন্য এই কাজ করেছি। তুই শান্ত হ বাবা। তুই শিক্ষিত ছেলে, সামান্য একটা মেয়ের জন্য এতটা উতলা হওয়া উচিত না।
সেলিম মাকে ছেড়ে দিয়ে আর কোনো কথা না বলে নিজের ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে ফোঁপাতে লাগল। রাত্রে ঘুমিয়ে সে স্বপ্ন দেখল, লাইলী পাগলি হয়ে গেছে। ভেঁড়া ময়লা কাপড় পরে তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। তার সুদীর্ঘ চুল উস্কোখুসকো হয়ে জট পাকিয়েছে। সে রাস্তায় যাকে পাচ্ছে তাকেই জিজ্ঞেস করছে, আপনি সেলিম সাহেবকে দেখেছেন? বলতে পারেন তিনি কোথায় ও কেমন আছেন? একটা হোটেল থেকে বেরোবার সময় গেটে লাইলী তাকে ঠিক ঐ কথাগুলো বলল। সেলিমের তখন ইচ্ছা হল, তাকে জড়িয়ে ধরে বলে এই তো আমিই তোমার সেই সেলিম সাহেব। ঠিক এই সময় মোয়াজ্জেনের আজান শুনে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। ভারাক্রান্ত মনে ফজরের নামায পড়ে লাইলীর মঙ্গলের জন্য আল্লাহ পাকের কাছে দোয়া চাইল।
সকাল সাতটায় সেলিম লাইলীদের বাড়িতে গেল।
জলিল সাহেব সেলিমকে দেখে অবাক হলেও ড্রইংরুমে এনে বসালেন।
সেলিম বলল, দয়া করে লাইলীকে বা ওর আব্বাকে একটু ডাকবেন?
জলিল সাহেব আরো বেশি অবাক হয়ে বললেন, খালুজান আজ প্রায় আট মাস আগে ইন্তেকাল করেছেন। আর লাইলী মাস দুই হল তার অসুস্থ মাকে নিয়ে চিটাগাং গেছে।
সেলিম “ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন” পড়ে উঠে এসে জলিল সাহেবের দু’টো হাত ধরে বলল, অনুগ্রহ করে তার ঠিকানাটা দিন।
জলিল সাহেব এতক্ষণ অনেক সহ্য করেছেন, এবার একটু রাগতস্বরে বললেন, আমরা তার ঠিকানা জানি না। এখন তার ঠিকানা নিয়ে কি করবেন? এতদিন কোথায় ছিলেন? শুনেছিলাম, একসিডেণ্ট করে স্মৃতি ও বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। এখন তো দেখছি আপনি সুস্থ। খোঁজ-খবর নেননি কেন? বই পুস্তকে পড়েছি, বড় লোকের ছেলেরা গরিব মেয়েদের নিয়ে দুদিনের জন্য পুতুল খেলার মতো খেলে। আপনাকে দেখে প্রত্যক্ষ করলাম। আপনার মায়ের চিঠি পেয়ে লাইলী খালুজানকে গহনাগুলো ফেরৎ দিতে পাঠিয়েছিল। জানি না আপনার মা তাকে কি বলেছিলেন। ফিরে এসে সেই যে বিছানা নিলেন আর উঠলেন না। সে রাতেই মারা গেলেন। আর কি চান আপনারা? অমন বেহেস্তের হুরের মত সুন্দরী ও নিপাপ মেয়েকে দুর্ণাম দিয়ে এখান থেকে তাড়ালেন। আরও যদি কিছু করতে চান, তা হলে চিটাগাং গিয়ে গোয়েন্দা লাগান, পেয়ে যাবেন। একটা কথা মনে রাখবেন, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। বড়লোকেরা টাকার দেমাগে গরিবদের উপর অনেক জুলুম করে, কিন্তু সেটা সাময়িক। উপরে একজন শাহানশাহ আছেন, তিনি বড় ন্যায় বিচারক। তাঁকে ফাঁকি দেওয়া কারুর পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি সত্য মিথ্যা একদিন প্রমাণ করে দেবেন।
সেলিম এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল। তার দু’চোখ পানিতে ভরে উঠল। জলিল সাহেব থেমে যেতে ভিজে গলায় বলল, আমি নিজের সাফাই গাইবার জন্য আসিনি। এতদিন পর কেন এসেছি, সে খবর আল্লাহপাক জানেন। শুধু একটা কথা বলে যাই, আল্লাহপাক যেন আপনার শেষ কথাটা কবুল করেন। তারপর সে রুমাল দিয়ে দু’চোখ মুছতে মুছতে হঠাৎ করে উঠে চলে গেল।
জলিল সাহেব সেলিমের কথা ঠিক বুঝতে পারলেন না। রহিমা দরজার পর্দার আড়াল থেকে তাদের কথা শুনছিল। এবার ভিতরে এসে বলল, আমার কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে। সেলিম সাহেব বোধ হয় এসব ঘটনা কিছুই জানেন না। না জেনে তুমি তাকে শুধু শুধু যাতা করে বললে?
সেলিমের ব্যবহারে জলিল সাহেবেরও মনে খটকা লেগেছে। বললেন, কি জানি, হয়তো হবে। তবু কিন্তু থেকে যাচ্ছে।
রহিমা বলল, এইজন্য হাদিসে আছে, আসল ঘটনা না জেনে কারও উপর সন্দেহ পোষণ করা মহাপাপ।
লাইলী মাঝে মাঝে রহিমাকে পত্র দেয়। কিন্তু ঠিকানা দেয় না। পোষ্ট অফিসের সীলমোহর দেখে ওরা জেনেছে, সে চিটাগাং-এ আছে।
সেলিম ঘরে ফিরে এসে জামাকাপড় ব্রীফকেসে ভরে নিয়ে মায়ের কাছে এসে বলল, মা, আমি চিটাগাং যাচ্ছি।
সোহানা বেগম বললেন, সে কিরে? মাত্র গতকাল এত জার্নি করে এলি। কয়েকদিন রেষ্ট নে, তারপর না হয় যাবি। এত ব্যস্ত হওয়ার কি আছে?
সেলিম হতাশভাবে ব্রীফকেসটা সেখানে রেখে নিজের রুমে ফিরে এল। ইজিচেয়ারে শুয়ে চোখ বন্ধ করে লাইলীকে নিয়ে তার অতীত জীবনের কথা চিন্তা করতে লাগল।
সোহানা বেগম আসমাকে বলে দিয়েছেন তোর দাদার দিকে খুব খেয়াল রাখবি। তাকে বেশি চিন্তা করতে দিবি না। সে বীফকেসটা নিয়ে সেলিমের ঘরে এসে সেটা যথাস্থানে রেখে দিল। তারপর তার কাছে এসে মাথার চুলে হাত বুলাতে লাগল।
সেলিম চমকে উঠে তাকিয়ে আসমাকে দেখে বসতে বলে বলল, হাঁরে রেহানা বা মনিরুলের সঙ্গে তোর পরিচয় হয়নি?
আসমা সামনের একটা চেয়ারে বসে বলল, রেহানার সঙ্গে এখানে আসার কয়েকদিন পর পরিচয় হয়েছে। প্রথমদিন রুবীনার সঙ্গে আমাকে দেখে তার কাছে আমার পরিচয় জানতে চাইতে রুবীনা বলল, আমাদের দুর সম্পর্কের আত্মীয়া। আমাকে অবশ্য সে কোনোদিন কিছু জিজ্ঞেস করেনি। আর মনিরুল প্রায়ই এসে রুবীনার সঙ্গে গল্প করে। মাঝে মাঝে দুজনে বেড়াতে যায়। আমি তার সামনে কোনোদিন যাইনি।
মনিরুলকে তুই ঠিক চিনতে পেরেছিস? আসমা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
সেলিম বলল, তোকে ভালভাবে আই, এ, পাশ করতে হবে। এখানে বেশি দিন থাকলে ধরা পড়ে যাবি। তোকে অন্তত বি. এ. পাশ করতে হবে। তোর ছেলেকে কনভেণ্ট স্কুলে ভর্তি করে দেব। ছেলের চিন্তা করিসনে, তারও ব্যবস্থা করতে পারব। তোর জন্য ঐ স্কুলে ছেলেমেয়েদের দেখাশুনার কাজটা ঠিক করে দেব। তোকে আর ছেলে ছেড়ে থাকতে হবে না।
আসমা মেঝেয় বসে পড়ে সেলিমের দুটো পা জড়িয়ে ধরে কাঁদকাঁদ স্বরে বলল, দাদা, তুমি এই মহাপাপীর জন্য যা করছ, তার এক কণাও আমি প্রতিদান দিতে পারব না। তোমার মতো ছেলের জীবনে কেন যে এরকম একটা ঘটনা ঘটে গেল, তা একমাত্র আল্লাহপাক জানেন। তারপর সে সেলিমের দুই হাঁটুর মাঝখানে মাথা রেখে ফোঁপাতে লাগল।
সেলিম তার মাথায় হাত বলাতে বুলোতে ভাঙ্গা গলায় বলল, কাঁদিসনে বোন কাঁদিসনে, উঠে বস। কি করবি বল? উপরের দিকে আঙুল তুলে বলল, সবকিছু উনি করছেন। ওখানে মানুষের কিছু করার ক্ষমতা নেই। হারে, লাইলীর আরা মারা গেলেন, তোরা বুঝি সে খবর জানিস নি?
এবারও আসমা মাথা নাড়ল। এমন সময় রেহানা সেলিম তুমি ঘরে আছ বলে ভিতরে ঢুকে আসমাকে ঐ অবস্থায় দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। সেলিম ভালো হয়ে ফিরে এসেছে জেনে সে তাকে দেখতে এসেছে।
সেলিম আসমার মাথাটা হাত দিয়ে তুলে ধরে বলল, উঠে বস। তারপর রেহানার দিকে চেয়ে বলল, কি খবর? কেমন আছ?
রেহানা নিজেকে সামলে নিয়ে ঝাঁজের সঙ্গে বলল, সেলিম তুমি এত নিচে নেমে গেছ? আমি যে ভাবতে পারছি না, ছি, ছি, ছি।
সেলিম বলল, তুমি একি বলছ রেহানা? তোমার কাছ থেকে একথা শুনব আশা করিনি।
ততক্ষণে আসমা উঠে দাঁড়িয়ে দুচোখ মুছে বলল, দেখুন রেহানাদি, যারা বাইরেটা দেখে বিচার করে, তাদের রায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভুল হয়। তারপর সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
রেহানা বলল, শুনেছি মেয়েটা তোমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়া। সে তো অনেকদিন হয়ে গেল এসেছে, আর কত দিন থাকবে?
সেলিম বলল, আচ্ছা রেহানা, মেয়েরা এত হিংসুটে ও সন্দেহ প্রবণ হয় কেন বলতে পার? যাক, তুমি আমাকে যা কিছু ভাবতে পার। এখন দয়া করে আমাকে একটু একা থাকতে দাও, প্লীজ।
রেহানা রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে অনেক কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু সেলিমের শেষের কথা শুনে অপমান বোধ করে হাই হিল জুতোর আওয়াজ তুলে গট গট করে চলে গেল।
সেলিম চোখ বন্ধ করে আবার লাইলীর চিন্তায় ডুবে গেল।
ঐদিন দুপুরে আরিফের চিঠি এল। সে প্রথমে হাফেজ হয়ে পরে আরবীতে এম, এ, পাশ করেছে। যে কোনোদিন বাড়িতে এসে পৌঁছাবে। সেলিমের ব্যাপারটা নিয়ে এ সংসারে যেমন বিষাদের ছায়া নেমেছিল, আরিফের চিঠি পেয়ে সকলের মনে আনন্দের সাড়া জেগে উঠল। সেলিম মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, কি, আমি বলিনি? আরিফ মানুষের মত মানুষ হয়ে একদিন ঠিক ফিরে আসবে? এতদিন নিজেকে বড় একা মনে হত, ও এলে আর কোনো চিন্তা নেই। সকলে আরিফের পথ পানে চেয়ে রইল।
দিন দশেক পরের ঘটনা। রুবীনা বিকেলে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে গেটের দিকে চেয়েছিল। দেখল, একজন দাড়ীওয়ালা মৌলবী ধরনের লোক গেটে দারোয়ানের সঙ্গে কথা বলতে বলতে, ভিতরে আসছে।
দারোয়ান তার হাত থেকে সুটকেসটা নিয়ে আগে আগে এসে চিৎকার করে বলল, বেগম সাহেবা দেখবেন আসুন, ছোট বাবু এসেছেন।
উপরের বারান্দা থেকে রুবীনা আরিফকে চিনতে পারেনি। দারোয়ানের চিৎকার শুনে সকলে নিচের বারান্দায় বেরিয়ে এল।
আরিফ মায়ের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে উঠে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, মা তুমি কেমন আছ? আমাকে মাফ করে দিয়েছ তো?
সোহানা বেগম ছেলেকে বুকে চেপে ধরে আনন্দঅশ্রু ফেলতে ফেলতে বললেন, মাফ তো অনেক আগেই করেছি। আল্লাহ যে তোকে আমার কোলে ফিরিয়ে আনলেন, তার জন্য তাঁকে অসংখ্য শুকরিয়া জানাচ্ছি। তোর খবরাখবর চিঠি দিয়েও তো জানাতে পারতিস। আজ তোর বাবা বেঁচে থাকলে কত যে খুশি হতেন।
আরিফ মাকে ছেড়ে দিয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে বলল, কি বললে মা? আহ্বা বেঁচে নেই? ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন বলে মায়ের পায়ের কাছে বসে তার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আব্বা আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলেন? আমি যে তার কাছে মাফ চাইতে পারলাম না। ইয়া রাহমানুর রহিম, তুমি আমার আবার রুহের মাগফেরাত দান কর। তার সমস্ত অপরাধ মাফ করে দাও।
সোহানা বেগম ছেলের হাত ধরে তুলে বললেন, কতদুর থেকে এসেছিস, চল বাবা, হাত মুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম নিবি। তারপর রুবীনার দিকে চেয়ে বললেন, তোর ছোটদার জন্য নাস্তা নিয়ে আয়।
আরিফ বাথরুম থেকে হাতমুখ ধুয়ে এসে নিজের রুমে কাপড় পাল্টাল। একটা অচেনা মেয়েকে রুবীনা ও মায়ের সঙ্গে নাস্তা নিয়ে ঢুকতে দেখে জিজ্ঞেস করল, মা, এই মেয়েটিকে তো চিনতে পারছি না?
সোহানা বেগম বললেন, তুই চিনবি না। আমাদের দুর সম্পর্কে আত্মীয়া। বিপদে পড়েছে। তাই সেলিম ওকে রুবীনার মত মানুষ করছে। এমন সময় বছর তিনেকের একটা ছেলে পর্দা ঠেলে ঘরে ঢুকে আরিফের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইল। তারপর আমার দিকে দুহাত বাড়িয়ে আম্মা বলে এগিয়ে গেল। আসমা ছেলেকে কোলে তুলে নিল।
আরিফ বলল, বাহ! ছেলেটা তো খুব সুন্দর। সোহানা বেগম বললেন, হ্যাঁ ওরই ছেলে।
আরিফ নাস্তা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল, ভাইয়া কখন ফিরবে? সে নিশ্চয় ব্যবসা বাণিজ্যে মন দিয়েছে?
সোহানা বেগম মান স্বরে বললেন, সে দেখবে না তো কে দেখবে? সে একা আর কত দিক সামলাবে। কখন ফেরে, কখন খায়, তার কিছু ঠিক নেই। এবার দু’ভাই মিলে সবকিছু দেখাশোনা করবি।
আচ্ছা মা, মনে হচ্ছে ভাইয়ার এখনও বিয়ে দাওনি?
আরিফের কথা শুনে সোহানা বেগমের মুখটা আরও মান হয়ে গেল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, কি আর বলব বাবা, বিয়ে তো ঠিক করেছিলাম। কিন্তু তা আর হল কৈ?
কেন, হল না কেন।
বিয়ের বিশ পঁচিশ দিন আগে তোর দাদা এ্যাক্সিডেণ্ট করে স্মৃতি ও বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছিল। ওকে নিয়ে আমি সুইজারল্যাণ্ডে গিয়ে ছ’মাস চিকিৎসা করিয়ে ভালো করি। এই তো মাত্র দশ বারদিন হল আমরা ফিরেছি।
আরিফ আল্লাহপাকের দরবারে হাজার হাজার শুকরিয়া জানিয়ে বলল, তিনি যা কিছু করেন, তার বান্দাদের মঙ্গলের জন্যই করেন। তুমি অত মন খারাপ করছ কেন? এবার একটা ভালো মেয়ে দেখে ভাইয়ার বিয়ের ব্যবস্থা কর।
রাত্রি আটটায় সেলিম ঘরে ফিরল। তাকে দেখতে পেয়ে আরিফ সালাম দিয়ে প্রায় ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে বলল, ভাইয়া তুমি কেমন আছ?
সেলিম সালামের উত্তর দিয়ে ছোট ভাইকে আবেগের সঙ্গে বুকে চেপে ধরল। তারপর কান্নাজড়িত স্বরে বলল, মাঝে মাঝে চিঠি দিয়ে আমাদের অশান্তি দূর করতে পারতিস। তোর ঠিকানা জানা থাকলে আর কথা জানাতে পারতাম। তারপর দুভাই দুজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। এশার আজান শুনে সেলিম বলল, চল মসজিদ থেকে নামায পড়ে আসি।
আরিফ সেলিমকে আবার জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি নামায পড়? ইয়া আল্লাহ তোমার দরবারে জানাই লাখ লাখ শুকরিয়া।
সেলিম আস্তে আস্তে ভিজে গলায় বলল, তোকে এক সময় সব কথা বলব। এখন শুধু এইটুকু জেনে রাখ, যে আমাকে এই পথে চালিত করল, তাকে ভাগ্যদোষে হারিয়ে ফেলেছি।
নামায পড়ে এসে সকলে মিলে গল্প করতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে সোহানা বেগম খাওয়ার জন্য সবাইকে ডেকে পাঠালেন।
ডাইনিংরুমে গিয়ে আরিফ বলল, ভাইয়া, চেয়ার টেবিলে বসে খাওয়া আর চলবে না।
সেলিম বলল কেন? হাদিসে এরকম কিছু লেখা আছে নাকি? না এটা তোর গোঁড়ামী?
আরিফ বলল, আমার গোঁড়ামী কি না জানি না, আর হাদিসেও তা লেখা নেই। তবে রাসূলুল্লাহ (সঃ) ফ্লোরে বসে দস্তরখানা বিছিয়ে খেতেন। হাদিসে আছে, তিনি বলেছেন, “যে দস্তরখানা বিছিয়ে খাবে এবং তাতে যা খাবার পড়বে তা কুড়িয়েও খাবে, সে কোনোদিন অভাবগ্রস্ত হবে না। আর যারা খাবার জিনিষ যদি চারিদিকে ফেলে খায়, তা হলে ঐ ফেলে রাখা খাবারগুলো তাদের জন্য অভিসম্পাৎ করে।১” তা ছাড়া এটা বিধর্মীদের অনুকরণ করা হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (সঃ) আরো বলেছেন “যারা যে ধর্মাবলম্বীদের অনুকরণ করবে অর্থাৎ তাদের যে কোনো কাজ পছন্দ করবে, তারা কেয়ামতের দিন তাদের সঙ্গে উঠবে।২” এখন তুমিই বল, আমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে অনুকরণ করব না বিধর্মীদের অনুকরণ করব?
সেলিম বলল, ঠিক আছে আজ খেয়ে নে, পরে যে যার ইচ্ছামত করবে। না তুই মেঝেয় বসেই খাবি?
আরিফ বলল, টেবিল চেয়ারে বসে খাব না কেন? এতে খেলে তো আর গোনাহ হচ্ছে না। তবে এটা সুন্নতের বরখেলাপ, পরিত্যাগ করা উচিৎ।
খেতে খেতে সেলিম আসমাকে দেখিয়ে আরিফকে জিজ্ঞেস করল, একে চিনিস? এ বড় বিপন্না মেয়ে। নাম অসমা। ওর একটা ফুটফুটে ছেলে আছে। আমি একে ছোট বোন বলে গ্রহণ করেছি। আশা করি, তুইও ওকে ছোট বোনের মত গ্রহণ করবি।
আরিফ বলল, আল্লাহপাক তা হলে আমাদেরকে আর একটা বোন দিয়েছেন? খাওয়ার পর্ব শেষ করে সকলে বারান্দায় বসে আরিফের বিদেশে কাটান দিনগুলোর কথা শুনতে লাগল। সোহানা বেগম একবার ঘুমাবার জন্য তাড়া দিয়ে গেলেন। আসমা তার বাচ্চাকে নিয়ে ঘুমাতে গেল। একটু পরে রুবীনা ঘুম পাচ্ছে বলে উঠে গেল। আরিফ বলল, ভাইয়া, তোমার উপর আমার যেন কেমন সন্দেহ হচ্ছে।
কি রকম সন্দেহ?
মনে হচ্ছে কোনো মায়বীনি তোমাকে তার মায়ায় ফেলেছে। তুমি সেই মায়ার যাদুতে হাবুডুবু খাচ্ছ। শত চেষ্টা করেও নাগাল পাচ্ছ না।
সেলিম তার মুখের দিকে হা করে চেয়ে রইল, কিছুই বলতে পারল না।
কি হল ভাইয়া, তুমি কথা বলছ না কেন? তুমি নারীর প্রেমে পড়েছ বলেছি বলে আমাকে খুব অসভ্য, বেহায়া মনে করছ বুঝি?
সেলিম সামলে নিয়ে বলল, সেটা ভাবা কি আমার অন্যায় হবে?
তা হবে না বলে আরিফ চুপ করে গেল।
সেলিম করুণ স্বরে বলল, তোর সন্দেহটা ঠিক। সত্যিই আমি লাইলী নামে একটা মেয়েকে ভালবেসেছি। কিন্তু ললাট লিখন কে খণ্ডাবে বল। কপালের ফেরে দুজনেই বিরহ জালায় জ্বলছি। আল্লাহই জানেন আমাদের কি হবে।
তুমি কি বলছ ভাইয়া আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
সেলিম খুব সংক্ষেপে ওদের দুজনের ঘটনা বলল। তারপর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তুই এবার ঢাকার সব কিছু দেখাশোনা কর। আমি চিটাগাং-এরটা দেখব। শুনেছি, লাইলী সেখানেই আছে? চেষ্টা করব তাকে খুঁজে বের করার। বাকি আল্লাহপাকের মর্জি।