হুমায়ূন আহমেদ

ভয় : জিন-কফিল

ধুন্দুল নাড়া গ্রামে সন্ধ্যার পর পৌঁছলাম। পৌঁছেই খবর পেলাম পাঁচ দিন হয় ইমাম সাহেবের একটি কন্যা হয়েছে। কন্যাটি ভালো আছে। বড় ধরনের স্বস্তি বোধ করলাম।

ইমাম সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম মসজিদে। তিনি আমাদের দেখে বড়ই অবাক হলেন। আমি বললাম, ‘আপনার স্ত্রী কেমন আছেন?’

ইমাম সাহেব বিব্রত গলায় বললেন, ‘ভালো না। খুব খারাপ। কফিল তার সঙ্গে-সঙ্গে আছে। কফিল বলেছে, সাতদিনের মাথায় মেয়েটিকে মেরে ফেলবে। খুব কষ্টে আছি ভাইসাহেব। আল্লাহ্‌পাকের কাছে আমার জন্য খাস দিলে একটু দোয়া করবেন।’

আমি বললাম, ‘আমি আমার এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি। উনি আপনার স্ত্রীর সঙ্গে কিছু কথা বলবেন।

ইমাম সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘কেন?’

‘যাতে আপনার বাচ্চাটা ভালো থাকে, সুস্থ থাকে। উনি খুব বড় একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। অনেক কিছু বুঝতে পারেন, যা আমরা বুঝতে পারি না। ওনার কথা শুনলে আপনাদের মঙ্গল হবে। এই জন্যেই ওনাকে এনেছি।’

‘অবশ্যই আমি ওনার কথা শুনব। অবশ্যই শুনব।’

ইমাম সাহেব আমাদের ঘরে নিয়ে গেলেন। ঘরে অনেক লোকজন ছিল, তাদের সরিয়ে দেওয়া হল।

মিসির আলি বললেন, ‘আমি কিছু কথা বলব যা শুনতে ভালো লাগবে না, তবু দয়া করে শুনুন।’

লতিফা চাপা গলায় বলল, ‘আমার সাথে কী কথা?’

‘আপনার বাচ্চাটির বিষয়ে কথা। বাচ্চাটি যাতে বেঁচে থাকে, ভালো থাকে, সেজন্যেই আমার কথাগুলি আপনাকে শুনতে হবে।’

লতিফা তার স্বামীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, ‘বলেন, কী বলবেন।’

মিসির আলি খুবই নিরাসক্ত গলায় কথা বলতে শুরু করলেন। কথা বলার সময় একবারও লতিফার দিকে তাকালেন না। লতিফা তার শিশুকে বুকের কাছে নিয়ে খাটে হেলান দিয়ে বসে আছে। তার মাথায় লম্বা ঘোমটা। ঘোমটার ফাঁক দিয়ে মাঝে-মাঝে তার তীব্র চোখের দৃষ্টি নজরে আসছে। ইমাম সাহেব তাঁর স্ত্রীর পাশে বসে আছেন। মিসির আলির ব্যাখ্যা যতই শুনছেন ততই তাঁর চেহারা অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে।

মিসির আলি কথা শেষ করে লতিফার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি কি আমার ব্যাখ্যা বিশ্বাস করলেন?’

লতিফা জবাব দিল না। মাথার ঘোমটা সরিয়ে দিল। কী সুন্দর শান্ত মুখ! চোখের তীব্রতা এখন আর নেই। মনে হচ্ছে অশ্রু টলমল করছে।

মিসির আলি কঠিন গলায় বললেন, ‘আমার ব্যাখ্যা আপনি বিশ্বাস না-করলেও শিশুটির দিকে তাকিয়ে তার মঙ্গলের জন্যে শিশুটিকে আপনি অন্যের কাছে দিন। সে যেন কিছুতেই আপনার সঙ্গে না থাকে। আমার যা বলবার বললাম, বাকিটা আপনাদের ব্যাপার। আচ্ছা, আজ তাহলে যাই। আমরা রাতেই রওনা হব। নৌকা ঠিক করা আছে।’

আমরা বাইরে এসে দাঁড়ালাম। আমি বললাম, ‘মিসির আলি সাহেব, আপনার কি মনে হয় মেয়েটি আপনার কথা বিশ্বাস করেছে?’

মিসির আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, ‘হ্যাঁ, করেছে। এবং বিশ্বাস করার কারণেই তার দ্রুত রোগমুক্তি ঘটবে। আমার ধারণা, মেয়েটি নিজেও খানিকটা হলেও এই সন্দেহই করছিল। মেয়েটি অসম্ভব বুদ্ধিমতী। চলুন, রওনা দেওয়া যাক। এই গ্রামে রাত কাটাতে চাই না।’

আমি বললাম, ‘ইমাম সাহেবের সঙ্গে কথা বলে যাবেন না?’

‘না। আমার কাজ শেষ, বাকিটা ওরা দেখবে।’

রওনা হবার আগে ইমাম সাহেব ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। শিশুটি তাঁর কোলে। তিনি বললেন, ‘লতিফা মেয়েটাকে দিয়ে দিয়েছে। সে খুব কাঁদতেছে। আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়। মেহেরবানি করে একটু আসেন।’

আমরা আবার ঢুকলাম। বিস্মিত হয়ে দেখলাম, লতিফা ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। মিসির আলি কোমল গলায় বললেন, ‘আপনি কি কিছু বলবেন?’

লতিফা কাঁদতে-কাঁদতে বলল, ‘আল্লাহ্ আপনার ভালো করবে। আল্লাহ্ আপনার ভালো করবে।’

‘আপনি কোনো রকম চিন্তা করবেন না। আপনার অসুখ সেরে গেছে। আর কোনো দিন হবে না।’

লতিফা তার স্বামীর কানে-কানে কী যেন বলল।

ইমাম সাহেব বিব্রত গলায় বললেন, ‘জনাব, কিছু মনে করবেন না। লতিফা আপনারে একটু ছুঁইয়া দেখতে চায়।’

মিসির আলি হাত বাড়িয়ে দিলেন। লতিফা দু’ হাতে সেই হাত জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো চিৎকার করে কাঁদতে লাগল।

নৌকায় উঠছি।

ইমাম সাহেব আমাদের তুলে দিতে এলেন। নৌকা ছাড়ার আগ-মুহূর্তে নিচু গলায় বললেন, ‘ভাইসাহেব, আমি অতি দরিদ্র মানুষ, আপনাদের যে কিছু দিব আল্লাহ্‌পাক আমাকে সেই ক্ষমতা দেন নাই। এই কোরান শরিফটা আমার দীর্ঘ দিনের সঙ্গী। যখন মন খুব খারাপ হয় তখন পড়ি—মন শান্ত করি। আমি খুব খুশি হব যদি কোরান মজিদটা আপনি নেন। আপনি নিবেন কি না তা অবশ্য জানি না।’

মিসির আলি বললেন, ‘অবশ্যই নেব। খুব আনন্দের সঙ্গে নেব।’

‘ভাইসাহেব, আমার মেয়েটার একটা নাম কি আপনি রাইখা যাইবেন?’

মিসির আলি হাসিমুখে বললেন, ‘হ্যাঁ, যাব। আপনার মেয়ের নাম রাখলাম লাবণ্য। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় এই নামের একটা মেয়ের প্রেমে পড়েছিলাম। মেয়েটা আমাকে একেবারেই পাত্তা দেয় নি। মাঝেমাঝেই মেয়েটার কথা আমার মনে হয়। মনটা খারাপ হয়ে যায়। ভাই, যাই।’