☼ হুমায়ূন আহমেদ ☼
ভয় : চোখ
৩
রাশেদুল করিম ঠিক ছ’টায় এসেছেন। মনে হচ্ছে বাইরে অপেক্ষা করছিলেন। ঠিক ছ’টা বাজার পর কলিং বেলে হাত রেখেছেন। মিসির আলি দরজা খুলে বললেন, ‘আসুন।’
রাশেদুল করিমের জন্যে সামান্য বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। তাঁর জন্যে টেবিলে দুধছাড়া চা। মিসির আলি বললেন, ‘আপনি কাঁটায় কাঁটায় ছ’টায় আসবেন বলে ধারণা করেই চা বানিয়ে রেখেছি। লিকার কড়া হয়ে গেছে বলে আমার ধারণা। খেয়ে দেখুন তো।’
রাশেদুল করিম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘ধন্যবাদ।’
মিসির আলি নিজের কাপ হাতে নিতে-নিতে বললেন, ‘আপনাকে একটা কথা শুরুতেই বলে নেওয়া দরকার। আমি মাঝে-মাঝে নিজের শখের কারণে সমস্যা নিয়ে চিন্তা করি। তার জন্যে কখনো অর্থ গ্রহণ করি না। আমি যা করি তা আমার পেশা না—নেশা বলতে পারেন। আপনার ডলার আমি নিতে পারছি না। তা ছাড়া অধিকাংশ সময়ই আমি সমস্যার কোনো সমাধানে পৌঁছতে পারি না। আমার কাছে পাঁচ শ’ পৃষ্ঠার একটা নোট বই আছে। ঐ নোট বই ভর্তি এমন সব সমস্যা—যার সমাধান আমি বের করতে পারি নি।
‘আপনি কি আমার সমস্যাটার কিছু করেছেন?’
‘সমস্যার পুরো সমাধান বের করতে পারি নি―আংশিক সমাধান আমার কাছে আছে। আমি মোটামুটিভাবে একটা হাইপোথিসিস দাঁড় করিয়েছি। সেই সম্পর্কে আপনাকে আমি বলব, আপনি নিজে ঠিক করবেন—আমার হাইপোথিসিসে কী কী ত্রুটি আছে। তখন আমরা দু’ জন মিলে ত্রুটিগুলি ঠিক করব।’
‘শুনি আপনার হাইপোথিসিস।’
‘আপনার স্ত্রী বলেছেন, ঘুমুবার পর আপনি মৃত মানুষের মতো হয়ে যান। আপনার হাত-পা নড়ে না। পাথরের মূর্তির মতো বিছানায় পড়ে থাকেন। তাই না?’
‘হ্যাঁ, তাই।’
‘স্লিপ অ্যানালিস্টরা আপনাকে পরীক্ষা করে বলেছেন—আপনার ঘুম সাধারণ মানুষের ঘুমের মতোই। ঘুমের মধ্যে আপনি স্বাভাবিকভাবেই নড়াচড়া করেন।’
‘জ্বি, কয়েকবারই পরীক্ষা করা হয়েছে।’
‘আমি আমার হাইপোথিসিসে দু’জনের বক্তব্যই সত্য ধরে নিচ্ছি। সেটা কীভাবে সম্ভব? একটিমাত্র উপায়ে সম্ভব—আপনি যখন বিছানায় শুয়ে ছিলেন তখন ঘুমুচ্ছিলেন না। জেগে ছিলেন।’
রাশেদুল করিম বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘কী বলছেন আপনি!’
মিসির আলি বললেন, ‘আমি গত কালও লক্ষ করেছি, আজও লক্ষ করছি— আপনার বসে থাকার মধ্যেও একধরনের কাঠিন্য আছে। আপনি আরাম করে বসে নেই—শিরদাঁড়া সোজা করে বসে আছেন। আপনার দুটো হাত হাঁটুর ওপর রাখা। দীর্ঘ সময় চলে গেছে, আপনি একবারও হাত বা পা নাড়ান নি। অথচ স্বাভাবিকভাবেই আমরা হাত-পা নাড়ি। কেউ-কেউ পা নাচান।’
রাশেদুল করিম চুপ করে রইলেন। মিসির আলি বলল, ‘ঐ রাতে আপনি বিছানায় শুয়েছেন—মূর্তির মতো শুয়েছেন। চোখ বন্ধ করে ভাবছেন আপনার অঙ্কের সমস্যা নিয়ে। গভীরভাবে ভাবছেন। মানুষ যখন গভীরভাবে কিছু ভাবে তখন একধরনের ট্রেন্স স্টেটে ভাবজগতে চলে যায়। গভীরভাবে কিছু ভাবা হচ্ছে একধরনের মেডিটেশন। রাশেদুল করিম সাহেব—’
‘জ্বি।’
‘অঙ্ক নিয়ে ঐ ধরনের গভীর চিন্তা কি আপনি প্রায়ই করেন না?’
‘জ্বি, করি।’
‘আপনি কি লক্ষ করেছেন এই সময় আশেপাশে কী ঘটছে তা আপনার খেয়াল থাকে না?’
‘লক্ষ করেছি।’
‘আপনি নিশ্চয়ই আরো লক্ষ করেছেন যে, এই অবস্থায় আপনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দিচ্ছেন। লক্ষ করেন নি?’
‘করেছি।’
‘তাহলে আমি আমার হাইপোথিসিসে ফিরে আসি। আপনি বিছানায় শুয়ে আছেন। আপনার মাথায় অঙ্কের জটিল সমস্যা। আপনি ভাবছেন, আর ভাবছেন। আপনার হাত-পা নড়ছে না। নিঃশ্বাস এত ধীরে পড়ছে যে মনে হচ্ছে আপনি মৃত।’
রাশেদুল করিম সাহেব সানগ্লাস খুলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। মিসির আলি বললেন, ‘ভালো কথা, আপনি কি লেফ্ট হ্যানডেড পার্সন? ন্যাটা?’
ভদ্রলোক বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, কেন বলুন তো?’
‘আমার হাইপোথিসিসের জন্যে আপনার লেফ্ট হ্যানডেড পার্সন হওয়া খুবই প্রয়োজন।’
‘কেন?’
‘বলছি। তার আগে—শুরুতে যা বলছিলাম সেখানে ফিরে যাই। দৃশ্যটি আপনি দয়া করে কল্পনা করুন। আপনি একধরনের ট্রেন্স অবস্থায় আছেন। আপনার স্ত্রী জেগে আছেন—ভীত চোখে আপনাকে দেখছেন। আপনার এই অবস্থার সঙ্গে তাঁর পরিচয় নেই। তিনি ভয়ে অস্থির হয়ে গেলেন। তাঁর ধারণা হল আপনি মারা গেছেন। তিনি আপনার গায়ে হাত দিয়ে আরো ভয় পেয়ে গেলেন। কারণ আপনার গা হিমশীতল।’
‘গা হিমশীতল হবে কেন?’
‘মানুষ যখন গভীর ট্রেন্স স্টেটে চলে যায় তখন তার হার্টবিট কমে যায়। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস ধীরে বয়। শরীরের টেম্পারেচার দুই থেকে তিন ডিগ্রী পর্যন্ত নেমে যায়। এইটুকু নেমে যাওয়া মানে অনেকখানি নেমে যাওয়া। যাই হোক, আপনার স্ত্রী আপনার গায়ে হাত দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনি তাকালেন—তাকালেন কিন্তু এক চোখ মেলে। বাঁ চোখে। ডান চোখটি তখনো বন্ধ।’
‘কেন?’
‘ব্যাখ্যা করছি। রাইট হ্যানডেড পার্সন যারা আছে, তাদের এক চোখ বন্ধ করে অন্য চোখে তাকাতে বললে তারা বাঁ চোখ বন্ধ করে ডান চোখে তাকাবে। ডান চোখ বন্ধ করে বাঁ চোখে তাকানো তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এটা সম্ভব শুধু যারা ন্যাটা তাদের পক্ষেই। আপনি লেফ্ট হ্যানডেড পার্সন—আপনি একধরনের গভীর ট্রেন্স স্টেটে আছেন। আপনার স্ত্রী আপনার গায়ে হাত রেখেছেন। আপনি কী হচ্ছে জানতে চাচ্ছেন। চোখ মেলছেন। দু’টি চোখ মেলতে চাচ্ছেন না। গভীর আলস্যে একটা চোখ কোনোমতে মেললেন—অবশ্যই সেই চোখ হবে—বাঁ চোখ। আমার যুক্তি কি গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে?’
রাশেদুল করিম হ্যাঁ-না কিছু বললেন না।
মিসির আলি বললেন, ‘আপনার স্ত্রী আরো ভয় পেলেন। সেই ভয় তাঁর রক্তে মিশে গেল। কারণ শুধুমাত্র একবার এই ব্যাপার ঘটে নি। অনেকবার ঘটেছে। আপনার কথা থেকেই আমি জেনেছি, সেই সময় অঙ্কের একটি জটিল সমাধান নিয়ে আপনি ব্যস্ত। আপনার সমগ্র চিন্তা-চেতনায় আছে—অঙ্কের সমাধান—নতুন কোনো থিওরি। নয় কি?’
‘হ্যাঁ।’
‘এখন আমি আমার হাইপোথিসিসের সবচেয়ে জটিল অংশে আসছি। আমার হাইপোথিসিস বলে, আপনার স্ত্রী আপনার চোখ গেলে দেন নি। তাঁর পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। তিনি আপনার চোখের প্রেমে পড়েছিলেন। একজন শিল্পীমানুষ কখনো সুন্দর কোনো সৃষ্টি নষ্ট করতে পারেন না। তবুও যদি ধরে নিই তাঁর মাথায় হঠাৎ রক্ত উঠে গিয়েছিল এবং তিনি এই ভয়াবহ কাণ্ড করেছেন—তাহলে তাঁকে এটা করতে হবে ঝোঁকের মাথায়, আচমকা। আপনার চোখ গেলে দেওয়া হয়েছে পেনসিলে—যে পেনসিলটি আপনার মাথার বালিশের নিচে রাখা। যিনি ঝোঁকের মাথায় একটা কাজ করবেন তিনি এত যন্ত্রণা করে বালিশের নিচে থেকে পেনসিল নেবেন না। হয়তো-বা তিনি জানতেনও না বালিশের নিচে পেনসিল ও নোটবই নিয়ে আপনি ঘুমান।’
রাশেদুল করিম বললেন, ‘কাজটি তাহলে কে করেছে?’
‘সেই প্রসঙ্গে আসছি—আপনি কি আরেক কাপ চা খাবেন। বানিয়ে দেব?’
‘না।’
‘অ্যাকসিডেন্ট কীভাবে ঘটল তা বলার আগে আপনার স্ত্রীর লেখা ডায়েরির প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি—এক জায়গায় তিনি লিখেছেন—আপনার বাঁ চোখ দিয়ে পানি পড়ত। কথাটা কি সত্যি?’
‘হ্যাঁ, সত্যি।’
‘কেন পানি পড়ত? একটি চোখ কেন কাঁদত? আপনার কী ধারণা?’
রাশেদুল করিম বললেন, ‘আমার কোনো ধারণা নেই। আপনার ধারণা বলুন। আমি অবশ্যি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। ডাক্তার বলেছেন এটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। যে-গ্ল্যাণ্ড চোখের জল নিয়ন্ত্রণ করে, সেই গ্ল্যাণ্ড বাঁ চোখে বেশি কর্মক্ষম ছিল।’
মিসির আলি বললেন, ‘এটা একটা মজার ব্যাপার। হঠাৎ কেন বাঁ চোখের গ্ল্যাণ্ড কর্মক্ষম হয়ে পড়ল। আপনি মনে-মনে এই চোখকে আপনার সব রকম অশান্তির মূল বলে চিহ্নিত করার জন্যেই কি এটা হল? আমি ডাক্তার নই। শারীরবিদ্যা জানি না। তবে আমি দু’ জন বড় ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা বলেছেন এটা হতে পারে। মোটেই অস্বাভাবিক নয়। গ্ল্যাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্ক। একটি চোখকে অপছন্দও করছে মস্তিষ্ক।’
‘তাতে কী প্রমাণ হচ্ছে?’
মিসির আলি কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, ‘তাতে একটি জিনিসই প্ৰমাণিত হচ্ছে—আপনার বাঁ চোখ আপনি নিজেই নষ্ট করেছেন।’
অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে রাশেদুল করিম ভাঙা গলায় বললেন, ‘কী বলছেন আপনি!’
‘কনশ্যাস অবস্থায় আপনি এই ভয়ংকর কাজ করেন নি। করেছেন সাবকনশ্যাস অবস্থায়। কেন করেছেন তাও বলি—আপনি আপনার স্ত্রীকে অসম্ভব ভালবাসেন। সেই স্ত্রী আপনার কাছে থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। কেন দূরে সরে যাচ্ছেন? কারণ তিনি ভয় পাচ্ছেন আপনার বাঁ চোখকে। আপনি আপনার স্ত্রীকে হারাচ্ছেন বাঁ চোখের জন্যে। আপনার ভেতর রাগ, অভিমান জমতে শুরু করেছে। সেই রাগ আপনার নিজের একটি প্রত্যঙ্গের ওপর। চোখের ওপর। এই রাগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রচণ্ড হতাশা। আপনি যে-বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন সেই গবেষণা অন্য একজন করে ফেলেছেন। জার্নালে তা প্রকাশিত হয়ে গেছে। আপনার চোখ সমস্যা তৈরি না-করলে এমনটা ঘটত না। নিজেই গবেষণাটা শেষ করতে পারতেন। সবকিছুর জন্যে দায়ী হল চোখ।’
মিসির আলি আরেকটি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, ‘আমার এই হাইপোথিসিসের পেছনে আরেকটি শক্ত যুক্তি আছে। যুক্তিটি বলেই আমি কথা শেষ করব।’
‘বলুন।’
‘আপনার স্ত্রী পুরোপুরি বিকৃত মস্তিস্ক হবার পরে যে-কথাটা বলতেন—তা হল, এই লোকটা পিশাচ। আমার কাছে প্রমাণ আছে। কেউ আমার কথা বিশ্বাস করবে না। কিন্তু প্রমাণ আছে। তিনি এই কথা বলতেন, কারণ—পেনসিল দিয়ে নিজের চোখ নিজে গেলে দেওয়ার দৃশ্য তিনি দেখেছেন। আমার হাইপোথিসিস আমি আপনাকে বললাম। এর বেশি আমার কিছু বলার নেই।’
রাশেদুল করিম দীর্ঘ সময় চুপ করে রইলেন। মিসির আলি আরেক বার বললেন, ‘ভাই, চা করব? চা খাবেন?’
তিনি এই প্রশ্নেরও জবাব দিলেন না। উঠে দাঁড়ালেন। চোখে সানগ্লাস পরলেন। শুকনো গলায় বললেন, ‘যাই?’
মিসির আলি বললেন, ‘মনে হচ্ছে আমি আপনাকে আহত করেছি—কষ্ট দিয়েছি। আপনি কিছু মনে করবেন না। নিজের ওপরেও রাগ করবেন না। আপনি যা করেছেন—প্রচণ্ড ভালবাসা থেকেই করেছেন।’
রাশেদুল করিম হাত বাড়িয়ে মিসির আলির হাত ধরে ফেলে বললেন, ‘আমার স্ত্রী বেঁচে থাকলে তার সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দিতাম—আপনি দেখতেন, সে কী চমৎকার একটি মেয়ে ছিল! এবং সেও দেখত—আপনি কত অসাধারণ একজন মানুষ!
‘ঐ দুর্ঘটনার পর জুডির প্রতি তীব্র ঘৃণা নিয়ে আমি বেঁচে ছিলাম। আপনি এই অন্যায় ঘৃণা থেকে তাকে মুক্তি দিয়েছেন। জুডির হয়ে আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
ভদ্রলোকের গলা ধরে এল। তিনি চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে ফেলে বললেন, ‘মিসির আলি সাহেব, ভাই দেখুন—আমার দু’টি চোখ থেকেই এখন পানি পড়ছে। চোখ পাথরের হলেও চোখের অশ্রুগ্রন্থি এখনো কার্যক্ষম। কুড়ি বছর পর এই ঘটনা ঘটল। আচ্ছা ভাই যাই।’
দু’ মাস পর আমেরিকা থেকে বিমান-ডাকে মিসির আলি বড় একটা প্যাকেট পেলেন। সেই প্যাকেটে জলরঙে আঁকা একটা চেরি গাছের ছবি। অপূর্ব ছবি।
ছবির সঙ্গে একটি নোট। রাশেদুল করিম সাহেব লিখেছেন :
“আমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটি আপনাকে দিতে চাচ্ছিলাম। এই ছবিটির চেয়ে প্রিয় কিছু এই মুহূর্তে আমার কাছে নেই। কোনোদিন হবে বলেও মনে হয় না।”