» » ফুটন্ত গোলাপ

বর্ণাকার
🕮

এগার

ঐদিন রুবীনা বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে ঢুকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বিছানায় শুয়ে রইল। চিন্তা করতে লাগল, এখন কি করবে। যদি মায়ের কথামত মহিমের সঙ্গে মেলামেশা না করত, তা হলে এই অঘটন ঘটত না। তখন তার মনে অনেক কথা ভেসে উঠল। মহিম তাদের পাড়ার বড় লোকের ছেলে। দেখতে সুন্দর। লেখাপড়াতেও ভালো। কিন্তু সে চরিত্রহীন। বড় লোকের সুন্দর মেধাবী ছেলের বান্ধবীর অভাব হয় না। সে প্রত্যেককে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তাদের মধু খেয়েছে। অনেকে তার আসল রূপ জানতে পেরে সরে গেছে। রুবীনা পাড়ার মেয়ে বলে এতদিন পরিচয় থাকলেও কোনো অশ্লীল কাজ তার সঙ্গে করেনি। কিন্তু ইদানীং বান্ধবীর অভাবে রুবীনার পিছনে লেগেছিল।

স্কুল জীবন থেকে তাদের পরিচয়। কলেজে ঢুকে সেটা গাঢ় হয়। প্রায় প্রতিদিন গভীর রাতে মহিম এসে সে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে রুবীনার সঙ্গে গল্প করত। একদিন তার মা সোহানা বেগম জানতে পেরে মেয়েকে রাগারাগি করেন। কিন্তু রুবীনা শোনেনি। গোপনে গোপনে তার সঙ্গে নানান জায়গায় ঘুরে বেড়াত। এক ছুটির দিনে কাউকে কিছু না বলে সে মহিমের গাড়িতে করে ন্যাশনাল পার্কে বেড়াতে যায়। সেদিন মেঘলা ছিল। সেখানে পৌঁছাবার কিছুক্ষণপর ভীষণ ঝড়-বৃষ্টি আরম্ভ হল। দিনের বেলাতে সন্ধ্যার মত অন্ধকার হয়ে এল। ওরা বেড়াতে বেড়াতে ছুটে এসে ডাক বাংলোতে উঠল। খুব জোরে ঝড় হচ্ছিল বলে একটি কামরার মধ্যে ঢুকে লাইট জ্বেলে দুজনে দুটো চেয়ারে বসল। তখন আর কেউ সেখানে ছিল না। ঝড়ের দাপট এক সময় কারেণ্ট অফ হয়ে গেল। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকে উঠে কাছাকাছি কোথাও বাজ পড়ল। রুবীনা ভয় পেয়ে ছুটে এসে মহিমকে জড়িয়ে ধরল। মহিম তাই চাচ্ছিল। রুবীনাকে সে বুঝিয়ে সুজিয়ে নিজের মনস্কামনা চরিতার্থ করার জন্য এখানে এনেছে। সুযোগ পেয়ে সেও রুবীনাকে জড়িয়ে ধরল। রুবীনার নরম তুলতুলে যৌবন পুষ্ট শরীরের স্পর্শে মহিমের শরীরের অনুকণাগুলো সতেজ হয়ে উঠল। ভাবল, আজ তার মনের ইচ্ছা পূরণ হবে। সে একটা হাত দিয়ে রুবীনার মুখটা নিজের মুখের কাছে এনে ঠোঁটে ঠোঁট দিয়ে বলল, এত ভয় পাচ্ছ কেন? আমিতো রয়েছি। তারপর তার নিচের ঠোঁট চুষতে লাগল। রুবীনা প্রথমে ভয় পেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরেছিল, কিন্তু মহিম যখন তার ঠোঁট চুষতে লাগল তখন তার যৌবন জোয়ার উত্তাল তরঙ্গের মত প্রবাহিত হতে লাগল। সে সব কিছু ভুলে গেল। সমস্ত শরীর তার থর থর করে কেঁপে উঠল। ঘন ঘন গরম নিঃশ্বাস পড়তে লাগল। তার অবস্থা দেখে মহিম তখন পাগলের মত বুকে চেপে ধরে পীষে ফেলার চেষ্টা করল। রুবীনা বলল, প্লীজ মহিম, অতজোরে চাপ দিয়ো না, আমার লাগছে। মহিম মনে করল, রুবীনার তা হলে এসব ভালো লাগছে। সে তখন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। সুযোগ পেয়ে আদিমতায় মেতে উঠল। একসময় দুজনেই ক্লান্ত হয়ে পড়ল। বেশ কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলতে পারল না। একটু পরে রুবীনা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। নিজের ভুলের অনুশোচনায় সে তখন জর্জরিত।

তাকে কাঁদতে দেখে মহিম কপটতার আশ্রয় নিয়ে বলল, আমি ঠিক এতটা চাইনি। উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে করে ফেলেছি। তুমি আমাকে ক্ষমা কর।

রুবীনা বেশ কিছুক্ষণ কাঁদল। তারপর চোখ মুছে বলল, মহিম ভাই, একটা কথা বলব রাখবে?

মহিম বলল, বল কি কথা?

রুবীনা বলল, এরপর আমি আর অন্য কাউকে এই দেহ দিতে পারব না। যদি তুমি আমাকে বিয়ে না কর, তবে আমি বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করব।

মহিম বলল, সে কথা আমিও এখন ভাবছিলাম। কথা দিলাম, আমি তোমাকে বিয়ে করব। তবে তোমাকে অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে।

রুবীনা মহিমের কপটতা বুঝতে পারল না। বলল, যতদিন অপেক্ষা করতে বলবে ততদিন অপেক্ষা করব।

আরও কিছুক্ষণ দুজনে গল্প করে বাড়ি ফিরে এল। এরপর প্রায়ই তাদের দৈহিক মিলন হত। মহিম খুব চালাক, সে প্রেগনেণ্টের ভয়ে সব সময় কণ্ডম ব্যবহার করে। কিন্তু দুর্ঘটনা যা ঘটবার প্রথম বারে ঘটে গেছে। মাস শেষ হওয়ার পর যখন রুবীনার ঋতুস্রাব হল না তখন বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল। মনে করল, তার তো মাসিকের একটু দোষ আছেই। আগেও কয়েকবার এরকম হয়েছে। কিন্তু যখন দুমাস কেটে গেল অথচ মাসিক হল না, তখন সে মহিমকে সব কথা জানাল।

রুবীনার কথা শুনে মহিম প্রথমে একটু ঘাবড়ে গেল। তারপর সামলে নিয়ে রেগে উঠে বলল, আমি সব সময়।

এ রকম হতে পারে না। তারপর রুবীনাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিল, আমি তোমার গর্ভের সন্তানের জন্মদাতা নই, অন্য কেউ। যাও আর কোনোদিন এস না। মহিমের তখন অন্য চিন্তা মাথায় ঘুরছে। সে ফিজিক্সে উচ্চ ডিগ্রী নেওয়ার জন্য বিদেশ যাবে। বিদেশী যুবতীদের চিন্তায় তার মাথা ঘুরপাক খাচ্ছে। সে এখন রুবীনাকে থোড়াই কেয়ার করে।

রুবীনার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। বলল, মহিম তুমি এতবড় নীচ কথা বলতে পারলে? এত বড় পাষাণ্ড তুমি? আমি যে কিছুই ভাবতে পারছি না।

মহিম বলল, দেখ বেশি বাড়াবাড়ি করো না, যা বলছি শোন, লক্ষ্মী মেয়ের মত ঘরে ফিরে যাও। তারপর তোমার গর্ভে যার ঔরসে সন্তান এসেছে তাকে ভয়ে দেখিয়ে বিয়ে করে ফেল।

রুবীনা রাগে ও অপমানে আর কোনো কথা বলতে পারল না। কেমন করে সেদিন বাড়ি ফিরেছিল তার মনে নেই। সেই থেকে মহিমের খোঁজ আর করেনি। কয়েকদিন পরে এক বান্ধবীর কাছে শুনেছে, সে বিদেশ চলে গেছে।

এই ঘটনার কিছুদিন পর মনিরুল তার পিছনে লাগল। রুবীনা দু একদিন তার সঙ্গে বেড়িয়ে বুঝতে পারল, সেও তাকে চায়। রুবীনা এখন চালাক হয়ে গেছে। বিয়ের আগে দেহ দিলে সে তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চাইবে না। তাই মনিরুল যখন সুযোগ পেয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেল তখন রুবীনা নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে মেকি রাগ দেখিয়ে বলেছিল, বিয়ের আগে এসব হলে বিয়ের পর আর মজা থাকবে না। বিয়ের পর যা কিছু করো আমি আপত্তি করবো না।

রুবীনা এত তাড়াতাড়ি বিয়ের প্রস্তাব দিবে মনিরুল ভাবেনি। সে তখন তাকে পাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠল। সেইজন্য ঐ দিন তাকে নিয়ে কাবিন করতে যাবে বলে বলেছিল। জানাজানি করে বিয়ে করতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। তাই গোপনে এই ব্যবস্থা করেছিল। এই সমস্ত চিন্তা করতে করতে রুবীনা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। এরপর আর কি করে সকলের কাছে মুখ দেখাবে? কদিন ধরে কিছু খেতে পারছে না, শুধু বমি পায়। একদিন তো ভাবির সামনেই ওকি করতে করতে শরীর খারাপের অজুহাত দেখিয়ে পালিয়ে বেঁচেছে। তাকে সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। এই বুঝি ভাবির কাছে ধরা পড়ে গেল? এভাবে আর কত দিন পাপকে লুকোতে পারবে? মনিরুলকে বিয়ে করে পূর্বের পাপটা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাকেও মহিমের মত দেখল। সে তখন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল। সেইদিন সন্ধ্যার পর দুটো চিঠি লিখল। একটি মাকে আর

অন্যটা থানার দারোগাকে।

মায়ের চিঠি- মা, আমি তোমার কলঙ্কিনী মেয়ে। আমার আর এ দুনিয়াতে থাকার কোনো অধিকার নেই। তুমি জেনে খুব দুঃখ পাবে, তবু বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমি মা হতে চলেছি। আমি অনেক চিন্তা করে দেখেছি, দুনিয়ার কোনো কিছু দিয়ে এ পাপ ঢাকতে পারব না। তাই আমি আত্মহত্যার পথ বেছে নিলাম। আমার এই পরিণতির জন্য আমি কাউকে দায়ী করলাম না। শুধু তুমি দুনিয়ার সব মায়েদের বলে দিও, তারা তাদের মেয়েদের যত লেখাপড়া করাক না কেন, ছেলেদের সঙ্গে যেন ফ্রীভাবে মেলামেশা করতে না দেয়। যুবক যুবতীরা এক সঙ্গে ফ্রী মেলামেশা করলে কোনো এক দূর্বল মুহূর্তে অপকীর্তি করে ফেলবেই। ভাবির কাছে শুনেছিলাম, এই জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দঃ) ছেলেমেয়েদের এক সঙ্গে মেলামেশা করতে নিষেধ করেছেন। মেয়েদের কাজের ও থাকার স্থান আলাদা করে দিয়েছেন। এই সব শিক্ষা তুমি আমাকে দাওনি। তুমি আমাকে ধর্মেরও কোনো জ্ঞান দাওনি। এই সমস্ত জ্ঞান আমি ভাবির কাছে পেয়েছি। বিয়ের আগে প্রথম যখন ভাবি আমাদের বাড়িতে আসে তখন আমি তাকে সেকেলে আনকালচার্ড মেয়ে মনে করে এড়িয়ে চলেছি। যখন তাকে পরশ পাথর বলে চিনলাম তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ভাবি ও দাদাদেরকে আমার জন্য দোয়া করতে বলো। তোমাকে আর কি দোষ দেব। এটাই আমার তকদীর। পারলে এই কলঙ্কিনী মেয়েকে ক্ষমা করো। ইতি- রুবীনা।

দারোগার চিঠি-দারোগা সাহেব, আমি আমার দুস্কর্মের জন্য আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছি। এর জন্য কেউ দায়ী নয়। আমি এক ভাগ্য বিড়ম্বনা চরিত্রহীন মেয়ে। আমার মত মেয়ে এ দুনিয়ায় বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো মনে করে এই পথ বেছে নিলাম। আপনারা আমার মা, ভাই, ভাবি এবং অন্য কাউকে সন্দেহ করবেন না। আমি নিজে স্বেচ্ছায় সকলের অগোচরে চলে যাচ্ছি। আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ, আমার লাশ ময়না তদন্ত করবেন না। আশা করি, আপনি একজন মৃত্যুপথ যাত্রীর অনুরোধ রক্ষা করে তাড়াতাড়ি দাফনের অনুমতি দিবেন। নিজের মেয়ে বা বোন মনে করে আমার এই অনুরোধ রাখার জন্য আবার অনুরোধ করছি। ইতি-রুবীনা।

রাত দশটার সময় লাইলী রুবীনাকে ভাত খাওয়ার জন্য ডাকতে এসে দরজা বন্ধ দেখে কড়া নাড়া দিয়ে বলল, ভাত খাবে এস।

রুবীনার তখন এ্যাবনরমাল অবস্থা। সে ভাবির গলা শুনে অনেক কষ্টে গলার স্বর সংযত রেখে দরজা না খুলে বলল, তোমরা খেয়ে নাও, আমার শরীর খারাপ। আজ আমি কিছু খাব না।

লাইলী ফিরে এসে সেলিমকে রুবীনার কথা বললে সেলিম বলল, আজ ওর শরীর ও মন খুব খারাপ হওয়ার কথা, তার জন্য কোনো চিন্তা করো না।

ওদিকে রুবীনা যখন বুঝল, ভাবি ফিরে গেছে তখন সে ধীরে ধীরে আলমারীর কাছে গিয়ে ঘুমের ট্যাবলেটের শিশি হাতে নিল। প্রেগন্যাণ্ট হওয়ার পর থেকে সে রাত্রে একদম ঘুমাতে পারত না। তাই ঘুমের ট্যাবলেট এক শিশি কিনে ছিল। তাতে এখনো অনেক ট্যাবলেট আছে। রুবীনা সব ট্যাবলেট এক সঙ্গে খেয়ে ঘুমিয়ে গেল। সে ঘুম তার আর ভাঙ্গল না।

পরের দিন অনেক বেলা পর্যন্ত যখন রুবীনা ঘর থেকে বের হল না তখন লাইলী এসে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ দেখে কড়া নাড়া দিয়ে ডাকতে লাগল। কোনো সাড়া না পেয়ে লাইলীর মনে সন্দেহ হল। সে কাচের জানলা দিয়ে দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু জানালাও ভিতর থেকে বন্ধ। পর্দা ঝুলছে। শেষে ফিরে গিয়ে শাশুড়ীকে ও স্বামীকে জানাল।

আরিফও সেখানে ছিল। সবাই মিলে তাড়াতাড়ি করে এসে দরজা জানালা কিছুই খুলতে পারল না। অনেক ডাকাডাকি করেও কোনো সাড়া পেল না। শেষে আরিফ জানালার কাচ ভেঙ্গে পর্দা সরিয়ে দেখল, রুবীনা খাটের উপর শুয়ে আছে। সেলিম ও আরিফ খুব জোরে ডাকতে লাগল। কিন্তু রুবীনার কাছ থেকে কোনো সাড়া এল না। তখন লাইলীর সন্দেহ দৃঢ় হল। স্বামীকে বলল, তুমি শীগগীর একটা মিস্ত্রী নিয়ে এসে দরজা খোলার ব্যবস্থা কর, নচেৎ দরজা ভেঙ্গে ফেল।

কথাটা আরিফ শুনতে পেয়ে ছুটে বাজারের মোড় থেকে দুজন কাঠের মিস্ত্রী ডেকে নিয়ে এলে তারা দরজা ভেঙ্গে দিল। ভিতরে ঢুকে রুবীনাকে মৃত দেখে সবাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। কিছুক্ষণ পর লাইলী একটা চাদর দিয়ে রুবীনাকে ঢাকা দিয়ে দিল। সেলিম থানায় ফোন করল। লাইলী শাশুড়ীকে বৃথা প্রবোধ দিতে লাগল। সেলিম টেবিলের উপর ভাঁজ করা কাগজ দেখতে পেয়ে হাতে নিয়ে পড়ে সবাইকে শুনাল। আরিফ হাউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে মা ও ভাইকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল, রুবীনা, এ কি করল? আমরা তো কিছুই বুঝতে পারিনি। আমাদের যে আর কোনো বোন রইল না মা। রুবীনা, তুই যে আমাদের বড় আদরের বোন ছিলি, আমাদেরকে ফাঁকি দিয়ে চলে যেতে পারলি? যত বড় অন্যায় করে থাকিস না কেন, আমরা তোকে ক্ষমা করে দিতাম।

কিছুক্ষণ পরে দুজন সিপাই সঙ্গে করে দারোগা সাহেব এলেন। সেলিমের সঙ্গে তার আগে থেকে জানাশোনা। তার বড় ছেলে সেলিমদের মিলের অফিসে চাকরি করে। তিনি রুবীনার দুটি চিঠিই পড়লেন। তারপর তাদেরকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করে ডাইরীতে তাদের মুখজবানী লিখে লাশ দাফন করার হুকুম দিয়ে ফিরে গেলেন।

রুবীনার মৃত্যুর পরে সারা বাড়িতে দুঃখের ছায়া নেমে এল। কারো মুখে হাসি নেই।

রুবীনার মৃত্যুর খবর পেয়ে জাহিদ সাহেবদের বাড়ির সবাই এসেছিল।

আসমা সোহানা বেগমকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছে। ফিরে যাওয়ার সময় সোহানা বেগমকে বলল, আমাকে তো মেয়ের মত মানুষ করেছেন; আমি আপনার পেটে না হয়েও যা স্নেহ ভালোবাসা, পেয়েছি তাতে করে নিজের গর্ভধারিণী মায়ের চেয়েও আপনাকে আমি বেশি জানি।

সোহানা বেগম রুবীনার এই পরিণামের জন্য নিজেকে দায়ী মনে করে আহার নিদ্রা ত্যাগ করে কেঁদে কেঁদে দিন কাটাতে লাগলেন। সেলিম ও আরিফ ব্যবসা বাণিজ্য দেখাশোনা করছে বটে, কিন্তু কারও মনে শান্তি নেই।

লাইলী একদিন বিকেলে চায়ের টেবিলে শাশুড়ীকে জোর করে নিয়ে এল। এতদিন তিনি নিজের ঘর থেকে বার হননি। সবাইকে চা দিয়ে লাইলী বলল, আজ আমি দু’একটা কথা না বলে থাকতে পারছি না।

আরিফ বলল, বেশ তো ভাবি! কি বলবে বল না।

লাইলী কয়েক সেকেণ্ড সবাইকে দেখল, তারপর বলল, আমরা আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা বলে বিশ্বাস করি কিনা? এবং তিনিই যে একমাত্র বিশ্বনিয়ন্তা, এ কথাও বিশ্বাস করি কি না?

সকলে লাইলীর দিকে চেয়ে রইল; কিন্তু কেউ কোনো উত্তর দিল না। লাইলী বলল, কি হল? তোমরা উত্তর দিচ্ছ না কেন? সেলিম বলল, মুসলমান মাত্রেই ঐ কথা সবাই বিশ্বাস করে। লাইলী বলল, আমরা এও বিশ্বাস করি, তার হুকুম ছাড়া কোনো কিছু হয়। সেইজন্য তার কোনো কাজে আমাদের অসন্তুষ্ট হওয়া উচিত না। দুঃখ কষ্টে, বিপদ-আপদে তিনি আমাদের সবর করতে বলেছেন। আমরা যদি তার কোনো কাজে অসন্তুষ্ট হই, তা হলে কি তাঁকে বিশ্বনিয়ন্তা বলে অস্বীকার করা হল কি?

সুখ দুঃখ মানুষের জীবনে দিন রাত্রির মত জড়িত। যে লোক সুখ দুঃখ দুটোই লোগ না করেছে, তার জীবন পূর্ণ হয় না। আর এ রকম লোক দুনিয়াতে আছে কি না সন্দেহ। এই দুর্ঘটনায় আমরা খুব দুঃখ পেয়েছি। আল্লাহর কাছে আমরা তা সইবার ক্ষমতা চাইব। তারপর লাইলী শাশুড়ীকে জড়িয়ে ধরে বলল, মা, এক রুবীনাকে আল্লাহ নিয়েছেন তো কি হয়েছে? এ দুনিয়াতে রুবীনার মত কত শত মেয়ে আছে, তারাও যেন রুবীনার মত দুর্ঘটনায় না পড়ে, সেজন্য আমাদের সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে। যদি আমরা তা করি, তা হলে নিশ্চয় আল্লাহ খুশি হবেন। তখন সোহানা বেগমের চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল। লাইলী নিজের আঁচল দিয়ে মুছে দিয়ে বলল, আমাকে রুবীনা মনে করে দীলে তসল্লি দিন মা। দোয়া করুন, আমি যেন রুবীনার মতো হয়ে আপনার দুঃখ ভুলাতে পারি।

সোহানা বেগম ভিজে গলায় বললেন, তুমি আমার রুবীনার থেকে অনেক বেশি মা। রুবীনাকে কেড়ে নিবে বলে আল্লাহ তোমাকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন। লাইলী বসে পড়ে শাশুড়ীর পা জড়িয়ে ধরে বলল, তা হলে এবার থেকে ঠিক মত খাওয়া দাওয়া করবেন বলুন? না খেয়ে খেয়ে আপনি শুকিয়ে আধখানা হয়ে গেছেন।

সেলিম ও আরিফ উঠে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, মা, তোমার বউ যা বললে, সেইমত আমাদের সবার চলা উচিত। নচেৎ আল্লাহ বেজার হবেন। তারপর ধীরে ধীরে বাড়ির সবার মনে শান্তি ফিরে আসতে লাগল।

কয়েকদিন পর মনিরুল রেহানা ও আসমাকে নিয়ে সেলিমদের বাড়িতে বেড়াতে এল। নাস্তার টেবিলে সবাই বসেছে। লাইলী নাস্তা আনার জন্য রান্নাঘরে গেছে। হঠাৎ মনিরুল উঠে গিয়ে সোহানা বেগমের পায়ে হাত দিয়ে বলল, ফুফুআম্মা, আপনি আমাকে মাফ করে দিন। আমি আপনাকে আর ভাবির আবাকে বেনামে চিঠি দিয়ে সেলিমের বিয়ে ভাঙ্গিয়েছিলাম। আমার এই অন্যায় কাজের জন্য অনুতপ্ত হয়ে আপনার কাছে মাফ চাইছি।

এমন সময় লাইলী চা-নাস্তা নিয়ে এসে মনিরুলের কথা শুনে থ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

সোহানা বেগম শুনে ওম হয়ে বসে রইলেন। তার নিজের ভাইপো হয়ে এমন জঘন্য কাজ করবে, তিনি কখনও ভাবতে পারেন নি।

ফুফুআম্মাকে চুপ করে থাকতে দেখে মনিরুল আবার বলল, আপনি যদি আমাকে ক্ষমা না করেন, তবে আমি কারও কাছে মুখ দেখাতে পারব না। আর নিজের বিবেকের চাবুকে চিরকাল জর্জরিত হতে থাকব। তার কথাগুলো কান্নার মত শোনাল।

লাইলী শাশুড়ীকে বলল, আপনি মনিরুল ভাইকে ক্ষমা করে দিন মা। আল্লাহপাক ক্ষমাকে ভালবাসেন। যখন কেউ নিজের অপরাধ স্বীকার করে অনুতপ্ত হৃদয়ে তার কাছে ক্ষমা চায়, তখন তিনি সঙ্গে সঙ্গে তাকে ক্ষমা করে দেন। যে ক্ষমাপ্রার্থীকে ক্ষমা করে, আল্লাহপাক তার অপরাধও ক্ষমা করে দেন এবং তাকে ভালবাসেন।

সোহানা বেগম পূত্রবধূর কথা শুনে অশ্যপূর্ণ নয়নে বললেন, মনিরুল, তুমি আমার কাছে যতটুকু অপরাধ করেছ, তার চেয়ে শতগুণ বেশি মা লাইলীর কাছে করেছ। আগে তার কাছে মাফ চাও। আমি তোমাকে মাফ করে দিলাম।

মনিরুলকে উঠে তার দিকে এগোতে দেখে লাইলী বলল, আমার কাছে মাফ চাইতে হবে না। আমি কোনোদিন কারুর দোষ দেখি না। কেউ যদি আমার কোনো

ক্ষতি করে, তখন আমি ভাবি সবকিছু আল্লাহপাকের ইশারা। তার হুকুম ছাড়া কারুর কিছু করার ক্ষমতা নেই। সেই কথা চিন্তা করে আমি কারও প্রতি দোষারোপও করি এবং কাউকে অপরাধীও মনে করি না। যদি কিছু করে থাক, দোয়া করছি, আল্লাহপাক যেন তোমাকে মাফ করেন।

লাইলীর জ্ঞানগর্ভ কথা শুনে সকলে শুধু অবাক নয়, সেই থেকে তারা তাকে আল্লাহপাকের খাসবান্দী বলে মনে করল।

সোহানা বেগম পূত্রবধূকে কাছে বসিয়ে গায়ে ও মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, আল্লাহ এমন রত্মকে আমার বৌ করে ধন্য করেছেন। আল্লাগো! তোমার দরবারে হাজার হাজার শুকরিয়া।

সেলিম বলল, আমি কিন্তু মনিরুলকে কিছুতেই ক্ষমা করতাম না। আসমাকে বিয়ে করেছে বলে ক্ষমা পেয়ে গেল। আল্লাহ ওকে সুবুদ্ধি দিয়েছেন, মচৎ আমি এতক্ষণ ওকে আস্ত রাখতাম না। আল্লাহপাকের দরবারে দোওয়া করি, তিনি যেন আমাদের সবাইকে হেদায়েত দান করেন। তারপর লাইলীকে বলল, তুমি চা নাস্তা খাওয়াবে, না মায়ের সব আদরটুকু স্বার্থপরের মত নিজে একা ভোগ করবে? তারপর মাকে বলল, তুমি যেভাবে ওকে আদর করছ, মনে হচ্ছে দুদিন পরে আমদেরকে ভুলেই যাবে। আচ্ছা আরিফ! তুইও কিছু বলবি না?

আরিফ হাসতে হাসতে বলল, ভাইয়া, আদর-যত্ব, ভক্তি-সম্মান কেউ কাউকে দেয় না। আদায় করার ক্ষমতা থাকা চাই। ঐগুলো পাওয়ার জন্য যা কিছু দরকার, সবগুলোই ভাবির মধ্যে আছে। সেইজন্য সে আমাদের সবাই-এর কাছ থেকে শ্ৰেনীমত আদর-যত্ন-ভক্তি সম্মান পাচ্ছে।

সেলিম বলল, তুইও তোর ভাবির দলে? বেশ, তোরা তাকে ভক্তি-সম্মান করতে থাক, আমি হোটেলে গিয়ে চা খাব। সেই কখন থেকে চা খাবার ইচ্ছা হচ্ছে। তারপর সত্যি সত্যি যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল।

লাইলী তাড়াতাড়ি করে নাস্তা পরিবেশন করতে লাগল।

সোহানা বেগম বললেন, আমি তো ভাগ্যচক্রে ওকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। তুইতো খুঁজে এনে দিলি। ওর জন্য সেদিন তুই আমাকে কি বলেছিলি মনে আছে? বাপ মরা মেয়েকে এখন একটু আদর করলে তোর হিংসা হয় কেন?

সোহানা বেগমের কথা শুনে সবাই মিটি মিটি হাসতে লাগল।

লাইলী চায়ের কাপটা সেলিমকে দেওয়ার সময় ফিস ফিস করে বলল, নিজের কথায় কেমন বকুনি খাওয়া হচ্ছে?

সেলিম কৃত্রিম রাগতস্বরে বলল, মা তোমার ফরে, তা না হলে কে তোমার কথা শুনতো?

এক রাত্রে ঘুমাবার সময় লাইলীর দেরি দেখে সেলিম ছটফট করতে লাগল। তাকে জড়িয়ে ধরে না ঘুমালে তার ঘুম আসে না। সে মনে মনে একটু রেগে গেল।

লাইলী শাশুড়ীর বিছানা ঠিক করে দিয়ে মাথার কাছে টেবিলে এক গ্লাস পানি ঢেকে রেখে তার হুকুম নিয়ে নিজের রুমে ঢুকল। দেখল, সেলিম চেয়ারে বসে বই পড়ছে।

সেলিম লাইলীকে ঢুকতে দেখেও না দেখার ভান করে বই পড়তে লাগল।

লাইলী বুঝতে পারল, তার অভিমান হয়েছে। কারণ খাওয়া দাওয়ার পর মায়ের কাছে সবাই গল্প করছিল। সেলিম উঠে আসার সময় লাইলীকে ইশারা করে চলে আসতে বলেছিল। কিন্তু মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে একটু দেরি হয়ে গেছে। লাইলী চেয়ারের পেছন থেকে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চিবুক রেখে বলল, অপরাধীনি ক্ষমা প্রার্থী। সারাদিন অফিসে কাজ করে তুমি ক্লান্ত, এবার ঘুমাবে চল।

সেলিম তাকে সামনে এনে কোলে বসিয়ে বলল, স্বামীর জন্য যদি এত দরদ, তবে তাকে এত রাত জাগিয়ে রেখেছ কেন?

অন্যায় করেছি, তার জন্য আবার ক্ষমা চাইছি।

সেলিম বলল, মেয়েরা বেশ সুখে আছে। কোনো চিন্তা ভাবনা নেই, অন্যায় করলে মাফ চেয়ে খালাস। আজ কিন্তু মাফ করছি না। শাস্তি পেতেই হবে বলে তাকে দুহাতে তুলে নিয়ে খাটের দিকে এগোল।

লাইলী বলল, তুমি যত ইচ্ছা শাস্তি দাও। তোমার শাস্তি আমাকে যে কি আনন্দ দেয়, তা যদি জানতে, তা হলে………বলে তার বুকে মুখ লুকাল।

ওরে দুষ্ট মেয়ে, দাঁড়াও মজা দেখাচ্ছি বলে সেলিম তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আনন্দে মেতে উঠল।

এইভাবে খুব সুখের মধ্যে ওদের দিন কাটছিল। কিন্তু আল্লাহপাক সুখ দুঃখকে আলো ও অন্ধকারের মত পাশাপাশি রেখেছেন। কিছুদিন পর হঠাৎ লাইলীর ভীষণ জ্বর হল। জ্বরের ঘোরে সে ভুল বকতে শুরু করল, ‘আমি রেহানার কাছে অপরাধী।’ রেহানা সারাদিন তার কাছে থেকে সেবা শুশ্রুষা করে রাত্রে বাড়ি চলে যায়। সোহানা বেগম বড় ডাক্তার এনে চিকিৎসা করাতে লাগলেন। সেলিম আজ আট দিন স্ত্রীর কাছ থেকে উঠেনি। রেহানা জোর করে তাকে গোসল করতে ও খেতে পাঠায়। সেলিম সারারাত স্ত্রীর কাছে জেগে বসে থাকে। সোহানা বেগম ছেলেকে অনেক করে বোঝান, মানুষ মাত্রেই অসুখ বিসুখ হয়। তুই অত ভেঙ্গে পড়ছিস কেন? আল্লাহপাকের কাছে দোওয়া চা। সেলিম পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের পর স্ত্রীর রোগ মুক্তির জন্য দোয়া করতে লাগল। পনের দিন পর লাইলীর জ্বর একটু কমল।

ডাক্তার বললেন, এবার আর ভয় নেই, রুগী এখন আউট অফ ডেঞ্জার। প্রতিদিন মনিরুল আসমাকে সঙ্গে করে লাইলীকে দেখতে আসে।

প্রায় এক মাস রোগ ভোগের পর লাইলী অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। এখন বালিশে হেলান দিয়ে বসতে পারে।

একদিন রেহানা যখন তাকে পথ্য খাওয়াচ্ছিল, তখন লাইলী তাকে বলল, তুমি মায়ের পেটের বোনের মত আমার সেবা করে আমাকে বাঁচিয়ে তুলেছ। তোমার ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতে পারব না।

রেহানা বলল, তোমার মতো বোন পেলে আমি ধন্য হয়ে যেতাম। আচ্ছা ভাবি, তুমি জ্বরের ঘোরে কেন বলতে, আমার কাছে তুমি অপরাধী?

লাইলী তাকে পাশে বসিয়ে বলল, জ্বরের মধ্যে কি বলেছি না বলেছি জানি না। এখন তোমাকে একটা কথা বলতে চাই, কিছু মনে করবে না তো?

কি যে বল ভাবি, তোমার কথায় কিছু মনে করব এ কথা ভাবতে পারলে? তুমি কি বলবে বল, আমি কিছু মনে করব না।

লাইলী রেহানার দুটো হাত ধরে বলল, তোমাকে আমি ছোট জা করে সারাজীবন কাছে পেতে চাই। তুমি রাজি থাকলে বল, আমি সব ব্যবস্থা করব।

রেহানা মনে মনে খুব খুশি হল। কারণ সে লাইলীর সংস্পর্শে এসে ধর্মের অনেক জ্ঞান পেয়ে তার স্বভাব চরিত্রের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। ভেবে দেখেছে নারী স্বাধীনতার নামে দিন দিন নারী সমাজ উচ্ছল হয়ে অধঃপতনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সেই কারণে আরিফের দিকে তার মন ঝুঁকে পড়েছে।

তাকে চুপ করে থাকতে দেখে সাইলী বলল, কি হল? কথা বলছ না কেন?

ভাবি, তোমার কথা শুনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা কথা মনে পড়ে গেল। “মানুষ যা চায় তা পায় না। আর যা পায় তা ভুল করে চায়।” আমি তো তোমার কাছে জেনেছি, আল্লাহপাক প্রত্যেক নারীকে তার স্বামীর বাঁ দিকের পাঁজরা থেকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি যার সঙ্গে আমার জোড়া করেছেন, তার সঙ্গে বিয়ে হবেই। এখন এর বেশি কিছু বলতে পারছি না।

ঠিক এই সময় সেলিম ঘরে ঢুকে রেহানার শেষ কথা শুনতে পেয়ে বলল, তোমার ভাবি বুঝি প্রশ্ন করছে, যার উত্তর দিতে পারছ না? ওর সঙ্গে কেউ তর্কে পারে না। কি প্রশ্ন করছে বল, দেখি আমি উত্তর দিতে পারি কি না।

রেহানা ভীষণ লজ্জা পেল। কিছু না বলতে পেরে তাড়াতাড়ি করে ঝুঁটো বাসন পত্র নিয়ে এস্তপদে পালিয়ে গেল।

সেলিম অবাক হয়ে তার চলে যাওয়া দেখল। তারপর খাটে লাইলীর পাশে বসে বলল, ওকে তুমি কি কথা জিজ্ঞেস করেছ? আমি জানতে চাইতে লজ্জা পেয়ে পালিয়ে গেল।

মৃদু হেসে লাইলী বলল, সে কথা তোমার এখন শুনে কাজ নেই, পরে এক সময় বলব।

দেখ স্বামীর অবাধ্য হলে কি হয়, তাতো জান।

লাইলী স্বামীর দুটো হাত ধরে বলল, তুমি রাগ করবে না তো?

সেলিম তার হাতটায় চুমো খেয়ে বলল, এই চুমোর কসম কিছু মনে করব না।

লাইলীও স্বামীর হাতে চুমো খেয়ে বলল, রেহানাকে আমার খুব পছন্দ। আর আরিফের সঙ্গেও খুব মানাবে। তার এতে মত আছে নাকি জিজ্ঞেস করছিলাম।

সেলিম কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করল, রেহানা কি বলল? রেহানা যা বলেছে তার হুবহু বলে লাইলী বলল, আমার মনে হয় ও রাজি আছে।

সেলিম বলল, আরিফ যদি রাজি থাকে, তা হলে বেশ ভালই হবে। এবার থেকে ঘটকালির কাজ শুরু করলে তা হলে?

তাতো আপন জনের জন্য একটু আধটু সবাইকে করতে হয়।

এরপর থেকে রেহানা প্রতিদিন আসে না। মাঝে মাঝে আসে। একদিন লাইলী তাকে জিজ্ঞস করল, তুমি এখানে আসা কমিয়ে দিয়েছ কেন? সেদিনের কথায় মনে কি ব্যাথা পেয়েছ? যদি তাই হয়, তা হলে আমার কথা উইথড় করে নিচ্ছি। আমাকে ক্ষমা করে দাও।

রেহানা বলল, ভাবি তোমার কথায় আমি মনে ব্যাথা পাইনি। শুধু শুধু তুমি ক্ষমা চাইছ কেন? তবে খুব লজ্জা পেয়েছি, তাই ঘনঘন আসতে মন চাইলেও আসতে পারিনি।

লাইলী বলল, অনার্সের ছাত্রী। এতটা লজ্জা পাওয়ার কথা নয়?

রেহানা বলল, তোমার সংস্পর্শে আসার আগে অবশ্য ঐসব ছিল না। কিন্তু তোমার কাছে এসে তোমার দেওয়া শিক্ষা পেয়ে এখন অনেক কিছু আমার পরিবর্তন হয়েছে।

লাইলী বলল, আলহামদুলিল্লাহ, (সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার)। আল্লাহ সবাইকে হেদায়েত করুন।

ইদানিং রেহানা যে খুব কম আসে সেটা আরিফও লক্ষ্য করেছে। আজ যখন সে অফিস থেকে ফিরে গাড়ি থেকে নামছিল তখন রেহানাকে তাদের ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে ডেকে বলল, একটু সময় হবে? তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল।

রেহানা তার মুখের দিকে চেয়ে বলল, বেশ তো বল না কি কথা বলবে?

আরিফ বলল, এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি বলা যায়? গাড়িতে উঠ, নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে বলব।

রেহানা সামনের সীটে আরিফের পাশে বসল। আরিফ তাকে রমনা পার্কের একটা নিরিবিলি জায়গায় নিয়ে এল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আরিফ বলল, তুমি আমাকে কি মনে করবে জানি না তবু বলছি, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। বিদেশ থেকে ফিরে এসে তোমাকে দেখেই আমার খুব পছন্দ হয়েছে। অবশ্য তোমারও পছন্দ আছে। আমি তোমার মতামতের দাম দেব, এ কথা বলে রাখছি।

রেহানা বেশ কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে চিন্তা করল। তারপর তার দিকে চেয়ে বলল, আমার কিছু কথা তোমার জানা দরকার। সেগুলো শোনার পর তুমি যা ভালো বুঝবে করবে, তাতে আমার কোনো আপত্তি থাকবে না।

বেশ বল, তুমি কি বলতে চাও?

প্রায় বছর তিনেক আগে ফুফুআম্মা আব্বাকে বলেছিল, আমাকে সেলিম ভাইয়ের জন্য পছন্দ করেছে। আৰ্বও রাজি ছিলেন। আমি আড়াল থেকে তাদের কথা শুনে খুব আনন্দ পাই। কারণ সেলিম ভাইয়ের মত চরিত্রবান সুপুরুষকে কার না ভালো লাগবে? সেই থেকে মনে মনে তাকে ভালবেসে ফেললাম, কিন্তু সেলিম ভাই বোধ হয় সে কথা জানত না। এরপর যখন সেলিম ভাই লাইলী ভাবির দিকে ঝুঁকে পড়ল তখন তার উপর আমার খুব রাগ ও হিংসা হয়। দাদাও ব্যাপারটা জানত। সেও যখন দেখল, লাইলী ভাবির জন্য সেলিম ভাইয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে হচ্ছে না তখন সে বেনামী চিঠি দিয়ে বিয়ে ভাঙ্গিয়ে দেয়। তারপরের ঘটনা সেদিন সে তোমাদের বাড়িতে বলে সকলের কাছ থেকে মাফ চেয়ে নিয়েছে। তবে আমি দাদার ঐসব কার্যকলাপ কিছুই জানতাম না তোমাদের বাড়িতেই প্রথম শুনলাম। যাই হোক, আমি অজ্ঞতা ও ঈর্ষার কারণে লাইলী ভাবিকে ভুল বুঝেছিলাম। অনুতপ্ত হয়ে তার কাছে আমিও মাফ চেয়ে নিয়েছি। তাকে মানবী বলে আমার মনে হয় না। যতবড় শত্রু এবং যত বড় দুশ্চরিত্র লোক তার সংস্পর্শে আসুক না কেন, সে মিত্র ও চরিত্রবান হতে বাধ্য। হবে। লাইলী ভাবি যেন পরশ পাথর, যেই তাকে ছুঁবে, সেই মানিক হয়ে যাবে। আল্লাহপাক তাকে যেমন অদ্বিতীয়া সুন্দরী করে সৃষ্টি করেছেন, তেমনি সর্বগুণে গুণান্বিতাও করেছেন।

আরিফ বলল, সত্যি ভাবি অদ্বিতীয়া। তার উপর ধর্মের জ্ঞান পেয়ে এবং সেই মত চলে সে সকলের কাছে উচ্চ মর্যাদার আসন পেয়েছে। ইসলাম বড় উদার ধর্ম। সেখানে কোনো কুসংস্কার ও মানুষের মনগড়া কিছুর স্থান নেই। আমি মনপ্রাণ দিয়ে তোমাকে পেতে চাই।

রেহানা ছলছল নয়নে আরিফের হাত ধরে বলল, তুমি আমাকে তোমার মত করে গড়ে নিও। আর দোষ ত্রুটি সংশোধন করার সুযোগ দিও।

আরিফ সুবহান আল্লাহ বলে বলল, আল্লাহ তুমি সর্বত্র বিরাজমান। তুমি আমাদের মনের বাসনা পূরণ কর। তারপর বলল, চল তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিই।

রেহানা বলল, তোমাদের বাড়িতেই চল। আমার গাড়ি তো ওখানে আছে। বাড়িতে ফিরে আরিফ রেহানাকে তার গাড়িতে তুলে বিদায় দিয়ে একেবারে ভাবির ঘরে ঢুকল।

লাইলী জানালা দিয়ে তাদের দুজনের যাওয়া আসা দেখেছে এবং অনেক কিছু বুঝেও নিয়েছে।

আরিফের ডাক শুনে বলল, কি ব্যাপার? ছোট সাহেবকে আজ খুব খুশি খুশি লাগছে। মনে হচ্ছে যেন দুনিয়া জয় করে এসেছ।

আরে থাম থাম, তুমি যে দেখছি এ্যাসট্রোলজার হয়ে গেছ। তারপর বলল, সত্যি ভাবি আজ যা পেয়েছি, সারা দুনিয়া জয় করলেও তা পাওয়া যেত না।

সে তো বুঝতেই পারছি। বলি ব্যাপারটা খুলেই বল না?

আরিফ চারিদিকে তাকিয়ে নিয়ে গলা খাটো করে বলল, তোমাদেরকে আর মেয়ে দেখতে হবে না। এতদিনেও যখন তোমরা পারলে না তখন আমি নিজেই আজ সেই কাজ করে এসেছি।

লাইলী অবাক হওয়ার ভান করে বলল, সে কি? এদিকে আমি ও তোমার ভাইয়া একটা মেয়ে পছন্দ করেছি। কথাবর্তাও এক রকম পাকাপাকি। তুমি আমাদের। মান ইজ্জত ডুবাবে বুঝি? তা হতে দিচ্ছি না।

আরিফের আনন্দ উজ্জল মুখটা মুহুর্তে মলিন হয়ে গেল। বলল, তা হলে বড় সমস্যা হয়ে দাঁডল দেখছি! একদিকে আমার প্রেম, আর একদিকে তোমাদের ইজ্জত, ধুততেরী বিয়েই করব না।

লাইলী অনেক কষ্টে হাসি চেপে রেখে বলল, তুমি চিন্তা করো না, আমি তোমার সব সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করব। মেয়েটার পরিচয় তো শুনি?

মেয়েটার পরিচয় জেনে কি হবে? আর তুমি সমস্যার সমাধানই বা করবে কি করে? আমি যদি আমার পছন্দ করা মেয়েকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে না করি?

আরে ভাই হতাশ হচ্ছ কেন? এমনভাবে মীমাংসা করব, সাপও মরবে না, আর লাঠিও ভাঙ্গবে না।

যা খুশি তোমরা করগে যাও, আমি বিয়েই করব না।

সে দেখা যাবে যখন সময় হবে, এখন হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা খাবে এস। খাব না, ক্ষিদে নেই বলে আরিফ আবার বাইরে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াল।

লাইলী বলল, আরে ভাই, শুনে যাও না। তোমার সঙ্গে একটু রসিকতা করছিলাম। তোমার প্রেমিকা রেহানার সঙ্গেই তোমার বিয়ের ব্যবস্থা আমরা করেছি, হয়েছে তো? বাব্বাহ, সাহেবের রাগ দেখ না? এখনই যদি এত, বিয়ের পর কি করবে কি জানি।

আরিফ কথাগুলো শুনে ভীষণ লজ্জা পেল। সে যেন কিছু শুনতে পায়নি এমনি ভাব দেখিয়ে গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিয়ে বলল, ভাইয়ার মতো আমার কোনো প্রেমিকা নেই। তারপর ভাবিকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সাঁ করে বেরিয়ে গেল।

লাইলী হাসি মুখে সেদিকে চেয়ে রইল।

— : সমাপ্ত : —