» » ফুটন্ত গোলাপ

বর্ণাকার
🕮

ছয়

সেলিমের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে। একদিন মাকে বলল, আমি ফার্স্টক্লাস পেলে বিলেতে পড়তে যাব।

সোহানা বেগম ছেলের মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বললেন, তুমি এখন বড় হয়েছ যা ভালো বুঝরে করবে। তবে আমার মতে এবার তোমার ব্যবসা পত্র দেখা উচিত। আমার বয়স হয়েছে। আমি একা কতদিন চালাব? তমি যদি তোমার নিজের জিনিষ না দেখ, তা হলে অন্য পোক আর কতদিন দেখবে। বিলেতে না গিয়ে ব্যবসা-বানিজ্যে মন দাও। আজ পাঁচ বছর হয়ে গেল আরিফের কোনো খোঁজ খবর নেই। তার চিন্তায় আমি জারে-জার হয়ে আছি। তার উপর তুমি যদি বিদেশে পড়তে চলে যাও, তা হলে আমি বাঁচাবো কাকে নিয়ে? শেষের দিকে তাঁর গলা ধরে এল।

সেলিম মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ঠিক আছে, তোমার মনে আমি দুঃখ দেব না। তুমি যা বলবে তাই করব। আরিফের জন্য আমারও মনটা মাঝে মাঝে খারাপ হয়ে যায়। আজ যদি সে ঘরে থাকত, তা হলে দুই ভাই মিলে সব কিছু দেখাশোনা করতাম। তুমি দেখ মা, আরিফ একদিন না একদিন মানুষের মত মানুষ হয়ে ঠিক ফিরে আসবে।

এরপর থেকে সেলিম নিয়মিত অফিসে বাবার সীটে গিয়ে বসতে লাগল। তার কাজে ও ব্যবহারে অফিসের সবাই খুব সন্তুষ্ট। সে অফিসের ও মিলের সব ধরণের অফিসার ও শ্রমিকদের সঙ্গে খুব সহজভাবে মেলামেশা করে। তাদের অভাব অভিযোগ শুনে এবং যতটা সম্ভব সেগুলোর সমাধান করে। সব বিষয়ে সেলিমের কর্মদক্ষতা দেখে সকলে খুব খুশি।

একদিন সেলিম অফিসে কাজ করছে। এমন সময় লেবার অফিসার এসে একজন শ্রমিকের বিরুদ্ধে অনুপস্থিতির কমপেন দিয়ে তাকে ছাঁটাই করার কথা বললেন।

সেলিম তাকে ব্যাপারটা খুলে বলতে বলল।

লেবার অফিসার বললেন, হারুন নামে এই শ্রমিকটা প্রতি মাসে দশ-বার দিন কামাই করে। তাকে বহুবার ওয়ার্নিং দেওয়া হয়েছে। সে প্রতিবারই নানান অজুহাত দেখায়। তাকে এত বেশি ফেসিলিটি দিলে অন্যান্য শ্রমিকরাও সে সুযোগ নিতে চাইবে।

সেলিম বলল, আপনি এখন যান, আমি পরে আপনাকে জানাব। লেবার অফিসার চলে যাওয়ার পর সেলিম বেয়ারাকে ডেকে বলল, তুমি হারুনকে ডেকে নিয়ে এস।

কিছুক্ষণ পর একজন আধ্যবয়সী লোক এসে সেলিমের টেবিলের সামনে দাঁড়াল।

সেলিম ফাইল দেখতে দেখতে তার দিকে না চেয়ে বলল, আপনি বসুন।

লোকটা থতমত খেয়ে বলল, হুজুর!

আপনি বসুন, আমি আমার হাতের কাজটা সেরে আপনার সঙ্গে কথা বলছি।

লোকটা ভয়ে ভয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

সেলিম ফাইলের কাজটা শেষ করে সেটা যথাস্থানে রেখে লোকটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, আপনি দাঁড়িয়ে কেন, বসুন।

লোকটা ঘামতে ঘামতে একটা চেয়ারে জড়সড় হয়ে বসল।

আপনার নাম হারুন, আপনি প্রতিমাসে দশবার দিন করে কামাই করেন, একথা কি সত্যি?

সাহেবকে তার মত একজন সামান্য শ্রমিকের সঙ্গে আপনি করে কথা বলতে শুনে হারুন অবাক হয়ে মাথা নিচু করে বলল, হুজুর যদি আমার সব কথা শোনেন, তা হলে সব বুঝতে পারবেন।

আপনি অত হুজুর হুজুর করছেন কেন? আপনার সব কথা শুনব, তার আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।

জ্বি, আমার নাম হারুন। আমি প্রতিমাসে দশবার দিন নয়, চার পাঁচ দিন কামাই করি।

কামাই দিনের বেতন কি কেটে নেওয়া হয়?

জ্বি, কিন্তু যতদিন কামাই করি, তার ডবল দিনের বেতন কেটে নেয়।

কেন আপনি প্রতি মাসে কামাই করেন?

হুজুর, আমার মা বাপ, আমাকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করবেন না।

আবার হুজুর হুজুর করছেন, যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দিন।

আমার বাড়ি হাতিয়া। সেখানে আমার বুড়ো মা অসুস্থ। আমার স্ত্রী তাকে দেখাশোনা করে। আমাদের কোনো সন্তান নেই। আর এমন কোনো আত্মীয় নেই, যে মায়ের ঔষুধপত্র ডাক্তারের কাছ থেকে এনে দেবে। তাই প্রতি মাসে বাড়িতে গিয়ে অসুস্থ বুড়ো মায়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে আসতে হয়। মাহফিলে মৌলবীদের মুখে শুনেছি, উপযুক্ত ছেলে থাকতে যদি মা-বাপ কষ্ট পায়, তা হলে আল্লাহ তাকে মাফ করেন না। আমি আল্লাহ আদেশ পালন করার জন্য কাজ কামাই করে প্রতিমাসে মায়ের সেবা করতে যাই। এখন আপনি যদি চাকুরি থেকে বরখাস্ত করেন; তা হলে আমার মায়ের চিকিৎসা করা খুবই অসুবিধে হবে। সামান্য যেটুকু জমি আছে, তাতে একবেলা একসন্ধ্যে করে চলে যায়। কিন্তু মাকে নিয়ে আমার খুব চিন্তা। টাকা পয়সার অভাবে শহরে এনে চিকিৎসা করাতে পারছি না বলে খুব অশান্তিতে আছি।

সেলিম বলল, আপনার কথা কি সত্যি?

হারুন জীব কেটে “তওবা আসতাগফেরুলাহ” পড়ে বলল, কি যে বলেন সাহেব, আমি অশিক্ষিত হতে পারি; কিন্তু আলেমদের মুখে শুনেছি, যে মিথ্যা বলে তার ঈমান থাকে না। আবার কলমা পড়ে ঈমান আনতে হয়। আমি গরিব হতে পারি; কিন্তু মিথ্যাবাদী নই।

সেলিম একজন অশিক্ষিত শ্রমিকের মুখে মাতৃভক্তি ও ধর্মের কথা শুনে অবাক হয়ে বলল, আমি আপনার কাছ থেকে অনেক জ্ঞান পেয়ে আপনাকে ওস্তাদের আসনে বসালাম। আর এই নিন বলে একশত টাকার পাঁচখানা নোট মানি ব্যাগ থেকে বের করে তার দিকে বাড়িয়ে বলল, এটা আমি আমার ওস্তাদের নজরানা দিলাম। আপনি এই টাকা দিয়ে আপনার মাকে এখানে নিয়ে এসে হাসপাতালে ভর্তি করে দিন। তার যাবতীয় খরচ আমি দেব। তারপর বেয়ারাকে লেবার অফিসারকে ডাকতে বললেন।

সেলিমের কথা শুনে হারুন পাথরের মত জমে গেল। চিন্তা করল, সে জেগে আছে, না স্বপ্ন দেখছে? নিজের কান ও চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। কোথায় তার চাকুরি বরখাস্ত হওয়ার কথা, আর কোথায় এতসব কাণ্ড?

তাকে অবাক হয়ে চুপ করে থাকতে দেখে সেলিম বলল, নিন, টাকাটা পকেটে রাখুন।

নিজের অজান্তে কম্পিত হাতে হারুন টাকাটা নিয়ে পকেটে রাখল।

একটু পরে লেবার অফিসার এসে জিজ্ঞেস করলেন, আমাকে ডেকেছেন স্যার? তারপর হারুনকে চেয়ারে বসে থাকতে দেখে রেগেমেগে বলে উঠলেন, এই ব্যাটা উঠ, তোর সাহস তো কম না, সাহেবের সামনে তুই চেয়ারে বসে রয়েছিস। লেবার

অফিসারের নাম মামুন।

হারুনকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে সেলিম বলল, আপনারা দু’জনেই বসুন। তারপর বললেন, আচ্ছা মামুন সাহেব, আপনি নিজেকে কি ভাবেন?

হঠাৎ এরকম প্রশ্নের জন্য মামুন সাহেব প্রস্তুত ছিলেন না। আমতা আমতা করে বললেন, কেন স্যার? কিছু অন্যায় করে ফেলেছি কি?

আপনি অন্যায় করেছেন কি না তা আমি জিজ্ঞেস করিনি, যা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দিন।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মামুন সাহেব বললেন, দেখুন স্যার।

আপনি স্যার স্যার করছেন কেন? আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।

স্যার, নিজেকে আর কি ভাববো? তবে ওদেরকে বেশি প্রশ্রয় দিলে মাথায় উঠে যায়। তখন শত চেষ্টা করেও নামান যাবে না।

চুপ করুন, আমি এদের কথা জিজ্ঞেস করিনি, করেছি আপনার কথা।

মামুন সাহেব কি উত্তর দিবে ঠিক করতে না পেরে চুপ করে বসে রইলেন।

সেলিম বলল, মামুন সাহেব, আমাদের প্রত্যেকের জানা উচিত, আমরা আল্লাহ পাকের সৃষ্টির মধ্যে সর্বোত্তম ও সব থেকে প্রিয়। তার প্রধান কারণ হল, তিনি মানুষকে বিবেক বলে একটা অমূল্য জিনিষ দান করেছেন। যা অন্য কোনো সৃষ্টকে দেন নি। আমরা সেই শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম বিবেক সম্পন্ন জীব হয়ে একে অন্যকে ঘৃণা করি, নিজেকে বড় মনে করি। এর কারণ কি জানেন? অহমিকা ও অজ্ঞতা। এইগুলোই মানুষকে বিভিন্ন গোত্রে, বিভিন্ন সম্প্রদায়ে ও বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করেছে। আর একই কারণের বশবর্তী হয়ে বিবেক বিসর্জন দিয়ে আমরা একে অন্যের প্রতি চরম দুর্ব্যবহার করি। অথচ আল্লাহপাক বলিয়াছেন, “এক মুমীন অন্য মুমীনের ভাই।1” আর আমাদের নবী (দঃ) বলিয়াছেন, “তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ঐ ব্যক্তি যে চরিত্রের দিক থেকে সর্বোত্তম।2” তাঁর দরবারে ধনী দরিদের কোনো তফাৎ নেই। যে কেউ তাঁকে ভয় করে আদর্শ চরিত্রবান হবে, সেই তাঁর কাছে উচ্চ আসন পাবে। তাঁর রাসূল (দঃ) হাদিসে বলেছেন “মানুষকে ঘৃণা করো না, পাপীকে ঘৃণা করো না, বরং পাপকে ঘৃণা করবে।” যাই হোক, এই লোকটার বেতন সামনের মাস থেকে একশত টাকা বাড়িয়ে দেবেন। আর উনি যখন ছুটির দরখাস্ত করবেন, মঞ্জুর করবেন।

ইনার কেন, যে কোনো লোকের আবেদন সরাসরি আমাকে জানাবেন। আমাকে না জানিয়ে নিজে কিছু করবেন না। যদি কেউ ফাঁকি দেয়, কিংবা অন্যায় আচরণ করে, সে দিকে কড়া নজর রাখবেন। আমার কথায় আপনি রাগ বা মনে কষ্ট নেবেন না। আপনার ক্ষমতা কমানো হল না, যেমন আছে তেমনি থাকবে। শুধু কোনো কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার। আগে আমার পরামর্শ নেবেন। যান, এবার আপনারা আসুন।

ফেরার পথে হারুন মনে করল, এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল। সে ছোট সাহেবের জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করতে লাগল। আর লেবার অফিসার মামুন সাহেব আশ্চর্য্য হয়ে ভাবতে লাগলেন, এর আগে তো কতবার ছোট সাহেবকে দেখেছি, তখন তো তাকে ধার্মিক বলে মনে হয়নি? তিনি ব্যাপারটা কিছু বুঝতে পারলেন না। আর এ ব্যাটা হারুনটাই বা কি বলল কি জানি? বড় সাহেব তো ধর্মের নামে জ্বলে উঠতেন। তারই ছেলে হয়ে ছোট সাহেব কেমন করে ধার্মিক বনে গেল?

যোহরের আযান ভেসে আসতে সেলিম নামায পড়ার জন্য মসজিদে রওয়ানা হল। সে সমস্ত মিলে ও অফিসে নোটিশ দিয়ে দিয়েছে, নামাযের সময় সব কিছু বন্ধ রেখে যেন সবাই মসজিদে নামায পড়তে যায়। নোটিশ পেয়ে নামাযীরা খুব খুশি হল। বেনামাযীরা খুশি না হলেও সেই সময়টা ক্যাণ্টিনে আড্ডা জমায়। সেলিম আজ পনের দিন হল নামায ধরেছে। এরই মধ্যে অফিসে সকলের জন্য পাঠাগার করেছে। সেখানে সব ধরনের বই আছে। তবে ইসলামিক বই-এর সংখ্যা বেশি। অবসর সময়ে সেও ইসলামিক বই পড়ে। কিছুদিন আগে সে বায়তুল মোকাররমে কি একটা জিনিস কিনতে গিয়েছিল। সে দিন ছিল জুম্মার দিন। দলে দলে টুপি পরা লোকদের মসজিদে ঢুকতে দেখে তার লাইলীর কথা মনে পড়ল। অনেক বোরখাপরা মেয়েকেও নামায পড়তে যেতে দেখে একজন মুসুল্লীকে জিজ্ঞেস করল, এখানে মেয়ে পুরুষ একসঙ্গে নামায পড়ে? লোকটা কয়েক সেকেণ্ড তার দিকে চেয়ে থেকে বলল, আপনি দেখছি কিছুই জানেন না। এখানে মেয়েদের নামায পড়ার জন্য আলাদা ব্যবস্থা আছে। সেলিমেরও মসজিদে গিয়ে নামায পড়ার খুব ইচ্ছা হল। কিন্তু কি ভেবে গেল না। আজ পর্যন্ত সে বায়তুল মোকাররমে কোনোদিন ঢুকেনি। শুধু দূর থেকে তার সৌন্দর্য উপভোগ করেছে। ঐ দিনই ইসলামি ফাউণ্ডেশন থেকে ইসলামিক অনেক বই কিনে আনে। তারপর নামায ধরেছে। ইসলামিক বই যত পড়তে লাগল তত ধর্মের প্রতি তার প্রগাঢ় ভক্তি জন্মাতে লাগল এবং ধর্মের আইন মেনে চলার প্রেরণা পেল। সে পাঁচ ওয়াক্ত নামায মসজিদে জামাতের সঙ্গে পড়ে। বাড়িতে এখনো পড়েনি। তাই বাড়িতে কেউ এখনও জানেনি যে, সে নামায পড়ে।

একদিন ম্যানেজার সাহেব সোহানা বেগমকে বললেন, ছোট সাহেবের মধ্যে আমরা অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। সে ক্রমশঃ ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। ম্যানেজার সাহেব প্রবীণ ব্যক্তি। মিলের জন্মদিন থেকে এই পদে আছেন। তিনি সেলিমকে ছোটবেলা থেকে দেখে আসছেন। তার অনেক আব্দার সাহেবের অগোচরে পূরণ করেছেন। তাই তাকে তিনি ছেলের মত সম্বন্ধ করে থাকেন।

কথাটা শুনে সোহানা বেগমের নারী হৃদয় আনন্দে ভরে গেল। আর সেই সঙ্গে আরিফের কথা মনে পড়ল। সেও আজ কত বছর এই ধর্মের জ্ঞানলাভ করার জন্য তাদের ছেড়ে চলে গেছে।

সোহানা বেগমকে চুপ করে থাকতে দেখে ম্যানেজার আবার বললেন, ছোট সাহেবকে আর সাহেব বলে চেনা যায় না। মিলের ছোট-বড় সকলের সঙ্গে এমনভাবে মেলামেশা করে; দেখে মনে হয় সেও যেন তাদেরই একজন।

সোহানা বেগম বললেন, আপনি তার গার্জেনের মত, কিছু বলেননি কেন?

বলিনি মানে? একদিন আমরা পাঁচ ছয়জন ছোট সাহেবকে এসব না করার জন্য বোঝাতে গেলাম। যেমনি দু-একটা কথা বলেছি, অমনি তার উত্তরে এমন সব হাদিস কালাম শুনিয়ে উদাহরণ দিয়ে আমাদেরকেই বুঝিয়ে দিল যে, আমরা আর কোনো যুক্তি খুঁজে পেলাম না।

সোহানা বেগম বললেন, ঠিক আছে, আপনি আসুন। আমি সময় মতো ওকে সবকিছু বুঝিয়ে বলব।

এদিকে ছোট সাহেবের পরিবর্তন মিলের ও অফিসের সকলের চোখে ধরা পড়ল। ছোট সাহেবকে তারা যেমন যমের মত ভয় করে, তেমনি পীরের মত ভক্তি-শ্রদ্ধা করে। ছুটির পর এবং ছুটির দিন সেলিম শ্রমিক কলোনিতে ঘুরে ঘুরে ছোট-বড় সকলের খোঁজ খবর নেয়। কারও কোনো অভিযোগ থাকলে তার প্রতিকারের ব্যবস্থা করে। তাদের অসুখে-বিসুখে নিজের টাকায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। সেলিমের এই সব দেখে বেশির ভাগ লোক বলাবলি করে, কি লোকের ছেলে কি হয়েছে। তারা আরও বলতে লাগল, ইনি নিশ্চয়ই অলি আল্লাহ ধরনের লোক হবেন। একদিন তারা মসজিদের ইমাম সাহেবকে ছোট সাহেবের কথা জিজ্ঞেস করল। উনি বললেন, আল্লাহপাক যাকে হেদায়েৎ করেন, তাকে কেউ ঠেকাতে পারে না। মনে হয়, উনি কোনো পরশ পাথরের সংস্পর্শে গেছেন।

ক্রমশঃ মিল-কারখানার শ্রমিকরা সেলিমকে অলি আল্লাহ ভাবতে লাগল। তারা তার সম্মানে দ্বিগুণ উৎসাহে কাজ করতে লাগল। এবছর অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক বেশি মুনাফা হল।

রমজানের এক সপ্তাহ আগে সেলিম মায়ের অনুমতি নিয়ে বোর্ডের সব মেম্বরদের বোনাসের ব্যাপারে আলোচনা করার জন্য সকলকে একদিন বিকেলে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করল। সেদিন ছুটির দিন। কাজের ব্যস্ততার জন্য বেশ কিছুদিন সেলিম লাইলীর খোঁজ-খবর নিতে পারেনি। আজ অবসর পেয়ে লাইলীদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য বেলা তিনটের দিকে গাড়ি নিয়ে বেরুল।

সোহানা বেগম ছেলেকে অসময়ে বেরোতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, এখন আবার কোথায় যাচ্ছিস? বিকালে বোর্ডের মিটিং বসবে?

তুমি কিছু ভেবো না মা, আমি ঠিক সময় মত ফিরে আসব বলে সেলিম চলে গেল।

এদিকে লাইলী সেলিমের অনেকদিন খোঁজ খবর না পেয়ে খুব চিন্তায় দিন কাটাচ্ছে। তারও পরীক্ষা হয়ে গেছে। ভাবল, এতদিন হয়ে গেল তার খোঁজ নিচ্ছে না কেন? সে পুরুষ, তার তো উচিত আমার খোঁজ নেওয়া। একবার তাদের বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছা করেছিল; কিন্তু লজ্জা এসে তাকে বাধা দিয়েছে। কোনো কিছুতেই তার মন বসছিল না।

আজ রহিমা ভাবি তার মনমরা দেখে জিজ্ঞেস করল, কিগো সখি, মুখে হাসি নেই কেন? সখা বিনে দিন দিন যে শুকিয়ে যাচ্ছ? বলি এখন যদি এত? বিয়ের পরে যে কি করবে, তা উপরের মালিকই জানেন।

লাইলী কপট রাগ দেখিয়ে বলল, তোমার শুধু ঐ এক কথা। মানুষের মন তো আর সব সময় এক রকম থাকে না। নানান কারণে সেটা খারাপ হতে পারে।

তা হতে পারে, তবে আমি যে কারণটা বললাম, সেটাই কিন্তু আসল কারণ। কী ঠিক বলিনি?

তুমি তো দেখছি ভবিষ্যৎ বক্তা হয়ে গেছ?

তা একটু আধটু হচ্ছি বই কি?

তা হলে বলতো দেখি, সেলিম সাহেবের এতদিন খোঁজ-খবর নেই কেন?

রহিমা প্রথমে হেসে ফেলে বলল, ঠিক জায়গা মত তা হলে কোপটা পড়েছে? তারপর কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে গম্ভীর হয়ে বলল, তিনি হয়তো কোনো কাজে আটকা পড়েছেন। সময় পেলেই তার প্রিয়ার খোঁজে ছুটে আসবেন। রহিমার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে কলিং বেল বেজে উঠতে দুজনই চমকে উঠল। রহিমা বলল, এই রে, এ যে দেখছি সেলিম সাহেবের বেল বাজাবার কায়দা।

লাইলীও সেটা বুঝতে পেরেছে। সে লজ্জা পেয়ে কি করবে ভেবে ঠিক করতে পেরে চুপ করে বসে রইল।

কি হল বসে রইলে কেন? যাও ভদ্রলোককে অভ্যর্থনা করে নিয়ে এস। দরজা না খুলে দিলে বাড়িতে কি করে ঢুকবে? কেউ নেই মনে করে যদি ফিরে যান, তা হলে তো তখন তোমার আফশোসের সীমা থাকবে না।

কথাটি সঁচের মত লাইলীর বুকে বিধল। সে তাড়াতাড়ি উঠে গেটের দিকে গেল। ততক্ষণে আবার বেলটা বেজে উঠল। লাইলী দরজার ছিদ্র দিয়ে সেলিমকে দেখে খুলে দিল।

সেলিম লাইলীকে দেখে প্রথমেই সালাম দিল। তারপর জিজ্ঞেস করল, কেমন আছ?

সেলিমকে সালাম দিতে দেখে খুব অবাক হলেও লাইলী সালামের জবাব দিয়ে বলল, আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। এস, ভিতরে এস, তুমি কেমন আছ?

সেলিম তখন আর লাইলীর কোনো কথা শুনতে পাচ্ছে না। এতদিন পর তার প্রিয়তমার দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে রইল। তার মনে হল, লাইলীকে অনেক বছর দেখেনি। বহুদিন পর তার প্রাণ শীতল হল।

সেলিমকে চুপ করে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে লাইলী বলল, ভিতরে এস না? এখানে রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে থাকলে লোকে ভাববে কি? তবুও সেলিমের সাড়া না পেয়ে গেটের কড়াটা জোরে নাড়া দিয়ে বলল, এই যে মশাই শুনছেন? লোকের বাড়িতে এসে এভাবে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা অভদ্রতার লক্ষণ।

কড়া নাড়ার শব্দ পেয়ে সেলিম চমকে উঠল। তারপর ভিতরে ঢুকল। লাইলী গেট বন্ধ করে সেলিমকে নিয়ে এসে ড্রইংরুমে দু’জন বসল। প্রথমে লাইলী বলল, এতদিন খবর না পেয়ে ভেবেছিলুম, তোমার কোনো অসুখ-বিসুখ হল কি না। আল্লাহ পাকের দরবারে লাখলাখ শুকরিয়া জানাই, তিনি তোমাকে সুস্থ রেখেছেন। বাড়ির সবাই ভালো আছে?

সেলিম বলল, হ্যাঁ, সকলে ভালো আছে। অফিসের কাজে এই কয়েকদিন খুব ব্যস্ত ছিলাম। এবারতো আমাকেই সব কিছু দেখাশোনা করতে হচ্ছে।

তুমি একটু বস, আমি চায়ের ব্যবস্থা করে আসি বলে লাইলী যাওয়ার উপক্রম করলে সেলিম আতঙ্কিত স্বরে বলল, যেও না প্ৰীজ।

লাইলী কাছে এসে তার কাঁধে একটা হাত রেখে বলল, আজ তোমার কি হয়েছে বলতো? তোমাকে যেন একটু এ্যাবনরম্যাল লাগছে।

সেলিম তার হাত ধরে সামনে চেয়ারে বসিয়ে বলল, তোমাকে দেখার আগে পর্যন্ত আমি নরম্যাল ছিলাম। তোমাকে দেখার পর থেকে এ্যাবনরমাল হয়ে গেছি। আমার বেনটা যেন ঠিকমত কাজ করছে না। কেবলই মনে হচ্ছে, তোমাকে অনেক দিনের জন্য হারিয়ে ফেলব। আমার চা-টা লাগবে না, তুমি চুপ করে বস। আর আমি আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে তোমাকে দেখে তৃপ্ত হই।

লাইলী অভিমান ভরা কণ্ঠে বলল, এতদিন দেখার ইচ্ছে হয়নি বুঝি? এদিকে এই হতভাগী তোমার চিন্তায় অস্থির। ছেলেদের জান বড় শক্ত। শেষের দিকের কথাগুলো ভারী হয়ে এল।

সে জন্য মাফ চাইছি বলে সেলিম দুহাত জোড়া করল।

হয়েছে, হয়েছে বলে লাইলী স্মিত হাস্যে বলল, দু’মিনিট অপেক্ষা কর, আমি আসছি। সেলিমকে মাথা নাড়তে দেখে লাইলী আবার বলল, বা রে, আমি কি হারিয়ে যাচ্ছি? তুমি কষ্ট করে আমাদের বাড়িতে এলে, আর আমি তোমাকে এক কাপ চা দিয়েও আপ্যায়ন করাব না? আমরা গরিব তাই বলে মেহমানের যত্ন নেব না?

সেলিম বলল, তুমি বড়লোকের ছেলের সঙ্গে প্রেম করেও তাদেরকে হুল ফোঁটাতে ছাড় না। এক এক সময় ইচ্ছা হয়, সব কিছু ত্যাগ করে চিরকালের জন্য তোমার কাছে চলে আসি।

লাইলী সেলিমের কাতর উক্তি শুনে নিজের ভুল বুঝতে পারল। বলল, তুমি মনে এত বড় আঘাত পাবে জানলে কথাটা বলতাম না। আমার অন্যায় হয়ে গেছে। তারপর তার দুটো হাত ধরে বলল, আজ থেকে প্রতিজ্ঞা করলাম, এভাবে তোমাকে আর কখনো বলব না। তুমিও প্রতিজ্ঞা কর, আর কোনোদিন ঐরূপ চিন্তা করবে না। তারপর চোখের পানি গোপন করার জন্য মাথা নিচু করে নিল।

সেলিমও এতটা ভেবে বলেনি। লাইলী যেমন কথার ছলে বলেছে, সেও তেমনি বলেছে। লাইলীকে মাথা নিচু করে চুপ করে থাকতে দেখে বলল, দুজনেই কথাচ্ছলে বলেছি, এতে অন্যায় কারো হয়নি। হলেও সেম সাইড চার্জ, মামলা ডিসমিস। আমার দিকে তাকও তো?

লাইলী ধীরে ধীরে চোখভরা আঁশু নিয়ে তার দিকে চাইল।

এত সামান্য কথায় তার চোখে আঁশ দেখে সেলিম অবাক হয়ে লাইলীর ডাগর ডাগর পটলচেরা চোখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল।

লাইলী নিজেকে সামলে নিয়ে আঁচলে চোখ মুছে বলল, আমাকে একটু যাওয়ার অনুমতি দাও বলে দাঁড়িয়ে পড়ল।

সেলিম আবার হাত ধরে বসিয়ে দিয়ে বলল, তুমি চা আনতে যাবে তো? আমি ওসব ফরমালিটি পছন্দ করি না।

তা হলে তুমি কি পছন্দ কর?

পৃথিবীর সমস্ত ঐশ্বর্যের বদলে তোমাকে কাছে পেতে চাই।

সেলিমের কথাগুলো ঠিক যেন কেউ লাইলীর মুখে একরাশ আবীর ছড়িয়ে দিল। সে কয়েক সেকেণ্ড লজ্জায় কথা বলতে পারল না। তারপর ধীরে ধীরে তার দিকে চোখ তুলে বলল, প্লীজ সেলিম, কথাগুলো একটু আস্তে বল, ভাবি হয়তো সব শুনতে পাচ্ছে।

সেলিম বলল, প্রতিদিন শুধু তোমার মুখে ভাবির কথা শুনি। কিন্তু সেই পূণ্যবতী নারীকে কোনোদিন দেখার সৌভাগ্য হল না। তুমি তাকে বলো, তিনি আমার বড় বোনের মত। এই অধম গোনাহগার ভাইয়ের কাছে কী আসতে পারেন না?

রহিমা এতক্ষণ পর্দার আড়াল থেকে তাদের কথোপকথন শুনছিল। আর থাকতে পারল না, দরজার পর্দা সরিয়ে বলল, আসতে পারি

লাইলী ফিস ফিস করে বলল, ভাবি।

সেলিম দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বলল, আসুন ভাবি আসুন। তারপর সে এগিয়ে গিয়ে রহিমার পায়ের কাছে বসে কদমবুসি করে বলল, আমাকে ছোট ভাই মনে করলে কৃতার্থ হব।

রহিমা এতটা ভাবেনি। একটু থতমত খেয়ে গেল। তার কোনো ভাই নেই। তারা তিন বোন। তার মনটা আনন্দে ভরে গেল। মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করে বলল, উঠে বস ভাই। খুব খুশি হয়ে তোমাকে ভাই বলে গ্রহণ করলাম। আমাদের কোনো ভাই নেই। তারপর তোমরা গল্প কর, আমি চা তৈরী করে নিয়ে আসি।

রহিমা চলে যাওয়ার পর তারা দুজন দুজনের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। লাইলী মিষ্টি ভৎর্সনা করে বলল, এই কি হচ্ছে? ভাবি এসে দেখলে কি মনে করবে বল তো?

সেলিম বলল, যা মনে করার তা তো অনেক আগেই করে ফেলেছে। এখন আর নূতন করে কি ভাববে? সত্যি ভাবি যে কত ভালো, তা আজ বুঝতে পারলাম। চল একটু বেড়িয়ে আসি। পরীক্ষার পড়ার তো আর তাড়া নেই? তাকে চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবার বলল, কী চাচী আম্মার বকুনীর ভয় হচ্ছে বুঝি?

কয়েক সেকেণ্ড মাথা নিচু করে থেকে যখন লাইলী তার হরিণীর মত চোখ নিয়ে সেলিমের দিকে তাকাল তখন তার চোখ থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে।

সেলিম তাকে কাঁদতে দেখে একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, আমি তো একটু রসিকতা করলাম। এতে তুমি কাঁদবে জানলে বলতাম না। ঠিক আছে, আমি আমার কথা উইথড্র করে নিচ্ছি। প্রীজ চোখ মুছে ফেল।

লাইলী আঁচলে চোখ মুছে বলল, এই হতভাগীকে যে তুমি অত ভালবাস, সেটা কি আমার কপালে সইবে?

রহিমা চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে ঘরে ঢুকে লাইলীর কথা শুনে বলল, আরে ভাই কপালে কি  লেখা আছে না আছে, তা যিনি লিখেছেন তিনিই জানেন। ওসব নিয়ে অত চিন্তা করে কাজ নেই। মানুষ বর্তমানকে নিয়ে বেঁচে থাকে। প্রত্যেক মানুষের উচিত তাঁর উপর নির্ভর করে যখন যে অবস্থায় তিনি রাখেন, তাতেই সন্তুষ্ট থাকা। তাই দুঃখ হোক আর সুখ হোক। সেটা তাঁরই নির্দেশ বুঝেছ? নাও, এখন চিন্তা বাদ দিয়ে চা খেয়ে দুজনে একটু বেড়িয়ে এস।

লাইলী লজ্জারাঙা চোখে ভাবির দিকে চেয়ে বলল, আম্মাকে কি বলে যাব?

সে চিন্তাও বাদ দাও, আমি খালা আম্মাকে বলবখন।

বারে, আম্মাকে বলে যেতে হবে না?

বেশতো বলেই যাও।

কি বলে যাব?

যা সত্য তাই বলবে, তুমি তো মিথ্যা বলবে না। সত্য পথে চললে বাধা বিঘ্ন তো আসবেই। তুমি বলত ভাই, ঠিক বলছি কিনা বলে রহিমা সেলিমের দিকে চাইল।

সেলিম কোনো কথা না বলে মিটি মিটি হাসতে লাগল।

লাইলী চা খেয়ে কাপটা টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে এক্ষুণি আসছি বলে উপরে চলে গেল।

রহিমা চায়ের কাপ ও পিরীচগুলো নিয়ে যাওয়ার সময় বলল, আমার সখীর জন্য একা একা একটু অপেক্ষা কর ভাই।

লাইলী একটা গ্রীন রং-এর শাড়ী ও ব্লাউজ পরে তার উপর বোরখা চড়িয়ে রহমান সাহেবের কাছে গিয়ে বলল, আব্বা, আমি একটু বাইরে যাচ্ছি।

রহমান সাহেবের হার্টের অসুখটা ক’দিন থেকে বেড়েছে। তিনি এই ক’দিন অফিসে যেতে পারেননি, শুয়েছিলেন। বললেন, তাড়াতাড়ি ফিরে আসবি।

স্ত্রী হামিদা বানু স্বামীর পাশে বশে বুকে তেল মালিশ করছিলেন। লাইলী বেরিয়ে যাওয়ার পর বললেন, মেয়ে কোথায় কার সাথে গেল, জিজ্ঞেস করলে না যে?

রহমান সাহেব বললেন, ছেলেমানুষ পরীক্ষার পর একটু কোথাও বেড়াতে যাবে হয়তো, তাতে অত দোষ মনে করছ কেন?

মেয়ে বড় হয়েছে সেদিকে খেয়াল করেছ? তুমিই তো কিছু না বলে দিন দিন ওর সাহস বাড়িয়ে দিচ্ছ।

লাইলী নিচে এসে দেখল, সেলিম একা বসে আছে। বলল, তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে কিন্তু, আর শরীর ভালো নেই।

সেলিম বলল, চাচাজানের কি হয়েছে? আমাকে এতক্ষণ বলনি কেন চল তাকে দেখব।

এস বলে লাইলী আগে আগে উপরে গিয়ে তাকে বারান্দায় একটু অপেক্ষা করতে বলে ঘরে ঢুকে বলল, মা তুমি ওঘরে যাও। সেলিম এসেছে আৰ্বকে দেখতে।

হামিদা বানু তাড়াতাড়ি উঠে ভিতরের দরজা দিয়ে পাশের রুমে চলে গেলেন। লাইলী দরজার কাছে এসে সেলিমকে ভিতরে আসতে বলল। সেলিম ঘরে ঢুকে সালাম দিয়ে বলল, “চাচাজান আপনার কি হয়েছে?”

রহমান সাহেব সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, আমার বরাবর হার্টের অসুখ আছে। মাঝে মাঝে বেশ ট্রাবল দেয়। দু’চারদিন রেষ্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে। তা বাবা তোমাদের বাড়ির সব খবর ভালো তো?

সেলিম হ্যাঁ বলে জিজ্ঞেস করল, কোনো বড় ডাক্তারকে দেখান না কেন?

রহমান সাহেব বললেন, আমাদের অফিসের বড় ডাক্তার দেখছেন। এখন একটু ভালো আছি। লাইলী তোমার সঙ্গে বুঝি বাইরে কোথায় যাচ্ছিল? তোমাকে দু একটা কথা বলব বাবা, মনে আবার কষ্ট নিও না যেন। আব্বা কি কথা বলবে বুঝতে পেরে লাইলী সকলের অলক্ষ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

সেলিম বলল, আপনি কি বলবেন বলুন, কিছু মনে করব না। আমি আপনার ছেলের মত। যদি অন্যায় কিছু করি, তা হলে গার্জেনের মত নিশ্চয় বলবেন।

রহমান সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমরা গরিব আমাদের তো কিছুই নেই বাবা। যতটুকু আছে তা হল ইজ্জত। জ্ঞ্যাতি শত্ৰু কম বেশি সকলেরই থাকে, আমারও আছে। তুমি বড় লোকের ছেলে। গাড়ি করে আমাদের বাড়ি আস এবং লাইলীর সঙ্গে তোমার খুব জানাশোনা, সেটা এরই মধ্যে পাড়াতে কানাঘুষো চলছে। আমার তো ঐ একটি মাত্র মেয়ে। তা ছাড়া আল্লাহপাকও বেগানা জোয়ান ছেলে মেয়েদের এক সঙ্গে মেলামেশা করতে নিষেধ করেছেন। তুমি শিক্ষিত ছেলে, অল্প কথায় সব কিছু নিশ্চয় বুঝতে পারছ? আমার মেয়ের নামে দুর্নাম রটলে আমি তার বিয়ে দিতে পারব না। আর পাঁচজনের কাছে মুখও দেখাতে পারব না। এই দেখ, মনের খেয়ালে তোমাকে কত কথা শুনিয়ে দিলাম।

সেলিম বলল, না-না চাচাজান, আপনি ঠিক কথা বলেছেন। পনার কথায় আমার মনে কোনো কষ্ট হয়নি। বরং আপনার এই সর্তকবাণী আম। জ্ঞানের চোখ খুলে দিয়েছে। আপনাকে বলতে আমার কোনো বাধা নেই, আপনারা কি মনে করবেন জানি না, আমি লাইলীকে বিয়ে করতে চাই। কথাটা নির্লজ্জার মত আমিই বলে ফেললাম। ইচ্ছা ছিল, আমার মাকে দিয়ে বলাব। আপনি অসুস্থতার মধ্যে দুঃশ্চিন্তায় থাকবেন, তাই বললাম। ভাববেন না, এটা বড় লোকের ছেলের খামখেয়ালী। আমি আল্লাহপাকের কসম খেয়ে বলছি, তিনি রাজি থাকলে কেউ আমার সিদ্ধান্ত বদলাতে পারবে না। এখন আমি বেশি কিছু বলতে চাই না। যা কিছু বলার আমার মা এসে বলবেন। অবশ্য মাকে এ পর্যন্ত আমি কিছুই জানাইনি। তবে যতদূর আমি আমার মাকে জানি, তিনি এই কাজে অমত করবেন না। আর যদি একান্ত রাজি না হন, তা হলে আমি সবকিছু ত্যাগ করে হলেও আমার সত্যকে মিথ্যা হতে দেব না।

রহমান সাহেব বললেন, তুমি আমাকে অনেক দুঃশ্চিন্তা থেকে বাঁচালে বাবা। আল্লাহ তোমার মনের নেক মকসুদ পুরা করুন। তবে বাবা জেনে রেখ, বিয়ে সাদি তকদিরে  লেখা থাকে। আল্লাহ যার সঙ্গে যার জোড়া তৈরি করে রেখেছেন, তার সঙ্গে তা হবেই। কেউ আটকাতে পারবে না।

লাইলী বারান্দা থেকে এবং তার মা পাশের রুম থেকে তাদের সব কথা শুনতে পাচ্ছিল। লাইলী সব শুনে খুব লজ্জা পেয়ে চিন্তা করতে লাগল, এরপর সেলিমের সঙ্গে বেড়াতে যাব কি করে? আর তার মা ভাবছিলেন, কোটিপতির ছেলেকে কি সত্যি জামাই হিসেবে পাব? মেয়ের কপালে কি অত সুখ আছে?

একটু পরে সেলিম রহমান সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে এসে লাইলীকে দেখতে পেয়ে বলল, চল নিচে গিয়ে আগে আসরের নামায পড়ে নিই, তারপর বেড়াতে যাব।

সেলিম নামায পড়বে শুনে লাইলী আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বলল, আলহামাদু লিল্লাহ (সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার।) তাঁর দরবারে জানাই কোটি কোটি শুকরিয়া, যিনি অধম বান্দীর দোয়া কবুল করেছেন। ততক্ষণ তার চোখ দিয়ে আনন্দে অশ্রু পড়তে শুরু করেছে।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সেলিম বলল, তুমি অধম হলে তোমার দোয়া কবুল হত না। তুমি তার প্রিয় বান্দী। তাইতো তিনি তোমার দোয়া কবুল করেছেন।

ড্রইংরুমে সেলিমের নামায পড়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে লাইলী ভাবির সঙ্গে নামায পড়ে নিল। তারপর সেলিমের কাছে এসে বলল, চল কোথায় বেড়াতে যাবে বলছিলে।

সেলিম বলল, এখানে অনেক দেরি হয়ে গেছে। পাঁচটার পর আমাদের বাড়িতে বোর্ডের মিটিং আছে। সন্ধ্যার পরে সেই উপলক্ষে একটা ফাংশানও হবে। আমি তোমাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে চাই।

লাইলী বলল, বেশতো চল। তুমি যেখানে নিয়ে যাবে, সেখানেই যাব।

রহিমা আসরের নামায পড়ে লাইলীর কাছে সেলিম ও খালুজানের সব কথা শুনেছে। সেও খুব খুশি হয়ে ড্রইংরুমে ঢুকে হাসতে হাসতে বলল, কি ভাই, দিল্লী এখন দুরে, না কাছে?

লাইলী ভাবির গাল টিপে দিয়ে বলল, অ্যাভি ভি দূর হ্যায়, (এখনও অনেক দূরে)।

সেলিম বলল, ভাবি, আমি লাইলীকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি, রাত্রে দিয়ে যাব। আপনিও চলুন না ওর সঙ্গে, মা আপনাকে দেখে খুব খুশি হবেন।

রহিমা বলল, তোমার দুলাভাই এর অনুমতি না নিয়ে তো আমি কোথাও যেতে পারি না, অনুমতি নিয়ে অন্য একদিন না হয় যাব।

গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে সেলিম জিজ্ঞেস করল, বেড়াতে যাওয়ার কথা বলতে তোমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল কেন?

লাইলী বলল, আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করে তোমাকে নামায পড়ার তওফিক দিয়েছেন জেনে আনন্দে চোখে পানি এসে গিয়েছিল। আজ কিন্তু আমি তোমাদের ফাংশানে কিছু গাইতে পারব না, সে কথা এখন থেকে বলে রাখছি। সেদিনের কথা মনে হলে আজও আমার যে কি হয়, তা বলতে পারছি না।

সেলিম বলল, সেদিন রেহানা তোমাকে অপমান করার জন্য গাইতে বলেছিল। আজ আর হয়তো সে কিছু বলবে না। তবে যাই বল তোমার গলা কিন্তু অদ্ভুত। আমি তো তোমার গলা শোনার জন্য সেই থেকে পাগল হয়ে আছি। আজও একটা গজল গেয়ে শোনাবে?

লাইলী জোড়হাত করে বলল, মাফ কর। অত লোকের সামনে আমি কিছুতেই গজল গাইতে পারব না।

তা হলে আমার মনের বাসনা মনেই থেকে যাবে?

তোমাকে সময় মত একদিন শোনাব। প্লীজ, আমাকে আর কিছু বল না। তোমার কথা রাখতে না পারলে আমার বড় কষ্ট হয়।

সেলিম বলল, ঠিক আছে তাই হবে। পথে গাড়ি থামিয়ে নানারকম ফল ও মিষ্টি কিনল।

বাড়ি পৌঁছাতে রুবীনা বলল, তুমি এত দেরি করে ফিরলে কেন? মা তোমাকে খুঁজছে। তারপর লাইলীর দিকে চেয়ে বলল, কেমন আছেন।

লাইলী বলল, ভালো আছি।

সেলিম লাইলীকে সঙ্গে করে একেবারে মায়ের কাছে গিয়ে বলল, তুমি নাকি আমাকে খুঁজছিলে?

সোহানা বেগম লাইলীকে দেখে খুশি হয়ে বলে উঠলেন, এদের বাড়িতে গিয়েছিলি বুঝি? তারপর লাইলীকে বললেন, তুমি এসেছ ভালই হয়েছে। এখন মিটিং হবে এবং রাত্রে ফাংশান আছে। অফিসাররা সব এসে গেছেন। এস তো মা, তুমি আমাকে একটু সাহায্য করবে।

সেলিম বলল মা, একটু ওঘরে চল, তোমাকে একটা কথা বলব।

কি কথা এখানেই বল না।

লাইলীর দিকে একবার আড় নয়নে চেয়ে সেলিম বলল, সব কথা কি সকলের সামনে বলা যায়?

পাগল ছেলে, আচ্ছা চল বলে লাইলীকে বললেন, তুমি এখানে বস আমি আসছি। পাশের রুমে গিয়ে সেলিম মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, কথাটা শুনে তুমি রাগ করবে না বল?

আজ তোর কি হয়েছে বলতো? ছাড় ছাড়, তোর কথায় আমি আবার কোনো দিন রাগ করেছি?

সেলিম মাকে ধরে রেখেই বলল, আমি লাইলীর বাবাকে আজ কথা দিয়ে এসেছি, ওকে আমি বিয়ে করব। তুমি হয়তো রেহানাকে আমার জন্য ঠিক করে রেখেছ? তোমার মনে আঘাত দেওয়ার মোটেই আমার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু আমি অনেক ভেবে চিন্তে দেখেছি রেহানাকে আমি সুখী করতে পারব না। আর লাইলীকে পেলে আমিও সুখী হতে পারব না।

সোহানা বেগম ছেলেকে সামনে এনে বললেন, কথা দেওয়ার আগে মাকে তো একবার জিজ্ঞেস করতে পারতিস? যাক, যা হওয়ার হয়েছে। আর রেহানার ব্যাপারে দাদাকে একবার বলে ছিলাম। তোর সুখের জন্য না হয় দাদার কাছে থেকে কথাটা ফিরিয়ে নেব। এখন চল বোর্ডের মেম্বাররা সব তোর অপেক্ষায় বসে আছেন।

আসমা এতক্ষণ রান্নাঘরে ছিল। সে সোহানা বেগমের খোঁজে এসে লাইলীকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি কখন এলেন? কেমন আছেন?

লাইলী বলল, এইতো একটু আগে এসেছি। আমি ভালো আছি, আপনি কেমন আছেন।

আল্লাহপাকের রহমতে খুব ভালো আছি ভাই। আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব, কিছু মনে করবেন না তো?

না, কি বলবেন বলুন।

আপনি কি এদের আত্মীয়া?

না, এরপরে যে প্রশ্ন করবেন, সেটার উত্তর সেলিম সাহেবের কাছ থেকে জেনে নেবেন।

আসমা বলল, সত্যি আল্লাহপাক আপনাকে যেমন রূপবতী করেছেন তেমনি বুদ্ধিমতীও করেছেন বলে হেসে ফেলল।

আপনার ছেলেকে দেখছি না যে, তার কি নাম রেখেছেন?

সে আয়ার সঙ্গে বাগানে বেড়াচ্ছে। দাদাই তার নাম রেখেছে রফিকুল ইসলাম।

মায়ের সাথে সেলিম এঘরে এসে লাইলীর সঙ্গে আসমাকে কথা বলতে দেখে জিজ্ঞেস করল, একে চিনতে পেরেছিস?

আসমা বলল, হ্যাঁ, তুমি যেদিন আমাকে নিয়ে এলে সেদিন তো ইনিই তোমার সঙ্গে ছিলেন। আচ্ছা দাদা, ইনি আমাদের কে হন? তুমি তো আজও পরিচয় করিয়ে দিলে না?

সেলিম বলল, কেন? তুই পরিচয় জেনে নিতে পারিস না।

চেষ্টা তো করেছিলাম, প্রথম চালেই ফেল করেছি।

ফেল যখন করেছিস তখন মায়ের কাছ থেকে জেনে নিস।

সোহানা বেগম বললেন, একটু পরেই সবাই ওর পরিচয় জানতে পারবে। তারপর ওদেরকে এদিকের কাজ দেখতে বলে সেলিমকে সঙ্গে করে মিটিং রুমে এসে প্রবেশ করলেন।

সেলিম ঢুকেই “আসসালামু আলাইকুম” দিয়ে বলল, আমার আসতে একটু লেট হয়ে গেছে, সেই জন্য প্রথমে আপনাদের কাছে মাফ চাইছি।

মাতা পুত্রকে এক সঙ্গে আসতে দেখে সবাই দাঁড়িয়ে পড়ল। তাদের মধ্যে দু’একজন সালামের উত্তর দিল।

সেলিম তাদের সবাইকে বসতে অনুরোধ করে বলল, আজকে আমরা শ্রমিকদের বোনাস, বেতন ও তাদের সুবিধা অসুবিধার ব্যাপারে আলোচনা করব। আপনারা সব প্রবীন ব্যক্তি। অনেকদিন থেকে বিশ্বস্ততার সঙ্গে কাজ করে আসছেন। আমি যা কিছু বলব, তার মধ্যে ভুলত্রুটি হলে সুধরে দেবেন এবং প্রত্যেকে নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করবেন। তারপর কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে সেলিম আবার বলতে শুরু করল, আপনাদের ন্যায়নিষ্ঠ ও পরিশ্রমের ফলে আমাদের দিন দিন উন্নতি হচ্ছে। অবশ্য এতে শ্রমিকদেরও দান রয়েছে। আমার মতে একজন কুলি থেকে আমরা যারা এখানে রয়েছি, সবাই শ্রমিক। শুধু আমাদের কাজ ভিন্ন। যাই হোক, আমি যা বলছিলাম, আমরা মানে মিল-কারখানার সমস্ত অফিসার ও শ্রমিকরা দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছি বলে অন্যান্য বছরের চেয়ে এবছর দ্বিগুণ মুনাফা হয়েছে। আমি এই অধিক মুনাফা থেকে দুমাসের বেতন ঈদের বোনাস হিসাবে এবং গ্রেড অনুযায়ী প্রত্যেকের বেতন বাড়িয়ে দিতে চাই। আর শ্রমিকদের ফ্রি চিকিৎসার জন্য মিল এলাকায় একটা হাসপাতাল করার মনস্থ করেছি। এখন আপনারা প্রত্যেকে নিজের মতামত প্রকাশ করে ঠিক করুন, কতটা কি করা যায়।

সেলিম থেমে যেতে সকলে মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলেন। সোহানা বেগম প্রথমে বলে উঠলেন, প্রত্যেককে দুই মাসের বেতন বোনাস দিলে কত টাকা লাগবে তা হিসেব করে দেখেছ?

সেলিম মায়ের দিকে চেয়ে বলল, যা লাভ হয়েছে তার একের আট অংশ।

সোহানা বেগম বললেন, আমি এতে রাজি। এবার আপনাদের মতামত বলুন।

ডাইরেক্টর আসাদ সাহেব বললেন, আপনারা মালিক হয়ে যখন খুশি মনে এসব দিচ্ছেন তখন আমরা তাতে অমত করব কেন?

জেনারেল ম্যানেজার বসির সাহেব বললেন, কিন্তু যে বছর লোকসান যাবে, সে বছরের কথা চিন্তা করেছেন। তখন কত টাকা আসল থেকে বেরিয়ে যাবে?

সেলিম বলল, আপনি ঠিক বলেছেন। আমি সে কথাও চিন্তা করে দেখেছি। লাভ-ক্ষতি নিয়ে ব্যবসা। কোনো বছর লাভ হবে। আবার কোনো বছর ক্ষতি হবে। আপনারা তা এত বছর কাজ করে আসছেন, কোনো বছর ক্ষতি হয়েছে কি? হয় নি? তবে লাভ কম বেশি হয়েছে। তা ছাড়া আল্লাহর প্রেরিত রাসূল (দঃ) বলেছেন। “যে ব্যবসায় ক্ষতি ছাড়া শুধু লাভ হয়, সে ব্যবসা হারাম। যেমন সুদের ব্যবসা। এই ব্যবসায় লাভ ছাড়া ক্ষতি নাই। তাই এটা হারাম।” আমি মনে করি, শ্রমিকদের খুশি রাখলে তারা আরও দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে কাজ করবে। আমরা যদি তাদের সব রকম সুবিধা অসুবিধার দিকে লক্ষ্য রাখি, আর তাদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিই, আমার দৃঢ় ধারণা, তা হলে তারা কোনো দিন কাজে ফাঁকি দেবে না। বেশি পাওয়ার আশায় আরো বেশি পরিশ্রম করবে।

ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার আসিফ সাহেব প্রবীণ ও ধার্মিক ব্যক্তি। তিনি বললেন, আল্লাহপাক আপনাকে কামিয়াব করুন। আপনার কথা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আশা করি, আমার অন্যান্য সহকর্মী ভাইয়েরাও আপনাকে সমর্থন করবেন। ওঁর কথা শেষ হওয়ার পর সকলে সেলিমকে সমর্থন করলেন। তারপর সকলে মিলে আলোচনা করে মুসলমান অফিসার ও শ্রমিকদের জন্য দুই ঈদে দু’মাসের বেতন এবং হিন্দুদের জন্য পূজার সময় দু’মাসের বেতন বোনাস ও গ্রেড অনুযায়ী বেতন বাড়ানর

এবং মিল এলাকায় আপাতত পঁচিশ বেডের একটা হাসপাতাল করার সিদ্ধান্ত নিল।

মাগরিবের নামাযের সময় হয়ে গিয়েছিল। সভা শেষ ঘোষণা করে সেলিম নামায পড়ার জন্য মসজিদে গেল। মেম্বারদের মধ্যেও দুজন গেলেন।

সন্ধ্যার পর নিমন্ত্রিত মেহমানরা আসতে লাগল। রেহানাও তার মার সঙ্গে এসেছে। সেলিমের অনেক বন্ধু বান্ধবী এল। তারপর ছোট খাট গানের আসর হল। যারা সেবারে লাইলীর গজল শুনেছিল, তারা আজও একটা গজল গাওয়ার জন্য

কে অনুরোধ করল। লাইলী কিছুতেই সম্মত হল না। শেষে সবই সেলিমকে বলল, তোমাকে কিছু শোনাতে হবে। সেলিম সে জন্য প্রস্তুত ছিল। সে স্বরচিত একটা গান অন্তরের সমস্ত দরদ দিয়ে গাইল–

তুমি সুন্দর তাইতো শুধু তোমার পানে চেয়ে থাকি,

তোমার নয়ন মনিতে দেখিতে পাই নিজের প্রতিচ্ছবি।

আমার হৃদয়ে তোমার স্মৃতি রয়েছে যে গো জড়িয়ে,

তাইতো তোমায় পুলকিত মনে চেয়ে দেখি বারে বারে।

লোকলজ্জা বাধা দিতে পারে নাকো হেন কাজে,

আমি যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি তোমারই মাঝে।

পৃথিবীতে যা কিছু সুন্দর,

সবারই কাছে হয় তা সমাদর।

কাউকে যদি সেই সুন্দর করে আকর্ষণ,

তা হলে কি তারে দুষিবারে পারে সর্বজন?

যে যাই বলুক, মাশুক করে না কো দুর্ণামের ভয়,

শত বাধা ঠেলে সে তার সুন্দরকে পেতে চায়।

পৃথিবীতে এমন কত আশেক মাশুক আছে,

বাধা পেয়ে গেছে হারিয়ে নিষ্ঠুর সমাজের কাছে।

তাই মনে হয় মানুষ যদি মানুষের মত হত,

তা হলে তারা সুন্দরের মর্যাদা দিতে জানত।

সেলিম যখন গান গাইতে শুরু করে, তখন রেহানার ভাই মনিরুল এল। সেলিমের দৃষ্টি অনুসরণ করে সে লাইলীকে দেখে একেবারে এসটোনিষ্ট হয়ে গেল। অন্য সব মেয়েদের দিকে চেয়ে আবার লাইলীর উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চিন্তা করল, ওরা সব দামী দামী কাপড় পরে কত রকমের প্রসাধন মেখে সুন্দরী সেজেছে। আর লাইলীকে প্রসাধনহীন সাধারণ পোষাকে তাদের থেকে অনেক বেশি সুন্দরী দেখাচ্ছে। গানটা শুনে মনে মনে সেলিমকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারল না। সত্যি এরকম নিখুঁত সুন্দরী মেয়ে পৃথিবীতে বিরল। সে লাইলীর দিকে একাগ্রচিত্তে চেয়ে রইল।

গান শেষ হওয়ার পর হাত তালিতে ঘর ভরে উঠল। সবশেষে সোহানা বেগম সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আজকের এই অনুষ্ঠানে আপনাদেরকে একটা আনন্দের খবর জানাচ্ছি। তারপর লাইলীর কাছে গিয়ে তাকে দাঁড় করিয়ে বললেন, এই যে মেয়েটিকে আপনারা দেখছেন, অনেকে একে চেনেন না। এ একজন সাধারণ ঘরের মেয়ে, ইসলামীকে হিষ্ট্ৰীতে অনার্স পরীক্ষা দিয়েছে। এর নাম লাইলী। একে সেলিম পছন্দ করেছে বিয়ে করার জন্য। আমিও ছেলের পছন্দকে সমর্থন করি। আশা করি, আপনারাও সেলিমের পছন্দ করা মেয়েকে সমর্থন করবেন। কথা শেষ করে তিনি দু’গাছা সোনার বালা লাইলীর হাতে পরিয়ে দিয়ে সকলকে দোয়া করতে বললেন।

লাইলী ভীষণ লজ্জা পেয়ে মাথা হেঁট করে রইল। আর সবাই হাততালি দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করতে লাগল। অনেকে বলল, সেলিমের পছন্দকে বাহবা দিতে হয়। সেলিম খুব সুন্দর। তার বৌ তার থেকে আরও বেশি সুন্দরী। যারা এর আগে লাইলীকে দেখেনি, তারা তার রূপ দেখে নির্বাক হয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

তারপর ডিনার পরিবেশন করা হল। বাইরের মেহমানরা বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার পর সোহানা বেগম দাদাকে ডেকে বললেন, রেহানাকে বৌ করব বলে মনে বড় সখ ছিল। সেইজন্য একদিন তোমাকে সেকথা বলেও ছিলাম। কিন্তু সেলিমকে কিছুতেই রাজি করাতে পারিনি। আমি তোমার ছোট বোন হয়ে আমার অপরাধের জন্য মাফ চাইছি। তুমি আমাকে মাফ করে দাও দাদা।

রেহানার বাবা জাহিদ সাহেব বললেন, এতে তোমার কোনো অপরাধ হয়নি। আজকাল শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা নিজেদের পছন্দ মত বিয়ে করে। তাই সেলিমকেও দোষ দেওয়া যায় না। তবে মেয়েটির বাবা কি করেন? তাদের বংশ কেমন? দেখা দরকার। তারপর তিনি ছেলেমেয়েকে সঙ্গে করে বাড়ি ফিরে গেলেন।

সোহানা বেগম লাইলীকে খাইয়ে দিয়ে সেলিমকে বললেন, ওকে এবার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আয়। আর লাইলীকে বললেন, তোমার বাবা মাকে আমার সালাম জানিয়ে বলে, আমি দুই একদিনের মধ্যে আসছি।

লাইলী সোহানা বেগমকে কদমবুছি করলে তিনি লাইলীর মুখে চুমো খেয়ে বললেন, সুখী ও দীর্ঘজীবি হও মা।

লাইলী সেলিমের পাশে বসেছে। সেলিম ধীরে ধীরে গাড়ি চালাতে চালাতে জিজ্ঞেস করল, সেলিম নামে দুষ্ট ছেলেটার সাথে বিয়েতে মত আছে তো? তোমার কোনো মতামত না নিয়েই তার মা তোমার সঙ্গে ছেলের বিয়ের কথা সবাইকে জানিয়ে দিলেন।

এমনিতেই লাইলী খুব লজ্জিত ছিল। তার উপর সেলিমের প্রশ্ন শুনে আরও বেশি লজ্জা পেয়ে কথা বলতে পারল না। কারণ আনন্দ আর লজ্জা তখন গলা টিপে ধরেছে।

তাকে চুপ করে থাকতে দেখে সেলিম আবার জিজ্ঞেস করল, আমার প্রশ্নে উত্তর দিলে না যে?

লাইলী সেলিমের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে আস্তে আস্তে বলল, আমি তো অনেক আগেই সেই দুষ্ট ছেলেটার পায়ে নিজেকে সঁপে দিয়েছি। আবার ঐ সব প্রশ্ন করছ কেন? আমার ভীষণ লজ্জা করছে।

সেলিম ডান হাত দিয়ে তার গলাটা আলতো করে টিপে দিয়ে বলল, লজ্জা মেয়েদের চিরচারিত ভূষণ। যে মেয়ের লজ্জা নেই, তাকে সেলিম পছন্দ করবে কেন?

সেলিমের হাতের স্পর্শ পেয়ে লাইলী কারেণ্ট সর্ট খাওয়ার মত কেঁপে উঠে ঐ অবস্থায় নিথর হয়ে বসে রইল।

লাইলীদের বাড়ির গেটে গাড়ি পার্ক করে সেলিম বলল, আবার কবে তোমাকে দেখতে পাব?

লাইলী গাড়ি থেকে নেমে কলিং বেলে হাত রেখে বলল, যে দিন তুমি ইচ্ছা করবে।

জলিল সাহেব অফিস থেকে ফিরে সকালের দিকের ঘটনা শুনেছেন। তিনি গেট খুলে ওদের দুজনকে দেখতে পেলেন। সেলিমকে সালাম দিয়ে বললেন, কেমন আছেন?

সেলিম সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?

আল্লাহপাকের দয়াতে ভালো আছি। আসুন ভিতরে চলুন। ড্রইংরুমে এসে দুজনে বসল। লাইলী আগেই ভাইয়াকে পাশ কাটিয়ে পালিয়ে গেছে।

একটু পরে রহিমা তিন কাপ চা নিয়ে এসে লাইলীকে দেখতে না পেয়ে বলল, কই আমার ননদিনীকে দেখছি না কেন?

জলিল সাহেব বললেন, ও গেট দিয়ে ঢুকেই পালিয়ে গেছে। চা পান শেষ করে সেলিম বিদায় নিয়ে ফিরে গেল।

রহমান সাহেব ও হামিদা বানু এত রাত পর্যন্ত লাইলী ফিরে আসছে না দেখে খুব চিন্তিত ছিলেন। মেয়েকে দেখে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললেন। লাইলীকে ডেকে রহমান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, এত রাত হল কেন মা? আমরা এদিকে ভেবে মরছি।

লাইলী বালা পরা হাত দুটো দেখিয়ে লজ্জা রাঙা হয়ে বলল, ওর আম্মা পরিয়ে দিয়েছেন। উনি আপনাদের সালাম জানিয়েছেন। আমি আর কিছু বলতে পারব না বলে প্রায় ছুটে নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।

রহমান সাহেব স্ত্রীর দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন, তার দুচোখ থেকে তখন পানি গড়িয়ে পড়ছে।

পরের দিন সকালে লাইলীর হাতের দিকে চেয়ে রহিমা জিজ্ঞেস করল, কি গো সখি, কে পরিয়ে দিল?

লাইলী লজ্জা পেয়ে বলল, তুমিই বল না দেখি?

নেকলেস হলে বুঝতাম, সেলিম দোকান থেকে কিনে পরিয়ে দিয়েছেন। বালা যখন, তখন নিশ্চয় ওর মা পরিয়ে দিয়েছেন।

প্রথমটা ঠিক কিনা জানি না, তবে দ্বিতীয়টা তুমি ঠিক বলেছ। জান ভাবি, ফাংশানের শেষে যখন ওর মা সকলকে বিয়ের কথা বলে বালা দু’টো পরিয়ে দিলেন তখন আমার এত লজ্জা ও ভয় করছিল যে, তোমাকে আমি ঠিক বলতে পারছি না।

শুধু লজ্জা আর ভয় পেলে, আনন্দ পাওনি?

তা আবার পাইনি। কত বড় বড় ঘরের লোকজনও তাদের ছেলেমেয়েরা সেখানে ছিল, আমি তো খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।

রহিমার কাছে লাইলীর মা-বাবা সব কিছু শুনে যেমন খুশি হলেন, তেমনি আবার চিন্তিতও হলেন। অত বড়লোকের খাতির যত্ন করবেন কেমন করে? রহমান সাহেব আনন্দে অসুখের কথা ভুলে গেলেন। তিনি সুস্থ মানুষের মত পরের দিন থেকে নিয়মিত অফিস করতে লাগলেন।

দু’দিন পর বিকালে সোহানা বেগম ড্রাইভারের সঙ্গে লাইলীদের বাড়িতে এলেন।

রহমান সাহেব ও জলিল সাহেব কেউ অফিস থেকে তখনও ফেরেন নি। লাইলী সোহানা বেগমকে সালাম করে মা ও ভাবির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। পরিচয়ের পালা শেষ করে হামিদা বানু প্রাথমিক আপ্যায়নের পর রহিমাকে সোহানা বেগমের কাছে বসিয়ে, লাইলীকে নিয়ে নাস্তা তৈরি করতে গেলেন।

সোহানা বেগম রহিমার কাছ থেকে তাদের ও লাইলীদের সব খবর জেনে নিলেন।

হামিদা বানু নাস্তা তৈরি করে এনে বললেন, আমরা ভাই গরিব মানুষ। আপনাদের মত লোকের আদর যত্ন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। যতটুকু করেছি খেয়ে আমাদের ধন্য করুন।

সোহানা বেগম তার হাত ধরে পাশে বসিয়ে বললেন, ঐ রকম কথা বলে লজ্জা দেবেন না। আমি সবকিছু জেনেশুনে আত্মীয়তা করত এসেছি। এখানে গরিব ও বড়লোকের প্রশ্ন নেই। আসুন আমরা তিনজন এক সঙ্গে খাই, লাইলীর বাবা ও দাদা বুঝি এখনও ফেরেন নি?

হামিদা বানু বললেন, না, তবে আসবার সময় হয়ে গেছে। লাইলী সবাইকে নাস্তা পরিবেশন করল। নাস্তার পর তিনজনে গল্প করতে লাগলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে রহমান সাহেব ও জলিল সাহেব ফিরলেন।

পরিচয়াদির পর সোহানা বেগম বললেন, আমি তো লাইলীকে পূত্রবধূ করার জন্য পাকা কথা বলতে এসেছি। আপনাদের মতামত না নিয়েই সেদিন আমাদের বাড়িতে সকলের সামনে লাইলীকে পূত্রবধূ করব বলে মনোনীত করেছি। আপনাদের মেয়েকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। এখন আপনাদের মতামত জানতে পারলে একদম দিন ধার্য করে ফিরব।

রহমান সাহেব বললেন, আমরা কি আর বলব। এযুগে এরকম ঘটনা বিরল। মনে হয় আল্লাহপাকের বড় রহমত আমাদের মেয়ের উপর। তাই আপনাদের মত লোকের বাড়িতে তার স্থান হচ্ছে। দোয়া করি, তিনি যেন আপনাদের সবাইকে সুখী করার তওফীক লাইলীকে দান করেন। আর ওদের দাম্পত্য জীবন সুখের করেন। এর বেশি কি আর বলব বোন?

সোহানা বেগম লাইলীকে ডাকতে বললেন।

রহমান সাহেব অনুচ্চস্বরে মেয়ের নাম ধরে ডেকে বললেন, এখানে এস তো মা।

পাশের রুম থেকে লাইলী তাদের সবকথা শুনতে পাচ্ছিল। ধীরে ধীরে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়াল।

সোহানা বেগম ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে পাঁচভরী ওজনের একটা সোনার হার বার করে লাইলীর গলায় পরিয়ে দিলেন।

লাইলীর রূপ ঝলসে উঠল। সবাই নির্বাক হয়ে তাকে দেখতে লাগল। লাইলী প্রথমে সোহানা বেগমকে ও পরে একে একে সবাইকে কদমবুসি করল।

সোহানা বেগম তার মাথায় ও চিবুকে হাত বুলিয়ে চুমো খেয়ে বললেন, বেঁচে থাক মা, তোমরা দুজনে সুখী হও।

বিয়ের তারিখ ঠিক করে সোহানা বেগম ফিরতে চাইলে রহমান সাহেব বললেন, সে কি কথা বেয়ান, আপনি আজ মেহমান হয়ে প্রথম এসেছেন, খাওয়া দাওয়া না করে যেতে দিচ্ছি না।

সোহানা বেগম বললেন, একটু আগে তো খেলাম। আমি এত তাড়াতাড়ি আর কিছু খেতে পারব না। আত্মীয়তা যখন হল তখন তো মাঝে মাঝে এসে খেয়ে যাব। আমি একা মানুষ, আরও কয়েক জায়গায় যেতে হবে, কাজ আছে।

রহমান সাহেব নাছোড়বান্দা। শেষে আর এক প্রস্থ চা বিস্কুট খেয়ে সোহানা বেগম বিদায় নিলেন।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. সূরা-হুজুরাত, ১০ নং আয়াত, পারা ২৬।
  2. বর্ণনায়, আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা.) — বোখারী ও মুসলিম