» » ফুটন্ত গোলাপ

বর্ণাকার

নয়

সেলিম আরিফকে নিয়ে মিল, কারখানা ও অফিসের সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। সব কাজ তাকে বুঝিয়ে দিতে লাগল। সারাদিন কাজের মধ্যে ডুবে থাকলেও রাত্রে ঘুমোবার সময় লাইলীর চিন্তায় সে অস্থির হয়ে উঠে। সবকিছু তার কাছে অসহ্য মনে হয়। শেষে একদিন সবাইকে জানিয়ে দিল, আগামীকাল সে। চিটাগাং যাবে।

সোহানা বেগম বললেন, আর কয়েকদিন থেকে যা।

সেলিম বলল, ম্যানেজার ট্রাঙ্কল করেছিল, আমার যাওয়া একান্ত প্রয়োজন নচেৎ অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। কালকের ফ্লাইটে যাব বলে ম্যানেজারকে বলে দিয়েছি। পরের দিন সেলিম দশটা চল্লিশের প্লেনে চেপে বসল।

এদিকে ম্যানেজার সাহেব অফিসের সমস্ত ষ্টাফকে জানিয়ে দিয়েছেন, সাহেব আসছেন। অফিসের কেউ এখনও তাদের সাহেবকে দেখেনি। ম্যানেজার সাহেবের কাছেই তারা শুনেছে, সাহেবের মতো সাহেব নাকি আর হয় না। তিনি সততাকে খুব ভালবাসেন। যারা সততার সঙ্গে কাজ করে তারা তার প্রিয়পাত্র। সকলে মিলে সাহেবকে অভ্যর্থনা করার ব্যবস্থা করল। তারা জেনে ছিল, এই অফিস উদ্বোধন করার পরের দিন তিনি এ্যাকসিডেণ্ট করেন এবং চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশ নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তারা সমস্ত অফিস কক্ষ রংবেরং এর রঙিন কাগজ দিয়ে সাজাল। সাহেবের অফিস রুমটা সব থেকে আকর্ষণীয় করে তুলল। তারপর রিসিভ করার জন্য সবাই এয়ারপোর্ট গেল।

বিমান যাত্রীদের মধ্যে একজন সুদর্শন যুবকের দিকে ম্যানেজার সাহেব হাত বাড়িয়ে বললেন, ঐ যে সাহেব আসছেন। ওরা প্রথমে তাকে ইউরোপিয়ান সাহেব মনে করে ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করল, আমাদের সাহেব কি ইংরেজ?

ম্যানেজার সাহেব বললেন, উনি খাস ঢাকাইয়া।

তখন সবাই অবাক হয়ে এগিয়ে যেতে লাগল। এত সুন্দর লোক তারা এর আগে দেখেনি।

অনেকগুলো লোকের সঙ্গে ম্যানেজার সাহেবকে এগিয়ে আসতে দেখে সেলিম আগে সালাম দিয়ে বলল, আশা করি, আল্লাহর রহমতে আপনারা ভালো আছেন।

ম্যানেজার ছাড়া আর কেউ সালামের জওয়াব দিতে পারল না। তারা অবাক হয়ে তাদের সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইল। তাদের মধ্যে সুভাস নামে একটা ছেলে এগিয়ে গিয়ে সেলিমের গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দিল এবং হাতে একটা লাল গোলাপ দিয়ে আদাব জানাল।

সেলিম খুশি হয়ে তাকে ধন্যবাদ দিল।

এদের সঙ্গে লাইলী আসেনি। সে সাহেবের আসবার খবরও জানে না। তার মায়ের শরীর দিন দিন ভেঙ্গে পড়ছে, তাই ডাক্তারের পরামর্শ মতো পনের দিনের ছুটি নিয়ে সাত দিন আগে মাকে নিয়ে কক্সবাজারে বেড়াতে গেছে। হামিদা বানুর দৈহিক কোনো অসুখ নেই। ডাক্তাররা বলছেন, উনি কোনো কারণে মনে ভীষণ আঘাত পেয়েছেন। সেই চিন্তাটা ওঁকে কুরে কুরে খাচ্ছে। লাইলী হোটেলে উঠেছে। লাইলী প্রতিদিন সূর্যাস্ত দেখতে সমুদ্র তীরে গিয়ে কিছুক্ষণ বেলাভূমিতে হাঁটে। তারপর পাড়ে বসে সূর্যাস্ত দেখে। সূর্যাস্তের পর ঐখানে মাগরিবের নামায পড়ে হোটেলে ফিরে আসে। প্রথম প্রথম মাকে সঙ্গে করে এনেছে। পরে উনি আসতে চান নাই, তাই লাইলী একাই রোজ আসে।

সেলিম অফিসে এসে সবকিছু দেখে বলল, আপনাদের ব্যবহারে আমি খুব আনন্দিত হয়েছি। আশা করি, আপনারা সব সময় সততার সঙ্গে কাজ করে এই ফার্মের উন্নতি করবেন। একটা কথা মনে রাখবেন, ফার্মের উন্নতী মানেই আপনাদের উন্নতি। আমি আর বেশি কিছু বলতে চাই না। এখন জলযোগ শেষ হওয়ার পর আজ ছুটি ঘোষণা করছি। আগামীকাল থেকে আপনারা যথারীতি কাজ করবেন। সকলে হাততালি দিয়ে উঠল।

সেলিম তাদের থামিয়ে দিয়ে বলল, হাততালি দেওয়া মুসলমানদের রীতি নয়। আনন্দ প্রকাশ করার সময় বলবেন, ‘সুবাহান আল্লাহ’ অথবা ‘মারহাবা মারহাবা।’ সাহেবের কথা শুনে সবাই অবাক হয়ে গেল। এ রকম কথা তারা কোনোদিন শুনে নাই। সবাইকে অবাক হতে দেখে সেলিম আবার বলল, আমি কোনো নূতন কথা আপনাদের বলিনি। পুরাতন কথাটা আপনারা জানেন না বলে নূতন বলে মনে হচ্ছে। তারপর ম্যানেজার সাহেবকে বললেন, কই খাবারের কি ব্যবস্থা করেছেন, এখানে আনতে বলুন, সকলে এক সঙ্গে বসে খাব।

অফিস স্টাফদের বিস্ময় ক্রমশঃ বেড়েই চলল। এতবড় ধনী মালিক, কর্মচারীদের সঙ্গে বন্ধুর মতো ব্যবহার করছেন। ম্যানেজার সাহেব বললেন, আপনারা অবাক হয়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছেন কেন? খাবারের ব্যবস্থা করুন। তারপর সকলে একসঙ্গে খাওয়ার পর অফিস ছুটি হয়ে গেল।

সেলিম পরের দিন জাষ্ট টাইমে অফিস কামরায় প্রবেশ করল। তারপর পিয়নকে ডেকে বলল, যারা এখানে কাজ করছে তাদের বায়োডাটা, ফটো ও দরখাস্তগুলো ম্যানেজার সাহেবকে নিয়ে আসতে বলুন।

ম্যানেজার সাহেব সবকিছু নিয়ে এলে তাকে বলল, আপনি এখন যান, প্রয়োজন হলে ডেকে পাঠাব। ম্যানেজার সাহেব চলে যাওয়ার পর তাদের কাগজ পত্রগুলো দেখতে লাগল। শেষ দরখাস্তের সাথে লাইলীর ফটো দেখে চমকে উঠল। সবকিছু ভুলে তন্ময় হয়ে ফটোর দিকে তাকিয়ে রইল। এক সময় তার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। কিছুক্ষণ পর তার কাগজ পত্রের উপর একবার চোখ বুলিয়ে বাথরুম থেকে চোখ মুখ ধুয়ে এসে ম্যানেজার সাহেবকে ডেকে পাঠাল।

ম্যানেজার সাহেব এসে সামনের চেয়ারে বসলেন।

সেলিম লাইলীর দরখাস্তটা এগিয়ে দিয়ে বলল, এই মেয়েটি দেখছি ষ্টেনোর জন্য দরখাস্ত করেছে। তাকে এপয়েণ্টমেণ্টও দিয়েছেন। কিন্তু কাল থেকে তাকে দেখছি না কেন?

ম্যানেজার সাহেব বললেন, এক সপ্তাহ আগে পনের দিনের ছুটি নিয়ে ডাক্তারের কথামতো তার অসুস্থ মাকে নিয়ে কক্সবাজারে বেড়াতে গেছে। লাইলীর মায়ের অসুখের কথা শুনে সেলিম খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল।

সাহেবকে চিন্তিত দেখে ম্যানেজার সাহেব বললেন, মেয়েছেলেকে চাকরি দিয়েছি বলে কি তুমি অসন্তুষ্ট হয়েছ? সেলিম কিছু বলার আগে তিনি আবার বললেন, দেখ বাবা, আমার তো অনেক বয়স হয়েছে, এই মেয়েটির মতো আর দ্বিতীয় কোথাও দেখিনি। যেন সাক্ষাৎ বেহেস্তের হুর। মেয়েটিকে দেখে খুব দুঃখী বলে মনে হয়েছে এবং তার যে একটা চাকরির খুব দরকার সেটা বুঝতে পেরে দিয়েছি। অফিসে প্রতিদিন নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে; কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ তার মুখ দেখেনি। আমাকে চাচা বলে ডাকে এবং আমিও তাকে মেয়ের মতো মনে করি বলে হয়তো সে আমার কাছে মুখ খুলে রাখে।

ম্যানেজার সাহেবের কথা শুনতে শুনতে সেলিম লাইলীর চিন্তায় ডুবে গেল। তার মন আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠল। কোনো রকমে সে ভাবটা গোপন করে বলল, ঠিক আছে, আপনি এখন আসুন। ম্যানেজার সাহেব চলে যেতে লাইলীর সব কাগজপত্র নিজের ব্রীফকেসে ভরে নিল। অফিস ছুটির পর সেলিম উপরে গিয়ে কিছুতেই নিজেকে বুঝাতে পারল না। তার মন এক্ষুণি কক্সবাজারে যাওয়ার জন্য ছটফট করতে লাগল। ছুটি শেষ হওয়ার পর লাইলীর ফিরে আসা পর্যন্ত ধৈৰ্য্য ধরে থাকা তার পক্ষে অসম্ভব বলে মনে হল। শেষে অনেক ভেবেচিন্তে ম্যানেজারকে চিঠি লিখল।

ম্যানেজার চাচা,

প্রথমে সালাম নেবেন। পরে জানাই যে, আজকের সন্ধ্যার ফ্লাইটে বিশেষ কারণবশতঃ আমি কক্সবাজারে যাচ্ছি। ফিরতে দুচার দিন দেরি হতে পারে? আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। ইনশাআল্লাহ আমি শীঘ্রি ফিরে আসব।

ইতি–

সেলিম।

সেলিমের বাসার কাজ-কর্ম ও রান্না-বান্না করার জন্য জাভেদ নামে একজন লোককে ম্যানেজার সাহেব ঠিক করে দিয়েছেন। লোকটা খুব বিশ্বাসী। সাহেব আসবে শুনে সে আগে থেকে ঘর-দরজা, বিছানাপত্র সব পুরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করে রেখেছিল। তার আর একটি বড় গুণ, সে খুব ভালো রান্না করতে পারে। সেলিম প্রথম তার হাতের রান্না খেয়েই বুঝতে পেরেছে, লোকটি আগে বোধ হয় কোনো বড় হোটেলের বাবুর্চি ছিল। সে চিঠিটা শেষ করে জাভেদের হাতে দিয়ে বলল, কাল ঠিক নটার সময় এটা ম্যানেজার সাহেবের হাতে দেবেন। আর আমি আজ কক্সবাজার যাচ্ছি, কয়েকদিন পর ফিরে আসব।

সেইদিন সন্ধ্যার ফ্লাইট সেলিম কক্সবাজারে গিয়ে পৌঁছাল। রাত্রে হোটেলে শুয়ে শুয়ে সে চিন্তা করল, কি করে লাইলীকে খুঁজে বের করবে। এই শহরে কোথায় আছে কি করে সে জানবে? পরের দিন সে সমস্ত হোটেলে গিয়ে তাদের রেজীষ্টার খাতা চেক করে দেখল, কিন্তু কোথাও লাইলীর নাম খুঁজে পেল না। সেলিম যদি লাইলীর মায়ের নাম জানত, তা হলে পেত। কারণ লাইলী মায়ের নামে রুম নিয়েছে। সারাদিন এলোমেলোভাবে ঘুরে সন্ধ্যার দিকে সে সমুদ্র তীরে গেল। তখন সূর্যাস্তের সময়। সেলিম সূর্যাস্তের অলৌকিক শোভা দেখতে লাগল। সূৰ্য্য যখন একটা বড় থালার মত টকটকে লাল হয়ে ডুবতে আরম্ভ করল তখন সেলিমের মনে হল, একটা বিরাট রক্তগোলাপ যেন ধীরে ধীরে সমুদ্রের মাঝখানে ডুবে যাচ্ছে। তার লাল কিরণছটাতে সমুদ্রের পানিও রক্তের মত লাল হয়ে গেছে। সে যে কি এক অপূর্ব দৃশ্য, তা যে দেখেছে, সে ছাড়া আর কেউ অনুভব করতে পারবে না। একটু পরে মাগরীবের আজানের ধ্বনি শুনে সেলিম সমুদ্র পাড়ের মসজিদে গিয়ে নামায পড়ল। তারপর সে আবার বেলাভূমিতে ফিরে এসে ধীরে ধীরে সমুদ্রের পানির কিনার ধরে কিছুক্ষণ হাঁটার সময় হঠাৎ ভূত দেখার মতো সে চমকে উঠল। একটা বোরখা পরা মেয়ে মুখ খোলা অবস্থায় তার পাশ দিয়ে চলে গেল। সে দ্রুত ঘুরে বলল, এই যে শুনুন।

লাইলী প্রতিদিনকার মতো সূর্যাস্ত দেখে নামায পড়ে হোটেলে ফিরছিল। কতলোক সূর্যাস্ত দেখতে আসে। সেলিমকে সে দেখেনি, অন্য নোক ভেবে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল। প্রথমে সেলিমের গলার আওয়াজ পেয়ে সে স্তম্ভিত হয়ে গেল। পরে তার মনে হল কেউ হয়তো অন্য কাউকে ডাকছে। সে সেলিমের চিন্তায় ছিল বলে হয়তো তার গলার মতো শুনতে পেয়েছে। সেইজন্য থমকে দাঁড়িয়ে আবার পথ চলতে শুরু করল।

সেলিম ততক্ষণ লাইলীর সামনে এসে তার পথ রোধ করে দাঁড়াল। আবছা অন্ধকার হলেও দুজন দুজনকে চিনতে পারল। বেশ কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলতে পারল না। দুজনেরই মনে হল, স্বপ্ন দেখছে। চোখে পানি এসে গেছে বুঝতে পেরে লাইলী মাথা নিচু করে নিল।

সেলিম মৃদুস্বরে ডাকল, লাইলী?

লাইলী অশ্রুভরা নয়নে তার দিকে শুধু চেয়েই রইল। শত চেষ্টা করেও তার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না, শুধু তার ঠোঁট দুটো নড়ে উঠল।

সেলিম বলল, তুমি আমার সঙ্গে কথাও বলবে না? জান, আমি ভালো হওয়ার পর থেকে তোমাকে পাগলের মত খুঁজে বেড়াচ্ছি? আর তুমি তোমার সেলিমকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছ। তারপর তার হাত দুটো নিজের বুকে ধরে রেখে বলল, আল্লাহপাকের দরবারে কোটি কোটি শুকরিয়া জানাই, তিনি এত তাড়াতাড়ি আমার প্রিয়তমাকে পাইয়ে দিলেন।

লাইলী থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে যাচ্ছিল।

সেলিম তাকে ধরে ফেলল। তারপর যখন বুঝতে পারল অজ্ঞান হয়ে গেছে, তখন তাকে পাজাকোলা করে পানির কাছে নিয়ে বসিয়ে একহাতে ধরে রেখে অন্য হাত দিয়ে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ কেটে যেতেও যখন তার জ্ঞান ফিরল না তখন তাকে আবার পাঁজাকোলা করে তুলে একটা বেবী ট্যাক্সিতে করে হোটেলের রুমে নিয়ে এসে বিছানায় শুইয়ে দিল। তারপর হোটেলের বয়কে দিয়ে ডাক্তার আনল।

ডাক্তার দেখে বললেন, ভয় পাবেন না, হঠাৎ মানষিক কারণে জ্ঞান হারিয়েছে। আমি একটা ইনজেকশন দিচ্ছি, এক্ষুণি জ্ঞান ফিরবে।

ডাক্তার ইনজেকশন দেওয়ার পাঁচ মিনিট পর লাইলীর জ্ঞান ফিরল। ঘরের চারিদিকে তাকিয়ে ধড়মড় করে উঠে বসে সেলিমের সঙ্গে ডাক্তারকে দেখে মাথার কাপড়টা টেনে দিয়ে মুখটা ঢেকে দিল। পানিতে বোরখা ভিজে গিয়েছিল বলে সেলিম রুমে এসে সেটা খুলে দিয়েছে।

ডাক্তার বললেন, আর কোনো চিন্তা নেই। সেলিম ডাক্তারকে বিদায় করে এসে দেখল, লাইলী জড়সড় হয়ে বসে আছে।

সেলিমকে ঘরে ঢুকতে দেখে সে খাট থেকে নেমে তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল।

সেলিম তার দিকে দু’হাত বাড়িয়ে ডাকল, ‘লাইলী।’

লাইলী আর স্থির থাকতে পারল না। সে ভুলে গেল এখনও তাদের বিয়ে হয়নি। সেলিম বলে ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে মাথা রেখে অশ্রু বিসর্জন করতে লাগল।

সেলিমেরও চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। তারা স্থির হয়ে অনেকক্ষণ ঐভাবে রইল। কেউ কোনো কথা বলতে পারল না। যখন তাদের মনের উত্তাল স্পন্দন ক্লান্ত হল তখন প্রথমে লাইলী বুঝতে পারল তার চোখের পানিতে সেলিমের অনেকখানি জামা ভিজে গেছে। লজ্জা পেয়ে আলিঙ্গন মুক্ত হয়ে বলল, দেখ কি করলাম, তোমার জামা একদম ভিজিয়ে দিয়েছি।

সেলিম লাইলীর আঁচল দিয়ে প্রথমে তার চোখ মুখ মুছে দিয়ে পরে নিজেরটা মুছতে মুছতে বলল, দু’জন প্রেমিক প্রেমিকা প্রেমের সাগরে ডুব দিয়েছিল। সাগরে তো পানি থাকবেই। তারপর তারা দু’টো চেয়ারে সামনা-সামনি বসে একে অপরের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর লাইলী বলল, এভাবে বসে থাকলে চলবে? ওদিকে মা ভীষণ চিন্তা করছে।

মায়ের কথা শুনে সেলিম জিজ্ঞেস করল, উনি এখন কেমন আছেন?

লাইলী বলল, একটু ভালোর দিকে।

তোমার হোটেলের ফোন নাম্বার ও রুম নাম্বারটা বল, মায়ের চিন্তা দূর করে দিই।

লাইলী ফোন নাম্বার বলল।

সেলিম ডায়েল করে হোটেলের ম্যানেজারকে বলল, এত নাম্বার রুমে দিন তো। তারপর লাইলীর হাতে রিসিভার দিয়ে বলল, মায়ের সঙ্গে কথা বল। বলবে তোমার ফিরতে আরও দেরি হবে, উনি যেন চিন্তা না করেন।

লাইলী সেলিমের কথামতো মায়ের সঙ্গে কথা বলে রিসিভার নামিয়ে রেখে বলল, আরো কত দেরি করাবে?

সেলিম বলল, আরও কিছুক্ষণ বস না, প্রাণ ভরে দেখি। বহুদিন পর তোমাকে পেলাম। ছাড়তে মোটেই মন চাইছে না। কি করি বল দেখি? আচ্ছা, আমাকে ছেড়ে যেতে তোমার মনে চাইছে?

লাইলী বলল, না। তোমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা মনে করলে কলজে মোচড় দিয়ে উঠছে। কিন্তু মায়ের কথা ভেবে নিজেকে সংযত করতে হচ্ছে।

সেলিম বলল, এক্ষুণি তোমাকে ছাড়ছি না। একবার ছেড়ে যা ভোগান ভুগিয়েছে, আর নয়। আগে বাঁধব, তারপর যা হয় হবে। তারপর ব্রিফকেস খুলে কিছু টাকা নিয়ে লাইলীকে সঙ্গে করে একটা বেবী ট্যাশ্রীতে উঠে বলল, কাজি অফিসে চল।

ডাইভার বলল, এখন তো কাজি অফিস বন্ধ হয়ে গেছে, স্যার।

হোক বন্ধ, আপনি চলুন।

ড্রাইভার কাজি অফিসের সামনে গাড়ি পার্ক করল।

সেলিম তাকে অপেক্ষা করতে বলে লাইলীকে নিয়ে অফিসের সামনে গিয়ে দেখল বন্ধ। তবে দরজার ফাঁক দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে। সে দরজায় ধাক্কা দিতে একজন প্রবীণ লোক বেরিয়ে এসে তাদেরকে দেখে বললেন, এখন অফিস বন্ধ হয়ে গেছে, আগামীকাল সকাল আটটায় আসুন।

সেলিম বলল, দেখুন আমরা ভোরেই এখান থেকে চলে যাব। আপনাকে অফিসের টাইমের বাইরে কাজ করার জন্য ওভার টাইম দেব। আপনি দয়া করে আমাদের কাজটা করে দিন।

কাজি সাহেব বললেন, সরকারী রেটের চেয়ে ডবল দিতে হবে। আর দুজন সাক্ষীর জন্য আলাদা চার্জও দিতে হবে।

সেলিম সবকিছুতে রাজি হয়ে ওদের বিয়ের কাবিন রেজিষ্ট্রি করে নিল। তারপর গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে বলল, একটা ভালো হোেটলের সামনে রাখবেন। আর লাইলীকে বলল, খেয়ে দেয়ে তোমাকে মায়ের কাছে পৌঁছে দেব। খাওয়া দাওয়া সেরে ওরা যখন হোটেলে পৌঁছাল তখন রাত্রি দশটা।

সেলিমকে সঙ্গে করে লাইলী যখন রুমে ঢুকল তখন হামিদা বানু ওজিফা শেষ করেছেন। সেলিমকে দেখে অবাক হয়ে ঘোমটা টেনে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ততক্ষণে লাইলী ও সেলিম একসঙ্গে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল। তারপর সেলিম বলল, আজ আমাদের কাবিন হয়ে গেছে। বাকি কাজ আগামীকাল চিটাগাং-এ গিয়ে সেরে নিতে চাই। আপনি আমাদেরকে দোয়া করুন মা।

সেলিমের কথা শুনে হামিদা বানু আরো অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি যেন কিছু বিশ্বাস করতে পারছেন না।

ওকে চুপ করে থাকতে দেখে সেলিম আবার বলল, আমার অসুখের সময় আমার মা আপনাদেরকে ভুল বুঝে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছেন। আমি সেজন্য খুব দুঃখিত। অনুগ্রহ করে আমাদের সবাইকে মাফ করে দিন। আমি এসবের কিছুই জানতাম না। এ্যাকসিডেণ্ট করে যখন স্মৃতিশক্তি ও বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম তখন চিকিৎসার জন্য সাত মাস বিদেশ ছিলাম, তাই এইরুপ অঘটন ঘটে গেছে। আপনার ছেলে যদি অন্যায় করে মাফ চাইত, তা হলে কি তাকে মাফ করতেন না? সেলিমের শেষের দিকের কথাগুলো কান্নার মত শোনাল। লাইলীর চোখ দিয়ে পানি টপটপ করে পড়তে লাগল।

হামিদা বানুর চোখও পানিতে ভরে উঠল। চোখ মুছে বললেন, সবই আল্লাহপাকের ইচ্ছা বাবা, তিনি তোমাদের মাফ করুন। আমরাও তোমাদেরকে ভুল বুঝে অন্যায় করেছি।

সেলিম বলল, না, না আপনারা কোনো অন্যায় করেননি। এই রকম ঘটনা ঘটলে সবাই তাই করতো। আমার মা যে ভুল করেছেন, সেটা আমি শুধরোতে চাই। আপনি আজ বিশ্রাম নিন। তারপর লাইলীর দিকে চেয়ে বলল, তুমি ভোরে উঠে সব গুছিয়ে নিয়ে রেডি হয়ে থাকবে। আমি এসে তোমাদেরকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যাব। আমরা কাল ফাষ্ট ফ্লাইটে চিটাগাং যাব। তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হোটেলে নিজের রুম ফিরে এসে এয়ারপোর্টে ফোন করে তিনটি টিকিট বুক করল। পরেরদিন ভোর ছ’টার প্লেনে সেলিম লাইলীকে ও হামিদা বানুকে নিয়ে প্রেনে উঠল।

বেলা আটটার সময় সাহেবকে দুজন মহিলাসহ গাড়ি থেকে নামতে দেখে জাভেদ দোতলা থেকে ছুটে নেমে এল। তখনও অফিস খুলেনি। বেলা নয়টায় অফিস খুলে। সেলিম জাভেদকে আসসালামু আলাইকুম দিয়ে বলল, গাড়ি থেকে সব মালপত্র নিয়ে উপরে এস।

সাহেবকে আগে সালাম দিতে শুনে জাভেদ লজ্জায় এতটুকু হয়ে সালামের উত্তর দিতে ভুলে গেল।

সেলিম তার অবস্থা দেখে বলল, এতে লজ্জা বা অবাক হওয়ার কিছু নেই। হাদিসে আছে না যে আগে সালাম দিবে সে উত্তর দাতার চেয়ে নই গুণ সওয়াব বেশি পাবে? তারপর সে ওদেরকে নিয়ে উপরে চলে গেল।

জাভেদ মালপত্র গাড়ি থেকে নামাবার সময় ভাবল, সাহেব গেলেন একা, এলেন তিনজন। উনারা কে হতে পারে যেই হোক না কেন তাতে আমার কি ভেবে মালপত্র নিয়ে উপরে এল।

উপরে পাঁচ কামরা ঘর। একটাতে সেলিম আর একটাতে জাভেদ থাকে। বাকি রুমগুলো খালি পড়ে থাকে। জাভেদ মালপত্র উপরে নিয়ে এলে সেলিম তাকে বলল, তুমি পাশের রুমটা পরিষ্কার কর, আর শেষের রুমটায় তুমি থকবে। তোমার মালপত্র নিয়ে সেখানে রেখে এস। আমার রুমের পাশেরটা উইংরুম আর তার পাশেরটা আর একটা বেডরুম করবে। আমি সেই মত আসবাবপত্র পাঠিয়ে দিচ্ছি। তোমার এখন অনেক কাজ। দেখছ না, মেহমান এসেছে। বাজার করে এনে ভালো করে রান্না করবে। তারপর কিছু টাকা তার হাতে দিয়ে বলল, যাও তাড়াতাড়ি কর। আর শোন, এখন আগে আমাদের নাস্তার ব্যবস্থা কর।

নাস্তা খেয়ে সেলিম হামিদা বানুকে বলল, মা, আপনি বিশ্রাম নিন। আমরা একটু বাইরে যাব। তারপর লাইলীকে সাথে করে মার্কেটে গিয়ে ঘরের প্রয়োজনীয় সব আসবাবপত্র কিনে দোকানের ম্যানেজারকে ঠিকানা দিয়ে পাঠিয়ে দিতে বলল। তারপর কাপড়ের দোকানে গিয়ে কয়েকটা দামী শাড়ী ও গহনার দোকানে গিয়ে কয়েক সেট সোনার অলঙ্কার কিনে বাসায় ফিরল।

ততক্ষণে জাভেদ ফার্নিচারগুলো পাশের দুটি রুমে সাজিয়ে দিয়ে রান্নার কাজে লেগে গেছে। হামিদা বানু রান্নাঘরে এসে তার সঙ্গে রান্নার তদারক করছেন।

সেলিম ম্যানেজার সাহেবকে উপরে ডেকে পাঠালে তিনি সেলিমের ঘরে এসে লাইলীকে দেখে অবাক হলেন।

ম্যানেজার সাহেবকে বসতে বলে সেলিম বলল, আপনি বোধ হয় শুনে থাকবেন, আমার পছন্দ করা মেয়েকে আমার মা পুত্রবধূ করবেন বলে আমাদের বাড়ির এক ফাংশানে তাকে বালা পরিয়ে সকলের সামনে ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ আমরা তাকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। সেই মেয়েটি ভাগ্যের অন্বেষণ আমদের এই অফিসে না জেনে চাকরি নেয়। তারপর লাইলীকে দেখিয়ে বলল, আপনার ষ্টেনোকে নিশ্চয় চিনতে পারছে। অফিসে ওর ফটো দেখে কক্সবাজার থেকে অনেক কষ্ট করে নিয়ে এসেছি। কারণ এই সেই মেয়ে, যার সঙ্গে আমার বিয়ের পাকা কথা হয়েছিল। গতকাল কক্সবাজারে কাবিন করেছি। আপনি আমার বাবার বয়েসী। আজকেই আমাদের বাকি কাজগুলো আপনাকে সেরে দিতে হবে। আর চাচি মাকে এক্ষুণি আনার ব্যবস্থা করুন।

এতক্ষণ লাইলী লজ্জায় মাথা নিচু করে ছিল। এবার আস্তে আস্তে এসে ম্যানেজার সাহেবের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল।

ম্যানেজার সাহেব বললেন, থাক মা, বেঁচে থাক। আল্লাহপাকের কাছে দোয়া করি, তিনি তোমাদেরকে সুখী করুন। তারপর সেলিমের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি নিশ্চিন্ত থাক, আমি সব ব্যবস্থা করছি।

ম্যানেজার সাহেব চলে যাওয়ার উপক্রম করলে সেলিম বলল, আর একটা কথা, আজ রাত্রে সব অফিস স্টাফকে বিয়ের দাওয়াত দিবেন।

ম্যানেজার সাহেব সম্মতি জানিয়ে চলে গেলেন।

ম্যানেজার সাহেব চলে যাওয়ার পর লাইলী সেলিমকে বলল, আমার প্রাণের সই সুলতানা এখানে আছে। তার স্বামী এখানকার মেডিকেল কলেজের মেডিসিনের পফেসর। তাদেরকে দাওয়াত দিয়ে আনার ব্যবস্থা কর। তা না হলে সই ভীষণ মনে কষ্ট পাবে।

সেলিম বলল, তোমার সই তো আমাকে চেনে না। তুমি বরং একটা চিঠি লিখে দাও।

তা দিচ্ছি, তবে আমার সই তোমাকে চেনে।

তা চিনতে পারে। কত মেয়েই তো আমাকে চেনে। অথচ আমি তাদের অনেককে চিনি না।

লাইলী একটা চিঠি লিখে সেলিমের হাতে দিল।

সেলিম চিঠি নিয়ে ঠিকানা অনুযায়ী গিয়ে দরজা নক করল।

খালেদ মেডিকেলে চলে গেছে। সুলতানা ময়নার মাকে রান্নার আইটেম বাতলে দিয়ে এসে একটা গল্পের বই পড়ছিল। অসময়ে দরজায় আওয়াজ শুনে বিরক্তির সঙ্গে দরজা খুলে সেলিমকে দেখে অবাক হয়ে বলল, সেলিম ভাই তুমি? এতদিন কোথায় ছিলে? এস ভিতরে এস।

সেলিম ভিতরে এসে ভাবল, লাইলীর কথাই ঠিক। মেয়েটি আমাকে চেনে অথচ আমি তাকে চিনি না। কিন্তু এ কেমন করে হয়? শেষে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, আমাকে চিনলেন কেমন করে? অথচ আমি আপনাকে তো চিনি না।

সুলতানা বলল, তুমি আমাকে আপনি করে বলছ কেন? আমি ছেলেবেলা থেকে তোমাকে চিনি। আর সঙ্গে কয়েকবার তোমাদের বাসায় গেছি। তোমার আর সঙ্গে আমাদের দূরের কি রকম একটা সম্পর্ক ছিল। সে তো ছোটকালের কথা। বড় হয়ে ভার্সিটিতে তোমাকে অনেক দেখেছি। তা ছাড়া আমার সই এর লাভার হিসাবে তোমাকে আরও বেশি চিনি।

সেলিম বলল, এখন বুঝলাম। তারপর লাইলীর চিঠিটা বের করে সুলতানার হাতে দিল। এবার সুলতানার অবাক হওয়ার পালা। চিঠি খুলে পড়তে লাগল—সই, আল্লাহপাকের দরবারে লক্ষ লক্ষ শুকরিয়া জানিয়ে তোকে জানাচ্ছি যে, এক্ষুণি আমাদের শুভ কাজ হতে যাচ্ছে। তুই চিঠি পেয়েই সয়াকে সাথে নিয়ে ওর সঙ্গে চলে আসবি। সাক্ষাতে সব কিছু বলব।

ইতি–

তোর সই লাইলী।

চিঠি ভাঁজ করে সেলিমের দিকে চেয়ে বলল, সুবহান আল্লাহ। আল্লাহ তোমার কুদরত বোঝা মানুষের অসাধ্য। যাই হোক, সই এর যখন হুকুম তখন অমান্য করতে পারি না। চা পাঠিয়ে দিচ্ছি খাও, আমি ততক্ষণে তৈরী হয়ে নিই। কথা শেষ। করে কিচেনে গিয়ে ময়নার মাকে মেহমানকে চা দিতে বলল। তারপর স্বামীকে ফোন করে সংক্ষেপে সব কিছু বলে এক্ষুণি বাসায় আসতে বলল। তারপর পোশাক পরিবর্তন করে সেলিমের কাছে এসে তার অতীত জীবনের সমস্ত কথা শুনতে লাগল।

ঘণ্টা খানেকের মধ্যে খালেদ এসে গেল। সেলিমের সঙ্গে সালাম ও পরিচয় বিনিময়ের পর সকলে রওয়ানা হল।

ম্যানেজার সেলিমের কাছ থেকে ফিরে এসে অফিসের সমস্ত ষ্টাফকে নিজের রুমে ডেকে পাঠালেন। সকলে এলে ম্যানেজার সাহেব বললেন, আপনাদেরকে একটা আশ্চর্যজনক আনন্দ সংবাদ জানাবার জন্য ডেকেছি। আমাদের এখানে যে মেয়েটা ষ্টেনোর কাজ করছে, সে আমাদের সাহেবের বাগদত্ত। সাহেব এ্যাকসিডেণ্ট করে বিদেশে চিকিৎসার জন্য চলে গেলে, মেয়েটি ভাগ্যের ফেরে না জেনে এখানে চাকরি নেয়। সাহেব অফিসে আপনাদের সবার বায়োডাটা দেখার সময় মেয়েটির ফটো দেখে চিনতে পারে। আর আমাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে, সে কক্সবাজার বেড়াতে গেছে। তাই সেদিন বিকেলে কক্সবাজারে গিয়ে তাকে নিয়ে ফিরে এসেছে। আজ তার সঙ্গে সাহেবের সন্ধ্যার পর বিয়ে হবে। আপনারা সকলেই বিয়েতে আমন্ত্রিত।

ম্যানেজারের কথা শুনে সকলে আশ্চর্য হয়ে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগল, আমরা মেয়েটিকে যা-তা বলে খুব অন্যায় করেছি।

তাদেরকে ফিস ফিস করে কথা বলতে শুনে ম্যানেজার সাহেব আবার বললেন, আপনারা এখন যে যার কাজ করুন গিয়ে, সন্ধ্যার পর সকলেই বাসায় আসবেন।

সেলিম সুলাতানা ও খালেদকে নিয়ে ফিরে এল। ওরা ড্রইংরুমে এসে বসল। লাইলী সুলতানাকে নিয়ে বেডরুমে ঢুকে জড়িয়ে ধরে বলল, সই, আমি যে এখনও নিজেকে বোঝাতে পারছি না, এটা বাস্তব না স্বপ্ন।

সুলতানা বলল, আমিও তোর চিঠি পেয়ে অবাক হয়ে ভাবলাম, এটা বাস্তব না স্বপ্ন। এখন দেখছি সব বাস্তব। আল্লাহ তোদের সুখী করুক ভাই। একটা সোনার নেকলেস ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে বের করে লাইলীর গলায় পরিয়ে দিয়ে বলল, এটা আমাদের তরফ থেকে তোকে উপহার দিলাম।

শুধু শুধু এত দামী জিনিষ দিতে গেলি কেন তোর ভালবাসাকে আমি এর চাইতে দামী মনে করি।

সেই ভালবাসার নমুনা স্বরূপই তো এটা তোকে উপহার দিলাম। যাকে ভালবাসি, তাকে কি আর কম দামী জিনিষ দিতে পারি?

তোর খালেদ সাহেবের চেয়েও কি আমাকে বেশি ভালবাসিস? বলে হেসে ফেলল।

দূর পাগলী, তোকে আর তাকে ভালবাসার মধ্যে অনেক পার্থক্য।

সে আবার কি রকম?

অত ন্যাকা সাজিসনি। তবু বলছি শোন, তুই তো খালাম্মা আর সেলিমকে খুব ভালবাসিস। কেউ যদি তোকে জিজ্ঞেস করে, দুজনের মধ্যে কাকে বেশি ভালবাসিস, তখন কি বলবি?

বলব দুজনকেই বেশি ভালবাসি। এই কথায় দুজনেই হেসে উঠল।

বিয়ে পড়াবার আগে সুলতানা সইকে মনের মত করে সাজাল। তারপর ড্রেসিং টেবিলের আয়নার কাছে নিয়ে গিয়ে বলল, দেখতো সই, ঐ মেয়েটিকে চিনতে পারিস কি না?

লাইলী আয়নার দিকে চেয়ে সত্যি নিজেকে চিনতে পারল না। তার মনে হল, আয়নার মেয়েটি অন্য কেউ, লাইলী নয়।

কিরে চুপ করে আছিস কেন তারপর গাল টিপে দিয়ে বলল, সত্যি আল্লাহ তোকে এত রূপ দিয়ে বানিয়েছেন, সে আর কি বলব। তিনি যদি আমাকে পুরুষ করে বানাতেন তা হলে তোকে হাইজ্যাক করে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করতাম। সেলিম খুব ভাগ্যবান। তার ভাগ্যকে আমি মেয়ে হয়েও হিংসা করছি।

লাইলী নিজের প্রশংসা শুনে লজ্জা পেয়ে বলল, তুই বুঝি দেখতে খারাপ, তোর মত রূপ কটা মেয়ের আছে শুনি।

তোর কথা মানি, কিন্তু আমার সই অদ্বিতীয়া।

রাত্রি এগারোটায় বিয়ের কাজ ও খাওয়া-দাওয়া মিটে গেল। আমন্ত্রিত অতিথিরা সব বিদায় নিয়ে চলে গেল। শুধু খালেদ স্ত্রীকে নিয়ে যাবে বলে খালেদ বরবেশি সেলিমের সঙ্গে উইংরুমে বসে বসে গল্প করতে লাগল। সুলতানা বাসর ঘর সাজাতে ব্যস্ত। একটু পরে লাইলীকে বাসর বিছানায় বসিয়ে রেখে ড্রইংরুমে এসে সেলিমের হাত ধরে সীত হাস্যে বলল, চল ভাই, তোমার প্রিয়তমা তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে। যাওয়ার সময় স্বামীর দিকে চেয়ে বলল, তুমি একটু অপেক্ষা কর, আমি কপোতকে কপোতীর কাছে দিয়ে এক্ষুণি আসছি। তারপর এক রকম জোর করে সেলিমকে নিয়ে এসে বাসর ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, আল্লাহপাকের উপর ভরসা করে আমার সইকে তোমার কাছে দিয়ে গেলাম। দেখবেন, সে যেন কোনো বিষয়ে কষ্ট না পায়। কষ্ট দিলে ভালো হবে না বলে দিচ্ছি। আল্লাহ তোমাদের সুখি করুন। আজ আসি আবার দেখা হবে। তারপর আল্লাহ হাফেজ বলে দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে স্বামীর কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, কি গো, আমার সই-এর বাসর রাত্রির কথা ভেবে তোমারও কী আমাকে নিয়ে বাসর করার ইচ্ছে হচ্ছে নাকি।

খালেদ হেসে বলল, তোমার অনুমান ঠিক। তবে আমার মন বলছে, তোমার মনের ইচ্ছটা আমার উপর দিয়ে বলে ফেললে। তারপর লাইলীর মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দুজনে হাসতে হাসতে বাসায় ফেরার জন্য গাড়িতে উঠল।

সেলিম বাসর ঘরে ঢুকে লাইলীর দিকে চেয়ে এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। যখন বুঝতে পারল সুলতানা ও খালেদ চলে গেছে, তখন ধীরে ধীরে খাটের কাছে গেল। লাইলী খাটের উপর বসে তার দিকে চেয়ে ছিল। সেলিম এগিয়ে এসে খাটের কাছে দাঁড়াতে খাট থেকে নেমে তার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল।

সেলিম তাকে দুহাতে পাজাকোলা করে তুলে নিয়ে তার কপালে চুমু খেয়ে সুবহান আল্লাহ বলে তার দিকে অপলক নয়নে চেয়ে রইল। সে লাইলীর রূপের ঐশ্বর্যের মধ্যে ডুবে গেল। আগেও তো সে কতবার দেখেছে, কিন্তু এখনকার লাইলী যেন অন্য মেয়ে। তার মনে হল, বেহেস্তের হুর আসমান থেকে নেমে এসে তার হাতে ধরা দিয়েছে। বিয়ের পোশাকে ও নানারকম অলঙ্কারে সজ্জিত লাইলী যেন

আসমান জমিনের সব রূপ কেড়ে নিয়েছে। সেলিম সেই রূপের সাগরে তলিয়ে গিয়ে। বাহ্যিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।

অনেকক্ষণ ঐভাবে তাকে নিয়ে সেলিমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লাইলী তার পূর্ব অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারল, সেলিম নিশ্চয় বাহ্যিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। সে তখন দু হাত দিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরে মুখে মুখ ঘসে বলল, এই, তোমার কষ্ট হচ্ছে না? হাত ব্যাথা করবে তো, আমাকে নামাও না। তবু যখন সেলিমের হুঁস হল না তখন সেলিমের ঠোটু নিজের মুখের মধ্যে নিয়ে আস্তে কামড়ে ধরে রইল।

এবার সেলিম সজ্ঞানে ফিরে এল। তারপর সে লাইলীর সারা মুখে চুমোয় ভরিয়ে দিয়ে শেষে তার লাল গোলাপী ঠোঁটে ঠোঁট রেখে ফিস ফিস করে বলল, তুমি আমার ঠোঁট কামড়ে দিয়েছ, আমি তার শোধ তুলে নিই?

লাইলী মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে লজ্জায় চোখ বন্ধ করে নিল। সেলিম তার নরম তুল তুলে ঠোঁটে নিজের ঠোঁট দিয়ে একটু চাপ দিয়ে বলল, সেই আল্লাহপাকের দরবারে কোটি কোটি শুকরিয়া জানাই, যিনি তোমাকে আমার সহধর্মিণী করেছেন। তারপর খাটে বসে লাইলীকে কোলের উপর রেখে জিজ্ঞেস করল, বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ায় আমার প্রতি তোমার খুব রাগ হয়েছিল তাই না?

লাইলী অপূর্ণ চোখে তার দিকে চেয়ে বলল, আমার অন্তর্যামী জানেন, আমি তোমার কখনো দোষ খুঁজেছি কি না বা তোমাকে দোষী মনে করেছি কি না। ভেবেছি, আমার মত হতভাগিণী তোমার অযোগ্য, তাই এইরূপ হয়েছে। আজ যদি আব্বা বেঁচে থাকতেন, তা হলে সব থেকে বেশি খুশি হতেন।

সেলিম তার টস টসে রক্তিম গোলাপী ঠোঁটে আঙ্গুল ঠেকিয়ে বলল, চুপ। তোমাকে একদিন বারণ করেছিলাম না, নিজেকে কোনোদিন হতভাগিণী বলবে না? তারপর অধরে অধর ঠেকিয়ে বলল, প্রতিজ্ঞা কর, আর কখনও একথা বলবে না।

লাইলী আস্তে করে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।

সেলিম লাইলীকে পাশে বসিয়ে বলল, এস চাচাজানের রূহের মাগফেরাত কামনা করে আল্লাহপাকের দরবারে দোয়া চাই। মোনাজাত শেষে লাইলী স্বামীর দুটো হাত নিজের মাথায় রেখে বলল, তুমি দোয়া কর, আমি যেন কখনও তোমার প্রেমের অমর্যাদা না করি।

সেলিম দোয়া করে বলল, আমি সত্যি তোমাকে নিজের করে পেয়েছি, না এখন ও স্বপ্ন দেখছি।

লাইলী তার বুকে মাথা রেখে বলল, আল্লাহপাক যেন সারাজনম আমাদের এই স্বপ্ন না ভাঙ্গেন।

সেলিম লাইলীর কাছ থেকে সব ঘটনা জেনে নিয়ে বলল, ঐ রকম একটা চিঠি মাও পেয়েছে। মা যেদিন চিঠি পায়, সেদিন আমি এ্যাকসিডেণ্ট করি। তাই সে তোমাকে অপয়া ভেবে বিয়ে ভেঙ্গে দেয়। আমি মায়ের সে ভুল ভাঙ্গিয়ে দেব। তুমি মায়ের উপর মনে কোনো কষ্ট রাখনি তো?

লাইলী বলল, আব্বা যেদিন গহনা ফেরৎ দিয়ে এলেন, সেদিন রাত্রেই হার্টের ব্যাথায় মারা যান। তখন খালা আম্মাকে দায়ী মনে করে তার উপর আমার মনে কষ্ট হয়েছিল, কিন্তু পরে যখন আমার বিবেক বলল, কারুর মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী হয় না, হায়াত মউত একমাত্র আল্লাহপাকের হাতে। তুমি না তকদীর বিশ্বাস কর? তিনি যদি তোমাকে তার জোড়া করে পয়দা করে থাকেন, তা হলে বিয়ে ভেঙ্গে গেলেও জোড়া লাগতে কতক্ষণ তিনি সর্বশক্তিমান। যখন যা কিছু করার ইচ্ছে করেন, তখন শুধু বলেন, হও, আর তা তখুনি হয়ে যায়। এইসব চিন্তা করার পর থেকে তার প্রতি আমার মনের কষ্ট দূর হয়ে গেছে।

সেলিম লাইলীকে জড়িয়ে ধরে আবার সারামুখে চুমোয় ভরিয়ে দিয়ে বলল, আল্লাহপাক তার এক প্রিয় বান্দীর স্বামী করে আমাকে ধন্য করেছেন। সেই জন্যে আবার তার দরবারে লাখ লাখ শুকরিয়া জানাচ্ছি।

লাইলীও তার স্বামীর সোহাগের প্রতিদান দিয়ে বলল, ইয়া আল্লাহ, তুমি তোমার এই নগণ্য বান্দীকে স্বামীর খেদমত করে তাকে সুখী করার তৌফিক দাও।

সে রাত্রে তারা ঘুমোতে পারল না। সারারাত প্রেমালাপ করে কাটাল। দুজনেরই মনে হয়েছে ঘুমিয়ে পড়লে যদি এই মধুময় স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। ফজরের আজান শুনে সেলিম বলল, আল্লাহপাক আজকের রাতটাকে বড় ছোট করে তৈরি করেছেন।

লাইলী মৃদু হেসে বলল, সুখের রাত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। তারপর দুজনে একসঙ্গে ফজরের নামায পড়ে সেলিম বলল, এস, এবার একটু ঘুমিয়ে নিই।

লাইলী বলল, উঠতে বেলা হয়ে গেলে মা কি মনে করবেন? আমার লজ্জা করবে না বুঝি?

সেলিম বলল, মা সবকিছু জানেন। উনি কিছু মনে করবেন না। তারপর তারা আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

লাইলীর যখন ঘুম ভাঙল তখন দেয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং আওয়াজ করে বেলা নটা ঘোষণা করল। দেখল, এখনও সেলিম তাকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। তার ঠোঁটে আস্তে করে একটা হাম দিয়ে খুব ধীরে ধীরে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে বাথরুমে গেল। ফিরে এসে ড্রেস চেঞ্জ করে সেলিমের পাশে বসে তার পায়ে হাত বুলিয়ে ঘুম ভাঙাবার চেষ্টা করল।

সেলিমের ঘুম ভেঙে গেল। ধীরে ধীরে চোখ খুলে লাইলীকে বুকে টেনে নিল।

কিছুক্ষণ স্থির থেকে লাইলী বলল, এই, এবার উঠে পড়। সাড়ে নয়টা বাজে, আমি এখন মায়ের কাছে যাব কি করে? ভীষণ লজ্জা করছে।

সেলিম তাকে আদর করতে করতে বলল, একজন পুরুষের বুকের উপর শুয়ে থাকতে লজ্জা করছে না বুঝি?

লাইলী বলল, ধ্যেৎ, তুমি পুরুষ হতে যাবে কেন?

তা হলে আমি কি মেয়ে মানুষ?

মেয়ে মানুষও না পুরুষও না। তুমি যে আমার শাহানশাহ। আর আমাকে আল্লাহপাক সেই শাহানশাহর চরণের সেবা করার জন্য আইনের মাধ্যমে বেঁধে দিয়েছেন। তারপর তার ঠোঁটে ঠোঁট রেখে বলল, এভাবে অনন্তকাল থাকতে চাই, কিন্তু কর্তব্য বলে তো একটা কথা আছে। সোনা যে, এবার উঠে হাতমুখ ধুয়ে নাও। এখানে মা না থাকলে তোমাকে ছেড়ে উঠতাম না।

তোমার সাথে তর্কে কোনোদিন পারব না বলে সেলিম উঠে বাথরুমে গেল। ফিরে এলে লাইলী তোয়ালে এগিয়ে দিল।

সেলিম বলল, মায়ের কাছে যাবে না।

লাইলী বলল, যাব তো; কিন্তু একজন ভদ্রলোক আমাকে এমন বিপদে ফেলেছেন যে, আমি এখন লজ্জায় মায়ের কাছে যেতে পারছি না।

তা হলে তো ভদ্রলোকটার শাস্তি হওয়া উচিৎ। দেবে নাকি শাস্তি বলে সেলিম মুখটা তার ঠোঁটের কাছে নিয়ে গেল।

লাইলী তার ঠোঁটে খুব আস্তে করে কামড়ে দিতে সেলিম ওকে জাপটে ধরল। লাইলী বলল, অপরাধ বেশি হয়ে যাচ্ছে।

সেলিম বলল, আমিও শাস্তি বেশি পেতে চাই।

লাইলী বলল, হার মানছি, প্রীজ ছেড়ে দাও। চল দুজনে আম্মাকে সালাম করব। কালকেই সালাম করা উচিৎ ছিল। কিন্তু আমরা নিজেদেরকে নিয়ে এমনই মশগুল ছিলাম যে, সে কথা কারুরই মনে আসেনি। তার দোয়া নেওয়া উচিত।

সেলিম তাকে আলিঙ্গন মুক্ত করে বলল, চল। তারপর বলল, সত্যি তোমার বুদ্ধির তারিফ না করে পারছি না। আল্লাহ তোমাকে রূপের সঙ্গে সবকটা গুণও দিয়েছেন। আর দেরি করে লাভ নেই বলে সে তার হাত ধরে এগোতে গেল।

লাইলীকে দাঁড়িয়ে মিটি মিটি হাসতে দেখে বলল, কি হল যাবে না?

শুধু গেঞ্জী গায়ে দিয়েই যাবে নাকি?

সেলিম নিজের শরীরের দিকে চেয়ে বলল, তাই তো লাইলী ততক্ষণে তার জামাটা এনে হাতে দিল। তারপর দুজনে মায়ের ঘরে গেল।

হামিদা বানু জাভেদের সঙ্গে নাস্তা তৈরী করে সবেমাত্র বসে বসে মেয়ের ভাগ্যের কথা চিন্তা করছিলেন। তাদেরকে আসতে দেখে বললেন, এস বাবা এস।

ওরা পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল।

হামিদা বানু দুজনকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমা খেয়ে দোয়া করলেন, আল্লাহপাক তোমাদের দুজনকে অক্ষে ওশ্মর করুন। তোমাদের সুখী করুন। লাইলীর আব্বা বেঁচে থাকলে বড় খুশি হতেন।

সেলিম বলল, আল্লাহপাক তার রূহের মাগফেরাত দিন। তাঁকে কাঁদতে দেখে সেলিম আবার বলল, আম্মা, আপনি কাঁদবেন না। সবকিছু আল্লাহপাকের ইচ্ছা। তারপর লাইলীকে বলল, তুমি নাস্তার ব্যবস্থা কর।

হামিদা বানু চোখ মুখ মুছে বললেন, তোমরা এখানে বস, নাস্তা তৈরি আছে। আমি জাভেদকে নিয়ে আসছি।

নাস্তা খেয়ে রুমে ফিরে এসে সেলিম বলল, নিচেই তো অফিস। যাওয়ার পারমিসান চাই। দর হলে আজ অবশ্য যেতাম না।

লাইলী জামা-কাপড় এগিয়ে দিয়ে বলল, তোমার অফিসের ষ্টেনো কি করবে? তার চাকরি আছে তো?

সেলিস বলল, সে ম্যানেজার সাহেবের ষ্টেনো ছিল। তাকে মালিক প্রমোশন দিয়ে পার্টনার করে নিয়েছে। এখন সেও কোম্পানীর মালিক। মালিক তো আর নিজের অফিসে ষ্টেনোর কাজ করতে পারে না।

লইলী বলল, দুজন মালিকের মধ্যে একজন যখন অফিসের স্টাফের মত কাজ করতে পারে, তখন অন্যজনই বা পারবে কেন।

দোষ আছে বলে আমি বলছি না। অন্য জন পুরুষ হলে কোনো কথা ছিল না। তিনি একজন মহিলা। যিনি বর্তমানে একজনের স্ত্রী। বিয়ের পর মেয়েদের আগের জীবনের সবকিছু পরিত্যাগ করে স্বামীকে সন্তুষ্ট রাখার কাজ করবে।

লাইলী এরপর আর কিছু বলতে পারল না। কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বলল, ঠিক একটায় আসবে কিন্তু। তারপর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে উঠে দাঁড়াল।

সেলিম তাকে জড়িয়ে ধরে তার গোলাপী নরম ঠোঁটে চুমো খেয়ে বলল, তাই হবে, আসি, আল্লাহ হাফেজ।

লাইলীও বলল, আল্লাহ হাফেজ।

প্রতিদিন অফিসের পর সেলিম লাইলীকে নিয়ে বেড়াতে যায়। ছুটির দিনে সুলতানাদের বাসায় হৈ হুল্লোড় করে দিন কাটায়।

বিয়ের পর লাইলী সব কিছু জানিয়ে রহিমা ভাবিকে চিঠি দিয়েছে। তারা লাইলীর পত্র পেয়ে আল্লাহর কাছে শোকর গুজারী করেছে।

একদিন লাইলী স্বামীকে বলল, আম্মাকে পত্র দিয়ে তোমাদের বাড়ির সবাইকে আমাদের বিয়ের কথা জানাবে না?

সেলিম বলল, না, আর কয়েকদিন পর দুজনে এক সঙ্গে গিয়ে সবাইকে অবাক করে দেব। সেইজন্য ম্যানেজারকেও জানাতে নিষেধ করে দিয়েছি।

প্রায় মাসখানেক পর সেলিম আরিফের টাঙ্কল পেল, মা খুব অসুস্থ, তুমি আজই আসবার চেষ্টা করবে। সেলিম ম্যানেজারকে ডেকে বলল, মা অসুস্থ, আরিফ ট্রাঙ্কল করেছে। আমি আজই যেতে চাই। আপনি বিমান অফিসে ফোন করে দেখুন, তিনটে সীট পাওয়া যাবে কিনা। যদি না পাওয়া যায়, তা হলে গাড়ি নিয়ে যাব। আপনি তাড়াতাড়ি ব্যাবস্থা করুন।

ম্যানেজার সাহেব বিমান অফিসে ফোন করে জেনে বলেন, একটা সীটও খালি নেই।

সেলিম বলল, ঠিক আছে আমি গাড়ি নিয়ে যাব।

স্বামীকে দুপুরের আগেই মন ভার করে আসতে দেখে লাইলী সালাম দিয়ে এগিয়ে এলে তার একটা হাত ধরে জিজ্ঞেস করল, তোমার কী শরীর খারাপ?

সেলিম সালামের জবাব দিয়ে তাকে উদ্বিগ্ন হতে দেখে জড়িয়ে ধরে বলল, আরিফ ট্রাঙ্কল করেছে, মায়ের অসুখ। আমি এক্ষুণি রওয়ানা হতে চাই। প্লেনে সীট নেই, তাই ঠিক করেছি, অফিসের গাড়ি নিয়ে যাব।

সেলিমের কথাগুলো লাইলীর কানে কান্নার মতো শোনাল। তার বুকে মাথা রেখে বলল, আল্লাহপাক আম্মাকে সহিসালামতে রাখুন। তুমি হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে একটু বিশ্রাম নাও। আমি মাকে নিয়ে সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছি।

সেলিম সবাইকে নিয়ে বেলা দুটোয় রওয়ানা দিল। গাড়িতে লাইলী জিজ্ঞেস করল, আরিফ কে?

সেলিম বলল, আরিফ আমার ছোট ভাই। ম্যাটিক পাশ করে ধর্মের দিকে খুব ঝুঁকে পড়ে। ধর্মের জ্ঞান আহরণের জন্য আজ থেকে প্রায় পাঁচ ছ বছর আগে কাউকে কিছু না জানিয়ে দেওবন্দ চলে গিয়েছিল। সেখানে পড়াশুনা শেষ করে মাস দুয়েক হল ফিরে এসেছে।

রাত্রি আটটায় ওরা ঢাকার বাড়িতে এসে পৌঁছাল। গাড়ির শব্দ শুনে আরিফ, রুবীনা ও আসমা ঘর থেকে বেরিয়ে এল। তারা এতক্ষণ সোহানা বেগমের কাছে ছিল। তার আজ এক সপ্তাহ খুব জ্বর। গতকাল ডাক্তার বলেছে, টাইফয়েডের লক্ষণ। তাই আরিফ সেলিমকে আসার জন্য ট্রাঙ্কল করেছিল। সেলিমের সঙ্গে লাইলীকে এবং আধা বয়সী একজন মহিলাকে দেখে ওরা সবাই অবাক হয়ে গেল।

সেলিম আরিফের সঙ্গে সালাম বিনিময় করে লাইলীকে দেখিয়ে বলল, তোদের ভাবি, আর উনি আমার শ্বাশুড়ী।

আসমা একরকম ছুটে এসে লাইলীকে জড়িয়ে ধরে বলল, ভাবি আপনি কেমন আছেন

সেলিম বলল, আসমা কি হচ্ছে? আগে মায়ের কাছে চল, মা কেমন আছে?

আসমা ভাবিকে ছেড়ে দিল। আরিফ ডাক্তারের কথাগুলো বলল। সকলে সোহানা বেগমের ঘরে এসে ঢুকল। উনি শুয়ে ছিলেন। জ্বর এখন একটু কম, রাত্রে বেশি বাড়ে। ওদের দেখতে পেয়ে আস্তে আস্তে উঠে হেলান দিয়ে বসলেন।

সেলিম মায়ের পায়ের কাছে বসে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বলল, তুমি এখন কেমন আছ মা সোহনা বেগম ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে চুমো খেয়ে বললেন, এখন একটু সুস্থ বোধ করছি।

ততক্ষণে লাইলী এসে সোহানা বেগমের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আপনি আমাদের দুজনকে মাফ করে দিন মা।

সোহানা বেগম সবকিছু বুঝতে পারলেন। তিনি লাইলীকে জড়িয়ে ধরে তার মাকে কাছে এসে বসতে বলে বললেন, তোমরা কোনো অন্যায় করনি। যা কিছু করেছি আমি। তোমাদেরকে ভুল বুঝেছিলাম। সেলিম ভালো হয়ে সেদিন যে কথা বলেছে, তাতেই আমার ভুল ভেঙ্গে গেছে। তারপর হামিদা বানুর হাত ধরে বললেন, বেয়ান সাহেবা, আপনি আমাকে মাফ করে দিন। লাইলীর আব্বা এলেন না যে, তিনি বুঝি এখনও আমার উপর রাগ করে আছেন?

সেলিম বলল, মা তিনি অনেকদিন আগে ইন্তেকাল করেছেন।

সোহানা বেগম অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন, আল্লাহ তার ভালো করুন। সেদিন তার প্রতি ভালো ব্যবহার করিনি। তার কাছে ক্ষমা চাওয়া হল না। তারপর আঁচলে চোখ মুছে সকলের দিকে তাকিয়ে বললেন, হ্যারে, এ বাড়ির বড় বৌ প্রথম বাড়িতে এল, তোরা একটু আনন্দ করবি না? আরিফকে বললেন, তুই দোকান থেকে মিষ্টি আনতে দে। আর তোমরা সব দাঁড়িয়ে আছ কেন? বৌমাকে তার ঘরে নিয়ে যাও, অনেক দুর থেকে এসেছে, বিশ্রাম করুক।

লাইলী বলল, আম্মা, আপনি ওসব নিয়ে কিছু ভাববেন না। তারপর সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, তোমরা এখন এ ঘর থেকে যাও। অসুস্থ শরীরে মানসিক টেনশন এলে মায়ের ক্ষতি হতে পারে।

লাইলীর কথায় যেন একটা আদেশের সুর রয়েছে। আর কথাটা এমনভাবে বলল, তা কেউ অমান্য করতে পারল না। সেলিম সবাইকে নিয়ে চলে গেল।

সকলে বেরিয়ে যাওয়ার পর লাইলী শাশুড়ীর বিছানা ঝেড়ে ঠিক করে দিয়ে তাকে শুইয়ে দিল। চার্ট দেখে ঔষধ খাইয়ে টেম্পারেচার দেখে চার্টে লিখে রাখল। তারপর পায়ের কাছে বসে পায়ে হাত বুলোত বুলোতে বলল, আপনি আর একদম কথা বলবেন না, ঘুমোবার চেষ্টা করুন। আমি ঠিক সময় মত পথ্য ও ঔষধ খাওয়াব।

সোহানা বেগম নিজেকে সংযত করতে পারলেন না। তার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল। ধরা গলায় বললেন, ঠিক যেন আমার মা। জান মা, ছোট বেলায় আমার যখন জ্বর জ্বালা হত তখন আমার মাও ঠিক এই রকম করত।

লাইলী মিষ্টি ধমকের স্বরে বলল, আপনাকে কোনো কিছু চিন্তা করতে ও কথা বলতে নিষেধ করলাম না? নিজের আঁচল দিয়ে তার চোখ মুছে দিয়ে আবার বলল, ঘুমোনার চেষ্টা করুন মা।

সোহানা বেগম আর কথা বললেন না। চোখ বন্ধ করে চিন্তা করলেন, এত সুন্দর ও গুণবতী মেয়েকে ভুল বুঝে তার নামে কত দুর্ণাম দিয়েছি। আল্লাহ কি আমাকে ক্ষমা করবেন তিনি মেয়েটির মধ্যে কি জিনিষ দিয়েছেন মুহূর্তের মধ্যে সবাইকে বাধ্য করে ফেলল।

লাইলী যখন বুঝতে পারল উনি ঘুমিয়ে গেছেন, তখন ধীরে ধীরে খাট থেকে নেমে কম্বলটা বুক পর্যন্ত টেনে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

এতক্ষণ আরিফ রুবীনা ও আসমা সেলিমের কাছ থেকে লাইলীকে কি করে খুঁজে বের করে বিয়ে করল, সে সব কথা শুনছিল।

লাইলী সেখানে এসে দাঁড়াতে আরিফ প্রথমে তার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল। তার দেখাদেখি আসমা ও রুবীনা করল।

লাইলী বলল, আল্লাহ সবাইকে হেদায়েত দান করুন। তিনি আমাদের সবাইকে সব রকম বিপদ-আপদ থেকে হেফাজত করুন। তারপর বলল, রাত অনেক হয়েছে, আর গল্প নয়, সকলে এশার নামাজ পড়ে খাওয়া দাওয়ার কাজ সেরে নাও। মায়ের অসুখ, সে কথা সকলের মনে রাখা উচিৎ।

আরিফ মাঝে মাঝে ভাবির দিকে না চেয়ে থাকতে পারছে না। দেখা অবধি ভাবিকে মানবী বলে বিশ্বাস করতে পারছে না। শুধু চিন্তা করছে, কোনো মানবী তো এত রূপবতী ও গুণবতী হতে পারে না। তার কথাগুলো যেন শুনতে মধুর মতো লাগে। তাকে সে মনের মধ্যে খুব উচ্চ আসনে বসিয়ে ফেলল।

খাওয়া দাওয়ার পর লাইলী বিছানা ঠিক করে মশারী খাটিয়ে স্বামীকে বলল, তুমি ঘুমাও। আমি মায়ের কাছে থাকব।

সেলিম বলল, তুমি ঘুমাও, আমি আমার মায়ের কাছে থাকব।

বিয়ের পর স্বামীর সবকিছুর উপর স্ত্রীর অধিকার হয়ে যায়। উনি এখন আমারও মা। তা ছাড়া স্ত্রীর কর্তব্য স্বামীর আরামের দিকে সর্বদা লক্ষ্য রাখা।

সেলিম কৃত্রিম রাগের সঙ্গে বলল, আর স্বামী বুঝি স্ত্রীর আরামের দিকে লক্ষ্য রাখবে না? আমি অতশত বুঝতে চাই না, তোমার সঙ্গে তর্কে কোনোদিন জিতেছি? আমিও তোমার সঙ্গে মায়ের কাছে থাকব। তোমার হুকুম বাড়ির সকলের উপর চালিও কিন্তু আমার উপর নয়। তা ছাড়া স্ত্রীর কর্তব্য স্বামীর হুকুম মেনে চলা।

লাইলী মৃদু হেসে বলল, হয়েছে হয়েছে, বাবুর রাগ দেখ না? আমি আর কোনোদিন তোমার সঙ্গে তর্ক করব না। স্বামীর হুকুম সবসময় মেনে চলব।

লাইলীর হাসিটা বিদ্যুতের মতো সেলিমের মনে আনন্দের ঝিলিক দিল। সে তাকে জড়িয়ে ধরে সোহাগ করতে করতে বলল, আমি তোমাকে ছেড়ে আর একটা রাতও থাকতে পারব না।

লাইলী আবার মৃদু হেসে বলল, আমিও পারি নাকি? তুমি অনেক দূর থেকে গাড়ি চালিয়ে এসে ক্লান্ত হয়েছ। প্রথম অর্ধেক রাত্রি তুমি ঘুমাও, আমার ঘুম পেলে তোমাকে না হয় জাগিয়ে মায়ের কাছে রেখে এসে তারপর আমি ঘুমাব।

সেলিম তার গালটা আস্তে করে টিপে ছেড়ে দিয়ে বলল, সব সময় জিতবেই, একবারও হারাতে পারলাম না। তারপর পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল।

লাইলী মশারী খুঁচে দিয়ে শাশুড়ীর ঘরে এসে দেখল, তিনি তখনও ঘুমোচ্ছেন। মাথায় হাত দিয়ে বুঝতে পারল জ্বর বেশি উঠেছে। চার্টে  লেখা আছে টেম্পারেচার বেশি উঠলে মাথায় বরফ দিতে হবে। লাইলী আইস ব্যাগে বরফ

ভরে মাথায় দিতে লাগল।

রাত তখন সাড়ে বারোটা, লাইলী আইস ব্যাগ শাশুড়ীর মাথায় ধরে বসে আছে। আরিফ ঘরে ঢুকে কয়েক মুহূর্ত লাইলীর শান্ত সৌম্য মুখের দিকে চেয়ে কাছে এসে বলল, ভাবি, আপনি এখনও জেগে আছেন? গত কয়েক রাত জেগে আজ একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এবার আপনি ঘুমোতে যান, আমি মায়ের কাছে বসছি।

লাইলী বলল, ভাবিকে কেউ আপনি করে বলে না। তারপর বলল, তুমি ঘুমাওগে যাও। আমার জন্য ভেব না, মেয়েদেরকে রাত জেগে সেবা করার ক্ষমতা ও ধৈৰ্য্য দিয়ে আল্লাহপাক তৈরি করেছেন। রাত জাগলে পুরুষদের শরীর ভেঙ্গে যায়। তা ছাড়া তোমরা এতদিন মায়ের সেবা করেছ, এবার আমাকে কিছু করতে দাও। যাও সোনা ভাই, ঘুমাওগে যাও। বড়দের কথার অবাধ্য, সুবোধ ছেলেরা হয় না। আমার অসুবিধা হলে তোমার ভাইয়াকে ডেকে নেব।

ভাবির কথা শুনে আরিফ মনে বড় শান্তি পেল। তখন তার ভাইয়ার সেদিনের কথা মনে পড়ল, “জানিস আরিফ, আমাদের সোসাইটির কলেজ ইউনিভার্সিটির কত মেয়ের সাথে তো পরিচিত হয়েছি, কিন্তু লাইলীর সঙ্গে তাদের তুলনা হয় না, লাইলী অনন্যা।”

তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লাইলী আবার বলে উঠল, বড়দের কথার অবাধ্য হওয়া যে বেয়াদবী, তা তো তুমি আমার থেকে ভালো জান।

আরিফ নিজেকে সংযত করতে পারল না, অশ্রুসিক্ত নয়নে ভক্তি গদগদ কণ্ঠে বলল, যাচ্ছি ভাবি, জীবনে কোনোদিন তোমার কথার অবাধ্য হওয়ার ধৃষ্টতা যেন

আমার না হয়। তারপর হনহন করে চলে গেল।

ফজরের আজান শুনে লাইলী নিজের ঘরে এসে স্বামীকে জাগিয়ে বলল, আজান হয়ে গেছে; তুমি নামায পড়ে মায়ের কাছে এসে বসবে। আমিও নামায পড়ব। এখনও বরফ দিতে হচ্ছে। রাত্রে জ্বর খুব বেশি উঠেছে, এখনও কমেনি। ডাক্তারকেও একবার কল দিতে হবে।

সেলিম তাড়াতাড়ি করে উঠে বলল, তোমার প্রতি খুব অবিচার করলাম। আমি নিজের ছেলে হয়ে স্বার্থপরের মত ঘুমালাম। আর তুমি বৌ হয়ে আমার মাকে সারারাত জেগে সেবা করলে?

লাইলী বলল, এতে তোমার কোনো অপরাধ হয়নি। তোমাকে বিশ্রাম করতে দেওয়া এবং মায়ের সেবা করা দুটোই আমার কর্তব্য। আমি তা করতে পেরে খুব আনন্দিত। এতে তোমার লজ্জা বা অনুশোচনা করার কিছু নেই।

দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা লাইলী শাশুড়ির সেবা করে চলছে। তারই ফাঁকে ফাঁকে স্বামীর প্রতি কর্তব্যও করছে। এইভাবে অক্লান্ত পরিশ্রম করে লাইলী শাশুড়ির সেবা করে চলল। প্রায় বিশ পঁচিশ দিন যমে মানুষে টানাটানি করার পর সোহানা বেগম এখন আরোগ্যের পথে।

আরো কয়েক দিন পর একদিন সকালের দিকে হামিদা বানু সোহানা বেগমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মেয়ে জামাইকে সঙ্গে করে র‍্যাংকীন স্ট্রীটে নিজের বাড়িতে এলেন।

সবাইকে দেখে রহিমা ও জলিল সাহেব খুশি হলেন। সেরেলা রহিমা তাদেরকে রান্না করতে দিল না। দুপুরে খুব ধুমধামের সঙ্গে খাওয়া দাওয়া হল। এক ফাঁকে রহিমা লাইলীকে একান্তে ডেকে নিয়ে বলল, কি সখি, সখাকে কেমন লাগছে? একেই বলে সত্যিকারের প্রেম। তা না হলে যার সঙ্গে একবার বিয়ে ভেঙ্গে যায়, তার সঙ্গেই আবার বিয়ে। হাদিসে আছে, সাতী সাধ্বী নারীর মনের বাসনা আল্লাহ পূরণ করেন। হাদিস তো মিথ্যা হতে পারে না

লাইলী প্রথমে লজ্জায় কথা বলতে পারল না। একটু সময় নিয়ে বলল, দোয়া কর ভাবি, আমি যেন তাকে সুখী করতে পারি।

জীবনে অনেক দুঃখ পেয়েছ। দোয়া করি ভাই, আল্লাহপাক তোমাদের দাম্পত্য জীবন সুখের করুন।

সাদেক ও ফিরোজা লাইলীকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি আমাদেরকে ছেড়ে দাদিকে নিয়ে কোথায় চলে গিয়েছিলে? আবার যাবে না তো?

রহিমা ছেলে মেয়েকে বোঝাল, তোমাদের ফুপু আম্মার বিয়ে হয়ে গেছে। সে তো তার শ্বশুর বাড়িতে যাবেই। তবে তোমাদের দাদি থাকবেন।

রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর হামিদা বানু কাঁদতে কাঁদতে মেয়ে জামাইকে বিদায় দিলেন।

সেলিম বলল, মা আপনি কাঁদবেন না। যখনই আপনার মন খারাপ হবে অথবা প্রয়োজনবোধ করবেন তখনই খবর দেবেন। আমি ঘরে না থাকলেও আপনার মেয়ে চলে আসবে। ছেলের অপরাধ যদি না নেন, তা হলে বলি, আমার ইচ্ছা আপনি আপনার মেয়ের সঙ্গে সব সময় থাকুন। আপনিও আমার মা। ছেলেকে মায়ের সেবা করার সুযোগ দিয়ে আমাকে ধন্য করুন।

সেলিমের কথা শুনে হামিদা বানু চোখের পানি রোধ করতে পারলেন না। বললেন, আল্লাহ তোমাদের সুখে রাখুন। তোমাকে আমিও ছেলের মত জানি। আমি স্বামীর ভিটে ছেড়ে অন্য জায়গায় গিয়ে শান্তি পাব না। আর তোমার মত জামাই পেয়েছিলে আমার নয়নের পূতলী লাইলীর জন্য কোনো চিন্তা নেই। তোমরা সময় করে দুজনে এসে আমাকে দেখা দিয়ে যেও। তা হলেই আমি খুশি হব, শান্তি পাব।

লাইলী মাকে সালাম করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল।

সেলিম বলল, লাইলী তুমি কাঁদছ? কোথায় তুমি মাকে শান্তনা দেবে? তা না করে নিজেই ভেঙে পড়ছ?

লাইলী সেলিমের কথা শুনে সামলে নিয়ে মাকে ছেড়ে দিয়ে তার চোখ বলল, তুমি কেঁদ না মা? কোনো চিন্তাও করো না, আমি প্রায়ই আসব।

সেলিমও শাশুড়ির পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠল।

কিছু দিনের মধ্যে সোহানা বেগম সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলেন। তিনি লাইলীকে যতই দেখছেন ততই মুগ্ধ হচ্ছেন আর ভাবছেন, কে বলবে, সে একজন সাধারণ ঘরের মেয়ে। আচার-ব্যাবহারে, চাল-চলনে, কথা-বার্তায় এবং আদর আপ্যায়নে সর্ব বিষয়ে পারদর্শী। কেউ তার কোনো কিছুতে এতটুকু দোষ ধরতে পারেনি। লাইলীকে পত্রবধূ হিসাবে পেয়ে সোহানা বেগম যেমন আনন্দিত তেমনি গর্বিতও।

কোটিপতির ছেলে সেলিম। উচ্চশিক্ষিত ও আল্টামডার্ণ সোসাইটিতে মানুষ হয়ে একটা গরিব ঘরের সেকেলে আনকালচার্ড মেয়েকে বিয়ে করেছে শুনে অনেক উচ্চশিক্ষিত ও আল্টামডার্ণ বন্ধু-বান্ধবী লাইলীকে দেখার জন্য তাদের বাড়িতে আসে। বন্ধুদের মধ্যে অনেকে তাদের সুন্দরী অর্ধনগ্ন বোন অথবা স্ত্রীকে সঙ্গে করে নিয়ে আসে সেলিমকে ক্রিটীসাইজ করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু যখন সেই আটপৌরে মেয়ে সাধারণ পোশাকে গায়ে মাথায় কাপড় দিয়ে স্বামীর সঙ্গে তাদের অভ্যর্থনা করে তখন তাকে দেখে, তার মার্জিত ভাষা শুনে ও সুমিষ্ট ব্যাবহারে তারা মুগ্ধ হয়ে যায়। তাদের সেই ঈর্ষা ও রাগ কোথায় যেন উড়ে যায়। অর্ধনগ্ন মেয়েরা তাদের শরীরের খোলা অঙ্গগুলো ঢেকে দেয়। তারা লাইলীকে যত দেখে, তার সঙ্গে যত কথা বলে ততই তারা আকৃষ্ট হতে থাকে। শেষে সবাই তাকে তাদের মনের উচ্চ আসনে বসায়, যেখানে কোনো হিংসা, বিদ্বেষ ও ক্রিটিসাইজ মনোভাবের স্থান নেই। বাড়ি ফেরার সময় প্রত্যেকে তাকে সাদর নিমন্ত্রণ করে। বন্ধুরা বলে, সত্যি সেলিম, তোর মতো ভাগ্য আর কারো হয় না। আলাহ তোদের দুজনকে ঠিক যেন এক বৃন্তে দুটো ফুল করে সৃষ্টি করেছেন। তোরা দুজনে একে অন্যের জন্য সৃষ্টি হয়েছিস। তোদের মতো এত সুন্দর মিল, সারা পৃথিবীতে আর আছে কি না সন্দেহ। ঐ দলে রেহানা আর মনিরুলও থাকে। তাদের মনেও আর কোনো ঈর্ষা বা রাগ নেই। লাইলীর ব্যাবহারে সব দূর হয়ে গেছে।

একদিন রেহানা লাইলীকে আসমার কথা উত্থাপন করে সেদিনের ঘটনাটা বলল।

লাইলী বলল, আসমার পরিচয় পেলে তুমি চমকে উঠবে। আর তোমার সেলিম ভাই-এর কথা যে বলছ, ওর চেয়ে চরিত্রবান ছেলে এ পৃথিবীতে আছে কি না সন্দেহ। তোমাকে একটা কথা বলি শোন, কখন পরের ছিদ অন্বেষণ করবে না বরং অন্যের ভালো গুণগুলো দেখবে। অন্যের কোনো দোষ দেখলে নিজের দিকে লক্ষ্য করবে। দেখবে তোমার সে দোষ আছে কিনা। যদি থাকে তবে তা সংশোধন করার চেষ্টা করবে। হাদিসে আছে, রাসূলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, “যে অন্যের দোষ পাঁচ জনের কাছে প্রকাশ না করে তার সম্মান বাঁচায়, কাল হাশরের ময়দানে আল্লাহ পাকও তার অনেক গুনাহ গোপন রাখবেন, যা মিজানের পাল্লায় দিলে সে জাহান্নামী হত।1

রেহানা লাইলীর কথা শুনে খুব খুশি হল। জিজ্ঞেস করল, আসমার পরিচয় পেলে চমকে উঠব কেন

সে কথা এখন বলতে পারব না, তোমার ভাইয়ের নিষেধ। তবে চিন্তা কর না, খুব শিঘী তার পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়বে।

মনিরুল ইদানিং এ বাড়িতে যাতায়াত শুরু করেছে। প্রায় প্রতিদিন রুবীনা কলেজ থেকে ফেরার সময় আসে। তার সঙ্গে গল্প করে। মাঝে মাঝে দুজনে গাড়ি নিয়ে বেড়াতে যায়।

সেলিম এর মধ্যে কয়েকবার চিটাগাং গিয়েছে। দুই একদিনের বেশি সেখানে থাকতে পারে না। এক রাতে চিটাগাং থেকে ফিরে লাইলীকে বলল, মা তো ভালো হয়ে গেছে। তুমি এবার আমার সঙ্গে চিটাগাং চল। এ রকম দু’একদিন ছাড়া যাতায়াত করে অফিসের অনেক ক্ষতি হচ্ছে।

লাইলী বলল, তুমি নিয়ে গেলেই যাব। তবে মায়ের শরীর আর একটু ইমপ্রুভ করলে তারপর গেলে ভালো হত।

সেলিম বলল, বেশ তাই হোক। গৃহকর্তি লাইলী আরজুমান বানুর কথা কি অমান্য করতে পারি।

তুমি আমার পুরো নাম জানলে কেমন করে।

কেন কাবিননামা  লেখার সময় জেনেছি। সত্যি তোমার নামটাও তোমার মতই অপূর্ব সুন্দর। যিনি তোমার এই নাম রেখেছিলেন, তাঁকে জানাই শত শত ধন্যবাদ।

রেহানাও মনিরুলের মতো ঘন ঘন এ বাড়িতে আসতে শুরু করেছে। আগে সে সেলিমের সঙ্গে বেড়াতে যেত, ব্যটমিণ্টন খেলত। এখন লাইলীর সঙ্গে গল্প করে। বিকেলে চায়ের আসরে গল্প বেশ জমে উঠে। লাইলী তাদেরকে কোরআন ও হাদিসের অনেক উপদেশ মূলক গল্প বলে এবং ইসলামের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ইসলামের মহান আদর্শের দৃষ্টান্ত দেয়। সোহানা বেগমও সেই সব শোনেন লাইলার চেষ্টায় এবাড়ির সকলে নামাজ পড়ছে। শুধু রুবানা ধরব ধরব করছে।

একদিন লাইলী দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর বিছানায় গা এলিয়ে বেহেস্তী জেওর বইটি পড়ছিল। সেলিম চিটাগাং গেছে।

এমন সময় রেহানা ঘরে ঢুকে বলল, ভাবি ঘুমিয়ে গেছ নাকি রেহানা লাইলীর গুণে মুগ্ধ হয়ে তাকে মনেপ্রাণে ভালবেসে ফেলেছে। একদিন না দেখলে থাকতে পারে না। সে লাইলীর মহব্বতে ও তার কাছে ধর্মীয় জ্ঞান পেয়ে চাল চলন ও পোশাক-পরিচ্ছদ পরিবর্তন করে ফেলেছে। মন থেকে তার প্রতি হিংসা বিদ্ধেষ দূর করে দিয়েছে, পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে। তাই প্রতিদিন বিকালে লাইলীর কাছে ছুটে আসে।

লাইলী বিছানার উপর উঠে বসে বলল, না ভাই ঘুমোইনি। তারপর বইটি দেখিয়ে বলল, এটা পড়ছিলাম। তুমিও পড়ো। এতে মেয়েদের অনেক শেখার জিনিষ আছে। এস, বস। আজ যে বড় তাড়াতাড়ি এসে গেছ।

রেহানা বলল, তুমি যে কি যাদু করেছ ভেবে পাইনি। সব সময় শুধু তোমার কথা মনে পড়ে। তারপর বিছানার উপর তার পাশে বসে আবার বলল, ভাবি বল না, তুমি যাদু জান কি না।

লাইলী বলল, না ভাই ওসব কিছু জানি না। তবে তোমাকে আমিও খুব ভালবেসে ফেলেছি। ওসব কথা বাদ দাও, আজ তোমাকে দুএকটা কথা বলব, তুমি যদি মনে কিছু না কর।

রেহানা বলল, তোমার কথায় আমি কিছু মনে করব না, তুমি নিশ্চিন্তে বল।

লাইলী বলল, দেখ বোন, আমার প্রায় মনে হয়, ওকে যেন আমি তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছি। এই চিন্তাটা আমার অন্তরে সব সময় কাটার মত বিধে। আল্লাহপাকের কসম করে বলছি, তোমার প্রতি আমার এতটুকু দুষমনি মনোভাব ছিল না, আজও নেই। আর আল্লাহপাককে জানাই ভবিষ্যতেও যেন না হয়। হঠাৎ কি করতে কি হয়ে গেল। আমরা দুজন দুজনকে ভালবেসে ফেললাম। তুমি নিউমার্কেটে একদিন এব্যাপারে কিছু কথা বলেছিলে। কিন্তু তখন বড় দেরি হয়ে গেছে। তা ছাড়া তার আগে আমি জানতাম না তোমাদের দুজনের সম্পর্ক। যাই হোক, তোমার কথা শুনে আমি দুরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ওর কথা ভেবে পারিনি। আমি শত দুঃখ পেলেও সবকিছু সহ্য করতে পারতাম। কিন্তু তোমার দাদা তার অনেক আগে আমাকে স্পষ্ট করে বলেছিল, আলাহপাক ছাড়া দুনিয়ার কোনো শক্তি আমার কাছ থেকে তোমাকে দূরে সরিয়ে নিতে পারবে না। যদি তুমি নিজে সরে যাও তবে হয় আমি পাগল হয়ে যাব, নচেৎ আত্মহত্যা করে ফেলব। আমি তোমার দাদার পরিণতির কথা চিন্তা করে তোমার কথা রাখতে পারিনি। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও, নচেৎ চিরকাল এই অশান্তিতে ভুগব।

রেহানা ভেজা কণ্ঠে বলল, তুমি ক্ষমা চেয়ে আমাকে আরো বেশি অপরাধী করো। তুমি যে কত মহৎ, তা অন্ধ মোহের বশবর্তী হয়ে তখন বুঝিনি। আল্লাহ তোমাকে সেলিম ভাই-এর উপযুক্ত করে সৃষ্টি করেছেন। আমার মতো মেয়ে তার উপযুক্ত নয়। আমি ঈর্ষা ও রাগের বশবর্তী হয়ে নিউমার্কেট যাতা করে বলেছি এবং ফাংশানের দিনে নানাভাবে অপমান করার চেষ্টা করেছি। সেইসব কথা এখন মনে হলে মরমে মরে যাই। আমার সেইসব দুর্মতির জন্য এখন তোমার কাছে মাফ চাইছি বলে লাইলীর হাত ধরে কেঁদে ফেলল।

লাইলী রেহানাকে জড়িয়ে ধরে বলল, এ ব্যাপারে তোমার কোনো অন্যায় হয়নি। আর হলেও আমি কিছু মনে রাখিনি। আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করুন। তারপর নিজের আঁচল দিয়ে তার চোখ মুছে দেওয়ার বলল, চল বারান্দায় গিয়ে চা খেতে খেতে গল্প করা যাবে। ঘর থেকে বেরোবার সময় বলল, তুমি যদি বল, তা হলে তোমার জন্য পাত্র দেখতে পারি। আমার হাতে একটা খুব ভালো ছেলে আছে। সব দিক থেকে সে তোমার উপযুক্ত। রেহানা কিছু না বলে শুধু তার দিকে একবার চেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে চায়ের টেবিলে এসে বসল।

আরিফের জন্য মেয়ে ধোজ করা চলছে। সেদিন চায়ের টেবিলে সেও ছিল। লাইলী তাকে বলল, আমি তোমার জন্য একটা মেয়ে চয়েস করেছি।

আরিফ বলল, একটা কেন হাজারটা চয়েস কর, তাতে কোনো আসে যায় না। কিন্তু মনে রেখ, আজকাল কলেজ-ইউনিভার্সিটির মেয়েরা ধর্ম মেনে চলা তো দূরের কথা, ধর্মের নাম শুনলেই নাক ছিটকায়।

লাইলী বলল, সব মেয়েরা কি এক রকম হয়? হাতের পাঁচটা আঙ্গুল কি সমান? আমিও তো কলেজ-ভার্সিটিতে পড়েছি। তাদের মধ্যে ভালো মেয়েও আছে।

আরিফ বলল, ভাইয়াই তোমার সঙ্গে তর্কে পারেনি, আর আমি তো কোন ছার। অতশত বুঝি না, আপটুডেট ডিসকো–মিসকো মেয়ে হলে আমি তো অসুখী হই, আর তোমাদের সাথেও বনিবনা হবে না। শেষে সকলেই অশান্তি ভোগ করব।

লাইলী বলল, তা হলে তো তোমাকে তোমার ভাইয়ার মত গরিব ঘরের মেয়ে বিয়ে করতে হয়।

তা হোক, তাতেও আমি রাজি। আমি কি তোমাদের বলেছি নাকি, বড়লোকের মেয়েকে বিয়ে করব?

সোহানা বেগম সেখানে ছিলেন না। একটু আগে এসে দেওর ভাবির কথা শুনছিলেন। হেসে ফেলে আরিফকে উদ্দেশ্য করে বললেন, যে ধরনের মেয়ে আসুক না কেন, তুই যদি ঠিক থাকিস, তা হলে আমার মা লাইলী তাকে দুদিনেই মানুষ করে ফেলবে।

আরিফ মায়ের কথা শুনে লজ্জা পেয়ে রেহানার দিকে একপলক চেয়ে পালিয়ে গেল। রেহানাও তার দিকে চেয়েছিল, দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেল।

লাইলী প্রায়ই লক্ষ্য করে ওরা মাঝে মাঝে একে অপরের দিকে গোপনে গোপনে তাকায়। আজকের ঘটনার পর থেকে তার মনে যেন একটু সন্দেহ হল।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. বর্ণনায় আবু হোরাইরা (রাঃ) —তিরমিজী।