» » ফুটন্ত গোলাপ

বর্ণাকার
🕮

তিন

পরের দিন লাইলী সারা শরীরে ব্যথা নিয়ে উঠে ফযরের নামায পড়ে কোরআন শরীফ তেলাওয়াত করল। তারপর প্রতিদিনের মতো রান্না ঘরে এসে মাকে সাহায্য করতে লাগল। আব্বা নাস্তা খেতে এলে বলল, আমার বোরখা কিনে আনবে। তা না হলে আমি ভার্সিটি যাব কেমন করে।

আজ তো হবে না মা, মাসের শেষ। হাত একদম খালি। বেতন পেয়ে কিনে দেব।

তোমার বেতন পেতে তো এখনও চার পাঁচ দিন বাকি। এতদিন ক্লাস কামাই করব?

দেখি কারও কাছ থেকে যদি জোগাড় করতে পারি, তা হলে নিয়ে আসব।

হামিদা বানু বললেন, ওর আর পড়াশোনা করার দরকার নেই। মেয়ে কি চাকরি করে আমাদের খাওয়াবে যে, লেখাপড়া করতেই হবে?

লাইলী মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তাই না হয় আমি চাকরি করে তোমাদের খাওয়াব। আর অমত করবে না তো?

হয়েছে হয়েছে, তোর ভাইয়া ফাঁকি দিয়ে চলে গেল। আর তুইও একদিন পরের ঘরে চলে যাবি বলে হামিদা বানু আঁচলে চোখ মুছলেন। এবার ছাড়, নাস্তা খেয়ে নে। বড় হলি এখনও ছেলেমানুষি গেল না।

লাইলী মাকে ছেড়ে দিয়ে নাস্তা খেতে লাগল।

গত পাঁচদিন লাইলী ভার্সিটি যায়নি। কারণ তার আরা বোরখা কিনে দিতে পারেনি। আজ ছুটির দিন তার ধারণা হল, সেলিম আজ নিশ্চয় আসবে। সকালে রান্নাঘরে মায়ের কাছে গিয়ে বলল, আজ ভার্সিটির সেই ছেলেটা আসতে পারে।

হামিদা বানু বললেন, ভালো কথা মনে করেছিস। হারে, ওরা খুব বড়লোক না? হ্যাঁ, বলে লাইলী নিজের রুমে চলে গেল। হামিদা বানু রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে স্বামীর কাছে এলেন।

উনি তখন একটা হাদিসের বই পড়ছিলেন। স্ত্রীকে কাছে এসে দাঁড়াতে দেখে হাদিসটা বন্ধ করে বললেন, কিছু বলবে নাকি?

লাইলী বলছিল, ইউনিভার্সিটির সেই ছেলেটা, যে লাইলীকে সেদিন বিপদ থেকে উদ্ধার করে দিয়ে গিয়েছিল, সে আজ আসতে পারে। তোমাকেওতো সেকথা বলে ছিলাম। এখন বাজার থেকে কিছু মিষ্টি, ময়দা আর ফল নিয়ে এস। কিছু ব্যবস্থা করতে হবে তো?

রহমান সাহেব বললেন, খুব ভালো কথা মনে করেছ। আমি তো একদম ভুলেই গিয়েছিলাম। তারপর তাড়াতাড়ি করে বাজারে গেলেন। মুরগী, মাছ ও নাস্তার সবকিছু এনে বললেন, ছেলেটাকে দুপুরে খেয়ে যেতে বলা যাবে। যদি রাজি হয়, তাই মুরগী ও মাছ আনলাম। তুমি ভালো করে রান্না কর। আর বৌমাদেরও বলে দিও, তারাও আজ দুপুরে আমাদের এখানে খাবে। তারপর নিজেই নিচে এসে হাঁক দিলেন, সাদেক দাদু ঘরে আছ নাকি?

দাদুর গলা পেয়ে সাদেক ও ফিরোজা পড়তে পড়তে বইখাতা ফেলে রেখে ছুটে এসে রহমান সাহেবকে জড়িয়ে ধরল।

সাদেক জিজ্ঞেস করল, আজকে নাকি একজন মেহমান আসবেন, আম্মা বলছিল।

রহমান সাহেব প্রতিদিন বাজার থেকে ফেরার সময় ওদের জন্য চকলেট নিয়ে আসেন। আজও এনেছেন। সেগুলো দুজনকে ভাগ করে দিয়ে বললেন, হ্যাঁ ভাই, আসার তো কথা আছে। তবে সে আসুক আর নাই আসুক, তুমি মাকে গিয়ে বল, এবেলা তোমরা সবাই আমাদের ওখানে খাবে। তারপর ওদেরকে নিয়ে ড্রইংরুমে এসে বসলেন।

এক কাপ চা ও বিস্কুট নিয়ে রহিমা ঘরে ঢুকে বলল, খালুজান, আপনারা এত ঝামেলা করতে গেলেন কেন?

ঝামেলা আর কি মা, তোমরাও তো এবাড়ির লোক। হাতের কাজ সেরে একটু উপরে যাওতো মা, তোমার খালা আম্মাকে সাহায্য করবে।

আমি এক্ষুণি যাচ্ছি বলে রহিমা খালি চায়ের কাপ নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

সেলিম পৌঁনে দশটার সময় লাইলীদের বাড়ির গেটের পাশে গাড়ি পার্ক করে কলিং বেলের বোতামে চাপ দিল।

সাদেক দরজা খুলে তার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। সেদিন সে সেলিমকে অল্পক্ষণের জন্য দেখেছিল, তাই চিনতে পারল না। জিজ্ঞেস করল, কাকে চান? কোথা থেকে এসেছেন?

সেলিম এতটুকু ছেলের উকিলি জেরা শুনে একটু অবাক হয়ে বলল, আমি লাইলীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। তিনি কি বাড়িতে আছেন?

সাদেক বলল, জ্বি আছেন, তবে তার সঙ্গে দেখা হবে না। কারণ ফুপুআম্মা কোনো বেগানা লোকের সঙ্গে দেখা করেন না। যদি বলেন, তা হলে দাদুকে খবর দিতে পারি। নচেৎ এখন বিদায় হন। একজন মেহমান আসার কথা আছে। আমি তার জন্য অপেক্ষা করছি।

সেলিম ছেলেটির বুদ্ধি ও কথাবার্তা শুনে আরো অবাক হয়ে বলল, যদি বলি আমিই সেই মেহমান।

এবার সাদেক অবাক দৃষ্টিতে সেলিমের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বলল, সন্দেহ হচ্ছে।

কেন সন্দেহ হচ্ছে কেন?

তিনি খুব বড় লোকের ছেলে। গাড়ি করে আসবেন। তার পোশাক পরিচ্ছদ খুব দামী।

সেলিম বড় লোকের ছেলে হয়েও পোশাকের দিকে তেমন তার খেয়াল থাকে না। সে সেদিন সাধারণ পোশাক পরে এসেছে।

লাইলী কলিংবেলের আওয়াজ শুনে হাতের কাজ সেরে বারান্দায় বেরিয়ে সাদেককে সেলিমের সঙ্গে কথা বলতে দেখে তাড়াতাড়ি নিচে এসে জলিল সাহেবকে বলল, ভাইয়া, সেই ছেলেটা এসেছে।

জলিল সাহেব গিয়ে সাদেকের শেষ কথাগুলো শুনে বললেন, সাদেক কি বেয়াদবি করছ? বাড়িতে মেহমান এলে আগে তাকে ঘরে এনে বসাতে হয়, তারপর আপ্যায়ন শেষে আলাপ করতে হয়।

সাদেক বলল, জান আব্বু, ইনি না ফুপু আম্মাকে খোঁজ করছিলেন। তাই আমি ওনার পরিচয় জেনে নিচ্ছিলাম। তা হলে এনারই আসার কথা ছিল? তারপর সেলিমের একটা হাত ধরে বলল, আমি তো আপনাকে চিনি না, তাই অনেক বেয়াদবি করে ফেলেছি। মাফ করে দিন।

সেলিম এতটুকু ছেলের কথাবার্তা ও ব্যবহারে আরো বেশি আশ্চর্য হয়ে বলল, না, তুমি কোনো অন্যায় করনি। বরং আমি খুব খুশি হয়েছি।

জলিল সাহেব বললেন, ভিতরে চলুন। ওরা সবাই এসে ড্রইংরুমে বসল।

এমন সময় রহমান সাহেব ঘরে ঢুকে সালাম দিয়ে বললেন, আপনি আসায় আমরা খুব খুশি হয়েছি। সেদিন আমার মেয়েকে উদ্ধার করে যে উপকার করছেন, সে কথা আর কি বলব বাবা, আল্লাহপাকের ইচ্ছায় আমরা মেয়েকে ফিরে পেয়েছি। সেই পরম করুণাময়ের নিকট দোয়া করি, তিনি আপনাদের সর্বাঙ্গীন মঙ্গল করুন।

সেলিম বলল, আমি এমন কোনো মহৎ কাজ করিনি। আপনার মেয়ে বিপদে পড়েছিলেন, আমি সাধ্যমত তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার চেষ্টা করে সফল হয়েছি। এটা করা প্রত্যেক মানুষের একান্ত কর্তব্য।

জলিল সাহেব উঠে গিয়ে নাস্তা নিয়ে এসে টেবিলের উপর রাখলেন।

রহমান সাহেব বললেন, আপনারা নাস্তা খেয়ে নিন, আমি আসছি। কথা শেষ করে সেখান থেকে চলে গেলেন।

সারা শরীর ও মাথা ঢেকে লাইলী চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে ঘরে ঢুকে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন? খালা আম্মা ভালো আছেন?

সেলিম লাইলীর সুমিষ্ট গলার স্বরে আকৃষ্ট হয়ে সালামের জবাব না দিয়ে তার চোখে চোখ রেখে বলল, আমাদের সব ভালো। আপনি এই কয়দিন ভার্সিটি যাননি কেন? আমি মনে করেছিলাম, বৃষ্টিতে ভিজে আপনার অসুখ করেছে।

লাইলী বলল, শরীর একটু খারাপ হয়েছিল, এখন ভালো আছি। কাল থেকে ভার্সিটি যাব। সে দুটো প্লেটে নাস্তা তৈরি করে জলিল সাহেবকে বলল, ভাইয়া আপনিও আসুন।

নাস্তা শেষে তারা যখন চা খাচ্ছিল তখন রহমান সাহেব এসে চেয়ারে বসলেন।

লাইলী আব্বাকে চা দিল।

চা খেতে খেতে তিনি বললেন, আপনাকে একটা অনুরোধ করবো রাখবেন?

সেলিম বলল, দেখুন, আমি আপনার ছেলের মতো, আমাকে আপনি করে বলছেন কেন? তুমি করেই বলুন।

সেলিমের কথা শুনে তার দুচোখ অশ্রুতে ভরে গেল। সেটা গোপন করার জন্য কোনো কিছু না বলে উঠে চলে গেলেন।

সেলিম কিছু বুঝতে না পেরে লাইলীর দিকে তাকিয়ে রইল।

জলিল সাহেব ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বললেন, ওঁর একটা ছেলে ছিল। বি. এ. পাশের রেজাল্ট নিয়ে ফেরার সময় গাড়ি চাপা পড়ে মারা যায়। সেই থেকে কেউ ছেলের মতো ব্যবহার করলে সামলাতে পারেন না। ওঁর ব্যবহারে আপনি কিছু মনে নেবেন না।

লাইলীর চোখেও পানি দেখে সেলিম কিছু বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় রহমান সাহেব ফিরে এসে বসলেন। মুখটা থমথমে।

সেলিম বলল, আমি না জেনে আপনাদের মনে দুঃখ দিলাম। আমাকে মাফ করে দিন।

রহমান সাহেব ধরা গলায় বললেন, না বাবা তুমি কোনো অন্যায় করনি। শুধু শুধু মাফ চাইছ কেন? আমি তখন যে কথা বলতে চাচ্ছিলাম, তুমি যদি দুপুরে একমুঠো ভাত খেয়ে যাও, তা হলে আমরা খুব খুশি হতাম।

সেলিম কারও বাড়িতে কখনো ভাত খায় না। যত বড় বন্ধু-বান্ধবী হোক না কেন, চা থেকে বড় জোর নাস্তা পর্যন্ত। কে মনে কষ্ট করল না করল, তা কোনোদিন ভাবেনি। কিন্তু আজ সে প্রতিবাদ করতে পারল না। কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বলল, আবার কষ্ট করতে যাবেন কেন? এইতো কত কিছু খেলাম।

জলিল সাহেব বললেন, আপনার যদি কোনো অসুবিধা না থাকে, তা হলে আর আপত্তি করবেন না।

সেলিম এক পলক লাইলীর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল, কত মিনতিভরা দৃষ্টিতে সে তার দিকে চেয়ে আছে। বলল, আমি এখন এক জায়গায় যাব। বেলা দুটোর মধ্যে ফিরে আসব।

রহমান সাহেব বললেন, শুনে খুশি হলাম। বেশ তাই এসো। তারপর উনি আর জলিল সাহেব চলে গেলেন।

লাইলী নাস্তার প্লেট ও চায়ের কাপ নিয়ে যেতে উদ্যত হলে সেলিম বলল, শুনুন।

লাইলী তার দিকে ঘুরে বলল, এগুলো রেখে এক্ষুণি আসছি। কথা শেষ করে চলে গেল। দুতিন মিনিটের মধ্যে ফিরে এসে বলল, বলুন কি বলবেন।

আপনার ভাইয়াকে আপনি বলে সম্বোধন করছিলেন কেন? আমার কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে? আচ্ছা, উনি আপনার কি রকম ভাই?

লাইলী বলল, আপনার সন্দেহ ঠিক। উনি আমাদের বাড়িতে অনেকদিন থেকে ভাড়া আছেন। আমরা সবাই একসঙ্গে মিশে গেছি। উনি ও উনার স্ত্রী, আব্বা আম্মাকে নিজের বাবা-মার মতো দেখেন। তাদেরকে খালুজান ও খালাম্মা বলে। ডাকেন। তাই আমি ওঁকে ভাইয়া আর ওঁর স্ত্রীকে ভাবি বলে ডাকি।

সেলিম বলল, সত্যি, এরকম সচরাচর দেখা যায় না। তারপর দুজনে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে দুজন দুজনকে দেখতে লাগল। ফলে বারবার চোখাচোখি হয়ে যাচ্ছে। এক সময় সেলিম বলল, কথা বলছেন না কেন?

লাইলী লজ্জা পেয়ে আঙ্গুলে আঁচল জড়াতে জড়াতে বলল, চুপ করে থেকেও তো অনেক কিছু বলা যায়।

তা যায়। তবে তারা হল গাছ-পালা, পাহাড়-পর্বত। কিন্তু আমরা তো মানুষ, কথা বলার জন্য আমাদের মুখ আছে। যাই হোক, আমাকে এখন একটু উঠতে হবে বলে সেলিম দাঁড়িয়ে পড়ল।

এমন সময় সাদেক ছুটে এসে বলল, ফুপু আম্মা, আপনাকে আম্মা ডাকছেন। তারপর সেলিমের দিকে তাকিয়ে বলল, তা হলে আপনিই সেদিন ফুপু আম্মাকে গুণ্ডাদের হাত থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছিলেন।

হ্যাঁ বলে সেলিম সাদেকের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, তোমার ফুপু আম্মা কিন্তু আমাকে অনেক দিন আগে হামলা করে ঘায়েল করে রেখেছেন।

সাদেক অবাক হয়ে লাইলীর দিকে চেয়ে বলল, তুমিও তা হলে মারামারী করতে পার?

সেলিমের কথা শুনে লাইলী চমকে উঠল। তারপর সাদেককে কাছে টেনে নিয়ে বলল, তুমিই বলত বাপি, আমাকে কখন কুস্তি বা মারামারী করতে দেখেছ?

কই নাতো? তারপর সেলিমের দিকে চেয়ে বলল, আপনি তা হলে একথা বললেন কেন?

সেলিম ওর গালটা আলতো করে টিপে দিয়ে বলল, সে তুমি এখন বুঝবে না, বড় হলে বুঝবে। এখন আসি দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে সেলিম চলে গেল।

ঠিক আড়াইটায় সেলিম ফিরে এসে খাওয়া-দাওয়া সেরে চারটের সময় ঘরে ফিরল।

পরের দিন সেলিম লাইব্রেরীতে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।

দুটো দশ মিনিটে লাইলী এসে দেখল, সেলিম চেয়ারে বসে একটা বই দেখছে। সেখানে আর কেউ নেই। শুধু লাইব্রেরীয়ান এককোণে তার সীটে বসে কি যেন লিখছে। লাইলী সেলিমের সামনে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন?

সেলিম শুধু তার মুখের দিকে একদৃষ্ট চেয়ে রইল। সালামের উত্তর বা কোনো কথা বলল না।

লাইলী তাকে চুপ করে থাকতে দেখে সেও বেশ কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে রইল। তারপর লজ্জা পেয়ে মাথাটা নিচু করে নিয়ে কম্পিত স্বরে বলল, আমি কাছে এলেই আপনি আমার দিকে অনেকক্ষণ ধরে চেয়ে থাকেন কেন? আমার লজ্জা করে না বুঝি? এই কথা বলার পর ও যখন সে কথা বলল না তখন লাইলী আবার বলল, কী চুপ করে আছেন কেন? কথা বলুন!

এবার সেলিম একটু নড়েচড়ে বসে বলল, কথা বলতে বলছেন? বললে শুনবেন তো?

লাইলী কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বলল, শুনবার হলে নিশ্চয় শুনবো।

তা হলে আসুন আমার সঙ্গে বলে সেলিম চেয়ার ছেড়ে এগোল।

লাইলী মনের মধ্যে দ্বন্ধ নিয়ে তার পিছু নিল।

সেলিম একেবারে গাড়ির কাছে এসে ড্রইভিং সীটে বসে পাশের দরজা খুলে দিয়ে বলল, উঠে আসুন।

গাড়িতে উঠবে কিনা লাইলী চিন্তা করতে লাগল।

সেলিম বলল, দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? উঠে আসুন। তাকে ইতস্ততঃ করতে দেখে আবার বলল, আমাকে কী আপনি বিশ্বাস করতে পারছেন না?

এরপর লাইলী আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না, ধীরে ধীরে গাড়িতে উঠে দরজার কাছ ঘেসে বসল।

সেলিম সিগারেটের প্যাকেট বার করে বলল, আমি সিগারেট খেলে আপনার অসুবিধা হবে না তো?

লাইলী শুধু মাথা নাড়াল।

সিগারেট ধরিয়ে সেলিম গাড়ি ছেড়ে দিল। একেবারে হোটেল ইণ্টারকনের গেটে গাড়ি পার্ক করে নেমে লাইলীর দিকের দরজা খুলে দিয়ে নামতে বলল। নামার পর তাকে নিয়ে একটা কেবিনে ঢুকে মুখোমুখি বসে বলল, কি খাবেন? তাকে চুপ করে থাকতে দেখে আবার বলল, অন্তত এখানে যতক্ষণ থাকব ততক্ষণ মুখের নেকাবটা সরিয়ে মুখটা ভোলা রাখুন।

লাইলী কিন্তু একটা কথাও বলল না, আর মুখের নেকাবও সরাল না, মাথা নিচু করে বসে রইল।

বেয়ারা বাইরে সাড়া দিলে সেলিম তাকে ডেকে দই মিষ্টির অর্ডার দিল। বেয়ারা চলে যেতে উঠে এসে লাইলীর মুখের নেকাব সরিয়ে দিয়ে অবাক হয়ে দেখল, তার আপেলের মতো নিটোল গোলাপী গাল বেয়ে অশ্রুবিন্দুগুলো মুক্তার ন্যায় গড়াচ্ছে। ভ্যাবাচাখা খেয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি, মানে আপনি কাঁদছেন?

বেয়ারা আসার শব্দ পেয়ে লাইলী মাথাটা আরও নিচু করে নিল।

সেলিম বেয়ারাকে বলল, আমি না ডাকা পর্যন্ত তোমার আসার দরকার নেই। বেয়ারা নাস্তার প্লেট রেখে ফিরে যেতে, সেলিম তার চিবুক ধরে তুলে অনেকক্ষণ চেয়ে রইল।

লাইলী চোখ বন্ধ করে মুক্তাবিন্দু ঝরাতে লাগল।

তার শরীরের কাপনি অনুভব করে সেলিম চিবুক থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, জ্ঞানমতে আমি কোনো অন্যায় করিনি। তবু যদি অজান্তে করে থাকি, তবে মাফ করে দিন। প্রীজ আর চুপ করে থাকবেন না। তারপর হাঁটুগেড়ে বসে হাত জোড় করে বলল, চোখ খুলে দেখুন, আপনার সেলিম হাত জোড় করে আপনার কাছে মাফ চাইছে।

লাইলী অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে রুমালে চোখ মুছে সেলিমকে ঐ অবস্থায় দেখে দাঁড়িয়ে জোড় করা হাত ধরে বলল, ছি ছি, আপনি একি করছেন? উঠুন। সেলিম চেয়ায়ে বসার পর লাইলী আবার বলল, আপনি কোনো অন্যায় করেন নি, করেছি আমি।

সেলিম বলল, আমার তো মনে হচ্ছে আমরা কেউ-ই করিনি। ঠিক আছে, আগে নাস্তা খেয়ে নিই আসুন, তারপর বিচার করব, কে অন্যায় করেছে।

নাস্তা খাওয়ার পর লাইলী বলল, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

করুন।

ঐ দিন আমাকে আপনাদের গাড়িতে কে এনেছিল?

প্রথমে মা আপনাকে নিয়ে আসার জন্য গিয়ে দেখে আপনি অজ্ঞান হয়ে গেছেন। তখন আমি দু’হাতে তুলে আপনাকে নিয়ে আসি।

লাইলী লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে বলল, আমি আর একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।

আপনি অত সংকোচ করছেন কেন? যতকিছু জিজ্ঞেস করুন না কেন, উত্তর দিতে আমি দ্বিধা বোধ করব না। আমি সবকিছু খোলাখুলি পছন্দ করি। কারুর মতো মনে এক আর বাইরে এক, এটা আউট অফ মাই প্রিন্সিপাল।

আপনারা তো খুব বড় লোক?

সেলিম ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।

আমি যতদূর জানি, যারা খুব বড়লোক, তারা ধর্মকে খুব এড়িয়ে চলে। আপনাদের বেলায়ও কি কথাটা প্রযোজ্য?

দেখুন, ধর্ম কি জিনিস জানি না। তবে মানব ধর্ম আমি মেনে চলি। যা কিছু ন্যায় তাকে ধর্ম জ্ঞান করি। আর যা কিছু অন্যায় তাকে অধর্ম মনে করি।

আপনি ঠিক বলেছেন। তবে কি জানেন, মানুষ নিজের জ্ঞানের দ্বারা ন্যায় অন্যায় বিচার করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে ভুল করে ফেলে। ফলে একটা জিনিস তার কাছে ন্যায় হলেও অন্যের কাছে অন্যায় বলে মনে হয়। কথায় বলে, যত মত তত পথ। তাই আমাদের তথা বিশ্বের সমস্ত মানুষের উচিত, সারা মখলুকাতের যিনি সৃষ্টিকর্তা, তাঁর আইন কানুন মেনে চলা। কারণ একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন তার সৃষ্টিজীবের জন্য কি কি আইন কানুন দরকার হতে পারে। সেই জন্য তিনি কোরআন পাকে এবং তার প্রেরিত রাছুল হযরত মুহাম্মদ (দঃ) এর মারফত হাদিসে সব আইন-কানুন বাতলে দিয়েছেন। সারা বিশ্ববাসী যদি কোরআন ও হাদিস মোতাবেক রাজনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবনে মেনে চলত, তা হলে পৃথিবীতে এত অশান্তির বহ্নিশিখা জ্বলে উঠত না। আর কোটি কোটি টাকা খরচ করে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরী করে মানুষ মারার ষড়যন্ত্র করত না। ক্লাস এইটের ইংরেজী বই-এ পড়েছিলাম, “ম্যান ইজ দি ওয়ারস এনিমি অফ ম্যান”। মানুষই মানুষের সব থেকে বড় শত্রু। আপনার নাম যখন মুসলমান তখন নিশ্চয় আপনি ইসলাম ধর্মাবলম্বী। আপনি আমার থেকে বেশি জ্ঞানী। তবু আপনাকে অনুরোধ করব, ইসলাম সম্বন্ধে দেশী ও বিদেশী ভাষায় অনেক ধরণের বই আছে সেগুলো পড়তে। তা হলে নিজের কৃষ্টি ও সাংস্কৃতি জানতে পারবেন। আজকাল স্কুল, কলেজ ও ইউনিভার্সিটির ছেলে-মেয়ে এবং অনেক উচ্চ ডিগ্রীধারী নর-নারী বিভিন্ন দেশের কৃষ্টি ও সাংস্কৃতিকে দেখে শুনে সেগুলোকে ভালো মনে করে তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় কি জানেন? তারাই আবার মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও কোরআন-হাদিসের জ্ঞান অর্জন না করে আল্লাহর আইন-কানুনকে বিদ্রুপ করে। যাই হোক, আমি তো অনেকক্ষণ বক বক করলাম, মনে কিছু করেননি তো?

সেলিম বলল, না বরং আপনার কাছে আমি অনেক নতুন জিনিস জানতে পারলাম।

লাইলী বলল, আপনি ভুল বললেন। আমি নতুন কিছু বলিনি। জানেন নি বলে পুরান কথাগুলো নতুন বলে মনে হয়েছে।

তা না হয় হল। আপনি কাঁদছিলেন কেন বলবেন না?

লাইলী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, সত্য কথা অনেক সময় অপ্রিয় হয়। উত্তরটা সেই রকম হয়ে যাবে যে?

যতই অপ্রিয় হোক, তুমি-মানে আপনি বলুন।

আপনি আমাকে তুমি করেই বলবেন।

তুমিও তা হলে তাই বলবে বল?

দেখুন মেয়েরা সাধারণতঃ ছেলেদের চেয়ে একটু ব্যাকওয়ার্ড হয়। তাই আপনি এ্যাডভান্স হন, আমিও আপনার পিছু নেবার চেষ্টা করব। সেলিমকে চুপ করে থাকতে দেখে লাইলী বলতে শুরু করল, আমি গোড়ার কথায় ফিরে যাচ্ছি। প্রথমে আপনি স্বীকার করেছেন, আপনারা খুব বড়লোক। সে কথা আপনাদের বাড়িতে জ্ঞান হওয়ার পর বুঝতে পারি এবং তখন থেকেই খুব ভয় পেয়েছি।

সেলিম তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ভয় পেলে কেন?

লাইলী কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বলল, আজ থাক আর একদিন বলব। এখন ক্লাশে যেতে হবে চলুন।

রীষ্টওয়াচের দিকে চেয়ে সেলিম বলল, তুমি আগে আমার দুটি প্রশ্নের উত্তর দাও, তারপর ক্লাশ করার কথা চিন্তা করব। আমার প্রশ্নগুলো তুমি এড়িয়ে যেতে চাচ্ছ কেন?

লাইলী বলল, আপনার দুটি প্রশ্নের উত্তরে মনের মধ্যে অনেক কথা এসে ভীড় করছে। কিন্তু যখন মনে পড়ছে আপনি বিপদ থেকে বাঁচিয়ে আমাকে তথা নারী জাতিকে অপমানের হাত থেকে রক্ষা করেছেন তখন আর কোনো কথা বলতে পারছি না। তা ছাড়া কথাগুলো শুনে আপনি আমাকে ভালো মন্দ দুটোই ভাবতে পারেন এবং মনে কষ্টও পাবেন।

তুমি জান না লাইলী, তোমাকে আমি কতটা ভালবেসে ফেলেছি। তোমার কোনো কিছুই আমাকে এতটুকু কষ্ট দেবে না। তুমি নির্ভয়ে বল।

প্রথম কারণ হল, ইসলামের আইন অনুযায়ী যুবক যুবতীদের নির্জনে দেখা করা হারাম। দ্বিতীয় কারণ হল সেই প্রথম ঘটনার দিন থেকে আমিও আপনাকে মনে প্রাণে ভালবেসে ফেলেছি। তখন কিন্তু জানতাম না, আপনি বড় লোকের ছেলে। যখন জানতে পারলাম তখন থেকে আপনাকে মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছি। কিন্তু সফল হতে পারিনি। সব সময় আপনার কথা মনে পড়ে। সামনে পরীক্ষা এগিয়ে আসছে, সেকথাও ভুলে যাই। বড় লোকদের আভিজাত্যের অহংকারের ও তাদের ছেলেদের চরিত্রহীনতার কথা বাস্তবে দেখে এবং বই-পত্রে পড়ে তাদেরকে আমি বড় ভয় ও ঘৃণা করি। কিন্তু এমনি ভাগ্যের খেলা যে, হঠাৎ আপনার সাথে কি হতে কি হয়ে গেল। আপনাকে যতটুকু জেনেছি, তাতে করে আমি ভয় পেয়ে কেঁদেছি।

আমার কি এমন জেনেছ যার ফলে ভয় পেয়েছ। আমাকে দেখে কি অহংকারী ও চরিত্রহীন বলে মনে হয়?

হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে লাইলী বলল, তা হলে তো বেঁচে যেতাম। ঐ সব ভেবে মন থেকে আপনার স্মৃতি আস্তাকুড়ে ফেলে দিতাম। আপনাকে ব্যক্তিক্রম দেখে তা পারছি না। যত চেষ্টা করছি ততই আপনি চোরাবালির মত আমার অন্তরে গেড়ে বসে যাচ্ছেন। তার শেষের দিকে কথাগুলো কান্নার মত শোনাল। তারপর কয়েক সেকেণ্ডচুপ করে থেকে আবার বলল, আপনারা বিরাট বড়লোক। আমরা গরিব। আপনার সঙ্গে এভাবে মেলামেশা কি ঠিক হচ্ছে? একটা নগণ্য মেয়ের জন্য আপনি আপনাদের আভিজাত্যে পদাঘাত করতে পারবেন কি? আপনার অভিভাবকরা কি আমাকে মেনে নিতে পারবেন? সে আর নিজেকে সংযত রাখতে পারল না। রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল, তার চেয়ে এক কাজ করুন, আমার স্বপ্ন আমার অন্তরেই থাক। আপনি দয়া করে আমাকে ভুলে যান। আমি সাধারণ ঘরের মেয়ে। আপনাদের সোসাইটিতে আমার চেয়ে বডলোকের অনেক সুন্দরী মেয়ে আছে। তাদের দিকে একটু নজর দিলে আশা করি আমার কথা আর মনে থাকবে না। আপনাকে না পেলে যে দুঃখ পাব, আমাকে জড়িয়ে আপনার কোনো ক্ষতি হলে তার চেয়ে লক্ষ্যগুণ বেশি পাব। আমি কেঁদে কেঁদে শেষ হয়ে গিয়েও যদি আপনাকে সুখী দেখি, তা হলে আমার জীবন সার্থক মনে করব। আশা করি আমার কাঁদার কারণ বুঝতে পেরেছেন।

সেলিম এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল। লাইলীর কান্না দেখে তার চোখেও পানি এসে গেল। চোখ মুছে বলল, হ্যাঁ বুঝেছি। তুমি অকপটে তোমার মনের কথা আমাকে বলতে পেরেছ বলে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আজ পর্যন্ত আমাদের সোসাইটিতে যত মেয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি, তারা শুধু ঐশ্বর্যকে ভালবাসে, আমাকে নয়। আমি তোমার সৎসাহস দেখে শুধু অবাক হয়নি, খুব আনন্দ বোধও করছি। আমার মন বলছে অপাত্রে প্রেম নিবেদন করিনি। তুমি আমাকে যে সমস্ত কারণে ভালবেসে ফেলেছ, আমিও সেইসব কারণে তোমার মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি। সেখান থেকে আর ফিরতে পারব না। প্রেম ধনী-গরিব বিচার করে না। আমাদের প্রেম যদি সত্যিকার প্রেম হয়, তা হলে ঐশ্বর্যের ব্যবধান আর বংশ মর্যাদা বাধা হতে পারবে না। শোন লাইলী, তুমি আমার স্বপ্ন, আমার মানষী। তোমাকে না পেলে আমি বাঁচব না। তুমি যদি ইচ্ছা করে সরে যাও, তা হলে আমার জীবনের ঝুঁকি তোমারই উপর বর্তাবে।

লাইলী তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, কিন্তু আমি যে সমাজে, যে পরিবেশে মানুষ হয়েছি সেটা আপনাদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমি যে কোনো কাজ করি, সেটাকে ধর্মের কষ্টিপাথরে যাচাই করে করি। সে সমস্ত আপনি যদি অপছন্দ করেন, তা হলে আমাদের দাম্পত্ত জীবনে খুব তাড়াতাড়ি ফাটল ধরবে। তখন দুজনেরই জীবন খুব দুর্বিসহ হয়ে উঠবে।

সেলিম বলল, আমি তো জানি মেয়েদের প্রধান ধর্ম হল, স্বামীকে সব বিষয়ে অনুসরণ করা এবং তার প্রত্যেক কথায় ও কাজে সম্মতি দিয়ে সেই মতো করা।

আপনি ঠিকই জানেন। তবে অর্ধেকটা। বাকি অর্ধেকটা হল, স্বামী যদি স্ত্রীকে আল্লাহ ও রাসূলের (দঃ) আইনের বাইরে কোনো কাজ করতে বলে, তা হলে সে স্বামীর আদেশ অমান্য করে আল্লাহ ও রাসূলের (দঃ) আদেশ মানবে। তাতে যদি বিচ্ছেদ ঘটে তবুও। সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার উপরও ঐ একই আদেশ। মোট কথা পিতা মাতা হোক আর স্বামী-স্ত্রী হোক, যে কেউ আল্লাহ ও রাসূলের (দঃ) হুকুমের বাইরে আদেশ করলে সেক্ষেত্রে আল্লাহ ও রাসূলের (দঃ) হুকুম অগ্রগণ্য। এমন কি জেহাদের ময়দানে ছেলে পিতা মাতার বিরুদ্ধে এবং স্ত্রী স্বামীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে এবং আল্লাহর হুকুম মোতাবেক ছেলে পিতা মাতাকে এবং স্ত্রী স্বামীকে হত্যা করতে পারে। ইতিহাসে এর বহু প্রমাণ আছে।

সেলিম বলল, তুমি আমার চেয়ে অনেক জ্ঞানী। তোমার সঙ্গে যুক্তিতে পারব। কিন্তু মনে রেখ, যুক্তি দিয়ে তুমি আমার প্রেমের আগুন নেভাতে পারবে না। তুমি আউট বই অনেক পড়েছ। আমিও যদি পড়তাম, তা হলে তোমার যুক্তিকে খণ্ডন করে তোমাকে হারিয়ে দিতাম।

লাইলী বলল, আমি জ্ঞানী না ছাই। জ্ঞানীদের পায়ের ধূলিকণাও নই। তবে আমি অহঙ্কার করছি না, আল্লাহপাকের শোকর গুজার করে বলছি, তিনি আমাকে ইসলামের অনেক বই পড়ার তওফিক এনায়েৎ করেছেন। আমাকে হারাতে হলে আপনাকে আউট বই পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মের বইও পড়তে হবে বলে লাইলী মৃদু হাসল।

তাই পড়ব বলে সেলিম তার দিকে চেয়ে রইল। লাইলীর মৃদু হাসি তার অন্তরকে আনন্দে ভরিয়ে দিয়েছে। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, সত্যি, আল্লাহ তোমাকে এত সুন্দরী করে সৃষ্টি করেছেন যে, যতই দেখছি ততই দেখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু দেখার পিয়াস আর মিটছে না।

লাইলী নিজের প্রশংসা শুনে ভীষণ লজ্জা পেল। বলল, দেখুন, কটা বেজেছে খেয়াল আছে?

সেলিম বেয়ারাকে ডেকে দুটো কো-কের অর্ডার দিয়ে বলল, আর কিছু খাবে?

না বলে লাইলী চুপ করে রইল।

বেয়ারা কোক দিয়ে ফিরে গেলে সেলিম বলিল, ক্লাস কামাই করে দিলাম,

আমার উপর খুব রাগ হচ্ছে, না?

লাইলী মৃদু হেসে বলল, আপনারও তো ক্লাস কামাই হল, তার জন্য আমার উপর রাগ হচ্ছে না?

সেলিমও মৃদু হেসে বলল, এটা বুঝি আমার উত্তর হল? তোমার উপর রাগ হবে কেন? বরং তোমার কাছ থেকে অনেক জ্ঞান তো পেলামই আর কি পেলাম জান?

লাইলী মাথা নাড়াল।

আর পেলাম আমার প্রিয়তমার মনের খবর। যা আমার কাছে সারাজীবনের পরম পাওয়া। যা না পেলে আমার জীবন বৃথা হয়ে যেত। আমারটা তো শুনলে, এবার তোমারটা শুনাও।

আমারটা শুনতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে বুঝি? তা হলে শুনুন, আমি যে বিশ্বাস করতে পারছি না, আমার মত দীনহীনা মেয়ে আপনার অন্তরে বাসা বেঁধেছে। আল্লাহ পাককেই মালুম আমি কতদিন সেই বাসায় বাস করতে পারব।

সেলিম তৎক্ষণাৎ বলল, আমার জীবন যদি সত্য হয়, তবে চিরকালই সেই সত্যের সঙ্গে তুমি আমার অন্তরে বাস করবে।

লাইলী লজ্জা পেয়ে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, এবার চলুন। নচেৎ রিকশাওয়ালা ফিরে যাবে।

যাক না ফিরে ভালইতো। আমি গাড়ি করে তোমাকে পৌঁছে দেব। বিল মিটিয়ে দিয়ে দুজনে গাড়িতে উঠল। সেলিম জিজ্ঞেস করল, ভার্সিটির গেটে রিকশার খোঁজ করবে, না আমার সঙ্গে যাবে?

প্রত্যেক দিন লাইলী ভার্সিটিতে পৌঁছে ফেরার টাইমটা রিকশাওয়ালা করিমকে বলে দেয়। আজ চারটের সময় আসতে বলে দিয়েছিল। সে সাড়ে চারটে পর্যন্ত অপেক্ষা করে অন্য প্যাসেঞ্জার নিয়ে চলে গেছে। সেলিম ভার্সিটির গেটে গিয়ে গাড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, তোমার রিকশা নেই, এই হতভাগা তার প্রিয়তমাকে পৌঁছে দিক?

আপনি হতভাগ্য হতে যাবেন কেন? বরং এই হতভাগীর জন্য এত কষ্ট করবেন? তার চেয়ে আমি একটা রিকশা করে চলে যেতে পারব। আমার মত সাধারণ একটা মেয়ের সঙ্গে ঘুরলে আপনার গার্লফ্রেণ্ডরা আপনাকে কিছু বলুক তা আমি চাই না। তা ছাড়া আপনাদের সমাজে ইজ্জৎ আবরুর কোনো মূল্য নেই। কিন্তু গরীবদের টাকা না থাকলেও তাদের তা আছে।

সেলিম গাড়ি চালাতে চালাতে বলল, তোমার বেশীর ভাগ কথা বড়লোকের প্রতি হুল ফুটান। আর অনেক বোঝাও যায় না।

লাইলী বলল, আগেই তো বলেছি, সত্য বেশির ভাগ সময় অপ্রিয় হয়। আমি স্পষ্ট কথা বলতে ভালবাসি। আমার কথা না বোঝার তো কোনো কারণ নেই। যেমন ধরুন, বড়লোকের ছেলে কোনো গুরুতর অন্যায় করলে, টাকার জোরে তা চেপে দেওয়া হয়। আর কোনো গরিব ছেলে সেই অপরাধ করলে, বিচার করে চাবুক মেরে তার গা থেকে চামড়া তুলে নেয়া হয় বা পুলিশের হাতে দেওয়া হয়। বড় লোকের মেয়েরা অর্ধনগ্না হয়ে বাইরে গেলে, তাদের ইজ্জৎ যায় না এবং সমাজে তাদেরকে নিয়ে কেউ সমালোচনাও করে না। কিন্তু গরিব লোকের মেয়েরা গেলে তাদের ইজ্জৎও যায় এবং সমাজে তাদের সমালোচনাও হয়। আরও শুনুন আপনার সঙ্গে ঘুরে বেড়ালে বা আপনাদের বাড়িতে গেলে কেউ কিছু বলতে সাহস করবে না বা বলবে না। কারণ আপনারা বড়লোক এবং এটা আপনাদের সমাজের রীতি। কিন্তু কেউ যখন আমাদের বাড়ির সামনে আপনার গাড়ি থেকে দু’একদিন আমাকে নামতে দেখবে, তখন বড়লোক, গরীব লোক সকলের কাছে আমি সমালোচনার পাত্রী হয়ে যাব।

সেলিম গাড়ি থামিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল, তার মানে আমাকে তোমাদের বাড়িতে যেতে নিষেধ করছ?

নিজের কথার মর্ম যে এটাই বোঝায়, সেলিমের কথা শুনে তা বুঝতে পেরে লাইলী কি বলবে ঠিক করতে পারল না। ভীষণ লজ্জা পেয়ে চুপ করে চিন্তা করল, শেষের কথাগুলো এ সময় বলা উচিত হয় নি।

সেলিম তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে বলল, তবু যা হোক একটা কথাতেও তোমাকে হারাতে পারলাম।

লাইলী লজ্জায় কিছু বলতে পারল না।

সেলিমও আর কিছু না বলে তাদের ঘরের গেটের কাছে এসে গাড়ি থামাল। তারপর হাত বাড়িয়ে দরজা খুলে দিয়ে বলল, খুব পিয়াস লেগেছে, একগ্লাস পানি খাওয়াবে?

লাইলী গাড়ি থেকে নেমে বলল, অফকোর্স, আসুন আমার সঙ্গে। আমরা গরিব হতে পারি, কিন্তু অকৃতজ্ঞ নই।

আজ নয় অন্য দিন। তারপর লাইলী কিছু বুঝে উঠবার আগে সেলিম সাঁ করে গাড়ি নিয়ে চলে গেল।

লাইলী তার গাড়ির দিকে চেয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। গাড়িটা বাঁক নিয়ে অদৃশ্য হয়ে যেতে কলিং বেলে চাপ দিল।

পরের দিন অফ পিরিয়র্ডে কমনরুমে লাইলীর প্রিয় বান্ধবী সুলতানা তাকে জিজ্ঞেস করল, সই, গতকাল শেষের দুটো ক্লাসে তোকে খুঁজে পেলাম না কেন? বাসায় চলে গিয়েছিলি বুঝি?

তুই আগে বল, আমাকে খোঁজ করছিলি কেন?

বা-রে, তোকে আমি আবার কবে খোঁজ করিনি? তবে একটা বিশেষ খবর শোনাব বলে তোকে আরও খোঁজ করছিলাম।

সুলতানার আহ্বা বিরাট বড়লোক। কিন্তু ইসলামের খুব পাবন্দ। পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে ঢাকায় দুইটি বাড়ি পেয়েছেন। তিনি উচ্চ শিক্ষিত, সরকারী বড় অফিসার। গরিবদের প্রতি খুব স্নেহপরায়ন। তার কোনো পুত্র সন্তান নেই। শুধু চার মেয়ে। সুলতানাই বড়। সেও বোরখা পরে ভার্সিটি আসে। ওদের ফ্যামিলী খুব পদনিশীন। ওর মামাতো ভাই খালেদের সঙ্গে ছেলেবেলা থেকে দুজনের বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়ে আছে। সে এফ, আর সি, এস, ডিগ্রী নিতে বিলেত গেছে। পাশ করে ফিরে এলেই তাদের বিয়ে হবে। এটা তার শেষ বর্ষ। তারই চিঠি এসেছে। লাইলী ও সুলতানা দুই সই। দুজন দুজনের মনের সব গোপন কথা প্রায়ই বলাবলি করে। হবু স্বামীর চিঠি পেয়ে কিছু কথা বলবে বলে গতকাল সে লাইলীকে খোঁজ করেছিল।

সুলতানার কথা শুনে লাইলী হেসে উঠে বলল, তোর বিশেষ খবর তো খালেদ সাহেবের চিঠি? কই বের কর, তোর জন্য কতটা উতলা হয়ে আছে দেখি।

সুলতানা বলল, সত্যি সই, ওর চিঠি পেয়ে এক এক সময় কি মনে হয় জানিস?

কি?

যদি আমাদের বিয়ে হয়ে যেত, তা হলে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে ওর কাছে চলে যেতাম। ওকে আজ চার বছর দেখিনি। ওর কথা মনে পড়লে আমি স্থির থাকতে পারি না। তুই তো আমাদের সব কথা জানিস। তোকে তো আমি কোনো কিছু গোপন করি নি। এই নে পড়ে দেখ বলে চিঠিটা তার হাত দিয়ে রুমালে চোখ মুছল।

লাইলী তার হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে পড়তে লাগল।

সুলতানা, প্রেয়সী আমার,

গতকাল তোমার নরম তুলতুলে হাতের  লেখা পত্র আমাকে নবজন্ম দান করেছে। তোমার নাম সার্থক। সত্যি তুমি সম্রাজ্ঞী। তবে কোনো দেশের নয়, আমার হৃদয় রাজ্যের। আমার চিঠি পাওয়ার ডেট ওভার হয়ে যেতে তুমি থাকতে না পেরে আমাকে চিঠি দিয়েছ। খুব অভিমান হয়েছে না? হবারই কথা। কিন্তু না দেওয়ার কারণটা জানলে অভিমান কী রাখতে পারবে? আমার টাইফয়েড হয়েছিল। আজ পঁচিশ দিন পর ভাত খেলাম। যোহরের নামায পড়ে তোমাকে চিঠি লিখছি। আগেও তোমাকে অসুখের কথা জানাতে পারতাম, তোমার মন খারাপ হয়ে যাবে, সামনে পরীক্ষা, তাই জানাইনি। আল্লাহপাকের ইচ্ছায় ভালো হয়ে পত্র দিলাম। এবার আর আমার হৃদয়ের রানীর অভিমান নিশ্চিয় নেই? অসুখের সময় তোমাকে কাছে পেতে খুব ইচ্ছা হয়েছিল। কিন্তু বিধির বিধান লংঘন করবে কে? তোমাকে কাছে পেতে অনেক বাধা। তাই আল্লাহপাকের কাছে সাহায্য চেয়ে সবর করছি। এবার দেশে ফিরে দেখব কেমন করে তুমি দূরে থাক। জান, তোমাকে চিঠি লিখতে বসলে এক সঙ্গে অনেক কথা এসে ভীড় করে। কোনটা লিখব, না লিখবো ঠিক করতে না পেরে শেষে সব গুলিয়ে যায়। তোমার স্মৃতি আমার তনু-মনুর সঙ্গে মিশে রয়েছে। যদিও জানি তুমি আমার, তবু মনে হয় তোমাকে পাব তো?

ছুটির দিন হোষ্টেলের সব ছেলেরা কত জায়গায় বেড়াতে যায়। আমার যেতে মন চায় না। একদিন বন্ধু জায়েদ ইবনে সাঈদ, সে সৌদি আরব থেকে এসেছে, জোর করে মিউজিয়াম ও চিড়িয়াখানা দেখাতে নিয়ে গেল। তার সঙ্গে গেলাম, সবকিছু দেখলাম; কিন্তু মনে শান্তি পেলাম না। আমার তখন মনে হয়েছে, তোমাকে সাথে না নিয়ে শান্তি পাচ্ছি না। আমাকে সে বলল, কিরে তুই অমন মন মরা হয়ে আছিস কেন? এটাই তো হেসে খেলে বেড়াবার সময়। আমি বললাম, সবাইকে সব সময় সব কিছু ভালো নাও লাগতে পারে।

জান, এখানে তো কত মেয়ে চোখে পড়ে, তাদেরকে দেখলে তোমার কথা আরও বেশি মনে পড়ে। সেইজন্য কোনো মেয়ের দিকে তাকাইনি। একরাত্রে চেয়ারে বসে পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ে স্বপ্ন দেখলাম, তুমি হঠাৎ এখানে এসে গেছ। আমাকে রাত দুটো পর্যন্ত পড়তে দেখে বই কেড়ে নিয়ে জোর করে ঘুম পাড়ালে। আমার তখন খুব ঘুম পেয়েছিল, আমি তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘাড়ে ব্যথা অনুভব হতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। দেখলাম তোমার কোলে নয় টেবিলে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছি। এখন রাখি, অসুখ হয়ে পড়ার অনেক ক্ষতি হয়েছে। পড়াশোনায় মন দেব। ভালো থেক, আমিও থাকার চেষ্টা করব। আল্লাহ হাফেজ।

ইতি—

তোমার খালেদ।

লাইলী চিঠিটা ভাঁজ করে সুলতানার হাতে ফেরত দিয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সত্যি তোদের দুজনের কথা ভেবে আমারও মনটা খারাপ হয়ে গেল। তবে আমিও কিছু কথা বলে তোর মনের দুঃখ লাঘব করতে পারি, যদি তুই কিছু খাওয়াস?

বেশতো খাওয়াব বল না কি কথা?

জানিস, আমি না বলে লাইলী মুখটা নিচু করে চুপ হয়ে গেল।

কি হল চুপ করে গেলি কেন? মাথা তুলবি তো বলে সুলতানা তার চিবুক ধরে তুলে দেখল, লজ্জায় মুখটা রাঙা হয়ে গেছে। কিরে অত লজ্জা পাচ্ছিস কেন? আমি তো পুরুষ না।

আমি না একজনের প্রেমে পড়ে গেছি বলে লাইলী তাকে জড়িয়ে ধরল।

আরে পাগলি ছাড় ছাড়? কেউ দেখলে কি ভাববে বলতো?

লাইলী তাড়াতাড়ি তাকে ছেড়ে দিল।

সুলতানা সোৎসাহে জিজ্ঞেস করল, কার প্রেমে পড়েছিস রে?

একটা ছেলের।

আর তাতো বুঝলাম, কিন্তু ছেলেটা কে? তার নাম কি সে কি করে। তার বাড়ি কোথায়?

থাম থাম, তোর অত প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না। যতটুকু জানি বলছি, ছেলেটার নাম সেলিম, এবছর স্ট্যাটিসটিক্স-এ অনার্স পরীক্ষা দিবে। বাড়ি গুলশানে।

ওমা তা হলে আমিওতো তাকে চিনি। ওরা আমাদের দুর সম্পর্কের আত্মীয় হয়। ওদের কেউ নামায রোযা তো করেই না, কলেমা জানে কিনা সন্দেহ। ওর আব্বা বলতো আলাহকে কী কেউ কোনোদিন দেখেছে যে, তার উপাসনা করব? আমার বয়স তখন দশ এগার হবে। এখনও স্পষ্ট মনে আছে, কি একটা ফ্যাংসানে ওদের বাড়িতে আব্বা-আম্মার সঙ্গে ছেলেবেলায় আমি একবার গিয়েছিলাম। আম্মাকে বোরখা পরা দেখে সকলে হেসেছিল। সেলিমের আব্বা তো সকলের সামনে আমাকে সালওয়ার কামিজ ও মাথায় ওড়না দেওয়া দেখে আবাকে বললেন, এযুগে আর ওসব পোষাক মানায় না। ঐসব ওল্ড মডেল। অত জামা কাপড় পরে থাকলে গায়ে আলো বাতাস লাগতে না পেরে অসুখ করবে। আব্বাও ছাড়বার পাত্র নন। বললেন, দেখুন আপনারা সব উচ্চ শিক্ষিত, আমি দু’একটা কথা বলতে চাই। জানি না কথাগুলো আপনাদের ভালো লাগবে কি না। আদিম যুগের মানুষ জঙ্গলে ও পাহাড়ের গুহায়ে বাস করত। তারা ন্যাংটা থাকত। যাদেরকে আমরা অসভ্য, জঙ্গলি ও বর্বর বলে থাকি। তারপর ক্রমান্বয়ে তারা গুহা ছেড়ে কুঁড়ে ঘরে বসবাস করতে শিখল এবং লজ্জা নিবারণের জন্য গাছের ছাল ও পাতা ব্যবহার করত। আরও অনেক যুগ পরে মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করতে আরম্ভ করল। তারা বুঝল শরীরের সৌন্দর্য ধরে রাখতে হলে শরীরের আবরণ দরকার এবং লজ্জা স্থানগুলো ঢেকে রাখা দরকার। তাই তারা কাপড় তৈরি করে পরতে শিখল। কিন্তু আমরা আজ চরম সভ্যতা লাভ করে যদি সে আবরণ উম্মুক্ত করে শরীরের গোপন অংগের বেশিরভাগ সকলকে দেখিয়ে বেড়াই, তা হলে তো আবার আমরা সেই অসভ্য বর্বর যুগে ফিরে যাচ্ছি। কিন্তু তাও বা বলব কি করে সে যুগে নর-নারী সকলেই উলঙ্গ থাকত। কিন্তু বর্তমান যুগে নরেরা দিবি মাথায় হ্যাট, গলায় নেকটাই, পায়ে মোজা এবং ফুলপ্যণ্ট ও ফুলশার্ট পরে শরীরের কোনো অংশই মেয়েদেরকে দেখাতে চায় না। অপর দিকে নারীকে অন্ধনগ্ন অবস্থায় সাথে করে ঘুরে বেড়াচ্ছি। নারীদের পোশাক দেখে মনে হচ্ছে, তারা জাঙ্গিয়া ও বেসীয়ার পরে বেড়াতেও কুণ্ঠাবোধ করবে না। আর সেই কারণে বর্তমানে পৃথিবীর সব দেশে মেয়েদের কদর কমে যাচ্ছে। অথচ আল্লাহর রাসূল (দঃ) মেয়েদেরকে কিমতি (দামী) জিনিস বলে উল্লেখ করেছেন। একটু বিবেচনা করলে বুঝতে পারবেন। কেউ দামি জিনিষকে যেখানে সেখানে উন্মুক্ত করে ফেলে রাখে। ফেলে রাখলে তার কি অবস্থা হবে তা সকলেই জানে। ভালো জিনিস দেখলে কার লোভ হবে। যেই সুযোগ পাবে সেই হাত বাড়াবার চেষ্টা করবে। ফলে নানা রকম অশান্তির সৃষ্টি হবে। নারী স্বাধীনতার নাম করে মেয়েরা যে সর্বক্ষেত্রে পর্দা না মেনে যত্রতত্র অবাধ বিচরণ করছে, তার ফলাফল যে কত বিষময়, তা তো অহরহ গ্রামে গঞ্জে ও শহরে এবং খবরের কাগজে দেখতে পাচ্ছি। আমি আর বিশেষ কিছু বলতে চাই না। আপনারা নিজেদের বিবেককে জিজ্ঞেস করে দেখুন। আধা চুপ করে গেলে ওঁরা কেউ কোনো কথা বলতে পারলেন না। শেষে বেয়ারা চা নাস্তা নিয়ে এলে সকলে সেদিকে মনোযোগ দিল। দেখিস, সেই ঘরের ছেলে সেলিম, বুঝে সুঝে পা বাড়াস।

লাইলী বলল, যেদিন জানতে পারলাম ওরা বড়লোক, সেদিন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে ওকে ভুলে যাওয়ার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু কিছুতেই সফল হতে পারিনি। গতকাল সেলিম লাইব্রেরী থেকে আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল।

তার অবস্থা কি রকম দেখলি?

আমার তো মনে হল সেও আমাকে খুব ভালবাসে। তারপর সেই প্রথম দিনের ঘটনা থেকে গতকাল পর্যন্ত যা কিছু হয়েছে সব খুলে বলল।

যা বললি তা যদি সত্যি হয়, তা হলে ভালই। কিন্তু জেনে রাখ, বড়লোকের ছেলেরা নারীদেরকে খেলার সামগ্রী মনে করে। দুদিন খেলা করে তারপর ভালো না। লাগলে আবার নুতনের পিছনে ছুটে। এমনি তো পুরষেরা ভ্রমরের জাত। বিভিন্ন ফুলের মধু খেতে ভালবাসে।

তা হলে তোর তিনিওতো বিলেতে বিভিন্ন ফুলের মধু খেয়ে বেড়াচ্ছেন? তুই তো আর এখান থেকে দেখতে পাচ্ছিস না।

তোর কথাকে মিথ্যা বলতে পারছি না। তবে একটা কথা ভুলে যাচ্ছিস কেন? যারা আল্লাহকে ভয় করে, তারা তাঁর আইন অমান্য করে না। খালেদ ভাইয়ের প্রতি আমার এইটাই দৃঢ় বিশ্বাস আছে যে, সে আল্লাহকে ভয় করে ও তাঁর আইন মেনে চলে। এর বেশি আমি বলতে পারছি না। ঘণ্টার আওয়াজ শুনে বলল, চল, ক্লাস আরম্ভ হয়ে যাবে। তারপর দুজনে এক সাথে ক্লাসরুমে ঢুকল।