» » ফুটন্ত গোলাপ

বর্ণাকার
🕮

পাঁচ

রেহানা বাড়িতে ফিরে লাইলীর কথা যত ভাবতে লাগল, তার প্রতি তত রাগে মনটা ভরে উঠল। তাকে হিংসার আগুনে পুডোতে গিয়ে নিজেই দগ্ধ হতে লাগল। চিন্তা করল, সেলিম এতদিন তাকে ভালবাসত, এখন লাইলীকে পেয়ে অবজ্ঞা করতে আরম্ভ করছে। আবার ভাবল, সেলিম যে তাকে ভালবাসে, এতদিনে তা ঘুনাক্ষরে প্রকাশ করেনি। আর আমিও যে তাকে ভালবাসি তাও তো জানাইনি। কিন্তু আমি তাকে ভালবাসি। সে আমাকে ভালবাসবেনিই বা কেন? আমার কী রূপ নেই? আমি দেখতে কী এতই খারাপ? স্বীকার করি লাইলী আমার থেকে বেশি সুন্দরী। তা বলে একটা সেকেলে আনকালচার্ড মেয়ের দিকে সেলিম বুকে পড়বে আর আমাকে তা দেখতে হবে? না-না, সেটা আমি হতে দিচ্ছি না। আমিও দেখে নেব, সে কেমন মেয়ে? আমার এত দিনের স্বপ্ন কী করে ভেঙ্গে দেয়? পড়ার ঘরে বসে রেহানা ঐ সব চিন্তা করছিল।

তার ভাই মনিরুল এসে বলল, কিরে অমন চুপ করে কি ভাবছিস? রুবীনাদের বাসায় গিয়েছিলি নাকি?

ওরা দুই ভাইবোন। সে রেহানার চেয়ে দু’বছরের বড়। এম, কম, পাশ করে বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করে। স্বভাব চরিত্র তেমন ভালো নয়। কয়েকটা মেয়ের সঙ্গে তার ভালবাসা আছে। সাধারণতঃ বড় লোকের ছেলেরা যে স্বভাবের হয়ে থাকে, তা থেকে একটু বেশি বেলাইনে চলাফেরা করে। প্রতিদিন নাইট ক্লাবে যাওয়া চাই। ক্লাবে ফ্লাস খেলে এবং বন্ধুদের সঙ্গে মাঝে মাঝে মদও খায়। তবে বংশ মর্যাদার দিকে তার প্রখর দৃষ্টি। কোনো কিছু এমন বাড়াবাড়ি করে না, যাতে বংশের দুর্ণাম হয়।

রেহানা ভাইকে তাড়াতাড়ি ফিরতে দেখে বলল, তুমি যে আজ সন্ধ্যা বেলাতেই ফিরে এলে। ক্লাবে যাওনি?

আজ শরীরটা একটু খারাপ লাগছে, তাই ক্লাব থেকে চলে এলাম। হ্যারে, তুই এত গভীরভাবে কি চিন্তা করছিলি বললি না যে? আজ রুবীনার বার্থডে পার্টিতে গিয়েছিলি বুঝি? আমারও কিন্তু যাওয়ার খুব ইচ্ছা ছিল। জরুরী কাজ থাকায় যেতে পারলাম না। তারও রুবীনার প্রতি খেয়াল আছে। অপেক্ষা করে আছে স্কুল ছেড়ে কলেজে ঢুকলেই তার পিছু নেবে। আবার জিজ্ঞেস করল, সেলিম সাহেবের খবর কি? এখনও তোকে কিছু বলেনি? মনিরুলও জানে রেহানার সঙ্গে সেলিমের বিয়ের কথা হয়েছে।

রেহানা বলল, দাদা তুমি একটু বেশি বেহায়া হয়ে যাচ্ছ?

আরে এতে বেহায়া হওয়ার কি হল? তোদের বিয়ের কথা হয়েছে, তাই ভাবলাম আগের থেকে হয়তো দুজন দুজনকে জেনে নিচ্ছিস?

হয়েছে হয়েছে আর বেশি কিছু তোমাকে ভাবতে হবে না। তবে একটা কথা না বলে পারছি না, আজ লাইলী নামে একটা মেয়েকে ওদের বাড়িতে দেখলাম। কি একটা বিপদ থেকে মেয়েটাকে নাকি সেলিম উদ্ধার করেছিল।

তাতে আর কি হয়েছে? বড়লোকদের ছেলেরা অমন কত মেয়েকে বিপদ থেকে উদ্ধার করে। নিশ্চয় মেয়েটা গরিবের আর দেখতেও খুব সুন্দরী?

গরিবের তো বটেই, কিন্তু শুধু সুন্দরীই নয়, অপূর্ব সুন্দরী এবং ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। এত নিখুঁত সুন্দরী আমি একটাও দেখিনি।

তাই বল, এতক্ষণে বুঝতে পারলাম তুই এত গভীরভাবে কি চিন্তা করছিলি। মেয়েটার ঠিকানা জানিস?

কেন, ঠিকানা নিয়ে তুমি কি করবে শুনি? ঠিকানা আমি জানি না।

আহ, অত চটছিস কেন? ঠিকানা পেলে তাকে আমি বুঝিয়ে দিতাম, বড়লোকের ছেলেরা মেয়েদেরকে দুদিনের খেলার সামগ্রী মনে করে। পুরোনো হয়ে গেলে লাথি মেরে দূরে সরিয়ে দেয়।

থাক তোমাকে আর বোঝাতে হবে না, আমিই ব্যবস্থা করব।

যাকগে, তুই যখন তোর দিকটা সামলাবি বলছিস, তখন আমি আর হস্তক্ষেপ করব না। তবে সামলাতে না পারলে আমাকে বলিস।

সে দেখা যাবে, তুমি এখন যাও তো? শরীর খারাপ বলছিলে, খেয়ে নিয়ে ঘুমাওগে যাও।

তাই যাচ্ছি বলে মনিরুল চলে গেল। ঘুমোবার সময় বিছানায় শুয়ে চিন্তা করল, পুরুষ জাতটার স্বভাবই শালা ঐ রকম, সব সময় নূতন ফুলের মধু খেতে ভালবাসে। এক ফুলে মন ভরে না। রেহানার কথামত মেয়েটা যদি সত্যিই অপূর্ব সুন্দরী হয়, তা হলে তো বেশ চিন্তার কথা। দেখা যাক কত দূরের পানি কত দূরে গড়ায়। এমন সময় ফোন বেজে উঠল। মনিরুল বিরক্ত হয়ে রিসিভার তুলে বলল, হ্যালো, আমি মনিরুল বলছি, আপনি কাকে চান?

যাকে চাই সেই ফোন ধরেছে।

ও পারভীন বলছ? তা এত রাতে, কি খবর?

তুমি যে আজ ক্লাবে আমার সঙ্গে দেখা না করে চলে গেলে? অবশ্য আসতে আমার একটু লেট হয়েছে। ভাবলাম আমার উপর রাগ করে হয়তো চলে গেছ।

না-না, তা নয়। শরীরটা ভালো নেই। তাই মনটাও খারাপ। কিছু ভালো লাগছিল না, সেই জন্য চলে এলাম। এবার রাখি তা হলে?

আগামীকাল নিশ্চয় আসছ?

শরীর ভালো থাকলে যাব বলে মনিরুল ফোন ছেড়ে দিয়ে চিন্তা করতে লাগল, শালা এই মেয়েটা জেঁকের মত পিছু লেগেছে। ওকে যতই এড়িয়ে চলতে চাই, ততই যেন জড়িয়ে ধরতে চায়। অথচ সে বড়লোকের শিক্ষিতা সুন্দরী ও স্বাস্থ্যবতী মেয়ে। তবে বড় গায়েপড়া স্বভাব। নিজের কোনো পার্শনালিটি নেই। ক্লাবে যার তার সাথে বড় বেশি মাখামাখি করে। অথচ তাকে কয়েকবার বলেছে, আমি তোমাকে প্রাণ অপেক্ষা বেশি ভালবাসি। তুমি আমাকে কি মনে কর জানি না, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। প্রথমে পারভীন যখন এই কথা মনিরুলকে বলে তখন তার প্রতি মনিরুলের মনটা ঘৃণায় ভরে গিয়েছিল। তার হাবভাব দেখে মনে হয়েছে, সে এই রকম কথা হয়েতো আরো অনেকের কাছে বলেছে। সেদিন মনিরুল তার কথার উত্তরে শুধু বলেছিল, এব্যাপারে আমি এখনও কোনো চিন্তা করিনি। পরে ভেবেচিন্তে দেখা যাবে। সেই থেকে মেয়েটা ওর পিছু লেগেছে। সে যা বলে মেয়েটা তৎক্ষণাৎ রাজী হয়ে যায়। অবশ্য এরকম আরও চার পাঁচটি তার বান্ধবী আছে। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ভাবল, কম্পারেটিভলি পারভীনই সব বান্ধবীদের চেয়ে ভালো। একে বিয়ে করলে নেহাৎ খারাপ হবে না। সঙ্গে সঙ্গে রুবীনার কথা মনের পর্দায় ভেসে উঠল। ভাবল, যদি কবীনাকে বাগাতে না পারি তখন দেখা যাবে। দূর কি সব ভাবছি, তার চেয়ে ঘুমোলে শরীরটা চাঙ্গা হয়ে যাবে। তারপর চিন্তা দূর করে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

দীর্ঘ দেড় মাস বন্ধের পর আজ ভার্সিটি খুলেছে। সেলিম ঠিক দুটোর সময় লাইব্রেরীতে এসে লাইলীকে দেখতে না পেয়ে তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে চেয়ে তাকে খুঁজতে লাগল।

মিনিট দশেক অপেক্ষা করার পর একটা বোরখা পরা মেয়েকে আসতে দেখে মনে করল, নিশ্চয় লাইলী।

মেয়েটি একদম কাছে এসে মুখের নেকাব খুলে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে স্মীত হাস্যে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছ?

লাইলী যখন মুখের নেকাব সরিয়ে তার সামনে দাঁড়াল তখন সেলিমের মনে হল, মেঘের ভিতর থেকে চাঁদ বেরিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়িয়েছে। সে তন্ময় হয়ে তার পানে চেয়ে রইল।

বেশ কিছুক্ষণ কেটে যেতে লাইলী বলল, কি হল কথা বলছ না কেন? ভিতরে চল। এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে অন্যেরা কি মনে করবে? তবুও যখন সেলিমের নড়বার লক্ষণ দেখা গেল না তখন সেলিমের একটা হাত ধরে নাড়া দিয়ে বলল, চুপ করে পথ আগলে দাঁড়িয়ে রয়েছ কেন?

সেলিম যেন ইহজগতে ছিল না। সম্বিত ফিরে পেয়ে ভিতরে গিয়ে বসে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছ?

লাইলী বলল, আমি যে আগেই সে কথা জিজ্ঞেস করেছি, তার বুঝি উত্তর দিতে নেই?

সেলিম বলল, তোমাকে ও তোমার হাসিমাখা মুখ দেখে আমি এতই মোহিত হয়ে গিয়েছিলাম যে, তোমার কোনো কথা তখন শুনতে ওর মনে হল, আমি যেন স্বপ্ন দেখছি। সৃষ্টিকর্তা তোমাকে এত সৌন্দর্যের ঐশ্বর্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন যে, তোমাকে যতবার দেখি ততবারই যেন নূতন দেখি।

আমি সৌন্দর্যের অধিকারী কিনা কোনদিন চিন্তা করিনি। আমাকে তুমি খুব বেশি ভালবাস। আর সেই ভালবাসার চোখে আমাকে দেখ, তাই তোমার কাছে আমি অপূর্ব সুন্দরী। আমিতো নিজের চেয়ে তোমাকে বেশি সুন্দর বলে মনে করি। তোমার মত সুপুরুষ আমি আর দ্বিতীয় দেখিনি। একটা কথা বলব, কিছু মনে করবে না তো?

তোমার কথায় আমি কিছু মনে করব, একথা ভাবতে পারলে? বল কি বলবে। আমার কথা শুনে প্রিয়তম অসন্তুষ্ট হোক, তা আমি চাই না, তাই জিজ্ঞেস করেছি।

যখন যা মনে আসবে কোনো দ্বিধা না করে তৎক্ষণাৎ বলে ফেলবে। অনুমতি নিতে হবে না। বল কি বলবে বলছিলে?

না এমন কিছু কথা নয়, হাদিসের কথা। রাসূলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, “কেউ সালাম দিলে তার উত্তর দেওয়া ওয়াজেব, অর্থাৎ কর্তব্য। না দিলে গোনাহ হয়। তাই বলছিলাম আমি তোমাকে প্রথমে সালাম দিয়ে কুশল জিজ্ঞেস করছিলাম। তুমি সালামের জবাবও দাওনি, আর কুশলও জানাওনি।

একটু আগেই তো বললাম। তোমাকে দেখে আমার বাহ্যিক জ্ঞান লোপ পেয়েছিল। তাই তখন তোমার কথা শুনতে পায়নি। আচ্ছা, সালাম কি এবং কেন সালাম দিতে হয়? তার ব্যাখ্যাটা আমাকে বুঝিয়ে দাও তো?

লাইলী বলল, রাসূলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, “একজন মুসলমান আরেকজন মুসলমানের সঙ্গে দেখা হলে বলবে-আসসালামু আলাইকুম।” ইহা বলা সুন্নত। আর দ্বিতীয় জন তার উত্তরে বলবে, ওআলাইকুম আসসালাম। ইহা বলা ওয়াজিব। তার ব্যাখ্যা হল, ‘আপনার প্রতি আল্লাহর শান্তি বর্ষিত হোক এবং আপনার প্রতিও আল্লাহর শান্তি বর্ষিত হোক।’ অর্থাৎ সাক্ষাৎকারীদ্বয় উভয় উভয়ের জন্য আল্লাহর কাছে শান্তি কামনা করবে। যে প্রথমে সালাম দিবে সে উত্তর দাতার চেয়ে নব্বইগুণ বেশি সওয়াব পাবে। বোধ হয় সেই কারণে রসূল পাক (দঃ) কে কেউ কোনো সময় আগে সালাম দিতে পারেনি। এখন বুজেছ?

সেলিম বলল, হ্যাঁ বুঝেছি। ইসলামের রীতি সত্যিই খুব সুন্দর।

লাইলী বলল, ইসলামের সমস্ত আইন এমন বৈজ্ঞানিক যুক্তিপূর্ণ ও সামঞ্জস্যপূর্ণ যে, মানুষ যদি তা অনুধাবন করত, তা হলে কেউ ইসলামের আইনের বাইরে চলতে পারত না। যাক, পরীক্ষার পড়াশোনা কেমন চলছে বল?

পরীক্ষার পড়াতো ঠিকভাবে চালাতেই হবে। তোমরাও নিশ্চয় চলছে?

তোমার কথাই ঠিক। তবে সেলিম নামে একটা ছেলের স্মৃতি মাঝে মাঝে বেশ বিঘ্ন ঘটায়।

তাই নাকি? তা হলে তো ছেলেটার শাস্তি হওয়া উচিৎ। আমার কিন্তু লাইলী নামে একটি মেয়ের স্মৃতি মনে পড়লে খুব উৎসাহিত বোধ করি।

তা হলে মেয়েটা তোমার বেশ উপকার করেছে। তাকে পুরষ্কার দেওয়া উচিত বলে লাইলী হেসে ফেলল।

লাইলীর হাসি সেলিমকে পাগল করে দেয়। সে তার মুখের দিকে পলকহীনভাবে চেয়ে রইল।

তাকে ঐভাবে চেয়ে থাকতে দেখে লাইলী বলল, এই কি হচ্ছে? আবার অমনভাবে চেয়ে রয়েছে? কে যেন আসছে?

সেলিম তাড়াতাড়ি বলল, চল না একটু বেড়িয়ে আসি?

লাইলী চল বলে সেলিমের সঙ্গে লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠল।

সেলিম গাড়ি ছেড়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, সেদিন তোমার মা-বাবা কিছু বলেনি?

মা অনেক বকাবকি করেছেন। আব্বা কিছু বলেননি।

তা হলে আজ যে আবার আমার সঙ্গে বেড়াতে এলে?

বারে, যার জন্যে চুরি করি, সেই বলে চোর। ঠিক আছে গাড়ি থামাও, আমি নেমে যাব।

বাব্বা, মেয়ের রাগ দেখ না? একটু রসিকতা করলাম। আর উনি কিনা রেগে গেলেন। বেশ তবে নেমেই যাও বলে সেলিম গাড়ির স্পীড খুব বাড়িয়ে দিল।

লাইলী ভয় পেয়ে বলল, একি হচ্ছে? প্লীজ এত জোরে চালিও না। আমার ভয় করছে বলে চোখ বন্ধ করে নিল।

সেলিম তার দিকে এক পলক তাকিয়ে নিয়ে অবস্থা বুঝতে পেরে স্পীড কমিয়ে দিয়ে বলল, সুন্দরী গো, এবার আঁখি খুলে দেখ, গাড়ি ধীরে চলছে।

লাইলী চোখ খুলে সেলিমের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়ে যত আনন্দ পাই, তার তুলনায় মায়ের বকুনী কিছুই নয়।

আচ্ছা দেখা যাবে, দু’দিন তোমাকে আটকে রাখব, তারপর বাড়ি পৌঁছে দেব। দেখব মায়ের কত বকুনি হুজম করতে পার?

আমার প্রিয়তম যদি তার প্রিয়তমাকে বকুনি খাইয়ে খুশি হয়, তা হলে আমি সন্তুষ্টচিত্তে মায়ের সব রকম বকুনি হজম করতে পারব।

তোমার বুদ্ধির ও কথার সঙ্গে আমি কোনোদিন পারব না। হার মানলাম সুন্দরী, আমায় ক্ষমা কর বলে সেলিম তার দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করল।

এমন সময় সামনে থেকে একটা ট্রাককে ওদের গাড়ির দিকে সোজা আসতে দেখে লাইলী চিৎকার করে কিছু বলে উঠল।

সেলিম তার দৃষ্টিকে অনুসরণ করে একবারে সামনে একটা ট্রাক দেখে বিদ্যুৎ গতিতে নিজের গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে বিপদ থেকে রক্ষা পেল। দ্রুত গাড়ি ঘোরাবার ঝাঁকানিতে লাইলী টাল সামলাতে না পেরে সেলিমের গায়ের উপর পড়ে গিয়ে ভয়ে তাকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল।

সেলিম গাড়ি সামলে নিয়ে এক হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমো খেয়ে বলল, খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলে না? আজ আল্লাহ তোমার মত পুণ্যবতী নারীর কারণে এ্যাকসিডেণ্টের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করলেন। লাইলী তখনও ভয়ে কাঁপছিল। সেলিম রাস্তার একপাশে গাড়ি পার্ক করে তার পিঠে ও মাথায় হাত বুলোত বুলোত বলল, কি, এখনও ভয় দূর হচ্ছে না?

লাইলী লজ্জা পেয়ে সেলিমকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসে কয়েক সেকেণ্ড তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল। তারপর বলল, আমি পুণ্যবতী পাপী হতভাগী? তা না হলে গাড়িতে উঠতে না উঠতে এ্যাকসিডেণ্ট হতে যাচ্ছিল।

সেলিম বলল, তুমি কি যা তা বলছ? পাপ পুণ্যের কথা আল্লাহ জানেন। ভাগ্যের লিখন কেউ খণ্ডন করতে পারে না শুনেছি। সে কথাতো তুমি আমার চেয়ে বেশি জান। ভাগ্যে যদি দুর্ঘটনা থাকত, তা হলে হতই। নেই, তাই আমরা বেঁচে গেলাম। তা ছাড়া শুনেছি, আল্লাহ যা করেন, বান্দাদের মঙ্গলের জন্যই করেন। ঐসব নিয়ে অত চিন্তা করে কান্নাকাটি কর না। তারপর সেলিম পকেট থেকে রুমাল বের করে লাইলীর চোখ মুখ মুছে দিল।

এমন সময় একটা সুন্দরী ও স্বাস্থ্যবতী যুবতী ময়লা কাপড় পরনে একটা ছেলে কোলে করে মানমুখে ওদের কাছে এসে হাত পেতে বলল, আপনারা দয়া করে আমাকে কিছু সাহায্য করুণ। আজ দুদিন যাবত বাচ্চাটাকে কিছু খেতে দিতে পারিনি।

সেলিম বলল, কোনো বাড়িতে কাজ করে খেতে পার না? যাও এখান থেকে, পেটে ভাত জোটে না বাচ্চা এল কোথা থেকে?

মেয়েটি বলল, আপনারা বড়লোক, গরিবের খবর রাখেন না। আমি কি আর সখ করে ভিখারিণী হয়েছি? গরিব ঘরে জন্মান যে কত বড় পাপ, তা যদি জানতেন, তা হলে ঐসব কথা বলতে পারতেন না। গরিব ঘরের মেয়েদের এই রকম পরিণতির জন্য আপনাদের মত ধনী লোকেরাই বেশি দায়ী।

লাইলী বলল, কেন কি হয়েছে? তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি লেখাপড়া জান?

মেয়েটি বলল, কি আর বলব, সবই ভাগ্যের ফের। আমাদের বাড়ি কুমিল্লা জেলার দেবীদ্বার থানায়। আমার বাবা একজন গরিব কৃষক। আমরা শুধু চার বোন। যে টুকু জমি ছিল, তা বিক্রি করে বাবা তিন বোনের বিয়ে দেয়। আমি ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছি। একা বাবা গতরে খেটে সংসার চালাবেন না আমার পড়ার খরচ যোগাবেন। অভাবের তাড়নায় পড়া বন্ধ হয়ে যায়। আর বাবা যৌতুকের টাকা যোগাড় করতে পারেনি বলে আমার বিয়েও দিতে পারেনি। একদিন গ্রামের মাতব্বরের বাগান থেকে শুকনো ডালপালা আনছিলাম। বাগানের গেটে একটা অচেনা সুন্দর ছেলেকে পথ আগলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। সে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, বাঃ এত সুন্দর মেয়ে তুমি, আর কাঠ কুড়িয়ে বেড়াচ্ছ? আমি বললাম, কি করব বলুন আমরা গরিব। এগুলো নিয়ে গেলে রান্না হবে। আপনি দয়া করে পথ ছাড়ুন। তখন ছেলেটি বলল, তুমি আগামীকাল দুপুরে এখানে এস, তোমার সঙ্গে আমার বিশেষ কথা আছে। এই বলে সে চলে গেল। ছেলেটাকে দেখে আমারও খুব ভালো লাগল। পরের দিন ভয়ে ভয়ে সেখানে গেলাম। দেখি ছেলেটা বাগানের ভিতর দাঁড়িয়ে আছে। আমি কাছে গিয়ে দাঁড়াতে নাম জিজ্ঞেস করল। বললাম, আমার নাম আসমা। ছেলেটা বলল, বেশ সুন্দর নাম তোমার। আমার নাম মনিরুল। তোমাকে কি জন্য ডেকেছি জান? আমি মাথা নেড়ে বললাম না। ছেলেটি তখন বলল, আমার বাড়ি ঢাকায়। মাতব্বরের ছেলে শামীম আমার বন্ধু। ওর সাথে কয়েকদিন বেড়াতে এসেছি। তোমাকে দেখে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। আমি লজ্জা ও ভয় পেয়ে বললাম, আপনি আমার বাবার সঙ্গে কথা বলুন। ছেলেটি তখন বলল, ঠিক আছে তাই বলব। তারপর থেকে আমরা প্রতিদিন লুকিয়ে দেখা করতাম। সে আমাকে নানান প্রলোভন দেখাতো। এর মধ্যে একদিন দুর্বল মুহূর্তে হঠাৎ ছেলেটা আমার সর্বনাশ করে ফেলে। আমি কাঁদতে থাকি। ছেলেটা আমাকে বুঝাল যে, সে আমাকে খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করবে। তারপর থেকে নানান কথা বলে আমার মধু আহরণ করতো। এভাবে প্রায় একমাস চলার পর হঠাৎ ছেলেটা আসা বন্ধ করে দিল। খবর নিয়ে জানলাম, সে ঢাকা চলে গেছে। মনে করলাম কোনো কারণে হয়তো তাড়াতাড়ি করে চলে গেছে, নিশ্চয় চিঠি দেবে। সে। রকম কথাবার্তা আমাদের মধ্যে হয়েছিল। তার ঠিকানাও আমাকে দিয়েছিল। সেই ঠিকানায় অনেকগুলো চিঠি দিয়ে ব্যর্থ হই। যখন তিন মাস পার হয়ে গেল এবং তাঁর কোনো খবর পেলাম না তখন আমি দিশেহারা হয়ে পড়লাম। কারণ এই ছেলেটা তখন আমার পেটে এসেছে। লজ্জায় ও ঘৃণায় কয়েকবার আত্মহত্যা করতে গেছি। কিন্তু পারিনি। জানাজানি হয়ে গেলে বাবার ইজ্জত যাবে, বাবা-মার কাছে মুখ দেখাব কি করে? এইসব সাত-পাঁচ ভেবে সামান্য কয়েকটা টাকা জোগাড় করে তার ঠিকানায় আসি। প্রথমে গেটে দারোয়ানের কাছে বাধা পাই। সাহেব আমার আত্মীয় বলাতে সে ভিতরে যেতে দেয়। আমি মনিরুলের খোঁজ করলাম। সে তখন বাড়িতে ছিল না। তার বাবা ছিলেন। তিনি আমার পরিচয় ও আসার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। আমি যতটা সম্ভব অকপটে সবকথা খুলে বললাম। তখন তিনি আমাকে কুৎসিত গালাগালি করে দারোয়ান দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়ার সময় বললেন, টাকা কামাবার জন্য এরকম কত মেয়ে শহরের বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে ঘুরে অভিনয় করে বেড়ায়। আবার যদি কোনোদিন এ বাড়িতে আস, পুলিশে ধরিয়ে দেব। শেষে আমার হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললেন, যাও, আর কোনোদিন আসবে না। আমি টাকাটা তার পায়ের কাছে ফেলে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে চলে আসি। অনেক কষ্টে একটা বাড়িতে ঝিগিরি কাজ জোগাড় করি। কিছুদিন পর তারা যখন বুঝতে পারল আমার পেটে বাচ্চা আছে তখন আমাকে নষ্ট মেয়ে ভেবে তাড়িয়ে দিল। শেষকালে স্বামী আছে খাওয়াতে পারে না, তাই মেরে ধরে তাড়িয়ে দিয়েছে বলে অন্য একটা বাড়িতে কাজ পাই। সেখানেই এই বাচ্চাটা হয়। বাচ্চাটা হওয়ার পর যখন আমার স্বাস্থ্য ভালো হল তখন বাড়ির কর্তার নজর আমার উপর পড়ল। সে উচ্চ শিক্ষিত সরকারী অফিসার। তার বয়সও বেশ হয়েছে। উনার এক ছেলে। তিনি বিদেশে পড়তে গেছেন। ঐ রকম লোক হয়ে সুযোগ পেলে আমার গায়ে হাত দেবার চেষ্টা করতেন। তার স্ত্রী আমাকে মেয়ের মত ভালবাসতেন। একদিন দুপুরে একা পেয়ে লোকটা আমাকে জড়িয়ে ধরেন। আমি তখন মেয়ের তুলনা দিয়ে কাকুতি-মিনতি করছি। ঠিক সেই সময় উনার স্ত্রী ঘরে এসে পড়েন। লোকটা তখন আমাকে ছেড়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান। উনার স্ত্রীও কোনো কথা না বলে স্বামীকে অনুসরণ করলো। সারাদিন আমি নিজের ঘরে বসে বসে কেঁদে কাটাই। সেই রাতের ভোরে তাদের বাড়ি থেকে লুকিয়ে চলে আসি। আজ দুদিন নিজে ও বাচ্চাটা পানি খেয়ে রয়েছি। কারও কাছে হাত পাতলে তারা আমার শরীরের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকে যেন গিলে খাবে। সে জন্য কারও কাছে হাত পাতিনি বলে মেয়েটা কেঁদে ফেলল। তারপর বলল, আপনাদেরও ছোট ভাইবোন আছে। আমাকে না হয় নাই দিলেন। ছেলেটা তো আর কোন পাপ করেনি। তাকে না হয় কিছু দিন। এক নাগাড়ে এতকথা বলে মেয়েটা হাঁপাতে লাগল।

সেলিম জিজ্ঞেস করল, ছেলেটার ঠিকানা তোমার মনে আছে?

মেয়েটা হ্যাঁ বলে ঠিকানাটা বলে দিল।

সেলিম চমকে উঠে গম্ভীর হয়ে কি যেন চিন্তা করতে লাগল।

লাইলী সেলিমের পরিবর্তন বুঝতে পেরে বলল, মনে হচ্ছে ছেলেটাকে তুমি চেন?

তোমাকে পরে বলব বলে সেলিম মেয়েটিকে গাড়িতে উঠিয়ে একেবারে নিজেদের বাড়ির গেটের বাইরে গাড়ি রেখে লাইলীকে বলল, তুমি একটু অপেক্ষা কর, আমি একে মায়ের কাছে দিয়ে আসছি। তারপর মেয়েটিকে নিয়ে সে বাড়ির ভিতরে চলে গেল।

সোহানা বেগম বারন্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। সেলিমের সঙ্গে ছেলে কোলে এক ভিখারিণীকে আসতে দেখে অবাক হলেন।

সেলিম তার কাছে গিয়ে বলল, এই মেয়েটা ভীষণ বিপদে পড়েছে। একে তোমার আশ্রয়ে দিলাম। এ আমাদের পরম আত্মীয়া। ভাগ্যদোষে আজ ভিখারিণী। এর বেশি কিছু এখন বলতে পারছি না। ফিরে এসে সব কিছু বলব। এদের আজ দু’দিন কিছু খাওয়া হয়নি। তুমি এদের খাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা কর। মাকে অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে থাকতে দেখে সেলিম আবার বলল, তোমার ছেলে কখনো কোনো অন্যায় করেনি। আর কখন করবেও না। তারপর মাকে কথা বলার সুযোগ দিয়ে চলে গেল।

সোহানা বেগম নির্বাক হয়ে ছেলের চলে যাওয়া দেখলেন। এর মধ্যে রুবীনা ও কাজের দু’জন মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। তিনি কাজের মেয়েদের বললেন, এদের ভিতরে নিয়ে খাবার ব্যবস্থা কর। আর সিড়ির পাশে রুমটাতে থাকার ব্যবস্থা করে দাও।

ফিরে এসে সেলিম গাড়িতে উঠে বলল, এখন তো ক্লাস নেই, কোথায় যাবে, না। তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেব?

লাইলী বলল, তোমার যা ইচ্ছে।

কিছুক্ষণ বেড়িয়ে ওরা একটা রেষ্টুরেণ্টে ঢুকে নাস্তার জন্য অর্ডার দিল।

লাইলী বলল, আমি কিছু কথা বলতে চাই।

বেশ তো বল।

চার পাঁচদিন আগে আমি একটা বই কেনার জন্য নিউমার্কেটে গিয়েছিলাম। সেখানে হঠাৎ রেহানার সঙ্গে দেখা। আমাকে একটা রেষ্টুরেণ্টে ডেকে নিয়ে গিয়ে চা খাওয়ার সময় বলল, সে তোমার বাগদত্তা। তোমার সাথে আমার পরিচয় কি করে হল তা জানতে চাইল। আমি শুধু সেই ঝড়ের দিনের দুর্ঘটনার কথা বলেছি। শুনে বলল, তুমি নাকি তোমার কর্তব্য করেছ। আমি যেন তোমাকে শুধু উপকারী বন্ধু বলে মনে করি। তার বেশি এগোলে আমাদের মত গরিবদের বিড়ম্বনা ও দুর্ভাগ্য ডেকে আনবে। আমি তার কথা শুনে মনে কিছু করিনি। বরং আমাকে সাবধান করে দেওয়ার জন্যে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে আসি।

সেলিম এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল। লাইলী থেমে যেতে বলল, আমি জীবনে মিথ্যা কথা বলিনি। আর কখনো যেন বলতে না হয়। রেহানা আমার বাগদত্তা নয়। যদি তা হত, তা হলে নিশ্চয় আমি জানতাম। তবে বেশ কিছুদিন আগে মা একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করছিল, ওকে আমার কেমন মনে হয়? তার উত্তরে আমি বলেছিলাম, “সে ভালো মেয়ে। ভালোকে তো আর খারাপ বলতে পারি না। তবে মেয়েটার একটু অহংকার আছে। মেয়েদের অহংকার থাকা ভালো নয়।” ব্যাস, ওর সম্পর্কে সব কথা এখানে ইতি টেনেছিলাম। রেহানা আমার মামাতো বোন। মা যদি তার ভাইয়ের সঙ্গে কোনো কথা বলে থাকে, তবে সে সব কিছু জানি না। আমার যতদুর মনে হয়, মা তার ভাইয়ের কাছে আমাদের দু’জনের বিয়ের সম্বন্ধে যখন কিছু বলা কওয়া করছে তখন হয়তো রেহানা শুনেছে। আর সেই জন্য তোমাকে ঐরকম কথা বলেছে। তবে মা আমার মতের বিরুদ্ধে কিছু যে করবে না, সে বিষয়ে আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত। তুমি কিছু মনে করো না। আমি তোমাকে কথা দিয়েছি বললে ভুল হবে, বরং যেখানে আমি আমার মানস প্রিয়াকে আবিষ্কার করেছি, সেখানে দুনিয়াশুদ্ধ লোক আমার বিরুদ্ধে গেলেও আমি তাকে হারাতে পারব না। তার জন্য যদি সব কিছু ত্যাগ করতে হয় তাতেও পিছপা হব না। তুমি আমাকে সব কিছু বলে খুব ভালো করেছ। রেহানার কথা শোনার পরেও আমার প্রতি তোমার অকপট ব্যবহারে আমি খুব খুশি হয়েছি। আমার প্রতি তোমার বিশ্বাস দেখে আমার মন আনন্দে ভরে গেছে। সবশেষে একটা কথা বলে রাখছি, যদি কখনো আমাকে কোনো মেয়ের সঙ্গে অশোভন ভাবভঙ্গীতে নিজের চোখেও দেখ, তবু আমার ভালবাসাকে তুমি অবিশ্বাস করো না। জানবে, এটা কোনো ছলনাময়ীর ষড়যন্ত্র। আশা করি, এরূপ ঘটনা ঘটবে, তবু তোমাকে সাবধান করে রাখলাম।

লাইলী বলল, প্রেম মানেই কান্না। সেটা মানবিক হোক বা আধ্যাত্মিক হোক। কান্না আছে বলেই সুখের মূল্য আছে। মানুষ যদি দুঃখ না পেত, তা হলে সুখের মর্যাদা অনুভব করতে পারত না। তাইতো কবি বলেছেন—

“চিরসুখীজন ভ্রমে কি কখন

ব্যথিত বেদন বুঝিতে কি পারে?

কি যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে,

কভু আশীবিষে দংশেনি যারে।”

সংক্ষেপে বলতে গেলে, অভিজ্ঞতা ভিন্ন মানুষ সুখের আনন্দ, দুঃখের বেদনা, রোগের যন্ত্রণা, ভোগের মাধুর্য, ঐশ্বর্যের সুখ, দারিদ্রের যাতনা বুঝতে সক্ষম হয় না। আগুনে পুড়ে সোনা যেমন খাঁটি হয়, প্রকৃত মানুষ হতে হলে আমাদেরকেও তেমনি দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা-বেদনা অতিক্রম করে অগ্রসর হতে হবে। আমরা সুখের জন্য যত চেষ্টা করি না কেন, আল্লাহপাক আমাদের তকদ্বীরে যতটা সুখ ও দুঃখ রেখেছেন, কোনো কিছুর দ্বারা তা কমবেশি করতে পারব না। তাই তিনি কোরআনপাকের মধ্যে বলেছেন-”যারা প্রকৃত জ্ঞানী তারা দুঃখ কষ্টের সময় বিচলিত না হয়ে আল্লাহ পাকের উপর সন্তুষ্ট থেকে সবর করে।”

সেলিম বলল, সত্যি, তোমার জ্ঞানের গভীরতা দেখে আমি মাঝে মাঝে খুব আশ্চর্য হয়ে যাই। এত অল্প বয়সে তুমি কত জ্ঞান অর্জন করেছ। তোমার সঙ্গে যত বিষয়ে কথা বলি, সব বিষয়ে গভীর জ্ঞানের পরিচয় দাও। তাই তোমার মত মেয়েকে প্রিয়তমা হিসাবে পেয়ে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করছি। জানি না, তোমার মত সৌভাগ্যবতীকে কবে আমি স্ত্রীরূপে পাব?

লাইলী নিজের প্রশংসা শুনে লজ্জায় জড়সড় হয়ে বলল, তুমি আমাকে খুব বেশি ভালবাস, তাই এই রকম ভাবছ। আসলে আমি তোমার পায়ের ধুলোর যোগ্য কিনা আল্লাহপাককে মালুম।

সেলিম ওর দুটো হাত ধরে তন্ময় হয়ে মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, তুমি আমার হৃদয়ের স্পন্দন, চোখের জ্যোতি। নিজেকে এত ছোট করে আর কখনো আমার কাছে বলবে না। সব বিষয়ে তোমার মর্যাদা অনেক। আমার মত ছেলের সঙ্গে কি আল্লাহ তোমাকে জোড়া নির্ধারণ করেছেন? আল্লাহ না করুন, যদি তোমাকে আমি না পাই, তা হলে সত্যি আমি বাঁচব না।

লাইলী কান্না জড়িত স্বরে বলল, প্রীজ, সেলিম, তুমি এবার থাম। তোমার ভালবাসার মূল্য কি ভাবে দেব, সে কথা ভেবে দিশেহারা হয়ে যাই। যদি তুমি আমাকে এভাবে বল, তা হলে আমি নিজেকে সামলাব কি করে?

সেলিম রুমাল দিয়ে তার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, চল ওঠা যাক, নচেৎ দেরি হলে তোমাকে বকুনী খেতে হবে।

লাইলী কিছু না বলে গাড়িতে উঠল।

সেলিম তাকে তাদের বাড়ির কাছে রাস্তার মোড়ে নামিয়ে দিয়ে ফেরার সময় ভাবল, কই লাইলী তো ভিখারিণী আসমার কথা জিজ্ঞেস করল না? সত্যি লাইলী, তুমি অতি বুদ্ধিমতি ও ধৈর্যশীলা। তোমার জুড়ি দ্বিতীয় নেই, তুমি ধন্যা। তারপর বাড়িতে এসে মাকে আসমার সব কথা খুলে বলল।

সব শুনে সোহানা বেগম গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, মেয়েটিকে নিয়ে তুই কী করতে চাস?

আমি মেয়েটাকে রুবীনার মত স্নেহ দিয়ে লেখাপড়া শিখিয়ে পাঁচজনের মত ভদ্রভাবে বাঁচাতে চাই। যদি সম্ভব হয়, আপ্রাণ চেষ্টা করব যাতে মনিরুল তাকে বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে ঘরে তুলে নেয়। অবশ্য তার আগে ওকে মনিরুলের উপযুক্ত করে গড়ে তুলবো।

ছেলের কথা শুনে সোহানা বেগম অবাক হয়ে বললেন, কী যা-তা পাগলের মত বকছিস, সে কি করে সম্ভব?

সেলিম বলল, তুমি দোয়া কর মা, আমি অসম্ভবকে সম্ভব করে ছাড়ব। আমি যা ভালো বলে চিন্তা করি, তা করেই থাকি। তুমি মা হয়ে নিশ্চয় ছেলের এই বদগুণটা জান?

সোহানা বেগম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, বেশ চেষ্টা করে দেখ কতদুর। কি করতে পারিস।

সেলিম বলল, তুমি যদি এ ব্যাপারে সাহায্য কর, তা হলে ইনশাআল্লাহ আমি কামিয়াব হতে পারব।

সোহানা বেগম ছেলেকে যেন আজ নূতনরূপে দেখেছেন। এতদিন যেরূপে দেখেছেন সেটা ধীরে ধীরে তার কাছ থেকে যেন দুরে সরে যাচ্ছে। এই ভাবধারায় ওঁর মুখ দিয়েও হঠাৎ বেরিয়ে গেল, আল্লাহ তোর মনের মকসুদ পুরণ করুক।

সেই থেকে ভিখারিণী আসমা ওদের বাড়িতে রুবীনার বোনের মর্যাদা নিয়ে রয়ে গেল। সেলিম প্রাইভেট মাষ্টার রেখে তার ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিল। আসমা সেলিমকে বড় ভাই এবং সোহানা বেগমকে খালা আম্মা বলে ডাকে।

সেদিন রাত্রে ঘুমোবার সময় সোহানা বেগমের রুবীনার জন্মদিন উৎসবে লাইলীর গজল ও হাদিসের কথা মনে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে আরিফের স্মৃতি মনের পর্দায় ভেসে উঠল। আজ পাঁচ ছয় বছর হল আরিফ ঘর ছেড়ে চলে গেছে। কোথায় কিভাবে আছে? কি করছে? নানা চিন্তায় ডুবে গেলেন। সে যাওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত কোনো চিঠি-পত্রও দেয়নি। সোহানা বেগমের দুই চোখ মাতৃস্নেহে পানিতে ভরে উঠল। ভাবলেন, সে তো ধর্মের জ্ঞান অর্জন করতে গেছে। নিশ্চয় আল্লাহ তাকে হেফাজতে রেখেছেন। আরিফের কথা ভাবতে গিয়ে নিজের অতীত জীবনের ছেলেবেলার কথা মনে পড়ল। সে যখন মৌলবী সাহেবের কাছে আরবি পড়ত তখন তার মুখে শুনেছিল, যে বান্দা আল্লাহর এলেম অর্জনের জন্য ঘর থেকে বের হয়, তিনি তার হেফাজত করেন। তার মা খুব ধার্মিক মহিলা ছিলেন। বিয়ের পর স্বামীর বাড়ি এসে খাপ খাওয়াতে তার অনেক কষ্ট হয়েছে। স্বামী ছিলেন বিলেত ফেরৎ ব্যারিষ্টার। তাদের চাল-চলন ছিল সাহেবী ধরনের। স্বামীর মনস্তৃষ্টির জন্য তাকে নিজের ও ইসলামের নীতির বাইরে অনেক কাজ করতে হয়েছে। স্বামীর বাড়িতে ইসলামের নামগন্ধ ছিল না। এত কিছু সত্বেও তিনি যথাসম্ভব নামায রোযা করতেন। আর প্রতিদিন কোরআন পড়তেন? তার স্বামী নিষেধ করতেন। বলতেন, ঐ সব করে কি লাভ? মৃত্যুর পরে কি হবে না হবে, সে কি কেউ কোনোদিন দেখেছে? পরে স্ত্রীর রূপে ও গুণে মুগ্ধ হয়ে তাকে খুব ভালবেসেছিলেন। তাই তার মনে কষ্ট হবে বলে ধর্মের ব্যাপারে স্ত্রীকে আর কিছু বলতেন না। সেই মায়ের একমাত্র সন্তান সোহানা বেগম। মা তাকে নিজের মত করে গড়তে চাইলে এত দিন পর আবার স্বামীর সঙ্গে মনোমালিন্য শুরু হয়। বাবা চাইলেন মেয়েকে নিজের মত যুগপযোগী করার জন্য শিক্ষায়-দিক্ষায় চাল-চলনে আপটুডেট করে গড়তে। শেষে বাবার জীদ বজায় রইল। মেম সাহেব মাষ্টার রেখে ইংলিশ শিখিয়ে ইংলিশ স্কুলে ভর্তি করেন। তবে প্রথম অবস্থায় মা মৌলবী রেখে কিছু আরবি পড়িয়েছিলেন। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর সে সব বন্ধ হয়ে যায়। তবুও মা অবসর সময় গোপনে মেয়েকে ধর্মের অনেক কথা শোনাতেন। অনেক দিন আগের কথা হলেও আজও সোহানা বেগমের বেশ স্পষ্ট মনে আছে। যখন তার বয়স পনের বছর তখন তার মা মাত্র কয়েকদিনের জ্বরে মারা গেলেন। তারপর বাবা আর বিয়ে করেননি। মেয়েকে আল্টামডার্ণ করে মানুষ করেছিলেন। মায়ের কাছে যা কিছু ধর্মের কথা শিখেছিল সব ভুলে গেল। আজ সে সব কথা ভেবে সোহানা বেগম চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না। লাইলীর কথাগুলো ঠিক যেন তার মায়ের মুখে ধর্মের কথা শুনলেন। তার মাও তাকে মাঝে মাঝে এ রকম করে বোঝাতেন। লাইলীকে দেখলে মায়ের কথা মনে পড়ে। তার মনে হয় তার মাও যেন এ রকম দেখতে ছিল। লাইলীর প্রতি কি এক অজানা আকর্ষণ অনুভব করলেন। ভাবলেন, লাইলী যদি সেলিমের বৌ হয়ে আসে, তা হলে বেশ ভালো হয়? আবার ভাবলেন, সেলিম যে সমাজে মানুষ হয়েছে, সে কি লাইলীকে মেনে নিতে পারবে? কিন্তু সেলিম মাকে ফাঁকি দিতে পারেনি। লাইলী দুদিন এখানে এসেছে। তার সঙ্গে সেলিমের ব্যবহার অন্যান্য বান্ধবীদের থেকে আলাদা। তৎক্ষণাৎ রেহানার কথা মনে পড়ল। রেহানাকে লাইলীর চেয়ে এই সমাজে যেন বেশি মানায়। দেখা যাক, সেলিম কাকে পছন্দ করে। তার অমতে কিছু করতে পারব না। কারণ সেলিম তার বাবার মত একগুয়েমী স্বভাব পেয়েছে। নিজে যা ভালো মনে করবে তা করেই ছাড়ে। রেহানার বাবাকে বুঝেয়ে বললেই হবে। রুবীনাটা তার মত হয়েছে। তাকে নিয়েই চিন্তা। সে খুব উগ্র আর উচ্ছল। ভাইপো মনিরের সঙ্গে তার বিয়ে দেবে বলে ভেবে রেখেছিলেন। কিন্তু এখন তার দুশ্চরিত্রের কথা জেনে সোহানা বেগমের মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। ভাবলেন, মনির কি আসমাকে গ্রহণ করবে? হঠাৎ কিসের শব্দ শুনে সোহানা বেগমের চিন্তা হল। শব্দটা যেন রুবীনার ঘরের জানালার দিকে হল। বিছানা ছেড়ে দরজা খুলে রুবীনার ঘরের দিকে গেলেন। ভেণ্টিলেটার থেকে আলো দেখতে পেয়ে বুঝলেন, সে জেগে আছে। এতরাত্রে সে কি করছে দেখার জন্য জানালার পর্দা সরিয়ে দেখলেন, রুবীনা বাগানের দিকের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে একটা ছেলের সঙ্গে কথা বলছে। এতরাত্রে বাইরের একটা ছেলের সঙ্গে কথা বলতে দেখে সন্দেহ হল। দরজার কড়া নেড়ে রুবীনা বলে ডাকলেন।

রুবীনা মায়ের গলা পেয়ে ছেলেটাকে বিদায় দিয়ে দরজা খুলে বলল, মা তুমি এখনও ঘুমোওনি?

সোহানা বেগম গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কার সঙ্গে এতরাত্রে কথা বলছিলে? ছেলেটা কে? তার সঙ্গে এখন তোমার কী দরকার?

রুবীনা ধরা পড়ে ভয়ে ও লজ্জায় একেবারে বোবা হয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল। কি উত্তর দেবে খুঁজে পেল না।

সোহানা বেগম গর্জে উঠলেন, কথা বলছ না কেন? দিন দিন বড় হচ্ছ, না ছোট হচ্ছ? এবার তোমার ভালো মন্দ জ্ঞান হওয়া উচিৎ। এতরাত্রে যে ছেলে গোপনে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসে, সে যে খারাপ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যাও ঘুমিয়ে পড়। আর যেন কোনোদিন এরকম দুঃসাহস তোমার না হয়। তোমার বয় ফ্রেণ্ড আছে, ভালো কথা। তাই বলে তার সঙ্গে এরকম করা মোটই ভালো নয়। তারপর তাকে দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়তে বলে নিজের ঘরে ফিরে এলেন।