একমাত্র পরিচারিকা সঙ্গে, নিশাকালে রাজমহিষী, রাজপথে দাঁড়াইয়া কাঁদিতে লাগিল। কুল্সম জিজ্ঞাসা করিল, “এখন কি করিবেন?”
দলনী চক্ষু মুছিয়া বলিল, “আইস, এই বৃক্ষতলে দাঁড়াই, প্রভাত হউক।”
কু। এখানে প্রভাত হইলে আমরা ধরা পড়িব।
দ। তাহাতে ভয় কি? আমি কোন্ দুষ্কর্ম করিয়াছি যে, আমি ভয় করিব?
কু। আমরা চোরের মত পুরীত্যাগ করিয়া আসিয়াছি। কেন আসিয়াছি, তা তুমিই জান। কিন্তু লোকে কি মনে করিবে, নবাবই বা কি মনে করিবেন, তাহা ভাবিয়া দেখ।
দ। যাহাই মনে করুন, ঈশ্বর আমার বিচারকর্তা—আমি অন্য বিচার মানি না। না হয় মরিব, ক্ষতি কি?
কু। কিন্তু এখানে দাঁড়াইয়া কোন্ কার্য সিদ্ধ হইবে?
দ। এখানে দাঁড়াইয়া ধরা পড়িব—সেই উদ্দেশ্যেই এখানে দাঁড়াইব। ধৃত হওয়াই আমার কামনা। যে ধৃত করিবে, সে আমাকে কোথায় লইয়া যাইবে?
কু। দরবারে।
দ। প্রভুর কাছে? আমি সেইখানেই যাইতে চাই। অন্যত্র আমার যাইবার স্থান নাই। তিনি যদি আমার বধের আজ্ঞা দেন, তথাপি মরিবার কালে তাঁহাকে বলিতে পারিব যে, আমি নিরপরাধিনী। বরং চল, আমরা দুর্গদ্বারে গিয়া বসিয়া থাকি—সেইখানে শীঘ্র ধরা পড়িব।
এই সময়ে উভয়ে সভয়ে দেখিল, অন্ধকারে এক দীর্ঘাকারে পুরুষ-মূর্তি গঙ্গাতীরাভিমুখে যাইতেছে। তাহারা বৃক্ষতলস্থ অন্ধকারমধ্যে গিয়া লুকাইল। পুনশ্চ সভয়ে দেখিল, দীর্ঘাকার পুরুষ, গঙ্গার পথ পরিত্যাগ করিয়া সেই আশ্রয়-বৃক্ষের অভিমুখে আসিতে লাগিল। দেখিয়া স্ত্রীলোক দুইটি আরও অন্ধকারমধ্যে লুকাইল।
দীর্ঘাকার পুরুষ সেইখানে আসিল। বলিল, “এখানে তোমরা কে?” এই কথা বলিয়া, সে যেন আপনা আপনি মৃদুতর স্বরে বলিল, “আমার মত পথে পথে নিশা জাগরণ করে, এমন হতভাগা কে আছে?”
দীর্ঘাকার পুরুষ দেখিয়া, স্ত্রীলোকদিগের ভয় জন্মিয়াছিল, কণ্ঠস্বর শুনিয়া সে ভয় দূর হইল। কণ্ঠ অতি মধুর—দুঃখ এবং দয়ায় পরিপূর্ণ। কুল্সসম বলিল, “আমরা স্ত্রীলোক, আপনি কে?” পুরুষ কহিলেন, “আমরা? তোমরা কয় জন?”
কু। আমরা দুই জন মাত্র।
পু। এত রাত্রে এখানে কি করিতেছ?
তখন দলনী বলিল, “আমরা হতভাগিনী—আমাদের দুঃখের কথা শুনিয়া আপনার কি হইবে?”
শুনিয়া আগন্তুক বলিলেন, “অতি সামান্য ব্যক্তি কর্ত্তৃক লোকের উপকার হইয়া থাকে, তোমরা যদি বিপদগ্রস্ত হইয়া থাক—সাধ্যানুসারে আমি তোমাদের উপকার করিব।”
দ। আমাদের উপকার প্রায় অসাধ্য—আপনি কে?
আগন্তুক কহিলেন, “আমি সামান্য ব্যক্তি—দরিদ্র ব্রাহ্মণ মাত্র। ব্রহ্মচারী।”
দ। আপনি যেই হউন, আপনার কথা শুনিয়া বিশ্বাস করিতে ইচ্ছা করিতে করিতেছে। যে ডুবিয়া মরিতেছে, সে অবলম্বনের যোগ্যতা অযোগ্যতা বিচার করে না। কিন্তু যদি আমাদিগের বিপদ্ শুনিতে চান, তবে রাজপথ হইতে দূরে চলুন। রাত্রে কে কোথায় আছে বলা যায় না। আমাদের কথা সকলের সাক্ষাতে বলিবার নহে।
তখন ব্রহ্মচারী বলিলেন, “তবে তোমরা আমার সঙ্গে আইস।” এই বলিয়া দলনী ও কুল্সামকে সঙ্গে করিযা নগরাভিমুখে চলিলেন। এক ক্ষুদ্র গৃহের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া, দ্বারে করাঘাত করিয়া “রামচরণ” বলিয়া ডাকিলেন। রামচরণ আসিয়া দ্বার মুক্ত করিয়া দিল। ব্রহ্মচারী তাহাকে আলো জ্বালিতে আজ্ঞা করিলেন।
রামচরণ প্রদীপ জ্বালিয়া, ব্রহ্মচারীকে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করিল। ব্রহ্মচারী তখন রামচরণকে বলিলেন, “তুমি গিয়া শয়ন কর।” শুনিয়া রামচরণ একবার দলনী ও কুল্সমমের প্রতি দৃষ্টি করিয়া চলিয়া গেল। বলা বাহুল্য যে, রামচরণ সে রাত্রে নিদ্রা যাইতে পারিল না। ঠাকুরজী, এত রাত্রে দুইজন যুবতী স্ত্রীলোক লইয়া আসিলেন কেন? এই ভাবনা তাহার প্রবল হইল। ব্রহ্মচারীকে রামচরণ দেবতা মনে করিত—তাঁহাকে জিতেন্দ্রিয় বলিয়াই জানিত—সে বিশ্বাসের খর্বতা হইল না। শেষে রামচরণ সিদ্ধান্ত করিল, “বোধ হয়, এই দুইজন স্ত্রীলোক সম্প্রতি বিধবা হইয়াছে—ইহাদিগকে সহমরণের প্রবৃত্তি দিবার জন্যই ঠাকুরজী ইহাদিগকে ডাকিয়া আনিয়াছেন—কি জ্বালা, এ কথাটা এতক্ষণ বুঝিতে পারিতেছিলাম না।”
ব্রহ্মচারী একটা আসনে উপবেশন করিলেন—স্ত্রীলোকেরা ভূম্যাসনে উপবেশন করিলেন। প্রথমে দলনী আত্মপরিচয় দিলেন। পরে দলনী রাত্রের ঘটনা সকল অকপটে বিবৃত করিলেন।
শুনিয়া ব্রহ্মচারী মনে মনে ভাবিলেন, “ভবিতব্য কে খণ্ডাইতে পারে? যাহা ঘটিবার তাহা অবশ্য ঘটিবে। তাই বলিয়া পুরুষকারকে অবহেলা করা কর্তব্য নহে। যাহা কর্তব্য, তাহা অবশ্য করিব।”
হায়! ব্রহ্মচারী ঠাকুর! গ্রন্থগুলি কেন পোড়াইলে? সব গ্রন্থ ভস্ম হয়, হৃদয়-গ্রন্থ ত ভস্ম হয় না। ব্রহ্মচারী দলনীকে বলিলেন, “আমার পরামর্শ এই যে, আপনি অকস্মাৎ নবাবের সম্মুখে উপস্থিত হইবেন না। প্রথমে, পত্রের দ্বারা তাঁহাকে বৃত্তান্ত অবগত করুন। যদি আপনার প্রতি তাঁহার স্নেহ থাকে, তবে অবশ্য আপনার কথায় বিশ্বাস করিবেন। পরে তাঁহার আজ্ঞা পাইলে সম্মুখে উপস্থিত হইবেন।”
দ। পত্র লইয়া যাইবে কে?
ব্র। আমি পাঠাইয়া দিব।
তখন দলনী কাগজ কলম চাহিলেন। ব্রহ্মচারী রামচরণকে আবার উঠাইলেন। রামচরণ কাগজ কলম ইত্যাদি আনিয়া রাখিয়া গেল। দলনী পত্র লিখিতে লাগিলেন।
ব্রহ্মচারী ততক্ষণ বলিতে লাগিলেন, “এ গৃহ আমার নহে; কিন্তু যতক্ষণ না রাজাজ্ঞা প্রাপ্ত হন, ততক্ষণ এইখানেই থাকুন—কেহ জানিতে পারিবে না, বা কেহ কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবে না।”
অগত্যা স্ত্রীলোকেরা তাহা স্বীকার করিল। লিপি সমাপ্ত হইলে, দলনী তাহা ব্রহ্মচারীর হস্তে দিলেন। স্ত্রীলোকদিগের অবস্থিতি বিষয়ে রামচরণকে উপযুক্ত উপদেশ দিয়া ব্রহ্মচারী লিপি লইয়া চলিয়া গেলেন।
মুঙ্গেরের যে সকল রাজকর্মচারী হিন্দু, ব্রহ্মচারী তাঁহাদিগের নিকট বিলক্ষণ পরিচিত ছিলেন। মুসলমানেরাও তাঁহাকে চিনিত। সুতরাং সকল কর্মচারীই তাঁহাকে মানিত। মুন্সী রামগোবিন্দ রায়, ব্রহ্মচারীকে বিশেষ ভক্তি করিতেন। ব্রহ্মচারী সূর্যোদয়ের পর মুঙ্গেরের দুর্গমধ্যে প্রবেশ করিলেন; এবং রামগোবিন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া দলনীর পত্র তাঁহার হস্তে দিলেন। বলিলেন, “আমার নাম করিও না; এক ব্রাহ্মণ পত্র আনিয়াছে, এই কথা বলিও।” মুন্সী বলিলেন, “আপনি উত্তরের জন্য কাল আসিবেন।” কাহার পত্র, তাহার মুন্সী কিছুই জানিলেন না। ব্রহ্মচারী পুনর্বার, পূর্ববর্ণিত গৃহে প্রত্যাবর্তন করিলেন। দলনীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া বলিলেন, “কল্য উত্তর আসিবে। কোন প্রকারে অদ্য কাল যাপন কর।”
রামচরণ প্রভাতে আসিয়া দেখিল, সহমরণের কোন উদ্যোগ নাই।
এই গৃহের উপরিভাগে অপর এক ব্যক্তি শয়ন করিয়া আছেন। এই স্থানে তাঁহার কিছু পরিচয় দিতে হইল। তাঁহার চরিত্র লিখিতে লিখিতে শৈবলিনী-কলুষিতা আমার এই লেখনী পুণ্যময়ী হইবে।