যাহার কাছে দলনীর পত্র গেল, তাহার নাম গুর্গণ খাঁ।
এই সময় বাঙ্গালায় যে সকল রাজপুরুষ নিযুক্ত ছিলেন, তন্মধ্যে গুর্গণ খাঁ এক জন সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বোৎকৃষ্ট। তিনি জাতিতে আর্মাণি; ইস্পাহান তাঁহার জন্মস্থান; কথিত আছে যে, তিনি পূর্বে বস্ত্রবিক্রেতা ছিলেন। কিন্তু অসাধারণ গুণবিশিষ্ট এবং প্রতিভাশালী ব্যক্তি ছিলেন। রাজকার্যে নিযুক্ত হইয়া তিনি অল্পকালমধ্যে প্রধান সেনাপতির পদ প্রাপ্ত হইলেন। কেবল তাহাই নহে, সেনাপতির পদ প্রাপ্ত হইয়া, তিনি নূতন গোলন্দাজ সেনার সৃষ্টি করেন। ইউরোপীয় প্রথানুসারে তাহাদিগকে সুশিক্ষিত এবং সুসজ্জিত করিলেন, কামান বন্দুক যাহা প্রস্তুত করাইলেন, তাহা ইউরোপ অপেক্ষাও উৎকৃষ্ট হইতে লাগিল; তাঁহার গোলন্দাজ সেনা সর্বপ্রকারে ইংরেজের গোলন্দাজদিগের তুল্য হইয়া উঠিল। মীরকাসেমের এমত ভরসা ছিল যে, তিনি গুর্গণ খাঁর সহায়তায় ইংরেজদিগকে পরাভূত করিতে পারিবেন। গুর্গণ খাঁর আধিপত্যও এতদনুরূপ হইয়া উঠিল; তাঁহার পরামর্শ ব্যতীত মীরকাসেম কোন কর্ম করিতেন না; তাঁহার পরামর্শের বিরুদ্ধে কেহ কিছু বলিলে মীরকাসেম তাহা শুনিতেন না। ফলতঃ গুর্গণ খাঁ একটি ক্ষুদ্র নবাব হইয়া উঠিলেন। মুসলমান কার্যাধ্যক্ষেরা সুতরাং বিরক্ত হইয়া উঠিলেন।
রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর, কিন্তু গুর্গণ খাঁ শয়ন করেন নাই। একাকী দীপালোকে কতকগুলি পত্র পড়িতেছিলেন। সেগুলি কলিকাতাস্থ কয়েকজন আর্মাণির পত্র। পত্র পাঠ করিয়া, গুর্গণ খাঁ ভৃত্যকে ডাকিলেন। চোপ্কদার আসিয়া দাঁড়াইল, গুর্গণ খাঁ কহিলেন, “সব দ্বার খোলা আছে?”
চোপ্োদার কহিল, “আছে।”
গুর্। যদি কেহ এখন আমার নিকট আইসে—তবে কেহ তাহাকে বাধা দিবে না—বা জিজ্ঞাসা করিবে না, তুমি কে। এ কথা বুঝাইয়া দিয়াছ?
চোপ্দাের কহিল, “হুকুম তামিল হইয়াছে।”
গুর্। আচ্ছা, তুমি তফাতে থাক।
তখন গুরগণ খাঁ পত্রাদি বাঁধিয়া উপযুক্ত স্থানে লুক্কায়িত করিলেন। মনে মনে বলিতে লাগিলেন, “এখন কোন্ পথে যাই? এই ভারতবর্ষ এখন সমুদ্রবিশেষ—যে কত ডুব দিতে পারিবে, সে তত রত্ন কুড়াইবে। তীরে বসিয়া ঢেউ গণিলে কি হইবে? দেখ, আমি গজে মাপিয়া কাপড় বেচিতাম—এখন আমার ভয়ে ভারতবর্ষ অস্থির। আমিই বাঙ্গালার কর্তা। আমি বাঙ্গালার কর্তা? কে কর্তা? কর্তা ইংরেজ ব্যাপারী—তাহাদের গোলাম মীরকাসেম; আমি মীরকাসেমের গোলাম—আমি কর্তার গোলামের গোলাম! বড় উচ্চপদ! আমি বাঙ্গালার কর্তা না হই কেন? কে আমার তোপের কাছে দাঁড়াইতে পারে? ইংরেজ! একবার পেলে হয়। কিন্তু ইংরেজকে দেশ হইতে দূর না করিলে, আমি কর্তা হইতে পারিব না। আমি বাঙ্গালার অধিপতি হইতে চাহি—মীরকাসেমকে গ্রাহ্য করি না—যেদিন মনে করিব, সেইদিন উহাকে মসনদ হইতে টানিয়া ফেলিয়া দিব। সে কেবল আমার উচ্চপদে আরোহণের সোপান—এখন ছাদে উঠিয়াছি—মই ফেলিয়া দিতে পারি। কণ্টক কেবল পাপ ইংরেজ। তাহারা আমাকে হস্তগত করিতে চাহে—আমি তাহাদিগকে হস্তগত করিতে চাহি। তাহারা হস্তগত করিতে চাহি। তাহারা হস্তগত হইবে না। অতএব আমি তাদের তাড়াইব। এখন মীরকাসেম মসনদে থাক; তাহার সহায় হইয়া বাঙ্গালা হইতে ইংরেজ নাম লোপ করিব। সেইজন্যই উদ্যোগ করিয়া যুদ্ধ বাধাইতেছি। পশ্চাৎ মীরকাসেমকে বিদায় দিব। এই পথই সুপথ। কিন্তু আজি হঠাৎ এ পত্র পাইলাম কেন? এ বালিকা এমন দুঃসাহসিক কাজে প্রবৃত্ত হইল কেন?”
বলিতে বলিতে যাহার কথা ভাবিতেছিলেন, সে আসিয়া সম্মুখে দাঁড়াইল। গুর্গণ খাঁ তাহাকে পৃথক আসনে বসাইলেন। সে দলনী বেগম।
গুর্গণ খাঁ বলিলেন, “আজি অনেকদিনের পর তোমাকে দেখিয়া বড় আহ্লাদিত হইলাম। তুমি নবাবের অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া অবধি আর তোমাকে দেখি নাই। কিন্তু তুমি এ দুঃসাহসিক কর্ম কেন করিলে?”
দলনী বলিল, “দুঃসাহসিক কিসে?”
গুর্গণ খাঁ কহিল, “তুমি নবাবের বেগম হইয়া রাত্রে গোপনে একাকিনী চুরি করিয়া আমার নিকট আসিয়াছ, ইহা নবাব জানিতে পারিলে তোমাকে আমাকে—দুইজনকেই বধ করিবেন।”
দ। যদি তিনি জানিতেই পারেন, তখন আপনাতে আমাতে যে সম্বন্ধ, তাহা প্রকাশ করিব। তাহা হইলে রাগ করিবার আর কোন কারণ থাকিবে না।
গুর্। তুমি বালিকা, তাই এমত ভরসা করিতেছ! এত দিন আমরা এ সম্বন্ধ প্রকাশ করি নাই। তুমি যে আমাকে চেন, বা আমি যে তোমাকে চিনি, এ কথা এ পর্যন্ত আমরা কেহই প্রকাশ করি নাই—এখন বিপদে পড়িয়া প্রকাশ করিলে কে বিশ্বাস করিবে? বলিবে, এ কেবল বাঁচিবার উপায়। তুমি আসিয়া ভাল কর নাই।
দ। নবাব জানিবার সম্ভাবনা কি? পাহারাওয়ালা সকল আপনার আজ্ঞাকারী—আপনার প্রদত্ত নিদর্শন দেখিয়া তাহারা আমাকে ছাড়িয়া দিয়াছে। একটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে আমি আসিয়াছি—ইংরেজের সঙ্গে যুদ্ধ হইবে এ কথা কি সত্য?
গুর্। এ কথা কি তুমি দুর্গে বসিয়া শুনিতে পাও না?
দ। পাই। কেল্লার মধ্যে রাষ্ট্র যে, ইংরেজের সঙ্গে নিশ্চিত যুদ্ধ উপস্থিত। এবং আপনিই এ যুদ্ধ উপস্থিত করিয়াছেন। কেন?
গুর্। তুমি বালিকা, তাহা কি প্রকারে বুঝিবে?
দ। আমি বালিকার মত কথা কহিতেছি? না, বালিকার ন্যায় কাজ করিয়া থাকি? আমাকে যেখানে আত্মসহায়স্বরূপ নবাবের অন্তঃপুরে স্থাপন করিয়াছেন, সেখানে বালিকা অগ্রাহ্য করিলে কি হইবে?
গুর্। হউক। ইংরেজের সঙ্গে যুদ্ধে তোমার আমার ক্ষতি কি। হয়, হউক না।
দ। আপনারা কি জয়ী হইতে পারিবেন?
গুর্। আমাদের জয়েরই সম্ভাবনা।
দ। এ পর্যন্ত ইংরেজকে কে জিতিয়াছে?
গুর্। ইংরেজেরা কয়জন গুর্গণ খাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করিয়াছে?
দ। সেরাজউদ্দৌলা তাহাই মনে করিয়াছিলেন। যাক—আমি স্ত্রীলোক, আমার মন যাহা বুঝে, আমি তাই বিশ্বাস করি। আমার মনে হইতেছে যে, কোন মতেই আমরা ইংরেজের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া জয়ী হইব না। এ যুদ্ধে আমাদের সর্বনাশ হইবে। অতএব আমি মিনতি করিতে আসিয়াছি, আপনি এ যুদ্ধে প্রবৃত্তি দিবেন না।
গুর্। এ সকল কর্মে স্ত্রীলোকের পরামর্শ অগ্রাহ্য।
দ। “আমার পরামর্শ অগ্রাহ্য করিতে হইবে। আমায় আপনি রক্ষা করুন। আমি চারিদিক অন্ধকার দেখিতেছি।” বলিয়া, দলনী রোদন করিতে লাগিল।
গুর্গণ খাঁ বিস্মিত হইলেন। বলিলেন, “তুমি কাঁদ কেন? না হয় মীরকাসেম সিংহাসনচ্যুত হইলেন, আমি তোমাকে সঙ্গে করিয়া দেশে লইয়া যাইব।”
ক্রোধে দলনীর চক্ষু জ্বলিয়া উঠিল। সক্রোধে তিনি বলিলেন, “তুমি কি বিস্মৃত হইতেছ যে, মীরকাসেম আমার স্বামী?”
গুর্গণ খাঁ কিঞ্চিৎ বিস্মিত, কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ হইয়া বলিলেন, “না বিস্মৃত হই নাই। কিন্তু স্বামী কাহারও চিরকাল থাকে না। এক স্বামী গেলে আর এক স্বামী হইতে পারে। আমার ভরসা আছে, তুমি এক দিন ভারতবর্ষের দ্বিতীয় নুরজাহান হইবে।”
দলনী ক্রোধে কম্পিতা হইয়া গাত্রোত্থান করিয়া উঠিল। গলদশ্রু নিরুদ্ধ করিয়া, লোচনযুগল বিস্ফারিত করিয়া, কাঁপিতে কাঁপিতে বলিতে লাগিল,—“তুমি নিপাত যাও! অশুভক্ষণে আমি তোমার ভগিনী হইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছিলাম—অশুভক্ষণে আমি তোমার সহায়তায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়াছিলাম। স্ত্রীলোকের যে স্নেহ, দয়া ধর্ম আছে, তাহা তুমি জান না। যদি তুমি এই যুদ্ধের পরামর্শ হইতে নিবৃত্ত হও, ভালই; নহিলে আজি হইতে তোমার সঙ্গে আমার সম্বন্ধ নাই। সম্বন্ধ নাই কেন? আজি হইতে তোমার সঙ্গে আমার শত্রুসম্বন্ধ। আমি জানিব যে, তুমিই আমার পরম শত্রু। তুমি জানিও, আমি তোমার পরম শত্রু। এই রাজান্তঃপুরে আমি তোমার পরম শত্রু রহিলাম।”
এই বলিয়া দলনী বেগম বেগে পুরী হইতে বহির্গতা হইয়া গেলেন।
দলনী বাহির হইলে গুর্গণ খাঁ চিন্তা করিতে লাগিলেন। বুঝিলেন যে, দলনী আর এক্ষণে তাঁহার নহে; সে মীরকাসেমের হইয়াছে। ভ্রাতা বলিয়া তাঁহাকে স্নেহ করিতে করিতে পারে, কিন্তু সে মীরকাসেমের প্রতি অধিকতর স্নেহবতী। ভ্রাতাকে স্বামীর অমঙ্গলার্থী বলিয়া যখন বুঝিয়াছে বা বুঝিবে, তখন স্বামীর মঙ্গলার্থ ভ্রাতার অমঙ্গল করিতে পারে। অতএব আর উহাকে দুর্গমধ্যে প্রবেশ করিতে দেওয়া কর্তব্য নহে। গুর্গণ খাঁ ভৃত্যকে ডাকিলেন।
একজন শস্ত্রবাহক উপস্থিত হইল। গুর্গণ খাঁ তাহার দ্বারা আজ্ঞা পাঠাইলেন, দলনীকে প্রহরীরা যেন দুর্গমধ্যে প্রবেশ করিতে না দেয়।
অশ্বারোহণে দূত আগে দুর্গদ্বারে পৌঁছিল, দলনী যথাকালে দুর্গদ্বারে উপস্থিত হইয়া শুনিলেন, তাঁহার প্রবেশ নিষিদ্ধ হইয়াছে।
শুনিয়া দলনী ক্রমে ক্রমে, ছিন্নবল্লীবৎ, ভূতলে বসিয়া পড়িলেন। চক্ষু দিয়া ধারা বহিতে লাগিল। বলিলেন, “ভাই, আমার দাঁড়াইবার স্থান রাখিলে না।”
কল্সম বলিল, “ফিরিয়া সেনাপতির গৃহে চল।”
দলনী বলিল, “তুমি যাও। গঙ্গার তরঙ্গমধ্যে আমার স্থান হইবে।”
সেই অন্ধকার রাত্রে, রাজপথে দাঁড়াইয়া দলনী কাঁদিতে লাগিল। মাথার উপরে নক্ষত্র জ্বলিতেছিল—বৃক্ষ হইতে প্রস্ফুট কুসুমের গন্ধ আসিতেছিল—ঈষৎ পবনহিল্লোলে অন্ধকারাবৃত বৃক্ষপত্র সকল মর্মরিত হইতেছিল। দলনী কাঁদিয়া বলিল, “কল্সম!”