» » » পঞ্চম পরিচ্ছেদ : হাসে

বর্ণাকার

বজরার ভিতরে আসিয়া আমিয়ট গল্ষ্ট নকে বলিলেন, “এই স্ত্রীলোক একাকিনী চরে বসিয়া কাঁদিতেছিল। ও আমার কথা বুঝে না, আমি উহার কথা বুঝি না। তুমি উহাকে জিজ্ঞাসা কর।”

গল্‌ষ্টন প্রায় আমিয়টের মত পণ্ডিত; কিন্তু ইংরেজ মহলে হিন্দিতে তাঁহার বড় পশার। গল্‌ষ্টন তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে তুমি?”

শৈবলিনী কথা কহিল না, কাঁদিতে লাগিল।

গ। কেন কাঁদিতেছ?

শৈবলিনী তথাপি কথা কহিল না—কাঁদিতে লাগিল।

গ। তোমার বাড়ী কোথায়?

শৈবলিনী পূর্ববৎ।

গ। তুমি এখানে কেন আসিয়াছ?

শৈবলিনী তদ্রূপ।

গল্‌ষ্টন হার মানিল। কোন কথার উত্তর দিল না দেখিয়া ইংরেজেরা শৈবলিনীকে বিদায় দিলেন। শৈবলিনী সে কথাও বুঝিল না—নড়িল না—দাঁড়াইয়া রহিল।

আমিয়ট বলিলেন, “এ আমাদিগের কথা বুঝে না—আমরা উহার কথা বুঝি না। পোষাক দেখিয়া বোধ হইতেছে, ও বাঙ্গালির মেয়ে। একজন বাঙ্গালিকে ডাকিয়া উহাকে জিজ্ঞাসা করিতে বল।”

সাহেবের খানসামারা প্রায় সকলেই বাঙ্গালি মুসলমান। আমিয়ট তাহাদিগের একজনকে ডাকিয়া কথা কহিতে বলিলেন।

খানসামা জিজ্ঞাসা করিল, “কাঁদিতেছ কেন?”

শৈবলিনী পাগলের হাসি হাসিল। খানসামা সাহেবদিগকে বলিল, “পাগল।”

সাহেবেরা বলিলেন, “উহাকে জিজ্ঞাসা কর, কি চায়?”

খানসামা জিজ্ঞাসা করিল। শৈবলিনী বলিল, “ক্ষিদে পেয়েচে।”

খানসামা সাহেবদিগকে বুঝাইয়া দিল। আমিয়ট বলিলেন, “উহাকে কিছু খাইতে দাও।”

খানসামা অতি হৃষ্টচিত্তে শৈবলিনীকে বাবর্চিখানার নৌকায় লইয়া গেল। হৃষ্টচিত্তে, কেন না শৈবলিনী পরম সুন্দরী। শৈবলিনী কিছুই খাইল না। খানসামা বলিল, “খাও না।”

শৈবলিনী বলিল, “ব্রাহ্মণের মেয়ে; তোমাদের ছোঁওয়া খাব কেন?

খানসামা গিয়া সাহেবদিগকে এ কথা বলিল। আমিয়ট সাহেব বলিলেন, “কোন নৌকায় কোন ব্রাহ্মণ নাই?”

খানসামা বলিল, “একজন সিপাহী ব্রাহ্মণ আছে। আর কয়েদী একজন ব্রাহ্মণ আছে।”

সাহেব বলিলেন, “যদি কাহারও ভাত থাকে দিতে বল।”

খানসামা শৈবলিনীকে লইয়া প্রথমে সিপাহীদের কাছে গেল। সিপাহীদের নিকট কিছুই ছিল না। তখন খানসামা, যে নৌকায় সেই ব্রাহ্মণ কয়েদী ছিল, শৈবলিনীকে সেই নৌকায় লইয়া গেল।

ব্রাহ্মণ কয়েদী, প্রতাপ রায়। একখানি ক্ষুদ্র পান্সীনতে, একা প্রতাপ। বাহিরে, আগে পিছে সান্ত্রীর পাহারা। নৌকার মধ্যে অন্ধকার।

খানসামা বলিল, “ওগো ঠাকুর!”

প্রতাপ বলিল, “কেন?”

খা। তোমার হাঁড়িতে ভাত আছে?

প্র। কেন?

খা। একটি ব্রাহ্মণের মেয়ে উপবাসী আছে। দুটি দিতে পার?

প্রতাপেরও ভাত ছিল না। কিন্তু প্রতাপ তাহা স্বীকার করিলেন না।

বলিলেন, “পারি। আমার হাতের হাতকড়ি খুলিয়া দিতে বল।”

খানসামা সান্ত্রীকে প্রতাপের হাতকড়ি খুলিয়া দিতে বলিল। সান্ত্রী বলিল, “হুকুম দেওয়াও।”

খানসামা হুকুম করাইতে গেল। পরের জন্য এত জল বেড়াবেড়ি কে করে? বিশেষ পীরবক্স সাহেবের খানসামা; কখন ইচ্ছাপূর্বক পরের উপকার করে না। পৃথিবীতে যত প্রকার মনুষ্য আছে, ইংরেজদিগের মুসলমান সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট। কিন্তু এখানে পীরবক্সের একটু স্বার্থ ছিল। সে মনে করিয়াছিল, এ স্ত্রীলোকটার খাওয়া দাওয়া হইলে ইহাকে একবার খানসামা মহলে লইয়া গিয়া বসাইব। পীরবক্স শৈবলিনীকে আহার করাইয়া বাধ্য করিবার জন্য ব্যস্ত হইল। প্রতাপের নৌকায় শৈবলিনী বাহিরে দাঁড়াইয়া রহিল—খানসামা হুকুম করাইতে আমিয়ট সাহেবের নিকট গেল। শৈবলিনী অবগুণ্ঠনাবৃতা হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র। বিশেষ সুন্দর মুখের অধিকারী যদি যুবতী স্ত্রী হয়, তবে সে মুখ অমোঘ অস্ত্র। আমিয়ট দেখিয়াছিলেন যে, এই “জেণ্টু” স্ত্রীলোকটি নিরুপমা রূপবতী—তাহাতে আবার পাগল শুনিয়া একটু দয়াও হইয়াছিল। আমিয়ট জমাদ্দার দ্বারা প্রতাপের হাতকড়ি খুলিয়া দিবার এবং শৈবলিনীকে প্রতাপের নৌকার ভিতর প্রবেশ করিতে দিবার অনুমতি পাঠাইলেন।

খানসামা আলো আনিয়া দিল। সান্ত্রী প্রতাপের হাতকড়ি খুলিয়া দিল। খানসামাকে সেই নৌকার উপর আসিতে নিষেধ করিয়া প্রতাপ আলো লইয়া মিছামিছি ভাত বাড়িতে বসিলেন। অভিপ্রায় পলায়ন।

শৈবলিনী নৌকার ভিতরে প্রবেশ করিল। সান্ত্রীরা দাঁড়াইয়া পাহারা দিতেছিল—নৌকার ভিতর দেখিতে পাইতেছিল না। শৈবলিনী ভিতরে প্রবেশ করিয়া, প্রতাপের সম্মুখে গিয়া অবগুণ্ঠন মোচন করিয়া বসিলেন।

প্রতাপের বিস্ময় অপনীত হইলে, দেখিলেন, শৈবলিনী অধর দংশন করিতেছে, মুখ ঈষৎ হর্ষপ্রফুল্ল,—মুখমণ্ডল স্থিরপ্রতিজ্ঞার চিহ্নযুক্ত। প্রতাপ মানিল, এ বাঘের যোগ্য বাঘিনী বটে।

শৈবলিনী অতিলঘুস্বরে, কাণে কাণে বলিল, “হাত ধোও—আমি কি ভাতের কাঙ্গাল?”

প্রতাপ হাত ধুইল। সেই সময়ে শৈবলিনী কাণে কাণে বলিল, “এখন পলাও। বাঁক ফিরিয়া যে ছিপ আছে, সে তোমার জন্য।”

প্রতাপ সেইরূপ স্বরে বলিল, “আগে তুমি যাও, নচেৎ তুমি বিপদে পড়িবে।”

শৈ। এই বেলা পলাও। হাতকড়ি দিলে আর পলাইতে পারিবে না। এই বেলা জলে ঝাঁপ দাও। বিলম্ব করিও না। একদিন আমার বুদ্ধিতে চল। আমি পাগল—জলে ঝাঁপ দিয়া পড়িব। তুমি আমাকে বাঁচাইবার জন্য জলে ঝাঁপ দাও।

এই বলিয়া শৈবলিনী উচ্চৈর্হাস্য করিয়া উঠিল। হাসিতে হাসিতে বলিল, “আমি ভাত খাইব

না।” তখনি আবার ক্রন্দন করিতে করিতে বাহির হইয়া বলিল, “আমাকে মুসলমানের ভাত খাওয়াইয়াছে—আমার জাত গেল—মা গঙ্গা ধরিও।” এই বলিয়া শৈবলিনী গঙ্গার স্রোতে ঝাঁপ দিয়া পড়িল।

“কি হইল? কি হইল?” বলিয়া প্রতাপ চীৎকার করিতে করিতে নৌকা হইতে বাহির হইল। সান্ত্রী সম্মুখে দাঁড়াইয়া নিষেধ করিতে যাইতেছিল। “হারামজাদা! স্ত্রীলোক ডুবিয়া মরে, তুমি দাঁড়াইয়া দেখিতেছ?” এই বলিয়া প্রতাপ সিপাহীকে এক পদাঘাত করিলেন। সেই এক পদাঘাতে সিপাহী পান্ে‍সী হইতে পড়িয়া গেল। তীরের দিকে সিপাহী পড়িল। “স্ত্রীলোককে রক্ষা কর” বলিয়া প্রতাপ অপর দিকে জলে ঝাঁপ দিলেন। সন্তরণপটু শৈবলিনী আগে আগে সাঁতার দিয়া চলিল। প্রতাপ তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ সন্তরণ করিয়া চলিলেন।

“কয়েদী ভাগিল” বলিয়া পশ্চাতের সান্ত্রী ডাকিল। এবং প্রতাপকে লক্ষ্য করিয়া বন্দুক উঠাইল। তখন প্রতাপ সাঁতার দিতেছেন।

প্রতাপ ডাকিয়া বলিলেন, “ভয় নাই—পলাই নাই। এই স্ত্রীলোকটাকে উঠাইব—সম্মুখে স্ত্রীহত্যা কি প্রকারে দেখিব? তুই বাপু হিন্দু—বঝিয়া ব্রহ্মহত্যা করিস।”

সিপাহী বন্দুক নত করিল।

এই সময়ে শৈবলিনী সর্বশেষের নৌকার নিকট দিয়া সন্তরণ করিয়া যাইতেছিল। সেখানি দেখিয়া শৈবলিনী অকস্মাৎ চমকিয়া উঠিল। দেখিল যে, যে নৌকায় শৈবলিনী লরেন্স ফষ্টরের সঙ্গে বাস করিয়াছিল, এ সেই নৌকা।

শৈবলিনী কম্পিতা হইয়া ক্ষণকাল তৎপ্রতি দৃষ্টিপাত করিল। দেখিল, তাহার ছাদে জ্যোৎস্নার আলোকে, ক্ষুদ্র পালঙ্কের উপর একটি সাহেব অর্ধশয়নাবস্থায় রহিয়াছে। উজ্জ্বল চন্দ্ররশ্মি তাহার মুখমণ্ডলে পড়িয়াছে। শৈবলিনী চীৎকার শব্দ করিল—দেখিল, পালঙ্কে লরেন্স ফষ্টর।

লরেন্স ফষ্টরও সন্তরণকারিণীর প্রতি দৃষ্টি করিতে করিতে চিনিল—শৈবলিনী। লরেন্স ফষ্টরও চীৎকার করিয়া বলিল, “পাকড়ো! পাকড়ো! হামারা বিবি!” ফষ্টর শীর্ণ, রুগ্ন, দুর্বল, শয্যাগত উত্থানশক্তিরহিত।

ফষ্টরের শব্দ শুনিয়া চারি পাঁচ জন শৈবলিনীকে ধরিবার জন্য জলে ঝাঁপ দিয়া পড়িল। প্রতাপ তখন তাহাদিগের অনেক আগে। তাহারা প্রতাপকে ডাকিয়া বলিতে লাগিল, “পাকড়ো! পাকড়ো! ফষ্টর সাহাব ইনাম দেগা।” প্রতাপ মনে মনে বলিল, “ফষ্টর সাহেবকে আমিও একবার ইনাম দিয়াছি—ইচ্ছা আছে আর একবার দিব।” প্রকাশ্যে ডাকিয়া বলিল, “আমি ধরিতেছি—তোমরা উঠ।”

এই কথায় বিশ্বাস করিয়া সকলে ফিরিল। ফষ্টর বুঝে নাই যে, অগ্রবর্তী ব্যক্তি প্রতাপ। ফষ্টরের মস্তিষ্ক তখনও নীরোগ হয় নাই।

Leave a Reply