নবাবের অপরাধী প্রজাদের আশ্রয়দান
নবাবের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে নবাবেরই প্রজাদের, যারা অপরাধী হিসেবে নবাবের বিচারসাপেক্ষ, কলকাতায় আশ্রয় দিয়ে নবাবকে অগ্রাহ্য করার প্রকৃষ্ট নমুনা কৃষ্ণদাসের ঘটনা। নবাব আলিবর্দিও এরকম অবৈধ ও বেআইনি আশ্রয়দানের জন্য কয়েকবার জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।1 আমরা আগেই দেখিয়েছি, আমাদের হাতে যে-সব তথ্যপ্রমাণ আছে তা থেকে যথেষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, কৃষ্ণদাসকে আশ্রয়দানের পেছনে ইংরেজদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল এবং মসনদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিপ্রেক্ষিতে সিরাজ ন্যায়সঙ্গতভাবেই কৃষ্ণদাসকে তাঁর হাতে প্রত্যর্পণের দাবি জানিয়েছিলেন। আমরা আগেই দেখেছি কৃষ্ণদাসের পিতা রাজবল্লভের বিরুদ্ধে ঢাকায় সরকারি তহবিল তছরুপের অভিযোগ আনা হয়েছিল। সে-সব হিসেবপত্র যখন পরীক্ষা করা হচ্ছিল, রাজবল্লভ তখন ওয়াটসকে অনুরোধ জানান কৃষ্ণদাসকে কলকাতায় আশ্রয় দেবার জন্য। কাশিমবাজার থেকে ওয়াটসই গভর্নর ড্রেকের কাছে কৃষ্ণদাসকে কলকাতায় আশ্রয়দানের সুপারিশ করেছিলেন। ওয়াটসের ধারণা ছিল, ঘসেটি বেগমের দল, যার অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন কৃষ্ণদাসের পিতা রাজবল্লভ, মসনদ দখলের লড়াইয়ে নিশ্চিত সাফল্যলাভ করবে। ওয়াটস লেখেন যে রাজবল্লভকে ইংরেজদের কাজে লাগে এবং ভবিষ্যতে আরও বেশি লাগতে পারে।2 কিন্তু আলিবর্দির মৃত্যুর ঠিক আগে ওয়াটস বুঝতে পারেন যে সিরাজের উত্তরাধিকার সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ নেই। তখন তিনি ড্রেক ও ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে জানিয়ে দিলেন যে কৃষ্ণদাসকে এ-অবস্থায় কলকাতায় রাখা মোটেই সমীচীন হবে না।3 ড্রেক কিন্তু তাতে কর্ণপাতও করলেন না, যদিও কাউন্সিলের দুই সদস্য হলওয়েল ও ম্যানিংহাম অভিমত দিয়েছিলেন যে, এ-অবস্থায় কৃষ্ণদাসকে কলকাতায় রাখা ঠিক নয়। কারণ তা হলে নতুন নবাব সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে কোম্পানির সম্পর্ক বিঘ্নিত হতে পারে।4 অবশ্য হলওয়েল যথারীতি কদিন পরেই মত পালটে ছিলেন কেননা তখন বাজারে গুজব যে, ঘসেটি বেগমের দল হয়তো জিততেও পারে। তাই হলওয়েল লিখেছেন: ‘কৃষ্ণদাসকে এ সময় কলকাতা থেকে বার করে দেওয়া কোম্পানির স্বার্থের দিক থেকে ক্ষতিকারক হতে পারে।’5 যা হোক, এটা সুস্পষ্ট যে কৃষ্ণদাসকে আশ্রয় দিয়ে ইংরেজরা শুধু নবাবের কর্তৃত্বকেই অমান্য ও অবজ্ঞা করেনি, সিরাজের যে-বিরোধী দল তার সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছিল। সুতরাং এটা পরিষ্কার যে, নবাবের অপরাধী প্রজাদের অন্যায়ভাবে কলকাতায় আশ্রয়দানের জন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজদ্দৌল্লার যে-অভিযোগ, তা খুবই ন্যায়সঙ্গত।
তা হলে দেখা যাচ্ছে যে, ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজদ্দৌল্লার অভিযোগগুলি খুবই সঙ্গত। একটিও তাদের আক্রমণ করার জন্য নবাবের মিথ্যা ওজর নয়। এ সময় বাংলায় উপস্থিত একজন ইংরেজ নাবিক, ডেভিড রেনি (David Rannie), জানাচ্ছেন যে ইংরেজদের বিরুদ্ধে নবাবের তিনটে অভিযোগই ‘অত্যন্ত খাঁটি’ (strictly true)।6 এমনকী হিলও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে নবাবের ‘মিথ্যা ওজরগুলোর’ মধ্যে ‘কিছুটা সত্য’ ছিল।7 তবে সিরাজদ্দৌল্লার ঘাড়ে দোষ চাপাবার জন্য তিনি সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলেছেন, ‘যেখানে ইংরেজদের মতো রাজ্যের পক্ষে হিতকারী জাতির সঙ্গে তাঁর মাতামহ নরম মনোভাব দেখিয়েছিলেন, সেখানে সিরাজদ্দৌল্লার মূর্খামি হয়েছিল যে তিনি তাদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করেছিলেন।’8
সিরাজদ্দৌল্লা যা করেছিলেন তাকে কোনওভাবেই মূর্খামির দ্যোতক বলা যায় না। বাদশাহি ফরমানে ইংরেজদের যে সুযোগসুবিধে দেওয়া হয়েছিল, তা সিরাজ কখনওই বাতিল করতে চাননি৷ ইংরেজরাই বরং ফরমানের শর্তাবলীর অপব্যবহার করছিল। সিরাজ শুধু চেষ্টা করেছিলেন যাতে তারা ফরমানের শর্তাবলী মেনে ব্যবসা-বাণিজ্য করে। তা ছাড়া এটাও ঠিক নয় যে আলিবর্দি ইংরেজদের প্রতি নরম মনোভাব দেখিয়েছিলেন। ইংরেজদের আক্রমণ করা বা তাদের কুঠি দখল করা তাঁর কখনও প্রয়োজন হয়নি কারণ তারা তার আগেই তাঁর মতো শক্তিশালী নবাবের কথা বা নির্দেশ মাথা পেতে নিত, অগ্রাহ্য করতে সাহস করত না। সিরাজের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্যরকম দাঁড়িয়ে যায়— ইংরেজরা তখন দরবারের রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে পড়েছে, এমনকী সিরাজের প্রতিদ্বন্দ্বী দলকে মদত দিতেও শুরু করেছে, যা আলিবর্দির সময় করতে তারা সাহস করত না।
সূত্রনির্দেশ ও টীকা
- Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, pp. 38-39.
- কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা হলওয়েলের চিঠি, ৩০ নভেম্বর ১৭৫৬, Hill, II, pp. 4-5; রিচার্ড বেচার, লিউক স্ক্র্যাফ্টনের কোর্টকে চিঠি, ১৮ জুলাই ১৭৫৬, Beng. Letters Rec., vol. 23, f. 239; C & B Abstrs., vol. 6, f. 118; কোর্টকে ওয়াটসের চিঠি, ৩০ জানুয়ারি ১৭৫৭, Beng. Letters Recd., vol. 23, f. 378.
- Hill, III, pp. 332-33; II. Pp. 4-5.
- কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা হলওয়েলের চিঠি, ৩০ নভেম্বর ১৭৫৬, Hill, II, p. 5.
- ঐ।
- Causes of Loss of Calcutta, David Rannie, Aug. 1756, Hill, III, p. 384.
- Hill, I, p. lv.
- ঐ।