» » সিরাজদ্দৌল্লা ও ইংরেজ কোম্পানির সংঘাত

বর্ণাকার

এর পরের যে ঘটনাবলী তার সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে সিরাজদ্দৌল্লা এতসব সত্ত্বেও দম্ভসূচক বা হঠকারিতার কোনও কাজ করেননি। তিনি তাঁর দরবারের বিশিষ্ট ব্যক্তি ও অমাত্যদের ডেকে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্বন্ধে পরামর্শ চাইলেন। মুজাফ্‌রনামা-র লেখক করম আলির তথ্য অনুযায়ী, সিয়রে-র লেখক গোলাম হোসেন, জয়নাল আবেদিন, মীর্জা হাবিব বেগ, মীর হাসাউল্লা প্রমুখের নেতৃত্বে একদল পরামর্শ দিল, ইংরেজদের না ঘাঁটাতে, তারা ‘আগুনের শিখার মতো’ (‘flames of fire’), অন্যদিকে খোজা ওয়াজিদ, রায়দুর্লভ, মীরজাফর প্রমুখের নেতৃত্বে সবচেয়ে প্রভাবশালী গোষ্ঠী পরামর্শ দিল, ইংরেজদের প্রতি ‘দৃঢ় কূটনীতির সঙ্গে প্রয়োজনে অস্ত্রধারণের নীতি’ (‘a policy of firmness and diplomacy combined with a show of force’) অবলম্বন করতে।1 সেই (দ্বিতীয়) পরামর্শ অনুযায়ী সিরাজদ্দৌল্লা প্রখ্যাত আর্মানি বণিক খোজা ওয়াজিদকে ইংরেজদের সঙ্গে আপস-মীমাংসার দৌত্যে নিযুক্ত করলেন। ওয়াজিদের নিযুক্তি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ মিটিয়ে নেবার জন্য তরুণ নবাবের সদিচ্ছারই প্রমাণ। এই দৌত্যের কাজে ওয়াজিদই যোগ্যতম ব্যক্তি ছিলেন সন্দেহ নেই, কারণ এই আর্মানি বণিক তখন বাংলার অগ্রণী ব্যবসায়ীদের অন্যতম এবং ইংরেজ সমেত ইউরোপীয়দের সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেনের মাধ্যমে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।

কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ওয়াজিদের দৌত্য নিষ্ফল হল। ইংরেজ গভর্নর ড্রেক তাঁর সঙ্গে অপমানসূচক ব্যবহার করেন এবং তাঁকে কলকাতা থেকে তাড়িয়ে দেন। উইলিয়াম ওয়াটসের লেখা থেকে জানা যায়, ওয়াজিদ চার বার কলকাতায় ইংরেজদের সঙ্গে দেখা করে নবাবের সঙ্গে একটা মিটমাটের চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু ইংরেজরা তাঁকে এই বলে শাসিয়েছিল যে এরকম প্রস্তাব নিয়ে ওয়াজিদ যেন আর কলকাতায় আসার চেষ্টা না করেন।2 এমনকী বাংলায় প্রুশীয় (Prussian) কোম্পানির প্রধান জন ইয়াং (John Young) নবাব ও বাংলার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ইংরেজদের প্রতি ক্ষোভের বিবরণ দিতে গিয়ে লিখেছেন: 3

[ইংরেজদের সঙ্গে] মিটমাটের জন্য যখন ফখর-উৎ-তুজ্জার [ওয়াজিদ] গেছলেন বা তাঁকে পাঠানো হয়েছিল—কোনটা আমি ঠিক জানি না, কতবার তাও না—তখন আপনারা [ইংরেজরা] নাকি কোনও কথায় কর্ণপাত করতে বা কোনও কিছু মেনে নিতে একেবারে অনিচ্ছুক ছিলেন। উপরন্তু আপনারা নাকি তাঁকে এ-কাজে আবার না আসার জন্য শাসিয়েছিলেন।

খোজা ওয়াজিদ যখন নিষ্ফল দৌত্যে ব্যস্ত, সিরাজদ্দৌল্লা তখন দুর্লভরাম ও হাকিম বেগকে কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠি অবরোধ করার জন্য নির্দেশ দিয়ে শওকত জঙ্গের বিরুদ্ধে অভিযান করার জন্য পুর্ণিয়া অভিমুখে রওনা হন।4 কিন্তু রাজমহল পৌঁছে ইংরেজদের উদ্ধত আচরণের, ড্রেকের চিঠির এবং নারায়ণ সিং-এর প্রতি দুর্ব্যবহারের খবর পেলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তড়িৎগতিতে কাশিমবাজারের দিকে প্রত্যাবর্তন করেন। ইতিমধ্যে, ২৪ মে তিনশোর মতো নবাবের সৈন্য কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠির সামনে উপস্থিত হয়। সিরাজদ্দৌল্লা কাশিমবাজার পৌঁছলেন ৩ জুন, তখন তাঁর সৈন্যসংখ্যা ৩০,০০০।5 ৪ জুন কাশিমবাজারের ইংরেজকুঠি বিনা প্রতিরোধে নবাবের কাছে আত্মসমর্পণ করে। কুঠির প্রধান উইলিয়াম ওয়াটস সিরাজের নির্দেশে এক চুক্তির শর্তাবলীতে স্বাক্ষর করলেন। এই শর্তগুলি হল: (১) নবাবের কোনও অপরাধী প্রজাকে কলকাতায় আশ্রয় দেওয়া চলবে না (২) ইংরেজরা ফোর্ট উইলিয়ামে পেরিনের উদ্যানে যে দুর্ভেদ্য প্রাচীর ও অপসারণীয় সেতু (draw bridge) তৈরি করেছে, তা ভেঙে দিতে হবে (৩) এশীয়/ভারতীয় বণিকদের কাছে ইংরেজরা দস্তক বিক্রি করতে পারবে না।6 এ থেকে পরিষ্কার, শর্তগুলি ইংরেজদের বিরুদ্ধে নবাবের নির্দিষ্ট অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে রচিত—অভিযোগগুলি আমরা পরে খতিয়ে দেখব। কাশিমবাজারের পতনের পর সিরাজদ্দৌল্লা ৫ জুন কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করেন। তাঁর নির্দেশে কাশিমবাজার কুঠির ওয়াটস এবং কোলেটও নবাবের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে কলকাতা চললেন। সিরাজ কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠির গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া আর কিছুতে হাত দেননি বা বাজেয়াপ্ত করেননি—কোনও লুঠতরাজ বা হত্যাকাণ্ড হয়নি। কোনও নিষ্ঠুরতাও নয়।7

এ পর্যন্ত ইংরেজদের সঙ্গে সিরাজদ্দৌল্লার সম্পর্কে তাঁর কোনও দাম্ভিকতা বা ঔদ্ধত্যের পরিচয় পাওয়া যায় না। কলকাতা আক্রমণ করার আগে (১৬ জুন) সিরাজ আপস-মীমাংসার জন্য ইংরেজদের অনেক সময় দিয়েছিলেন, প্রথমে অস্ত্রধারণ না করে শুধু কূটনীতি ও দৌত্যের মাধ্যমে তিনি ইংরেজদের সঙ্গে মিটমাটের চেষ্টা করেছিলেন। তা যখন ব্যর্থ হল, তখনই তিনি একদিকে দৌত্য এবং অন্যদিকে অস্ত্রধারণ করলেন। কাশিমবাজার কুঠি অবরোধ করার পেছনে বোধহয় সিরাজের উদ্দেশ্য ছিল, ওখানে ইংরেজদের নিরস্ত্র করে ওই কুঠির প্রধান ওয়াটসের মাধ্যমে কলকাতায় ইংরেজদের ওপর নবাবের সঙ্গে মিটমাট করে নেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করা। ওয়াটসের সঙ্গে চুক্তির যে শর্তাবলী, সেগুলি ইংরেজদের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগের ওপর ভিত্তি করা এবং মোটেই অযৌক্তিক কিছু নয়। তা ছাড়া এরকম ক্ষেত্রে ইউরোপীয় কোম্পানির কুঠি অবরোধ করা নতুন কিছু নয়, সিরাজের আগের নবাবরাও তা করেছেন। কাশিমবাজার কুঠির অবরোধ সম্বন্ধে রিচার্ড বেচারের মন্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ: 8

That he [Siraj] must have been greatly incensed somehow or other is certain; he had proceeded as far as Rajamahall against the Purnea Nabob, who he must have looked on as a competitor for his sub- adarry, and yet he waived his resentment against him and marched back directly to attack the English. This does not appear like a pre-meditated design but rather a sudden gust of passion. What prevented you gentlemen [the Governor and the Fort William Council] from using proper means to mollify him while on his march I do not know….

হুগলির ডাচ কুঠিয়ালরাও জানাচ্ছে যে ইংরেজরা ফোর্ট উইলিয়ামের দুর্গকে দুর্ভেদ্য করার জন্য যে-সব নির্মাণকার্য করেছিল, সেগুলি ভেঙে দেবার জন্য নবাবের নির্দেশে তারা কর্ণপাত করেনি। এভাবে তাঁকে অগ্রাহ্য করার জন্যই নবাব কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠি দখল করেন।9

সিরাজদ্দৌল্লার ‘অর্থলিপ্সার’ কোনও প্রমাণ কিন্তু সমসাময়িক নথিপত্রে পাওয়া দুষ্কর, যদিও শুধু হিল সাহেব নন, এমনকী অধুনাও কোনও কোনও ঐতিহাসিক সোজাসুজি বা প্রচ্ছন্নভাবে তার ইঙ্গিত দিয়েছেন।10 এখানে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, সিরাজ যদি অর্থলোলুপ হতেন, তা হলে কাশিমবাজার কুঠির পতনের পর ইংরেজদের ওখানকার সব ধনসম্পত্তি তিনি অনায়াসে আত্মসাৎ করতে পারতেন। তিনি কিন্তু কিছুতে হাত দেননি, শুধু ইংরেজদের অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ বাজেয়াপ্ত করেছিলেন। তিনি তাদের কাছ থেকে কোনও অর্থও দাবি করেননি। তার চেয়েও বড় কথা, ওয়াটস যে-সব শর্তাবলীতে সই করেছিলেন, তাতেও অর্থের কোনও কথা ছিল না, যদিও এ রকম ক্ষেত্রে অর্থের দাবি করাটা প্রচলিত রীতি ছিল এবং বাংলার পূর্বেকার নবাবরা তা করেছিলেন। সিরাজদ্দৌল্লা যে ইংরেজদের সঙ্গে একটা শান্তিপূর্ণ মীমাংসা করতে চেয়েছিলেন এবং তাঁর তথাকথিত ‘অর্থলিপ্সা’ যে তাতে কোনও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি, তা ওয়াটস ও কোলেটের চিঠি থেকে স্পষ্ট: ‘নবাব যে একটা আপস-মীমাংসা করতে চেয়েছিলেন তার প্রমাণ তিনি কাশিমবাজারে যুদ্ধের সাজসরঞ্জাম ছাড়া কোম্পানির অন্য কোনও জিনিসে হাত পর্যন্ত দেননি।’11 পরে অবশ্য কলকাতা আসার পথে নবাবের দেওয়ান ও সেনাপতি দুর্লভরাম ওয়াটস ও কোলেটের কাছে অর্থের দাবি করেন—নবাব নন—তাও খুব একটা জোর দিয়ে নয়, অনেকটা তাদের যাচাই করার জন্য, অর্থের বিনিময়ে ইংরেজরা নবাবের কলকাতা অভিযান বন্ধ করতে রাজি কি না দেখতে হয়তো।12 ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের অনেকে অবশ্য ভেবেছিল কিছু টাকাপয়সা দিয়ে নবাবের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করা যেত কিন্তু ইংরেজদের প্রতি সিরাজদৌল্লার অসন্তোষ এত তীব্র হয়ে উঠেছিল যে শুধু অর্থ দিয়ে তা দূর করা সম্ভব ছিল না বলেই মনে হয়। অবশ্য এটা ঠিক যে, কলকাতা দখল করার পর মুর্শিদাবাদ ফেরার পথে তিনি ডাচদের কাছ থেকে সাড়ে চার লক্ষ টাকা ও ফরাসিদের থেকে সাড়ে তিন লক্ষ টাকা নজরানা হিসেবে নিয়েছিলেন।13 কলকাতার ইংরেজ কোষাগারে নবাব মাত্র চল্লিশ হাজার টাকার মতো পেয়েছিলেন। এখানে স্মর্তব্য, বাংলার সব নবাবই কোনও যুদ্ধজয়ের পর বা ওরকম উপলক্ষে বিদেশি বণিক ও দেশীয় সওদাগরদের কাছ থেকে প্রথাগত নজরানা আদায় করতেন—নজরানার পরিমাণ অনেক ক্ষেত্রে বেশিও হত। তবু বেছে বেছে অর্থলিপ্সার অপবাদ সিরাজের ঘাড়ে চাপানো কেন?

সিরাজদ্দৌল্লার কলকাতা আক্রমণের সময় ইংরেজ কোম্পানির যে ক্ষয়ক্ষতি হয় (আনুমানিক বারো লক্ষ টাকার মত14) তা মূলত সংঘর্ষের সময় অগ্নিকাণ্ডের জন্যই। লুঠতরাজ অবশ্য হয়েছিল সন্দেহ নেই। ইংরেজ কোম্পানির সরকারি ঐতিহাসিক রবার্ট ওরমের (Robert Orme) মতে তার জন্য দায়ী ছিলেন রাজা মানিকচাঁদ, সিরাজ নন। পরে সিরাজ তাঁকে এজন্য কারাদণ্ড দেন এবং দশ লক্ষ টাকা জরিমানা দিয়ে তিনি শেষে মুক্তি পান।15 সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে অর্থলোলুপতার অভিযোগ যে কত অসার এবং তা যে দু’পক্ষের মধ্যে বিরোধের জন্য একেবারেই দায়ী নয় তা এক অজ্ঞাতনামা ইংরেজের লেখা [লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে রক্ষিত] পাণ্ডুলিপি থেকে স্পষ্ট। ওই লেখক বলছেন: ‘বাংলার সুবাদার [সিরাজদ্দৌল্লা] যা চেয়েছিলেন তা মোটেই অর্থ নয়—অর্থের ব্যাপারটা ছিল নিতান্তই গৌণ। তিনি আসলে চেয়েছিলেন, ইউরোপীয়রা নিজেদের সুসংহত করার জন্য দুর্গগুলিকে যেভাবে দুর্ভেদ্য করে তুলছিল, তার সম্পূর্ণ অবসান।16 এমনকী যে হলওয়েল সিরাজের প্রতি মোটেই সদয় ছিলেন না, তাঁর ব্যাপারও প্রমাণ করে যে, সিরাজ মোটেই অর্থগৃধ্নু ছিলেন না। কলকাতার পতনের পর যখন হলওয়েলকে বন্দি হিসেবে নবাবের কাছে উপস্থিত করা হল, তখন তিনি নবাবকে জানান যে, যুদ্ধের ফলে তাঁর ব্যক্তিগত অনেক ক্ষয়ক্ষতি হলেও নবাবকে ভাল পরিমাণ অর্থ দিয়েই তিনি তাঁর মুক্তি কিনতে চান। সিরাজ এর উত্তর দিয়েছিলেন: ‘হলওয়েলের টাকা থাকলে তাঁর নিজের কাছেই থাক। তাঁর অনেক যন্ত্রণাভোগ হয়েছে, তাঁকে মুক্তি দেওয়া হোক।’17 এ থেকে একটা জিনিস সুস্পষ্ট যে সিরাজদ্দৌল্লা অর্থলোলুপ ছিলেন না এবং অন্তত কিছুটা মানবিকতাবোধও তাঁর মধ্যে ছিল। বেশির ভাগ ঐতিহাসিক তাঁকে যতটা ‘অমানুষ’ ভাবেন, ততটা ‘অমানুষ’ হয়তো তিনি ছিলেন না।

ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজদ্দৌল্লার অভিযোগ: ন্যায়সঙ্গত না শুধু মিথ্যা ওজর?

ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজদ্দৌল্লার তিনটে নির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল এবং আমাদের কাছে যে-সব তথ্যপ্রমাণ আছে তা থেকে স্পষ্ট যে এগুলি খুবই ন্যায়সঙ্গত। এগুলিকে ইংরেজদের আক্রমণ করার জন্য ‘শুধু মিথ্যা ওজর’ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তিনটে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে কেন্দ্র করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজদ্দৌল্লার অভিযোগ:

(১) ফোর্ট উইলিয়াম কেল্লার সংস্কার ও এটাকে দুর্ভেদ্য এবং সুসংহত করার প্রচেষ্টা।

(২) দস্তকের বা বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার অনুমতিপত্রের যথেচ্ছ অপব্যবহার।

(৩) নবাবের অপরাধী প্রজাদের কলকাতায় আশ্রয়দান।

খোজা ওয়াজিদকে ইংরেজদের সঙ্গে আপস-মীমাংসার দৌত্যে নিযুক্ত করার পর সিরাজদ্দৌল্লা তাঁকে একটা চিঠিতে ইংরেজদের প্রসঙ্গে তাঁর নিজের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন: 18

তিনটে মুখ্য কারণে আমি আমার রাজ্য থেকে ইংরেজদের বহিষ্কার করতে চাই। প্রথমত, দেশের কোনও আইনকানুন না মেনে তারা বাদশাহি মুলুকে [বাংলায়] গড়খাই কেটে জোরদার কেল্লা বানিয়েছে। দ্বিতীয়ত, তারা দস্তকের যথেচ্ছ অপব্যবহার করেছে, এমন সব লোককে দস্তক দিয়েছে যারা কোনওমতেই তা পেতে পারে না এবং তাতে বাদশাহের [রাজ্যের] রাজস্বের যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। তৃতীয়ত, নবাবকে অগ্রাহ্য করে নবাবের অপরাধী প্রজাদের নবাবের বিচারের হাত থেকে তাদের রেহাই দিতে কলকাতায় আশ্রয় দিচ্ছে।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. করম আলি, মুজাফ্‌ফরনামা, পৃ. ৬৩-৬৪। এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় তা হল সিয়রে-র লেখক গোলাম হোসেন খানের সিরাজের প্রতি বিরূপ মনোভাব। তিনি এক জায়গায় বলছেন, সিরাজ ‘কারও সঙ্গে আলোচনা করতে বা কারও পরামর্শ নিতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছুক ছিলেন না’ এবং ‘কারও সঙ্গে পরামর্শ না করেই শুধুমাত্র নিজের অভিপ্রায় অনুযায়ী এই অনভিপ্রেত ও অশুভ অভিযানে [কাশিমবাজার ও কলকাতা আক্রমণ] লিপ্ত হয়ে পড়েন।’ কিন্তু পরে গোলাম হোসেন নিজের উক্ত বক্তব্যের সম্পূর্ণ উল্টো কথা বলেছেন—তিনি লিখেছেন: ‘সিরাজ যাদের সঙ্গে [এ ব্যাপারে] পরামর্শ করেছিলেন, তারা সিরাজের অপছন্দ হতে পারে এমন কোনও পরামর্শ দেওয়া থেকে বিরত থাকেন।’ সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৮৮-৮৯।
  2. ওয়াটস ও কোলেটের চিঠি, ফোর্ট সেন্ট জর্জ কাউন্সিলকে লেখা, চন্দননগর, ৭ জুলাই ১৭৫৬, Hill, I, p. 58; কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা ওয়াটস ও কোলেটের চিঠি, চন্দননগর, ১৬ জুলাই ১৭৫৬, Hill, I, p. 104.
  3. Hill, I, pp. 62-63.
  4. Hill, II, pp. 142-43.
  5. কোম্পানিদের জব্দ করতে বা তাদের বেচাল দেখলে বাংলার নবাবরা অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে কোম্পানির কুঠি বা বাণিজ্য অবরোধ করে তাদের সোজা পথে আনার চেষ্টা করতেন।
  6. ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখা ফ্রান্সিস সাইকসের [Francis sykes] চিঠি, কাশিমবাজার, ৪ জুন ১৭৫৬, Hill, I, p. 10.
  7. জাঁ ল’-র তথ্য [Law’s Memoir, Hill, III, 166] অবলম্বন করে হিল জানাচ্ছেন যে ওয়াটসের হাত দুটি পেছনে বাঁধা অবস্থায় তাঁকে বন্দি হিসেবে সিরাজের সামনে উপস্থিত করা হয় (Hill, I, p. lix)| অন্যদিকে উইলিয়াম টুক লিখছেন যে ওয়াটসের হাত দুটি একটা রুমাল দিয়ে মোড়া হয়েছিল, শুধুমাত্র ওয়াটসের বশ্যতা স্বীকার বোঝাবার জন্য (Tooke’s Narrative, Hill, I, p. 252)৷ এটা যদিও বলা হয় যে ওয়াটস এবং কোলেট দু’জনকেই বন্দি করে রাখা হয়েছিল, তাঁরা কেউ কিন্তু এই অভিযোগ করেননি যে তাঁদের হাত পা বেঁধে রাখা হয়েছিল (ফোর্ট সেন্ট জর্জ কাউন্সিলকে লেখা ওয়াটস ও কোলেটের চিঠি, ২ জুলাই ১৭৫৬, Hill, I, p. 46; কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা ওয়াটস ও কোলেটের চিঠি, Hill, I, p. 10)। এখানে উল্লেখযোগ্য যে সাইকস ও কোলেট, যাঁরা দুজনেই তখন কাশিমবাজারে ছিলেন, ৪ জুন ১৭৫৬-তে লিখছেন যে নবাব কলকাতা রওনা হওয়ার সময় তাঁর সঙ্গে ওয়াটস, কোলেট ও বেটসনকে সঙ্গে নিয়ে যান, কিন্তু বন্দি করে নিয়ে যান, এমন কথা লেখেননি (ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখা কোলেটের চিঠি, ৪ জুন ১৭৫৬, Hill, I, p. 9; সাইকসের চিঠি, ৪ জুন ১৭৫৬, Hill, I, p. 10)। একটা বেশ চালু গল্প হচ্ছে যে ওয়াটস সিরাজের পা জড়িয়ে ধরে ‘আমি তোমার গোলাম’, ‘আমি তোমার গোলাম’ বলে কান্নাকাটি করেছিলেন। সেটা নেহাতই বাজারে গল্প, যার কোনও ভিত্তি নেই। এমনকী হিল পর্যন্ত এটা বিশ্বাস করেন না। কিন্তু তা সত্ত্বেও এখনও কোনও কোনও ঐতিহাসিক এ গল্পের পুনরাবৃত্তি করার লোভ সামলাতে পারেন না। যেমন রজতকান্ত রায়, পলাশী, পৃ. ২৬, ২৯; ‘Colonial Penetration’, p. 10.
  8. ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখা রিচার্ড বেচারের চিঠি, ২৫ জানুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, p. 161. জোরটা আমি দিয়েছি।
  9. ব্যাটাভিয়াতে লেখা হুগলি ডাচ কাউন্সিলের চিঠি, ৫ জুলাই ১৭৫৬, Hill, I, p. 53.
  10. Rajat Kanta Ray, পলাশী,, পৃ. ১৫৬; C. A. Bayly, Indian Society, pp. 49-50; P, J. Marshall, Bengal, p. 76.
  11. কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা ওয়াটস ও কোলেটের চিঠি, ১৬ জুলাই ১৭৫৬, Hill, I. p. 103; কোর্টকে লেখা ওয়াটসের চিঠি, ৩০ জানুয়ারি ১৭৫৭, Hill, III, p. 336.
  12. Hill, I, pp. 58, 60, 103, 118; III, p. 336.
  13. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 80.
  14. ঐ, পৃ. ৮১-৮২।
  15. Robert Orme, Military Transactions, II, p. 147.
  16. Mss. Eur. D. 283, f. 27.
  17. Holwell’s Narrative, Hill, III, p. 152.
  18. খোজা ওয়াজিদকে লেখা সিরাজদ্দৌল্লার চিঠি, ১ জুন ১৭৫৬, Hill, III, p. 152.