হুমায়ূন আহমেদ

ভয় : চোখ

মিসির আলি স্কেচবুকের প্রতিটি পাতা সাবধানে ওল্টালেন। চারকোল এবং পেনসিলে স্কেচ আঁকা। প্রতিটি স্কেচের নিচে আঁকার তারিখ। স্কেচের বিষয়বস্তু অতি তুচ্ছ, সবই ঘরোয়া জিনিস—এক জোড়া জুতো, মলাট-ছেঁড়া বই, টিভি, বুকশেলফ। স্কেচ বুকের শেষের দিকে শুধুই চোখের ছবি। বিড়ালের চোখ, কুকুরের চোখ, মাছের চোখ এবং মানুষের চোখ। মানুষের চোখের মডেল যে রাশেদুল করিম তা বলার অপেক্ষা রাখে না। না বললেও ছবির নিচের মন্তব্য থেকে বোঝা যাচ্ছে। মন্তব্যগুলি বেশ দীর্ঘ। যেমন একটি মন্তব্য :

‘আমি খুব মন দিয়ে আমার স্বামীর চোখ লক্ষ করছি। মানুষের চোখ একেক সময় একেক রকম থাকে। ভোরবেলার চোখ এবং দুপুরের চোখ এক নয়। আরো একটি জিনিস লক্ষ করলাম—চোখের আইরিশের ট্রান্সপারেন্সি মুডের ওপর বদলায়। বিষাদগ্রস্ত মানুষের চোখের আইরিশ থাকে অস্বচ্ছ। মানুষ যতই আনন্দিত হতে থাকে তার চোখের আইরিশ ততই স্বচ্ছ হতে থাকে। আমার এই অবজারভেশন কতটুকু সত্য তা বুঝতে পারছি না।’

মেয়েটি মাঝে-মাঝে তার মনের অবস্থাও লিখেছে—অনেকটা ডায়েরি লেখার ভঙ্গিতে। মনে হয় হাতের কাছে ডায়েরি না-থাকায় স্কেচবুকে লিখে রেখেছে। সব লেখাই পেনসিলে। প্রচুর কাটাকুটি আছে। কিছু লাইন রাবার ঘষে তুলেও ফেলা হয়েছে।

১৮.৪.৮২

আমি ভয়ে অস্থির হয়ে আছি। নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছি—এই ভয় অমূলক। বোঝাতে পারছি না। আমি আমার স্বামীকে ভয় পাচ্ছি, এই তথ্য স্বভাবতই স্বামী বেচারার জন্যে সুখকর নয়। সে নানানভাবে আমাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছে। কিছু-কিছু চেষ্টা বেশ হাস্যকর। আজ আমাকে বলল, ‘জুডি, আমি ঠিক করেছি—এখন থেকে রাতে ঘুমুব না। আমার অঙ্কের সমস্যা নিয়ে ভাবব। লেখালেখি করব। তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমাও। আমি দিনের বেলায় ঘুমুব। একজন মানুষের জন্যে চার ঘণ্টা ঘুমই যথেষ্ট। নেপোলিয়ান মাত্র তিন ঘণ্টা ঘুমুতেন।’

আমি এই গম্ভীর, স্বল্পভাষী লোকটিকে ভালবাসি। ভালবাসি, ভালবাসি, ভালবাসি। আমি চাই না, আমার কোনো কারণে সে কষ্ট পাক। কিন্তু সে কষ্ট পাচ্ছে, খুব কষ্ট পাচ্ছে। হে ঈশ্বর, তুমি আমার মন শান্ত কর। আমার ভয় দূর করে দাও।

২১.৪.৮২

যে-জিনিস খুব সুন্দর তা কত দ্রুত অসুন্দর হতে পারে—বিস্মিত হয়ে আমি তা-ই দেখছি। রাশেদের ধারণা আমি অসুস্থ। সত্যিই কি অসুস্থ? আমার মনে হয় না। কারণ, এখনো ছবি আঁকতে পারছি। একজন অসুস্থ মানুষ আর যা-ই পারুক—ছবি আঁকতে পারে না। গত দু’ দিন ধরে ওয়াটার কালারে বাসার সামনের চেরি গাছের ফুল ধরতে চেষ্টা করছিলাম। আজ সেই ফুল কাগজে বন্দি করেছি। অনেকক্ষণ ছবিটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। ভালো হয়েছে। রাশেদ ছবি তেমন বোঝে বলে মনে হয় না—সেও মুগ্ধ হয়ে অনেকক্ষণ দেখল। তারপর বলল, ‘আমি যখন বুড়ো হয়ে যাব, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেব, তখন তুমি আমাকে ছবি আঁকা শিখিয়ে দেবে।’ এই কথাটি সে আজ প্রথম বলে নি, আগেও বলেছে। আন্তরিক ভঙ্গিতে বলেছে। কেউ যখন আন্তরিকভাবে কিছু বলে তখন তা টের পাওয়া যায়। আমার মনে হয় না সে কোনোদিন ছবি আঁকবে। তার মাথায় অঙ্ক ছাড়া কিছুই নেই।

২১.৫.৮২

আমি ছবি আঁকতে পারছি না। যেখানে নীল রঙ চড়ানো দরকার, সেখানে গাঢ় হলুদ রঙ বসাচ্ছি। ডাক্তার সিডেটিভের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সারাক্ষণ মাথা ঝিম ধরে থাকে। কেন জানি খুব বমি হচ্ছে।

আজ দুপুরে অনেকক্ষণ ঘুমুলাম। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সুন্দর একটা স্বপ্নও দেখে ফেললাম। সুন্দর স্বপ্ন আমি অনেক দিন দেখি না, অনেক দিন দেখি না, অনেক দিন দেখি না। অনেক দিন দেখি না। অনেক দিন দেখি না। আচ্ছা, আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি? শুনেছি পাগলরাই একই কথা বারবার লেখে। কারণ তাদের মাথায় একটি বাক্যই বারবার ঘুরপাক খায়।

বৃহস্পতিবার কিংবা বুধবার

আজ কত তারিখ আমি জানি না। বেশ কয়েক দিন ধরেই দিন-তারিখে গণ্ডগোল হচ্ছে। আজ কত তারিখ তা জানার কোনো রকম আগ্রহ বোধ করছি না। তবে মনের অবস্থা লেখার চেষ্টা করছি, যাতে পরবর্তী সময়ে কেউ আমার লেখা পড়ে বুঝবে যে মাথা খারাপ হবার সময় একজন মানুষ কীভাবে কী চিন্তা করে।

মাথা খারাপের প্রথম লক্ষণ হচ্ছে, আলো অসহ্য হওয়া। আমি এখন আলো সহ্য করতে পারি না। দিনের বেলায় দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখি। ঘর অন্ধকার বলেই প্রায় অনুমানের ওপর নির্ভর করে আজকের এই লেখা লিখছি। দ্বিতীয় লক্ষণ হচ্ছে, সারাক্ষণ শরীরে একধরনের জ্বালা অনুভব করা। মনে হয়, সব কাপড় খুলে বাথটবে শুয়ে থাকতে পারলে ভালো লাগত। আমার আগে যারা পাগল হয়েছে তাদেরও কি এমন হয়েছে? জানার জন্যে পাবলিক লাইব্রেরিতে টেলিফোন করেছিলাম। আমি খুব সহজভাবে বললাম, ‘আচ্ছা, আপনাদের এখানে পাগলের লেখা কোনো বই আছে?’

যে মেয়েটি টেলিফোন ধরেছিল সে বিস্মিত হয়ে বলল, ‘পাগলের লেখা বই বলতে কী বোঝাচ্ছেন?’

‘মানসিক রুগীদের লেখা বই?’

‘মানসিক রুগীরা বই লিখবে কেন?’

‘কেন লিখবে না? আমি তো লিখছি, বই অবশ্যি নয়—ডায়েরির আকারে লেখা।’

‘ও, আচ্ছা। ঠিক আছে, আপনার বই ছাপা হোক। ছাপা হবার পর অবশ্যই আমরা আপনার বইয়ের কপি সংগ্রহ করব।’

আমি মনে-মনে হাসলাম। মেয়েটি আমাকে উন্মাদ ভাবছে। ভাবুক। উন্মাদকে উন্মাদ ভাববে না তো কী ভাববে?

রাত দুটো দশ

আমার মা এই কিছুক্ষণ আগে টেলিফোন করলেন। দুপুররাতে তাঁর টেলিফোন করার বদঅভ্যাস আছে। আমার মা’র অনিদ্রা রোগ আছে। কাজেই তিনি মনে করেন পৃথিবীর সবাই অনিদ্রার রুগী। যাই হোক, আমি জেগে ছিলাম। মা বললেন, ‘জুডি, তুই আমার কাছে চলে আয়।’

আমি বললাম, ‘না, রাশেদকে ফেলে আমি যাব না।’

মা বললেন, ‘আমি তো শুনলাম ওকে নিয়েই তোর সমস্যা।’

‘ওকে নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই মা। I love him. I love him. I love him.’

‘চিৎকার করছিস কেন?’

‘চিৎকার করছি না। মা, টেলিফোন রাখি। কথা বলতে ভালো লাগছে না।’

আমি টেলিফোন নামিয়ে রাখলাম। রাশেদকে ফেলে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। আমার ধারণা, রাশেদ নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সেও এখন রাতে ঘুমায় না। গ্রুপ থিওরির যে-সমস্যাটি নিয়ে সে ভাবছিল, সেই সমস্যার সমাধান অন্য কে নাকি বের করে ফেলেছে। জার্নালে ছাপা হয়েছে। সে গত পরশু ঐ জার্নাল পেয়ে কুচিকুচি করে ছিড়েছে। শুধু তাই না—বারান্দার এক কোণায় বসে ছেলেমানুষের মতো কাঁদতে শুরু করেছে। আমি সান্ত্বনা দেবার জন্যে তার কাছে গিয়ে চমকে উঠলাম। সে কাঁদছে ঠিকই, কিন্তু তার বাঁ চোখ দিয়ে পানি পড়ছে, ডান চোখ শুকনো।

আমি তাকে কিছু বললাম না। কিন্তু সে আমার চাউনি থেকেই ব্যাপারটা বুঝে ফেলল। নিচু গলায় বলল, ‘জুডি, ইদানীং এই ব্যাপারটা হচ্ছে—মাঝে-মাঝেই দেখছি বাঁ চোখ দিয়ে পানি পড়ে।’

কথাগুলি বলার সময় তাকে এত অসহায় লাগছিল! আমার ইচ্ছা করছিল তাকে জড়িয়ে ধরে বলি—I love you. I love you. I love you.

হে ঈশ্বর! হে পরম করুণাময় ঈশ্বর! এই ভয়াবহ সমস্যা থেকে তুমি আমাদের দু’ জনকে উদ্ধার কর।

স্কেচবুকের প্রতিটি লেখা বারবার পড়ে মিসির আলি খুব বেশি তথ্য বের করতে পারলেন না, তবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যা জানা গেল তা হচ্ছে—মেয়েটি তার স্বামীকে ভালবাসে, যে-ভালবাসায় একধরনের সারল্য আছে।

স্কেচবুকে কিছু স্প্যানিশ ভাষায় লেখা কথাবার্তাও আছে। স্প্যানিশ ভাষা না-জানার কারণে তার অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব হল না। তবে এই লেখাগুলি যেভাবে সাজানো তাতে মনে হচ্ছে—কবিতা কিংবা গান হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মডার্ন ল্যাংগুয়েজ ইনস্টিটিউটে স্কেচবুক নিয়ে গেলেই ওরা পাঠোদ্ধারের ব্যবস্থা করে দেবে—তবে মিসির আলির মনে হল তার প্রয়োজন নেই। যা জানার তিনি জেনেছেন। এর বেশি কিছু জানার নেই।