দশ
আসমা ফাষ্ট ডিভিসনে আই এ, পাশ করল। সেলিম তাকে জয়দেবপুরে কনভেণ্ট স্কুলে প্রাইমারী সেকশানে মাষ্টারী পাইয়ে দিল। সে ছেলেকে নিয়ে সেখানে থাকে। আর প্রাইভেটে বি. এ পরীক্ষা দেবার জন্য পড়াশোনা করতে লাগল। প্রতি সপ্তাহে ছুটির দিনে ছেলেকে নিয়ে সে সেলিমদের বাড়িতে আসে। এক ছুটির দিন স্কুলে ফাংশান ছিল বলে আসতে পারল না। সেলিম গত রাত্রে বাড়ি ফিরেছে। দুপুর পর্যন্ত আসমা এল না। বেলা তিনটার দিকে মনিরুল এসেছে। সে আজ রুবীনাকে নিয়ে কোথায় যেন যাবে। সেলিম খাওয়া দাওয়া সেরে শুয়ে শুয়ে একটা বই পড়ছিল। লাইলী সবাইকে খাইয়ে নিজেও খেল। তারপর হাতের কাজ সেরে স্বামীর পাশে এসে বসে বলল, একটা কথা বলব তুমি যেন আবার মাইণ্ড করো না?
সেলিম বলল, আমি তোমার কথায় কখনো মাইড করেছি?
লাইলী বলল, রুবীনা মনিরুলের সঙ্গে প্রতিদিন বেড়াতে যায়। ফিরে আসে রাত করে। ও এখন বড় হয়েছে। অত রাতে বাড়ি ফেরা আমি ভালো মনে করি না।
সেলিম বলল, তুমি ঠিক বলেছ। আমিও মাঝে মাঝে তা লক্ষ্য করেছি। তোমাকে তো সেদিন আসমা আর মনিরুলের ব্যাপারটা বলেছি। এক কাজ কর, আজ আমরা সবাই আমাকে দেখতে যাই চল। সে আজ কেন এল না? নিশ্চয়ই কোনো অসুখ বিসুখ হয়েছে। রেহানা এসেছে কি?
লাইলী বলল, হ্যাঁ সে মায়ের সঙ্গে কথা বলছে। সেলিম বলল, তুমি রেহানা, মনিরুল ও রুবীনাকে কথাটা বলে এসে তৈরি হয়ে নাও। আমরা এক্ষুণি বেরুব।
দুটো গাড়িতে করে সকলে এসে কনভেণ্ট স্কুলের গেটের কাছে নামল। স্কুলের ফাংশান অনেক আগে শেষ হয়ে গেছে। আসমাকে ফাংশানে অনেক খাটাখাটনি করতে হয়েছে। তাই ক্লান্ত হয়ে ষ্টোভে চা করে ছেলেকে নিয়ে খাচ্ছিল।
সেলিম আসমার রুম চেনে। সবাইকে নিয়ে এগোল।
তাদেরকে দেখতে পেয়ে আসমা সালাম দিয়ে লাইলীকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমার কি সৌভাগ্য, তোমরা এই হতভাগীর কাছে এসেছ? সে মনিরুলকে লক্ষ্য করেনি।
সেলিম বলল, আজ বাড়িতে এলি না, ভাবলুম তোর কোনো অসুখ বিসুখ হল কিনা। তাই দেখতে এলুম।
আসমা বলল, আজ স্কুলে একটা ফাংশান ছিল। তাই যেতে পারিনি। ভাবছিলাম, এক্ষুণি সেকথা ফোনে তোমাদের জানাব। তোমরা এসে খুব ভালো হয়েছে। কিন্তু এত লোককে কোথায় বসতে দেব? লাইলীর দিকে চেয়ে বলল, তুমি বল না ভাবি, আমি এখন কি করব?
লাইলী আসমার ছেলেকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে বলল, তোমাকে কিছু করতে হবে না, ঘরে চাবি দিয়ে তুমিও আমাদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়। কোনো হোটলে গিয়ে তোমার ভাইয়ার পকেট খালি করে দিই।
সেলিম বলল, তাই চল বাইরে কোথাও যাই। তারপর মনিরুলের দিকে একবার চেয়ে সকলের অলক্ষ্যে লাইলীর কানের কাছে মুখ নিয়ে খুব আস্তে আস্তে বলল, ওদের দুজনকে রেখে রেহানা ও রুবীনাকে সাথে করে বাইরে চলে এস।
লাইল আসমাকে বলল, আমরা বাইরে অপেক্ষা করছি। তুমি তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে এস।
ওরা বাইরে চলে যাওয়ার পর মনিরুলের দিকে আসমার লক্ষ্য পড়ল। দেখল, সে তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। এতক্ষণ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে মনিরুল আসমাকে দেখে ভীষণ আশ্চর্য হয়ে তার দিকে তাকিয়েছিল। তার মনে তখন চিন্তার ঝড় বইছে। রেহানার মুখে সে একদিন শুনেছিল, আসমা নামে একটা মেয়ে সেলিমদের বইতে আছে। সেদিন নামটা শুনে মনে মনে চমকে উঠেছিল। পরে ভেবেছে আসমা নামে তো অনেক মেয়ে আছে। কিন্তু আজকে যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তার মনে হল, এই দিন-দুপুরে স্বপ্ন দেখছে না তো? কিছুক্ষণ দুজন দুজনের দিকে চেয়ে রইল। আসমা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, মনিরুল ভাই, আমাকে চিনতে পারছ?
মনিরুল কি বলবে ভেবে ঠিক করতে পারল না। তার মনের পর্দায় তখন অনেক দিন আগের কুমিল্লার একটা বাগান বাড়ির কথা মনে পড়ল। সেই বাগানে কত দিন এই মেয়েটার সঙ্গে প্রেম করেছে। শহরে ফিরে তার কথা ভুলে গিয়েছিল। তার জীবনে এমন কত মেয়ে আসে যায়, কটাকে মনে রাখবে। আজ আসমাকে দেখে তার বিবেক বলল, মনিরুল, তুমি এমন রন্সকে হারিও না। বুঝতে পারছ না, তোমার জন্য সে বাপ মায়ের দেশ ছেড়ে এসে কি রকম তপস্যা করছে। এখনও তোমার শুধরাবার সময় আছে।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে আসমা আবার বলল, বড়লোকেরা গরিবদের মানুষ বলে গণ্য করে না। তিন চার বছর আগের আসমাকে কি আর তোমার মনে আছে। এর মধ্যে কত আসমা তোমার জীবনে এসেছে। গরিবদের যতটুকু দয়া দেখাও, তা শুধু নিজেদের স্বার্থের খাতিরে। যেখানে স্বার্থ নেই সেখানে দয়াও নেই। মনে হচ্ছে,
জেনে তুমি এখানে এসে পড়েছ। আমি তোমার কাছে কোনো আব্দার বা দাবী করব না, শুধু ঐ ছেলেটাকে পিতৃত্বের পরিচয় দিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা কর। তারপর মনিরুলের দু’পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল।
সেলিম ও লাইলী আসমার বুদ্ধির পরিচয় পেয়ে অবাক হল। রেহানা সব দেখেশুনে একেবারে থ হয়ে গেল। সে জানত, ভাইয়া মেয়েদেরকে নিয়ে একটু হৈ হুল্লোড় করে। তা বলে বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে গিয়ে একটা গরিবের মেয়ের সর্বনাশ করে আসবে, সেকথা কল্পনাও করেনি। রেগে মেগে ঘরের ভিতরে যেতে উদ্যত হলে সেলিম তার একটা হাত ধরে আস্তে আস্তে বলল, এখনও সময় হয়নি, আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর।
এদিকে রুবীনাও ভীষণ রেগে গেল। কাল তাদের রেজেষ্ট্রি করে বিয়ে হওয়ার কথা। সে কোনো রকমে টলতে টলতে গাড়িতে গিয়ে বসল।
আসমা ঐ অবস্থায় বলে চলল, যখন আমি বুঝতে পারলাম মা হতে চলেছি তখন তোমাকে দিনের পর দিন পাগলের মত চিঠি লিখেছি। কিন্তু কোনো উত্তর পাইনি। শেষে তোক জানাজানির ভয়ে একরাত্রে ঘর থেকে পালিয়ে তোমার দেওয়া ঠিকানায় গেলাম। তোমাকে পেলাম না। পেলাম একজন বয়স্ক লোককে। মনে হয় তিনি তোমার বাবা। সব শুনে তিনি লাঞ্ছনা গঞ্চনা দিয়ে তাড়িয়ে দিলেন। তারপর অনেক ঘটনা ঘটেছে। শেষে সেলিম ভাই আশ্রয় দিয়ে নিজের বোনের মত দেখছে। তবে যত কিছু ঘটুক না কেন, আজ পর্যন্ত তুমি ছাড়া আর কেউ আমার শরীরে হাত দিতে পারেনি। জানি না, এসব তুমি বিশ্বাস করবে কিনা? যদি তুমি আমাকে আর তোমার ছেলেকে পথের কাঁটা বলে মনে কর, তবে খাবারের সঙ্গে বিষ মাখিয়ে এনে দিও। তাই খেয়ে তোমার আপদ দূর হয়ে যাবে।
মনিরুল আর সহ্য করতে পারল না। একেবারে ভেঙ্গে পড়ল। সে ভূলে গেল বারান্দায় তার সঙ্গীরা থাকতে পারে। ঝুকে পড়ে আসমাকে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরে ভিজে গলায় বলল, আসমা, তুমি আমার ভুল ভাঙ্গিয়ে দিয়েছ। আমি তোমার কাছে চরম অন্যায় করেছি। মাফ করে দিয়ে সংশোধন হওয়ার সুযোগ দাও। আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। আমার অন্যায়ের জন্য লজ্জিত ও দুঃখিত হৃদয়ে তোমার কাছে মাফ চাইছি। বল আসমা বল, মাফ করে দিয়ে আমাকে সংশোধন হওয়ার সুযোগ দিবে।
আসমাও মনিরুলকে আঁকড়ে ধরে ফোঁপাতে লাগল। কিছুক্ষণ পর আসমা নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে এসে কাপড়টা ঠিক করে বলল, আল্লাহ কি এত সুখ আমার কপালে রেখেছেন? আমার স্বপ্ন কি সফল হবে? তুমি যা বলবে তাই করব। এখন বাথরুম থেকে চোখে-মুখে পানি দিয়ে ধুয়ে এস। ওরা সবাই আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে।
মনিরুল বাথরুম থেকে এসে বলল, তুমি এখানে থাক, আমি আসছি বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
ওরা সবাই তখন গাড়ির কাছে অপেক্ষা করছিল। সে তাদের কাছে এসে লাইলীর দিকে দু’হাত বাড়িয়ে বলল, ভাবি, ওকে আমার কাছে দিন। আপনারা তো সবকিছু জানেন। আপনারা যান, ওর সঙ্গে আমার আরও কথা আছে।
লাইলী ছেলেটাকে কোল থেকে নামাতে নামাতে বলল, যাও সোনামনি তোমার আন্ধুর কাছে যাও।
মনিরুল আর কোনো কথা না বলে ছেলেকে বুকে তুলে নিয়ে আসমার কাছে ফিরে এল।
সেলিম সবাইকে নিয়ে গাড়িতে উঠল।
রুবীনা বলল, ভাইয়া আমার ভীষণ মাথা ধরেছে, আমাকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে তোমরা যেখানে খুশি যাও।
রেহানা বলল, আজ বেড়াবার মুড নষ্ট হয়ে গেছে, তোমরা যাও। আমি বাড়ি চললাম বলে নিজেদের গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিল।
মনিরুল ছেলেকে বুকে করে ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করল, এর নাম কি রেখেছ?
ছেলেসহ মনিরুলকে আসতে দেখে আমার চোখে আবার পানিতে ভরে গেল। ধরা গলায় বলল, রফিকুল ইসলাম।
রফিকুল মনিরুলের বুকে থেকেই বলল, আম্মা, মামী বললেন, ইনি আমার আব্বু। তুমি এতদিন আমাকে আন্ধুর কাছে নিয়ে যাওনি কেন? মা কিছু বলছে না দেখে সে মনিরুলের মুখের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি আমার আব্বু?
ছেলেকে আদর করে বুকে চেপে ধরে মনিরুল বলল, হ্যাঁ সোনা, আমি তোমার আব্বু। রফিক মায়ের কাছে ছাড়া এত আদর আর কারও কাছ থেকে পায়নি। সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, এতদিন আসেননি কেন? আম্মা কত কাঁদে।
এইতো এসেছি বাবা আর তোমার আম্মা কাঁদবে না। তারপর আসমাকে বলল, চল একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি।
আজ আমি বড় ক্লান্ত। তুমি বস, আমি চা করে নিয়ে আসি। পাশেই রান্না ঘর। সেখান থেকে কয়েকটা বিস্কুট বের করে মনিরুলকে খেতে দিল।
রফিক বলে উঠল, আমিও চা খাব আম্মা।
মনিরুল ছেলের দুহাতে চারটে বিস্কুট দিয়ে বলল, আগে এগুলো খেয়ে নাও, পরে চা খাবে।
চা খাওয়ার সময় মনিরুল বলল, তুমি আগামীকাল ছুটি নেবে। আমি ঠিক দশটার দিকে আসব। তুমি রেডী থাকবে। কালকেই বিয়ের কাজটা সারতে চাই। আসমা বলল, বেশ, তাই হবে। মনিরুল বিদায় নিয়ে চলে গেল।
মনিরুলকে বিদায় দিয়ে আসমা চোখের পানি ফেলছিল। রফিক মাকে কাঁদতে দেখে বলল, আব্বু চলে গেছে বলে তুমি কাঁদছো? আবার কখন আব্বু আসবেন?
আসমা চোখ মুছে ছেলেকে চুমো খেয়ে বলল, তোমার আন্ধু আবার কালকে আসবেন।
পরের দিন ঠিক দশটায় স্কুলের গেটের কাছে মনিরুলকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে আসমা এগিয়ে এসে সালাম দিল।
মনিরুল সালামের উত্তর দিয়ে বলল, তুমি তৈরি?
আসমা মাথা নেড়ে সায় দিল।
রফিক কোথায়?
তাকে রিজিয়া নামে আমার এক সহকর্মির তত্বাবধানে রেখে এসেছি।
তা হলে এস বলে মনিরুল গাড়িতে উঠে পাশের গেট খুলে দিল।
মনিরুল তাকে নিয়ে কাজি অফিসে গিয়ে কাবিন ও বিয়ের কাজ সারল। তারপর বেলা দুটোর সময় ফিরে এল। রিজিয়াকে রফিক বড় বিরক্ত করছিল। তার মায়ের জন্য খুব কান্নাকাটি করছিল। মার সঙ্গে আব্বাকে দেখতে পেয়ে কান্না থামিয়ে ছুটে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি কোথায় গিয়েছিলে? আমি তোমার জন্য কাঁদছিলাম। তারপর মনিরুলের দিকে চেয়ে বলল, আপনি আম্মাকে নিয়ে গেলেন, আমাকেও নিয়ে গেলেন না কেন?
মনিরুল ছেলেকে কোলে নিয়ে চুমো খেয়ে বলল, আমরা একটা কাজে গিয়েছিলাম। এবার আর কখনো তোমাকে ফেলে কোথাও যাব না। তারপর আসমাকে বলল, তুমি সব গুছিয়ে নাও, আমি তোমাদের হেড মিস্ট্রেসের সঙ্গে দেখা করে এখনই আসছি।
হেড মিস্ট্রেস একজন অচেনা লোককে রফিককে কোলে নিয়ে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কাকে চান?
মনিরুল রফিককে দেখিয়ে বলল, ওর মা আসমা আমার স্ত্রী, তাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে চাই। তাই আপনার অনুমতি নিতে এসেছি।
হেড মিস্ট্রেস বসতে বলে বললেন, স্বামীর বাড়ি তো মেয়েদের নিজের বাড়ি। নিয়ে যাবেন ভালো কথা। আসমা কী চাকরি রিজাইন দিয়ে একেবারে চলে যেতে চায় নাকি? তা হলে কিন্তু আমার আপত্তি আছে। কারণ ওর মত মেয়ে পাওয়া মুশকিল। বাচ্চারা আসমা আপা বলতে অজ্ঞান। এতদিন আমি শাসন করে যা পারি নি, মাত্র কয়েক মাস হল এসে সে তার থেকে অনেক বেশি করেছে।
মনিরুল বলল, দেখুন চাকরি করবে কি না করবে সে কথা ও আপনাকে পরে জানাবে।
সেলিম সাহেব আপনার কে হন?
ফুপাতো ভাই।
ঠিক আছে ওকে নিয়ে যান। যাওয়ার আগে একটা ছুটির দরখাস্ত দিয়ে যেতে বলুন।
সব ব্যবস্থা করে ওরা গাড়িতে উঠল। সামনের সীটে সবাই বসেছে।
গাড়ি চলতে শুরু করার পর রফিক বলল, আব্বু এটা তোমার গাড়ি? সে মাঝখানে বসেছে।
গাড়ি চালাতে চালাতে মনিরুল ছেলের গালটা আলতো করে টিপে আদর করে বলল, হ্যাঁ আব্বু, এটা তোমার আরুর গাড়ি। ওরা যখন ঘরে পৌঁছল তখন বিকেল পাঁচটা।
মনিরুলের বাবা জাহিদ সাহেব তখন বাড়ির সামনের লনে স্ত্রী ও মেয়েসহ বৈকালিক জলযোগ করছিলেন। মনিরুলের গাড়ি গেট দিয়ে ঢুকতে দেখে সেদিকে সকলে একবার চেয়ে খাওয়াতে মনোযোগ দিলো। তিনি গত রাত্রে রেহানার কাছে ছেলের অপকীর্তির সব কথা শুনেছেন।
মনিরুল গাড়ি পার্ক করে নেমে ছেলের একটা হাত ধরে আসমাকে সঙ্গে করে একবারে তাদের কাছে এসে বলল, আব্বা, আমি আসমাকে বিয়ে করেছি। আজ সকালে মনিরুল যাওয়ার সময় কাজি অফিস থেকে আসমাকে বিয়ে করে নিয়ে আসবার কথা রেহানাকে বলেছিল। রেহানা চা খেতে খেতে একটু আগে মা-বাবাকে সেকথা বলেছে।
জাহিদ সাহেব কয়েক মুহূর্ত গম্ভীর হয়ে বসে থেকে রাগে ফেটে পড়লেন। বললেন, তুমি একটা স্কাউণ্ডেল। তোমার মত চরিত্রহীন ছেলের আমি বাবা, এ কথা মনে করলে নিজের প্রতি ঘৃণা হয়। একটা মেয়ের সরলতার সুযোগ নিয়ে তার সর্বনাশ করে এতদিন ভুলে ছিলে। মেয়েটার যদি কোনো অঘটন ঘটে যেত, তা হলে তোমাকে আমি দূর করে তাড়িয়ে দিতাম। লেখাপড়া করে তুমি একটা জানোয়ার হয়েছ।
রফিক জাহিদ সাহেবের রাগ দেখে প্রথমে ভয় পেয়ে যায়। তারপর সে
সকলের অলক্ষ্যে জাহিদ সাহেবের সামনে গিয়ে বলল, কে আপনি? আমার আন্ধুকে বকছেন কেন?
জাহিদ সাহেব চমকে উঠে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে দেখলেন, অবিকল মনিরুলের অবয়ব। তিনি তাকে কোলে তুলে নিয়ে বললেন, আমি তোমার দাদু। তোমার আব্বু তোমাদের এতদিন আনেনি বলে বকলাম। তোমার নাম কি ভাই?
আমার নাম রফিকুল ইসলাম। আমাকে সবাই রফিক বলে ডাকে।
বাহ বেশ সুন্দর নাম তো। রফিক মানে বন্ধু। তা হলে আজ থেকে তুমি আমার বন্ধু হলে। এবার থেকে আমরা দু’বন্ধুতে মিলে খুব গল্প করব, কি বল?
আপনি গল্প জানেন? কি মজা! আমি কিন্তু আপনার কাছে ঘুমাব। সেই সময় আপনি গল্প বলবেন।
তাই হবে ভাই। তারপর আমার মুখের দিকে চাইতে অনেক দিন আগের একটা আবছা মুখ মনে পড়ল। সে দিন বোধ হয় এই মেয়েটাই মনিরুলের খোঁজ। করে অনেক কথা বলেছিল? তাকে অপমান করে টাকা দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছিল। মেয়েটা টাকা তার পায়ের কাছে ফেলে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে চলে গিয়েছিল। আজ সেকথা মনে হতে খুব অনুতপ্ত হলেন। বললেন, বৌমা, তোমাকে সেদিন ভুল বুঝে অনেক অপমান করে তাড়িয়ে দিয়ে অন্যায় করেছি। বুড়ো ছেলে মনে করে আমাকে। ক্ষমা করে দাও মা।
আসমা বসে পড়ে শ্বশুরের পায়ে হাত দিয়ে বলল, আপনি ক্ষমা চেয়ে আমাকে গোনাহগার করবেন না। সবকিছু তকদিরের লিখন। যার তকদিরে যতদিন বিড়ম্বনা থাকে, তাকে ততদিন সেটা ভোগ করতেই হবে। আমাকে আপনি পূত্রবধূ হিসাবে। পায়ে ঠাই দিয়ে ধন্য করেছেন। সেই জন্য আল্লাহপাকের দরবারে জানাই লাখো শুকরিয়া। তারপর ফুঁপিয়ে উঠল।
জাহিদ সাহেব তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, আল্লাহ তোমাদের সুখি করুন। তারপর মেয়ে ও স্ত্রীর দিকে চেয়ে বললেন, বৌমাকে ঘরে নিয়ে যাও। তোমরা দাঁড়িয়ে রয়েছ কেন?
আসমা উঠে এসে শাশুড়ীকে কদমবুসি করল।
তার দেখাদেখি মনিরুলও মা-বাবাকে কদমবুসি করল।
রেহানা আসমার হাত ধরে বলল, এস ভাবি আমরা ঘরে যাই।