চার
আজ তিন দিন খুব ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। লাইলী ভার্সিটি যেতে পারেনি। দুপুরে শুয়ে হয়ে একটা বই পড়ছিল। রহিমা ভাবি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে পর্দা ফাঁক করে বলল, “মে আই কাম ইন সিস্টার?”
লাইলী না তাকিয়ে বলল, “নো, নট নাউ।”
রহিমা ভাবি ঢুকে পড়ে খাটে লাইলীর পাশে বসে বলল, কি ভাই, কিছু দিন যাবত আমাকে এড়িয়ে চলছ, জানি না কি অপরাধ করেছি। আমার সঙ্গে ভালো করে কথাও বলছ না। মনে হচ্ছে তোমার কিছু একটা হয়েছে।
লাইলী বলল, তোমাকে আসতে নিষেধ করলাম না।
কখন করলে ইংরেজীতে দুটো নো মানে হাঁ, তাই তোমার নো নট শুনে হ্যাঁ মনে করে চলে এলাম। আর নিষেধ করেছ তো কি হয়েছে? এখানে তো আর নন্দাই নেই যে, কোনো অশোভন দৃশ্য দেখতে পাব।
ভাবি ভালো হবে না বলছি বলে লাইলী উঠে বসে কিল দেখাল।
কিল দেখাও আর যাই দেখাও, কথাটা শুনতে খুব ভালো লাগল তাই না কথা শেষ করে পালাতে গেল।
লাইলী তার আঁচল ধরে বসিয়ে দিয়ে বলল, হঠাৎ এসময়ে কি মনে করে?
রহিমা আঁচলটা গায়ে জড়িয়ে বলল, ভয়ে ভয়ে বলব, না নির্ভয়ে বলব?
আজে বাজে কথা না হলে নির্ভয়ে বলতে পার।
এই বৃষ্টির দিনে ঘুম আসছিল না। ভাবলাম, ননদিনীর মনের খবর একটু নিয়ে আসি। সত্যি কথা বলতে কি, আমি যদি ছেলে হতাম, তবে যেমন করে হোক তোমাকে বিয়ে করতামই করতাম। আল্লাহপাক এতরূপ তোমাকে দিয়েছে কি বলব ভাই, আমি মেয়ে মানুষ হয়েও তোমাকে দেখে তৃপ্তি মিটে না। তোমার নাগর যে কি করবে ভেবে কুল পাইনে।
নিজের রূপের প্রশংসা শুনে লজ্জা পেয়ে লাইলী বলল, পুরুষ যখন আল্লাহ তোমাকে করেনি তখন আর আফশোস করে লাভ নেই। তারপর একটু রাগতস্বরে বলল, তুমি কি আর অন্য কথা খুজে পেলে না। যতসব বেহায়াপনা কথা। যাও, তোমার সঙ্গে আমি আর কোনো কথা বলব না বলে মুখ গোমড়া করে অন্য দিকে ঘুরে বসল।
রহিমা তার চিবুক ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, আহা দুঃখিনীর মান ভাঙ্গাবার কেউ নেই গো। এমনভাবে কথাটা বলল, দুজনেই জোরে হেসে উঠল। তারপর রহিমা জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা সখি, সেলিম সাহেবের খবর কি?
ভালো, উনি দিব্বি ক্লাস করছেন, তার প্রিয়তমাকে নিয়ে বলে জিব কেটে চুপ করে গেল।
কি হল থেমে গেলে কেন। সেলিম সাহেবের প্রিয়তমাকে তুমি চেন নাকি?
লাইলী লজ্জারাঙা চোখে বলল, আমি কি করে জানব তার প্রিয়তমা কে।
তুমি তো নিজেই বলতে গিয়ে চুপ করে গেলে। আর এদিকে তোমার ভাইয়া বলছিল, ওর একজন কলিগ ওকে একটা শিক্ষিতা, সুন্দরী ও পর্দানশীন খানদানি ঘরের মেয়ে দেখতে বলেছেন। কোনো দাবিদাবা নেই। ছেলেটা নাকি খুব ধার্মিক। শুনে আমার তো মনে হয়েছে তোমার সঙ্গে ভালো মানাবে। খালুজানের সঙ্গেও তোমার ভাইয়া ঐ ব্যাপারে কিছু কথাবার্তা বলেছে।
লাইলী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ভাবিকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
রহিমা এতটা আশা করেনি। বলল, আরে কর কি? কাঁদছ কেন? কি হয়েছে ব্যাপারটা খুলেই বল না। আমি তো তোমার শত্রু নই।
লাইলী তাকে ছেড়ে দিয়ে আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বলল, আমরা দুজনে দুজনকে ভালবেসে ফেলেছি। কিন্তু…
কিন্তু কি, বল না।
কিন্তু ওরা খুব বড়লোক। ওদের কাছে ধর্মের কোনো নাম গন্ধ নেই। তাই খুব ভয় হয়।
তুমি শিক্ষিতা মেয়ে। তার কাছে যা নেই তা দিয়ে ভরিয়ে দাও। আল্লাহ ও রাসূলের (দঃ) তাই-ই হুকুম। তোমার কাছে যে জ্ঞানের আলো আছে তা দান করে অন্যের অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর করে দাও। তা যদি পার, তা হলে তোমাদের দুজনের মধ্যে আর কোনো বাধা বা ভয় থাকবে না।
তুমি ঠিক বলেছ ভাবি, আমি তাই চেষ্টা করব, তুমি দোয়া কর।
রহিমা মৃদু হেসে বলল, তোমার জন্য সব কিছু করব নিশ্চয়, কিন্তু পুরস্কার দেবে তো? লাইলী ও মৃদু হেসে জবাব দিল, আগে কাজ পরে মজুরী, তারপর পুরষ্কার। আব দিল্লী বহুৎ দূর হ্যায়।
ঠিক আছে দিল্লী দূরে না কাছে সে দেখা যাবে, তোমার ভাইয়ার ফিরবার সময় হয়ে গেছে। এখন যাই বলে রহিমা নীচে চলে গেল।
লাইলী হাতের বইটা নিয়ে পড়ার চেষ্টা করল। কিন্তু লেখার পরিবর্তে মনের পর্দায় সেলিমের ছবি ভেসে উঠতে তন্ময় হয়ে তার কথা চিন্তা করতে লাগে।
রহিমা নিজের রুমে এসে লাইলীর কথা ভাবছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে জলিল সাহেব অফিস থেকে ফিরলেন। সালাম বিনিময়ের পর রহিমা স্বামীর জামা-কাপড় আলনায় রেখে লুংগী এগিয়ে দিয়ে বলল, তুমি হাত মুখ ধুয়ে নাও, আমি নাস্তা নিয়ে আসি। এদিকে সাদেক ও ফিরোজা ঘুম থেকে উঠে পড়ছে। সকলে মিলে আগে আসরের নামায পড়ল। সাদেক এই বয়স থেকেই নিয়মিত নামায পড়ে। চার বছরের মেয়ে ফিরোজাও মায়ের সঙ্গে শুরু করে দেয়।
নাস্তা খাওয়ার সময় রহিমা বলল, তুমি যে লাইলীর জন্য তোমার কলিগকে পছন্দ করেছ, এদিকে তোমার বোন তো আর একজনকে মন দিয়ে বসে আছে।
জলিল সাহেব স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে কথাটা বোঝার চেষ্টা করে সফল হতে পেরে বলল, ব্যাপারটা খুলে বল, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
এতে না বোঝার কি আছে? সেদিন সেলিম নামে যে ছেলেটাকে দাওয়াত করে খাওয়ানো হলো, সে তো লাইলীর জান ও ইজ্জৎ বাঁচিয়েছে। তার অনেক আগেও নাকি কি একটা ঘটনায় দুজন দুজনের প্রতি আকৃষ্ট হয়। শেষে ঐ দুঘর্টনার মাধ্যমে তা দৃঢ় হয়। এই তো কিছুক্ষণ আগে তার সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলছিলাম। আমার কাছে তোমার কলিগের কথা শুনে আমাকে সব খুলে বলেছে। স্বামীকে চুপ করে নাস্তা খেতে দেখে জিজ্ঞেস করল, কিছু বলছ না যে?
কি বলব বল? সবই তকদিরের খেলা। যার সঙ্গে যার জোড়া আল্লাহপাক রেখেছেন, তার সঙ্গে হবেই। সেখানে আমরা হস্তক্ষেপ করে শুধু হয়রানিই হব। যা ঘটবার ঘটবেই। তবে সেলিমদের সম্বন্ধে খোঁজ খবর নেওয়া দরকার। আজকাল বড়লোকের ছেলেদের চেনা বড় মুস্কিল।
রেইনী ভ্যাকেসানের জন্য ভার্সিটি দেড়মাস বন্ধ। একটানা কয়েকদিন বৃষ্টি হওয়ার পর আজ সকাল থেকে সোনালী রোদে চারদিক ঝলমল করছে। সোনালী রোদের সংগে লাইলীর মনটাও রঙিন হয়ে উঠল। পড়াশুনায় মন বসাতে পারল না। পনের দিন সেলিমকে দেখেনি। তার মনে হল যেন পনের বছর। কিছুক্ষণ মায়ের কাছে গিয়ে নাস্তা বানাল। তারপর নাস্তা খেয়ে রহিমা ভাবির ঘরে ঢুকল।
জলিল সাহেব একটু আগে অফিসে চলে গেছেন। রহিমা ফিরোজাকে সংগে করে নাস্তা খাচ্ছিল। সাদেক নাস্তা খেয়ে আর সংগে স্কুলে গেছে। লাইলীকে দেখতে পেয়ে বলল, আরে সাত সকালে ননদিনী পড়া ছেড়ে এসেছে দেখছি। এস এস, আমার সঙ্গে একটু নাস্তা খেয়ে নাও।
লাইলী বলল, তুমি খাও, আমি এক্ষুণি খেয়ে এলাম।
বলি ব্যাপার কি? মনের মানুষকে কয়েকদিন দেখতে পাওনি বলে মনটা বুঝি ছটপট করছে?
দেখ ভাবি, ভালো হবে না বলে দিচ্ছি। চোরের মনতো বোচকার দিকে থাকবেই।
আরে ভাই অত চটছো কেন? আমার তো আর ফাঁকা মন নেই যে, বোঁচকার দিকে থাকবে। এই কথা বলে তুমি নিজেই জানিয়ে দিচ্ছ, তোমার মন সেলিম সাহেবকে খুঁজছে।
সেলিমের নাম শুনে লাইলী চুপ হয়ে গেল।
ওমা, সেলিম সাহেবের নাম শুনে একেবারে চুপ করে গেলে যে? বলি ব্যাপারটা যদি গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছে থাকে, তা হলে বল, তোমার ভাইয়াকে বলে শুভশ্য শীঘ্রম করার ব্যবস্থা করি।
তুমি থামবে, না আমি চলে যেতে বাধ্য হব? পড়তে ভালো লাগছিল না বলে ওনার কাছে একটু গল্প করতে এলাম, আর উনি কিনা আমাকে তাড়াতে পারলেই বাঁচেন।
ঠিক আছে ভাই ঠিক আছে, আমারই ভুল হয়েছে। তোমাকে তাড়াতে যাব কেন? তুমি গল্প বল, আমি এই চুপ করলাম। তারপর নাস্তার পর্ব শেষ করে হাত-মুখ ধুয়ে এসে রহিমা একটা চেয়ার টেনে লাইলীর কাছে গম্ভীর হয়ে বসল।
লাইলী অভিমানভরা কণ্ঠে বলল, কেউ গোমড়া মুখ করে বাবার মত থাকলে তার সঙ্গে গল্প করা যায় বুঝি?
রহিমা হেসে ফেলে বলল, তুমি বড় ডেঞ্জারাস মেয়ে। কথা বললেও দোষ, আর না বললেও দোষ। কি করব তা হলে তুমিই বলে দাও।
লাইলী এই কথার উত্তর খুঁজে না পেয়ে চুপ করে বসে রইল। ঠিক এমন সময় কলিং বেলটা বিরতি নিয়ে দু’বার বেজে উঠল। কলিং বেল বাজাবার মধ্যেও যেন আভিজাত্য রয়েছে। প্রথমে দু’জনে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। তারপর লাইলী ওঠে গেট খোলার জন্য গেল। দরজার ছিদ্র দিয়ে সেলিমকে দেখে তার মনে আনন্দের শিহরণ খেলে গেল। দরজার এই ছিদ্রটা ভিতরের দিকে একখণ্ড কাঠ দিয়ে ঢাকা থাকে। যখন মেয়েদের গেট খুলতে হয় তখন প্রথমে তারা এই কাঠ সরিয়ে ছিদ্র দিয়ে আগন্তককে দেখে নেয়। সে যদি চেনা লোক হয়, তবে গেট খুলে দেয়, নচেৎ তাকে পরে আসতে বলে।
লাইলী কয়েক সেকেণ্ড দাঁড়িয়ে রইল, তারপর গায়ে মাথায় ভালো করে কাপড় দিয়ে গেট খুলে দিল।
সেলিম লাইলীকে দেখে তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।
লাইলী বলল, ভিতরে আসুন। কেমন আছেন? সেলিমের দিক থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে দরজার কড়া নেড়ে বলল, এই যে মশায় শুনছেন, এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। প্লীজ ভিতরে আসুন। লোকে দেখলে কি ভাববে বলুন তো? তা ছাড়া ভাবি জানালা দিয়ে সবকিছু দেখছে।
দরজার কড়া নাড়ার শব্দে সেলিম বাস্তবে ফিরে এল। লাইলীর কথাগুলো শুনে চুপচাপ তার সংগে ড্রইংরুমে এসে বসল।
সেলিমকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে লাইলী বলল, কি ব্যাপার? কোনো কথা বলছেন না কেন?
সেলিম বলল, কি আর বলব বল? তুমি যেভাবে আমার সবকিছু কেড়ে নিয়েছ, তাতে করে না এসে পারলাম না। এই কদিন কিভাবে যে কেটেছে তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। এভাবে এ সময়ে তোমাদের এখানে আসা ঠিক নয় জেনেও চলে এলাম। লোকনিন্দা আমাকে বাধা দিয়ে রাখতে পারে নি। আচ্ছা, তোমার মনে কি কোনো প্রতিক্রিয়া হয় নি?
লাইলী এতক্ষণ তার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়েছিল। দৃষ্টিটা নামিয়ে নিয়ে বলল, সে খবর আমার অন্তর্যামী জানেন। আপনি বসুন, আমি এক্ষুনি আসছি। তারপর দরজার বাইরে এসে রহিমা ভাবিকে দেখে লজ্জা পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
সে তারই অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে দুজনের কথা শুনছিল। বলল, কথায় বলে, যে যাকে ধায় তাকে সে পায়। কথাটা এতদিন শুনে এসেছি, আজ প্রত্যক্ষ করলাম। তা। যাচ্ছ কোথায়? কি দিয়ে আপ্যায়ন করাবে শুনি?
লাইলী প্রথমে লজ্জায় কথা বলতে পারল না। তারপর বলল, তুমিই বল না ভাবি।
বারে তোমার প্রিয়তমকে কি খাওয়াবে, সে কথা আমি কি করে বলব? বাজারে যাওয়ার তো কোনো লোক নেই। তোমার স্টকে যদি কিছু না থাকে, তবে আমার কাছ থেকে ধার নিতে পার।
তার দরকার নেই বলে লাইলী উপরে মায়ের কাছে গিয়ে বলল, জান আম্মা, ভার্সিটির সেই ছেলেটা এসেছে।
হামিদা বানু বললেন, কোথায় বসিয়েছিস তাকে?
নিচে ড্রইংরুমে, তুমি একটু চা কর না আম্মা।
হ্যাঁরে, অত বড়লোকের ছেলেকে শুধু চা দিবি?
আমরাতো আর বড়লোক নই, গরিব জেনেই এসেছেন। একটা ডিম সিদ্ধ করে আলমারী থেকে কয়েকটা বিস্কুট প্লেটে নিয়ে চায়ের কাপসহ এসে ঘরে ঢুকল। সেগুলো টেবিলের উপর রেখে একগ্লাস পানি নিয়ে এসে বলল, অনেকক্ষণ একা একা বসিয়ে রাখলাম, সে জন্য ক্ষমা চাইছি।
সেলিম বলল, এসবের কিছু দরকার ছিল না। তুমি তো আমার কথা না শুনে চলে গেলে। একটা কথা বলব, শুনবে? আমার সঙ্গে একটু বাইরে যাবে?
লাইলী কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বলল, আগে এগুলো খেয়ে নিন।
তোমার চা কোথায়?
আমি একটু আগে খেয়েছি।
সেলিম ডিমটা খেয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, আমার কথার উত্তর দিলে না যে?
আপনার সাথে যাব, সে তো আমার পরম সৌভাগ্য। কিন্তু বলে লাইলী চুপ করে মেঝের দিকে চেয়ে রইল।
কিন্তু আবার কি? তোমার কোনো কিন্তু আমি শুনব না।
দেখুন, আপনার সঙ্গে যেতে আমি মনেপ্রাণে চাই। কিন্তু আল্লাহপাক যুবক যুবতীকে এভাবে যেতে নিষেধ করেছেন। রাসূল (দঃ) পবিত্র হাদিসে বলেছেন-”যদি কোনো লোক কোনো স্ত্রীলোকের সহিত নির্জনে থাকে, তাহাদের মধ্যে তৃতীয়জন থাকে শয়তান।1” আল্লাহপাক সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। তাঁর সৃষ্টির মধ্যে মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ। অতএব সেই সৃষ্টির সেরা মানুষের উচিত সষ্টার হুকুম মেনে চলা।
সেলিম লাইলীর মুখের দিয়ে চেয়ে তার কথাগুলো হৃদয়ঙ্গম করে বলল, তোমার কথা হয়তো ঠিক; কিন্তু আমরা ছেলে মানুষ। একটু আধটু অন্যায় করলে তা তিনি নিজ গুণে ক্ষমা করে দেবেন। শুনেছি, তিনি অসীম ক্ষমাশীল ও করুণাময়। বাবা-মা
সেই গুণের কিঞ্চিতের বঞ্চিত পেয়ে তাদের ছেলেমেয়েদের কত রকম অন্যায় ক্ষমা করে দেয়।
আপনি ঠিক বলেছেন, কিন্তু ছেলেমেয়েরা বড় ও শিক্ষিত হয়ে যদি পিতা-মাতার আদেশ অমান্য করে তখন তো ক্ষমার কোনো প্রশ্নই উঠে না। আর ওঁরা ক্ষমা করলেও নিজেদের বিবেকের কাছে চিরকাল অপরাধী হয়ে থাকে। এখন আপনিই বলুন, আমরা শিশু, না শিক্ষিত যুবক-যুবতী? আমরা জ্ঞানী হয়ে যদি অন্যায় করি, তবে কী তিনি বিনা শাস্তিতে তা ক্ষমা করবেন?
সেলিম বলল, তোমাকে নিয়ে বেড়াতে গেলে আল্লাহ যত শাস্তি দেন না কেন, তাতে আমার কোন আপত্তি নেই।
লাইলী বলল, শাস্তি অবশ্য দুজনেরই হবে। আমার হয় হোক কিন্তু আমার জন্য আপনি পাবেন, তা আমি হতে দিতে পারি না।
আচ্ছা, তোমরা কি কোনো কাজ আল্লাহ ও রাসূলের হুকুমের বাইরে কর না?
আল্লাহপাকের প্রিয় বান্দারা তা করে থাকেন। আমরা তাদের পায়ের ধুলোর মোগ্যও নই। তবে যতটা পারি মেনে চলার চেষ্টা করি।
তোমার কাছ থেকে আজ অনেক জ্ঞান পেলাম। আমাদের সোসাইটির অনেক মেয়ের সঙ্গে বেড়িয়েছি। সত্যি বলতে কি, তাদের সঙ্গে বেড়িয়ে মনে শান্তি পাইনি। কোথায় যেন খচ খচ করে বিঁধতে। তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে মনের সেই খচখচানিটা আর নেই। মনের ভিতর থেকে কে যেন বলে এই সেই মেয়ে, যাকে তুমি খুঁজে বেড়াচ্ছ। তোমার সংগে বেড়িয়ে যে আনন্দ পেতাম, এখন মনে হচ্ছে তার থেকে অনেক বেশি শান্তি পেলাম। পড়তে ভালো লাগছিল না। তোমার কথা মনে হতে ভাবলাম, তোমাকে নিয়ে একটু বেড়ালে মনটা ফ্রেশ হয়ে যাবে। তাই এসেছি। তোমারও তো সামনে পরীক্ষা। অনেক সময় নষ্ট করলাম এখন চলি তা হলে।
সেলিম চলে যেতে উদ্যত হলে লাইলী বলল, যাবেন না, বসুন। আমার যতই পড়ার ক্ষতি হোক, আমি কিছু মনে করব না। আপনি তাড়াতাড়ি চলে গেলে বরং আমি মনে খুব কষ্ট পাব। আর পড়াশুনাও একদম করতে পারব না। আর একটু অপেক্ষা করুন। আমি এক্ষুণি আসছি বলে সে ঘর থেকে বেরিয়ে ভাবির ঘরে গেল।
রহিমা বলল, তোমাকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারছি না। তুমি যে কি করে সেলিম সাহেবের আমন্ত্রণ ডিনাই করতে পারলে ভেবে পাচ্ছি না? আমি হলে তা বর্তে যেতাম। কি চিন্তা করলে? যাবে নাকি?
তুমিই বল না ভাবি? আমার মাথায় তো কিছুই আসছে না।
ওমা, আমি কি বলব? তুমি আমার চেয়ে কত জ্ঞানী? তবে আমার মতে, যার মধ্যে সবকিছু বিলীন করে দিয়েছ এবং যাকে স্বামী বলে মনে প্রাণে মেনে নিয়েছ, তার সন্তুষ্টির জন্য একটু বেড়াতে গেলে পাপ হবে না। আর যদি তা হয়, আল্লাহপাকের কাছে ক্ষমা চাইলে নিশ্চয় ক্ষমা করে দেবেন।
লাইলী আর কিছু না বলে নিজের রুমে গিয়ে একটা নীল রং-এর শাড়ী ও ব্লাউজের উপর বোরখা পরল। তারপর মায়ের কাছে গিয়ে বলল, আমি একটু বাইরে যাচ্ছি।
হামিদা বানু মেয়ের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, সেলিম চলে গেছে?
আমি তো তারই সঙ্গে যাচ্ছি।
হামিদা বানু অবাক হয়ে রাগের সঙ্গে বললেন, তাড়াতাড়ি ফিরে আসবি।
লাইলী নীচে এসে সেলিমকে বলল, চলুন।
সেলিম প্রথমে বেশ অবাক হলেও পরক্ষণে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে তার সঙ্গে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠল। ষ্টার্ট দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবে?
আপনি যেখানে নিয়ে যাবেন?
তুমি কিন্তু এখনও আপনি করেই বলছ। সেদিনের কথা নিশ্চয় মনে আছে, আমাকে আগে যেতে বলে তুমি পিছু নেবে বলেছিলে?
মনে ঠিক আছে তবে কি জানেন……
সেলিম তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে আবার বলে তার ডান হাতটা ধরে তালুতে চুমো খেয়ে বলল, এরপর থেকে যদি ঐভাবে কথা বল, তা হলে আমি মনে কষ্ট পাব।
লাইলী কেঁপে উঠল। তারপর হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে চুমো খাওয়া হাতটা নিজের ঠোঁটে চেপে ধরল।
সেলিম আড়চোখে তা লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করল, কি কথা বলছ না কেন?
এবার থেকে চেষ্টা করব।
আর একটা কথা, তুমি যতক্ষণ আমার সঙ্গে থাকবে ততক্ষণ মুখটা খোলা রাখবে।
লাইলী মুখের নেকাবটা সরিয়ে রাস্তার দিকে চেয়ে রইল।
বেশ কিছুক্ষণ শহরের নানান রাস্তা ঘুরে একটা হোটেলের সামনে গাড়ি পার্ক করে সেলিম বলল, খিদে পেয়েছে কিছু খাওয়া যাক চল। ভিতরে নিয়ে গিয়ে কেবিনে বসে জিজ্ঞেস করল, কি খেতে মন চাচ্ছে বল?
আমি এখন কিছু খাব না, তুমি খাও।
তোমাকে কিছু খেতেই হবে বলে বেয়ারাকে ডেকে লুচি, মুরগীর মাংস ও মিষ্টির অর্ডার দিল। শেষে দুটো কোক খেয়ে গাড়িতে উঠে সেলিম বলল, আমাদের বাড়িতে যাবে? মা তোমার কথা প্রায়ই জিজ্ঞেস করে।
লাইলী বলল, চল, খালা আম্মার সঙ্গে দেখা করে আসব।
যদি বলি আর আসতে দেব না, চিরদিন বন্দী করে রাখব।
লাইলী লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে বলল, তোমার বিবেক যদি তাই বলে, তা হলে আমার আপত্তি নেই।
সেলিম তাদের বাড়িতে এসে গাড়ি থামাতে লাইলী বলল, কাদের বাড়িতে নিয়ে এলে?
কেন ভয় লাগছে বুঝি? বাড়িটা চিনতে পারলে না? ভিতরে চল, বাড়ির লোকদের নিশ্চয় চিনতে পারবে?
রুবীনা হলরুমে বসে দুজন বান্ধবীর সঙ্গে গল্প করছিল। এই হলরুমটাই ড্রইংরুম। এখান থেকে ভিতরে যাওয়ার রাস্তা। দাদার সাথে লাইলীকে দেখে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছেন?
লাইলী সালাম দিয়ে বলল, ভালো আছি।
সেলিম রুবীনাকে জিজ্ঞেস করল, হারে মা কোথায়?
মা উপরে আছে বলে লাইলীর হাত ধরে পাশে বসিয়ে বলল, আমার বান্ধবী জেসমীন ও সামসুন্নাহার। আর ওদের বলল, ইনি লাইলী, ভার্সিটিতে পড়ে।
সেলিম বলল, তোমরা গল্প কর আমি আসছি।
সোহানা বেগম নিচে আসছিলেন। ছেলের গলার আওয়াজ পেয়ে সেখানে এসে বললেন, সেই সকালে যে নাস্তা না খেয়ে বেরিয়ে গেলি, খিদে পাইনি? তারপর লাইলীকে দেখতে পেয়ে বললেন, মা মণিকে কোথা থেকে ধরে আনলি রে?
লাইলী উঠে গিয়ে সোহানা বেগমকে কদমবুসি করে বলল, কেমন আছেন খালা আম্মা?
সোহানা বেগম মাথায় চুমো খেয়ে বললেন, বেঁচে থাক মা, ভালো আছি। তোমার বাবা মা ভালো আছেন।
জ্বি ভালো আছেন।
সেলিম তা হলে তোমাদের বাসায় গিয়েছিল?
লাইলী মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
সেলিম বলল, জান মা, আমি ওদের বাড়িতে গিয়ে যখন বললাম, চল একটু বেড়াতে যাই তখন কত হাদিস কালাম শুনিয়ে দিল। শেষে কি জানি কি মনে করে আবার চলে এল।
সোহানা বেগম লাইলীকে বললেন, তুমি এখন আর যেতে পারবে না। আজ রুবীনার জন্মদিন পালন করা হবে। ওর অনেক বন্ধু-বান্ধবী ও আত্মীয়-স্বজন আসবে, একেবারে রাত্রে খাওয়া-দাওয়া সেরে যাবে। আমি ড্রাইভারকে দিয়ে তোমাদের বাসায় খবর পাঠিয়ে দিচ্ছি।
রুবীনা সেলিমের কাছে এসে তার হাতে একটা লিষ্ট দিয়ে বলল, এগুলো তাড়াতাড়ি কিনে আন।
এক্ষুণি যাচ্ছি বলে সেলিম গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল। সোহানা বেগম লাইলীকে ঘরে নিয়ে এসে বোরখা খুলে ফেলতে বললেন।
আয়াকে নাস্তার অর্ডার দিতে শুনে লাইলী বলল, আমি এক্ষুণি খেয়ে এসেছি, কিছু খেতে পারব না।
সোহানা বেগম বললেন, তা হোক, তবু দুটো মিষ্টি খাও।
নাস্তা খেয়ে লাইলী রুবীনাদের কাছে এসে বসল। ততক্ষণ আরও দুতিনজন তার সমবয়সী মেয়ে এসেছে। তারা সব বড়লোকের সুন্দরী মেয়ে। কিন্তু লাইলীর রুপ তাদেরকে ম্লান করে দিল।
এমন সময় রেহানা এসে রুবীনার পাশে সাধারণ পোশাকে লাইলীকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কে রে রুবীনা?
রুবীনা বলল, ইনি লাইলী, ভার্সিটির ছাত্রী। দাদার সঙ্গে এসেছে।
রেহানা এবার লাইলীকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কিসে পড়েন?
ইসলামিক হিষ্ট্ৰীতে অনার্স।
রেহানা কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে থেকে দৃষ্টিটা ফিরিয়ে নিয়ে রুবীনাকে বলল, তোর দাদা কোথায়?
এইতো কয়েক মিনিট আগে মার্কেটে গেল, তোমার সঙ্গে রাস্তায় দেখা হয়নি? কোনো কিছু না বলে রেহানা ফিরে চলে গেল।
বিকেলে রুবীনার ও সেলিমের অনেক বন্ধু ও বান্ধবী এল। যখন সবাই মিলে চা খাচ্ছিল তখন রেহানা তার বান্ধবী সালমাকে সঙ্গে করে নিয়ে এল। সালমাকে সেলিম চিনে। ভার্সিটিতে একদিন বেঁচে তার সঙ্গে আলাপ করতে এসে সুবিধে করতে না পেরে আর মিশবার চেষ্টা করেনি। তাকে আজ রেহানার সংগে দেখে সেলিম জিজ্ঞেস করল, কেমন আছেন?
ভালো আছি বলে সালমা চুপ করে রইল। সেও বড়লোকের মেয়ে।
রেহানা চা খেতে খেতে সেলিমকে বলল, সালমাকে নিয়ে আজ আমি তোমার সঙ্গে ব্যাডমিণ্টন খেলব, দেখি হারাতে পারি কি না? সালমা খুব ভালো খেলে। যারা এসেছে তারা সবাই বড়লোকের ছেলেমেয়ে। মেয়েরা কেউ সালওয়ার কামিজ, কেউ শাড়ী, আবার কেউ ফুলপ্যাণ্টের উপর পাঞ্জাবী পরে এসেছে। তাদের পায়ে ডিস্কো ও পেন্সিল হীল জুতো। সেলিম মৃদু হেসে বন্ধু রেজাউলকে জুটি করে খেলতে নামল।
রেহানা স্যাণ্ডো ব্লাউজ ও শাড়ী পরেছে। সে শাড়ীটা ভালভাবে সেঁটে নিল। আর সালমা টাইটফিট সালওয়ার কামিজ পরেছে। সরু ওড়নাটা বুকের মাঝখান দিয়ে এঁটে পিছনের দিকে বেঁধে নিল। তাদের ভরাট যৌবন পুষ্ট শরীর খেলার ছন্দে উত্তাল তরঙ্গের মত ঢেউ খেলতে লাগল। ছেলেদের মধ্যে অনেকে খেলা দেখা বাদ দিয়ে তাদের দুজনের যৌবনের উত্তাল তরঙ্গ দেখতে লাগল।
এতক্ষণ লাইলী ঘরের ভিতরে সোহানা বেগমের কাছে ছিল। খেলা শুরু হতে তিনি বললেন, যাও না, ওদের খেলা দেখ গিয়ে।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও লাইলী এক পা দু’পা করে বারান্দায় গিয়ে দুটি মেয়েকে দুটো ছেলের ঐভাবে খেলতে দেখে লজ্জা পেয়ে সরে এসে একটা চেয়ারে বসে রইল।
রেহানা ও সালমা দুজনেই পটু। তার উপর আজ প্রতিজ্ঞা করে নেমেছে, সেলিমকে হারাবেই। সেলিম অপটু রেজাউলকে নিয়ে ওদের বিরুদ্ধে খেলতে হীমসীম খেয়ে যাচ্ছে। হার্ড কনটেণ্ট হওয়ার পর শেষ পর্যন্ত সেলিমরা তিন পয়েণ্ট জিতে গেল। তারা সকলে খুব ক্লান্ত হয়ে বারান্দায় ফ্যানের নিচে বিশ্রাম নিতে এসে লাইলীকে দেখে অবাক হয়ে গেল। যারা তাকে এর আগে দেখেনি তারা তাকে অস্পরী মনে করে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রইল। সামসুনের সঙ্গে লাইলীর ওবেলা পরিচয় হয়েছিল। সে তার কাছে এসে বলল, চলুন আমরাও একটু খেলে আসি।
লাইলী বলল, মাপ করবেন, আমি ওসব খেলা জানি না।
কথাটা সেলিম, রেহানা ও অন্য সবাই শুনতে পেল। একমাত্র লাইলী সাদামাঠা পোশাক পরে শালীনতা বজায় রেখেছে। তাকে এই পোশাকে এদের সকলের চেয়ে সুন্দরী দেখাচ্ছে। সব ছেলে মেয়ে তার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখছিল। লাইলীর ওসব খেলা জানি না কথাটা শুনতে পেয়ে সকলে তার দিকে সরাসরি তাকাল।
রেহানা প্রথম থেকে লাইলীর রূপ দেখে হিংসায় জ্বলছিল। তার উপর সেলিমের সঙ্গে ওবেলা এসে এতক্ষণ ঘরেই ছিল বুঝতে পেরে মনে মনে ইর্ষায় ও রাগে গুমরাচ্ছিল। তাকে দেখার আগে পর্যন্ত রেহানার ধারণা ছিল, তার মত সুন্দরী তাদের সোসাইটিতে কেউ নেই। এতদিন সে মনে করত সেলিম তাকে ভালোবাসে, কিন্তু আজ লাইলীকে দেখে তার ধারণা মিথ্যা বলে মনে হল। কেন কি জানি তার ভিতর থেকে কে যেন বলল, এর কাছে তুমি হেরে যাবে। হিংসার বশবর্তী হয়ে তার কথায় খেই ধরে বিদ্রুপ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, তা হলে কি খেলা আপনি জানেন?
লাইলী কয়েক সেকেণ্ড রেহানার দিকে চেয়ে থেকে বলল, আমি কি খেলা জানি
জানি, তা আপনাদের জানা দরকার আছে বলে মনে করি না। তবে আমার মনে হয়, ঐ রকম বিদেশী খেলা আমাদের দেশের মেয়েদের কোনো প্রয়োজন নেই।
সালমা তাড়াতাড়ি কটাক্ষ করে বলে উঠল, তা হলে স্বদেশী কি খেলা আমাদের খেলা উচিত বলে দিলে বাধিত হব।
লাইলী বলল, দেখুন, আমি আপনাদের সমাজের মেয়ে নই। আপনারা কি খেলবেন না খেলবেন, সে বিষয়ে আমি উপদেশ দিতেও আসিনি এবং সে সব সম্বন্ধে আমার কোন জ্ঞানও নেই। আপনাদের একজন আমাকে খেলতে ডেকেছেন। তার উত্তরে আমি শুধু বলেছি ওসব খেলতে জানি না। এর মধ্যে যদি আপনারা জেলাস মনোভাব নিয়ে আমাকে আক্রমণ করেন, তা হলে আমি অপরাগ। কারণ আপনাদের সকলের যুক্তির কাছে আমি একা নিরূপায়? তবে আমার মনে হয়, বড় ছেলে মেয়েরা এক সঙ্গে খেলাধুলা না করে আলাদাভাবে অর্থাৎ ছেলেরা ছেলেদের সঙ্গে আর মেয়েরা মেয়েদের সঙ্গে খেললে, খেলাধুলার উদ্দেশ্য নিশ্চয় নষ্ট হবে না।
লাইলীর কথা শুনে কেউ কোনো উত্তর দিতে না পেরে চুপ করে গেল।
সেমীনা ও রোজীনা টেবিল টেনিস খেলা শেষ করে এসে লাইলীর কথা শুনছিল। সেমিনা নীরবতা ভঙ্গ করে বলে উঠল, তা হলে আপনি ছেলেদের সঙ্গে ভার্সিটিতে পড়ছেন কেন?
লাইলী স্মীত হাস্যে তার দিকে চেয়ে বলল, নিরূপায় হয়ে। যদি আমাদের দেশে মেয়েদের জন্য আলাদা ইউনিভার্সিটি থাকতো, তা হলে আমি কো-এডুকেশনে পড়তাম না।
এবার রেহানা জিজ্ঞেস করল, তা না হয় হল, কিন্তু আপনি গার্ল ফ্রেণ্ডের সঙ্গে না বেড়িয়ে বয় ফ্রেণ্ডের সঙ্গে বেড়ান কেন?
খোঁটাটা লাইলী ভালভাবে অনুভব করল। কোনো রকম দ্বিরুক্তি না করে জওয়াব দিল, আমার কোনো বয় ফ্রেণ্ড নেই। আর আমি কোনদিন কোন ছেলের সঙ্গে ঘুরেও বেড়ায়নি?
রেহানা একটু রাগের সঙ্গে আবার জিজ্ঞেস করল, সেদিন সেলিম ভাই-এর সঙ্গে গাড়িতে করে তা হলে কোথায় গিয়েছিলেন? আর আজই বা তার সঙ্গে এ বাড়িতে এসেছেন কেন? সেই জন্য লোকে বলে, কেউ নিজের দোষ নিজে দেখতে পায় না, শুধু অপরের দোষ দেখতে পায়।
এই কথায় সেলিম ও সোহানা বেগম ছাড়া সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
সোহানা বেগম রহিমের হাতে চা-নাস্তা দিয়ে সঙ্গে এসে তাদের কথা শুনছিলেন। ব্যাপারটা ক্রমশঃ ঝগড়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেখে বললেন, তোমাদের একি ব্যাপার বলতো? একটা মেয়ে অতিথি হয়ে এ বাড়িতে এসেছে। তাকে তোমরা যা তা প্রশ্ন করে বিব্রত করে তুলছে। তা ছাড়া কারও ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে সবাইর সামনে এভাবে প্রশ্ন করা খুবই অন্যায়। এখন ওসব কথা বাদ দিয়ে কে কি খাবে নাও। এরপর কেউ আর কোনো কথা বলতে সাহস করল না। চুপ চাপ কেউ কোকো কোলা, কেউ চা পান করতে লাগল।
সেলিম এতক্ষণ কোনো কথা বলেনি। সবাইকে বোকা বানাবার জন্য বলল, মা, তুমি কিছু বলল না, আমি লাইলীকে রেহানার শেষ প্রশ্নের উত্তরটা দিতে অনুরোধ করছি।
লাইলী কয়েক মুহূর্ত মাথা নিচু করে রইল, তারপর সেলিমের দিকে একবার চেয়ে নিয়ে বলল, একবার আমি ভীষণ বিপদে পড়েছিলাম। সেই সময় সেলিম সাহেব ও তার মা আমাকে সেই বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। যদি ওঁরা সেদিন আমাকে ঐ বিপদ থেকে উদ্ধার না করতেন, তা হলে আমি আর ইহজগতে কারও কাছে মুখ দেখাতে না পেরে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হতাম। সেই লোক যদি আমাকে কোথায় নিয়ে গিয়ে থাকে এবং এখানে এনে থাকেন, তা হলে কি করে আমি বাধা দিতে পারি বলুন? অত অকৃতজ্ঞ হতে বিবেকে বেধেছে। ওঁকেই জিজ্ঞেস করে দেখুন, প্রথমে আমি যেতে এবং আসতে চাইনি। পরে বিবেকের অনুশোচনায় আসতে বাধ্য হয়েছি। এখন আপনারই আমার বিচার করুন। অন্যায় করে থাকলে যে শাস্তি দেবেন মাথা পেতে নেব। কথা শেষ করে লাইলী মাথা নিচু করে বসে রইল। এমন সময় মাগরিবের আযান শুনতে পেয়ে লাইলী উঠে দাঁড়িয়ে বলল, মাপ করবেন, আমি নামায পড়ব। লাইলীর কথা শুনে সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। আর লাইলী অযু করার জন্য বাথরুমের দিকে চলে গেল।
সামসুন বলল, মেয়েটা একদম সেকেলে। চল, সবাইকে তো আবার আসতে হবে।
বেয়ারা রহিম বলে উঠল, আপনারা যাই বলুন, আপামনি কিন্তু বড় খাঁটি কথা বলেছেন।
সোহানা বেগম ধমকে উঠলেন, নে হয়েছে, তোকে আর লেকচার দিতে হবে না।
মাগরিবের নামায পড়ে লাইলী সোহানা বেগমের কাছে গিয়ে বলল, খালাআম্মা, ড্রাইভারকে দিয়ে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিন।
সোহানা বেগম বললেন, কেন মা, তোমার কী কোন অসুবিধে হচ্ছে? তোমাকে তো বলেছি, আজ সন্ধ্যার পর রুবীনার বার্থডে উৎসব হবে। ওর অনেক বন্ধু-বান্ধবী আসবে, তুমি ওদের সঙ্গে একটু আনন্দ করবে না?
লাইলী বলল, আমি অন্য সমাজের মেয়ে। আপনাদের এখানে যারা আসবেন, তারা হয়তো আমাকে পছন্দ করবেন না। তাই ভয় হচ্ছে, আমার জন্যে আপনারা অপমানিত হতে পারেন।
পাগলী মেয়ে, ওসব আজেবাজে চিন্তা করো না। কে কি ভাববে অত চিন্তার কি আছে? আর তোমার জন্য আমরাই বা অপমান হতে যাব কেন? তা ছাড়া হঠাৎ যদি তেমন কিছু ঘটেও যায়, তা হলে তুমি তোমার জ্ঞানের দ্বারা তা কভার দিতে পারবে বলে আমি মনে করি। ঐসব চিন্তা বাদ দিয়ে তুমি রুবীনার কাছে যাও মা।
রুবীনা ছোট বলে মা ও ভাই এর খুব আদর পায়। সে খুব আলট্টা মর্ডান। সব সময় নিত্য নূতন পোশাক পরে নিজেকে বড়লোকের সুন্দরী মেয়ে বলে জাহির করে এবং রূপের আগুনে ছেলেদের আকর্ষণ করে বেড়ানকে গর্ব বলে মনে করে। ছাত্রী হিসাবে মোটামুটি ভালো। তবে রূপ চর্চার চেয়ে যদি পড়াশোনায় মন দিত, তা হলে অনেক ভালো রেজাল্ট করতে পারত। তবু এখনও তরুণীর শেষ পর্যায়ে অর্থাৎ যৌবন ছুঁইছুঁই করছে। সব সময় স্কুলের ও পাড়ার দু’ একজন বয়ফ্রেণ্ডের সঙ্গে সময় কাটায়। তাদের মধ্যে করিম নামে বড়লোকের একটা ছেলের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করতে শুরু করেছে।
অবশ্য এই ব্যাপারটা তার মা অথবা ভাই কেউ জানে না।
রুবীনা প্রথম থেকে লাইলীকে ভালো চোখে দেখতে পারেনি। সেটা লাইলী কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে। তাই সোহানা বেগম যখন লাইলীকে তার কাছে যেতে বললেন তখন তার মন তাতে সায় দিল না। সে ধীরে ধীরে বাইরে এসে ফুল বাগানের দিকে বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে বিকেলের কথাগুলো ভাবতে লাগল।
এর মধ্যে দু’একজন করে আসতে শুরু করেছে। অনেকের বাবা-মা ও আসছেন। রুবীনা ছেলে মেয়েদের আর সেলিম বড়দের অভ্যর্থনা করতে লাগল। রাত্রি আটটায়ে কেক কাটা দিয়ে উৎসব শুরু হল। নাস্তার পর চা, কফি, কোকো, ফাণ্টা ও সেভেন আপ যার যার ইচ্ছামত পরিবেশন করা হল। অনেকে রুবীনাকে কিছু গাইবার জন্য অনুরোধ করল। সে একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত ও একটা আধুনিক গান গাইল। তার গান শুনে সকলে খুশি হয়ে হাততালি দিল। হঠাৎ রেহানা দাঁড়িয়ে বলল, এবার সেলিম ভাই আপনাদের একটা গান শুনাবে। তারপর লাইলীকে গাওয়ার জন্য সকলের তরফ থেকে আমি প্রস্তাব দিচ্ছি।
কথাটা শুনে লাইলী চমকে উঠল। জীবনে সে কোনোদিন গান বাজনা করে নি। এখন সে কি করবে ভাবতে লাগল।
সেলিম একটা আধুনিক গান গাইল। তার গলা খুব ভালো। সেলিমের গান শুনে সকলে মোহিত হয়ে গেল। লাইলী চিন্তার মধ্যে থাকলেও সেলিমের গলা শুনে খুব আশ্চর্য হল। সেলিম এত ভালো গান গাইতে পারে এটা যেন তার কল্পনার বাইরে। হাত তালিতে ঘর গম গম করে উঠল। এখন লাইলী আবার চিন্তিত হয়ে পড়ল।
সেলিম লাইলীর সব কিছু লক্ষ্য করছিল। হাত তালি থামিয়ে দিয়ে সে বলল, এবার রেহানা আমাদের পিয়ানো বাজিয়ে শোনাবে।
সালমা বলে উঠল, কিন্তু এবার তো লাইলীবানুর পালা।
সেলিম বলল, ঠিক আছে, রেহানা আগে পিয়ানো বাজিয়ে শোনাক।
রেহানা অনেক কষ্টে রাগটা সামলে নিয়ে নিজেকে সংযত করে পিয়ানো বাজাল। অদ্ভুত সে বাজনা। তার পিয়ানো বাজনা শুনে সকলে স্তব্ধ হয়ে গেল। লাইলীর মনে হল, সেলিমের গলার থেকে বাজনাটা আরো অনেক শ্রুতিমধুর। সে মনে মনে রেহানাকে ধন্যবাদ জানাল। রেহানা পিয়ানো বাজিয়ে সকলের অকুণ্ঠ প্রশংসা কুড়াল। শেষে রেহানা লাইলীর কাছে গিয়ে তার হাত ধরে দাঁড় করিয়ে সকলের দিকে চেয়ে বলল, এনাকে আপনারা অনেকে চেনেন না। ইনি আমাদের কাছে আজ নূতন অতিথি। ইসলামিক হিষ্টির অনার্সের ছাত্রী। আশা করি, কিছু শুনিয়ে আমাদের সকলকে আনন্দ দান করবেন। রেহানা কথা শেষ করে চেয়ারে গিয়ে বসে ভাবল, মনের মত অপমান করার সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছি।
এদিকে লাইলী লজ্জায় ও অপমানে ঘামতে শুরু করল। আল্লাহপাকের কাছে মনে মনে সাহায্য চাইতে লাগল। কিছুক্ষণ মেঝের দিকে চেয়ে থেকে নিজেকে সামলে নিল। সে শাড়ীর উপর খাড় গাঁটের নিচ পর্যন্ত কামিজের মত সাদা বোরখা পরেছে আর মাথা ও বুক অন্য একটা কাপড় দিয়ে ঢেকে শুধু মুখটা খোলা রেখেছে। এখন শুধু তার হাতের দুই কজী ও চুলের নিচ থেকে মুখমণ্ডল দেখা যাচ্ছে।
সে যখন রেহানার পাশে দাঁড়াল তখন সকলে তার দিকে চেয়ে স্তম্বিত হয়ে গেল। এত রূপসী মেয়ে তারা এর আগে কখনও দেখেনি। সকলে নিস্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। ছেলেরা মনে করল, যে মেয়ের এতরূপ, তার গলার স্বর না জানি কত মিষ্টি। সকলে শুধু এক পলক তার মুখ দেখেছে। কারণ সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
তাকে ঐ অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সেলিম ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নিজেকে অপরাধী মনে করল। সে তার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল।
এমন সময় লাইলী এগিয়ে গিয়ে সকলের সামনে দাঁড়িয়ে মুখ তুলে সকলের দিকে চেয়ে আসসালামু আলাইকুম বলল। সেলিম আসতে আসতে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। কেউ সালামের উত্তর দিল না। লাইলী সেটা গ্রাহ্য না করে বলল, দেখুন, আমি স্বইচ্ছায় আপনাদের এই ফাংসানে আসিনি, দৈবচক্রে এসে পড়েছি। এই সমাজের রীতিনীতি সম্বন্ধে আমি অনভিজ্ঞ। আর আমি গান বাজনাও জানি না। আপনাদেরকে আনন্দ দেওয়ার মত কোনো বিদ্যা আমার জানা নেই। তবে যদি অনুগ্রহ করে সকলে অনুমতি দেন, তা হলে সেই সৃষ্টিকর্তা, যিনি পরম দাতা দয়ালু, তাঁর ও তার প্রেরিত রাসূলের (দঃ) কিছু সুতীগান ও আলোচনা করে শোনাতে পারি। তারপর সে অনুমতির পাওয়ার আশায় সকলের দিকে চেয়ে মাথা নিচু করে নিল।
এতক্ষণ যেন চাঁদ সেখানে আলো ছড়াচ্ছিল, লাইলী মাথা নিচু করে নিলে সকলের মনে হল চাঁদ যেন মেঘের ভিতরে ঢুকে গেল। বেশ কয়েক মিনিট কেউ কোনো কথা বলতে পারল না। সোহানা বেগম এবং আরও দুই তিনজন বয়স্কা মহিলা একসঙ্গে বলে উঠলেন, বেশ তো মা, তুমি কি শোনাতে চাও শোনাও।
লাইলী মুখ তুলে সকলের দিকে চেয়ে উর্দুতে একটা গজল গাইল।
“খুদী কো মিটাকর খোদা সে মিলাদে,
শুরুর আওর মস্তী কী দৌলত লুটাদে,
শরাবে হকিকত কী দরিয়া বাহাদে,
নেগাহুঁকী সাদকে মে বেখুদ বানাদে,
মুঝে সোফিয়া জামে ওহাদাৎ পিলাদে,
খুদীকো…
আজল সেহুঁ কুশতা ম্যায় তেরী আদাকা,
নাজীনে কী হজরত নাগাম হ্যায় কাজাকা,
না জেঁইয়া আসর কা না খাঁহাঁ দোওয়া কা,
মাসিহা সে তালেব নেহী ম্যায় সে কা কা,
মরীজে আলম হুঁ তেরা তু দোওয়া দে,
খুদী কো………
খুদারা কভি মেরী তুরজাত পীয়া কর,
বাসাদ নাজ হালকি সে ঠোকর লাগা কর;
দেখা মেরী খবিদা কীসমত জাগা কর,
সাদা কুম বেজনী কি মুজকো শুনা কর,
ম্যায় বেদম হুঁ আয়া ফাখরে ইসা জিলাদে
খুদী কো মিটা কর খোদা সে মিলাদে।”
লাইলী থেমে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ ঘরের মধ্যে পিন অফ সাইলেন্স বিরাজ করতে লাগল। সকলে বোবা দৃষ্টিতে তার দিকে করুণভাবে চেয়ে রইল। তাদের কানে এখনও লাইলীর সুমধুর ঝংকার বেজে চলেছে। যদিও অনেকে এই উগজলের মানে বুঝতে পারেনি, তবুও লাইলীর কোকিলকণ্ঠি গলা ও দরদভরা সুর সবাইকে যেন পাথরের মত স্তব্ধ করে দিয়েছে। সব থেকে বেশি অভিভূত হয়েছে সেলিম। সে ভাবল, লাইলীর সুরের কাছে তাদের সকলের সুরের কোনো তুলনা হয় না।
নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে প্রথমে সালমা হাততালি দিতে সকলে সম্বিত ফিরে পেয়ে তারাও হাততালি দিতে লাগল। সকলকে থামিয়ে সালমা বলল, আপনার গলা এত সুন্দর? আপনি যদি রেডিও, টিভি কিংবা ফিলম লাইনে যান, তা হলে তারা আপনাকে লুফে নেবে। আমি কত গায়ক-গায়িকার গান শুনলাম, কিন্তু আপনারটা তলনাহীন।
লাইলী এতক্ষণ লজ্জা পেয়ে জড়ো সড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সালমা থেমে যাওয়ার পর তার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার জওয়াবে অনেক কথা বলতে হয়। সেগুলো বললে আপনারা শুনে হয়তো অসন্তুষ্ট হবেন। তাই বেশি কথা না বলে এক কথায় বলছি, ইসলামে গান-বাজনা নিষিদ্ধ। তারপর সকলের দিকে এক নজর দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে আবার বলল, আল্লাহপাক তাঁর সৃষ্টির সেরা মানুষকে নর ও নারী দুটি আলাদা সত্ত্বে সৃষ্টি করেছেন। তাদের দৈহিক ও মানসিক দিক ভিন্ন করেছেন এবং তাদের কাজ ও তার ধারা আলাদা করে দিয়েছেন। কিন্তু আমরা তার সৃষ্টির সেরা জীব হয়ে তার আদেশ অমান্য করে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য নিজেরা আইন তৈরি করে নিয়েছি। যার ফলে আজ সারাবিশ্বে অশান্তির আগুন জ্বলছে। ছেলে-মেয়ের সঙ্গে পিতামাতার এবং স্ত্রীদের সঙ্গে স্বামীদের মনমালিন্য শুরু হয়ে সংসার নরকে পরিণত হতে চলেছে। এইসব কথা বলতে গেলে সরারাতেও শেষ হবে না। তা ছাড়া এমন আনন্দ উৎসব ফাংশানে এইসব আলোচনাও খাপ খায় না। তবুও আর একটু বলে শেষ করছি। প্রত্যেক মসুলমানের উচিত পৃথিবীকে জানার আগে নিজেকে জেনে নেওয়া। অর্থাৎ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সভ্যতা, ভাষা, ধর্ম ও মতামতকে প্রধান্য দেওয়ার আগে তার নিজের ধর্মের সংস্কৃতি ও কৃষ্টিকে জেনে নেওয়া দরকার। যদি তারা তাই করত, তা হলে বুঝতে পারত, পৃথিবীর অন্যান্য সবকিছুর চেয়ে ইসলামের অর্থাৎ আল্লাহপাকের আইন কত সুষ্ঠ, কত সুন্দর, কত। সহজতর। দূর থেকে লম্বা কুর্তা ও টুপী পরা মৌলবী এবং বোরখা পরা মেয়ে দেখে আজকাল বেশিরভাগ লোক সেকেলে, ন্যাষ্টি বলে নাক সিটকায়। আবার অনেকে ইসলামের আইন এযুগে মেনে চলা খুব কঠিন ও অচল বলে মনে করে। অথচ আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনের মধ্যে বলছেন, “আমি বান্দাকে এমন কাজ করতে আদেশ দিই নাই যা তাদের পক্ষে মেনে চলা কঠিন।2” আর বেশি কিছু বলে আপনাদেরকে বিরক্ত করতে চাই না। এতক্ষণ যা কিছু বললাম, তাতে হয়তো অনেক ভুলত্রুটি থাকতে পারে, সে জন্য ক্ষমা চাইছি। তারপর সে ফিরে এসে নিজের চেয়ারে বসে ঘামতে লাগল। তার মনে হল, সে যেন আগুনের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল। এরপরও কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা বিরাজ করল।
সোহানা বেগম বলে উঠলেন, এবার তোমরা সবাই খাবে চল, রাত বেশি হয়ে যাচ্ছে। তিনি রহিমকে ডেকে ডাইনিং রুমে খাবার সাজাতে বললেন।
এদিকে যারা লাইলীকে অপমান করতে চেয়েছিল, তারা ব্যর্থ হয়ে মনে মনে গুমরাতে লাগল। ছেলেরা তো লাইলীর রূপের ও সুরের প্রশংসায় মশগুল।
রেজাউল সেলিমের কাছে গিয়ে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করল, দোস্ত, এই কী সেই মেয়ে, যার সঙ্গে তুই ভার্সিটিতে এ্যাকসিডেণ্ট করেছিলি? আর মিল্লাদুন্নবীর ফাংশনের দিন যার সঙ্গে দেখা করার জন্য কবিতা গেয়েছিলি?
সেলিম বলল, তুই ঠিক ধরেছিস। আমার কথা সত্য না মিথ্যা তার প্রমাণ পেলি তো?
রেজাউল বলল, সত্যি দোস্ত, তুই মহাভাগ্যবান। এরকম মেয়ে বর্তমান দুনিয়ায় খুব বিরল।
একটু পরে রহিম এসে বলল, আপনারা সবই খাবেন চলুন।
একে একে সকলে ডাইনিং রুমে গেল। শুধু লাইলী একা বসে রইল।
সেলিম ফিরে এসে বলল, তুমি আমাদের সঙ্গে খাবে না?
লাইলী করুণসুরে বলল, প্লীজ সেলিম, তুমি মনে কিছু করো না। আমি কিছুতেই সকলের সাথে খেতে পারব না। তুমি যাও, নচেৎ অতিথিরা মনে কষ্ট পাবে। সেলিম চলে যাওয়ার পরও লাইলী চুপ করে বসে সারাদিনের ঘটনাগুলো একের পর এক ভাবতে লাগল।
এদিকে খাবার টেবিলে লাইলীকে দেখতে না পেয়ে একজন জিজ্ঞেস করল, কই নূতন অতিথিকে তো দেখতে পাচ্ছি না?
কেউ কিছু বলার আগে রেহানা বলে উঠল, উনি পর্দানশীন মহিলা, ছেলেদের সঙ্গে খান না। কথাটা শুনে অনেকে হেসে উঠল।
এমন সময় সোহানা বেগম ঘরে ঢুকে তাদের কথা শুনে বুঝতে পারলেন, লাইলী খেতে আসেনি। সেলিমকে জিজ্ঞেস করলেন, হ্যারে, লাইলী কোথায়?
সেলিম বলল, সে ঐ রুমে বসে আছে। তুমি তাকে আলাদা খাওয়াবার ব্যবস্থা কর।
সোহানা বেগম লাইলীর গজল ও কথা শুনে খুব মোহিত হয়ে গিয়েছিলেন। মনে মনে অনেক তারিফ করেছেন। তিনি লাইলীকে ডেকে অন্য রুমে খেতে দিলেন। সকলে বিদায় নিতে রাত্রি দশটা বেজে গেল। সোহানা বেগম লাইলীকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলে সেলিমকে সাথে যেতে বললেন।
যেতে যেতে গাড়িতে সেলিম বলল, সত্যি বলছি আজ যে রুবীনার বার্থডে পালন করা হবে, সে কথা আমার একদম মনে ছিল না। তবে একটা কথা মনে রেখ, যারা তোমাকে হিংসা করে অপমান করতে চেয়েছিল, তারা নিজেরাই অপমানিত হয়েছে। আর আমি আমার প্রিয়তমাকে অনেক বেশি জানতে পারলাম। তোমার গলা যে এত ভালো, আমি প্রশংসা করার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।
লাইলী লজ্জা পেয়ে বলল, কি জানি, আমি তো কোনোদিন গলা সাধিনি। আর কোনোদিন গানও গাইনি। যদি সত্যি তোমার কাছে ভালো লেগে থাকে, তা হলে নিজেকে ধন্য মনে করছি। তারপর আবার বলল, আমি কাউকে অপমান করার উদ্দেশ্যে কিছু বলিনি। বরং আমি ভাবছি, আমার জন্য তোমাদের কোনো অপমান হল কি না?
সেলিম বলল, তুমি আমাদের ইজ্জৎ বাড়িয়ে দিয়েছ। ওরা নিজেদেরকে খুব সুন্দরী ও ভালো গায়িকা মনে করত। আজ তাদের সেই অহংকার চূর্ণ হয়ে গেছে।
লাইলী বলল, তোমার গান শুনে আমি কিন্তু নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। তোমার গলা যে কত সুন্দর তার প্রশংসা করা আমার দ্বারা সম্ভব না।
দূর আমার গলা আবার গলা। কতদিন ওস্তাদ রেখে গলা সেধে এটুক তৈরি করেছি। আরে তুমি এমনি যা গাইলে, এর আগে জীবনে কোনোদিন শুনিনি।
এরপর লাইলী কথা খুঁজে না পেয়ে বলল, রাত অনেক হয়ে গেল, আব্বা-আম্মা খুব চিন্তা করছেন। অনেক বকাবকি ও করবেন।
আজ আমার জন্য না হয় একটু বকাবকি খেলে। ততক্ষণে তারা লাইলীদের বাড়ির গেটে পৌঁছে গেল। ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে দরজা খুলে দিল।
লাইলী নেমে কলিং বেলে চাপ দিয়ে বলল, ভিতরে আসবে না?
তুমি বললে নিশ্চয় আসব।
জলিল সাহেব গেট খুলে দিয়ে লাইলীর সঙ্গে সেলিমকে দেখে বললেন, আরে সেলিম সাহেব যে, আসুন ভিতরে আসুন। লাইলী লজ্জা পেয়ে পাশ কাটিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। জলিল সাহেব সেলিমকে সঙ্গে করে নিয়ে ড্রইংরুমে বসিয়ে বললেন, রাত্রে যখন এসেই পড়েছেন তখন একমুঠো ভাত খেয়ে যান।
সেলিম বলল, এইমাত্র খেয়ে আসছি। এখন কিছু খেতে পারব না।
অন্ততঃ এক কাপ চা তো চলবে। তারপর উঠে গিয়ে স্ত্রীকে চা তৈরি করে লাইলীর হাতে পাঠিয়ে দিতে বললেন।
একটু পরে লাইলী দুকাপ চা নিয়ে এল।
চা খেয়ে সেলিম বিদায় নিয়ে চলে গেল।
লাইলী খালি কাপ নিয়ে ফিরে এলে হামিদা বানু রাগের সঙ্গে বললেন, আজকাল মেয়েদের লজ্জা সরম বলতে কিছুই নেই। তুই যে সারাদিন ঐ ছেলেটার সঙ্গে ঘুরে বেড়ালি, তোর লজ্জা করল না? কলিযুগ ঘোর কলিযুগ। তা না হলে জোয়ান জোয়ান ছেলে-মেয়েরা একসঙ্গে লেখাপড়া ও ঘোরাফেরা করে? মেয়েদের পর্দা বলতে আর কিছুই রইল না। এইজন্য মানুষ দিন দিন রসাতলে যাচ্ছে। আর কোনোদিন এভাবে যাবি না বলে দিচ্ছি?
রহমান সাহেব লাইলী ফেরার খবর শুনে শুবার ব্যবস্থা করছিলেন। স্ত্রীর কথা শুনে বললেন, আহা রাগারাগি করছ কেন। যা বলবে মেয়েকে তো ভালো মুখে বুঝিয়ে বলতে পার?
হামিদাবানু গর্জে উঠলেন, তুমি থামো, তোমার আস্কারা পেয়ে তো ওর এত সাহস হয়েছে। মেয়ে ছোট নাকি যে, তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে? সে কি কিছু বোঝে না, না জানে না? পরের ছেলের সঙ্গে ঘুরে বেড়ালে বংশের ইজ্জত বাড়বে বুঝি?
লাইলী বলল, মা তুমি চুপ কর। এতরাতে কথা কাটাকাটি করো না। আমার অন্যায় হয়েছে। আর কোনোদিন যাব না। হয়েছে তো বলে নিজের ঘরে চলে গেল। সেলিমদের বাড়িতে সারাদিন যাই ঘটুক না কেন, ফেরার সময় তার মনটা বেশ উৎফুলু হয়েছিল। বাড়িতে ফিরে বকুনি খেয়ে তা খারাপ হয়ে গেল। পরক্ষণে ভাবল, এতে মায়ের কোনো দোষ নেই। কারণ পিতামাতা সন্তানের ভালো চান। আমার ভালোর জন্য মা রাগারাগি করেছে। আরও চিন্তা করল, গার্জেনরা শাসন না করলে ছেলেমেয়েরা প্রথমে ছোট-খাট অন্যায় করতে করতে পরে বড় বড় অন্যায় কাজ করতে দ্বিধাবোধ করে না। তারপর ঐ সব চিন্তা দূর করে দিয়ে সেলিমের কথা মনে করতে তার মধুর কণ্ঠের গানটা কানের পর্দায় ভেসে উঠল। সেই গান শুনতে শুনতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল।