☼ হুমায়ূন আহমেদ ☼
ভয় : জিন-কফিল
৩
সাধারণত আমি আমার জীবনের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার গল্প মিসির আলির সঙ্গে দেখা হওয়ামাত্র বলি। মজার ব্যাপার হচ্ছে—ইমাম সাহেরের এই গল্প তাঁকে বলা হল না।
ঢাকায় ফেরার তিন দিনের মাথায় তাঁর সঙ্গে আমার দেখা। নানান কথাবার্তা হল—এটা বাদ পড়ে গেল।
দু’ মাস পর মিসির আলি আমার বাসায় এলেন। রাতে একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করলাম। তিনি প্রায় দু’ ঘণ্টা কাটিয়ে বাড়ি চলে গেলেন—ইমাম সাহেবের গল্প বলা হল না। তিনি চলে যাবার পর মনে হল—ইমাম সাহেবের গল্পটা তো তাঁকে শোনানো হল না।
আমি আমার মেয়েকে বলে রাখলাম যে এর পরে যদি কখনো মিসির আলি সাহেব আমাদের বাসায় আসেন, সে যেন আমার কানের কাছে ‘ইমাম’ বলে একটা চিৎকার দেয়। আমার এই মেয়ের স্মৃতিশক্তি বেশ ভালো। সে যে যথাসময়ে ‘ইমাম’ বলে চিৎকার দেবে, সে-বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
হলও তাই। অনেকদিন পর মিসির আলি সাহেব এসেছেন। তাঁর সঙ্গে গল্প করছি—আমার মেয়ে কানের কাছে এসে বিকট চিৎকার দিল। এমন চিৎকার যে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। মেয়েকে কড়া ধমক দিলাম। মেয়ে কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলল, ‘তুমি তো বলেছিলে মিসির চাচু এলে ‘ইমাম’ বলে চিৎকার করতে।’
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘কানের পর্দা ফাটিয়ে দিতে তো বলি নি। যাও, এখন যাও তো!’
মিসির আলি বললেন, ‘ব্যাপারটা কী?’
আমি বললাম, ‘তেমন কিছু না। আপনাকে একটা অভিজ্ঞতার কথা বলতে চাচ্ছিলাম। একজন ইমাম সাহেবের গল্প। আপনার সঙ্গে দেখা হয় কিন্তু গল্পটা বলার কথা মনে থাকে না। মেয়েকে মনে করিয়ে দিতে বলেছি। সে এমন চিৎকার দিয়েছে, এখন মনে হচ্ছে বাঁ কানে কিছু শুনতে পাচ্ছি না।’
মিসির আলি বললেন, ‘গল্পটা কী বলুন শুনি।’
‘আজ থাক। আরেক দিন বলব। একটু সময় লাগবে। লম্বা গল্প।’
মিসির আলি বললেন, ‘আরেক কাপ চা দিতে বলুন। চা খেয়ে বিদেয় হই।’
চায়ের কথা বলে মিসির আলির সামনে এসে বসলাম। মিসির আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, ‘ইমাম সাহেবের গল্পটা আপনি আমাকে কখনই বলতে পারবেন না।’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কেন?’
‘আপনার মস্তিষ্কের একটা অংশ আপনাকে গল্পটা বলতে বাধা দিচ্ছে, যে-কারণে অনেক দিন থেকেই আপনি আমাকে গল্পটা বলতে চান অথচ বলা হয় না। আপনার মনে থাকে না। আজ আপনাকে মনে করিয়ে দেয়া হল, এবং মনেও করিয়ে দেওয়ার জন্য আপনি রেগে গেলেন। তার চেয়ে বড় কথা মনে করিয়ে দেবার পরেও আপনি গল্পটি বলতে চাচ্ছেন না। অজুহাত বের করেছেন—বলছেন, লম্বা গল্প। আমি নিশ্চিত, আপনার অবচেতন মন চাচ্ছে না এই গল্প আপনি আমাকে বলেন। আপনার সাবকনশ্যাস মাইন্ড আপনাকে বাধা দিচ্ছে।’
‘আমার সাবকনশ্যাস মাইন্ড আমাকে বাধা দিচ্ছে কেন?’
‘আমি তা বুঝতে পারছি না। গল্পটা শুনলে বুঝতে পারব। চা আসুক। চা খেতে-খেতে আপনি বলা শুরু করুন। আমার সিগারেটও ফুরিয়েছে। কাউকে দিয়ে কয়েকটা সিগারেট আনিয়ে দিন।’
আমি আর কোনো অজুহাতে গেলাম না। গল্প শেষ করলাম। গল্প শেষ হওয়ামাত্র মিসির আলি বললেন, ‘আবার বলুন।’
‘আবার কেন?’
‘মানুষ যখন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার গল্প বলে তখন মূল গল্পটি দ্রুত বলার দিকে ঝোঁক থাকে বেশি। গল্পের ডিটেইলস-এ যেতে চায় না। একই গল্প দ্বিতীয় বার বলার সময় বর্ণনা বেশি থাকে। কারণ মূল কাহিনী বলা হয়ে গেছে। কথক তখন না-বলা অংশ বলতে চেষ্টা করেন। আপনিও তাই করবেন। প্রথম বার শুনে কয়েকটা জিনিস বুঝতে পারি নি। দ্বিতীয় বারে বুঝতে পারব। শুরু করুন।’
আমি শুরু করলাম, বেশ সময় নিয়ে বললাম।
মিসির আলি বললেন, ‘কবে গিয়েছিলেন ধুন্দুল নাড়া? তারিখ মনে আছে?’
‘আছে।’
আমি মিসির আলিকে তারিখ বললাম। তিনি শান্ত গলায় বললেন, ‘আপনার তারিখ অনুযায়ী মেয়েটির বাচ্চা এখন হবে কিংবা হয়ে গেছে। আপনি বলছেন দশ মাস আগের কথা। মেয়েটির বাচ্চা হয়ে গিয়ে থাকলে তাকে যে হত্যা করা হয়েছে সেই সম্ভাবনা নিরানব্বই ভাগেরও বেশি। আর যদি এখনো হয়ে না থাকে তাহলে বাচ্চাটাকে বাঁচানো যেতে পারে। এখন ক’টা বাজে দেখুন তো।’
আমি ঘড়ি দেখলাম, ‘ন’টা বাজে।’
মিসির আলি বললেন, ‘রাত সাড়ে দশটায় ময়মনসিংহে যাওয়ার একটা ট্রেন আছে। চলুন রওনা হই।’
‘সত্যি যেতে চান?’
‘অবশ্যই যেতে চাই। আপনার অসুবিধা থাকলে কীভাবে যেতে হবে আমাকে বলে দিন। আমি ঘুরে আসি।’
‘আমার অসুবিধা আছে। তবু যাব। এখন বলুন তো জিন কফিলের ব্যাপারটা আপনি বিশ্বাস করছেন?’
‘না।’
‘আপনার ধারণা বাচ্চাগুলোকে খুন করা হয়েছে?’
‘তা তো বটেই।’
‘কে খুন করেছে?’
মিসির আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, ‘কে খুন করেছে তা আপনিও জানেন। আপনার সাবকনশ্যাস মাইন্ড জানে। জানে বলেই সাবকনশ্যাস মাইন্ড গল্পটি বলতে আপনাকে বাধা দিচ্ছিল।’
‘আমি কিছুই জানি না।’
মিসির আলি হাসতে-হাসতে বললেন, ‘আপনার সাবকনশ্যাস মাইন্ড জানে, কিন্তু সে এটি আপনার কনশ্যাস মাইন্ডকে জানায় নি বলেই আপনার মনে হচ্ছে আপনি জানেন না।’
আমি বললাম, ‘কে খুন করেছে?’
‘লতিফা। দু’টি বাচ্চাই সে মেরেছে। তৃতীয়টিও মারবে।’
‘কী বলছেন এ-সব!
‘চলুন, রওনা হয়ে যাই। দেরি হয়ে যাচ্ছে। ট্রেনে যেতে-যেতে ব্যাখ্যা করব।’
মিসির আলি বললেন, ‘লতিফা যে পুরো ঘটনাটা ঘটাচ্ছে তা পরিষ্কার হয়ে যায় শুরুতেই, যখন ইমাম সাহেব আপনাকে বলেন কীভাবে জিন কফিল তাঁকে আগুনে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করেছিল।……
পুরোনো ধরনের মসজিদ—একটামাত্র দরজা। এই ধরনের মসজিদে বসে থাকলে বাইরের চিৎকার শোনা যাবে না, ভেতর থেকে চিৎকার করলেও বাইরের কেউ শুনবে না। কারণ সাউন্ড ওয়েভ চলার জন্যে মাধ্যম লাগে। মসজিদের দেয়াল সেখানে বাধার মতো কাজ করছে।………
আপনি এবং ইমাম সাহেব মসজিদে ছিলেন। ইমাম সাহেব একসময় স্ত্রীর খোঁজ নিতে গেলেন এবং ফিরে এসে বললেন—লতিফা খুব চিৎকার করছে। তাই না?’
‘জ্বি, তাই?’
‘মসজিদের ভেতরে বসে সেই চিৎকার আপনি শুনতে পান নি। তাই না?’
‘জ্বি।’
‘অথচ ইমাম সাহেব যখন আগুন দেখে ভয়ে চেঁচালেন, বাঁচাও বাঁচাও—তখন লতিফা পানির বালতি নিয়ে ছুটে এল। প্রথমত ইমাম সাহেবের চিৎকার লতিফার শোনার কথা নয়। দ্বিতীয়ত শুনে থাকলেও লতিফা কী করে বুঝল আগুন লেগেছে? সে পানির বালতি নিয়ে ছুটে এল কেন? আগুন-আগুন বলে চিৎকার করলেও আমরা চিৎকার শুনে প্রথমে খালি হাতে ছুটে আসি, তারপর পানির বালতি আনি। এটাই স্বাভাবিক। এই মেয়েটি শুরুতেই পানির বালতি নিয়ে ছুটে এসেছে। কারণ পানির বালতি হাতের কাছে রেখেই সে আগুন ধরিয়েছে। আমার এই যুক্তি কি আপনার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে?’
‘হচ্ছে।’
‘প্রথম শিশুটি মারা গেল। শিশুটিকে ফেলা হল কুয়ায়। এই খবর মেয়েটি জানে, কারণ সে পাগলের মতো ছুটে গেছে কুয়ার দিকে—অন্য কোথাও নয়। তার বাচ্চাটিকে কুয়াতে ফেলা হয়েছে, এটা সে জানল কীভাবে? জানল, কারণ সে নিজেই ফেলেছে। এই যুক্তি কি আপনার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে?’
‘হ্যাঁ, হচ্ছে?’
‘আপনাকে কি আরো যুক্তি দিতে হবে? আমার কাছে আরো ছোটখাটো যুক্তি আছে।’
‘আর লাগবে না। শুধু বলুন—কুয়ার ওপরের টিনে ঝনঝন শব্দ হত কেন? যে-শব্দ ইমাম সাহেব নিজেও শুনেছেন?’
‘কুয়ার টিনটা না-দেখে বলতে পারব না। আমার ধারণা বাতাসে টিনটা কাঁপে, ঝনঝন শব্দ হয়। দিনের বেলায় এই শব্দ শোনা যায় না, কারণ আশেপাশে অনেক ধরনের শব্দ হতে থাকে। রাত যতই গভীর হয় চারপাশ নীরব হতে থাকে। সামান্য শব্দই বড় হয়ে কানে আসে।’
‘আপনার এই যুক্তিও গ্রহণ করলাম, এখন বলুন, লতিফা এমন ভয়ংকর কাণ্ড কেন করছে?’
‘মেয়েটা অসুস্থ। মনোবিকার ঘটেছে। ইমাম সাহেব লোকটি তাদের আশ্রিত। তাদের পরিবারে চাকরবাকররা যে-কাজ করে, সে তাই করত। মেয়েটি ভাগ্যের পরিহাসে এমন একজন মানুষের প্রেমে পড়ে যায়। প্রচণ্ড মানসিক চাপের সম্মুখীন হয়। পরিবারের সবার কাছে ছোট হয়, অপমানিত হয়। এত প্রচণ্ড চাপ সহ্য করার ক্ষমতা তার ছিল না। তার মনোবিকার ঘটে। পোয়াতি অবস্থায় মেয়েদের হরমোনাল ব্যালান্স এদিক-ওদিক হয়। সেই সময় মনোবিকার তীব্র হয়। মেয়েটির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। মেয়েটি দরিদ্র ইমামকে বিয়ে করে কঠিন মানসিক চাপের সম্মুখীন হয়েছে। একই সঙ্গে সে লোকটিকে প্রচণ্ড ভালবাসে, আবার প্রচণ্ড ঘৃণাও করে। কী ভয়াবহ অবস্থা!’
‘মেয়েটি ইমামকে প্রচণ্ড ঘৃণা করে, এটা কেন বলছেন?’
‘ইমামতি পেশা মেয়েটির পছন্দ নয়। পছন্দ নয় বলেই মেয়েটি কফিলের গলায় বলেছে—ইমাম আসছে। অজুর পানি দে, জায়নামাজ দে, কেবলা কোন দিকে বলে দে। একধরনের রসিকতা করার চেষ্টা করছে।’
‘মনোবিকার এমন ভয়াবহ রূপ নিল কেন? সে নিজের বাচ্চাকে হত্যা করছে কেন?’
‘বড়ো ধরনের বিকারে এ-রকম হয়। সে নিজেকে ধ্বংস করতে চাইছে। নিজের সন্তানহত্যার মাধ্যমে সেই ইচ্ছারই অংশবিশেষ পূর্ণ হচ্ছে। আরো কিছু থাকতে পারে। না-দেখে বলতে পারব না।’