» » সিরাজদ্দৌল্লা ও ইংরেজ কোম্পানির সংঘাত

বর্ণাকার

সিরাজদ্দৌল্লার অভিপ্রায়: গভর্নর ড্রেকের মনোভাব

সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ—বাংলা থেকে তিনি ইংরেজদের তাড়াতে চেয়েছিলেন। হিল হয়তো এটাকেই সিরাজের মূর্খামির চূড়ান্ত ভেবেছেন। এ-ধারণা ঐতিহাসিক মহলে এতদিন ধরে চলে এসেছে এবং এতই স্বতঃসিদ্ধ বলে গৃহীত যে অধুনা প্রকাশিত গ্রন্থেও বলা হচ্ছে যে, সিরাজদ্দৌল্লা ‘বাংলা থেকে ইংরেজদের বহিষ্কার করতে চেয়েছিলেন।’1 কিন্তু তখনকার তথ্যপ্রমাণ থেকে এ-অভিযোগ ভ্রান্ত বলে প্রমাণ করা অসুবিধে হবে না। খোজা ওয়াজিদকে লেখা চিঠিতে (২৮ মে ১৭৫৬) সিরাজ ইংরেজদের সম্বন্ধে তাঁর অভিপ্রায় পরিষ্কার করে জানিয়েছিলেন: 2

ইংরেজরা আমার রাজ্যে থাকতে চাইলে তাদের দুর্গগুলি ভেঙে ফেলতে হবে, পরিখা ভরাট করে দিতে হবে এবং জাফর খানের (মুর্শিদকুলি খান] আমলে যে-শর্তে তারা ব্যবসা-বাণিজ্য করেছে সেই শর্তেই তাদের এখন তা করতে হবে। তা না হলে আমার রাজ্য থেকে তাদের বহিষ্কার করা হবে। তারা যেন মনে রাখে আমিই এ রাজ্যের নবাব। ইংরেজরা যাতে পূর্বোক্ত শর্তগুলি মেনে চলে, সে ব্যবস্থা করতে আমি বদ্ধপরিকর।

এর ক’দিন পরে ওয়াজিদকে লেখা দ্বিতীয় চিঠিতে (১ জুন, ১৭৫৬) সিরাজ আরও জানাচ্ছেন: ‘ইংরেজরা যদি তাদের উপরোক্ত আচরণগুলি সংশোধন করবে বলে কথা দেয়, তা হলে আমি তাদের ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দেব এবং তাদের আমার রাজ্যে থাকতে দেব।’3 এ চিঠিগুলি থেকে এটা স্পষ্ট যে সিরাজদ্দৌল্লা আসলে চেয়েছিলেন, ইংরেজরা যাতে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য কাজকর্ম ১৭১৭ সালের ফরমানের শর্তগুলি মেনে করে এবং ওই ফরমানে তাদের যে সুযোগসুবিধে দেওয়া হয়েছে তার যেন যথেচ্ছ অপব্যবহার তারা না করে। তিনি যে ইংরেজদের বাংলা থেকে তাড়িয়ে দিতে চাননি সেটা ফোর্ট সেন্ট জর্জের (Fort St. George—মাদ্রাজ) গভর্নর পিগটকে (Pigot) লেখা তাঁর চিঠিতে সুস্পষ্ট: ‘সুবা বাংলায় ইংরেজদের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দেওয়া বা এখান থেকে ইংরেজদের তাড়িয়ে দেওয়া মোটেই আমার অভিপ্রায় নয়।’4 অজ্ঞাতনামা ইংরেজ লেখকও বলছেন: ‘ইংরেজরা যদি জাফর খানের আমলে যে-শর্তে বাণিজ্য করত সে-শর্তেই যদি আবার তা করতে রাজি না হয়, তা হলে সিরাজদ্দৌল্লা বাংলায় তাদের ক্ষমতা হ্রাস করতে এবং বাংলা থেকে তাদের বহিষ্কার করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন।’5 তবে এটা ঠিকই অল্প বয়সের ক্ষমতার দম্ভে ও অভিজ্ঞতার অভাবে তিনি বাংলা থেকে ইংরেজদের তাড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। এটা অবশ্য মনে হয় নেহাতই ইংরেজদের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য যাতে তারা তাঁর সঙ্গে মিটমাট করে নেয়।

নবাবের সঙ্গে ইংরেজদের যে-সংঘর্ষ এবং নবাবের কলকাতা আক্রমণের আগের যে-ঘটনাবলী তা বিশ্লেষণ করে এ সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, ইংরেজদের, বিশেষ করে গভর্নর ড্রেকের, কঠোর ও অনমনীয় মনোভাব এ-সংঘর্ষকে অনিবার্য করে তুলেছিল। কোম্পানির কর্মচারীদের লেখা থেকেই আমাদের বক্তব্যের প্রচুর সমর্থন পাওয়া যাবে। ইংরেজদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধার তিন দিন আগে পর্যন্ত সিরাজদ্দৌল্লা কূটনৈতিক দৌত্যের মাধ্যমে একটা আপস-মীমাংসার চেষ্টা করেছিলেন। নারায়ণ সিং ও খোজা ওয়াজিদের দৌত্য নিষ্ফল হল মূলত ড্রেকের ‘যুদ্ধং দেহি’ মনোভাবের জন্য। লন্ডনের পরিচালক সমিতি, মাদ্রাজের ফোর্ট সেন্ট জর্জ কাউন্সিল ও ফলতাতে ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখা কয়েকটি চিঠিতে ওয়াটস ও কোলেট বার বার জোর দিয়েছেন যে, ড্রেক ও ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল নবাবের সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে নেওয়ার জন্য কোনও আগ্রহই দেখায়নি।6 কাশিমবাজার থেকে কলকাতা অভিযানের পথে ওয়াটস ও কোলেট এক গোপন পত্রে দুর্লভরামের সঙ্গে মিটমাটের আলোচনার বিবরণ দিয়ে ড্রেককে জানিয়েছিলেন। কিন্তু ওয়াটস লিখেছেন: ‘ড্রেক এবং ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল তাতে কোনও সাড়াই দেয়নি,নবাবের সঙ্গে কোনও মীমাংসায় যেতে তারা [ড্রেক ও কাউন্সিল] একেবারেই নারাজ।’7 জাঁ ল’-র অবশ্য বিশ্বাস যে, ইংরেজরা ভেবেছিল একটু শক্ত ও কঠোর মনোভাব দেখালে নবাব ভয় পেয়ে মুর্শিদাবাদ পালিয়ে যাবেন।8 এটাও হয়তো সম্ভব যে ড্রেক ভেবেছিলেন নবাবের অভিযোগগুলি ইংরেজদের বাংলা থেকে বিতাড়নের এবং তাদের ধনসম্পত্তি দখল করার জন্য নবাবের মিথ্যে অজুহাত। তাই হয়তো ড্রেক সামরিক শক্তি প্রদর্শন করে নবাবকে কাবু করতে চেয়েছিলেন।

ওয়াটস, কোলেট ও বেটসন (Batson) আবার ৩১ মে ড্রেক ও ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লিখলেন নবাবকে ‘আপসের সুরে’ একটা চিঠি দিতে।9 ড্রেক সেটাও অগ্রাহ্য করলেন। এদিকে কলকাতার ধনী ব্যবসায়ী উমিচাঁদ ও খোজা ওয়াজিদের কলকাতার এজেন্ট শিববাবুর আপসচেষ্টা ড্রেকের আগ্রহের অভাবে ব্যর্থ হল। কাশিমবাজার কুঠির অবরোধ ও ইংরেজদের শর্তাধীন আত্মসমর্পণে ড্রেক খুবই ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। শিববাবুকে ড্রেক নাকি বলেছিলেন—সিরাজ যত তাড়াতাড়ি কলকাতা আসে ততই ভাল, তা হলে ড্রেক সিরাজের জায়গায় অন্য কাউকে নবাব করতে পারবেন।10 শিববাবু দ্বিতীয়বারের (১০ জুন) প্রচেষ্টায় ড্রেককে দিয়ে সিরাজদ্দৌল্লাকে একটি চিঠি লেখাতে সক্ষম হলেন কিন্তু সে-চিঠিতে যদি সমঝোতার কোনও সুর থেকেও থাকে, তা ড্রেকই ওই একই দিনে থানা ও সুখসাগরে নবাবের দুটি ফৌজি ফাঁড়ি আক্রমণ করার আদেশ দিয়ে বানচাল করলেন।11 নবাবের সঙ্গে একটা চুড়ান্ত বোঝাপড়ায় ড্রেক যে দৃঢ়সংকল্প তা ওয়াটস ও কোলেটের (তাঁরা তখনও নবাবের ফৌজের সঙ্গে কলকাতার পথে) চিঠির (১২ জুন) তিনি যে উত্তর দিচ্ছেন তা থেকে সুস্পষ্ট: ‘কাশিমবাজারে কোম্পানির যে-অবমাননা হয়েছে, তারপরে ইংরেজরা নবাবের সঙ্গে কোনও সমঝোতায় আসতে একেবারে নারাজ।’12 দু’পক্ষের মধ্যে আপস-মীমাংসার শেষ চেষ্টা করেছিলেন ফরাসি কোম্পানির প্রাক্তন কর্মচারী ও তখন নবাবের গোলন্দাজ বাহিনীর অধিনায়ক মার্কুইস দ্য সাঁ জাঁক (Marquis de St. Jacques) ১৩ জুন (নবাবের অজ্ঞাতে নিশ্চয়ই নয়, তার মানে নবাব তখনও পর্যন্ত একটা শান্তিপূর্ণ মীমাংসায় আগ্রহী ছিলেন)। এর উত্তরে ড্রেক সাঁ জাঁককে জানিয়েছিলেন, তিনি যেন নবাবকে ছেড়ে ইংরেজদের দিকে চলে আসেন।13 সুতরাং ওপরের আলোচনা থেকে এ সিদ্ধান্ত করা ভুল হবে না যে, গভর্নর ড্রেকের মারমুখো ও অনমনীয় মনোভাব ইংরেজদের সঙ্গে নবাবের ১৬ জুনের সংঘর্ষকে অনিবার্য করে তুলেছিল। এ-প্রসঙ্গে কোম্পানির কর্মচারী রিচার্ড বেচারের মন্তব্য বিশেষ প্রণিধানযোগ্য: 14

এ কথা কি কখনও কল্পনা করা যায় যে, কোনও রাজার [দোষী] প্রজাকে একদল বিদেশি বণিক আশ্রয় দেবে?…কিংবা তাঁর দূতকে অপমান করে তাড়িয়ে দিলে রাজা সেই অপমান নির্বিবাদে মেনে নেবেন?…দূতকে (অপমান করে] তাড়িয়ে দেওয়াটা সারা পৃথিবীতেই রাজার অপমান বলে গণ্য হয়…

ডাচ কোম্পানির নথিপত্র থেকেও এটা স্পষ্ট যে, সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে ইংরেজদের সংঘর্ষের জন্য ইংরেজরাই বহুলাংশে দায়ী। ১৭৫৬ সালের জুন মাসের ঘটনাবলী নিয়ে জুলাই মাসে হুগলির ডাচ কুঠি থেকে এশিয়াতে তাদের প্রধান কার্যালয় ব্যাটাভিয়াতে জানানো হয় যে, ইংরেজরাই এ সংঘর্ষের জন্য মূলত দায়ী।15 তা ছাড়া ড্রেক যখন সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে ডাচদের সাহায্য করতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, তখন বাংলায় ডাচ কোম্পানির প্রধান বিসডম (Bisdom) তা করতে অক্ষমতা জানিয়ে লেখেন যে, ইংরেজরা যখন এ-ঘটনার জন্য নিজেরাই দায়ী, তখন নবাবের বিরুদ্ধে তাদের সাহায্য করা ডাচদের পক্ষে সম্ভব নয়।16

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. C. A. Bayly, Indian Society, p. 46; Rajat Kanta Ray, পলাশী, পৃ. ৩২।
  2. খোজা ওয়াজিদকে লেখা সিরাজের চিঠি, ২৮ মে ১৭৫৬, Hill, I, p. 3.
  3. ঐ, পৃ. ৪।
  4. মাদ্রাজের গভর্নর পিগটকে লেখা সিরাজের চিঠি, ৩০ জুন ১৭৫৬, Hill, I, p. 196.
  5. Mss. Eur. D. 283, f. 26.
  6. ওয়াটস ও কোলেটের লেখা কোর্টকে বিভিন্ন সময়ের চিঠি, ৩০ জানুয়ারি ১৭৫৭, Hill, III, p. 336; ১৬ জুলাই ১৭৫৬, Hill I, pp. 103-04. ফোর্ট সেন্ট জর্জ কাউন্সিলকে লেখা ওয়াটস ও কোলেটের চিঠি, ২ জুলাই ১৭৫৬, Hill, I, p.47; ৭ জুলাই ১৭৫৬, Hill, I, p. 58; ফলতায় কাউন্সিলকে লেখা চিঠি, ৮ জুলাই ১৭৫৬, Hill, I, p. 60.
  7. কোর্টকে লেখা ওয়াটস ও কোলেটের চিঠি, ১৬ জুলাই ১৭৫৬, Hill, I, p. 103.
  8. Law’s Memoir, Hill, III, p. 169.
  9. ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখা ওয়াটস, কোলেট ও বেটসনের চিঠি, ৩১ মে ১৭৫৬, Hill, I, p.4.
  10. Beng. Letters Recd., vol. 23, ff. 239-40.
  11. কোর্টকে লেখা ওয়াটস ও কোলেটের চিঠি, ১৭ জুলাই ১৭৫৬, Hill, I, pp. 116-17.
  12. কোর্টকে ওয়াটস ও কোলেটের চিঠি, ১৬ জুলাই ১৭৫৬, Hill, I, p. 104; Drake’s Narrative, Hill, I, pp. 140-42.
  13. Hill, I, pp. 142-43.
  14. ড্রেককে লেখা রিচার্ড বেচারের চিঠি, কলকাতা, ২২ মার্চ ১৭৫৭, Beng. Letters Recd., vol. 23, f. 460; ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখা বেচারের চিঠি, ২৫ জানুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, pp. 158-60.
  15. ব্যাটাভিয়াতে লেখা হুগলির ডাচ কাউন্সিলের চিঠি, Hill, I, p. 54.
  16. ড্রেককে লেখা বিসডমের চিঠি, ১৪ জুন ১৭৫৬, VOC, 2781, ff. 16vo, 27vo, 243vo.