হুমায়ূন আহমেদ

ভয় : জিন-কফিল

জায়গাটার নাম ধুন্দুল নাড়া।

নাম যেমন অদ্ভুত, জায়গাও তেমন জঙ্গুলে। একবার গিয়ে পৌঁছলে মনে হবে সভ্যসমাজের বাইরে চলে এসেছি। সেখানে যাবার ব্যবস্থাটা বলি—প্রথমে যেতে হবে ঠাকরোকোণা। ময়মনসিংহ-মোহনগঞ্জ ব্রাঞ্চ-লাইনের ছোট্ট স্টেশন। ঠাকরোকোণা থেকে গয়নার নৌকা যায় হাতির বাজার পর্যন্ত। যেতে হবে হাতির বাজারে। ভাগ্য ভালো হলে হাতির বাজারে কেরায়া নৌকা পাওয়া যাবে। যদি পাওয়া যায় সেই নৌকায় শিয়ালজানি খাল ধরে মাইল দশেক উত্তরে যেতে হবে। বাকি পথ পায়ে হেঁটে পেরুতে হবে মাঠ, ডোবা, জলাভূমি। জুতো খুলে হাতে নিয়ে নিতে হবে। পা কাটবে ভাঙা শামুকে। গোটা বিশেক জোঁক ধরবে। বিশ্রী অবস্থা! কতটা হাঁটতে হবে তারও অনুমান নেই। একেক জন একেক কথা বলবে। একটা সময় আসবে যখন লোকজন হাসিমুখে বলবে—ধুন্দুল নাড়া? ঐ তো দেখা যায়। তখন বুঝতে হবে আরো মাইল সাতেক বাকি।

বছর পাঁচেক আগে এই জঙ্গুলে জায়গায় আমাকে জনৈক সাধুর সন্ধানে যেতে হয়েছিল। সাধুর নাম—কালু খাঁ। মুসলমান নাম হলেও সাধু হিন্দু ব্রাহ্মণ। বাবা-মা তাঁকে শৈশবেই পরিত্যাগ করেন। তিনি মানুষ হন মুসলিম পরিবারে। কালু খাঁ নাম তাঁর মুসলমান পালক বাবার দেওয়া। যৌবনে তিনি সংসারত্যাগী হয়ে শ্মশানে আশ্রয় নেন। তাঁর অসাধারণ ক্ষমতা, বিভূতির কোনো সীমাসংখ্যা নেই। তিনি কোনোরকম খাদ্য গ্রহণ করেন না। তাঁর গা থেকে সবসময় কাঁঠালচাঁপা ফুলের তীব্র গন্ধ বের হয়। পূর্ণিমার সময় সেই গন্ধ এত তীব্র হয় যে, কাছে গেলে বমি এসে যায়। নাকে রুমাল চেপে কাছে যেতে হয়।

সাধু-সন্ন্যাসী, তাঁদের অলৌকিক ক্ষমতা এইসব নিয়ে আমি কখনো মাথা ঘামাই না। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি—ব্যাখ্যার অতীত কোনো ক্ষমতা প্রকৃতি মানুষকে দেয় নি। কোনো সাধু যদি আমার চোখের সামনে শূন্যে ভাসতে থাকেন, আমি চমৎকৃত হব না। ধরে নেব এর পিছনে আছে ম্যাজিকের সহজ কিছু কলাকৌশল, যা এই সাধু আয়ত্ত করেছেন। কাজেই আমার পক্ষে সাধুর খোঁজে ‘ধুন্দুল নাড়া’ নামের অজ পাড়াগাঁয় যাবার প্রশ্নই আসে না। যেতে হয়েছিল সফিকের কারণে।

সফিক আমার বাল্যবন্ধু। সে বিশ্বাস করে না এমন জিনিস নেই। ভূত-প্রেত থেকে সাধু-সন্ন্যাসী সবকিছুতেই তার অসীম বিশ্বাস। বিংশ শতাব্দীর মানুষ হয়েও সে বিশ্বাস করে যে, সাপের মাথায় মণি আছে। কৃষ্ণপক্ষের রাতে এই মণি সে উগরে ফেলে। চারদিক আলো হয়ে যায়। আলোয় আকৃষ্ট হয়ে পোকা-মাকড় আসে। সাপ তাদের ধরে-ধরে খায়। ভোজনপর্ব শেষ হলে মণিটি আবার গিলে ফেলে।

সাধু কালু খাঁর খবর সফিকই নিয়ে এল এবং এমন ভাব করতে লাগল যে, অবতারের সন্ধান পেয়ে গেছে—যে-অবতারের সঙ্গে দেখা না হলে জীবন বৃথা।

আমি সফিকের সঙ্গে রওনা হলাম দু’টি কারণে—এক, সফিককে আমি অত্যন্ত পছন্দ করি। তাকে একা-একা ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না; দুই, সাধু খোঁজা উপলক্ষে গ্রামের দিকে খানিকটা হলেও ঘোরা হবে। মাঝে-মাঝে এ-রকম ঘুরে বেড়াতে মন্দ লাগে না। নিজেকে পরিব্রাজক-পরিব্রাজক মনে হয়। যেন আমি ফা’হিয়েন। বাংলার পথে-পথে ঘুরে বেড়াচ্ছি।

খুব আগ্রহ নিয়ে রওনা হলেও আগ্রহ হাতির বাজারে পৌঁছবার আগেই শেষ হয়ে গেল। অমানুষিক পরিশ্রম হল। হাতির বাজার থেকে যে-কেরায়া নৌকা নিলাম সে-নৌকাও এখন ডোবে তখন ডোবে অবস্থা। নৌকার পাটাতনের ফুটো দিয়ে বিজবিজ করে পানি উঠছে। সারাক্ষণ সেই পানি সেঁচতে হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত সফিকের মতো পাগলেরও ধৈর্যচ্যুতি হল। কয়েক বার বলল, ‘বিরাট বোকামি হয়েছে। গ্রেট মিসটেক। এর চেয়ে কঙ্গো নদীর উৎস বের করা সহজ ছিল।’

আমি বললাম, ‘এখনো সময় আছে। ফিরে যাবি কি না বল্।’

‘আরে না। এতদূর এসে ফিরে যাব মানে। ভালো জিনিসের জন্যে কষ্ট করতেই হবে। জাস্ট চিন্তা করে দেখ—একজন মানুষের গা থেকে ভুরভুর করে কাঁঠালচাঁপা ফুলের গন্ধ বেরুচ্ছে। ভাবতেই গায়ের লোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে। হাউ এক্সাইটিং!’

সন্ধ্যার পরপর ধুন্দুল নাড়া গ্রামে উপস্থিত হলাম। কাদায় পানিতে মাখামাখি। তিন বার বৃষ্টিতে ভিজেছি। ক্ষুধা এবং তৃষ্ণায় জীবন বের হবার উপক্রম। বিদেশি মানুষ দেখলেই গ্রামের লোকজন সাধারণত খুব আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসে। এইখানে উল্টো নিয়ম দেখলাম। আমাদের ব্যাপারে কারো কোনো আগ্রহ নেই। কোত্থেকে এসেছি? যাবো কোথায়? দায়িত্ব পালন করার ভঙ্গিতে এইটুকু জিজ্ঞেস করেই সবাই চলে যাচ্ছে। এ কী যন্ত্রণা!

সাধু কালু খাঁ-কে দেখেও খুব হতাশ হতে হল। বদ্ধ উন্মাদ একজন মানুষ। শ্মশানে একটা পাকুড় গাছের নিচে ন্যাংটো অবস্থায় বসা। আমাদের দেখেই গালাগালি শুরু করল। গালাগালি যে এত নোংরা হতে পারে তা আমার ধারণার বাইরে ছিল। আমাকে এবং সফিককে কালু খাঁ সবচেয়ে ভদ্র কথা যা বলল তা হচ্ছে, ‘বাড়িত্ যা। বাড়িত্ গিয়া খাবলাইয়া-খাবলাইয়া গু খা।’

আমি হতভম্ব। ব্যাটা বলে কী!

সফিকের দিকে তাকালাম। সে ভাব-গদগদ স্বরে বলল, ‘লোকটার ভেতর জিনিস আছে বলে মনে হচ্ছে।’

আমি বললাম, ‘কী করে বুঝলি? আমাদের গু খেতে বলেছে, এই জন্যে?’

‘আরে না। সে আমাদের এড়াতে চাচ্ছে। মানুষের সংসর্গ পছন্দ নয়। মানুষের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়ার এটা সহজ টেকনিক।’

‘লোকটা যে বদ্ধ উন্মাদ, তা তোর মনে হচ্ছে না?’

‘তাও মনে হচ্ছে। তবে একটা প্রবাবিলিটি আছে যে, সে উন্মাদ না।’

গ্রামের কয়েক জন বয়স্ক মানুষ আমাদের সঙ্গে আছেন। সাধুর প্রতি তাঁদের ভক্তিশ্রদ্ধাও সফিকের মতোই। তাঁদের একজন বললেন, ‘বাবার মাথা এখন একটু গরম।’

আমি বিরক্ত গলায় বললাম, ‘মাথা ঠাণ্ডা হবে কখন?’

‘ঠিক নাই। চাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ।’

‘চাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ মানে?’

‘অমাবস্যা-পূর্ণিমায় মাথা গরম থাকে।’

এই ব্যাপারেও মতভেদ দেখা গেল। একজন বলল, ‘অমাবস্যা-পূর্ণিামাতেই মাথাটা ঠাণ্ডা থাকে। অন্য সময় গরম। বাবার কাছে মাসের পর মাস পড়ে থাকতে হয়। অপেক্ষা করতে হয় কখন বাবার মাথা ঠাণ্ডা হবে।’

আমি বললাম, ‘সফিক, বাবার গা থেকে ফুলের গন্ধ তো কিছু পাচ্ছি না। আমাদের যে-দ্রব্য খেতে বলছিল তার গন্ধ পাচ্ছি। তুই কি পাচ্ছিস?’

সফিক জবাব দেবার আগেই আমাদের সঙ্গী মানুষের একজন ভীত গলায় বলল, ‘একটু দূরে যান। বাবা অখন ঢিল মারব। আইজ মনে হইতাছে বাবার মিজাজ বেশি খারাপ।’

কথা শেষ হবার আগেই ঢিলবৃষ্টি শুরু হল। দৌড়ে নিরাপদ দূরত্বে চলে গেলাম। বাবার কাণ্ডকারখানায় সফিকের অবশ্যি মোহভঙ্গ হল না। সে বেশ উৎসাহের সঙ্গেই বলল, ‘দুটো দিন থেকে দেখি। এতদূর থেকে আসা। ভালো-মতো পরীক্ষা না-করে চলে যাওয়াটা ঠিক হবে না।’

‘আর কী পরীক্ষা করবি?’

‘মানে ওনার মাথা যখন ঠাণ্ডা হবে তখন দু’-একটা কথাটথা জিজ্ঞেস করলে…’

আমি হাল ছেড়ে দেওয়া গলায় বললাম, ‘থাকবি কোথায়?’

‘স্কুলঘরে শুয়ে থাকব। খানিকটা কষ্ট হবে। কী আর করা! কষ্ট বিনে কেষ্ট মেলে না।’

জানা গেল এই গ্রামে কোনো স্কুল নেই। পাশের গ্রামে প্রাইমারি স্কুল আছে—এখান থেকে ছ’ মাইলের পথ। তবে গ্রামে পাকা মসজিদ আছে। অতিথি মোসাফির এলে মসজিদে থাকে। মসজিদের পাশেই ইমাম সাহেব আছেন। তিনি অতিথিদের খোঁজখবর করেন। প্রয়োজনে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করেন।

আমি খুব একটা উৎসাহ বোধ করলাম না। গ্রামের একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ইমাম সাহেব লোক কেমন?’

সে অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে দার্শনিকের মতো বলল, ‘ভালোয়-মন্দয় মিলাইয়া মানুষ। কিছু ভালো, কিছু মন্দ।’

এই উত্তরও আমার কাছে খুব সন্দেহজনক মনে হল। উপায় নেই। আকাশে আবার মেঘ জমতে শুরু করেছে। রওনা হলাম মসজিদের দিকে। গ্রামের লোকগুলো অভদ্রের চূড়ান্ত। কেউ সঙ্গে এল না। কীভাবে যেতে হবে বলেই ভাবল আমাদের জন্যে অনেক করা হয়েছে।

মসজিদ খুঁজে বের করতেও অনেক সময় লাগল।

অন্ধকার রাত। পথঘাট কিছুই চিনি না। সঙ্গে টর্চলাইট ছিল—বৃষ্টিতে ভিজে সেই টর্চলাইটও কাজ করছে না। অন্ধের মতো এগুতে হচ্ছে। যাকেই জিজ্ঞেস করি সে-ই খানিকটা জেরা করে—‘জুম্মাঘরে যাইতে চান ক্যান? কার কাছে যাইবেন? আপনের পরিচয়?’

শেষ পর্যন্ত মসজিদ পাওয়া গেল। গ্রামের একেবারে শেষপ্রান্তে একটা খালের পাশে মসজিদ। মসজিদের বয়স খুব কম হলেও দু’ শ’ বছরের কম হবে না। বিশাল স্তূপের মতো একটা ব্যাপার। সেই স্তূপের সবটাই শ্যাওলায় ঢাকা। গা বেয়ে উঠেছে বটগাছ। সব মিলিয়ে কেমন গা-ছমছমানি ব্যাপার আছে।

আমাদের সাড়াশব্দ পেয়ে হারিকেন হাতে ইমাম সাহেব চলে এলেন। ছোটখাটো মানুষ। খালি গা। কাঁধে গামছা চাদরের মতো জড়ানো। বয়স চল্লিশের মতো হবে। দাড়িতে তাকে খানিকটা আর্নেস্ট হেমিংওয়ের মতো দেখাচ্ছে। আমার ধারণা ছিল মসজিদে রাত্রি যাপন করব শুনে তিনি বিরক্ত হবেন। হল উল্টোটা। তাঁকে আনন্দিত মনে হল। নিজেই বালতি করে পানি এনে দিলেন। গামছা আনলেন। দু’ জোড়া খড়ম নিয়ে এলেন। সফিক বলল, ‘ভাই, আমাদের খাওয়াদাওয়া দরকার। সারাদিন উপোস। টাকাপয়সা নিয়ে যদি খাওয়ার ব্যবস্থা করেন।’

ইমাম সাহেব বললেন, ‘ব্যবস্থা হবে জনাব। আমার বাড়িতেই গরিবি হালতে ডালভাতের ব্যবস্থা।’

‘নাম কি আপনার?’

‘মুনশি এরতাজউদ্দিন।’

‘থাকেন কোথায়, আশেপাশেই?’

‘মসজিদের পিছনে—ছোট্ট একটা টিনের ঘর আছে।’

‘কে কে থাকেন?’

‘আমার স্ত্রী, আর কেউ না।’

‘ছেলেমেয়ে?’

ছেলেমেয়ে নাই জনাব। আল্লাহ্‌পাক সন্তান দিয়েছিলেন, তাদের হায়াত দেন নাই। হায়াত-মউত সবই আল্লাহ্‌পাকের হাতে। আপনারা হাত-মুখ ধুয়ে বিশ্রাম করেন, আমি আসতেছি।’

ভদ্রলোক ছোট-ছোট পা ফেলে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। সফিক বলল, ‘ইমাম সাহেবকে নিতান্ত ভদ্রলোক বলে মনে হচ্ছে। মাই ডিয়ার টাইপ। মনে হচ্ছে আমাদের দেখে খুশি হয়েছেন।’

আমি বললাম, ‘ভদ্রলোক জঙ্গুলে জায়গায় একা পড়ে আছেন—আমাদের দেখে সেই কারণেই খুশি। এই মসজিদে নামাজ পড়তে কেউ আসে বলে আমার মনে হয় না।’

‘বুঝলি কি করে?’

‘লোকজনের যাতায়াত থাকলে পায়ে চলার পথ থাকত। পথ দেখলাম না।’

সফিক হাসতে হাসতে বলল, ‘মিসির আলির সঙ্গে থেকে-থেকে তোর অবজারভেশন পাওয়ার বেড়েছে বলে মনে হয়।’

‘কিছুটা তো বেড়েছেই। ইমাম সাহেব আমাদের বসিয়ে রেখে যে চলে গেলেন, কী নিয়ে ফিরবেন জানিস?’

‘কী নিয়ে?’

‘দু’ হাতে দুটো কাটা ডাব নিয়ে।’

‘এই তোর অনুমান?’

আমি হাসিমুখে বললাম, ‘মিসির আলি থাকলে এই অনুমানই করতেন। অনুমানের ভিত্তি হচ্ছে গ্রামে প্রচুর ডাব গাছ। অতিথিদের ডাব দেওয়া সনাতন রীতি।’

‘লজিক তো ভালোই মনে হচ্ছে।’

আমার লজিক ভুল প্রমাণ করে মুনশি এরতাজউদ্দিন ট্রে হাতে উপস্থিত হলেন। ট্রেতে দু’ কাপ চা। একবাটি তেল-মরিচ মাথা মুড়ি। এই অতি পাড়াগাঁ জায়গায় অভাবনীয় ব্যাপার তো বটেই। মফস্বলের চা অতিরিক্ত গরম, অতিরিক্ত মিষ্টি এবং অতিরিক্ত কড়া হয়। তবু চা হচ্ছে চা। চব্বিশ ঘণ্টা পর প্রথম চায়ে চুমুক দিলাম, মনটা ভালো হয়ে গেল। চমৎকার চা। বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘চা কে বানিয়েছে? আপনার স্ত্রী?’

ইমাম সাহেব লাজুক মুখে বললেন, ‘জ্বি। তার চায়ের অভ্যাস আছে। শহরের মেয়ে। আমার শ্বশুরসাহেব হচ্ছেন নেত্রকোণার বিশিষ্ট মোক্তার মমতাজউদ্দিন। নাম শুনেছেন বোধহয়।’

আমরা এমন ভঙ্গি করলাম যে নামটা আমাদের কাছে অপরিচিতি নয়, আগে অনেক বার শুনেছি।

ইমাম সাহেব বললেন, ‘আমি চা খাই না। আমার স্ত্রীর চায়ের অভ্যাস আছে। শহর থেকে ভালো চায়ের পাতা এনে দিতে হয়। বিরাট খরচান্ত ব্যাপার।’

‘আপনি কি ইমামতি ছাড়া আর কিছু করেন?’

‘জ্বি-না। সামান্য জমিজমা আছে। আধি দেই। আমার শ্বশুর সাহেব তাঁর মেয়ের নামে নেত্রকোণা শহরে একটা ফার্মেসি দিয়েছেন—সানরাইজ ফার্মেসি। তার আয় মাসে-মাসে আসে। রিজিকের মালিক আল্লাহ্‌পাক। তাঁর ইচ্ছায় চলে যায়।’

‘ভালো চলে বলেই তো মনে হচ্ছে।’

‘জ্বি জনাব, ভালোই চলে। সংসার ছোট। ছেলেপুলে নাই।’

এশার নামাজের সময় হয়ে গিয়েছিল। ইমামসাহেব আজান দিয়ে নামাজ পড়তে গেলেন। কোনো দ্বিতীয় ব্যক্তিকে নামাজে আসতে দেখলাম না। ইমাম সাহেবকে জিজ্ঞেস করে জানলাম—লোক এমনিতেই হত না। দু’ বছর ধরে একেবারেই হচ্ছে না। শুধু জুমাবারে কিছু মুসুল্লি আসেন।

লোকজন না-হওয়ার কারণও বিচিত্র। মসজিদ সম্পর্কে গুজব রটে গেছে, এখানে জিন থাকে। নাপাক অবস্থায় নামাজ পড়লে জিন তার সঙ্গে বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয়। নানান ধরনের যন্ত্রণা করে।

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘জিন কি সত্যি-সত্যি আছে?’

‘অবশ্যই আছে। আল্লাহ্‌পাক কোরান মজিদে বলেছেন। একটা সুরা আছে— সুরায়ে জিন।’

‘সেই কথা জিজ্ঞেস করছি না—জানতে চাচ্ছি জিন গিয়ে বিরক্ত করে এটা সত্যি কিনা?’

‘জ্বি জনাব, সত্য। তবে লোকজন জিনের ভয়ে মসজিদে আসে না—এটা ঠিক না, আসলে সাপের ভয়ে আসে না।’

‘সাপের ভয়ে আসে না! কী বলছেন আপনি?’

‘একবার নামাজের মাঝখানে সাপ বের হয়ে গেল। দাঁড়াস সাপ। অবশ্য কাউকে কামড়ায় নাই। বাস্তুসাপ কামড়ায় না। মাঝেমধ্যে ভয় দেখায়।’

সফিক আঁৎকে উঠে বলল, ‘মাই গড! যখন-তখন সাপ বের হলে এইখানে থাকব কীভাবে?’

‘ভয়ের কিছু নাই। কার্বলিক এসিড ছড়ায়ে দিব।’

‘কার্বলিক এসিড আছে?’

‘জ্বি। নেত্রকোণার ফার্মেসি থেকে তিন বোতল নিয়ে আসছি। আমার স্ত্রীরও খুব সাপের ভয়। এই অঞ্চলে সাপখোপ একটু বেশি।’

মসজিদের সামনে উঁচু চাতালমতো জায়গায় বসে আছি। সাপের ভয়ে খানিকটা আতঙ্কগ্রস্ত। আকাশে মেঘ ডাকছে। বড় ধরনের বর্ষণ মনে হচ্ছে আসন্ন। ইমাম সাহেব বললেন, ‘খাওয়া দিতে একটু দেরি হবে। আমার স্ত্রী সব একা করছে—লোকজন নাই।’

‘ভাব দেখে মনে হচ্ছে—বিরাট আয়োজন।’

‘জ্বি-না, আয়োজন কিছু না, দরিদ্র মানুষ। আপনারা এসেছেন শুনে আমার স্ত্রী খুব খুশি। কেউ আসে না। আমি বলতে গেলে একা থাকি। সবাই আমাকে ভয় করে।’

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘কেন?’

‘সবার একটা ধারণা হয়েছে আমি জিন পুষি। জিনদের দিয়ে কাজকর্ম করাই…‥’

‘বলেন কী!’

‘সত্য না জনাব। তবে মানুষ অসত্যকে সহজে বিশ্বাস করে। অসত্য বিশ্বাস করা সহজ, কারণ শয়তান অসত্য বিশ্বাসে সাহায্য করে।’

ইমাম সাহেব বেশ মন খারাপ করে চুপ হয়ে গেলেন। প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্যে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সাধু কালু খাঁ সম্পর্কে কী জানেন?’

ইমাম সাহেব বললেন, ‘তেমন কিছু জানি না। তবে আপনাদের মতো দূর-দূর থেকে ওনার কাছে লোকজন আসে—এইটা দেখেছি। বিশিষ্ট ভদ্রলোকরাই আসে বেশি। ময়মনসিংহের ডি. সি. সাহেব ওনার পত্নীকে নিয়ে এসেছিলেন।’

‘ওনার ক্ষমতাটমতা কিছু আছে?’

‘মনে হয় না। কুৎসিত গালাগালি করেন। কামেল মানুষের এই রকম গালিগালাজ করার কথা না। তা ছাড়া কালু খাঁর কারণে অনেক বেদাতী কাণ্ডকারখানা হয়। এইগুলাও ঠিক না।’

‘কী কাণ্ডকারখানা হয়?’

‘উনি নগ্ন থাকেন। এইজন্য অনেকের ধারণা নগ্ন অবস্থায় তাঁর কাছে গেলে তাঁর মেজাজ ঠিক থাকে। অনেকেই নগ্ন অবস্থায় যান।’

‘সে কী।’

‘উনি পাগলমানুষ। সমস্যার কারণে যাঁরা তাঁর কাছে আসেন তাঁরাও এক অর্থে পাগল। পাগলমানুষের কাজকর্ম তো এই রকমই হয়। সমস্যা হলে তার পরিত্রাণের জন্য আল্লাহ্‌পাকের দরবারে কান্নাকাটি করতে হয়। মানুষ তা করে না, সাধু-সন্ন্যাসী, পীর-ফকির খোঁজে।’

ইমাম সাহেবের কথাবার্তায় আমি অবাক হলাম। পরিষ্কার চিন্তা-ভাবনা। গ্রাম্য মসজিদের ইমামের কাছ থেকে এমন যুক্তিনির্ভর কথা আশা করা যায় না। লোকটির প্রতি আমার একধরনের শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হল। তা ছাড়া ভদ্রলোকের আচার-আচরণেও সহজ সারল্য আছে, যে-সারল্যের দেখা সচরাচর পাওয়া যায় না।

রাত ন’টার দিকে ইমাম সাহেব বললেন, ‘চলেন যাই, খানা বোধহয় এর মধ্যে তৈরি হয়েছে। ডাল-ভাত-এর বেশি কিছু না। নিজ গুণে ক্ষমা করে চারটা মুখে দিবেন।’

ইমাম সাহেবের বাড়িটা ছোট্ট টিনের দু’-কামরার বাড়ি। একচিলতে উঠোন। বাড়ির চারদিকে দর্মার বেড়া। আমাদের ঘরে নিয়ে বসানো হল। মেঝেতে শতরঞ্জি বিছানো। থালা-বাসন সাজানো। আমরা সঙ্গে-সঙ্গে খেতে বসে গেলাম। খাবারের আয়োজন অল্প হলেও ভালো। সব্জি, ছোটো মাছের তরকারি, ডাল এবং টকজাতীয় একটা খাবার। ইমাম সাহেব আমাদের সঙ্গে বসলেন না। খাবার পরিবেশন করতে লাগলেন। খাবারের শেষ পর্যায়ে আমাদের অবাক করে দিয়ে ইমাম সাহেবের স্ত্রী ঘরে ঢুকলেন, এবং শিশুর মতো কৌতূহলী চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ব্যাপারটা এত আচমকা ঘটল যে আমি বেশ হকচকিয়েই গেলাম। অজ পাড়াগাঁয়ে এটা অভাবনীয়। কঠিন পর্দাপ্রথাই আশা করেছিলাম। আমি খানিকটা সংকুচিত হয়েই রইলাম। ইমাম সাহেবকেও দেখলাম খুব অপ্রস্তুত বোধ করছেন।

সফিক মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি কেমন আছেন?’

ইমাম সাহেবের স্ত্রী সঙ্গে-সঙ্গে বললেন, ‘ভালো নাই। আমার সঙ্গে একটা জিন থাকে। জ্বিনটার নাম কফিল। কফিল আমারে খুব ত্যক্ত করে।’

সফিক হতভম্ব হয়ে বলল, ‘আপনি কী বললেন, বুঝলাম না।’

মেয়েটি যন্ত্রের মতো বলল, ‘আমার সঙ্গে একটা জিন থাকে। জ্বিনটার নাম কফিল। কফিল আমারে বড় যন্ত্রণা করে।

সফিক অবাক হয়ে তাকাল আমার দিকে। আমি নিজেও বিস্মিত। ব্যাপার কী কিছু বুঝতে পারছি না। ইমাম সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন— ‘লতিফা, তুমি একটু ভিতরে যাও।’

ভদ্রমহিলা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, ‘ক্যান? ভিতরে ক্যান? থাকলে কী অসুবিধা?’

‘ওনাদের সঙ্গে কিছু কথা বলব। তুমি না থাকলে ভালো হয়। সব কথা মেয়েছেলেদের শোনা উচিত না।’

লতিফা তীব্র চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইল। খাওয়া বন্ধ করে আমরা হাত গুটিয়ে বসে রইলাম। এ কী সমস্যা!

লতিফা মেয়েটি রূপবতী। শুধু রূপবতী নয়, চোখে পড়ার মতো রূপবতী। হালকা-পাতলা শরীর। ধবধবে ফরসা গায়ের রঙ। লম্বাটে স্নিগ্ধ মুখ। বয়সও খুব কম মনে হচ্ছে। দেখাচ্ছে আঠার-উনিশ বছরের তরুণীর মতো। এত কম বয়স তার নিশ্চয় নয়। যার স্বামীর বয়স চল্লিশের কাছাকাছি তার বয়স আঠার-উনিশ হতে পারে না। আরো একটি লক্ষ করার মতো ব্যাপার হল—মেয়েটি সাজগোজ করেছে। চুল বেঁধেছে, চোখে কাজল দিয়েছে—কপালে লাল রঙের টিপ। গ্রামের মেয়েরা কপালে টিপ দেয় বলে ও জানতাম না।

ইমাম সাহেব আবার বললেন, ‘লতিফা, ভিতরে যাও।’

মেয়েটি উঠে চলে গেল।

ইমাম সাহেব গলার স্বর নিচু করে বললেন, ‘লতিফার মাথা পুরাপুরি ঠিক না। ওর দুটো সন্তান নষ্ট হয়েছে। তারপর থেকে এ-রকম। তার ব্যবহারে আপনারা কিছু মনে করবেন না। আমি তার হয়ে আপনাদের কাছে ক্ষমা চাই। কিছু মনে করবেন না।—আল্লাহ্‌র দোহাই।’

আমি বললাম, ‘কিছুই মনে করি নি। তা ছাড়া মনে করার মতো কিছু তো উনি করেন নি।

ইমাম সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘জিনের কারণে এ-রকম করে। জিনটা তার সঙ্গে-সঙ্গে আছে। মাঝে-মাঝে মাসখানিকের জন্য চলে যায়। তখন ভালো থাকে। গত এক মাস ধরে তার সাথে আছে।’

‘আপনি এ-সব বিশ্বাস করেন?’

‘বিশ্বাস করব না কেন? বিশ্বাস না-করার তো কিছু নাই। বাতাস আমরা চোখে দেখি না, কিন্তু বাতাস বিশ্বাস করি। কারণ বাতাসের নানান আলামত দেখি। সেই রকম জিন কফিলেরও নানান আলামত দেখি।’

‘কী দেখেন?’

‘জিন যখন সঙ্গে থাকে, তখন লতিফা খুব সাজগোজ করে। কথায়-কথায় হাসে, কথায়-কথায় কাঁদে।’

‘জিন তাড়াবার ব্যবস্থা করেন নি?’

‘করেছি। লাভ হয় নাই। কফিল খুব শক্ত জিন। দীর্ঘদিন লতিফার সঙ্গে আছে। প্রথম সন্তান যখন গর্ভে আসল তখন থেকেই কফিল আছে।’

‘জিন চায় কী?’

ইমাম সাহেব মাথা নিচু করে রইলেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি কোনো কারণে খুব কষ্ট পাচ্ছেন। আমার মনে ক্ষীণ সন্দেহ হল—জিন বোধহয় লতিফা মেয়েটিকেই স্ত্রী হিসেবে চায়। বিংশ শতাব্দীতে এই ধরনের চিন্তা মাথায় আসছে দেখে আমি নিজের ওপরও বিরক্ত হলাম। ইমাম সাহেব বললেন, ‘এই জিনটা আমার দুইটা বাচ্চা মেরে ফেলেছে। আবার যদি বাচ্চা হয় তারেও মারবে। বড় মনকষ্টে আছি জনাব। দিন-রাত আল্লাহ্‌পাকেরে ডাকি। আমি গুনাগার মানুষ, আল্লাহ্‌পাক আমার কথা শুনেন না।’

‘আপনার স্ত্রীকে কোনো ডাক্তার দেখিয়েছেন?’

‘ডাক্তার কী করবে? ডাক্তারের কোনো বিষয় না। জিনের ওষুধ ডাক্তারের কাছে নাই।’

‘তবু একবার দেখালে হত না?’

‘আমার শ্বশুরসাহেব দেখিয়েছিলেন। একবার লতিফাকে বাপের বাড়িতে রেখে এসেছিলাম। শ্বশুরসাহেব তারে ঢাকা নিয়ে গেলেন। চিকিৎসাটিকিৎসা করালেন। লাভ হল না।’

বারান্দা থেকে গুনগুন শব্দ আসছে। উৎকর্ণ হয়ে রইলাম—খুবই মিষ্টি গলায় টেনে টেনে গান হচ্ছে—যার কথাগুলোর বেশির ভাগই অস্পষ্ট। মাঝে-মাঝে দু’-একটা লাইন বোঝা যায়, যার কোনো অর্থ নেই। যেমন:

‘এতে না দেহে না দেহে না এতে না।’

ইমাম সাহেব উঁচু গলায় বললেন, ‘লতিফা, চুপ কর। চুপ কর বললাম।’

গান থামিয়ে লতিফা বলল, ‘তুই চুপ কর্। তুই থাম্ শুয়োরের বাচ্চা।’

অবিকল পুরুষের ভারি গলা। আমার গা কাঁটা দিয়ে উঠল। সেই পুরুষকণ্ঠ থমথমে স্বরে বলল, ‘চুপ কইরা থাকবি। একটা কথা কইলে টান দিয়া মাথা আলগা করুম। শ‍ইল থাকব একখানে মাথা আরেকখানে। শুয়োরের বাচ্চা আমারে চুপ করতে কয়।’

আমরা হাত ধুয়ে উঠে পড়লাম। এত কাণ্ডের পর খাওয়াদাওয়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব না। এ-জাতীয় যন্ত্রণায় পড়ব, কখনো ভাবি নি।

সফিক নিচু গলায় বলল, ‘বিরাট সমস্যা হয়ে গেল দেখি। ভয়ভয় লাগছে। কী করা যায় বল্ তো?’

মসজিদের ভেতর এর আগে কখনো রাত্রি যাপন করি নি। অস্বস্তি নিয়ে ঘুমুতে গেলাম। কেমন যেন দম-বন্ধ দম-বন্ধ লাগছে। মসজিদের একটামাত্র দরজা—সেটি পেছন দিকে। ভেতরে গুমোট ভাব। ইমাম সাহেব যত্নের চূড়ান্ত করেছেন। স্ত্রীর অস্বাভাবিক আচরণজনিত লজ্জা হয়তো-বা ঢাকার চেষ্টা করেছেন। আমাদের জন্যে দুটো শীতল পাটি, পাটির চারপাশে কার্বলিক এসিড ছড়ানো হয়েছে। তার চেয়েও বড় কথা—দুটো মশারি খাটানো হয়েছে।

ইমাম সাহেব বললেন, ‘ভয়ের কিছু নাই। হারিকেন জ্বালানো থাকবে। আলোতে সাপ আসে না। দরজা বন্ধ। সাপ ঢোকারও পথ নাই।’

আমি খুব যে ভরসা পাচ্ছি, তা নয়। চৌকি এনে ঘুমুতে পারলে হত। মসজিদের ভেতর চৌকি পেতে শোয়া—ভাবাই যায় না।

সফিকের হচ্ছে ইচ্ছাঘুম। শোয়ামাত্র নাক ডাকতে শুরু করেছে। বাইরে ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছে। ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। মসজিদের ভেতর আগরবাতির গন্ধ। যে-গন্ধ সবসময় মৃত্যুকে মনে করিয়ে দেয়। সব মিলিয়ে গা ছমছমানো ব্যাপার।

আমি ইমাম সাহেবকে বললাম, ‘আপনি চলে যান, আপনি এখানে বসে আছেন কেন? আপনার স্ত্রী একা। তাঁর শরীরও ভালো না।’

ইমাম সাহেব বললেন, ‘আমি মসজিদেই থাকব। এবাদত-বন্দেগি করব। ফজরের নামাজ শেষ করে বাসায় গিয়ে ঘুমুব।’

‘কেন?’

‘লতিফা এখন আমাকে দেখলে উন্মাদের মতো হয়ে যাবে। মেঝেতে মাথা ঠুকবে।’

‘কেন?’

‘ওর দোষ নাই কিছু। সঙ্গে জিন আছে—কফিল। এই জিনই সবকিছু করায়। বেচারির কোনো দোষ নাই।’

আমি চুপ করে রইলাম। ইমাম সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘এমনিতে তেমন উপদ্রব করে না। সন্তানসম্ভবা হলেই কফিল ভয়ংকর যন্ত্রণা করে। বাচ্চাটা মেরে না-ফেলা পর্যন্ত থামে না। দুইটা বাচ্চা মেরেছে—এইটাও মারবে।’

‘আপনার স্ত্রী কি সন্তানসম্ভবা?’

‘জ্বি।’

‘আপনি কি নিশ্চিত যে পুরো ব্যাপারটা জিন করছে, অন্য কিছু না?’

‘জ্বি, নিশ্চিত। জিনের সঙ্গে আমার মাঝেমধ্যে কথা হয়।’

‘অবিশ্বাস্য সব কথাবার্তা বলছেন আপনি।’

‘অবিশ্বাসের কিছু নাই। একদিনের ঘটনা বলি—তাহলে বুঝবেন। ভাদ্র মাস। খুব গরম। একটা ভেজা গামছা শরীরে জড়ায়ে এশার নামাজে দাঁড় হয়েছি। মসজিদে আমি একা। আমি ছাড়া আর কেউ নাই। হঠাৎ দপ করে হারিকেনটা নিভে গেল। চমকে উঠলাম।। তারপর শুনি মসজিদের পিছনের দরজার কাছে ধুপ-ধুপ শব্দ। খুব ভয় লাগল। নামাজ ছেড়ে উঠতে পারি না। নামাজে মনও দিতে পারি না। কিছুক্ষণ পরপর পিছনের দরজায় ধুপধুপ শব্দ। যেন কেউ কিছু একটা এনে ফেলছে। সেজদায় যাবার সময় কফিলের গলা শুনলাম—টেনে-টেনে বলল, ‘তোরে আইজ পুড়াইয়া মারব। তোরে আইজ পুড়াইয়া মারব।’ তারপর ধপ করে আগুন জ্বলে উঠল। দাউদাউ আগুন। নামাজ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। দেখি দরজার কাছে গাদা করা শুকনা লাকড়ি। আগুন জ্বলছে। আমি চিৎকার দিয়ে উঠলাম—বাঁচাও, বাঁচাও! আমার চিৎকার শুনে লতিফা পানির বালতি হাতে ছুটে আসল। পানি দিয়ে আগুন নিভায়ে আমারে মসজিদ থেকে টেনে বার করল। আমার স্ত্রীর কারণে সেই যাত্রা বেঁচে গেলাম। লতিফা সময়মতো না আসলে মারা পড়তাম।’

‘জিন মসজিদের ভেতরে ঢুকল না কেন?’

‘খারাপ ধরনের জ্বীন। আল্লাহ্‌র ঘরে এরা ঢুকতে পারে না। আমি এই জন্যই বেশির ভাগ সময় মসজিদে থাকি। মসজিদে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমাতে পারি। ঘরে পারি না।’

‘কফিল আপনাকে খুন করতে চায়?’

‘তাও ঠিক না—একবারই চেয়েছিল। তারপর আর চায় নাই।’

‘খুন করতে চেয়েছিল কেন?’

ইমাম সাহেব চুপ করে রইলেন। আমি বললাম, ‘আপনার যদি আপত্তি না থাকে পুরো ঘটনাটা বলুন। আপত্তি থাকলে বলার দরকার নেই।’

‘না, আপত্তির কী আছে? আপত্তির কিছু নাই। আমি লতিফার অবস্থা একটু দেখে আসি।’

‘যান, দেখে আসুন।’

ইমাম সাহেব চলে গেলেন। আমি ভয়ে অস্থির হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ভূত, প্রেত, জিন, পরী কখনো বিশ্বাস করি নি—এখনো করছি না, তবু আতঙ্কে আধমরা হয়ে গেছি। সফিক জেগে থাকলে খানিকটা ভরসা পাওয়া যেত। সে ঘুমুচ্ছে মড়ার মতো। একেই বলে পরিবেশ। ইমাম সাহেব দশ মিনিটের মধ্যে ফিরে এলেন। বিরস গলায় বললেন, ‘ভালোই আছে, তবে ভীষণ চিৎকার করছে।’

‘তালাবন্ধ করে রেখেছেন?’

‘জ্বি-না। তালাবন্ধ করে তাকে রাখা সম্ভব না। কফিল ওর সঙ্গে থাকে কাজেই ওর গায়ের জোর থাকে অসম্ভব। না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবেন না।’

ইমাম সাহেব মন-খারাপ করে বসে রইলেন। আমি বললাম, ‘গল্পটা শুরু করুন ভাই।’

তিনি নিচু গলায় বললেন, ‘আমার স্ত্রীর ডাকনাম বুড়ি।’

কথা পুরোপরি শেষ করতে পারলেন না। মসজিদে প্রচণ্ড শব্দে ঢিল পড়তে লাগল। ধুপধুপ শব্দ। সেই সঙ্গে মনে হচ্ছে কয়েকজন মানুষ যেন চারদিকে ছোটাছুটি করছে। আমি আতঙ্কিত গলায় বললাম, ‘কী ব্যাপার?

ইমাম সাহেব বললেন, ‘কিছু না। কফিল চায় না আমি কিছু বলি।’

‘থাক ভাই, বাদ দিন। গল্প বলার দরকার নেই।’

‘অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ঢিল ছোঁড়া বন্ধ হবে। ভয়ের কিছুই নাই।’

সত্যি-সত্যি বন্ধ হল। বৃষ্টির বেগ বাড়তে লাগল। ইমাম সাহেব গল্প শুরু করলেন। আমি তাঁর গল্পটাই বলছি। তাঁর ভাষাতে। তবে আঞ্চলিকতাটা সামান্য বাদ দিয়ে।

গল্পের মাঝখানেও একবার তুমুল ঢিল ছোঁড়া হল। ইমাম সাহেব একমনে আয়াতুল কুরসি পড়লেন। আমার জীবনে সে এক ভয়াবহ রাত।