» » সিরাজদ্দৌল্লা ও ইংরেজ কোম্পানির সংঘাত

বর্ণাকার

কেল্লার সংস্কার ও দুর্ভেদ্যীকরণ

উপরোক্ত অভিযোগগুলিকে কেন্দ্র করেই যেহেতু ইংরেজদের সঙ্গে সিরাজদ্দৌল্লার বিরোধ, সেজন্য এগুলি আদৌ ভিত্তিহীন কি না তা খুব সতর্কতার সঙ্গে বিচার করা দরকার। তখনকার সব সরকারি নথিপত্র থেকে স্পষ্ট, সব ইউরোপীয় কোম্পানিই এ সময় তাদের কেল্লাগুলিকে সুসংহত ও দুর্ভেদ্য করে তোলার প্রচেষ্টায় লিপ্ত ছিল। সপ্তদশ শতকের শেষদিকে মেদিনীপুরের চন্দ্রকোণার জমিদার শোভা সিং-এর বিদ্রোহের সময় বাংলার সুবাদার ইউরোপীয় কোম্পানিগুলিকে তাদের কেল্লা সুসংহত করার যে ঢালাও অনুমতি দেন, তার সুযোগ নিয়ে তারা তাদের কেল্লাগুলিকে দুর্ভেদ্য করে তুলছিল।1 আবার, ১৭৪০-এর দশকে মারাঠা আক্রমণের সময় ইংরেজরা ফোর্ট উইলিয়ামে পেরিনের উদ্যানের দিকটাতে দুর্ভেদ্য প্রাচীর ও অপসারণীয় সেতু তৈরি করে এবং ফোর্ট উইলিয়ামের চারিদিকে গড়খাই খনন করে। এর পরেও লন্ডন থেকে কোম্পানির পরিচালক সমিতি কলকাতায় নির্দেশ পাঠায় (১৬ জানুয়ারি, ১৭৫২), ‘নবাবের অনুমতি নিয়ে বা অন্য কোনও উপায়ে’ ফোর্ট উইলিয়াম কেল্লা আরও শক্তিশালী করে তুলতে।2 এর আগেও অবশ্য তারা কলকাতাকে জানিয়েছিল (১৭ জুন ১৭৪৮) যে বাংলার নবাব যদি কেল্লা সুরক্ষিত করার অনুমতি দিতে না চান তবে যেন তাঁকে সাবধান করে দেওয়া হয় যে, এর ফল দেশের এবং দেশের রাজস্বের পক্ষে খুবই ক্ষতিকারক হবে। সঙ্গে সঙ্গে এটাও যেন জানিয়ে দেওয়া হয় যে, ইংল্যান্ডের রাজা কোম্পানির হিতাকাঙক্ষী। ফলে কোম্পানি যা করবে, তিনি তা সমর্থন করবেন।3 এমনকী ১৭৫৪ সালেও কোম্পানির পরিচালক সমিতি কলকাতায় লিখছে, নবাবকে বোঝাতে যে, ইংরেজদের কেল্লা সুসংহত করার মূল উদ্দেশ্য অন্য ইউরোপীয়দের হাত থেকে কোম্পানির অর্থসম্পত্তি রক্ষা করা এবং বাংলায় শান্তি বজায় রাখা।4 এ থেকে স্পষ্ট, ফরাসিদের হাত থেকে ইংরেজদের রক্ষা করতে নবাবের সাধ্যে কুলোবে কি না সে-বিষয়ে ইংরেজরা যথেষ্ট সন্দিহান ছিল এবং এটা সিরাজদ্দৌল্লার শ্লাঘায় আঘাত করেছিল।

প্রকৃতপক্ষে ইংরেজরা ফোর্ট উইলিয়ামের কেল্লা সুদৃঢ় ও সুরক্ষিত করার জন্য বেশ সচেষ্ট ছিল। ১৭৫৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ড্রেক ও ম্যানিংহাম (Manningham) কলকাতা থেকে লন্ডনে যে চিঠি লেখেন তা থেকে এটা পরিষ্কার: 5

কর্নেল স্কটের [Colonel Scott] মৃত্যুতে [কলকাতার কেল্লাকে দুর্ভেদ্য করার] তাঁর যে পরিকল্পনা (দেশীয় [নবাবের] আক্রমণ থেকে আমাদের বসতিকে রক্ষা করার জন্য) তা যথেষ্ট তৎপরতার সঙ্গে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। কারণ তাতে যে পরিমাণ খরচ হবে তা করতে আমরা দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম। কিন্তু আপনারা তা অনুমোদন করার ফলে এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তা করার চেষ্টা করব। তবে আবহাওয়া কেমন থাকে তার ওপর কাজের অগ্রগতি কিছুটা নির্ভর করবে। এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন, নবাবি সরকারের মনোভাব যদিও বেশ কঠিন, এখনও পর্যন্ত আমাদের কাজে বাধা দিতে তারা কোনও চেষ্টা করেনি।

বলা বাহুল্য, লন্ডনের পরিচালক সমিতি কলকাতার কেল্লা সুদৃঢ় করার জন্য স্কটের পরিকল্পনা অনুমোদন করেছিল।

এদিকে ড্রেক ও ম্যানিংহাম ওয়াটসের অভিমত চাইলেন, কর্নেল স্কটের পরিকল্পনা রূপায়ণ করতে নবাবের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন আছে কি না এবং না-নিলে কোনও ঝামেলা হতে পারে কি না তা জানতে। তার উত্তরে ওয়াটস জানালেন: ‘কলকাতার কেল্লা সুরক্ষিত করার ব্যাপারে আগে থেকে নবাবের অনুমতি চাওয়া একেবারেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। কারণ নবাব যদি অনুমতি দিতে অস্বীকার করেন, তা হলে আমাদের পুরো পরিকল্পনাই বাতিল করতে হবে। নয়তো নবাবকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে আমাদের এগোতে হবে।’6 বাংলার নবাবের কর্তৃত্বকে ইংরেজরা এ সময় কী রকম তাচ্ছিল্য এবং অবজ্ঞা করতে শুরু করে, ওয়াটসের এই বিধি তার নিদর্শন। ওয়াটস আরও লিখেছেন: ‘নবাব আলিবর্দির হয়তো চোখেই পড়বে না যে আমরা কলকাতার কেল্লা সুদৃঢ় করে তুলছি। সুতরাং নবাবের অনুমতি নেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। কাজটা তাড়াতাড়ি শুরু করে দেওয়াই উচিত।’7 গভর্নর ড্রেক ও ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল নবাবের অনুমতির তোয়াক্কা না করেই কলকাতার কেল্লা আরও দুর্ভেদ্য ও শক্তিশালী করে তোলার কাজ শুরু করে দিল।

অধুনা কোনও কোনও ঐতিহাসিকের বক্তব্য, ইংরেজরা ফরাসিদের আক্রমণের ভয়েই কলকাতার কেল্লা সুসংহত করেছিল।8 কিন্তু লন্ডনের পরিচালক সমিতিকে লেখা ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের চিঠি এ-বক্তব্যের অসারতা প্রমাণ করে। কাউন্সিল লন্ডনে পরিষ্কার লেখে যে, ফোর্ট উইলিয়াম কেল্লা শক্তিশালী করা হচ্ছে ‘দেশীয় শত্রুদের’ (অবশ্যই নবাব) বিরুদ্ধে কাজে লাগাবার জন্য।9 এর আগেই আমরা দেখেছি, ড্রেক এবং ম্যানিংহামও লন্ডনে লিখেছিলেন যে দুর্গকে দুর্ভেদ্য করা হচ্ছে ‘দেশীয় শত্রুদের আক্রমণ প্রতিহত করতে।’ এ-সব তথ্য থেকে সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে ইংরেজরা বাংলার নবাবের কর্তৃত্ব অগ্রাহ্য করে এবং তাঁর অনুমতি না নিয়েই ফোর্ট উইলিয়ামের কেল্লা দুর্ভেদ্য করে তুলছিল মূলত বাংলার নবাবের সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিরোধ করতে। দক্ষিণ ভারতে ইংরেজ ও ফরাসিদের কাণ্ডকারখানা দেখে এবং বাংলার মসনদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা মনে রেখে সিরাজদ্দৌল্লা স্বাভাবিকভাবেই ইংরেজদের এ-প্রচেষ্টায় আশঙ্কিত হয়েছিলেন। এ-বিষয়ে আমাদের অজ্ঞাতনামা ইংরেজ লেখকের বক্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ: 10

নবাব সুবাদার তাঁর রাজ্যে ইউরোপীয়দের স্বাধীন ক্ষমতা দেখে শঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং তাদের ক্ষমতা হ্রাস করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন। এদের মধ্যে ইংরেজরা সবচেয়ে শক্তিশালী বলে তারাই তাঁর ন্যায়সঙ্গত নীতির [just policy] প্রধান লক্ষ্য হয়ে পড়ে। তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, ইংরেজরা যদি জাফর খানের [মুর্শিদকুলি খান] সময় তারা যে-ভাবে বাংলায় ব্যবসাবাণিজ্য করত সে অবস্থায় ফিরে না যায়, তা হলে তিনি তাদের বাংলা থেকে বিতাড়িত করে ছাড়বেন। এটা স্পষ্ট যে সিরাজদৌল্লার প্রধান ও আসল উদ্দেশ্য ছিল [কলকাতার] কেল্লা ও যুদ্ধসরঞ্জাম ধ্বংস করা।

এখানে বলা প্রয়োজন যে, ইংরেজদের প্রতি কোনও বিরূপ বা শত্রুতামূলক মনোভাবের জন্য তাদের দুর্গ শক্তিশালী করাতে নবাব আপত্তি জানাননি। সিরাজদ্দৌল্লা সব ইউরোপীয়দেরই এই নির্দেশ দিয়েছিলেন। জাঁ ল’-র লেখা থেকে জানা যায় যে, নবাব একই সময় ইংরেজ এবং ফরাসি দু’পক্ষকেই আলিবর্দির রাজত্বের শেষ দিক থেকে তাদের দুর্গগুলি সুরক্ষিত করার জন্য যে-সব নির্মাণকার্য করেছিল সব ভেঙে দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি ল’-কে চিঠি লিখে জানান যে, তিনি দুর্গের সংস্কারে আপত্তি করছেন না, করছেন নতুন নির্মাণকার্যে। ফরাসিরা বিনীতভাবে নবাবকে জানায় যে তারা দুর্গে নতুন কিছু করেনি—ফলে ব্যাপারটা সহজেই মিটে গেছল।11 কিন্তু আমরা আগেই দেখেছি, ইংরেজদের মনোভাব ছিল আক্রমণাত্মক ও অবজ্ঞাপূর্ণ। এমনকী হিল সাহেবও স্বীকার করেছেন, ইংরেজরা তাদের দুর্গ সুরক্ষিত করার প্রশ্নে তাদের ‘অধিকারের সীমা অতিক্রম’ করেছিল এবং নবাবের ‘অনুমতি না নিয়েই’ বে-আইনিভাবে কলকাতার কেল্লা সুসংহত করেছিল।12 সুতরাং দেখা যাচ্ছে এ-ব্যাপারে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজদ্দৌল্লার অভিযোগ সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত, এটাকে ইংরেজদের আক্রমণ করার জন্য তাঁর মিথ্যা ওজর বলে নস্যাৎ করা যায় না।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. S. Chaudhury, Trade and Commercial Organization, pp. 39-40.
  2. ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখা কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসের চিঠি, DB, vol. 3, 16 Jan. 1752.
  3. ফোর্ট উইলিয়ামকে লেখা কোর্টের চিঠি, ১৭ জুন ১৭৪৮, DB, vol. 2.
  4. ফোর্ট উইলিয়ামকে লেখা কোর্টের চিঠি, DB, vol. 4, 29 Nov. 1754; FWIHC, vol. 1, p. 68.
  5. কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা ড্রেক ও ম্যানিংহামের চিঠি, ৩ সেপ্টেম্বর ১৭৫৫; FWIHC, vol. 1, p. 882.
  6. ড্রেক ও ম্যানিংহামকে লেখা ওয়াটসের চিঠি, ১৫ আগস্ট ১৭৫৫, Annex to Drake and Manningham’s Letter to Court, 3 Sept. 1755, Bengal Letters Recd. vol. 23, ff. 4-5; FWIHC, vol. 1, pp. 883-85.
  7. ড্রেক ও ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখা ওয়াটসের চিঠি, BPC, vol. 28, 15 Aug. 1755.
  8. C. A. Bayly, Indian Society, p. 50; Rajat Kanta Ray, ‘Colonial Penetration’, p. 9.
  9. ড্রেক ও ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখা ওয়াটসের চিঠি, BPC, vol. 28, 15 Aug. 1755; C. R. Wilson, Old Fort William, vol. II, p. 31.
  10. Mss. Eur. D. 283, f. 26. প্রায় একই রকম বক্তব্য কোর্টকে লেখা হলওয়েলের চিঠিতে, ৩০ নভেম্বর ১৭৫৬, Hill, II, p. 18.
  11. Law’s Memoir, Hill, III, pp. 164-65.
  12. Hill, I, pp. liv-ly.