দস্তকের অপব্যবহার
দস্তকের অপব্যবহার সম্বন্ধেও সিরাজদ্দৌল্লার অভিযোগ মোটেই ভিত্তিহীন নয়। ইংরেজ কোম্পানির নথিপত্রেই অসংখ্য প্রমাণ আছে যে কোম্পানির কর্মচারীরা দস্তকের যথেচ্ছ অপব্যবহার করছিল। এই দস্তক বা বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার অনুমতিপত্রের সাহায্যে কোম্পানির কর্মচারীরা শুধু নিজেদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের (private trade) ক্ষেত্রে শুল্ক ফাঁকি দিত না, এমনকী তারা এ-দস্তক এশীয় বণিকদের কাছে বিক্রি করত। ফলে এশীয় বণিকরাও ওই দস্তক দেখিয়ে তাদের পণ্যের জন্যও কোনও শুল্ক দিত না এবং তাতে রাজ্যের যথেষ্ট আর্থিক ক্ষতি হত। কারণ এতে করে বাণিজ্য শুল্ক বাবদ ন্যায্যপ্রাপ্য রাজস্ব থেকে রাজ্য বঞ্চিত হত। কোম্পানির কর্মচারীরা অবশ্য দাবি করত যে, ১৭১৭ সালে মুঘল সম্রাট ফারুখসিয়র যে ফরমান বা আদেশপত্র ইংরেজ কোম্পানিকে দিয়েছিলেন তা শুধু কোম্পানির আমদানি ও রফতানি বাণিজ্য নয়, কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যকেও শুল্কমুক্ত করে দিয়েছিল। এই দাবি কিন্তু একেবারেই অযৌক্তিক এবং অসঙ্গত। যে-উদ্দেশ্য ও প্রেক্ষিতে ওই ফরমান দেওয়া হয়েছিল, তা বিশ্লেষণ করে অনেকদিন আগেই আমরা দেখিয়েছি যে, ১৭১৭-এর ফরমান শুধু কোম্পানির আমদানি-রফতানি বাণিজ্যকেই শুল্ক থেকে অব্যাহতি দিয়েছিল, কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যকে নয়।1
ফলে মুর্শিদকুলির সময় থেকেই এ নিয়ে কোম্পানির কর্মচারীদের সঙ্গে বাংলার শাসকদের প্রায়ই বিবাদ-বিসংবাদ লেগে থাকত। কখনও কখনও ওই বিবাদের সুযোগ নিয়ে বাংলার নবাবের আদেশে কোম্পানির বেচাকেনা একদম বন্ধ করে দেওয়া হত। বিরোধ যখন চরমে উঠত তখন বেগতিক দেখে কোম্পানি নবাব ও তাঁর অমাত্যদের মোটা নজরানা দিয়ে মীমাংসা করে নিত। কখনও বা ইংরেজরা পালটা ব্যবস্থা হিসেবে হুগলি নদীতে এশীয়দের বাণিজ্যতরী আটকে দিত। আমাদের অজ্ঞাতনামা ইংরেজ লেখক লিখেছেন: ‘কোম্পানির দস্তকের অপব্যবহার নবাবের হাতে ন্যায্য হাতিয়ার তুলে দিয়েছিল যাতে নবাব ইচ্ছে করলে কোম্পানির বেচাকেনা বন্ধ করে দিতে পারতেন।’ ওই লেখক আরও বলেছেন: ‘দস্তকের যথেচ্ছ অপব্যবহারের ফলে কোম্পানির কাছ থেকে নবাব মোটা টাকা আদায় করার সুযোগ পেয়েছিলেন। এভাবে টাকা আদায় করাটা নবাবের পক্ষে বেশি বাড়াবাড়ি বলে গণ্য করা যায় না।’2 দস্তকের অন্যায় অপব্যবহারের প্রশ্ন আগের নবাবরাও তুলেছিলেন, সিরাজদ্দৌল্লা প্রথম নন। তবে তিনি এই অবৈধ ও বে-আইনি ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে চেয়েছিলেন। তাই হয়তো কোম্পানির কর্মচারীরা শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল যে এটার মাধ্যমে তাদের রাতারাতি বড়লোক হওয়ার সবচেয়ে সহজ ও লোভনীয় উপায়টি এবার বন্ধ হয়ে যাবে।
কোম্পানির কর্মচারীরা দস্তকের অপব্যবহারকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল যে আমাদের অজ্ঞাতনামা ইংরেজ লেখক লিখছেন ‘কী লজ্জাকর বেশ্যাবৃত্তিই না চলছে দস্তক নিয়ে।’ তিনি আরও জানাচ্ছেন, দরবারের গুপ্তচরেরা ‘দস্তক নিয়ে এই বেশ্যাবৃত্তির’ খবর রোজ দরবারে পৌঁছে দিত।3 এখানে মনে রাখা দরকার, সিরাজদ্দৌল্লা কিন্তু একেবারে মৌলিক প্রশ্ন যেটা, সেটা তখনও তোলেননি। কোম্পানির কর্মচারীরা দস্তকের ভাঁওতা দিয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবসার ব্যাপারে যে শুল্ক ফাঁকি দিত সেটা জেনেও সিরাজদ্দৌল্লা সে-অবৈধ অধিকারকে চ্যালেঞ্জ করেননি। তিনি প্রধানত কোম্পানির কর্মচারীরা মোটা টাকার বিনিময়ে দস্তকের মাধ্যমে এশীয় ব্যবসায়ীদের যে শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিত তাতেই বিশেষ আপত্তি জানিয়েছিলেন এবং এভাবে নবাব সরকারের যে রাজস্ব হানি হচ্ছিল তা বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। আমাদের পাণ্ডুলিপির অজ্ঞাতনামা ইংরেজ লেখক জানাচ্ছেন: 4
সিরাজদ্দৌল্লা ঘোষণা করেছিলেন, তাঁর কাছে যে সমস্ত রসিদ আছে তা থেকে তিনি প্রমাণ করতে পারবেন যে, ইংরেজরা ফারুখশিয়রের ফরমান পাওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত এশীয় ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যকে কোম্পানির দস্তকের মাধ্যমে শুল্ক মুক্ত করে দিয়ে বাংলার নবাবকে তাঁর ন্যায্যপ্রাপ্ত দেড় কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করেছে।
বাংলায় প্রশীয় কোম্পানির অধিকর্তা জন ইয়াং ইংরেজদের বিরুদ্ধে নবাব এবং দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের অসন্তোষ ও ক্ষোভের কারণ জানাতে গিয়ে গভর্নর ড্রেককে লিখেছিলেন: ‘এদেশীয় ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যকে শুল্কমুক্ত করার জন্য আপনাদের দস্তকের যে যথেচ্ছ অপব্যবহার করা হচ্ছে তা নিয়মিত বেশ্যাবৃত্তির পর্যায়ে পড়ে। এতে নবাবের যথেষ্ট রাজস্ব হানি হচ্ছে এবং এটা তাঁর সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এর ফলেই তিনি আপনাদের প্রতি বিরূপ হয়েছেন।’5 এমনকী হিল পর্যন্ত স্বীকার করেছেন যে: 6
ইংরেজদের ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য যে-সব সুযোগ সুবিধে দেওয়া হয়েছিল, তার অপব্যবহার সম্বন্ধে এটা স্বীকার করতে হবে যে ইংরেজরা দস্তক বা বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার অনুমতিপত্র যেভাবে ব্যবহার করেছে, তা ফরমানে কখনওই বলা হয়নি। এই ফরমান শুধু কোম্পানিকেই শুল্কমুক্ত বাণিজ্য করার সুবিধে দিয়েছিল কিন্তু ইংরেজরা এই দস্তক দিয়ে কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য শুধু নয়, দেশীয় ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যও শুল্কমুক্ত করে দিত।
ওপরের তথ্যপ্রমাণ ও বিশ্লেষণ থেকে এটা স্পষ্ট যে, দস্তক নিয়ে সিরাজদ্দৌল্লার অভিযোগ যথার্থ, একে মিথ্যা অজুহাত বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।