সাত
সেলিমদের বাড়ি থেকে ফিরে মনিরুল রেহানাকে বলল, তুই তো সেদিন খুব ফটফট করে বললি, তোর দিকটা তুই সামলাবি। দেখলি তো, ঐ মেয়েটা তোকে টেক্কা দিয়ে জিতে গেল।
রেহানা ভিতরে ভিতরে গুমরাচ্ছিল। কোনো কথা বলতে পারল না। চিন্তা করল, সে এতদিন সেলিমের সঙ্গে মেলামেশা করেও তাকে আকর্ষণ করেত পারল না। মাত্র কয়েক দিনের পরিচয়ে তাদের প্রেম এতদূর গড়িয়ে গেল? লাইলীর উপর রাগ বেশি হল। তার মনে হল, গরিব ঘরের মেয়ে ঐশ্বর্যের লোভে সেলিমকে রূপের ফাঁদে ফেলেছে।
রেহানাকে চুপ করে ভাবতে দেখে মনিরুল আবার বলল, তুই যদি বলিস, আমি ওদের বিয়ে ভেঙ্গে দিতে পারি।
রেহানা চমকে উঠে বলল, কিন্তু বিয়ে ভেঙ্গে গেলে সেলিম যে আমাকে বিয়ে করবে তার কোনো নিশ্চয়তা আছে? তা ছাড়া আমি কি এতই ফেলনা যে, আমাকে পছন্দ না করলেও তোমরা তার সঙ্গে আমার বিয়ে দিতে চাও। আমি শুধু দেখব লাইলীকে বিয়ে করে সে কত সুখী হয়।
মনিরুল বলল, তুই কিছু ভাবিস না, দেখি আমি কতদুর কি করতে পারি। একটা কথা ভুলে যাচ্ছিস কেন? মাঝপথে লাইলী না এলে সেলিম তোকে ঠিকই বিয়ে করত। তা ছাড়া সে তো তোকে ডিনাই করেনি। যত গণ্ডগোলের মূল হল, লাইলী। ওর বাড়ির ঠিকানাটা দিতে পারিস?
যেদিন নিউ মার্কেটে লাইলীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, সেদিন কথায় কথায় রেহানা তার ঠিকানা জেনে নিয়ে পরে এক টুকরো কাগজে লিখে রেখেছিল। রেহানা ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে লাইলীর ঠিকানাটা এনে দিয়ে বলল, দেখ, তুমি যেন আবার এমন কিছু করো না, যাতে করে সেলিম না মনে করে আমরা তাদের বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছি।
আরে না না। আমি কী কচি থোকা? সে কথাও তোকে বলে দিতে হবে। এমনভাবে কাজ করব লাঠিও ভাঙবে না, আর সাপও মরবে না। তারপর ঠিকানাটা পড়ে বলল, আরে এই ঠিকানায় নাজমুল নামে একটা ছেলে আমাদের অফিসের টাইপিষ্ট। দাঁড়া, কালকেই তাকে জিজ্ঞেস করলে সবকিছু জানা যাবে।
নাজমুল লাইলীর চাচাতো ভাই। সে কোনো রকমে ম্যাট্রিক পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। পাড়ার ও কলেজের লম্পট ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে বেড়াত। তাদের সঙ্গে বেশ কয়েকটা হাইজ্যাক ও নারীঘটিত কেসে ধরা পড়ে হাজৎ খেটেছে। তারপর তার বাবা তাকে অনেক শাসন করেও যখন বাগে আনতে পারলেন না তখন তাকে নিজের রেশন দোকানে বসান। সেখানেও সে অনেক টাকা পয়সা নষ্ট করে ফেলে। শেষে টাইপ শিখিয়ে একজনকে অনেক টাকা ঘুষ দিয়ে মনিরুলদের অফিসে চাকরিতে ঢুকিয়েছেন। ছেলের মতিগতি ভালো করার জন্য তার বাবা কয়েক জায়গায় মেয়ে দেখেছেন। কিন্তু সে রাজি হয়নি। শেষে তার মায়ের জেদাজেদীতে বলেছে, চাচাতো বোন লাইলীকে ছাড়া বিয়ে করবে না। তার বাবা কথাটা শুনে প্রথমে খুব রাগারাগি করেন। কারণ বড় ভাইয়ের সাথে কয়েক বছর আগে থেকে আকসা-আকসি। কোন মুখে সেখানে বিয়ের কথা বলবে। ছেলেকে অনেক বুঝিয়েও যখন কাজ হল না, তখন একদিন বড় ভাইকে ডেকে বিয়ের প্রস্তাব দেন।
ছোট ভাইয়ের কথা শুনে রহমান সাহেব অনেকক্ষণ চুপ করে চিন্তা করলেন। ভাইপোর সঙ্গে বিয়ে দিলে মেয়েকে সব সময় কাছে পাবেন। কিন্তু ছোট ভাইতো হারাম টাকা রোজগার করে। ছেলেটা আবার নামায রোযার ধার ধারে না। তার চরিত্রের অধঃপতনের কথা লাইলী ও নিশ্চয় শুনেছে। মেয়ে আমার ধর্মের আইন মেনে চলে। তা ছাড়া ছেলে, মেয়ের চেয়ে কম শিক্ষিত।
বড় ভাইকে বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এতক্ষণ কি ভাবছ? তোমার মতামত বল?
রহমান সাহেব বললেন, এসব ব্যাপারে ভেবেচিন্তে উত্তর দিতে হয়। ঠিক আছে, আমি লাইলীর মায়ের সঙ্গে কথা বলে পরে জানাব। ঘরে ফিরে স্ত্রীকে ছোট ভাইয়ের কথা বললেন।
হামিদা বানু শুনে খুব রেগে গেলেন। বললেন, আমার অমন সোনার চাদ মেয়েকে ঐ লম্পট ছেলের হাতে দিতে পারব না। দেওরপুত হলে কি হবে? চরিত্রহীন। তা ছাড়া লাইলী এখন বড় হয়েছে, লেখাপড়া করেছে, তারও তো একটা মতামত আছে? আমি একদম নারাজ। তুমি তোমার ভাইকে জানিয়ে দাও, এ বিয়ে হওয়া একদম অসম্ভব।
লাইলী কি দরকারে আবার কাছে যাচ্ছিল। আব্বাকে মায়ের সঙ্গে তার বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে শুনে দরজার আড়াল থেকে সব কথা শুনল। আর কথা শুনে প্রথমে সে খুব রেগে গিয়েছিল, শেষে মায়ের কথা শুনে তার মনটা হালকা হয়ে গেল।
দু’দিন পর রহমান সাহেব ছোট ভাইকে অমতের কথা জানালেন।
এতদিন পর ছেলের বিয়ের কথা বলে নাজমুলের বাবা বড় ভাইয়ের উপর কিছুটা নরম হয়েছিলেন। বিয়েতে অমত শুনে খুব রাগের সঙ্গে বললেন, আমিও দেখব, কোন রাজপুত্র এসে তোমার মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে যায়।
আব্বাকে চাচার সঙ্গে কথা বলতে নাজমুল গোপনে তাদের কথাবার্তা শুনতে ছিল চাচা তার সঙ্গে বিয়ে দেবে না জেনে সেও খুব রেগে গেল। আর মনে মনে ভাবল, দেখে নেব কেমন করে লাইলীর অন্য জায়গায় বিয়ে হয়।
পরের দিন মনিরুল অফিসে নাজমুলকে বলল, তোমাকে একটা মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করব, তার সম্বন্ধে তুমি যা জান সব আমাকে বলবে।
নাজমুল বলল, বলুন কোন মেয়ের সম্বন্ধে কি জানতে চান?
মনিরুল ঠিকানাটা তার সামনে ধরে জিজ্ঞেস করল, এটা কি তোমাদের বাড়ির ঠিকানা?
নাজমূল একবার চোখ বুলিয়ে বলল, হ্যাঁ স্যার। লাইলী নামে একটা মেয়েরও এই ঠিকানা, সে তা হলে কি হয় তোমার?
ছোট সাহেবের মুখে তার স্বপ্নের রাণীর নাম শুনে নাজমুল অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে রইল।
কি হল তুমি আমার কথার উত্তর দিচ্ছ না কেন? নামটা শুনে খুব অবাক হয়েছ দেখছি।
দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে নাজমুল বলল, লাইলী আমার বড় চাচার মেয়ে। তার সঙ্গে আমার বিয়ের কথা হয়েছিল।
বিয়ের কথা হয়েছিল? হল না কেন?
আপনি যখন তার কথা জানতে চান তখন সব কথা খুলে বলছি শুনুন, অনেক দিন থেকে চাচাদের সাথে আমাদের মনোমালিন্য। কিন্তু আমি ছেলেবেলা থেকে লাইলীকে ভালবাসি। বেশ কিছুদিন আগে আমি তাকে আমার মনের কথা বলে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। আমার কথা শুনে লাইলী বলল, দেখ নাজমুল ভাই, তুমি যে রকম ছেলে, সেই রকমের মেয়েকে বিয়ে করা তোমার উচিত। আর একটা কথা মনে রেখ, বামন হয়ে চঁাদে হাত বাড়াতে যেও না। তার কথা শুনে আমি খুব রেগে যাই। সেই সময় প্রতিজ্ঞা করি, যেমন করেই হোক আমি তার দেমাগ ভাঙব। শেষে বাবাকে দিয়ে চাচার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিই। তারা কেউ রাজি হয়নি। আমিও দেখব, কেমন করে অন্য জায়গায় বিয়ে হয়।
মনিরুল বলল, তুমি কি তাকে এখনও ভালবাস? আমি যদি তোমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করি, তা হলে কী তাকে বিয়ে করবে?
নাজমুল ছোট সাহেবের কথা শুনে যেন হাতে চাদ পেল। বলল হাঁ স্যার, তাকে এখনও আমি প্রাণ অপেক্ষা বেশি ভালবাসি। সে ভাগ্য কি আমার হবে স্যার? তা ছাড়া আপনি আমার জন্য এত কিছু করবেন কেন?
মনিরুল বলল, তুমি যদি আমার কথামত কাজ কর, তা হলে তোমার মনোস্কামনা পূর্ণ হতে দেরি হবে না।
আপনি যা বলবেন তাই শুনব স্যার। আপনাকে বলতে আমার আর কোনো লজ্জা নেই, আমি যদি ওকে না পাই, তবে সারাজীবন আর বিয়েই করব না।
ঠিক আছে, আমি তার সঙ্গে তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করে দেব। তবে তার আগে তোমাকে নিয়ে ওর নামে আমি দুর্ণাম রটাতে চাই। তোমাকে খুলে বলি, ওর সঙ্গে আমার এক আত্মীয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আমি চাই না তার সঙ্গে ওর বিয়ে হোক। তাই তোমার সংগে ওর দুর্ণাম রটিয়ে বিয়েটা ভাঙ্গাতে চাই। কিন্তু তুমি জীবনে কোনোদিন এই কথা কারো কাছে প্রকাশ করবে না। করলে এতে তোমারই বেশি ক্ষতি হবে। আর বিয়েটা ভেঙ্গে গেলে তুমি লাইলীকে বিয়ে করতে পারবে এবং আমি তোমার প্রমোশনও দিয়ে দেব।
নাজমুল আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বলল, আপনি মনিব, আপনার কথার বিরুদ্ধে আমি এতটুকুও কিছু করব না। কেউ কি স্যার তার নিজের ভবিষ্যৎ কোনোদিন নষ্ট করতে চায়?
মনিরুল বলল, আমি সময় মত সব কিছু তোমাকে জানাব। এখন যাও কাজ করগে। তারপর সে দুটো চিঠি লিখে অফিসের পিওনের হাতে দিয়ে একটা রহমান সাহেবকে ও অন্যটা সোহানা বেগমকে দেওয়ার নির্দেশ দিল। পিওন মনিবের কথা মত কাজ করে ফিরে এলে মনিরুল জিজ্ঞেস করল, দুটো চিঠিই ঠিক লোকের হাতে দিয়েছ তো?
পিওন বলল, হ্যাঁ সাহেব, আমি আগে চিঠির মালিকের নাম জেনেছি, তারপর দিয়েছি।
রহমান সাহেব, পিওনের হাত থেকে চিঠি নিয়ে ঘরে এসে পড়তে লাগলেন।
শ্রদ্ধেয় রহমান সাহেব,
প্রথমে সালাম নেবেন। পরে জানাই যে, আপনি আপনার একমাত্র মেয়ে লাইলীর বিয়ে যে ছেলের সঙ্গে ঠিক করেছেন, তার খোঁজ-খবর নিয়েছেন? ঐশ্বর্যের প্রতি গরিবদের কী এতই লোভ? একমাত্র মেয়েকে না জেনে, না দেখে বড়লোকের ছেলের সাথে বিয়ে দিতে যাচ্ছেন। বড়লোকের ছেলেরা যে কত চরিত্রহীন হয়, তার খোঁজ যদি রাখতেন, তা হলে ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে রাজার ছেলেকে জামাই করার স্বপ্ন দেখতেন না। এতটুকুও ভেবে দেখেন নি, অত বড় লোকের ছেলে কেন আপনার মতো গরিব লোকের মেয়েকে বিয়ে করতে চাচ্ছে? মেয়েরা তো তাদের কাছে খেলার সামগ্রী। দুদিন পরে ভালো না লাগলে ব্যবহৃত খেলনার মত ছুঁড়ে ফেলে দেয়। বিয়ে করা মেয়েকে তো আর সে ভাবে ছুঁড়ে ফেলতে পারে না। নেহাত বেকায়দায় পড়ে ঘরে ফেলে রাখে। আর তারা মদ খেয়ে অন্য মেয়েদের নিয়ে ফুর্তি করে বেড়ায়।
যাক আমি আপনার হিতাকাঙ্খী। সেলিমের দুশ্চরিত্রের কথা জানি বলে আপনাকে বাধা দিলাম। আপনার মেয়ে সুন্দরী ও শিক্ষিতা। যদি বলেন, আমি তার জন্য একটা ভালো ছেলে দেখে দেব। সে আপনাদের মত মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। আশা করি, আপনার মেয়েকে বাদীগিরী করার জন্য বড়লোকের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেবেন না। যদি আমাকে শত্রু মনে করে জিদ করে এই কাজ করেন, তবে আপনার মেয়ের শেষ পরিণতির জন্য আপনি দায়ী হবেন। দরকার মনে করলে নিচের ঠিকানায় পত্র দিয়ে জানাবেন।
ইতি।
আপনার জনৈক হিতাকাঙ্খী।
ঠিকানা ও পোস্ট বক্স নাম্বার………….।
চিঠি পড়ে রহমান সাহেব খুব মুষড়ে পড়লেন। তার মনের মধ্যে তখন অনেক রকম চিন্তা হতে লাগল। চিঠিটা যেই লিখুক না কেন, সত্যিই বড়লোকের ছেলেদের চরিত্র আজকাল খুব নিচে নেমে গেছে। খবরের কাগজ খুললে প্রায় প্রতিদিন তা দেখতে পাওয়া যায়। কি করবেন ভেবে ঠিক করতে পারলেন না। ভাড়াটিয়া জলিল সাহেবকে চিঠিটা দেখালেন। উনি বললেন, চিঠিটা যে দিয়েছে, তার নিশ্চয় কোনো মতলব আছে।
রহমান সাহেব বললেন, কার কি এমন মতলব আছে জানি না বাবা, আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না।
জলিল সাহেব বললেন, আপনি বেশি চিন্তা করবেন না। বিয়ের তো এখনও একমাস দেরি। দেখা যাক, এর মধ্যে কোনো কিছু ঘটে কিনা। লাইলীকে এ ব্যাপারে কিছু বলার দরকার নেই।
এদিকে সোহানা বেগমও চিঠি পেয়ে পড়তে লাগলেন–
শ্রদ্ধেয়া,
আমি আপনাদের পরিচিত লোক। বিশেষ কারণবশতঃ পরিচয় দিতে পারলাম না বলে দুঃখিত। সেলিমের সংগে লাইলীর বিয়ে হবে শুনে আপনাকে কয়েকটা কথা না বলে থাকতে পারলাম না। আপনারা বড়লোক ও উচ্চ শিক্ষিত মানুষ। কেন জানি না, লাইলীর মতো একটা চরিত্রহীনা মেয়েকে ঘরের বৌ করতে যাচ্ছেন। তার সম্বন্ধে ভালভাবে খোঁজ-খবর নিলে দেখবেন, সে মোটেই ভালো মেয়ে নয়। তার চাচাত ভাইয়ের সাথে বিয়ের কথা হয়েছিল। লাইলী বিয়ের কয়েকদিন আগে পাড়ার একটা ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যায়। কি করে যেন পুলিশ তাকে উদ্ধার করে দিয়ে যায়। সেই জন্য তার চাচাতো ভাই তাকে বিয়ে করেনি। মেয়েটা শুধু দেখতেই যা রূপসী। রূপ দিয়ে অনেক ছেলের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করেছে। আপনারা নিশ্চয় জানেন, “অল দ্যাট গীটার ইজ নট গোল্ড”। বেশি কিছু আর বলতে চাই না, জ্ঞানী হলে অল্পতেই বুঝতে পারবেন।
ইতি–
আপনাদের শুভাকাখি।
চিঠি পড়ে সোহানা বেগম যেন গাছ থেকে পড়লেন। চিঠিতে অনেক অবান্তর কথা থাকলেও কিছু কথা ঠিক। ভাবলেন, ওদের মহল্লার অন্যান্য লোকের কাছে তাদের খোঁজ-খবর নেওয়া উচিত ছিল। যদি সত্যিই লাইলীর চরিত্র খারাপ হয়? নাহ, কিছুই যেন তার মাথায় আসছে না। কে নাম ঠিকানা ছাড়া পত্র দিল? শেষে তার মনে হল, কেউ হয়তো এভাবে বিয়ে ভাঙ্গিয়ে দিয়ে নিজের স্বার্থ হাসিল করতে চায়। সেলিমও বাড়িতে নেই, চিটাগাং গেছে। সে বাড়িতে থাকলে তার সঙ্গে যুক্তি করা যেত। তারও খোঁজ খবর নেই। নানান চিন্তায় তিনি খুব অস্থির হয়ে পড়লেন। সেলিমকে আসার জন্য একটা টেলিগ্রাম করে দিলেন।
সেলিম আজ এক সপ্তাহ হল চিটাগাং এসেছে। সেখানে একটা বাড়ি কিনে নূতন অফিস খুলবে। সেই জন্য ম্যানেজারকেও সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। সুন্দর দেখে একটা দোতলা বাড়ি কিনে নিচে অফিস ও উপরে থাকবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অফিসের জন্য ফার্ণিচার কিনে ফেরার পথে সেলিমের গাড়ির সঙ্গে একটা ট্রাকের মখোমখী এ্যাক্সিডেণ্ট। গুরুতর অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। মাথায় বেশি আঘাত পেয়েছে। ম্যানেজার সাহেবও একই গাড়িতে ছিলেন। অলৌকিকভাবে তিনি বেঁচে গেছেন। তার আঘাত সামান্য। প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি সেলিমদের বাড়িতে টেলিগ্রাম করে দিলেন।
টেলিগ্রাম পেয়ে সোহানা বেগমের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। পিয়নকে দেখে আসমা ও রুবীনা এই দিকে আসছিল। মায়ের মুখ রক্তশূন্য দেখে ছুটে আসে টেলিগ্রামটা পড়ল, সেলিম সিরিয়াসলি উনডেড। হি ইজ ইন ডেঞ্জার। কাম সার্প।
রুবীনা মাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বলল, চল মা আমরা এখুনি রওয়ানা দিই।
সোহানা বেগম ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছেন। ডাইভারকে গাড়ি বার করতে বলে রুবীনাকে বললেন, আমি একা যাব’। তুমি আর আসমা এদিকে দেখাশুনা করবে। তারপর তৈরি হয়ে গাড়িতে উঠলেন। তিনি যখন চিটাগাং হসপিটালে পৌঁছালেন তখন রাত্রি নটা। আজ তিন দিন সেলিমের জ্ঞান ফিরেনি। মাথা পাষ্টার করা। সোহানা বেগম ছেলের অবস্থা দেখে মুষড়ে পড়লেন। অনেক টাকা খরচ করে কেবিনের ও স্পেশাল চিকিৎসার জন্য বড় ডাক্তারের ব্যবস্থা করলেন।
পরের দিন বেলা এগারটায় সেলিমের জ্ঞান ফিরল। ডাক্তার বললেন, রুগী এখন আউট অফ ডেঞ্জার। আপনারা ঘাবড়াবেন না। তবে আজও যদি জ্ঞান না ফিরত, তা হলে রুগীকে বাঁচান যেত কিনা সন্দেহ।
সোহানা বেগম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। সঙ্গে সঙ্গে সেই চিঠির কথা মনে পড়তেই ভাবলেন, লাইলী সুন্দরী হলে কি হবে, সে বড় অপয়া। তা না হলে বিয়ের তারিখ ঠিক হতে না হতে ছেলে আমার বিপদে পড়ল। আবার ভাবলেন, লাইলীর মতো মেয়ে অপয়া দুশ্চরিত্রা হতে পারে না। আর ঐ লোকটাই বা কেন উপযাজক হয়ে বেনামে তার দুর্ণাম দিয়ে বিয়ে ভাঙ্গাতে চাচ্ছে? এতে কি তার কোনো স্বার্থ আছে? নানা চিন্তায় তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন। শেষে ভেবে ঠিক করলেন, সেলিম ভালো হোক, তারপর তাকে লাইলীর সব কিছু জানিয়ে যা করা যাবে।
সেলিমের জ্ঞান ফিরল ঠিকই, কিন্তু সে কথা বলতে পারছে না। সকলের দিকে শুধু চেয়ে চোখের পানি ফেলে। সোহানা বেগম এর কারণ ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলেন।
ডাক্তার বললেন, এ রকম অনেক সময় হয়। ব্রেনে বেশি আঘাত পেলে অনেকে বাকশক্তি অথবা স্মৃতি শক্তি হারিয়ে ফেলে। কিন্তু ইনি তো দেখছি দুটোই হারিয়েছেন।
সোহানা বেগম আতঙ্কিত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, তা হলে কি সেলিম আর কখন কথা বলতে পারবে না? স্মৃতি শক্তি ও কী ফিরে পাবে না?
সেটা আমরা এখন ঠিক বলতে পারছি না। দেখা যাক, রুগী আগে সুস্থ হয়ে উঠুক। আমরা নরম্যালে আনার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছি, বাকি আল্লাহপাকের মর্জি।
সেলিম ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠল। কিন্তু সে কথা বলতে পারল না। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তার দিকে চেয়ে থাকে।
সোহানা বেগম ছেলেকে ঢাকায় এনে বড় বড় ডাক্তার দেখালেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। তার দৃঢ় ধারণা হল, লাইলী নিশ্চয় অপয়া মেয়ে। সেই জন্য ছেলের এই অবস্থা। তিনি বড় ভাই জাহিদ সাহেবকে একদিন বললেন, বিয়ের দিন তো প্রায় এসে গেছে। আমি এখন কি করব?
তিনি বললেন, এ অবস্থায় তো আর বিয়ে হতে পারে না? ওদের সবকিছু জানিয়ে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বিয়ের দিন পিছিয়ে দাও।
সোহানা বেগম বললেন, আমি এ বিয়ে একদম ভেঙ্গে দেব। আমার মনে হয়, মেয়েটা অপয়া। তা না হলে এরকম হবে কেন?
জাহিদ সাহেব বললেন, তুমি যা ভালো বোঝ তাই কর।
সেখানে রুবীনা ও আসমা ছিল। শুনে রুবীনা খুশি হল। কারণ লাইলীকে সে মোটেই পছন্দ করে না। বড় সেকেলে বলে তার মনে হয়। রেহানাকে এ বাড়ির উপযুক্ত বলে সে মনে করে। কিন্তু আসমার মন খুব খারাপ হয়ে গেল। লাইলীর ব্যবহার তাকে খুব ভালো লাগে। অমন সুন্দরী মেয়ে চরিত্রহীনা, অপয়া এটা যেন সে বিশ্বাস করতে পারছে না।
সেলিমের খবর পেয়ে রেহানা এ বাড়িতে ঘনঘন যাতায়াত করতে আরম্ভ করল। সে প্রতিদিন এসে প্রায় সারাদিন সেলিমের তত্ত্বাবধান করে।
বিয়ের তিন দিন আগে সোহানা বেগম অনেক ভেবে চিন্তে একটা পত্র লিখে ড্রাইভারের হাতে লাইলীদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন।
রহমান সাহেব পত্র পড়ে সেইখানেই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন।
লাইলী বাপের অবস্থা দেখে ছুটে এসে বলল, কি হল আরা, তুমি অমন করছ কেন? তারপর চিঠিটা দেখতে পেয়ে বলল, দেখি কার চিঠি?
রহমান সাহেব যন্ত্রচালিতের মত চিঠিটা তার দিকে বাড়িয়ে দিলেন।
লাইলীর কথা শুনতে পেয়ে হামিদা বানুও হাতের কাজ রেখে ছুটে এলেন। লাইলী চিঠি নিয়ে জোরে জোরে পড়তে লাগল।
রহমান সাহেব,
আপনাকে অত্যন্ত দুখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, আমরা অনেক কারণে এ বিয়ে ভেঙ্গে দিলাম। তার মধ্যে প্রধান কারণ হল, সেলিম একসিডেণ্ট করে বাকশক্তি ও স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। আর এটা হয়েছে আপনার মেয়ে লাইলীর মতো অপয়া, দুশ্চরিত্রা ও কুলক্ষণা মেয়ের জন্য। তার দৃশ্চরিত্রের কথা বাইরের লোক এসে জানাবে কেন? মনে করেছেন, সুন্দরী মেয়েকে দিয়ে আমাদের মতো সরল মানুষকে ঠকিয়ে ঐশ্চর্য্য ভোগ করবেন? গরিব হয়ে অত লোভ কেন? মনে রাখবেন, পাপ কোনোদিন ঢাকা থাকে না। বারেক বিয়ের আগে আমরা সব কথা জানতে পারলাম। নচেৎ বিয়ে হয়ে গেলে যে কি হত আল্লাহকে মালুম।
আশা করি, ভবিষ্যতে যা কিছু করবেন, ভেবে চিন্তে করবেন।
ইতি–
সেলিমের মা সোহানা বেগম।
চিঠি পড়তে পড়তে লাইলী নীল হয়ে গেল। পড়া শেষ হতে কয়েক মুহুর্ত নিশ্চল পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল, তারপর গাছ কাছাড় খেয়ে পড়ে জ্ঞান হারাল।
মেয়ের অবস্থা দেখে হামিদা বানু কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আল্লাহ গো, এ তুমি কি করলে, আমার মাসুম কলিজার টুকরা এত ব্যথা কি করে সহ্য করবে?
রহমান সাহেবের চোখ থেকে পানি পড়ছিল। বললেন, তুমি আল্লাহকে দোষ দিচ্ছ? ছি ছি, গোনাহগার হবে যে। তিনি বিশ্বজগতের প্রতিপালক। যখন যা প্রয়োজন ঠিক সময়ে তা করে থাকেন। আমরা বর্তমানকে খারাপ দেখে তাকে দোষারুপ করলে তিনি অসন্তুষ্ট হবেন। সুখে দুঃখে সব সময় তার উপর সন্তুষ্ট থাকা উচিত। ও ছেলেমানুষ, খবরটা জেনে সহ্য করতে পারেনি। তুমি ওর মাথায় পানি দিয়ে পাখার বাতাস দাও।
বেশ কিছুক্ষণ মাথায় পানি ঢালার পর লাইলী জ্ঞান ফিরে পেয়ে উঠে বসল। তারপর হাত থেকে বালা দটো ও গলা থেকে নেকলেস খুলে বাপের হাতে দিয়ে বলল, এগুলো এক্ষুণি ওদের ফিরিয়ে দিয়ে এস। আর সেলিম সাহেব কেমন আছেন দেখে আসবে। তুমি যেন আবার তাদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করো না। শুধু বলবে, গরিবদের সঙ্গে আত্মীয়তা না হয় না করলেন, তাই বলে তাদের নামে দুর্ণাম দেবেন কেন? আপনারা বড় লোক হতে পারেন, কিন্তু আল্লাহপাকের ন্যায় বিচারের কাছে সবাই সমান।
রহমান সাহেব বললেন, তাই হবে মা। এত তাড়া কিসের? আমরা তো আর তাদের জিনিষ বিক্রি করে খেয়ে ফেলছি না? জলিল সাহেবকে সবকিছু জানাই, তারপর যা হয় করা যাবে।
লাইলী আর কোনো কথা না বলে ধীরে ধীরে নিজের রুমে চলে গেল।
রাত্রে রহমান সাহেব জলিল সাহেবকে চিঠিটা দিলেন।
জলিল সাহেব চিঠি পড়ে খুব মর্মহত হলেন। বললেন, আল্লাহপাকের কি মহিমা তা তিনিই জানেন। আমরা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারি না। সেই পরম করুণাময়ের কাছে সবর করে থাকেন। তিনি কালাম পাকে বলেছেন “আল্লাহ সাবেরীনেদের সঙ্গে থাকেন।1” তারপর জিজ্ঞেস করলেন, লাইলী খবরটা শুনেছে?
হ্যাঁ, চিঠিটা পড়ে মেয়ে তো অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। জ্ঞান ফিরে পেয়ে গহনাগুলো খুলে দিয়ে বলল, যাদের জিনিষ তাদেরকে ফিরিয়ে দিয়ে এস।
জলিল সাহেব বললেন, লাইলী ঠিক কথা বলেছে। কাল সকালে আপনি ওগুলো ফিরিয়ে দিয়ে আসবেন।
পরের দিন রহমান সাহেব বেলা নটার সময় বালা ও হার নিয়ে সেলিমদের বাড়িতে গেল। একজন সাধারণ অচেনা লোককে ভিতরে ঢুকতে দেখে দারোয়ান বাধা দিল।
রহমান সাহেব বললেন, আমি সেলিমের মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। দারোয়ান তবুও যখন যেতে দিল না তখন বললেন, ওঁকে গিয়ে বল, লাইলীর আব্বা এসেছে।
দারোয়ান তাকে অপেক্ষা করতে বলে ভিতরে গেল। একটু পরে ফিরে এসে যেতে বলল।
সোহানা বেগম তৈরি ছিলেন। রহমান সাহেব ঘরে ঢুকতে বললেন, আপনি আবার এসেছেন কেন? আপনার মেয়ের জন্য আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে। আপনার চরিত্রহীনা মেয়ের জন্য যদি সাফাই গাইতে এসে থাকেন, তা হলে ভুল করেছেন। চলে যান। এভাবে মেয়েকে দিয়ে টোপ ফেলে আর কতদিন রোজগার করবেন?
রহমান সাহেব সোহানা বেগমের রাগ দেখে প্রথমে থতমত খেয়ে গেলেন। পরে সামলে নিয়ে ধীরভাবে বললেন, আপনারা আমার ও আমার মেয়ের বিরুদ্ধে কার কাছে কি শুনেছেন, তা আমি জানতে চাই না। বরং আপনি জেনে রাখুন, “এক জনের পাপের ফল আর একজনের উপর বার্তায় না।2” এটা কোরআন পাকের কথা। ওসব কথা থাক, আমি আপনাদের জিনিষগুলো ফেরৎ দিতে এসেছি। তারপর বালা দুগাছা ও হারটা এবং কাগজে মোড়া সোহানা বেগমের সাড়ি ও ব্লাউজ, যেগুলো পরে সেই ঝড় বৃষ্টির দিন লাইলী ঘরে ফিরেছিল, সেই প্যাকেটটা টেবিলের উপর রেখে দিলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, সেলিম এখন কেমন আছে? আহা ছেলেটা বড় ভালো। দোয়া করি, আল্লাহপাক তাকে শিগ্রি ভালো করে তুলুন।
জিনিষগুলো ফেরৎ দিতে দেখে সোহানা বেগমের মনে খচখচ করে বিধল। কিন্তু সেলিমের কথা জিজ্ঞেস করতে আবার রেগে গেলেন। বললেন, সে কেমন আছে অত খোঁজের আর দরকার কি? যান চলে যান। আর কখনও আসবেন না।
যাব বোন যাব, আমি তো থাকতে আসিনি। আর টাকার জন্যও আসিনি। আপনি অত রাগ করছেন কেন? আমরা গরিব হতে পারি, কিন্তু লোভী না। শুধু ছেলেটাকে দেখতে চেয়েছিলাম। ফিরে গেলে মেয়ে যখন জিজ্ঞেস করবে সেলিম সাহেবকে কেমন দেখলেন? তখন কি বলব? না দেখে মিথ্যা করে তো কিছু বলতে পারব না। আর জেনে রাখুন, আপনারা বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছেন বলে আমার তেমন দুঃখ হয়নি। কারণ আল্লাহপাক প্রত্যেক নারীকে তার স্বামীর বাম পাঁজর থেকে তৈরি করেছেন। আমরা যার সঙ্গে যার বিয়ে ঠিক করি না কেন, তিনি যার সংগে যার জোড়া তৈরি করে রেখেছেন, সেখানে হবেই। তাকে যখন আমরা বিশ্বাস করি, তখন আর এ নিয়ে দুঃখ করলে তাকে অমান্য করা হবে। শুধু মেয়েটার জন্য বড় চিন্তা হয়। সে এখনও এতটা জ্ঞান লাভ করেনি। মা আমার চিঠি পড়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল। যাক বোন, আল্লাহপাক তার বান্দাদের মঙ্গলের জন্য সবকিছু করেন। তাঁর কাজের উপর আমাদের অসন্তুষ্ট হওয়া উচিত নয়। যাওয়ার সময় একটা কথা বলে যাই, আপনি বোধ হয় কোথাও ভুল করেছেন। যার ফলে আমার নিস্পাপ মেয়ের উপর দুর্ণাম দিয়ে কথা বলেছেন। এখন আসি, অনেক কথা বললাম, অন্যায় কিছু হলে ক্ষমা করে দেবেন। আল্লাহ হাফেজ বলে রহমান সাহেব ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
সোহানা বেগম লাইলীর বাবার কথাগুলো শুনে ভাবলেন, লোকটাকে কত অপমান করলাম, অথচ সেসব গায়ে না মেখে অসীম ধৈর্যের সঙ্গে কত উপদেশ দিয়ে গেলেন। এরকম লোক কোনোদিন ঠকবাজ হতে পারেন না। কিন্তু যখন তার চিঠি ও ছেলের বিপদের কথা মনে পড়ল তখন রাগটা আবার জেগে উঠল।
রহমান সাহেব সেলিমদের বাড়ি থেকে ফিরে সেই যে বিছানা নিলেন, আর উঠলেন না। রাতে হার্টের ব্যাথাটা জোর করল। লাইলী ডাক্তার নিয়ে এল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। ভোরে যখন ফজরের আযান হচ্ছিল তখন মারা গেলেন। লাইলী বাপের পা দুটো জড়িয়ে ধরে পাথরের মত বসে রইল। খবর পেয়ে চাচা চাচি, পাড়া-পড়শী সবাই এল। রহিমা ও জলিল সাহেব রাত জেগে সেখানে ছিল। সবাই লাইলীকে ঐভাবে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে গেল। মেয়েরা বলাবলি করতে লাগল, লাইলীর কি শক্ত জানরে বাবা? বাবা মরে গেল অথচ মেয়ের চোখে এক ফোঁটা পানি নেই।
রহিমা কিন্তু বুঝতে পারল, লাইলী ভীষণ শক পেয়েছে। দু’দুটো দুঃখজনক ঘটনায় তার অন্তরটা ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। তাই কাঁদতে পারছে না।
সে লাইলীকে ধরে জোর করে নিজের ঘরে নিয়ে এলে লাইলী মন্ত্রচালিতের মত খাটে শুয়ে পড়ল। হামিদা বানু খুব কান্নাকাটি করছেন। রহিমা ফিরে এসে তাকে প্রবোধ দিতে লাগল। জলিল সাহেব খালুজানের দাফন করে যখন ফিরে এলেন তখন বেলা গড়িয়ে গেছে। লাইলীর চাচাদের বাড়ি থেকে ভাত এসেছিল। সাদেক ও ফিরোজকে খাইয়ে রহিমা স্বামীকে বলল, তুমিও একমুঠো খেয়ে নাও।
জলিল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, খালা আম্মা, লাইলী ওদেরকে খাইয়েছ?
না, খালা আম্মাতো কেঁদে কেঁদে পাগল। আর লাইলী সেই যে ঘুমিয়েছে এখনও উঠেনি।
জলিল সাহেব বললেন, সত্যি ওর জন্য খুব দুঃখ হয়। কি যে করবে মেয়েটা আল্লাহপাক জানেন। ওদেরকে খাওয়াবার চেষ্টা করে তুমিও কিছু খাও।
রহিমা অনেক চেষ্টা করেও হামিদা বানুকে খাওয়াতে পারল না। লাইলীকে তো ঘুম থেকে জাগাতেই পারল না। শেষে নিজে দু’মুঠো কোনো রকমে খেয়ে এসে স্বামীকে বলল, দেখ, খুব চিন্তার কথা, খালুজান মারা গেলেন, কিন্তু লাইলী একটুও কাদেনি। মনে হয় ওর কলিজা ফেটে গেছে, তাই কাঁদতে পারছে না।
জলিল সাহেব বললেন, ও এখন খুব ক্লান্ত। দু’দুটো শোক এক সঙ্গে পেয়েছে। তাই কাঁদতে পারছে না। ঘুম ভাঙলে যদি কান্নাকাটি করে তবে ভালো, নচেৎ ডাক্তার দেখাতে হবে। তা না হলে পাগল হয়ে যেতে পারে।
রাত্রেও লাইলী জাগল না। পরের দিন ভোরে উঠে ফজরের নামায পড়ে কোরআন শরীফ তেলাওয়াত করল। তারপর কেঁদে কেঁদে আর রুহের মাগফেরাতের জন্য আল্লাহপাকের দরবারে দোয়া করতে লাগল।
রহিমা ফজরের নামায পড়ে উপরে গিয়ে লাইলীকে কেঁদে কেঁদে দোয়া করতে দেখে নিশ্চিন্ত হল। নিচে এসে স্বামীকে সে কথা জানাল।
বাবার মৃত্যুর পর লাইলী আর হেসে কারও সঙ্গে কথা বলে না। সব সময় কি যেন চিন্তা করে।
জলিল সাহেব একমাসের মধ্যে তার বাবার সার্ভিসের টাকা তুলে এনে লাইলীর হাতে দিয়ে বললেন, খালুজানের কুলখানি তো করা দরকার।
লাইলী বলল, আমি পাঁচ খতম কোরআন শরীফ পড়ে তার রূহপাকের উপর বখশে দিয়েছি। লৌকিক প্রথা আমি মানি না। রাসুলুল্লাহ (দঃ) ও তাহার সাহাবীদের জামানায় ঐ প্রথা ছিল না। ওসব লোক দেখান। তবে এই টাকা থেকে আবার নামে কিছু মসজিদ ও মাদ্রাসায় দান করব। তাতে বরং আল্লাহপাক খুশি হয়ে আব্বাকে ক্ষমা করতে পারেন।
রহিমা ও হামিদা বানু সেখানে ছিল। অনেক দিন পর লাইলীকে এত কথা বলতে দেখে খুশি হল।
লাইলী আবার বলল, ভাইয়া, আমি ক’দিন থেকে চিন্তা করছি, মাকে নিয়ে দূরে কোথাও বেড়াতে যাব। তোমরা কিন্তু এখানে থাকবে।
জলিল সাহেব বললেন, বেশ তো যাবে।
দেখতে দেখতে ছয় মাস কেটে গেল। দান খয়রাত করার পর হাতে যা টাকা ছিল সব শেষ হয়ে গেছে। এখন শুধু ঘরের ভাড়া দিয়ে কোনো রকমে সংসার চলছে। লাইলী সাদেককে পড়ান বন্ধ করে দিয়েছে। ইলেট্রিক বিল, পানির বিল, গ্যাসের বিল ও পৌর ট্যাক্স অনেক বাকি পড়েছে।
এদিকে মনিরুল চিন্তা করল, সেলিম ভালো হয়ে গেলে জেনে যাবে, চিঠিটা কেউ শত্রুতা করে দিয়েছে। তখন সে লাইলীকে বিয়ে করবেই। তাই নাজমুলকে দিয়ে লাইলীদের সব খবর রাখছে। একদিন নাজমুলের সঙ্গে তাদের বাড়িতে গিয়ে তার বাবার সঙ্গে পরিচয় করার পর নাজমুলের বিয়ের কথা পাড়ল।
উনি বললেন, আমি তো বিয়ে দিতে চাই, কিন্তু ওতো ওর চাচাতো বোন লাইলীকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করতে চায় না। আপনি ওকে বোঝান তো বাবা?
মনিরুল বলল, লাইলীর সঙ্গে বিয়ে দেননি কেন?
আমি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলুম, ওরা না করে দিয়েছে।
মনিরুল বলল, সে তখন ওর বাবা বেঁচে ছিলেন। এখন আর একবার দিয়ে দেখুন। আমার মনে হয় রাজি হয়ে যাবে।
ঠিক আছে, আপনি যখন বলছেন তখন না হয় আর একবার বলেই দেখব। মনিরুল বলল, দেখব নয়, আজ এক্ষুণি যান। আমি ফলাফল শুনে যেতে চাই।
ছেলের মনিবকে এভাবে কথা বলতে দেখে নাজমুলের বাবা ভাবলেন, ছেলে হয়তো তাকে এই জন্যে ডেকে এনেছে। তিনি তখুনি লাইলীদের বাড়ি গিয়ে বড় ভাবির কাছে আবার বিয়ের প্রস্তাব দিলেন।
চাচাকে মায়ের সঙ্গে কথা বলতে দেখে লাইলী দরজার আড়ালে দাঁডল।
হামিদাবানু বললেন, লাইলীর আব্বা যে বিয়েতে অমত ছিলেন, এখন আমি তো সে কাজ করতে পারি না। তা ছাড়া মেয়ে আমার বড় হয়েছে। লেখাপড়া করেছে। তারও তো একটা মতামত আছে। আমি যে কি করব ভাই, ভেবে কিছু ঠিক করতে পারছি না।
লাইলী মায়ের বিচলিত অবস্থা দেখে ঘরের ভিতরে ঢুকে বলল, চাচাজান, আমার মন মেজাজ ভালো নেই। আমি এখন বিয়ে করব না। চাকরি করব চিন্তা করছি। আপনি নাজমূল ভাইয়ের বিয়ে অন্য কোথাও ঠিক করুন।
ভাইঝীকে মুখের উপর না করে দিতে দেখে নাজমুলের আরা খুব রেগে উঠে বললেন, বড় ভাই-এর এতিম মেয়েকে বেঁচে বউ করব বলে এসে ছিলাম। নিজেকে কি মনে কর তুমি? চিরকাল কুমারী থাকবে নাকি? আমার কথা মেনে নিলে ভালো করতে। আজকাল মেয়েরা লেখাপড়া করে একদম বেহায়া হয়ে যাচ্ছে। বাপ চাচাদের সামনে নিজের বিয়ের কথা বলতে লজ্জা বোধ করে না। যা খুশি কর, কিন্তু বংশের মুখে চুনকালি দিও না। এইতো একটা বড় লোকের ছেলেকে ফাসিয়ে ছিলে? কেন তারা বিয়ে ভেঙ্গে দিল? তারপর রাগে গর্জন করতে করতে চলে গেল।
ফিরে এসে নাজমুলের আ মনিরুলকে বললেন, মেয়ে তো নয়, যেন দাজ্জাল। সে এখন বিয়ে করবে না, চাকরি করবে। চাকরি যেন হাতের মোয়া। ইচ্ছে করলেই গালে পুরে দেবে। মেয়ের না হয় একটু রূপ আছে। তা বলে অত অহংকার ভালো নয়। আল্লাহ তাঁর রাসূলের (দঃ) অহংকার রাখেননি। আপনি একটা মেয়ে দেখে যদি ওকে বুঝিয়ে বিয়েটা দিয়ে দেন, তা হলে ওদেরকে দেখিয়ে দিতাম, আমার ছেলে অত ফেলনা নয়। উপযাজক হয়ে দু’বার গেছি। দু’বারই অপমান করে ফিরিয়ে দিয়েছে। বেঁচে থাকি তো দেখব, কোন রাজপুত্রের সঙ্গে ওর বিয়ে হয়।
মনিরুল চেষ্টা করব বলে ফিরে আসার সময় চিন্তা করল, যত সহজে কাজটা হবে ভেবেছিলাম তা হবে না। তবে সেলিমের সঙ্গে ওর বিয়েটা ভেঙ্গে দিয়েছি। নাজমুলের সঙ্গে লাইলীর বিয়ে হোক আর না হোক, তাতে কিছু আসে যায় না। সেলিম ভালো হয়ে কিছু করার আগে রেহানা যেন তাকে কবজা করে নেয়, সে কথা ওকে বলে দিতে হবে।